ডঃ নীলরতন বসাকের ডায়রি কেস স্টাডি ৪৮০২
নামঃ মশিউর রহমান বাদল
বয়সঃ ৪১
ঠিকানাঃ ঢাকা
জানালার পাশে ইজিচেয়ার, এক চিলতে চাঁদের আলো এসে ইজিচেয়ারের পায়ের কাছে পড়েছে। সেখানে আমার বসার অভ্যাস, কিন্তু আমি এখন বিছানায় বসে, কারণ ইজিচেয়ারে একজন বসে আছে। লোকটাকে আমি চিনি না। কেমন করে এখানে ঢুকেছে তা-ও জানি না। পায়ের কাছে আলো পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সিগারেট ধরিয়েছে সে, কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। কী চান আপনি এখানে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। একবার তো বলেছি, আমি কিছুই চাই না। একটু বসেছি মাত্র। আপনার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?
না, হচ্ছে না। কিন্তু নিজের পরিচয় দেবেন না, আরেকজনের ঘরে ঢুকে বসে থাকবেন, এটা কেমন কথা? ভাইসাহেব, পরিচয় অতি তুচ্ছ বিষয়। আপনি এটা নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? একজন মানুষের অনেক পরিচয় থাকতে পারে। আমার এক পরিচয়, আমি একজন সাধারণ মানুষ। অন্য পরিচয় থেমে গেল সে। কী হল, বলছেন না কেন?
না, থাক, বলবো না। সিগারেটে আবার টান দেয় সে। ঘরে অস্বস্তিকর নীরবতা। তবে লোকটার কোন ভাবান্তর নেই। হঠাৎ করেই কথা বলতে শুরু করলো সে, এ পাড়ার জামাল সাহেবকে চেনেন? চিনবো না কেন? খুব ভাল মানুষ, দেখা হলেই কুশল জিজ্ঞাসা করেন। উনি খুন হবেন। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার, গুলি খেয়ে মারা যাবে বুড়ো বয়সে।
সে কী? আঁতকে উঠি আমি। ওনার কোন শত্রু নেই, কে ওনাকে খুন করবে? খুন হতে কোন শত্রু লাগে না। কেউ খুন করে কারণে, কেউ করে অকারণে, হা হা হা । কে খুন করবে? আমার মনে সন্দেহ উঁকি দিয়ে যায়। কে খুন করবে সেটা এক রহস্যময় বিষয়। তবে আমার জানামতে খবর সঠিক, ভুল হওয়ার সুযোগ কম।
হঠাৎ করেই সিগারেট নিভিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। যাই, আমার কাজ আছে। আরে, কোথায় যাচ্ছেন? যাবেন না, দাঁড়ান। আমি বাধা দেবার আগেই চলে যায় সে। আমি মহা চিন্তিত হয়ে পড়ি। চিনি না জানি না, চেহারা পর্যন্ত দেখতে পারলাম না, এমন একজন এসে বলে গেল জামাল সাহেব খুন হবেন। কে লোকটা? কী চায়?
সকাল হয়েছে, আমি ছড়িটা নিয়ে বের হয়েছি হাঁটতে। পাড়ার সব লোকই আমার চেনা। কেন জানি না, জামাল সাহেবের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়, অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গুঞ্জন চলছে চারিদিকে, একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ভাই? জামাল সাহেব খুন হয়েছেন। সে কী? হ্যাঁ, রাতে এসে কেউ একজন গুলি করে খুন করেছে। বাড়ির লোকেরা এসে দেখে, মারা গেছেন তিনি, খুনী গায়েব।
মনটাই খারাপ হয়ে যায় আমার, বড় ভাল লোক ছিলেন তিনি। কয়েকদিন পর। আজও ইজিচেয়ারের পায়ের কাছে এসে পড়েছে চাঁদের ম্লান আলো। লোকটা আবার এসেছে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। আমি বললাম, ঠিক করে বলুন তো, আপনি কী করে জানলেন যে জামাল সাহেব খুন হবেন?
হাসল সে, চেহারা না দেখা গেলেও হলুদ দাঁত দেখা গেল, আর একটা শব্দ শোনা গেল। খুনটা কি আপনিই করেছেন? জবাব দেয় না সে। আপনাকে তো পুলিশে দেয়া উচিৎ, সব জানেন, অথচ মুখ খুলছেন না। বলুন, খুন কি আপনি করেছেন? খামোকা চেঁচাবেন না তো, মাথার ভেতর ব্যথা করে।
এখানে এসেছি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে। বসে থাকুন, যেখানে আছেন সেখানেই বসে থাকুন। নড়াচড়া করবেন না। আপনার ঘরের এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নিরিবিলি, কি সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস। গুণগুণ করে গান ধরে সে, গানের কথা বোঝা যায় না। হঠাৎই গান থামিয়ে বলে ওঠে সে, সোলায়মান সাহেবকে চেনেন? আমি নিমেষে পরের ঘটনা বুঝে ফেলি। কথা বলতে সাহস হয় না। জবাই করে খুন, বুঝলেন? জবাই করে। ধড় একদিকে, মাথা আরেকদিকে।
আমি চেয়ে থাকি। কী বলছে এই লোক? কাঁপা গলায় বলি, আমি কিন্তু পুলিশে ফোন করবো। লাভ নেই। তারা বিশ্বাস করবে না। আর যদি করেও, তাহলে বিপদে পড়বেন আপনিই। আপনাকে সন্দেহ করবে, ফাঁসিয়ে দেবে। খিক খিক খিক। গা জ্বালা করা হাসি হাসলো লোকটা। সেদিনের মতোই হঠাৎ করে উঠে চলে যায় সে। আমি বাধা দিতে পারি না।
পরদিন আমাকে রফিক সাহেব খবরটা দেন। আমাদের লাশ দেখতে দেয়া হয় না, খুবই নাকি বিচ্ছিরি ব্যাপার। লোকটা যেভাবে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই নাকি খুন হয়েছেন সোলায়মান সাহেব। তারও কয়েকদিন পর লোকটা আবার আসে। আগুনে পুড়ে মরা খুব বীভৎস ব্যাপার, তাই না? আমি জবাব দিই না।
পরের দিন মারা যান তাহের আলী সাহেব, লোকে বলে, শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগে যায় বাসাতে, জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। কিন্তু এটা কি একটা খুন? জানে ঐ লোকটা। আগাম খবর পেয়ে যাই আমি, কিন্তু কাকে কী বলবো? নিদারুণ দুশ্চিন্তা আর যন্ত্রণায় আমার সময় কাটছে, কাউকে কিছু বলতে পারছি না, সইতেও পারছি না।
সেই লোকটা আবার এসেছে। তার সিগারেট থেকে আজ খুবই কটু গন্ধ বের হচ্ছে। আপনার বয়স কত যেন, বাদল সাহেব? আমি চমকে উঠি। এবার কি আমার পালা? কেন? জিজ্ঞেস করি আমি।
বলুন না, আপনার বয়স কত? একচল্লিশ, গলা কেঁপে যায় আমার। চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় লোকটা, বেরিয়ে যায়। আমার শীত করতে থাকে, এই গরমের রাত্রেও। আজ সে অন্য কারো মৃত্যুর খবর দিয়ে যায় নি, তার মানে আমার পালা। দুটো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি, কিন্তু শীত কিছুতেই যায় না। আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকি। মৃত্যু এত ভয়ের কেন? জানালায় ওটা কীসের ছায়া?
পুনশ্চঃ পরদিন সকালে যখন আমাকে বাসার কাজের ছেলে মতি দেখে, তখন নাকি আমার গায়ে আকাশপাতাল জ্বর, আর আমি প্রলাপ বকছি, জানি আমি, সব জানি। কীভাবে ওরা সব মারা গেছে, আমি সব জানি।
কেন যেন মনে হয়, আমার তো বাঁচার কথা নয়, কীভাবে বেঁচে গেলাম? জবাব আজও পাই নি। আজ রাতেও আমার ঘরে ইজিচেয়ারের পায়ের কাছে চাঁদের আলো এসে পড়েছে, কিন্তু সেই লোকটা আসে নি।
কে জানে, কেন আমি তার জন্য অপেক্ষা করে আছি?