০১
হুট করেই একদিন সে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিল,বসে ছিল চুপচাপ।
আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।
কে?.. কে?..এত রাতে বলা নেই কওয়া নেই, আমার ঘরে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে আছে, এ কে? কেন? কী চায়?
মনে হল, মেয়েটাই ভয় পাচ্ছে।
একটা চেয়ারে বসে ছিল, কুঁকড়ে গেলো বসে থেকেই।
তেলাপোকা যদি বোঝে যে, ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে সে যতটা ভয় পাচ্ছে,
ছোট্ট মেয়েটা তেলাপোকা দেখে তার
চেয়েও বেশী ভয় পাচ্ছে, তখন সে একটু
উড়াল দেয় বৈকি! কাজেই মেয়েটি খুব
ধীরে ধীরে নড়াচড়া করলো।
বড় বড় চোখ দুটো মেলে বেশ আবদারের সুরে বলল, আমাকে এখানে ক’দিন থাকতে দেবেন?
আমি কোন অসুবিধা করবো না।
যেন এভাবে চেয়ে নেয়ার অধিকার সে রাখে।
আমি মাথা চুলকে ভাবলাম, বেশীক্ষণ
নয়! তারপর বললাম, কিন্তু … …
মেয়েটা তখনো চোখ গোল গোল করে চেয়ে আছে।
আক্কেলগুড়ুম হবার দশা।
কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।
সর্বনাশ হবে।
ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।
প্রথমেই মনে হল, এই মেয়েটা “তাদের” কেউ নয় তো?
যারা বায়ুচর হয়ে ঘুরে বেড়ায়?
নইলে সিঁড়ি, সদর দরজা – সব পেরিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল কী করে?
জানালা দিয়ে ঢোকে নি নিশ্চয়ই,
অথবা তাদের দরজা-জানালার দরকার
হয় না।
সিলিঙ কিংবা দেয়াল ফুটো করেই … …
কৌতূহল নিয়েই এগিয়ে গেলাম।
ছুঁয়ে দেখলাম।
মেয়েটা ভারী সংকোচে পড়ে গেলো যেন,
লাজুক হেসে হাতটা সরিয়ে নিলো।
আমি পড়ে গেলাম আরও ধন্দে।
না,মেয়েটার হাতের মধ্য দিয়ে আমার হাত
চলে যায় নি, বাধা পেয়েছে।
মেয়েটাকে ছোঁয়া যায়।
অর্থাৎ, সে “তাদের” কেউ নয়, সে মানবী।
রক্তমাংসের মানুষ।
কিন্তু কে?
কোথা থেকে এসেছে?
আমার কাছেই বা কেন?
কল্পনা নয় তো?
খুব শক্তিশালী কল্পনা?
বয়সের দোষ?
এই বয়সে কত উল্টোপাল্টা চিন্তা আসে, তারই একটা নয়তো মেয়েটা?
কিন্তু তা কী করে হয়?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি?
কোথা থেকে এসেছেন?
শিখিয়ে দেয়া বুলির মতই আবার সে বলল, আমাকে এখানে ক’টা দিন থাকতে দেবেন?
আমি কোন অসুবিধা করবো না।
বড় যন্ত্রণা! ইচ্ছে হল একবার ঘাড়
ধরে বার করে দিই।
কিন্তু তা কী করে করা চলে?
এক তরুণী এসে ভারী বিনয়ের সাথে বলছে ক ’টা দিন থাকতে দিতে।
চেহারা ছবিও সুন্দর … …
হুঁ, পুরুষমানুষ মাত্রই বোধহয় এভাবে ভাবে!
কাজেই যদিও জানা হল না সে কে,
জানা হল না তার নাম, জানা হল
না মেয়েটা কোথা থেকে উদয় হল,
তারপরও রাত্তিরে দেখা গেলো,
সে আমার বিছানা দখল করে ঘুমোচ্ছে,
আর আমি ঘুমোচ্ছি মাটিতে।
ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়। স্বপ্নের শেষ
হবে নিশ্চয়ই, কাল সকালে সূর্যোদয়ের
আগেই। দেখবো, বিছানা খালি,
মেয়েটি মিলিয়ে গেছে বাতাসে।
০২
এই, উঠুন! আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে তো!
আমি চোখ মেলে একটা বিকট চিৎকার
করতে গিয়ে সামলে নিলাম।
মেয়েটা মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ডাকাডাকি করছে।
কাঁধে ব্যথা নিয়ে উঠে বসি আমি।
শক্ত মেঝেতে শুয়ে অভ্যেস নেই তো।
মেয়েটা দূরে সরে যায়।
আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, সে জানলো কী করে?
ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই অবশ্য
বুঝতে পারি। আমি কেন, যে কেউ
বুঝতে পারবে। বাজছে পৌনে আটটা।
দাঁত ব্রাশ করতে করতে ভাবলাম,
মেয়েটার সম্পর্কে আরও কিছু জানা দরকার। খুব সাবধানে। তারপর,
কেলেঙ্কারি হবার আগেই একে বিদেয় করা দরকার। কে কবে কী শুনে ফেলে,
দেখে ফেলে – তারপর পাঁচকান করে ফেলে, আমার “ভালো ছেলে ” তকমার বারোটা বাজিয়ে … … আমি কোনদিন গার্লস স্কুল কিংবা কলেজের ধার দিয়ে হাঁটি নি, কাজেই আমার ঘরে একটা অপরিচিতা মেয়েকে জাঁকিয়ে বসে থাকতে দেখে সবাই কী ভাববে, খুব অনুমান করতে পারি। পাবলিক!
কাজেই মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে আবার
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে বলুন তো?
আবারো গোল গোল চোখ করে বলল মেয়েটা, আমি ক ’টা দিন এখানে থাকি?
আপনার কোন অসুবিধে করবো না।
আমার ইচ্ছে হল মেয়েটার মাথায়
একটা ঠোকা দিই। নিশ্চয়ই ভাঙা ক্যাসেট প্লেয়ার জাতীয় কিছু একটা ওর মাথায় কেউ লাগিয়ে গিয়েছে।
মা উঁকি দিলেন আমার রুমে। সর্বনাশ,
আমার দরজা ভেজানো ছিল,
ছিটকিনি লাগাই নি! রাতে কেউ ঢুকে পড়লে কী হত? বরফের মত জমে গেলাম আমি,
লাফিয়ে গিয়ে দরজা আটকাতে চাইলাম,
কিন্তু ততক্ষণে মা বিশাল বপু নিয়ে থপ থপ করে ঢুকে পড়েছেন। বললেন, বাহ, আজ দেখি এত আগেই উঠে পড়েছিস,
ঘুমুতে ঘুমুতে আর ঘুমুতে পারছিস না?
আমি বোকার মত দাঁত বার করে হাসলাম।
আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি,
এবং আমি চপেটাঘাতের অপেক্ষা করছি।
যে চপেটাঘাতে একটা ভোঁতা আওয়াজ হয়!
কিন্তু কি আশ্চর্য, খেতে আয়,
বলে নেমে গেলেন মা।
আমি হাঁপ ছাড়লাম, কিন্তু এটা কী হল?
পেছন ঘুরে দেখলাম, মেয়েটা এখনো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ওকে নিশ্চয়ই দেখেছেন মা, তারপরও রা কাড়লেন
না কেন?
নাকি … …
হ্যাঁ, নাকি আমি ছাড়া ওকে আর কেউ দেখতে পায় না? ভারী মজার ব্যাপার তো!
বাসা থেকে বার হবার আগে সে বলল, সাবধানে যাবেন।
আমার আক্কেলগুড়ুম হল, আরেকবার। এই মেয়েটা সারাদিন আমার ঘরে বসে থাকবে, একা একা?
কী করবে সারাদিন? আবার ঠিক হুকুমের সুরে বলছে, সাবধানে যাবেন..
০৩
বললে বিশ্বাস করবেন? বেশ ক ’দিন হয়ে গেছে, মেয়েটা এখনো আমার ঘরেই আছে। চলে যায় নি। হয়তো তার “ক ’টা দিন ” এখনো শেষ হয় নি। আমিও চলে যেতে বলি নি। অথচ এর মত বেখাপ্পা ব্যাপার আর কী আছে?
চলে যেতে বলি নি কেন?
বলি নি, কারণ
হয়তো চলে যেতে বলতে সংকোচ হয়েছে।
একটা মেয়েকে হুট করে চলে যেতে বলা যায়?!
বলি নি, কারণ হয়তো আমার বেশ লাগছে!
একটা গোপন সংসারের মত। আশ্চর্য একটা সঙ্গিনী, কাউকে দেখাতে পারবো না।
হয়তো কৌতূহল আছে আমার।
হয়তো খানিকটা ভালো লেগেছে,
মেয়ে বলেই হয়তো!
তাছাড়া মেয়েটা দেখতে বেশ মিষ্টি,
চোখ দুটো গোল গোল করে যখন তাকায়,
তখন আদুরে ভাব ফুটে ওঠে মুখটিতে!
কিংবা হয়তো এখন আর আমার অ্যালার্ম
ক্লকের দরকার হচ্ছে না, সকাল হলে আমাকে সে নিয়ম করে তুলে দেয়।
কিংবা হয়তো আমি ভারী একা, বন্ধুবান্ধব নেই, সবসময় চোখের সামনে একজনকে ঘুরেফিরে বেড়াতে দেখে ভালোই লাগে!
একই জায়গায় তো মানুষ বসে থাকে না, খানিকটা হলেও এগোয়। আমরাও এগিয়েছিলাম। আপনি থেকে এখন তুমি করেই ডাকি। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যাকে বলে। অস্বীকার করবো না, খানিকটা নির্ভরশীল হয়েও পড়েছিলাম। মায়া জন্মেছিল কি খানিকটা? হয়তো।
এমনকি এটাও মনে হচ্ছিল, একে আমার কাছেই রেখে দেয়া দরকার। হুট করে চলে গেলে কষ্ট পাবো।
ঘরে অনেকটা সময় কাটাতাম।
মেয়েটা উৎপাত করত না। ঘরেই হেঁটে বেড়াত, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াত, কখনো চুপচাপ পাশে বসে থাকতো।
চোখাচোখি হলে মৃদু হাসত, কিছু বলত না। কাউকে বলবেন না যেন, একবার ইচ্ছে হয়েছিল, তুলতুলে গাল দুটো টেনে দিই!
বারদুয়েক আমার সাথে বাইরে বেড়াতেও সে গেছে। তেমনি চোখ দুটো গোল গোল করে বলেছে, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে?
আমি মানা করতে পারি নি।
পার্কে নিয়ে গেছি, বিকেলে লেকের পাড়ে বসে থেকেছি।
না, হাত ধরাধরি করে বসে থাকি নি।
অতটা অন্তরঙ্গতা হয় নি। একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে থাকতে চাই নি।
দরকারও ছিল না। সে তো আমার বান্ধবী নয়, প্রেমিকা নয়, মনের মানুষ- টানুষ নয়। কোথাকার কে, শুধু ক’দিনের
জন্য থাকতে এসেছে!
ভারী আশ্চর্য, ভারী রহস্যময় এক সময় কাটছিল আমার।
তারপর একদিন … …
হ্যাঁ, যা ভাবছেন তাই। এক সকালে কেউ আমার ঘুম ভাঙাল না। আমি দেখি, বিছানা শূন্য। আমি পুরো ঘরে একা, নিচে শুয়ে আছি।
যে হুট করে এসেছিল, হুট করেই চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার তো কষ্ট পাওয়া উচিৎ নয়।
তারপরও মিষ্টি চেহারার আদুরে মেয়েটার জন্য এখনো খানিকটা কষ্ট হয়। না হয় জানা হয় নি সে কে। না হয় জানা হয়
নি কোন জগতে তার বাস ছিল। জানা হয় নি কোথায় সে গেছে, কোথায় থাকে।
তারপরও কষ্ট হয়। হয়তো ক’টা রহস্যময় দিন উপহার দিয়ে গেছে বলেই।
হয়তো ক’টা দিন ঘোরের মধ্যে ছিলাম বলেই।
ঘোর? তাই হবে। হয়তো পুরোটাই আমার কল্পনা ছিল। একাকীত্ব থেকে মানুষ সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনী কল্পনা করে নেয়,
তাই হয়তো হয়েছিল আমার। তারপর আবার সেটা আপনাআপনিই সেরে গেছে।
খুব বেশী রাগও করতে পারি না মীয়তার ওপর। যাকে কোন নাম দেয়া হয় নি, “এই এই ” করেই ডেকে পার করেছি দিনগুলো,
যাকে এক-আধবারের বেশী ছুঁয়ে দেখি নি,
যে আসলে কে বা কী ছিল তা-ই জানি না,
তার ওপর আবার রাগ কীসের?
আগে না ভালোবাসা আসে, তারপর আসে অভিমান,
আমি এবং আমরা তো ছিলাম তার থেকে অনেক দূরে, অনেক পেছনে!
হ্যাঁ, সন্দেহজনক অনেক কিছু হয়ে যেতে পারতো। যুগটা বড় সন্দেহজনক। অথচ কিছুই হয় নি। ভাব-
ভালোবাসা নয়, অনুরাগ-বিরাগ নয়।
কিছুই নয়। শুধু বড় বড় চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে।
আর মনে পড়ে সেদিন সকালের কথা।
ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে সমস্ত দিন কাটাবার কথা। বাস্তবে কেমন জানি না, তবে গল্পের নায়িকারা নিয়ম করে ঘুম ভাঙালেও যেদিন গল্পের নায়ক ইচ্ছে করে চোখ বুজে পড়ে থাকে কারো ঘুম ভাঙাবার,
সেদিন সকালেই নায়িকা উধাও হয়ে যায়, পালিয়ে যায়! আশ্চর্য নিয়ম, যার কোন বাত্যয় নেই।
দিনটা স্বাভাবিক কেটেছিল, তারপরের দিনগুলোও। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাটা সহজ নয়, তারপরও আমি পারলাম। হয়তো খুব বেশী কষ্ট পাই নি, তাই।
ভালো আছে তো আমার রহস্যময়ী! তার কোন অস্তিত্ব তো ছিল না কারো কাছে, শুধু আমার কাছে ছিল। কী করা উচিৎ
আমার? সবসময় তার জন্য মন খারাপ করে থাকা উচিৎ? কাউকে জিজ্ঞেস করে নেয়া উচিৎ, আমি এখন কী করবো।
তবে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, আমাকে সে পাগল ভাববে না।