জেলা সরকারি গ্রন্থাগার। মোট পঞ্চাশ জন একসাথে বসতে পারে। এখনো যে মানুষ বই পড়ে তা লাইব্রেরিতে না আসলে বুঝা যায় না।
সকাল এগারোটার মধ্যেই লাইব্রেরীর সব চেয়ার গুলোতে মানুষেরা অাঠার মত লেগে যায়। সারাদিন আর কারোর উঠার কোন সম্ভাবনা নেই।
বিকাল ছয়টায় লাইব্রেরীর কার্যক্রম বন্ধ হয়। চার জন লাইব্রেরিয়ার পর্যায়ক্রমে ডিউটি করেন।
লাইব্রেরীতে ঠিক কী পরিমান যে বই আছে তা আমার ধারনারও বাইরে। অনেকটা আনকাউন্টেবল নাউন।
শেষ বার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম এক বছর হলো। মাঝখানে একটু সমস্যায় যেতে পারিনি।
এক বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কটা বুক শেলফ তা দেখার সুযোগ পেলাম না। লাইব্রেরীর বিশাল কক্ষের এক জমকালো নতুন সজ্জা।
ঠিক বিয়ে বাড়ি না তবে বিয়ে বাড়ির মতোই। পার্থক্য শুধু বিয়ে বাড়িতে অনেক কোলাহল থাকে যা এখানে নেই।
প্রযুক্তি যে এতদূর চলে এসেছে আমি জানতাম না। কোনরকম একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ি।
এতগুলা মানুষের মাঝে একটা মুখও আমার পরিচিত ছিলনা। লাইব্রেরী ঘরের দক্ষিন দিকটায় তুলনামুলক একটু ফাকা। কী যেন একটা মেশিন।
ঠিক টিবি বা প্রজেক্টর না। তবে ব্যাবহার হয়ত অনেকটা এক রকম। সামনে কেবল একটাই চেয়ার ।একজন করে যাচ্ছে সেখানে।
দেখলাম প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় নিয়ে কিছু একটা দেখছে। আমি এসবের কিছুই বুঝিনা। জানিওনা।
ভাবলাম কিছু না দেখে কোন লজ্জায় পড়ব। আবার প্রযুক্তির এই নতুন আবিষ্কার ব্যাবহারে মন টানছিল চুম্বকের মতো।
তখনো আমার সিরিয়াল ছিলনা। যে মেয়েটা অদ্ভুত সে যন্ত্রের সামনে বসে আছে তারপরই আমার সিরিয়াল।
কিন্তু আমি নির্দিষ্ট সময়ের দশ মিনিট আগেই চলে গেলাম।
দেখলাম মেয়াটা একটা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সে যন্ত্রের ভেতর ডুকিয়ে স্ক্রিনে ঝুকে খুব মনযোগে দেখছে।
বুঝলাম এটা বইয়ের লেখা কোন কাহিনীর সচিত্র কাহিনি দেখার যন্ত্র। ভাবলাম ভালোই হয়েছে এখন আর না জেনে দেখে কিছু বিশ্বাস করতে হবে না।
ততক্ষনে লাইব্রেরীয়ান মাইক্রোফোন কী যেন বলছে। সবাই খুব মনযোগ দিয়ে শুনছে । সেদিকে দৃষ্টি দিলাম।
ওই তো স্যার লাইব্রেরীর নিয়মগুলো সবার উদ্দেশ্যে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
আমার বিস্ময় ক্রমেই বাড়ছে। এই নিয়মটা এক বছর আগেও ছিলনা। পাশ থেকে মেয়েটা বলে উঠল- লাইব্রেরীতেও স্বাধীনতা নেই আজকাল।
প্রতিদিন চেচাবে। বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। কথা বলার সুযোগ খুজছিলাম অনেকক্ষণ।
মেয়েটার সে কথায় আমিও একটু যোগ দেয়ার জন্য বললাম এখানে সবাই পড়তে আসে।
পড়ার বাইরে অন্য কোন নিয়ম করাটা তো বেআইনি । আর সবাই চুপচাপ মানছে কেন??
মেয়েটা আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল। একটু মোটা গড়নের মেয়েটার গায়ের রং আমার থেকেও কালো।
তবে চেহারায় যথেষ্ট আভিজাত্য। আমি আর কথা বললাম না।
মেরুদন্ডের ঠিক মাঝবরাবর একটু চিনচিনে ব্যাথা করছে। ব্যাথার উৎস খুজতে বাম হাতটা পিছন দিকে নিয়ে পিঠের উপর আঙুল দিয়ে খুজছি।
হঠাৎ কেপে উঠল শরীরটা। এটা ভালো লক্ষণ নয় । আমি অনেক বড় একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছি।
পিছনে স্পষ্ট কারোর নিশ্চুপে নিঃশ্বাসের বাতাস আমার ঘাড়ে এসে লাগছে। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি ভয় পেলে চলবে না শামীমা।
বি স্ট্রং এন্ড কেয়ারফুল। নিজের ভেতর থেকে এমন সিগনাল খুব বিপদ ছাড়া আসে না আমার।
কী ঘটতে যাচ্ছে তার কিছুটা ধারনা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না কিছুই মাথায় ডুকছে না।
নিঃশ্বাসের শব্দটা এখন বাম পাশ থেকে এসে ঘাড়ে পরছে। মনে হল পেছনের ছায়াটা আমার বামপাশে সরে এসেছে।
ইচ্ছে করে ডান পাশে ঘারটা ঘুড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলাম।
সবাই করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজনের মুখে স্পষ্ট শুনতে পেলাম আবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ের জীবন যাবে।
এরপরের কথাগুলো আর শুনতে পারিনি। দেখলাম কয়েকজনের ঠোট বিরবির করে কিছু বলছে। কিন্তু কথা গুলো স্পষ্ট না।
সে কখন থেকে ঘাড় ঘুড়িয়ে আছি একটুও ব্যাথা হচ্ছে না। চারপাশের কোন শব্দই আর কানে আসছে না। আমার অনুভূতি গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কিছুই বুঝতে পারছিনা কী হচ্ছে এসব। ততক্ষনে বামপাশের ছায়াটা আর একটু সামনে সরে এল। রোগা বিশ্রি চেহারা একটা ছেলে।
দেখলেই মনে হয় মদ ইয়াবা ছাড়া অন্য কিছু খায়না। হাতে একটা বিশ সিসি সিরিঞ্জ । সিরিঞ্জটা সে মেয়েটার হাতে দিল।
একহাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরল। মোটা মত মেয়েটাও আমার কাছে সরে আসছে। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি।
হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার কোন চেষ্টাই করছিনা । বুঝতে পারছিলাম এখন চাইলেও কিছুই সম্ভবনা। আমাকে অচেতন করার ইঞ্জেকশান দেয়া হয়েছে।
দুজন মানুষের মাঝখানে মন্ত্রমুগ্ধের মত হেটে যাচ্ছি। পাশ থেকে দেখলাম মানুষগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বাইরে বেড়ুতেই লাইব্রেরি গেটের কাছে একটা এমব্যুলেন্স দাড়ানো দেখলাম। কদিন আগের পত্রিকার কথা খুব মনে করছে।
শহরে হঠাৎ করেই মানুষ উধাও। উক্ত ঘটনার দিন নির্জন রাস্তায় হঠাৎ এমব্যুলেন্স চলাচল করতে দেখা যায়।
অনেকের ধারণা এই গ্রুপটা মানুষের চোখ,কিডনি,হৃৎপিন্ড পাচার করে।
ভয়ও পাচ্ছিলাম না। কেমন নিথর শরীরটা টেনে টেনে হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমি মারা গিয়েছি।
এখন শুধু গাড়িতে তুলে কেটে কুটে আবার নির্জন কোন জায়গায় নিয়ে ফেলে দেবে। কিন্তু আমি তো মরিনি। ও
ই তো তাপসি আপু,কান্তা আপু অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসল তাপসি,কান্তা জেমি আপুর বন্ধু। আমার কলেজের সিনিয়র ছিল।
মেডিক্যালে ভর্তি হবার পর আপুর সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই। শুধু চারচোখে দেখলেই হাই , হ্যালো – ব্যাস এইটুকুই।
কিন্তু তাপসি আপুদের সাথে একটা ছেলে। ছেলেটারও গায়ে এপ্রোন। বুঝাই যাচ্ছে আপুদের ফ্রেন্ড।
বেচে যাওয়ার ক্ষীণ ইচ্ছেয় আমার চোখ ঝলঝল করছিল।
কিন্তু পরক্ষনেই আবার তা নিভে গেল। তাপসি আপু এ চক্রের সাথে যুক্ত।
না আর ভাবতে পারছিনা।
অাচ্ছা আপু কী আমাকে চিনতে পেরেছে??
চিনতে না পারলে তো আর বাচার কোন সম্ভাবনাই নেই। ততক্ষনে আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ওই রোগা মত ছেলে আর মোটা মেয়েটা চলে গেছে।
ছেলেটার নাম আসিফ। আপুক তো তাই বলল। অন্যকিছুও হতে পারে। আমি শুধু আপুর ঠোট নাড়ানো দেখে বুঝেছি।
আমরা কলেজে থাকতে এমন প্রাকটিস করতাম। শব্দ না করে কেউ কথা বললে তা বুঝার চর্চা করতাম।
দূর থেকে কারোর কথা বলা খুব মনযোগ দিয়ে দেখলেও আমি আর সুমি বুঝতে পারি।
সুমিকে মনে পড়ছে খুব। আমরা দুজনই ভালো বোবাদের ভাষা বুঝতাম।
গাড়িটা আস্তে আস্তে সার্কিট হাউজ হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে।
আমি কান্তা আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
আপুর চেহারাও বেশ উদ্বিগ্ন। দেখলাম এপ্রোনের পকেট থেকে একটা ফোন বের করতে। এখন ফোনে কথা বলছে।
আমার মন বলছে আপু আমাকে চিনেছে। আর এখন সে জেমি আপুর সাথে কথা বলছে।
আমার খুশিতে তখন খুব হাসতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু আমার হাসার শক্তি নেই । মৃত মানুষের মতো অনেকটা। শুধু দর্শন ইন্দ্রিয়টা সচল ।
গাড়িটা দ্রুত টাউন হল মোড় হয়ে কলেজ রোড ডুকল। গীতিগুঞ্জ মোড়টায় এসে হঠাৎ ব্রেক চাপল।
হঠাৎ ব্রেক চাপায় আমার শরীরটা অনেকটা সরে যাচ্ছিল। তাপসী আপু আমার ঘারে একটা ইনঞ্জেকশান পোষ করল।
আমাকে ধরে বাইরে নামিয়ে দিল। জেমি আপু কোন রকম ধরে বাসায় নিয়ে আসল।
একি!!!
হাত পা ঘারে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে আবার।
আমার অচেতনতা কেটে যাচ্ছে। আমি বেচে উঠছি। রুমে ঢুকেই দু গ্লাস পানি ঢকঢক করে দম বন্ধ করে খেয়ে নিলাম।
এখন অনেকটা ভালো লাগছে। মস্তিষ্কও সচল। পুরো ঘটনাটা মনে পড়ছে স্পষ্ট। কিন্তু অামি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিনা।
নিজের মন্দ ভাগ্যে আমি বিস্মিত হইনি। সর্বদা আমি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত। ডাইরিটা খুলে বসলাম পুরো ঘটনাটা লিখে রাখা দরকার।
কিন্তু স্পষ্ট দেখছিনা কিছুই। এক চোখে পুরো অন্ধকার। ডানচোখে যাও দেখছি খুব ঝাপসা। কোন রকম সংক্ষেপে ঘটনাটা লিখা দরকার।
দরজাটা হঠাৎ নিঃশব্দে খুলে গেল।
আমি তাড়াতাড়ি ডাইরিটা বন্ধ করে উঠে দাড়ালাম। আসিফ বাসায় কেন? ও বাসা চিনবে কী করে??
আমি চিৎকার করতে নিলাম। অাসিফ মুখ চেপে ধরল। বলল সে সবার সামনে দিয়েই এসেছে। কেউ কিছু বলবে না ।
আর এখন তোমার বেচে যাওয়া মানে আমার লাইফ রিস্ক। আবার এর মাঝে তুমি দুজনকে ব্যাপারটা মোটামুটি ধারণা দিয়ে ফেলেছ।
আমাদের নিয়ে শহরে এখন তুলপার। তোমাকে এখন আমি মারব না। তুমি নিজেই মরবে। আর ইচ্ছে করলে একটা সুসাইড নোট লিখতে পার।
মনে পড়ল আসার পথে নজরুল স্যারকে জেমি আপু ব্যাপারটা বলেছিল। আর স্যার আমাকে সান্তনাও দিয়েছে যে সবাই ব্যাপারটা দেখছে।
নজরুল স্যারের ব্যাপারে আমি শুনেছি আপুর কাছ থেকে। সিনিয়র ইনভেস্টিগেট অফিসার। বেশ ভালো মানুষ নাকি।
সম্ভবত আসিফকে কিছু বলার সাহস কেউ রাখেনা। ভেতর থেকে স্পষ্ট সিগনাল আসছে যা কিছু করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।
আসিফ হাতের পিস্তলটা আমার ডায়রির উপর রাখল। বলল এটা দিয়ে তুমি নিজেকে শ্যুট করবে । আমি কিছুই বললাম না।
ও আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। বুঝতে পারছিলাম খুব অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলেছে । যার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।
আমিও স্বাভাবিক আচরণ করছি। অন্য সময় হলে সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এখন করছি। আমি বললাম অাসিফ একটাবার তো মানুষ হতে পারো।
এমন পশুর মতো আচরণ কেন?
আমার হাতটা ধরো।
আসিফ কাপা কাপা হাতে আমার হাত ধরল।
আসিফের চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ও নার্ভাস। এমনটা আসা করেনি যে আমি তাকে কোন বাধাই দিব না।
আমি ওর দুর্বলতা ঠিক বুঝতে পারছিলাম। বললাম একটু শক্ত করে হাতটা ধর।
আমি মানুষ কোন খাবার না। অসভ্যের মতো গায়ে হাত দিচ্ছিলে কেন?
এবার ও দুহাতে আমার হাতটা আকড়ে ধরল শক্ত করে।
এমন ভয়ংকর মানুষ এতটা বোকা হতে পারে আমি জানতাম না। আচমকা টেবিলে রাখা ফল কাটার নতুন চাকুটা ওর গলায় ডুকিয়ে দেই।
এক ঝটকায় আমাকে ছেড়ে জবাই করা হাসের মত চিল্লাচ্ছে। দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লাম কোন রকম। পাশের ইউনিটে নিঝুম থাকে।
বেশ সাহসী আর এডভেঞ্চার প্রিয় একটা মেয়ে। কোন কাজে ওকে বললে কখনোই না করবে না।
বিধ্বস্ত অবস্থায় যখন ওর রুমে গেলাম ,সে আমাকে কোন রকম সাহয্য করতে রাজিনা। কথাবার্তায় আগ্রহের স্পষ্ট অভাব।
আসিফ এখানেও চলে এসেছে। এখন ওকে আগের থেকেও ভয়ংকর লাগছে। একটু একটু ভয় যদি হচ্ছিল তার থেকে জেদটাই বেশি চেপে বসল।
কাঠের চেয়ারটা তুলে মাথায় জোরে অাছাড় দিলাম। আসিফ তাল রাখতে না পেরে নিচে পড়ে গেল। আমি একটার পর একটা আঘাত করে যাচ্ছি।
নিঝুম হয়ত এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছেনা। তাই হা করে একপাশে দাড়িয়ে ছিল। আসিফ মরে গেছে অনেক্ষণ।
তবুও আমি অাঘাত করেই যাচ্ছি। কারন আমার জন্য ও আসার পথে দুইটা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
রক্তের দাগ আমার সারা শরীরে। রক্তাক্ত থেতলে যাওয়া লাশটা ওভাবেই পড়ে অাছে। আমি বেড়িয়ে আসলাম রুম থেকে।
একটা দু ঘন্টার সাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দিতে হবে। আর এখন ফোনটা অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। কারণ আসিফকে মারার পারমিশান ছিলনা।
কিছু তথ্য দরকার ছিল আমাদের।
রাগটা ঠিক সামলাতে পারিনি। ব্যাপার না।
কাল পত্রিকায় আসিফের এ ছবি আসার পর এমনিতেও চক্রটা ভয় পেয়ে যাবে। তারপরও যদি এমন হয় তখন দেখা যাবে……