রহস্য যখন হাঁটুতে

রহস্য যখন হাঁটুতে

কলেজে উঠে থেকেই আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিল চন্দন। তাই, সোশিওলজির প্রোজেক্টে আমাদের যখন একটা গ্রাম নিয়ে রিপোর্ট লিখতে বলা হল, তখন স্বভাবতই চন্দনের গ্রাম,ভালকুঠির কথাই প্রথমে মাথাতে এল। ওর কাকা-কাকিমা থাকেন সেখানে। তো, সেকেন্ড ইয়ারের শেষদিকে, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

অগাস্ট মাস। রাত্রি আটটা নাগাদ যখন ভুবনদার ভটভটি থেকে নামছি, চারদিক বেশ ঘন অন্ধকার। বেলার দিকে বোধহয় হালকা বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট ভিজে, আর ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ঠিক হল পরের দিন সকালে গ্রামটা ঘুরে দেখব।

সকালের গ্রামটা অপরূপ সুন্দর। মাটির রাস্তা। কাঁকর বিছানো। চাষি,কাঠের মিস্ত্রি, কামার সবাই নিজের নিজের কাজে আস্তে আস্তে মজে যাচ্ছে, রোজকার মতো। আমার ছোট্ট ডাইরিতে সব টুকে রাখছিলাম। প্রজেক্টে লাগবে।

চাষিদের মধ্যেই একজন হলেন সমীর জ্যেঠু। সোমনাথবাবু অর্থাৎ চন্দনের কাকুর জমি দেখাশুনা করেন। এরা মূলত ভাগচাষী। কিন্তু সমীরবাবু বিগত বিশ বছর ধরে জমির দায়িত্বে।

কামারশালে শ্যাম কামারের ছেলে লক্ষ্মণ, চন্দনের বাল্যবন্ধু। ওখানেই দেখা হয়ে গেল। বেশ আড্ডা হল তিনজনে মিলে। খুব মজার ছেলে।

আমার আবার রাত জেগে বই পড়া, লেখালিখির শখ আছে বলে আমাকে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। দুপুরে মাগুর মাছের ঝোল ভাত খেয়ে সেই ঘরে বসেই সোমনাথ কাকুর মেয়ে রিঙ্কির সঙ্গে খেলা করছিলাম। রিঙ্কির এবারে ক্লাস থ্রি হল।

তখনই চন্দন এসে বলল,

“শোন না, আমাকে এখন একটু বেরোতে হবে বুঝলি। সাঁইথিয়া যাব। কাকার একটা ওষুধ আনতে। তুই থাক। আমি সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসব। কেমন?”

বলে রিঙ্কির গাল টিপে চন্দন বেরিয়ে গেল। আমিও মাথা নেড়ে‘হ্যাঁ’ বলে ফের পেন পেন্সিল নিয়ে বসলাম। রিঙ্কিকে মজার মজার কার্টুন এঁকে দিচ্ছিলাম। বাচ্চাটা বেশ আনন্দ পাচ্ছিল! ঘরে পুরনো কাগজপত্র ডাঁই করে রাখা আছে এক কোণে। এদিকে আমার কাছে রাফ কাগজও অত নেই। তাই ভাবলাম ওই পুরনো কাগজেই খেলাটা কন্টিনিউ করি।

তাতে কোনোটা ১৯৯৮ এর সংবাদপত্র, কোনোটা আবার পুরনো মুদিখানার খাতা। এইসব। রিঙ্কিও আমার দেখাদেখি একটা পুরনো ছোটোদের রামায়ণ টেনে বের করে আনল। সেটাতে অলরেডি ছবি –লেখা সবই আছে। ওকে আর কী করে বোঝাব সেটা! যাই হোক সে বেচারা, “দাদা, এটাতে একটা হনুমান আঁকো, হনুমান আঁকো” বলেই চলল।

আমি বাধ্য হয়ে বইটা খুলতে গিয়ে দেখি, একটা জায়গায় পেজমার্ক করা আছে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ দিয়ে। ওই জায়গাটায় হনুমানের লঙ্কাদহনের ঘটনাটা বর্ণিত হয়েছে। পুরোটাই আমার পড়া। ওটাকে বন্ধ করে রাখতে গিয়ে পেজমার্ক দেওয়া কাগজটায় চোখ গেল। সেটাতে আবার উল্টোপিঠে কিসব লেখা রয়েছে!

“পায়ের তলায় জমি, শক্ত লাঠি হাত-

তারিফ করেন তিনি। কাস্তে চাঁদের রাত।

লঙ্কাদহন – করল বাজিমাৎ!

ঘরের মধ্যে ঘর। ধারালো চাই ধাতু।

রইল পড়ে সোনায় মোড়া হাঁটু। ”

আমি তো এসবের মাথামুণ্ডু কিস্যু বুঝলাম না। এমনিতেই বেশ ঘুম পাচ্ছিল। রিঙ্কিকে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে দুপুরের ভাতঘুমের আয়োজন করলাম। ঘড়িতে ঢং করে আড়াইটের ঘণ্টা পড়ল।

চন্দন ফিরল সেই রাত করে। মুখ চোখ শুকনো। শুতে যাওয়ার আগে জিগ্গেস করলাম, “এত রাত করলি চাঁদু?”

“ফেরার সময় বাস মিস করলাম আর কি! ব্রেক জার্নি করতে হল ভাই। -”

বলতে বলতে নিজের ঘরে গিয়ে ‘গুড নাইট’ বলে শুয়ে পড়ল। আমিও নিজের ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা খুলে বসলাম। আজকের একটা খসড়া রিপোর্ট বানিয়ে রাখি এই বেলা। তারপর রামায়ণটা একবার পড়ব। পুরোনো বইয়ের গন্ধটাই আলাদা হয়!

********

আগাগোড়া রহস্যে মোড়া গ্রামটা। গরুর হাম্বা ডাকেও একটা আবছা সতর্কতা আছে। কিন্তু আসল চমক লাগানো ব্যাপারটা রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে আবিষ্কার করলাম।

ডায়েরি বন্ধ করার পর প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে রামায়ণটা নাড়াচাড়া করছিলাম। বলা ভালো ওই বিদঘুটে ছড়াটা নিয়ে। জানলা দিয়ে পুকুরের মাথায় এক ফালি চাঁদ দেখেই ‘কাস্তে’ কথাটার মিল পাই। কিন্তু তার বেশি কিছু মানে বের করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে ব্যাজার মুখে দেড়টা নাগাদ লাইট নিভিয়ে শুতে গেলাম।

খানিকক্ষণ ছটফট করে ঘুমটা এসেই ছিল, ঠিক তক্ষুনি বিছানার তলা থেকে ঠকঠক শব্দ!

আমি একধাক্কায় ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম। জানলার বাইরে কালো রাত নির্লিপ্ত! কোনো হেলদোল নেই। মৃদু বাতাসে তালগাছের পাতা খড়খড় করছে। এদিকে ঘরের ভিতর থেকে ক্রমাগত অদ্ভুত শব্দ।

একটু পরেই বুঝলাম, আওয়াজটা আসছে মাটির তলা থেকে। মাটিতে শুয়ে কান পেতে শুনলাম, কেউ যেন একনাগাড়ে কিছু ঠুকে চলেছে। ঠক… ঠক… ঠক…!

সকালে উঠতে উঠতে আটটা বেজে গেল। চন্দন তো তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি কাকিমার থেকে চা এর কাপটা নিয়ে টিভির ঘরে যাচ্ছিলাম, দেখি বাঁদিকে সদর দরজা দিয়ে সমীর জ্যেঠু ঢুকছে। আমাকে দেখে সহাস্যে বলে উঠল, “কী কেশববাবু, এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে? ঘুম হয়েছে?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, দিব্যি।” কাল রাতের কথাটা চেপে গেলাম। সোমনাথকাকুর সঙ্গে জমি নিয়ে কিছু আলোচনা সেরে জেঠু বেরিয়েই যাচ্ছিল, আমাকে ডেকে জিগেস করল, “চাঁদু তো ঘুমোচ্ছে। জমি দেখতে যাবে তো চলো… পেয়ারা খাওয়াব!”

আমি আর রিঙ্কি এক পায়ে খাড়া। ঝটপট হাওয়াই চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সমীর জ্যেঠুকে আমার বেশ লাগে। সত্যিই মাটির মানুষ। যেতে যেতে রিঙ্কি বলল, “জেঠু , গল্প শুনব কিন্তু। আজ একটা নতুন আর বড়ো গল্প বলবে!”

জ্যেঠু হেসে বলল, “এই হয়েছে বাচ্চা মা আমার, আমাকে পেলেই হল। কত গল্প শুনবি মা?”

রিঙ্কি বলল,”অনেক অনেক! আর এই ভালো দাদাটাও তো তোমার কোনও গল্প শোনেনি।”

রিঙ্কির কথা শুনে দু’জনেই হাসতে হাসতে আখের জমির কাছে এসে গেলাম। আমাদের দাঁড়াতে বলে দৌড়ে গিয়ে গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে আনল। একটা করে আমাদের দিয়ে নিজে একটা খেতে খেতে সমীর জ্যেঠু শুরু করল, “উনিশশো সাল। বীরভূমের ‘ডিস্টিক’ কালেক্টর এই গাঁয়েই থাকত। ওই গোয়ালাপাড়ার দিকে ব্যাটার দালানকুঠি ছিল। বড় ভালো মানুষ ছিলেন।”

“সেবার পৌষ মাস। কনকনে ঠাণ্ডা। খাজনাপাতি জোগাড় করে তখনও বাড়িতেই জমা রেখেছিল। সরকারের কাছে পাঠাত ক’দিন বাদেই।

ব্যস, খবর ঠিক চাউর হয়। গভীর রাতে ঘুমোচ্ছিলেন। তখুনি,একদল ডাকাত পাহারাদারকে বেঁধে কুঠিতে চড়াও হয়। কালেক্টর সাহেব চেঁচিয়ে ‘বাঁচাও’ বলার সুযোগটুকুও পাননি। তার আগেই তাঁর মুখ হাত চেপে বেঁধে দেয় ডাকাত সর্দার। তারপর সব পয়সা কড়ি , দুটো পুঁটলি বেঁধে চম্পট। তাও প্রায় হাজার দশেক হবে বইকি। গোটা জেলার খাজনা!”

“তারপর! তারপর!”, পেয়ারা শেষ করে আমি বলে উঠলাম।

“এদিকে, গাঁয়ের সেরা লাঠিয়াল গণেশ আর তার দুই সাগরেদ যাচ্ছিল জমির দিকে,পৌষ আগলাতে। ডাকাতের দল শিবতলা দিয়ে ঘুরেছে আর সামনে গণেশ।

এই ডাকাত সর্দারকে গনশা একবার নদীর দিকে পাকড়াও করেছিল। ব্যাটাকে একা পেয়ে বসিয়েও ছিল দু-চার ঘা। তারপর থেকে ডাকাতের উৎপাত আর হয়নি।

গণেশ দেখল পুরো ডাকাতের দল আছে। পল্টু আর শম্ভুকে গাঁয়ের বাকিদের খবর দিতে পাঠিয়ে দিল। আর ও একাই শুরু করল এ গাঁয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক লড়াই। বাঘের বাচ্চা ছিল এই গণেশ।

গণেশের লাঠির সামনে পঞ্চাশ জন ডাকাতও কম পড়ে যায়। ডাকাত সর্দার খানিকক্ষণ লড়াই করেই সেটা টের পেল। অন্য ফন্দি বের করল।

গণেশ যখন বাকিদের মোকাবিলায় জানপ্রাণ ঢেলে লাঠি চালাচ্ছে, সর্দার পিছন থেকে গিয়ে সজোরে মারল গণশার পায়ে। হাঁটু ধরে মাটিতে বসে পড়ল আমাদের গণেশ।

ভাঙা হাঁটুতেই ডাকাতদের ঠেকিয়ে রেখেছিল সেদিন। ততক্ষণে গাঁয়ের লোক সব এসে গেছে। ডাকাতরা বুঝল অবস্থা বেগতিক। ঝোলা থেকে বাঁধা বাঁধা বোম বের করে সবার বাড়ি জ্বালিয়ে দিল।

একে শীতকাল। খড়ের উপরের শিশিরটুকু সরে যেতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, গোয়ালাপাড়া, বায়েনপাড়া। তারপর উত্তুরে হাওয়ায় সে আগুন মুহূর্তের মধ্যে বিরাট আকার নিয়ে নিল। গাঁয়ের লোক কী করবে কিছু বুঝতে পারল না। ডাকাতরা এই সুযোগে সব ফেলে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাল।

লাঠিয়ালের দল অনেক দূর অব্দি পিছু নিয়েছিল। কিন্তু আর ধরতে পারে নি। ”

“দিয়ে? দিয়ে?” রিঙ্কি অধৈর্য হয়ে বলে উঠল।

“সারারাত ওই ঠান্ডায় পুকুর, দীঘি থেকে জল তুলে গোটা গ্রামের আগুন নিভিয়ে ছিল, শম্ভু, পল্টু, বিনোদরা। সে এক রাত ছিল।

তারপর তো কালেক্টর খুশি হয়ে পুনর্বাসন দিয়েছিলেন। সে অনেক পরের কথা।”

“আর, গণেশের কী হল জ্যেঠু?” আমি জানতে চাইলাম।

“গণেশ! ওই রকম টাকুড়ি দেওয়া শীতে ভাঙা পায়ে লড়েছিল ব‍্যাটাচ্ছেলে।….. হাঁটুর নিচে থেকে বাকি পা’টা কেটে বাদ দিতে হয়।”, লুঙ্গির খুঁটে চোখ মুছলেন সমীর জ্যেঠু। সত্যি, আমরাও যে কখন গণেশের এই নিঃস্বার্থ বিক্রমের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলাম জানতেও পারিনি। “সরকার থেকে গণেশকে নকল কাঠের পা গড়িয়ে দেয়। তবে কেউ কেউ বলে সেটা নাকি সোনার ছিল। আস্ত সোনায় মোড়া হাঁটু!”

বাড়ি এলাম। চান করতে হবে। চন্দন চান সেরে উঠোনে বসেছিল। নারকেল তেলের খোঁজ করার ফিকিরে ওর কাছে গেলাম। সব খুলে বললাম। শুনে টুনে চন্দনেরও চোখ কপালে। ও তো এসবের বিন্দু বিসর্গও জানত না!

দু’জনে মিলে প্ল্যান করলাম আজ রাতে দুটো নাগাদ,আবার যদি ঠক ঠক শুরু হয়, টর্চ হাতে বেরিয়ে যাব চুপিচুপি। আমার মন বলছিল এই হাঁটু -ঠক ঠক শব্দ সব কানেক্টেড!

“কিশুদাদা, ‘সুখী বাংলা’ য় পাতালঘর হচ্ছে। তাড়াতাড়ি চান করে এসো।”, টিভির ঘর থেকে চিৎকার করে বলল রিঙ্কি।

************

“কিশু, এই তোর দুধ রইল। আর শোন আমি শুতে গেলাম। তুই ঠিক দুটোর সময় অ্যালার্ম দিয়ে রাখিস। আমাকে ডাকবি মনে করে!”

আমি বাধ্য ছেলের মতো “হ্যাঁ” বলে দরজা বন্ধ করে শুতে গেলাম। এক ঢোকে দুধটা শেষ করে মশারি টাঙিয়ে নিলাম। জানলার বাইরে ওয়েদারটা কী দারুণ স্তব্ধ! সব যেন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে কোনো ওলটপালটের। তালগাছ থেকে খসখস আওয়াজটাও নেই।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই নেই। ভাগ্যিস অ্যালার্মটা আগেই দিয়ে রেখেছিলাম!

ঠিক আড়াইটের সময় ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। অলরেডি মোবাইলে চারটে স্নুজ! আর মাটির নিচে জোর ঠক….ঠকা…ঠক!

দৌড়ে গিয়ে আলো জ্বালতেই চোখে পড়ল দুধের গেলাসের কাছে একগাদা পিঁপড়ে জড়ো হয়ে পড়ে আছে। নিথর। মাথাটাও কেমন ঝিম ধরে আছে।

চন্দনের ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। সমীর জ্যেঠুর জাবদা টর্চটা নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে পড়লাম। বিপদের আশঙ্কা করে আগেই সেটা নিয়ে রেখেছিলাম। …আমি জানি,আওয়াজটা ঠিক কোত্থেকে আসছে!

জায়গায় পৌঁছে টর্চটা কোমরে গুঁজে ঢাকনাটা খুলে নামতেই যাব, অমনি সেটা উল্টো দিকে খুলে আমাকেই একটা জোরে ধাক্কা দিল। আমি চার হাত দূরে ছিটকে পড়লাম।

সঙ্গে সঙ্গে মাটি ফুঁড়ে উঠল একটা ছায়ামূর্তি। বগলে ভারী কিছু জিনিস। সেটা নিয়ে পড়িমরি করে পালাচ্ছে। আমি জোর গলায় বললাম, “কে রে!” আওয়াজ শুনে একবার চকিতে ফিরে তাকাল বোধহয়।

টর্চটা ছিটকে পাশেই পড়েছিল। কুড়িয়ে নিয়ে জ্বালতেই যাব আর দেখি লোকটা দ্বিগুণ স্পিডে দৌড়াচ্ছে। এক বিন্দু সময় নষ্ট না করে , প্রায় পনেরো হাত দূর থেকে তাক করে ছুঁড়ে মারলাম টর্চটা। অব্যর্থ নিশানা। ডান পায়ের পিছনে সজোরে গিয়ে লাগল। লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে ভারী জিনিসটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমি পিছন থেকে তেড়ে গেলাম।

লোকটা জিনিসটার মায়া ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তালগাছের সারির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তালগাছের মাথায় সরু কাস্তের মতো একফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।

টর্চ হাতে নীচে নামতেই আমার রক্ত জল হয়ে গেল। নিথর হয়ে পড়ে আছে চন্দনের নলি কাটা দেহ। চারদিকে তাজা রক্ত!

“পায়ের তলায় জমি, শক্ত লাঠি হাত-

তারিফ করেন তিনি। কাস্তে চাঁদের রাত।

লঙ্কাদহন – করল বাজিমাৎ!

ঘরের মধ্যে ঘর। ধারালো চাই ধাতু।

রইল পড়ে সোনায় মোড়া হাঁটু।

আচমকাই সংকেতটা খুঁজে পাই একটা পুরনো রামায়ণ বইয়ে। গোটা রহস্যটার এটাই খোলা সুতো। বলতে গেলে সবটাই এতে বলা আছে।”

চন্দন খুন হওয়ার পর একটা গোটা দিন পেরিয়ে গেছে। কাল সারাদিন এক মুহূর্তের জন্যও থিতু হতে পারিনি। পুলিশ চলে যাওয়ার পর গোটা বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজে বের করেছি আসল রহস্যটা।

তাকিয়ে দেখি এক রিঙ্কি বাদে সবাই একাগ্রভাবে আমার দিকে চেয়ে। ইন্সপেক্টর মৈত্র, সমীর জ্যেঠু, কাকু-কাকিমা আর চন্দনের মা, পূর্বা আন্টি। টিভির টেবিলে রাখা বোতল থেকে একঢোক জল খেয়ে আবার শুরু করলাম।

“পায়ের তলায় জমি, শক্ত লাঠি হাত – গণেশের সেই গল্পটা। কনকনে শীতের বিভীষিকাময় একটা অধ্যায়। প্রায় একশ কুড়ি বছর আগের এক রাতের ইতিহাস। গোটা গ্রাম পুড়ে ছারখার হওয়ার ইতিহাস। ভালকুঠির লঙ্কাদহন!

সমীর জেঠু , ওটা কাঠের হাঁটুই ছিল। …বাইরেরটা। ভিতরে কাঠের ফাঁকে ফাঁকে চাপ চাপ জমাট সোনা। খুব সম্ভবত এই সোনা, কালেক্টরের নিজস্ব অত্যাচারের রোজগার ছিল। হ্যাঁ,ইতিহাস ঘাঁটলে গিবসন সাহেবের অনেক কৃতিত্বই জানা যাবে। লোকটা পুরোপুরি ভালো মোটেই ছিলেন না।

ডাকাতরা সেদিন খাজনার লোভে আসে নি। এসেছিল ওই সোনার লোভেই। সেটা খুঁজে না পেলেও খাজনার টাকা নিয়েই চম্পট দিয়েছিল।

এদিকে যে ঘরে একবার ডাকাত পড়েছে সেখানে যে আবার পড়বে না তার কী নিশ্চয়তা?

“তারিফ করেন তিনি” – কালেক্টর তারিফ করার ছুতোয় উপহারের মধ্যেই সব সোনা গলিয়ে ভরা করিয়ে ছিলেন। হয়তো প্ল্যান ছিল,ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়ার আগে নতুন হাঁটুর বদলে ওটা নিয়ে নেওয়ার।

কিন্তু না! তার আগেই গভীর রাতে সাপের কামড়ে প্রাণ হারায় গণেশ। সাহেব তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে নাজেহাল। দিল্লি পালিয়ে ছিলেন বোধয়।

গণেশের বাকি দেহ সৎকার করা হলেও, হাঁটুটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল প্রাণের বন্ধু শম্ভু। নিজেও জানত না কী মহার্ঘ জিনিস ঘরে এনেছিল। এই শম্ভু কে ছিলেন জানেন জ্যেঠু?”

“গোবিন্দ খুড়োর বাপ!”

“ঠিক তাই। সোমনাথ কাকুর বাবা, মানে চন্দনের স্বর্গত দাদু হলেন গোবিন্দ মন্ডল। সেই গোবিন্দর বাবা শম্ভু ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে পেরে, পাঁচকান হওয়ার আগেই এক কাণ্ড করে। এই মন্ডল বাড়ির নিচে একটা ছোটো ঘর বানিয়ে সেখানে একটা আশ্চর্য রকমের বড়োসড়ো শক্ত ট্রাঙ্কে তালাবন্দি করে রেখে দেন। বয়সকালে যাতে ভুলে না যান, সেজন্য সংকেত বানিয়ে ভরে রাখলেন রামায়ণের মধ্যে।”

“কাল যখন সারা সকাল ভেবে কিছুই কূলকিনারা পেলাম না,চন্দনের ঘরে একবার ঢুঁ মারলাম। পুলিশ একদফা তল্লাশি করে গেছিল। ঘরে ঢুকে পাপোশে পা মোছা আমার একটা বাতিক। পা দিতেই কেমন একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। যেন পাপোশের ভিতরে কিছু আছে।

কেটে বের করতেই হাতে এল হলদেটে একটা ফাইল। এই ফাইলটা আমি ট্রেনে আসার সময় চন্দনকে বার দুয়েক বের করে পড়তে দেখেছি। ওরই ফাইল। আর তাতেই এই সবকিছু পয়েন্ট আউট করে রাখা ছিল।

শম্ভু মারা যাওয়ার আগে কাউকেই এসব বলে যেতে পারেনি। সংকেতটাও কারও নজরে এসেছে বলে মনে হয় না। ফলে,লাভের গুড় কেউই খেতে পায় নি। তবে এই বাড়িতেই ঠাকুর ঘরের পুরনো ব্রতকথার বইয়ে খাপছাড়া ভাবে লিখে রেখে যান তিনি। খানিকটা আধুনিক ‘ট্রেজার হান্টে’র আদলেই। সেখানেই বলা আছে “হদিশ পাবে রামায়ণে” অর্থাৎ ওই সংকেতটা যেটা আমি আগেই পেয়েছিলাম।

সংকেত থেকেই জায়গাটার সন্ধান পাই আমি। আমাকে থাকতে দেওয়া হয় যে ঘরটায় সেটা বরাবর বন্ধই থাকে। কাজেই চন্দনের জানার কথা ছিল না যে পাতালঘরটা ঠিক আমার রুমের নীচেই!

হ্যাঁ, পাতালঘর। সংকেতের পংক্তিগুলোর প্রথম অক্ষর গুলো যোগ করলে দাঁড়ায় পা-তা-ল-ঘ-র। থ্যাংকস টু রিঙ্কি অ্যান্ড ‘সুখী বাংলা’ ।

চন্দন খুন হওয়ার দিন বিকেলে আমি পুকুর পাড়ে গিয়ে জোর অনুসন্ধান চালাই পাতালঘরের এন্ট্রান্স খুঁজে বের করার। প্রথমে পাতকুয়োটাকেই পাতাল -পাতাল করে ভুল করছিলাম। লাঠি দিয়ে মাটি সরিয়েও কিছু পাচ্ছিলাম না। শেষে যখন সন্ধে হয়েই এসেছিল, হতাশ হয়ে পা ছুঁড়তেই একটা শক্ত মতো কিছুতে হালকা ধাক্কা খেলাম। জায়গাটা তাল গাছের গোড়ায়। পাতকুয়োর ‘পা’ আর তালগাছের ‘তাল’। পাতাল। তখনই একবার মাটি সরিয়ে নেমে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু চারদিক ভালোই অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে যাই। পাতালঘর ঢোকার ঢাকনাটা ওখানেই!”

এই অব্দি বলে একটু থামলাম। ঘর জুড়ে পিনড্রপ সাইলেন্স। রিঙ্কিও দেখি চুপ করে বসে শুনছে। শুধু পূর্বা আন্টি নির্বিকার।

আমি একটু গলা খাঁকরে তাঁকে জিগেস করলাম, “আচ্ছা কাকিমা, উজ্জ্বল কাকুর তো সেলসের জব। সেটা কি রিসেন্টলি কোথাও ধাক্কা খেয়েছিল?”

কাকিমা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বললেন, “লাস্ট ছ’মাস ধরে বেকার। সারাদিন ছুটে বেড়ায় চাকরির আশায়।লজ্জার কথা আর কাকে বলি বলো বাবা! … ছেলেটা আমার ….”ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। রিঙ্কির মা তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। উজ্জ্বল কাকু এখন ভাগ্যান্বেষণে বিহারে। আমি ফের শুরু করলাম।

“বাড়িতে থাকতেই সংকেত সলভ করে ফেলেছিল চন্দন। তাই, এখানে এসে প্রথম দিন রাতেই একবার ঢুকেছিল। একাই। ব্যাপারটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। তখনই ধারালো ধাতুর কেসটা বুঝতে পারে। সেদিন আর ঠোকাঠুকি কিছু করেনি।

এদিকে ওই ঘুপচি ঘরের মধ্যে বাক্সটা ভেঙে দেওয়ার উপায় ছিল না । বাইরে বের করে আনলেও চাপ। তাই, চন্দনের দরকার ছিল তালা ভাঙার ‘ধারালো’ হাতিয়ার।

এই ব্যাপারটা মাথায় স্ট্রাইক করল গতকাল বিকেলে। হাই রোড দিয়ে হাঁটছিলাম। ভুবনদা বাড়ি ফিরছিল। আমাকে দেখে চুপিচুপি বলল ভটভটিতে উঠে পড়তে।

মনে আছে রিঙ্কি, যেদিন তোকে ছবি এঁকে দিচ্ছিলাম দুপুরে,চন্দন কোথায় গেছিল বলেছিল?”

“ওই তো, বাবার ওষুধ আনতে। কিন্তু বাবার তো শরীর খারাপ করেনি সেদিন।”

“ঠিক তাই। আর কাকুকে বলে গেছিল আমার জন্যে প্রজেক্ট ফাইলপত্র আনতে যাচ্ছে। আসলে সেদিন ও লাভপুরের কামারশালে গেছিল তালা ভাঙার অস্ত্র বানাতে। ভুবনদা লাভপুর প্রায়ই যায় তার ভাইয়ের কাঠের ব্যবসার কাঁচামাল আনতে। বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া কামারশাল থেকে চন্দনকে বেরোতে দেখে সেদিন।”, আমি একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলাম।

“চন্দন খুন হত না। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারলে …..

“মুশকিল করল চন্দন নিজেই, আমার দুধে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে। আমার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে যা হওয়ার হয়ে গেছিল। যে মুহূর্তে ট্রাঙ্ক খুলে হাঁটু বেরল অমনি নিজের হাতে বানানো ধারালো ছুরি দিয়ে চন্দনকে খুন করল লক্ষ্মণ।”

“হ্যাঁ, লক্ষণ! সে ছাড়া লাভপুরে কামারশালের হদিশ কে দেবে? ইন্সপেক্টর মৈত্র অলরেডি লোক লাগিয়ে জানতে পেরেছেন, সেদিন ওই কামারশালে চন্দনের সঙ্গে সেও ছিল। ভুবনদার চোখে পড়েনি। তাছাড়া, ছুরিটা চন্দনের বডির পাশেই পড়েছিল। হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।

ওরা ছোটবেলার ভালো বন্ধু ছিল। চন্দন ওকে বিশ্বাস করেছিল। লোভ কী ভয়ানক রোগ!”

আজ ভোরের বাসে লক্ষ্মণ ধরা পড়েছে। সাঁইথিয়া থেকে আজিমগঞ্জ এক্সপ্রেস ধরার তালে ছিল। কাছে পিঠে সব জায়গার পুলিশ স্টেশনেই কাল রাত্রে অ্যালার্ট দিয়ে রেখেছিলেন মিস্টার মৈত্র।

“আমার পৌঁছতে আরেকটু দেরি হলে লক্ষ্মণকে ধরা হয়ত অসম্ভব হয়ে যেত। সেই সঙ্গে গণেশের হাঁটু, যেটা আপাতত পুলিশের জিম্মায়! … হায় রে চন্দন, ঘুমের ওষুধটা না মেশালেই পারতি।”

সেদিন দুপুরেই খেয়ে দেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এসেছিলাম প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কত মজা করতে করতে, আর ফিরছি বন্ধুহারা হয়ে!

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত