রেনোয়া নির্মীত ফিল্ম এর মধ্যে ‘রুলস অব দ্যা গেইম’ নামটি আমার ভীষণ প্রিয়। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম নামটি কোথাও ব্যবহার করি। সুযোগ বুঝে মেরে দিলাম
১. জুই খুব সাধারণ মেয়ে। খুব সাধারণ তার জীবন যাপন। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার বয়স কুড়ি। প্রথম নজরেই তার চেহারার যে বিষয়টি সবার নজরে পরে তা হল বিষন্নতা। আর কারো কথা জানি না তবে জুই প্রমান করতে পেরেছে যে বিষন্নতাও মানুষের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারে। বন্ধুমহলে জুই ‘বিষন্ন সুন্দরী’ হিসেবেই খ্যাত।
তার বাবা আজগর সাহেব, প্রায় শিল্পী হতে হতে এখন একটি দ্বিতীয় শ্রেনীর বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ হেড। বাবা যখন শিল্পী হওয়ার চেষ্টায় অপ্রকিতস্থপ্রায় ঠিক তখন তার জন্ম। বাবার সাফল্য ও ব্যর্থতার সন্ধিক্ষণে এবং সংসারের চরম টানাপোড়নের সময় তার মা বিদেশ পাড়ি জমায়, অন্য মানুষ(তার অবশ্য বন্ধুই ছিল) বিয়ে করে।
সচারচর যেমন কাহিনী হয় তেমন আর কি! স্রেফ কাগজ কলমের সম্পর্ক নয় বলে কিংবা সে তার বাবাকে প্রচন্ড ভালবাসে বলে কিংবা উকিলী ফ্যাসাদে সে তার বাবার পক্ষে ভোট দিয়েছিল বলে, এখন বাবার সাথেই তার বাস। মেয়ের কারণেই তার বাবা চাকরি নেন এবং অতি অল্পের মধ্যেই নিজেকে কর্পোরেট শিল্পী হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন।
বাবার মতে, পৃথিবীর বুকে আরও একজন অশিল্পীর জন্ম হয়। সেও অনেকদিন আগের কথা। এখন জুইয়ের বয়স কুড়ি। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বাবা-মায়ের প্রাক্তন প্রেমের সম্পর্ক, পরবর্তী সাংসারিক জটিলতা, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা এনসব কাহিনী জুইয়ের মনে নানা দ্বীধার সৃষ্টি করেছে।সম্পর্কের বিশ্বাসে আস্থাহানি। আর তাই, অনেক আগ থেকেই ও হিসেব-নিকেষ কষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, প্রেম একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর থেকে একশ হাত দূরে থাকুন। কিন্তু প্রেম যে ওর থেকে দূরে থাকতে নারাজ।
একে সুন্দরী, তার উপর একটু আধটু গানও জানে সুতরাং ছেলেরা পিছু তো নেবেই। অবশ্য এ ধরনের ছেলেদের কিভাবে এড়াতে হয় সে বিদ্যা ও কৈশর থেকেই চর্চা করে আসছে।কিন্তু ওর সকল বিদ্যা এসে মার খেয়েছে মিলনের কাছে। সে একটা যন্ত্রনা। সে একটা নাছোড় বান্দা। সে একটা সুপার গ্লু। সে একটা কিছুদিন হল এই ছেলেটা জ্বালিয়ে মারছে তাকে।রাত নেই দিন নেই ফোন। দেখা করতে চায়। দেখা করে। সিনেমার মত প্রেমের প্রস্তাব দেয়।
মোদ্দাকথা আপদমস্তক তার পুরোটাই পাগলামি। এবং জুই ঠিক জানেনা এই ছেলেটা তাকে জ্বালাতে বিচিত্র সব সময় খুঁজে বের করে কেমন করে। যেমন- রাত দুটো। তাবত মানুষ ঘুমে। তখন তার সাধ হয় জুইকে দেখার। শুক্লপক্ষে জোসনা ভাগাভাগি, কৃষ্ণপক্ষে আঁধারে স্নান করতে চায়। দুপুর একটা।সুর্য মধ্য গগণে। তখন তার সাধ হয় জুইকে নিয়ে পিচগলা রাস্তায় হাঁটার! বলা চলে সে কেবল দুদিন জ্বালাতন করে, যেদিন বৃষ্টি হয় আর যেদিন হয় না।জুইয়ের বন্ধুদের মধ্যে অপূর্ব প্রধান।
সে ফিচেল ধরণের ছেলে।ধূর্ত এবং কৌশলী। সে একদিন মিলনকে ফাঁদে ফেলে। অন্য বান্ধবীকে দিয়ে ফোন করিয়ে ক্যাম্পাসে লাইব্রেরীর সামনে এনে একটি দীর্ঘ ‘বহিরাগত পেটাও’ মার দেয় ওকে। জুইয়ের ব্যাপারটায় মত ছিল না একদম। কিন্তু কি আর করা! বন্ধু হিসেবে এতটুকু কাজ করার অধিকার অপূর্ব রাখে। তারপর বেশ কয়েকদিন হাপ ছেড়ে বাঁচল। মিলনের কোন খোঁজ নেই। ও ভাবল, চিকিতসা করাতে দেশের বাইরেই গিয়ে থাকবে হয়ত। তা যাক। সেখানেই কোন সুন্দরী নার্স পাক।মন দেয়া নেয়া হোক। জুই বড় বেঁচে যায়।
২. একদিন, এমনি দুপুর বেলা। জুইয়ের ক্লাস নেই। একা বাড়িতে। ইতস্তত বই পড়ছিল। আদি ভৌতিক রহস্য উপন্যাস। স্টিফেন কিংয়ের। আধো ভয়, আধো নয় এমন অবস্থা। হঠাত দুপুর ভেঙে সেল ফোনটা বেজে ওঠে।
জুই একটু চমকে ফোনটা ধরে।আননোন নাম্বার।কিন্তু নোন ভয়েচ।ওহ শিট!দ্যাট পেইন এগেইন! মিলন!ব্যস্ত কোন রাস্তা থেকে সে ফোন করেছে। আশপাশে প্রচুর গাড়ির আওয়াজ, তাই গলা উঁচু। সেখানে জরুরী ভাব। হ্যালো! আমি মিলন। শোন জুই, আমি এখন একটা রাস্তার মোড়ে। তুমি যদি এই মুহূর্তে আমাকে ভালবাসি না বল তাহলে আমি গাড়ির নিচে লাফ দেব।কোন রকম ভূমিকার ধার ধারে না মিলন।
আপনার যা খুশি করতে পারেন। এইরকম বলপূর্বক সরাসরি এ্যাপ্রোচে জুই রীতিমত বিরক্ত। আর কথারই বা কি শ্রী। একদম বিশ্রী।এ কেমনতর ছ্যাবলামো! আমি কিন্তু গড ড্যাম সিরিয়াস জুই ভাবে মারের পর ডায়লগে একটু হলিউডি ভাব এসেছে ছেলেটার।
আমিও সিরিয়াস জুই হঠাত খুট করে একটা আওয়াজ পায়। সম্ভবত মোবাইল পড়ে যাবার। একটা আর্তচিতকার। তারপর অসংখ্য মানুষের কোলাহলের আওয়াজ। ক্রমে বাড়ে। অন্য আর একটা গলা কাছে এগিয়ে আসে। এই যে ভিকটিমের ফোন। ও মাই গড! লাইন এখনও চালু! হ্যালো, আপনার সাথে কথা বলতে গিয়েই কি ..
– কি হয়েছে?
সরি! হি ইজ ডেড। মাথা পুরোটাই থেতলে কি?! জুই হতভম্ব। ভয়ে হাত থেকে ফোনটা ফেলে দেয়। যেন একটা বিষাক্ত সাপ ধরে আছে সে।
একটা মানুষ, জলজ্যান্ত একটা মানুষ! কথা বলছিল! হঠাত সে মৃত!কি অস্বাভাবিক! কি অদ্ভুত! জুইয়ের পৃথিবীতে এমন ভয়ংকর ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি মা চলে যাবার সময়ও না।
সকাল থেকে বিকাল গড়ায়।সন্ধ্যা হয়।কিন্তু আতঙ্ক কাটে না।স্বভবতই ওর রাতটা হল দুঃসহ। দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কে ভরা।
একটা দুঃস্বপ্ন এমন-অনেকগুলি ফোন বাজছে। কান ঝালাপালা রিংয়ের শব্দে। একটা ফোন জুই রিসিভ করে। অমনি একটাকচ্ছপ গতির কন্ঠ শোনা যায়-হ্যালো, আমি মিলন। এর পরই মনিটর থেকে রক্ত গড়ায়। ভয়ে চিৎকার দেয় ও। কিন্তু গলা দিয়ে অনেক করেও কোন আওয়াজ বেরোয় না।
সে রাতে ভাল ঘুম হল না ওর, বলাই বাহুল্য।