প্রায় আট বছর পর নাসরিনের বড় ভাই আলাউদ্দিন দেশে ফিরল। সঙ্গে বিদেশি বউ। বউয়ের নাম ক্লারা। বউয়ের চুল সোনালি, চোখ ঘন নীল, মুখটাও মায়া-মায়া। তবু মেয়েটাকে কারোই পছন্দ হলো না।
যে-পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে নাসরিন বড় ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল, ভাইকে দেখে সে ঠিক ততখানি নিরাশ হলো। আট বছর আগে নাসরিনের বয়স ছিল নয়, এখন সতেরো। নবছর বয়েসী চোখ এবং সতেরো বছর বয়েসী চোখ একরকম নয়। নবছর বয়েসী চোখ সবকিছুই কৌতূহল এবং মমতা দিয়ে দেখে। সতেরো বছরের চোখ বিচার করতে চেষ্টা করে। তার বিচারে ভাই এবং ভাইয়ের বউ দুজনকেই খারাপ লাগছে।
নাসরিন দেখল তার ভাই আগের মতো চুপচাপ শান্ত ধরনের ছেলে নয়— খুব হইচই করা শিখেছে। স্ত্রীকে নিয়ে সবার সামনে বেশ আহ্লাদ করছে। ঠোট গোল করে হানি ডাকছে। অথচ হানি শব্দটা বলার সময় ঠোট গোল হয় না।
আলাউদ্দিন এতদিন পর দেশে আসছে, আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে উপহার-টুপহার আনা উচিত ছিল, তেমন কিছুই আনেনি। ভুসভুসা অ্যাশ কালারের একটা সোয়েটার এনেছে মার জন্যে। সেই সোয়েটার নিয়ে কতরকম আদিখ্যেতা–পিওর উল মা। পিওর উল আজকাল আমেরিকাতেও এক্সপেনসিভ। মা তোমার কি কালার পছন্দ হয়েছে?
নাসরিনের একবার বলার ইচ্ছা হলো— অ্যাশ কালারের পছন্দের কী আছে ভাইয়া?
সে অবিশ্যি কিছু বলল না। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এতদিন পর আসছে। ভাইয়ার কি উচিত ছিল না মার জন্যে একটা ভালো কিছু আনা?
বাবার জন্যে এনেছে ক্যালকুলেটর। যে-বাবা রিটায়ার করেছে, চোখে দেখতে পায় না, সে ক্যালকুলেটর দিয়ে কী করবে?
নাসরিনের বড় বোন শারমিন তার দুই যমজ মেয়েকে নিয়ে সুটকেস খোলার সময় বসে ছিল। এই দু-মেয়েকে আলাউদ্দিন দেখেনি। চিঠি লিখে জানিয়েছে এই দু-মেয়ের জন্যে একই রকম দুটো জিনিস নিয়ে আসবে যা দেখে দুজনই মুগ্ধ হবে। দুজনের জন্যে দুটো গায়েমাখা সাবান বেরুল। এই সাবান ঢাকার নিউ মার্কেট ভরতি, আমেরিকা থেকে বয়ে আনতে হয় না।
আলাউদ্দিন বলল, বেশি কিছু আনতে পারিনি বুঝলি। লাস্ট মোমেন্টে ক্লারা ডিসাইড করল আমার সঙ্গে আসবে। অনেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেল। কিছু টাকা সঙ্গেও রাখতে হয়েছে। ঢাকায় হোটেলের বিল কেমন কে জানে!
নাসরিন বলল, হোটেলের বিল মানে? তুমি কি হোটেলে উঠবে?
বাধ্য হয়ে উঠতে হবে। এই গাদাগাদি ভিড়ে ক্লারার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চট করে তো সব অভ্যাস হয় না। আস্তে আস্তে হয়। তোরা আবার এটাকে কোন ইস্যু বানিয়ে বসবি না। তোদের কাজই তো হচ্ছে। সামান্য ব্যাপারটাকে কোনোমতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ইস্যুতে নিয়ে যাওয়া।
নাসরিনের চোখে পানি এসে গেল। তার আপন বড় ভাই তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। নাসরিনের চোখের পানি অবিশ্যি কেউ দেখতে পেল না। একটু আসছি ভাইয়া বলেই সে চট করে উঠে গেল। বাথরুমে কিছুক্ষণ কাটিয়ে চোখ মুছে উপস্থিত হলো। আলাউদ্দিন তখন সুটকেস খুলে আরো কীসব উপহার বের করছে। অতি তুচ্ছ সব জিনিস— গাড়ির পেছনে লাগানোের স্টিকার, যেখানে লেখা Hug Your Kids। তাদের গাড়ি কোথায় যে তারা গাড়ির পেছনে স্টিকার লাগাবে? কেউ অবিশ্যি কিছু বলল না। সবাই এমন ভাব করতে লাগল যে গাড়ির স্টিকারটার খুব প্রয়েজন ছিল।
আলাউদ্দিন বলল, নাসরিন তোর জন্যে তো কিছু আনা হয়নি।
নাসরিন বলল, ভাইয়া আমার কিছু লাগবে না।
তোকে বরং এখান থেকেই শাড়ি-টাড়ি কিছু কিনে দেব।
আচ্ছা।
আলাউদ্দিন সুটকেস ঘাঁটতে লাগল। তার ঘাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে আশা করছে কিছু একটা পেয়ে যাবে যা নাসরিনকে দিতে পারলে শাড়ির ঝামেলায় যেতে হবে না। নাসরিনের লজ্জার সীমা রইল না।
এই যে জিনিস পাওয়া গেছে।
হাসিতে আলাউদ্দিনের মুখ ভরে গেল। সবাই ঝুঁকে পড়ল সুটকেসের ওপর। লিপস্টিকের মতো একটা বস্তু বেরুক্ল। আলাউদ্দিন বলল–নাসরিন নে। এর নাম লিপ গ্লস। ঠোটে দিলে ঠোট চকচক করে, ঠোঁট ফাটে না।
নাসরিন শুকনো গলায় বলল, থ্যাংকস ভাইয়া।
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল— গিফট হচ্ছে গিফট। গিফটের মধ্যে সস্তা দামি কোনো ব্যাপার না। বাঙালিদের স্বভাব হচ্ছে কোনো উপহার পেলেই হিসাব-নিকাশে বসে যাবে। দাম কত, কী!
নাসরিন বলল, আমি কোনো হিসাব-নিকাশ করছি না ভাইয়া। লিপ গ্লসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
দ্যাটস গুড। মাই গড–-নাসরিন তোর ভাগ্য ভালো আরেকটা জিনিস পাওয়া গেছে–ওইজা বোর্ড। এতক্ষণ চোখেই পড়েনি।
ওইজা বোর্ড আবার কী?
আলাউদ্দিন লুডু বোর্ডের মতো একটা বোর্ড মেলে ধরল। চারদিকে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখা— মাঝখানে দুটা ঘর— একটায় লেখা ইয়েস একটায় নো।
এটা কি কোনো খেলা ভাইয়া?
খেলাই বলতে পারিস। ভূত নামানোর খেলা। প্ল্যানচেটের নাম শুনিসনি? এটা দিয়ে প্ল্যানচেটের মতো করা যায়।
কীভাবে?
লাল বোতামটা দেখছিস না? দুজন বা তিনজন মিলে খুব হালকাভাবে তর্জনী দিয়ে এটাকে টাচ করে রাখবি, কোনোরকম প্রেশার দেয়া যাবে না। বোতামটাকে রাখবি বোর্ডের ঠিক মাঝখানে। ঘরের আলো কমিয়ে দিবি আর মনে-মনে বলবি If any good soul passes by, please come. তখন আত্মাটা বোতামে চলে আসবে। বোম নড়তে থাকবে। তখন কোনো প্রশ্ন করলে আত্মা জবাব দেবে।
কীভাবে জবাব দেবে?
বোতামটা অক্ষরগুলির উপর যাবে। কোন কোন অক্ষরের উপর যাবে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। ভূতটার নাম যদি হয় রহিম তা হলে প্রথমে যাবে আর-এর উপর, তারপর এ-এর উপর, তারপর এইচ— বুঝতে পারছিস?
বোতামটা আপনাআপনি যাবে?
না, আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে রাখতে হবে।
ভাইয়া ভূত কি সত্যি সত্যি আসে?
আরে দূর দূর। ভূত আছে নাকি যে আসবে! আমেরিকানদের এটা হচ্ছে পয়সা বানানোর একটা ফন্দি। এত সহজে আত্মা চলে এলে তো কাজই হতো!
আলাউদ্দিন আমেরিকানদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে মজার মজার গল্প করতে লাগল। আলাউদ্দিনের মা রাহেলার মনে ক্ষীণ আশা–গল্প যেভাবে জমেছে তাতে মনে হয় না ছেলে বউকে নিয়ে হোটেলে যাবে। যদি সত্যি সত্যি যায় তা হলে তিনি মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। এমনিতেই বিদেশী বউয়ের কথায় অনেকেই হাসাহাসি করছে। জামশেদ সাহেবের স্ত্রী গত সপ্তাহে এসে সরু গলায় বললেন–বাঙালি ছেলেরা যে বিদেশে গিয়েই বিদেশিনী বিয়ে করে ফেলে ঐসব বিদেশিনীগুলি নিচু জাতের। ঝি, জমাদারনি এইসব। ভদ্রলোকের মেয়েরা বাঙালি বিয়ে করতে যাবে কেন? ওদের গরজটা কী?
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, আপনাকে কে বলেছে?
বলবে আবার কে? এ তো সবাই জানে। বাঙালি ছেলেগুলির সাদা চামড়া দেখে আর হুশ থাকে না। ওরা তো প্রথম প্রথম জানে না যে ঐ দেশের ঝিয়ের চামড়াও সাদা, আবার মেথরানির চামড়াও সাদা।
রাহেলা এইসব কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি। শুধু শুনে গেছেন। এখন যদি ছেলে বউ নিয়ে হোটেলে চলে যায় তা হলে কী হবে? সবাই তো গায়ে থুথু দেবে।
অবিশ্যি তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ছেলে এবং ছেলের বউয়ের জন্যে একটা ঘর ভালোমতো সাজাতে। নাসরিনের ঘরটাই সাজাতে হয়েছে। দেয়ালে চুনকাম করা হয়েছে। টিউবলাইট লাগানো হয়েছে। একটা ফ্যান ঘরে আছে। সেই ফ্যান ঘটাং ঘটাং শব্দ হয় বলে নতুন একটা সিলিং ফ্যান কেনা হয়েছে। তারপরেও যদি ছেলে বউ নিয়ে হোটেলে ওঠে তিনি কী আর করবেন? তার আর কী করার আছে?
রাতের খাওয়া শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন বলল, আমরা তাহলে উঠি মা।
রাহেলা ক্ষীণ গলায় বললেন, কোথায় যাবি?
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় যাবি বলছ কেন মা? আগেভাগে তো বলেই রেখেছি একটা ভালো হোটেলে উঠতে হবে। ক্লারা গতরাতে এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। বেচারি গরমে সেদ্ধ হয়ে গেছে। বাতাস নেই এক ফোঁটা।
ফ্যান তো আছে।
বাতাস গরম হয়ে গেলে ফ্যানে লাভ কী? তোমরা গরম দেশের মানুষ ওর কষ্টটা কী বুঝবে? আমি নিজেই সহ্য করতে পারছিলাম না, আর ও…
বউকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে উঠলে লোকে নানান কথা বলবে।
আলাউদ্দিন এই কথায় রাগে জ্বলতে লাগল। হড়বড় করে এমন কথা বলতে লাগল যার তেমন কোনো অর্থ নেই।
তার বাবা মনসুর সাহেব যিনি কখনোই কিছু বলেন না তিনি শেষ পর্যন্ত বলে ফেললেন— তুই খামাকা চিৎকার করছিস কেন?
আমি খামাখা চিৎকার করছি? আমি খামাখা চিৎকার করছি? আমি শুধু বলছি লোকজনের কথা নিয়ে তোমরা নাচানাচি কর কেন? তোমরা যদি না খেয়ে মর লোকজন এসে তোমাদের খাওয়াবে? প্রতি মাসে দেড়শো ডলারের যে মানি অর্ডারটা পাও সেটা কি লোজন দেয়? বলো দেয় লোকজন?
মনসুর সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, যা যেখানে যেতে চাস। আলাউদ্দিন তিক্ত গলায় বলল, তোমরা যে ভাবছো ছেলে ঘর ছেড়ে হোটেলে চলে যাচ্ছে, কাজেই ছেলে পর হয়ে গেল–এটা ঠিক না।
আমরা কিছু ভাবছি না। তুই আর ভ্যাজভ্যাজ করিস না। মাথা ধরিয়ে দিয়েছিস।
মাথা ধরিয়ে দিয়েছি? আমি মাথা ধরিয়ে দিয়েছি?
আট বছর পর ফিরে আসা পুত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় রাতেই বাড়ির সদস্যদের খণ্ড প্রলয়ের মতো হয়ে গেল। নাসরিন মনে-মনে বলল, বেশ হয়েছে। খুব মজা হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি।
ক্লারা ঝগড়ার ব্যাপারটা কিছুই বুঝল না। একবার শুধু ভ্রু কুঁচকে বলল, তোমরা এত চেঁচিয়ে কথা বলো কেনো? বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে বসার ঘরে টিকটিকি দেখতে গেল। বাংলাদেশের এই ছোট্ট প্রাণী তার হৃদয় হরণ করেছে। সে টিকটিকির একুশটা ছবি এ পর্যন্ত তুলেছে। ম্যাকরো লেন্স আনা হয়নি বলে খুব আফসোসও করছে। ম্যাকরো লেন্সটা থাকলে ক্লোজআপ নেয়া যেত।
খুব সঙ্গত কারণেই গভীর রাত পর্যন্ত এ পরিবারের কোনো সদস্য ঘুমুতে পারল না। বারান্দায় বসে রাহেলা ক্রমাগত অবর্ষণ করতে লাগলেন। একসময় মনসুর সাহেব বললেন, আর কেঁদো না, চোখে ঘা হয়ে যাবে। তোমার ছেলের আশা ছেড়ে দাও। বিদেশী পেতনি বিয়ে করে ধরাকে সরা দেখছে। হারামজাদা।
নাসরিন আজ ওর ঘরে ঘুমুতে পারছে।
ঘরে ঢুকে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আগ্রহ করে তারা সবাই মিলে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে তবু ভাইয়ার পছন্দ হলো না। এই ঘরটা কি হোটেলের চেয়ে কম সুন্দর হয়েছে! মাথার পাশে টেবিল-ল্যাম্প। পায়ের দিকের দেয়ালে সূর্যাস্তের ছবি। খাটের পাশে মেরুন রঙের বেডসাইড কার্পেট। জানালা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে খুব একটা গরম কি লাগে? কই, তার তো লাগছে না! তার তো উলটো কেমন শীত-শীত লাগছে।
সে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালাল। এত বড় খাটে একা ঘুমুতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ভাইয়া থাকবে না জানলে বড় আপাকে জোর করে রেখে দিত। নাসরিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আজ রাতটা তাদের জন্যে খুব খারাপ রাত। আজ রাতে তাদের কারোরই ঘুম হবে না। একা একা জেগে থাকা খুব কষ্টের।
ভূত নামালে কেমন হয়? ওইজা বোর্ড খুলে সে যদি বোতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকে তা হলে কি কিছু হবে? যদি কোনো আত্মা চলে আসে ভালোই হয়। আত্মার সঙ্গে গল্প করা যাবে। মুশকিল হচ্ছে এই আত্মাগুলি আবার কথা বলে না। বোম ঠেলে ঠেলে মনের ভাব প্রকাশ করে।
নাসরিন দরজা বন্ধ করে ওইজা বোর্ড নিয়ে বসল। তর্জনী দিয়ে বোতামটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে নরম গলায় বলল, আমার আশপাশে যদি কোনো বিদেহী আত্মা থাকেন তা হলে তাঁদের মধ্যে একজন কি দয়া করে আসবেন? যদি আসেন তা হলে আমার মনটা একটু ভালো হবে। কারণ আজ আমার মনটা খুব খারাপ। কেন খারাপ তা তো আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। পুরো ঘটনার সময় নিশ্চয়ই আপনারা আশপাশে ছিলেন। ছিলেন না? এই পর্যন্ত বলেই নাসরিন চমকে উঠল। ডান হাতটা একটু যেন কাঁপছে।
বোতামটা কি নড়তে শুরু করেছে? অসম্ভব, হতেই পারে না। এ কী, বোতামটা এগিয়ে গেল কীভাবে? নাসরিন নিজেই হয়তো নিজের অজান্তে বোতাম ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেছে। খানিকটা ভয় এবং খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে নাসরিন অপেক্ষা করছে। হচ্ছেটা কী?
বোতাম ইয়েস লেখা ঘরে কিছুক্ষণ থেমে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। নাসরিন শব্দ করেই বলল, বাহ বেশ মজা তো! পরবর্তী কিছুক্ষণ ইয়েস এবং নাতে বোম ঘুরতে লাগল। নাসরিনের শুরুর
ভয় খানিকটা কমে গেল। যদিও তখনও বুক ধক ধক করছে।
ওইজা বোর্ডে ইয়েস এবং না ছাড়া আরো দুটি ঘর আছে সেগুলি হচ্ছে–আমি উত্তর দেব না, আমি জানি না। বোতামটা এইসব ঘরেও মাঝে মাঝে এল। প্রশ্ন এবং উত্তর এইভাবে সাজানো যায়
আপনি কি এসেছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন?
না।
আপনি কোথায় থাকেন?
আমি উত্তর দেব না।
আজ আমাদের সবার খুব মন-খারাপ সেটা কি আপনি জানেন?
না।
কীজন্যে আমাদের মন খারাপ সেটা কি বলব?
না।
শুধু না-না করছেন কেন? একটু শুনলে কী হয়? বলি?
হ্যাঁ।
তার আগে বলুন আপনার নাম কী?
বোতামটা ঘুরতে ঘুরতে এক্স ঘরে গিয়ে থামল। নাসরিন বলল, এক্স দিয়ে বুঝি কারোর নাম হয়? ঠিক করে নাম বলুন।
আমি জানি না।
আপনি জানেন না মানে? আপনার কি নাম নেই?
না।
ভূতদের নাম থাকে না?
আমি জানি না।
সে কী, আমার তো ধারণা প্রেতাত্মারা সব জানে। আর আমি আপনাকে যাই জিজ্ঞেস করছি— আপনি বলছেন আমি জানি না। আচ্ছা বলুন তো উনিশকে তিন দিয়ে গুণ দিলে কত হয়?
আমি জানি না।
আমি জানি না।
তবে আপনি যদি বলতেন তা হলে গুণ করে বের করতাম। আপনি কি গুণ অংক জানেন?
হ্যাঁ। আচ্ছা আত্মাদের কি অংক করতে হয়?
বোতাম এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল। উত্তর দিল না। নাসরিন বলল, আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?
হ্যাঁ।
প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না। কেউ আমার সাথে রাগ করলে আমার খুব মন-খারাপ থাকে। এমনিতেই আজ আমার খুব মন-খারাপ। আপনি কি জানেন আমার যে মন-খারাপ?
হ্যাঁ।
কেন মন-খারাপ সেই ঘটনাটা বলি? বলব?
হ্যাঁ।
নাসরিন আজ সারাদিনের ঘটনা বলতে শুরু করল। বলতে বলতে দুবার কেঁদে ফেলল। তার কাছে একবারও মনে হলো না সে হাস্যকর একটা কাণ্ড করছে। এইসব গল্প বোতামটাকে বলার কোনো মানে আছে?
নাসরিন ঘুমুতে গেল রাত তিনটায়। খুব চমৎকার ঘুম হলো। ঘুমিয়ে এত তৃপ্তি অনেকদিন সে পায়নি। তবে ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণই মনে হলো একজন বুড়োমানুষ তার গায়ে হাত রেখে শুয়ে আছেন। বুড়োমানুষটার শরীরে চুরুটের কড়া গন্ধ।
ভোর সাতটায় আলাউদ্দিন এসে উপস্থিত।
সে ভোর হতেই বাসায় চলে আসবে রাহেলা তা ভাবেননি। আগের রাতের সব দুঃখ তিনি ভুলে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, বউমাকে আনলি না।
ও ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভাঙলে চলে আসবে। নোট লিখে এসেছি।
আসতে পারবে একা একা?
আসতে পারবে না মানে? কী যে তুমি বল মা! ও কি আমাদের দেশের মেয়ে যে স্বামী ছাড়া এক পা ফেলতে পারে না!
তা তো ঠিকই।
রাহেলা নাশতার আয়েজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আলাউদ্দিনকে এখন সহজ ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রান্নাঘরে মার পাশে বসে অনেক গল্প করতে লাগল। নাসরিন এবং মনসুর সাহেবও গল্পে যোগ দিলেন।
তুই তো ঐ দেশেই থেকে যাবি?
হ্যাঁ। এই দেশে আছে কী বলো? এই দেশে থাকলে তো মরতে হবে না-খেয়ে।
অনেকেই তো আছে।
কীরকম আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
তাও ঠিক।
নাসরিনও সহজভাবে ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প করল। এখন ভাইয়াকে খুব আপন লাগছে। কথা বলতে ভালো লাগছে।
ভাইয়া, কাল ওইজা বোর্ড দিয়ে ভূত এনেছিলাম।
তা-ই নাকি?
হ্যাঁ। আপনাআপনি বোতাম এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যায়।
তুই নিশ্চয়ই ঠেলেছিস।
অনেস্ট ভাইয়া। মোটেই ঠেলিনি।
তুই না ঠেললেও তোর সাবকনশাস মাইন্ড ঠেলেছে। আমি নিউজ উইক পত্রিকায় দেখেছিলাম। পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাব-কনশাস মাইন্ডের।
এমন সহজ স্বাভাবিকভাবে যে মানুষটা গল্প করল সেই আবার ঠিক সন্ধ্যাবেলা একটা ঝগড়া বাধিয়ে বসল। সাধারণ ঝগড়া না— কুৎসিত ঝগড়া। ব্যাপারটা এরকম।
ক্লারা খাবার পানি চেয়েছে।
নাসরিন গ্লাসে করে পানি দিয়েছে। এক চুমুকেই সেই পানি খেয়ে ক্লারা বলল–থ্যাংকস। খুব বালো পানি।
ক্লারা এখন কিছু কিছু বাংলা বলার চেষ্টা করে।
আলাউদ্দিন বলল, ফোটানো পানি দিয়েছিস তো? বয়েলড ওয়াটার?
না ভাইয়া। ট্যাপের পানি।
কেন? তোদের কি আগে বলিনি সবসময় বয়েলড পানি দিবি? পানি ফুটিয়ে পরে বোতলে ভরে রাখবি। সামান্য কথাটা মনে থাকে না? বয়স যত বাড়ছে তোর বুদ্ধি দেখি তত কমছে!
নাসরিনের মুখ কালো হয়ে গেল।
মনসুর সাহেব মেয়েকে রক্ষা করার জন্যে বললেন, একবার মাত্র খেয়েছে কিছু হবে না। আমরা তো সব সময় খাচ্ছি।
তোমাদের খাওয়া আর ক্লারার খাওয়া এক হলো? মাইক্রো অরগেনিজম খেয়ে খেয়ে তোমরা ইমমিউন হয়ে আছ। ও তো হয়নি।
যা হবার হয়ে গেছে। এখন চিৎকার করে আর কী হবে?
চিৎকার করছি নাকি? তোমাদের সঙ্গে দেখি সামান্য আরগুমেন্টও করা যায় না!
নাসরিন অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারল না। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে দ্রুত বের হয়ে গেল। রাহেলা মৃদুস্বরে বললেন, দিলি তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে! যা অভিমানী মেয়ে! রাতে তো খাবেই না।
আলাউদ্দিন বিরক্ত গলায় বলল, এত অল্পতেই যদি চোখে পানি এসে যায় তা হলে তো মুশকিল। একটা ভুল করলে তার ভুল ধরিয়ে দেয়া যাবে ?
ও ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ কী বলছ? সতেরো আঠারো বছরের কেউ ছেলেমানুষ থাকে? তোমাদের জন্যে বড় হতে পারে না। তোমরা ছেলেমানুষ বানিয়ে রেখে দাও।
আলাউদ্দিন রাতে খেল না। বউকে নিয়ে নাকি নিরিবিলি কোথাও ডিনার করবে।
নাসরিন সেই রাতে ঘুমুতে গেল না-খেয়ে। অনেকক্ষণ জেগে রইল, ঘুম এল না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে। অনেক রাতে সে ওইজা বোর্ড নিয়ে বসল। আজ আর দেরি হলো না। বোতামে হাত রাখামাত্র বোতাম নড়তে লাগল। আজ সে উত্তরগুলিও শুধু হ্যা বা না দিয়ে দিচ্ছে না। অক্ষরের উপর ঘুরে ঘুরে ছোট ছোট শব্দ তৈরি করছে। মজার মজার শব্দ। নাসরিন এই শব্দগুলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না আবার গুরুত্ব দিচ্ছে। একবার ভাবছে–এগুলি অবচেতন মনের ইচ্ছে, আরেকবার ভাবছে— হতেও তো পারে। হয়তো সত্যি কেউ এসেছে। পৃথিবীতে রহস্যময় ব্যাপারটা তো হয়। কটা রহস্যের সমাধান আমরা জানি? কী যেন বলেছেন শেকসপিয়ার— There are many things….
আপনি কি এসেছেন?
হ্যাঁ।
কাল যিনি এসেছিলেন আজও কি তিনিই এসেছেন?
হ্যাঁ।
আপনার নাম?
X
কী অদ্ভুত নাম! আচ্ছা আপনি কি জানেন আজ আমার মন কালকের চেয়েও খারাপ?
জানি।
কী করা যায় বলুন তো?
আমি জানি না।
আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।
জানি।
ভাইয়া বলছিল এই যে আপনি নানান কথা বলছেন এগুলি আসলে আমার মনের অবচেতন ইচ্ছার প্রতিফলন।
হতে পারে।
ভাইয়াকে আমার দারুণ পছন্দ। আমি জানি।
ঐ পচা মেয়েটা সব নষ্ট করে দিয়েছে। আমার মনে হয় মেয়েটা ডাইনি। ও আশপাশে থাকলেই ভাইয়া অন্যরকম হয়ে যায়। তখন সবার সঙ্গে ঝগড়া করে।
জানি।
কী করা যায় বলুন তো।
মেয়েটাকে মেরে ফ্যালো।
ছিঃ, কী যে বলেন! মানুষকে মেরে ফেলা যায় নাকি?
হ্যাঁ, যায়।
কীভাবে?
অনেকভাবে।
আপনার কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। আপনি কী করে ভাবলেন আমি একটা মানুষ মারতে পারি?
সবাই পারে।
আপনি পারেন?
না।
আপনি পারেন না কেন?
আমি জানি না।
মানুষ মারা যে মহাপাপ এটা কি আপনি জানেন?
আমি জানি না।
আপনি আসলে কিছুই জানেন না।
হতে পারে।
তা ছাড়া আপনি আরেকটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন। ধরুন আমি ঐ পচা মেয়েটাকে মেরে ফেললাম, তখন পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেবে? আমাকে ধরে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে না?
তা দিতে পারে।
আর ভাইয়ার অবস্থাটা তখন চিন্তা করে দেখুন। কীরকম রাগ সে করবে। টাকা-পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেবে। আমরা তখন না-খেয়ে মারা যাব। বাবার এক পয়সা রোজগার নেই, আমাদের ব্যাংকে টাকা-পয়সা নেই। ভাইয়া প্রতি মাসে যে টাকা পাঠায় এটা দিয়ে আমরা চলি। ভাইয়া প্রতি মাসে কত পাঠায় বলুন তো?
আমি জানি না।
একশো ডলার। একশো ডলারে বাংলাদেশী টাকায় কত হয় তা জানেন?
না।
বেশি না, সাড়ে তিন হাজার। মা এবার কী ঠিক করে রেখেছেন জানেন? মা ঠিক করে রেখেছেন— ভাইয়াকে বলবেন আরো কিছু বেশি টাকা পাঠাতে। একশো ডলারে হচ্ছে না। জিনিসপত্রের যা দাম। আপনাদের তো আর কোনোকিছু কিনতে হয় না। আপনারা আছেন সুখে, তা-ই না?
আমি জানি না।
আচ্ছা আপনার কী মনে হয় ভাইয়া টাকার পরিমাণ বাড়াবে?
আমি জানি না।
না বাড়ালে আমাদের খুব কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাড়াবে না। বিয়ে করেছে, খরচ বেড়েছে। তাই না?
হতে পারে।
টাকা না বাড়ালে কী হবে বলুন তো! আমার আরেক ভাই আছেনজসিম ভাইয়া। চিটাগাঙে থাকেন। তাঁর টাকা-পয়সা ভালোই আছে। কিন্তু সে আমাদের একটা পয়সা দেয় না। আমরা যদি না খেয়ে মরেও যাই সে ফিরে তাকায় না। কী করা যায় বলুন তো?
ক্লারাকে মেরে ফেলা যাক।
বারবার আপনি এক কথা বলেন কেন? আপনার কাছে বুদ্ধি চাচ্ছি।
ক্লারাকে মেরে ফেলাই একমাত্র বুদ্ধি।
যান। আপনার সাথে আর কথাই বলব না।
নাসরিন ওইজা বোর্ড বন্ধ করে ঘুমুতে গেল। আজ আর গতরাতের মতো চট করে ঘুম এল না। একটু যেন ভয়-ভয় করতে লাগল। ওইজা বোর্ড টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে। তার কাছেই একটা চেয়ার। নাসরিনের কেন জানি মনে হচ্ছে চেয়ারে ঐ মি. এক্স বসে আছেন। বুড়ো ধরনের একজন মানুষ, যার গায়ে চুরুটের গন্ধ। ঐ বুড়ো মানুষটার একটা চোখে ছানিপড়া। গায়ে চামড়ার কোট। সেই কোটেও এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ।
নাসরিন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেউএকজন আছে।
নাসরিন ভয়ে-ভয়ে বলল, আপনি কি আছেন? চেয়ার নড়ে উঠল। সত্যি নড়ল? না মনের ভুল? নাসরিন ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি দয়া করে বসে থাকবেন না। চলে যান। যখন আপনাকে দরকার হবে আমি ডাকব।
আবার চেয়ার নড়ল। নিশ্চয়ই মনের ভুল।
নাসরিনের বড় ভয় লাগছে। জুন মাসের এই প্রচণ্ড গরমের রাতেও একটা চাদরে সারা শরীর ঢেকে সে শুয়ে রইল। ঘুম এল একেবারে শেষ রাতে। তাও গাঢ় ঘুম না। আজেবাজে সব স্বপ্ন। একটা স্বপ্ন তো খুবই ভয়ংকর। তার শাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সে অনেক চেষ্টা করছে আগুন নেভাতে। পারছে না। যতই চেষ্টা করছে আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ছে। একজন বুড়োমতো লোক চুরুট-হাতে পুরো ব্যাপারটা দেখছে, কিছুই করছে না।
টাকার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি রাহেলা অনেক ভণিতার পর করলেন। বলতে তাঁর খুবই লজ্জা লাগল, কিন্তু কোনো উপায় নেই।
আলাউদ্দিন তখন চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ নামিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, টাকা বাড়াতে বলছ?
হ্যাঁ।
একশো ডলারে তোমাদের হচ্ছে না?
না।
তোমরা কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে? আমেরিকায় কি আমি টাকার চাষ করছি? ট্রাকটার দিয়ে জমি চষে টাকার চারাগাছ বুনে দিচ্ছি?
রাহেলা ক্ষীণস্বরে বললেন, সংসার অচল।
সংসার তো আমারটা আরো বেশি অচল। বিয়ে করেছি— নতুন সংসার। অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি। একটা জিনিস নেই অ্যাপার্টমেন্টে। ক্লারা অফিস করে, তার একটা আলাদা গাড়ির দরকার। তোমাদের টাকা তো বাড়াতে পারবই না, বরং কিছু কমিয়ে দেব বলে ভাবছি।
আমাদের চলবে কীভাবে?
জসিম ভাইকে বলো। তারও তো কিছু দায়িত্ব আছে। সে তো গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরছে।
রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলাউদ্দিন বিরক্ত স্বরে বলল, এরকম ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে না মা। নিশ্বাস ফেলে সমস্যার সমাধান হয় না।
নাসরিন ওইজা বোর্ড নিয়ে বসেছে। রাত প্রায় দুটো। আজ অন্যদিনের মতো গরম নয়। সন্ধ্যাবেলায় তুমুল বর্ষণ হয়েছে। আকাশ মেঘলা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবারও হয়তো বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে বলে জানালা বন্ধ।
আপনি কি আছেন?
হ্যাঁ।
আমাদের কী বিপদ হয়েছে শুনেছেন?
ভাইয়া টাকা-পয়সা বেশি তো পাঠাবেই না; বরং আরো কমিয়ে দেবে।
ও আচ্ছা।
কী করব আমরা বলুন তো?
মেয়েটাকে মেরে ফ্যালো।
এইটা ছাড়া বুঝি আপনার মাথায় আর বুদ্ধি নেই?
না। এটা সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি।
আপনার সঙ্গে আমার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না।
শুনে দুঃখিত হলাম।
আচ্ছা ঐদিন আপনি আমাকে ভয় দেখালেন কেন? আপনি কি ঐ চেয়ারটায় বসেছিলেন? আমার মনে হয় আপনি এখনও চেয়ারটায় বসে আছেন।
ক্লারাকে আগুনে পুড়িয়ে মারলে কেমন হয়?
আপনি আজেবাজে কথা বলবেন না তো! আচ্ছা বলুন তো ঐদিন কি আপনি চেয়ারে বসেছিলেন?
তুমি একটু সাহায্য করলেই হয়।
কী সাহায্য?
যখন আগুন জ্বলে উঠবে তখন এই ঘরের দরজা তুমি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেবে।
আপনার কথাবার্তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
আগুন লাগার পর মেয়েটা যাতে বেরুতে না পারে।
কী বলছেন আপনি?
আগুন লাগার পর সে ছুটে বের হতে চাইবে। তখন তাকে শুধু আটকানো। অল্প কিছুক্ষণ আটকে রাখা।
চুপ করুন তো!
ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি।
আপনার বুদ্ধি চাই না।
তুমি আমার বন্ধু।
না, আমি আপনার বন্ধু নই।
আজ রাতে নাসরিন এক পলকের জন্যেও চোখ এক করতে পারল না। মনে মনে ঠিক করে ফেলল ওইজা বোর্ডটা ভোর হতেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে। কী সর্বনাশের কথা! বোতামটা এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেন?
আগামীকাল রাত দুটার ফ্লাইটে আলাউদ্দিন চলে যাবে। শেষ রাতটা এ বাড়িতে থাকবার জন্যে এসেছে, দীর্ঘদিন হোটেলে থাকায় তাকে বেশ লজ্জিতও মনে হচ্ছে।
আজ রাতটা থাকতে তেমন কষ্ট হবে না। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। আবহাওয়া অসহনীয় নয়। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
আলাউদ্দিন বসার ঘরে সবার সঙ্গে গল্প করছে। গল্প বেশ জমে উঠেছে। প্রথমদিকে আমেরিকায় সে কীসব বিপদে পড়েছিল তার গল্প। প্রতিটি গল্পই আগে অনেকবার শোনা তবু সবাই খুব আগ্রহ করে শুনছে।
ঘরে ইলেকট্রিসিটি নেই। বিকেলে ঝড়বৃষ্টির সময় ইলৈকট্রিসিটি চলে গিয়েছে, এখনও আসেনি। আজ রাতে আর আসবে বলে মনে হয় না। ঝড়বৃষ্টি এখনও হচ্ছে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, বৃষ্টির ঝমঝমানি, দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা, চমৎকার পরিবেশ।
একটিমাত্র হারিকেন, সেটা বসার ঘরে। হারিকেন ঘিরে সবাই বসে আছে।
ক্লারা ওদের গল্পে কোনো মজা পাচ্ছিল না, ঘন ঘন হাই তুলছিল। মাঝরাতে সে ঘুমুতে গেল। নাসরিন তার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
দুর্ঘটনা ঘটল তারও মিনিট দশেক পর, গল্প তখন খুব জমে উঠেছে। শুরু হয়েছে ভূতের গল্প। রাহেলা ছোটবেলায় নিশির ডাক শুনে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিলেন সেই গল্প হচ্ছে। গা ছমছমানো পরিবেশ। ঠিক তখন তীক্ষ্ণ গলায় নাসরিন বলল, ঘর এত আলো হয়ে গেছে কেন ভাইয়া? তার কথা শেষ হবার আগেই শোনা গেল গোঙানি ও চিৎকার। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে এবং ক্লারা চ্যাঁচাচ্ছে–Oh God, Oh Good.
সবাই ছুটে গেল শোবার ঘরের দিকে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।
দুর্ঘটনা তো বটেই। দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। বাতাসে মোমবাতি কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল নেটের মশারিতে। সেখান থেকে ক্লারার নাইট গাউনে। সিনথেটিক কাপড় মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল। খুবই সহজ ব্যাখ্যা। শুধু একটি ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। ক্লারার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। কেউ একজন বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছিল। আগুন লেগে যাবার পর ক্লারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে ঘর থেকে বেরুতে। বেরুতে পারেনি। চিৎকার করে দরজা খুলতে বলেছে— ঝড়-বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সঙ্গে তার চিৎকারও কেউ শোনেনি। ব্যাকুল হয়ে শেষ মুহূর্তে সে ঈশ্বরকে ডাকছিল। ঈশ্বর মানুষের কাতর আহ্বানে সাধারণত বিচলিত হন না।
<সমাপ্ত>