শহরে আতংক

শহরে আতংক

পাঠিয়েছেন আমাদের জনৈক পাঠক বন্ধু -হাসনাত ৭দিন পর আজ অফিসে যাচ্ছে আবির।এই সাতদিন ঘর বন্দি হয়ে ক্লান্ত আবির কিছুটা মুক্ততা অনুভব করলো।এই সাতদিন আবির তার জীবন থেকে মুছে ফেলেছে।এই সাত দিন তার সাথে কি কি ঘটেছে আবিরের কিছুই মনে নাই।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই আবির তার পাশের টেবিলে ক্যালেন্ডার এর দিকে তাকিয়ে অবাক। সে ২১-৯-১৭তারিখ রাতে ঘুমাতে যায়। আর আজ ২৯-৯-১৭।কি ভাবে সম্ভব?

অফিসে ঢুকতেই বস এর সাথে দেখা।”কি ব্যাপার আবির?এত দিন পর? কি হয়েছিল?খবর পাঠালাম তুমি নাকি বাসায় নাই?”আবির যদি বলে সে সাত দিন ঘুমিয়ে ছিল তা কেও বিশ্বাস করবে না বরং তার উপর সবাই হাসবে।তাই অন্য বুদ্ধি আঁটতে হলো। বলল,”গ্রামে এক ফুপি মারা যায় তাই গ্রামে যেতে হয়ে ছিল। আর তা হঠাৎ করে হয় তাই খবর দিতে পারিনি।”একটা ফোন অন্তত করতে!নাকি ব্যালান্স নাই?”আমার মোবাইল টা গ্রামে যাওয়ার সময় চুরি হয়।”ওওও এইজন্যই তো বলি রিং বাজে তবুও ফোন ধরেনা!এটা তো হতে পারেনা। আচ্ছা যাও এখন মন দিয়ে কাজ কর তো। অনেক সময় নষ্ট করেছ।”

নিজের জায়গায় এসে আবির বুঝতে পারে এই সাতদিন কাজ না করার পরিণতি । ভরপুর কাজে ভরা। দম নেবার সময় নেই। টানা কাজ করতে করতে আবির ক্লান্ত হয়ে তার কলিগ রায়হান এর রুমে যায়। যখনিই অফিসের কেউ ক্লান্তি অনুভব করে সে রায়হান এর রুমে চলে আসে ।আবার অনেকেই শুধু গল্প করতে আসে।কারন এই খানে শুধু হাসির গল্প চলে রায়হান সবাইকে হাসিয়ে ছাড়ে। তবে আজকে কোন হাসির গল্প হচ্ছে না।। রায়হানের পাশে পাচঁটি চেয়ার। পাচঁজনই খুব আগ্রহ নিয়ে রায়হান এর কথা শুনছে।রায়হান তার হাতে ধরে থাকা খবর কাগজ পড়ছে।

“””””শহরে আতংক””””

প্রত্যেক দিন এক জন এক জন করে খুন হচ্ছে এই শহরে।মাত্র সাত দিন এই সাত দিনে খুন হয়েছে দেশের সাত মাথা। কে করছে এই খুন কেনই বা করছে?পুলিশ এখন ও কিছু করতে পারছেনা। এইটুকু পড়েই রায়হান বক্তৃতা দেওয়ার মতো বলে ওঠে :” মাত্র সাতদিন? এরা সাত বছরেও খুঁজে বের করতে পারবে না। আমি ১০০%গ্যারান্টি দিতে পারি.””না পারাই তো ভালো।আপনার কি মনে হয় না এই সাতটা খুন একে ওপরের সাথে জড়িত”? এত ক্ষন পর সবাই আবিরের দিকে তাকালো। কেও টেরই পায় নাই সে কখন এলো।”হ্যা। সবাই ধরে নিয়েছে এই সাতটা খুন জড়িত। কিন্তু ভালো হবে কেন?””আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি এই সাতটা মাথা কারা। বাকি টুকু পড়েন।”রায়হান খবর কাগজে কিছুক্ষণ চোখ রেখে বললো :”ঠিক বলেছেন। একেবারে রাঘব বোয়াল গুলো মরেছে। দেশটা মনে হয় এখন একটু শান্তি পাবে।তো আপনি তো দেখছি খুব ভালোই খবর রাখেন।” আবিরকে কিছুটা বিচলিত লাগলো কারন সে তো নিজেও খবর জানে না।

সাজিদ:-টানা সাতটা খুন এর তদন্ত করা কি এতই সহজ? কোন ক্লু নেই। এভাবে আমরা কি বের করবো? খুনি?

আইজি :-তাহলে আপনি এই কাজ করছেন কেন? ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন এই পুলিশের চাকরি আর শুরু করেন খুন।

সাজিদ :-স্যার আপনি নিজেই ভাবুন এইভাবে আমরা কিভাবে তদন্ত করব? রাস্তায় এখন শুধু মারামারি কাড়াকাড়ি চলছে।গত ৭দিনে যে সাতটা খুন হয়েছে।এর পরেও কি এই দেশের মত কোন দেশ শান্ত থাকে? সব দলের লোক এখন গ্যাঞ্জাম শুরু করেছে।আমরা এই গ্যাঞ্জাম মিটাবো না তদন্ত করবো?

আইজি :- সেটা আপনার ভাবার বিষয়। আপনাকে আর ৪৮ঘন্টা দেওয়া হলো।এর মধ্যে খুনিকে না ধরতে পারলে আর এই ড্রেস আপনাকে পরতে হবে না। এখন যাই। আইজি চলে গেলে। সাজিদ এই কেসের ফাইল টা নিয়ে আবার বসলো।

১ম দিন এই দেশের এক নামি দামি ব্যবসায়ী খুন হয়।জানা যায় সে ড্রাগস ব্যবসার সাথে জড়িত। অস্ত্র ব্যবসারও কারবার আছে। তবে এই গুলো আড়ালে। সামনা সামনি সিমেন্ট এর ব্যবসা করে। ২২তারিখ রাতে সে গায়েব হয়। আর ২৩ তারিখ ভোরে ধানমন্ডির এক ডাস্টবিনে তার ছিন্ন ভিন্ন লাশ পাওয়া যায়। লাশের চোখ, জিহ্বা, কান,মগজ ছিল না। পেট কেটে কিডনি নিয়েছে।আর ঘাড়ে ব্লেড দিয়ে কেটে লেখা আছে # সাইকো। পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে এটা কোন পাগল সাইকোই করেছে। পাগলামো ছাড়া আর কিছু না তবে এটা কোন প্রফেসনাল এর কাজ।

বাকি ৬টা খুন ঠিক একই ভাবে করা হয়েছে।তবে লাশগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় পাওয়া যায়।এরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে অপরাধের সাথে যুক্ত । তা আবার ছোট খাটো অপরাধ না বড় বড় অপরাধ।তবে এইসব গুলো খুন-ই ঢাকার মধ্যে হয়েছে। আর সবাই রাতে গায়েব হয়ে গিয়ে কোন একটা ডাস্টবিনে উদয় হয়েছে।এদের প্রত্যেকেরই কান,জিহ্বা, চোখ পাওয়া যায়নি। সাথে পেট কেটে কিডনিও নিয়েছে। এখন তদন্তের শেষ ভরসা আবার নতুন থেকে শুরু করা।

প্রচুর কাজ করে ক্লান্ত আবির বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বাসায় ফিরছে। প্রচুর কাজের চাপে আবির ভুলেই গেছে তার সকালের ঘটনা।এখন শুধু বাসায় যেয়ে কোন মতে খেয়ে ঘুমাতে পারলেই হলো।আসার পথে রফিক ভাই এর দোকান থেকে খাবার কিনে যেয়ে অবাক হতে হয় আবির কে।দোকানে ঢুকার সাথে সাথে রফিক ভাই বলে উঠলো “কি ব্যাপার আবির ভাই এত দিন কই ছিলেন?দোকানে আসেন না?”(রফিক ভাই) কথা টা শুনেই সকাল বেলার সব ঘটনা আবিরের মনে আসল।

সে বেশি কথা না বাড়িয়ে গ্রামের কথা বলে খাবার নিয়ে বাসায় চলে আসে। এই সব কি ঘটছে তার সাথে?কিছুই বুঝতে পারছেনা আবির।তার ফোনটাও গায়েব। সকালে অফিসে মোবাইল না পেয়ে ভেবে ছিল বাসায় মনে হয় মোবাইলটা রেখে এসেছে। কিন্তু এখন বাসায়ও পাওয়া যাচ্ছেনা। সকাল হতে না হতেই কলিং বেল এর আওয়াজে আবির এর ঘুম ভাঙে।এত সকালে কে আসবে।কারো তো আসার কথা না।দরজা খুলতেই আবির অবাক। পুলিশ এসেছে।তার কাছে পুলিশ কেন আসবে।

সাজিদ :-আসতে পারি?

আবির :-হ্যা আসেন। কিন্তু আমার এখানে কি?

সাজিদ :-জানতে পারবেন।কিন্তু এখানে না।ভিতরে বসে কথা বলা যায় না?

আবির :-আসুন।

সাজিদ আবির এর পিছন তার বসার ঘরে একটা সাধারন চেয়ারে বসে।তার সামনে আবির আরেকটা চেয়ার নিয়ে বসে।

সাজিদ:-আপনি কিছু মনে না করলে কিছু কথা জানতে পারি?

আবির :-কি বিষয় নিয়ে ?

সাজিদ :-সেটা আপনার ব্যক্তিগত হবে। কিন্তু আপনি যদি সঠিক তথ্য দেন তাহলে আমাদের তদন্ত করতে সুবিধা হবে। এটা সাতটা খুন এর কেস।

আবির :-দেখুন এই সাত টা খুনে আমি কোন ভাবেই জড়িত নই।

সাজিদ :-তাহলে এই সাতদিন আপনি কই ছিলেন?

আবির :-আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আমার একটা ফুপি মারা যায়। তাই আমার গ্রামে যাওয়া লাগে।আর যাওয়ার সময় আমার মোবাইল চুরি হয় তাই কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি।

সাজিদ :-আপনি কি আমাকে আপনার অফিসের বসের মতো গাধা মনে করেন?

আবির :-কেন?

সাজিদ :-আপনার গ্রামে কি আর কারো মোবাইল নাই?আর আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনার কোন ফুপিই নাই তো মরলো কে?আর আপনি গ্রামেই যান নাই।আপনি এই সাত দিন ঢাকাতেই ছিলেন।আর আপনি ২৫তারিখ ১১নম্বর এলাকায় কি করতে গেছিলেন? কোনও উত্তর দিতে পারল না আবির। চুপ করে রইল।

সাজিদ :-কথা বলুন। আপনি ২৫তারিখ ১১নম্বর কেন গেছিলেন?

আবির :-আমি ১১নম্বর জাইনি।

সাজিদ :-তাহলে আপনার মোবাইল কি হাওয়াতে ভেসে ভেসে সেখানে গেল?

আবির :-আমি কিছুই জানি না।

সাজিদ :-তাহলে তো আপনাকে জেলে যেতে হয়। কারন ২৫ তারিখ আপনার মোবাইলটা আমরা পৌরমন্ত্রি এর ডেড বডির পাশে পাই।

আবির :-কি বলছেন আমি এই সবের কিছুই জানি না।

সাজিদ :-আপনার আর কিছু জানা লাগবে না। এখন জেলে চা নাস্তা খেয়ে সব সত্যি কথা বললেই হবে।

সকাল বেলা আবিরকে জেলখানায় ঢুকায় সাজিদ । এর আগে আবির কখনো জেলে যায়নি। সারা দিনে দুইবার উত্তম মাধ্যম খেয়ে আবির তার সাতদিন টানা ঘুমের কথা জানায়। সবাই পাগলের প্রলাপ ভেবে উড়িয়ে দেয়।এখন জেলখানায় অলসতা নেমে এসেছে হয়তো রাত হয়ে গেছে।হালকা হলুদ রংয়ের আলো জেলখানা কে আরো অন্ধকার করে দিয়েছে।চার দেয়ালের মধ্যে আবির একা একা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো -আবির তোর চিন্তা নেই।

তোকে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা। এই অবস্থায় এইরকম স্বান্তনা আবির কে অসাধারনতা ভুলিয়ে দেয়।সে দেখতে পায় তার পাসে সে-ই বসে রয়েছে। তবে তার অন্য কিছু রয়েছে যা আবিরকে মুগ্ধ করেছে। আবির আবিষ্টের মতো বলে ” হ্যাঁ, আমি জানি”। জেলের পাশে পাহারারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল আবির কে একা কথা বলা অবস্থায় দেখে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবে না। পরের কিছুক্ষণ পর আবির কে জেলখানায় আর খুঁজে পাওয়া যায়না।চার দেয়ালের মাঝখান থেকে উধাও! সবাইকে চিন্তায় ফেলে দেয়। রাস্তায় আনমনে হাঁটছে আবির। তার এখন কি করা উচিত? সে জানে না।

আজকে আবির তাকে চিনেছে। সে গত ৮দিন ধরে তার সাথে। সে দেখতে আবির এর মত।তার নাম সাইকো।কারো নাম সাইকো হয়?তার নাম সাইকো না।ওরা ওর নাম সাইকো রেখেছে। কি দোষ ছিল তার?একটু পাগল টাইপ ছিল বলে?হাহ হাহ হাহ। রাস্তায় এত জোরে হাসা উচিত না। সামনে কিছু কুকুর তাদেরকে দেখতে পায়। তারা সামান্যতম আওয়াজ টা না করে বরং তাদের সাথি হলো। ভালোই হলো রাস্তায় কেও আর আবিরকে পাগল ভাববে না। কেও ভাববে না সে অদৃশ্য সাইকোর সাথে কথা বলছে। কেও আর জানবে না সে সাইকোর বেদনার কথা শুনছে। সবাই ভাববে সে কুকুর এর সাথে কথা বলছে।তাতেও কি সবাই তাকে স্বাভাবিক ভাববে?নাকি আরো বড় পাগল ভাববে?সমাজ কি তাদের নাক গলানোটা বাদ দিবে?

সাজিদ এর চাকরি চলে গেছে। তার জায়গায় এক বয়স্ক বৃদ্ধ কে এই মামলার ভার দেওয়া হয়েছে । সবার ধারনা আমি ও হয়তো এর সাথে জড়িত ।হা হাহাহা হা হা।এরা এদের কাজ করুক আমি আমার মতো কাজ করবো। কিন্তু সাংবাদিক রা এখনো তাকে শান্তি দিচ্ছে না। খবর কাগজে প্রথম কাগজেই তার ভন্ডামি নিয়ে বিরাট বক্তব্য।আবির তা দেখছে আর হাসছে।এখন আর তার কিছু করার নেই।

আপাত দৃষ্টিতে বয়স্ক আব্দুর রহমান ও শান্তিতে নেই।তাকেও সাংবাদিক রা একই ভাবে জেরা করছে।অন্যদিকে নতুন ভাবে কেস হাতে পরায় সব নতুন থেকে শুরু করতে হচ্ছে। সবাই এখন শুধু আবির কে খুজছে তন্য তন্য করে খুঁজেও আবিরের ছায়াও পাওয়া যাচ্ছে না।

সাইকো তার জীবনের সব ঘটনা একটার পর একটা আবির কে বলেছে। কোন ছিটা ফোটা অংশও বাদ যায়নি। সাথে তার এই সাত দিনের ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলেছে সে। সাথে এটা বলতে ভুলে নি সাইকো। সে আরোও সাতদিন এই শহরে আতঙ্ক ছড়াবে। আবিরের মুখে এখন অবাক হওয়ার অনুভূতি বিন্দু মাত্র নেই । বরং তার মুখে এখন এক বিদ্রূপ এর হাসি।আবার এই শহর টি সেই সাত দিনের মতো আতঙ্কে পরবে। মুখোস পরা সেই বড় বড় ব্যক্তি রা ভয়ে কেঁপে উঠবে। হয়তো বা তারা বছর বছর যাদের কে জালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে তাদের আঁচলে মাথা গুজবে। না হয় ভালো মানুষের মুখোশ পরে যাদের কে দিনের পর দিন ঠকিয়েছে তাদের কাছে নিরাপত্তা চাইবে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত