রহস্যগল্প -ওঝা

রহস্যগল্প -ওঝা

“ভোর বিয়ানে মনুর মা বদনা হাতে বাইরে গেল। আর ঘরে ফেরার নাম নেই। মনুর বাপ মনুর মাকে ডাকতে ডাকতে বাইরে গিয়ে দেখে, মনুর মা বদনা হাতে তালগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। কথাও বলছে না, নড়ছেও না! কোনো সাড়া না পেয়ে মনুর বাপ এগিয়ে গিয়ে মনুর মার হাত ধরে টান দিতেই মনুর মা মাটিতে পড়ে কাঁচের মত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মনুর বাপ ভাঙ্গাচোড়া মনুর মা‘র দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল!‘
এমনই একটা কাহিনী মুহর্তে ছড়িয়ে গেল গ্রামে।

কাহিনীর হাত-পা গজাতে লাগল। যে-ই শুনছে সে-ই পাগলের মত ছুটে আসছে। গাঁয়ের সব মানুষ হনহন করে এসে ভিড় করেছে মনুদের তালতলায়। কেউ দরজার ডালা লাগিয়ে, কেউ না লাগিয়ে, কেউ জিন এটে ছুটে এসেছে এখানে।

এরা এসে ভয়ে-কৌতূহলে বলাবলি করছে, এমন আজব ঘটনা তো জীবনেও শুনিনি!
কোত্থেকে জানি কয়েকজন সঙ্গীসহ মস্তবড় এক ওঝা হনহন করে চলে এলো এখানে। ওরা এসেই বলল, ‘এগুলান মহা পাঁজি ভূতের কাম। এখনই ওদের কোমড় ভাঙতে না পারলে এ গ্রামের যার-তার ওপর ‘আছর-আবদার‘ করে সাংঘাতিক ফ্যাসাদে ফেলে দিতে পারে। ছেলে-বুড়ো কেউই নিরাপদ না। এদের কবলে পড়লে আর দিশা-মিশা পাবে না কেউ! তয় আসল চিকিৎসা শুরু করলে আপছে-আপ সেরে যাবে সব। ভাঙ্গা মনুর মা উঠে দাঁড়াবে, মনুর বাপ ফিরে এসে হাসি দিয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে ঘরে চলে যাবে। তয় সালাম দেয়ার সাথে সাথে শুদ্ধভাবে জবাবে বলবেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। সালামে ও আদব-লেহাজে হের-ফের হলে কিন্তু খবর আছে!’ পরে সে সবাইকে লক্ষ করে প্রশ্ন ছুড়ে মারল, ‘কী পারবেন না?’ ছোট-বড় সবাই বলল, ‘হ হ পারবো।’ ‘তাহলে কি শুরু করবো ভয়ঙ্কর পাঁজি ভূতের চিকিৎসা?’ সবাই সমস্বরে শুরু করেন, ‘শুরু করেন’ বলে ওঝাকে ভূতের চিকিৎসা করার অনুমতি দিল। কয়েকজন ফিসফিস করে বলল, ‘ওঝা একখান!‘

ওঝা তার কাঁধের গভীর ঝোলা থেকে সাপের মত বাঁকা ও মসৃণ একটা কাঠি বের করল। সে খুব যত্নে পকেট থেকে রঙ্গীন রুমাল বের করে বার কয়েক মুছে ফু-ফা করল এবং সেই কাঠি দিয়ে উপস্থিত লোকেদের ঘিরে দাগ কেটে চোখ বড় করে চিৎকার করে, হাত-পা ছুড়ে বলল, ‘বন্ধ, সব বন্ধ! কেউ কথা বলবি না, নড়াচড়া করার চেষ্টা করবি না, করলে, ফানাফানা হয়ে যাবি, রক্ত বমি হবে। ছুঃ ছাঃ ফুনা-ফুন, ফুঃ ফুঃ ফুঃ।’

ভয়ে সবার চোখ গোল আলুর মত হয়ে গেল। ওঝার কান্ড-কীর্তি, চোটপাট ও হুমকি-ধমকিতে কে জানি ভয়ে চিঁচিঁ করে কান্না শুরু করেদিল। এক মুখরা রমণী ত্যাজ দেখিয়ে ট্যারাচোখে বলেই ফেলল, ‘এই বেটায় আমগোরে বান মেরেছে।‘ সাথে সাথে ওঝার এক ধমকে বন্ধ হয়ে গেল মুখরা রমণীর অস্থিরমুখ। আর স্তব্ধ হয়ে গেল কান্নার শব্দ।
ওঝা মন্ত্রঝাড়ের ব্যাপক আয়োজন শুরু করে দিল। তার আয়োজনের ধরনটা সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর ও রহস্যময়!
মন্ত্রের তোড়জোর দেখে লোকজনের মনে স্বস্তি ফিরে এল। কিন্তু স্বস্তির জোর বেশিণ থাকল না। ওঝার অকথ্য মন্ত্রবাণে আর নর্তন-কুর্দনে সবাই তটস্থ। কিছুতেই কিছু হচেছ না। কাপড়ে ঢাকা কী যেন পড়ে আছে। মনুর মা উঠে দাঁড়াচেছ না, নড়াচড়াও করছে না, মনুর বাপেরও কোনো খবর নেই। ওঝা মাঝেমধ্যে প্তি হয়ে বলে উঠে, ‘খামুশ ইবলিশ শয়তান, খামুশ। আমার হাত থেকে বাঁচতে এক সিকন্ড সময় পাবি না তুই। পালাবার পথ পাবি না। এইতো চলে আসছে বলে।‘ তারপর সে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে কী জানি ধরে মুচড়ে ভেঙ্গে কিছু পকেটে ঢুকালো আর কিছুটা দিল মুখে। মজাকরে খাওয়ার শব্দ করে চিবিয়ে খেয়েও ফেলল। তার হম্বি-তম্বি আর তেলেছমাতি দেখে সবাই বাকরুদ্ধ।

বৃত্তবন্দী গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুরা ভয়ে নড়াচড়া করতে পারছে না। অনেকের বমি বমি লাগছে। কারো মাথা ঘুরছে। কেউ বা দুর্বল হয়ে পড়েছে। হঠাৎ মধ্যবয়সী এক মহিলা মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুঝে ফট করে মাটিতে বসে ঝিমুতে লাগল। ওঝা মন্ত্র পড়তে পড়তে এক দৌড়ে এসে মহিলার মুখে এক লোটকা থুতু দিয়ে বলল, সটান, সটান পটাপট, কথা ক ঝটপট, নো ঝিমুন্তি, নো চিমুন্তি, খাড়া, উঠে খাড়া। মহিলা চোখ মেলে মুখের সামনে আউলা-ঝাউলা ওঝাকে দেখে পাগলের মত গাল পাড়তে লাগল। শিশুরা চিঁচিঁ করে কান্না শুরু করে দিল। ওঝা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাজের সময় ভয় পেলে চলবে না, এ বড়ো পাঁজিজাত।’ সবাই পড়ে গেল ওঝার গ্যাঁড়াকলে। ওঝা চোখ বড় করে একটু পর পর স্মরণ করিয়ে দিচেছ যে, ‘পারমিশন ছাড়া এক পা নড়লে রক্ত বমি হবে।‘ এ কথা বলতেই এক যুবক ওয়াক ওয়াক করে পাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল এবং তার মুখ থেকে গল গল কের রক্ত ও লোল বেরিয়ে এলো। জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখে সবাই হতভম্ব।

ওঝা লাফিয়ে উঠে বলে ‘কেউ যদি এখন নটর-চটর করিস তাহলে কিন্তু সামাল দেয়া যাবে না। কাজ প্রায় শেষের দিকে। ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। কারণ মনুর মা-বাপকে বাঁচাতে হবে আগে তারপর অন্যকথা। সবাইকে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ পালাবার চেষ্টা করবি না। করলে, ফল হবে ভয়াবহ। মুখ দিয়ে কলিজাশুদ্ধ রক্ত বেরিয়ে আসবে।

ওঝা তার হাতটা টেলিফোনের মত করে কানে ধরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, ‘হ্যা হ্যা, হ্যালো হ্যালো, কখন? মনুর মা ও বাপ ঠিক আছে তো? আসছে কখন? ছেড়ে দে। এদের কোন য়-তি হলে কিন্তু কঠিন বান মেরে চিরদিনের মত ঘুম পাড়িয়ে রাখব। আমার নাম তুফাইন্না ওঝা। বুঝলি বেটারা, বুঝলি? হ্যা বুঝেই যদি থাকস তো ওদেরকে সসম্মানে ওদের ঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দে। হ্যা, তাইলে কি আমার এখানে থাকার আর প্রয়োজন নেই, চলে যেতে বলছিস? ক্যান, আমি থাকলে অসুবিধা কি? আর লোকগুলো? অনেকণ তো হলো। শিশুরা কান্ত হয়ে গেছে। হ্যা হ্যা, ত কখন ছাড়বো? আমি চলে আসার পর? আচছা ঠিক আছে, ঠিক আছে।‘

কান থেকে হাতটা নামিয়ে হাপাতে লাগল ওঝা। লোকজনকে ল্য করে বল্ল, ‘যাহাতাহা কাম? বাপরে বাপ। পাঁজি ভূতগুলান সহজে ছাড়তে চায় না, আর না ছেড়ে উপায় কি! কাজ হয়ে গেছে। আইচছা, বেটা-বেটিরা শোন, আমরা গিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি এখনই। আর তোরা থাক এখানে। মনুর মা-বাপের শেষ পরিণতিটা দেখে পরে যাবি। মনুর মা এখনই নড়ে-চড়ে উঠবে, আগেই বলেছি সালাম দিলে আদবের-লেহাজের সাথে সালাম নিবি। বেয়াদবি করা যাবে না। আর মনুর বাপ আসামাত্র মনুর মা ও বাপকে এক পাটিতে বসিয়ে ঠান্ডা পানি খাওয়াবি। ওদের দিকে নজর রাখবি আর কোনো শব্দ করতে পারবি না। বুঝলি ব্যাটারা?

সবাই একটু স্বস্তিবোধ করে সমস্বরে বলল, ওঝা ভাই আমগোরে চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে যান। এই দেহেন না পোলাপান্তেরা ঘেমে-নেয়ে শেষ, অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উদাম রেখে এসেছি ঘর-দুয়ার।
ওজা একটু চিন্তা করে একটা লম্বাশ্বাস টেনে বলল, আইচছা আমি এখন চলে যাচিছ। তোদেরও চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচিছ। তবে সাবধান, অনিয়ম করতে পারবি না। মন্ত্র পড়ে দিয়ে যাচিছ। আমি চলে যাওয়ার আধাঘন্টা পর এ সাদা দাগের বান খুলবে। তখন ধীরে ধীরে বাড়ি চলে যাবি। সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল। ওঝা ঝোলাটা কাঁধে তুলে সঙ্গীদের নিয়ে হনহন করে চলে গেল।

ওঝার দেয়া সময় শেষ হলো। জবুথবু লোকজন সাবধানে পা তুলে বৃত্তটা ডিঙ্গিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে যারযার বাড়ি গিয়ে উঠল। ওরা ঘরে ঢুকেই ’ওরে আল্লারে, কী সর্বনাশ হইল রে’ বলে চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। তারপর উঠোনে আছাড়খেয়ে পড়ে, কপাল ও মাটি চাপড়ে প্রলাপে-বিলাপে কান্না জুড়ে দিল। কারোর ঘরে মূল্যবান আর একটা জিনিসও অবশিষ্ট নেই!

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত