বিমল বা পরিমল নামদুটো সাধারণত নরসুন্দরদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেলেও চাঁদশীর বিমল চক্কোত্তি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নাম শুনেই বোঝা যায় বিমলকাকু ব্রাহ্মণ, তবে না দেখলে বোঝা যাবেনা ব্রাহ্মণ সত্ত্বা তাঁর মধ্যে কতটুকু বিরাজমান।
ভদ্রলোক তিরিশ পেরিয়েছেন বহু আগেই। মুসার মনে হয় তিনি তিনি পঁয়তিরিশের কম হবেন না কিছুতেই। এখনো বিয়ে-থা করেন নি। আদৌ করেন কিনা সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
মুসার আসল নাম অবশ্য এটা নয়। সে তিন গোয়েন্দার মুসা আমানের নামে নিজের নামকরণ করেছে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। পিতৃদত্ত নামের এহেন অসম্মানে তার বাবা তাকে ঝুড়ি বানানোর জন্য রাখা বেত দিয়ে কিঞ্চিৎ আদর করেছে। অবশ্য তাতেও মুসার দন্তবিকাশ প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি।
মোটামুটি মাথামোটা মুসার সাথে বইয়ের চরিত্র মুসা আমানের অবশ্য কয়েকটা মিল আছে। সে-ও মুসার মতই ভোজনরসিক। অবশ্য ভোজনরসিক না বলে খাদক বলাই শ্রেয়। ভূতের ভয় আছে বেদম, কথায় কথায় ‘খাইছে, মারছে’ বলে। আর ‘মাথামোটা’ যে তা আগেই বলা হয়েছে।
মুসা ফিরছিলো চাঁদশীর মেলা থেকে। প্রতি ৯ই বৈশাখ এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মুসা ইতোমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আধা সের জিলাপি সাবাড় করে দিয়েছে। ওর একহাতে বড় একটা ব্যাগ, তার মধ্যে মেলা থেকে আনা নানারকম খাবার আছে, আর আছে ছোটবোনের জন্য নেয়া খেলনা। আঙুলের ফাঁক গলে বের হওয়া জিলাপির রস শুষতে শুরু করলো ও। গতকাল ঠাণ্ডা লেগে সর্দিতে নাক বুজে আছে। জিলাপির রস শুষতে শুরু করায় নাকে-মুখে মিলে অদ্ভুত সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি হলো।
কালীমন্দিরটা পেরিয়ে ইট বসানো রাস্তার উপর দিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে মুসা তার সফল চৌর্যবৃত্তির কথা ভাবতে লাগলো। অবশ্য ও এটাকে চুরি বলতে নারাজ। ও আর ওর কয়েকজন কাজিন মিলে তিন গোয়েন্দার মতই একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছে। অবশ্য নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবেনা। ওদের কোনো স্থায়ী হেডকোয়ার্টার নেই, নেই গোয়েন্দাদের প্রয়োজনীয় কোনো সরঞ্জাম। এখনো কোনো কেইস-ও পায়নি। তো সেদিন কথায় কথায় ওদের তথাকথিত কিশোর পাশা বলেছিল, “বুঝলি রে হাঁদারাম, কেইস না পেলে তৈরি করতে হবে। ধর, তুই চাস ডাকাতির কেইস, কিন্তু রঘু ডাকাতের কেচ্ছা বইয়েই পড়েছিস; এখনকার বড় বড় ডাকাতেরা সব সাহেব বনে গিয়েছে। তো কী করবি?” কিশোরের এই সমস্যা, নিজেকে বইয়ের কিশোরই ভাবে, আর বইয়ের ভাষার মত কথা বলে। “ডাকাতেরা সাহেব বনে গেছে, এই ‘সাহেব বন’টা কোথায়” জিজ্ঞেস করাতে বরাবরের মতই প্রচণ্ড ধমক খেয়েছিলো অবশ্য। কিন্তু কিশোরের কথাটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো, কেইস না পেলে তৈরি করতে হবে; চুরির কেইস না পেলে নিজেই চুরি করে কেইস দাঁড় করাবে! মেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে বিভিন্ন দোকান থেকে জিনিসপত্র সরানো কঠিন কিছু নয়, দোকানদার একটু অসতর্ক বা ব্যস্ত হলেই হয়। তবে হ্যাঁ, সেজন্য বুকের পাটা থাকতে হবে। আর মুসা সেটা ওর আছে বলেই ভাবে; গপ গপ করে দু’-তিন থালা ভাত গেলাতে অবশ্য বুকের পাটার কতদূর কী হয়েছে বলা মুশকিল, ভুঁড়িখানা সগর্বে নিজ অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ভালোই!
দুইটা ছুরি, একটা সস্তা বাইনোকুলার, একটা খেলনা পিস্তল, একটা টেনিস বল আর কয়েকটা ভিউকার্ড – এই হলো মুসার প্রতিভার নমুনা। প্রথমদিনেই নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই চমৎকৃত ও, মেলার বাকি দুই দিনেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তাক লাগিয়ে দিতে চায় ওদের গোয়েন্দাপ্রধানকে।
ডানহাত আঠালো হয়ে গেছে। সামনে আরেকটু গিয়ে বাবুলালের বাড়ির আগে যে বাগানটা আছে, সেখানকার পুরনো ঘাঁটসংবলিত পুকুরে হাত ধোয়ার কথা ভাবলো ও। এই বাগানে একটা পুরনো মঠ আছে, এখন ঝোপঝাড়ে আকীর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এলাকার অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুরা ভারতে পালিয়ে যাবার সময়ে এই মঠের মধ্যে তাদের ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলো বলে গুজব আছে। অবশ্য গুজব সত্যি বলে ভাবা হয়েছিলো যখন কাছেই ঘর বানিয়ে থাকা ঠাণ্ডু মিয়া সোনার পাত পেয়েছে বলে চারদিকে খবর রটে যায়। সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ হয়নি, কারণ এরপরে ঠাণ্ডু মিয়াকে কেউ দেখেনি। শুধু মঠের পাশের ঝোপে খননের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা নিয়ে কিশোরের মাথার চুল ছেঁড়ার মত অবস্থা। কারণ হাতের নাগালে থাকার পরেও গুপ্তধন সংশ্লিষ্ট বড় একটা কেইস হাতছাড়া হয়ে যাওয়াটা কোনো ‘জাত গোয়েন্দা’-ই মানবেনা।
দূর থেকে মঠটা দেখা যাচ্ছে, এমন সময়ে মুসার বাম হাতে ব্যথায় ‘চিনিক’ করে উঠলো। একটানা অতটা পথ বাম হাতে ব্যাগটা নিয়ে এসেছে, ব্যথা হওয়াটা স্বাভাবিক। সাথে সাথে ব্যাগটা নামিয়ে বসে পড়লো ও। ভাবলো, হাত ধোয়ার আগে আরো দুয়েকটা জিলাপি খেলে মন্দ হয়না। এদিকটায় গাছপালার রাজত্ব, তার মধ্য দিয়ে সরু পথ চলে গেছে, মিশেছে ‘চাঁদশী টু সোমদ্দারপাড়’ রাস্তার সাথে। একটা জিলাপি বের করে মুখে দিবে, এমন সময় চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে থমকে গেলো ও। তাকিয়ে দেখে বিমল কাকু কেমন চোরের মত করে এগুচ্ছেন, তার লক্ষ্য মঠের দিকে। মুহূর্তে মুসার মধ্যে গোয়েন্দা সত্ত্বা জেগে উঠলো। জিলিপিটা কাগজের মোড়কে ঢুকিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আস্তে করে পাশের ঝোপে ঢুকে পড়লো ও।
বিমল কাকুর মুখে ক’দিনের না কামানো দাড়ি। তিনি গোল গলার ঢোলা একটা গেঞ্জি পরে আছেন, আর না ধোয়ার কারণে নোংরা হয়ে যাওয়া একটা ধুতি। এখন তিনি মুসা যে পথ দিয়ে এসেছেন সেদিকে তাকিয়ে আছেন। মুসার ভয় হলো, ওকে দেখে ফেলেনি তো! আবার ইতিউতি তাকাচ্ছেন, একবার মন্নান হাওলাদারের বাড়ির দিকে, একবার ঠাণ্ডু মিয়ার ঘরের এপাশে পানের বরজের দিকে। মুসা ভিতরে ভিতরে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠলো। নিশ্চিত কাকুর মনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে! এদিকে কাকু চারদিক তাকিয়ে মঠের ওপাশে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মুসার বুকে উত্তেজনায় হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ব্যাগটা বের করে সাবধানে উঁকি দিলো ও। নাহ, বিমলকাকুর টিকিটির-ও দেখা নেই। অবশ্য তাঁর মাথায় টিকি-ও নেই! মুসা সিদ্ধান্ত নিলো ঝোপের ওপাশে যাবার। দেশ ও দশের বৃহত্তর উন্নতির স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী। কে জানে, বিমল কাকুর ওই ভোলাভালা চেহারার পিছনে আন্তর্জাতিক বড় কোনো চক্রান্তকারী লুকিয়ে আছে কিনা! ব্যাগটা নিয়ে সামনে পথের উপরে রাখলো। এবার আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে মঠের ওপাশে এগুতে লাগলো। মৃদু গোঙ্গানি শুনে কলিজাটা ধড়াস করে উঠলো ওর। গলাটা বিমলকাকুর। মুসার আর সহ্য হলো না। দ্রুত ঝোপের ওপাশে গিয়ে উঁকি মারতেই চমকে উঠলো ও।
ঝোপের পাশে বিমল কাকু ওদিক ফিরে বসে আছেন। তবে, যোগাসনের ভঙ্গীতে নয় অবশ্যই। পরনের ধুতিটা কিছুটা উর্ধে অবস্থান করছে। আর বিমল কাকু একটু পর পরই মৃদু গোঙ্গানি দিয়ে যাচ্ছেন। সেটা অবশ্য তার শরীরের বাড়তি চাপ প্রয়োগের জন্য হচ্ছে। সোজা কথায় বলতে গেলে, বিমল কাকু প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করছেন, আর ঘটনাস্থলে দৃশ্য-শব্দ মিলিয়ে ভালোমতোই বোধগম্য হচ্ছে যে কাকুর কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে!
উত্তেজনার এমন ছন্দপতন মুসা মানতে পারলোনা। পাশ থেকে এক টুকরো পুরনো ইট তুলে ছুঁড়ে মারলো কাকুর আপাত উর্ধে অবস্থান করা শরীরের দিকে। কলাতলা স্কুলে আমগাছে ঢিল মেরে মেরে আম পেড়ে ওর হাতের টিপ নিখুঁত হয়ে গিয়েছে। ইটের টুকরোটা মোক্ষম জায়গাতেই গিয়ে লাগলো। পর মুহূর্তেই বিমল কাকু আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। আর মুসার পায়ে যেন পাখা গজিয়েছে, পথের উপর থেকে ব্যাগটা বগলদাবা করেই ছুট। দৌড়াতে দৌড়াতেই ও ভাবলো, আজ রসিয়ে বলার মতো অনেক কিছুই ভাণ্ডারে জমা হয়েছে!