সে ছিল ১৯১২ সালের জুন মাসের একটা রবিবার। লীনা আর ইনা স্টিলিংগার নামে দুই বোন গেছে চার্চে। সেখানে গিয়ে তাদের জোসিয়া আর সারা মুর-এর সঙ্গে দেখা। আইওয়ার এই ছোট্টো পাহাড়ি শহর ভিলিসকাতে সবাই সবাইকে চেনে। জোসিয়াদের মেয়ে ক্যাথলিনের সঙ্গে লীনা ইনাদের খুব ভাব। সেদিন সন্ধেবেলা দুই পরিবারের বাচ্চারা মিলে চার্চের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার কথা সেদিন সন্ধেবেলা।
ক্যাথলিন তাদের বলল, চল আমাদের সঙ্গে। সন্ধেবেলা প্রোগ্রামের পর আমাদের বাড়িতেই রাত্তিরে থাকবি। লীনা, ইনা তো এক কথায় রাজি। জোসিয়া তখন তাদের দিদি ব্লানশ-কে ফোন করে বলে দিলেন বাচ্চারা রাতে তাঁদের বাড়িতে থেকে যাচ্ছে। পরদিন ফিরবে।
অনুষ্ঠানের পর তারা সবাই মিলে মুরদের বাড়িতে পৌঁছোল রাত দশটা নাগাদ।
পরদিন সকালে মুরদেরপাশের বাড়ির গিন্নি মেরি পেকহ্যাম কাপড় ধুয়ে বাইরে মেলতে দিয়ে এসে খেয়াল করলেন মুরদের বাড়িতে কেউ তখনো ঘুম থেকে জাগেনি। আশ্চর্য নিথর হয়ে আছে দরজা জানালা বন্ধ করা বাড়িটা। কেমন একটু সন্দেহ হতে মেরি মুরদের বাড়িতে ঢুকে দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কেউ সাড়া দিল না।
মেরি এবার ঘাবড়ে গিয়ে জোসিয়ার ভাই রস মুরকে ফোন করে ডেকে আনলেন। তিনি এসেও ডেকেডুকে কোন সাড়া না পেয়ে শেষে নিজের চাবির গোছায় রাখা সে বাড়ির একজটা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তার সদর দরজা খুললেন।
একতলার শোবার ঘরের দরজা খুলে তিনি দেখলেন, সেখানে দুটি রক্তে মাখামাখি মৃতদেহ। সে দুটো ছিল লীনা আর ইনার।
পুলিশে খবর গেল। তারা এসে দোতলার ঘরগুলো থেকে আরো ছটা মৃতদেহ উদ্ধার করল। সেগুলো ছিল,জোসিয়া, সারা আর তাঁদের চার ছোটোছোটো ছেলেমেয়ে ক্যাথরিন, হার্মান, বয়েড আর পল-এর। ভারী কিছু দিয়ে প্রত্যেকের মাথার খুলি গুঁড়ো করে খুন করা হয়েছে তাদের। খুন করবার অস্ত্রটাও পাওয়া গেল নীচতলার ঘরটাতে ইনা আর লীনার শরীরের পাশে। সেটা ছিল জোসিয়ার একটা কুড়ুল।
তারপর অনেক তদন্ত হল। দেখা গেল বাড়ির সব ঘরের জানালার পর্দা টানা। যে দুটো ঘরে পর্দা নেই সেগুলোর জানালায় কাপড় ঠুসে দেয়া হয়েছে।
একশো বছরেরও আগের কথা। আজকের মত উন্নত বিজ্ঞান তখন তদন্তকারীদের সাহায্যের জন্য ছিল না। ব্লাডহাউন্ড এল, আঙুলের ছাপ নেয়া হল, কিছুতেই কিছু হল না। রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেল খুনে বা খুনেরা। কোন শত্রু ছিল না জোসিয়াদের। তাই সন্দেহের খাতায় তেমন কোন নামও উঠে আসেনি। শুধু জানা গিয়েছিল রাত বারোটা থেকে পাঁচটার মধ্যে খুনগুলো করা হয়েছে।
বাড়িটা আজও সেখানে আছে। তার নাম লোকমুখে দাঁড়িয়েছে ভিলিসকা অ্যাক্স মার্ডার হাউস। রাতে সেখানে অনেকে থাকতে যান অ্যাডভেঞ্চার করবার জন্য। তাঁরা সেখানে ছোটোদের গলার শব্দ পান। হাসি, খেলা, আর্তনাদ-
২০১৪ নভেম্বর মাসে উইসকনসিন থেকে একদল পর্যটক সে বাড়িতে ভূত দেখতে এসেছিলেন। রাতে সব বন্ধুদের নিচে রেখে একলা দোতলার বেডরুমে গিয়ে ঢোকেন রবার্ট স্টিভেন লরসেন নামের এক ভূতপ্রেমিক। রাত দুটো নাগাদ হঠাৎ নীচে থাকা বন্ধুদের মোবাইলে লরসেনের ফোন আসে। আর্তনাদ করছিলেন লরসেন। সাহায্য চাইছিলেন। বন্ধুরা দৌড়ে ওপরে উঠে গিয়ে দেখেন নিজের বুকে নিজেই ছুরি বসিয়ে দিয়েছেন লরসেন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে হেলিকপটারে ওমাহার বড়ো মেডিকেল কলেজে। কোনমতে প্রাণটা বেঁচেছে লারসনের। কিন্তু কোন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি গিয়েছেন রাতের ওই মুহূর্তগুলোতে সে নিয়ে তাঁর মুখ খোলানো যায়নি এখনো।
আসলে রাত দুটো নাগাদ ভিলিসকা শহর দিয়ে হুইশিল বাজিয়ে একটা ট্রেন যায়। একশো বছর আগেও যেত। বলা হয় তার দীর্ঘ হুইশিলের আওয়াজের মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগিয়ে খুনের দল নিরীহ শিশুদের আর তাদের চারজনের মা বাপকে খুন করেছিল পেশাদারী দ্রুততায়।
আজও এ বাড়িতে তাই ও সময়টা থেকে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে। অনেকে দেখেছেন, সেসময় একটা আবছা কুয়াশার পিণ্ড ভেসে আসে, প্রথমে সারাদের শোবার ঘর, তারপর তাদের ছেলেমেয়েদের ঘর হয়ে ভেসে আসে নিচের সেই শোবার ঘরে, যেখানে শেষ হয়ে গিয়েছিল লীনা আর ইনা নামে দুটো মেয়ের প্রাণ। তারপর শোনা যায় টুপ টুপ করে ঝরে পড়া তরলের শব্দ—যেন রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ছে কাঠের মেঝেতে।
আর এই সময়টাতেই লারসেনের সেই ভয়াবহ আত্মহননের চেষ্টাটাও ঘটেছিল সারাদের শোবার ঘরের ভেতরে।