পুনর্জন্ম (পর্ব -১)

পুনর্জন্ম (পর্ব -১)

‘আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন? ‘
‘চায়ের কাপটা ঠোঁটে তুলতে গিয়েও নামিয়ে ফেলল শখের গোয়েন্দা তারেক ফয়সাল। ‘কী জন্ম? ‘
কথা হচ্ছিল তারেক ফয়সালের স্টাডিরুমে।শখের গোয়েন্দা হলেও একটা ব্যাপার অন্যসব গোয়েন্দা থেকে তারেকের পার্থক্য তৈরী করে দিয়েছে। তারেক সাইকোলজির ছাত্র। অ্যাবনরমাল সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছে ও।সে কারণেই খুন কিংবা চুরির রহস্যের পাশাপাশি অদ্ভুত সব রহস্যের সমাধানও করে থাকে। বরং ব্যাখ্যাহীন এধরনের আধিভৌতিক রহস্যগুলোই বেশি করে টানে ওকে।তবে এখন যে সমস্যার কথাটা শুনছে সেটা কি ধরনের রহস্য তা এখনো পরিষ্কার না।
গতকাল রাতে সামনে বসা ভদ্রলোক ওকে ফোন করে বলে, তার স্ত্রীর নাকি কি সব সমস্যা আছে। ওর সাথে কথা বলতে চান। তারেক আজ সকালে আসতে বলে হাসানুজ্জামানকে।
মধ্যবয়সটাও পার করে এসেছেন হাসানুজ্জামান। পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে হবে তাঁর বয়স। সৌখিন এবং একইসঙ্গে ধনীও বটে ভদ্রলোক।
‘জী, পুনর্জন্ম।’

‘মানে হিন্দুরা যে বিশ্বাস করে মানুষ মারা গেলে তার আবার পুনর্জন্ম, আইমিন দ্বিতীয়বার জন্ম হয়, এমন কিছু? ‘

‘হ্যাঁ।আপনি বিশ্বাস করেন? ‘

‘না, করিনা। করার অবশ্য কোনো কারণও নেই।কেননা হিন্দুরা আরো বিশ্বাস করে আগের জন্মে কেউ ভাল কাজ করলে পরের জন্মে সে মানুষ হয়ে জন্ম নেবে।আর যদি সে খারাপ মানুষ হয় তাহলে পরের জন্মে সে নিম্নশ্রেণীর প্রাণী হয়ে জন্ম নেবে।এটা যদি সত্যিই হত তাহলে, কিছু মনে করবেন না, আপনার সামনে একটা বাঁদর টাইপ প্রাণী বসে থাকত এইমূহুর্তে! কারণ, আমার মনে হয়না আমি কোনো জন্মেই অত ভাল মানুষ ছিলাম। ‘

‘ব্যাপারটা কিন্তু সত্য। ‘থমথমে গলায় বললেন হাসানুজ্জামান।তারেকের রসিকতা তাঁর উপর কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি।’

‘এ ধারণা আপনার কি করে হল? ‘

‘কারণ আমার স্ত্রীর পুনর্জন্ম হয়েছে! ‘

তারেক অত্যন্ত বিষ্মিত হলেও সেটা প্রকাশ করল না। গোয়েন্দাদের কথায় কথায় বিস্মিত হলে চলেনা।শান্তভাব বজায় রেখে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং।’

‘আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হলেও আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে এই অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার দেখে।’

‘সেটাই তো স্বাভাবিক।তবে মি. হাসানুজ্জামান, একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করলেও আমার কাজ কিন্তু কাউন্সেলিং করা নয়।আমি শখের বশে গোয়েন্দাগিরি করি। আপনার স্ত্রীর পুনর্জন্মের ব্যাপারটা যদি স্কিজোফ্রেনিয়া ধরনের কোনো মানসিক রোগ হয় সেক্ষেত্রে আমার চাইতে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়াই আপনার জন্য ভাল হবে।
‘আমি জানি।’

‘বাই দ্য ওয়ে, আপনি আমার খবর পেলেন কার কাছ থেকে? ‘

‘অনুপ, অনুপ হায়দার।চিনতে পেরেছেন?ওর মরহুম বাবা আমার বাল্যবন্ধু ছিল। ‘

তারেকের মনে পড়ে গেল অনুপের কথা।কিছুদিন আগে অদ্ভুত এক রহস্য নিয়ে এসেছিল ছেলেটা ওর কাছে।নতুন বিয়ে করেছে বেচারা।কিন্তু বিয়ের দিনই বুঝতে পারে তার নতুন বউ আসলে একটা ডাইনি!

ও একা দেখলেও না হয় হ্যালুসিনেশন বলে উড়িয়ে দেয়া যেত কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ওদের বিশ্বস্ত ম্যানেজারও প্রতক্ষ্য করে এই রহস্যময় ঘটনা।
শেষপর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রহস্যটা সমাধান করে তারেক।এরপর থেকেই ভাল বন্ধু হয়ে যায় ওরা দুজন। প্রায়ই কথা হয় ওদের মাঝে। ‘হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।তিনদিন আগেও ওর সাথে কথা হয়েছে।তখন তো কিছু বলল না? ‘

‘আমি নিষেধ করেছিলাম।চাইনি জানাজানি হোক ব্যাপারটা। কিন্তু কাল. . .।আচ্ছা সব খুলেই বলি। ‘

‘হুমম্ সেটাই ভাল হবে।’

‘আমার স্ত্রীর জন্ম লন্ডনে।ওর বাবা বাঙ্গালী হলে মা ছিলেন ব্রিটিশ।ওখানেই জন্ম, পড়াশোনা, বড় হওয়া।
এবার আমার সম্পর্কে কিছু বলি। আমার জন্ম সিলেটে। পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনে চলে যাই।বোঝেনই তো আমাদের এলাকার রীতিই হয়ে গেছে এটা।লন্ডনে যেতে না পারলে জীবনটাই বৃথা।
নার্গিস, আইমিন আমার স্ত্রীর বাবা ছিলেন আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।আমার শশুড়ই আমাকে লন্ডনে নেয়ার ব্যাবস্থা করেন। তখন অবশ্য জানতাম না ইনিই একসময় আমার শ্বশুর হবেন।

যাইহোক, ওখানে একটা চাকরি করতাম।বছরে দুবছরে একবার দেশে আসতাম।
আমি লন্ডনে যাবার ছয় বছরের মাথায় বাবা মারা যান। মা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তখন জানতে পারি বাবা এবং আমার শশুর সাহেবের মধ্যে আগেই কথা পাকাপাকি ছিল, আমার আর নার্গিসের বিয়ে হবে।আমাদেরও কোনো আপত্তি ছিলনা।বিয়ে হয়ে যায় আমাদের।

বিয়ের পর দেশে আসা একেবারেই কমে যায় আমার।তবে দেশের কথা ভুলিনি কখনো।আমার পরিকল্পনা ছিল শেষ বয়সটা দেশেই কাটিয়ে দেব।বিদেশ কেন যেন আমার ধাতে ঠিক সইতো না। নার্গিস বিয়ের পর আমার সাথে দুবার দেশে এসে ওও বাংলার প্রেমে পড়ে যায়। আমার মত ওরও ইচ্ছে শেষ বয়সটা দেশে কাটানো। তবে বাদ সাধছিল নার্গিসের ব্রিটিশ মা।ভদ্রমহিলা কিছুতেই তার মেয়েকে এদেশে থাকতে দিতে রাজি না। থাকা তো দুরের কথা, নার্গিস আমার সাথে দেশে বেড়াতে আসুক সেটাও তিনি ভালো চোখে দেখতেন না। সেটা অবশ্য স্বাভাবিকই। বিদেশী মানুষ বাংলাদেশের ‘কুৎসিত ‘ রুপটা সম্পর্কেই জানে বেশি। তবে অবাক হতাম, আমার শশুড় পুরোদস্তুর বাঙালি হওয়া সত্বেও তিনিও চাইতেন না আমরা বাংলাদেশে আসি।যে কবার নার্গিসকে নিয়ে দেশে এসেছি প্রতিবারই তিনি প্রায় অনিচ্ছা সত্বে রাজি হয়েছিলেন।

‘আচ্ছা, আপনার শশুড়ের এমনিতে বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা ছিল কেমন? ‘প্রশ্ন করল তারেক।

‘বললাম না, পুরোদস্তুর বাঙালি ছিলেন তিনি।নার্গিসের সাথে কথা বললেই বুঝবেন মেয়েকে কতটা ভাল বাংলা শিখিয়েছেন তিনি। আপনি নার্গিসের কথা শুনলে বিশ্বাসই করবেন না ওর বাংলাদেশে বিচরণ মাত্র কয়েকটা দিনের।
তো যাই হোক, দুমাস আগে মাত্র একবছরের ব্যাবধানে আমার শাশুড়ি এবং শশুড় মারা যাবার পর আমরা ঠিক করি এবার আমাদের স্বপ্ন পূরণ করব।
লন্ডন থেকেই বাংলাদেশের একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মাধ্যমে একটা বাড়ি কিনি ধানমন্ডিতে।
‘কিছু মনে করবেন না, আপনাদের ছেলে মেয়ে? ‘

‘আমাদের কোনো সন্তান নেই।’

‘ওহ, সরি। ‘

‘ইটস ওকে।আমি আর নার্গিস মিলে ঠিক করেছিলাম দেশে এসে একটা বাচ্চা দত্তক নেব।’

‘এতদিন পর? ‘

‘আসলে এই ব্যাপারটা আমাদের মাথায় ওইভাবে আসেনি কখনো।তাছাড়া বিদেশী কোনো বাচ্চা দত্তক নেবার কোনো ইচ্ছেও আমাদের ছিলনা।যাইহোক, বাড়ি কেনা হল, ডেকোরেশনও আমরা লন্ডনে থাকতেই করিয়ে ফেলেছিলাম।এরপর দুসপ্তাহ আগে দেশে আসি আমরা। লন্ডনে এখনও আমার ব্যবসা আছে। ম্যানেজার চালাবে, আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসব। এমনটাই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দেশে আর থাকা হবেনা।’

‘আসলে ঠিক কি ঘটছে আপনার স্ত্রীর সাথে? ‘

‘ও ভয় পায়। ‘

‘ভয় পায়? ‘

‘হ্যাঁ, ওর ধারণা আমাদের বাড়ির পেছনের খালি জায়গাটাতে একটা লাশ পোঁতা আছে। অপঘাতে মারা গেছে ওই মৃত লোকটা।তারই অতৃপ্ত আত্মা ভয় দেখাচ্ছে ওকে।’

‘এ থেকে আপনার ধারণা হল, গতজন্মে সত্যি সত্যিই এমন কিছু ঘটেছিল? ওখানে আসলেই কোনো লাশ শুয়ে আছে? ‘

‘হ্যাঁ। ‘

‘খুব সহজ সমাধান আছে এই সমস্যার।লাশ পচে গেলেও যেহেতু হাড় গোড় বহু বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে সেহেতু আপনি ওই জায়গাটা খুড়ে দেখাতে পারেন আপনার স্ত্রীকে।তিনি যখন দেখবেন জায়গাটা খালি, তখন তার বিভ্রম কেটে যাবে। অহেতুক ভয় থেকে মুক্তি পাবেন। ‘

‘জায়গাটা খালি নয়। ‘

‘মানে! ‘

‘মানে, জায়গাটা গতকাল লোক ডাকিয়ে খুড়ে দেখেছি আমি।অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, ওখানে সত্যি সত্যিই একজন মানুষের বহু পুরোনো কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে! ‘

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

পুনর্জন্ম (পর্ব -১)
পুনর্জন্ম (পর্ব -2)
পুনর্জন্ম (পর্ব -3)
পুনর্জন্ম (পর্ব -4 শেষ পর্ব)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত