খুন রহস্য

খুন রহস্য

উঠলেন শহরের নামকরা গোয়েন্দা নূর সিদ্দিক। কিছুটা আতঙ্কবোধ করলেনরুমে ঢুকেই আঁৎকে তিনি।

একজন মানুষকে কেউ এভাবে খুন করতে পারে! খুনি কি তবে জঘন্যতম বিকৃতমনা? মুহূর্তের জন্য বন্ধ করা চোখটা ধীরে ধীরে খুললেন আলতো করে। বীভৎসতার জন্যে মনকে শক্ত করে মেঝেতে আবার তাকালেন গভীর সঙ্কল্প বোধ নিয়ে। ইকবাল চৌধুরীকে করাত দিয়ে গাছকাটার মতো করে খুনিরা চিলতে চিলতে করেছে বিকৃতভাবে। দেহটাকে কয়েক টুকরা করে ফেলে রাখা হয়েছে মেঝের চারপাশে।

শুধু মুখটা দেখেই শনাক্ত করা গেছে লাশটার মালিক ইকবাল চৌধুরী। মেঝেতে রক্ত জমাটের ওপর প্রচ্ছন্ন গুটি কয়েক পদচিহ্ন। বড় বড় পায়ের ছাপ সাতজনের। সাথে ছোট ছোট পায়ের ছাপ যেন কোনো বার-তের বছরের ছেলের। কোনো কিশোরও এমন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকতে পারে? পাশের রুম থেকে ইকবাল চৌধুরীর স্বজনদের কান্না ভেসে আসে। হঠাৎ একজন নারী কণ্ঠের উত্তেজিত ধ্বনি শোনা যায়।

নূর ছিদ্দিক রুমটার চারদিকে এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে পাশের রুমের পথে পা বাড়ান। সাথে সাথে হেঁটে আসে ওসি কাদের পলাশ। আস্তে করে জানতে চায়, স্যার কিছু বুঝতে পারলেন? নূর সিদ্দিককে বিভ্রান্ত দেখায়। নাহ্ তেমন কিছু চোখে পড়েনি তার। তবে আন্দাজ করতে পেরেছেন কী জন্যে খুন হতে পারেন ইকবাল চৌধুরী। রুমটার দেয়ালে বিখ্যাত শিল্পীদের কিছু ছবি সাঁটানো আছে। টাঙানো আছে চৌধুরীর কিছু পারিবারিক ছবিও।

কিন্তু আজ দক্ষিণের দেয়ালের দুটো হুকই শূন্য। যাতে চৌধুরীর ছবিসমেত কিছু অ্যালবাম সর্বাধিক পঠিত ছিলো। পরিবার পরিজন নিয়ে তোলা ছবি। এতো কিছু থাকতে খুনিরা শুধু ছবি দুটো নিলো কেন? মনের খটকাটা কিছুতেই মিটমাট করতে পারেন না মহা গোয়েন্দা। হয়তো এসব অ্যালবামে খুনিদেরও কারো কারো ছবি ছিলো।

আন্দাজে ছোড়া ঢিলটা যেনো কাজে লেগে গেলো। সত্যিই তো! এখন শুধু জানতে হবে অ্যালবামে কার কার ছবি ছিলো!দুই ইকবাল চৌধুরী নিয়মিত ঘুম থেকে উঠেন ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে। ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ কফি খাওয়া তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস ছিলো। সেদিন খুন হওয়া সকালে কাজের বুয়া গিয়েছিলো কফি নিয়ে। রুমের দরজাটা খোলাই ছিলো। বুয়া কফি নিয়ে যাবার মিনিট খানেক পরেই গোঙানির মতো চিৎকার শুনতে পান ইকবাল চৌধুরীর বড় ভাই হাশেম চৌধুরী।

এত রক্ত দেখে তার গলার স্বর বের হয় না। বুয়া মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এক টুকরা ভুড়ির দলার ওপর। আতঙ্কে হাশেম চৌধুরীর চিৎকার চেঁচামেচিতে ছুটে আসে ফ্ল্যাটের দারোয়ান। তারপর পুলিশে খবর দেয় সে। ইকবাল চৌধুরীর মতো পরোপকারী ডাক্তারের বহিঃশত্রু ছিলো না- এমনটাই চৌধুরীর স্ত্রী পান্না বেগমের নিকট জানতে পারলেন নূর সিদ্দিক। যার কোনো বহিঃশত্রু নেই তার ঘরে যে শত্রুবেশী বন্ধু থাকতে পারে না তা তো অসম্ভব নয়। এমন তো হতে পারে ইকবাল চৌধুরীর ঘরের শত্রু বিভীষণ ছিলো।

কিন্তু সেই বিভীষণটি কে তা জানার জন্যই ইকবাল চৌধুরীর ফ্ল্যাট থেকে চোখ সরাচ্ছেন না নূর সিদ্দিক। দারোয়ান বেটাকেও সন্দেহ হয়। তার অগোচরে ফ্ল্যাটে ঢোকা খুবই কষ্টকর। হত্যা মামলা দায়ের হলো থানায়। অজ্ঞাত বিশজন আসামী। আজ নিজের রুমে ফ্ল্যাটের দারোয়ানকে ডাকলেন নূর সিদ্দিক। নিজের রুম বলতে ইকবাল চৌধুরীর বাসায়ই। খুনের কূল-কিনারা করতেই এখানে এসে তাঁবু গেঁড়েছেন তিনি। ফ্ল্যাটের দারোয়ানের নাম কালাম মিয়া। পান খাওয়া লাল হয়ে যাওয়া দাঁতে দেঁতো হাসি সব সময়ই লেগে তাকে তার। নূর সিদ্দিকের কাছে দারোয়ানের হাসি কেমন ভূতুড়ে মনে হয়। কালাম মিয়ার পানে লাল হয়ে যাওয়া দাঁত আজ চুপ। শঙ্কিতভাবে তাকিয়ে আছে গোয়েন্দার টেবিলের দিকে। নূর

ছিদ্দিক কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। বললেন-

– ইকবাল চৌধুরী কী কারণে খুন হতে পারেন বলে তোমার ধারণা?

– জানি না স্যার। তবে …

– তবে কী?

– ইয়ে! স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন।

কালাম মিয়া স্পষ্টতই কথা লুকিয়ে রাখছেন। বুঝতে পারলেন নূর সিদ্দিক। এমন কিছু সে জানে যাতে খুনের সাথে সম্পৃক্ত কারা তা হয়তো বেরিয়ে আসবে। কালাম মিয়ার ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেছে। তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললো, আমি যাই-ই-ই স্যা-আ-আ-র। – যাও। কয়েক সেকেন্ড পরেই আচমকা নূর সিদ্দিকের ভরাট কণ্ঠ দেয়ালে গেঁথে থাকে। দারোয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ইকবাল চৌধুরীকে কে বা কারা খুন করেছে তা আমি জানি। কালকেই জেলের ভাত খেতে পারবে তারা।

কালাম মিয়ার নিচু হয়ে যাওয়া মাথা ঝট করে সিধে হলো। তারপর হা করা মুখ নিয়ে দৌড় দিলো দরজা বরাবর। তিন বিকেলে দুই ভ্যান পুলিশ এসে নামলো ‘রয়েল প্লেস’-এ। রয়েল প্লেস ইকবাল চৌধুরীর ফ্ল্যাটের নাম। তিনতলা এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মোট সাতাশ জন। ফ্ল্যাটটা ইকবাল চৌধুরীর হলেও তিনি প্রথম দু’তলাই ছেড়ে দিয়েছেন বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনদের জন্য।

কৌতূহলী সবাই জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বসে আছে একতলার বারান্দায়। কারো কারো মুখ অজানা ভয়ে শুকিয়ে আছে গ্রীষ্মের চৌচির মাঠের মতো। নূর সিদ্দিক বার বার ইকবাল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কামরান সাহেবকে আড়চোখে দেখছেন। দাড়িগোঁফ পেকে গেছে লোকটার। চোখে ভারী লেন্সের চশমা। একমাত্র কামরান সাহেবকে কেনম নির্ভার লাগছে। আশ্চর্য! সবাইকে উশখুশ করতে দেখে নূর সিদ্দিক সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন, আপনারা হয়তো জানেন আমি নূর সিদ্দিক। একজন গোয়েন্দা। এও আপনারা জানেন ইকবাল চৌধুরী আমার বাল্যকালের বন্ধু। তিনি আজ নেই।

তাকে কত নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে, তা ভাবলেই ভীষণ কষ্ট পাই। কী বীভৎস ছিলো তার মৃত্যু। অথচ কত ভালোই না ছিলেন তিনি। কিন্তু একটু খামখেয়ালিও ছিলেন তিনি বটে। যাই হোক, আজ বিভিন্ন সূত্র- উপাত্ত-মোটিভ বিশ্লেষণ করে চিনতে পেরেছি কে তাকে খুন করেছে। একটু পরেই খুনিকে আপনারা নিজের চোখে দেখবেন। ইকবাল চৌধুরীর খুনি হচ্ছেন- এইটুকু বলেই নূর সিদ্দিক একবার মুহূর্তের জন্য কামরান চৌধুরীর দিকে তাকালেন। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ইকবাল চৌধুরী খুন হননি। তিনি জীবিত আছেন।

কথাগুলো যেনো বোমা হয়ে ফাটলো খোলা বারান্দায়। ইকবাল চৌধুরী খুন হননি? তবে রক্তময় তার রুম, কাটা মুণ্ডু, হাত-পা-ভুড়ি এগুলো কী- কার? নানা মনে নানা প্রশ্ন জাগলো নীরবেই। কিন্তু সবাই কেমন যেনো নির্বাক হয়ে আছে। নূর সিদ্দিক কামরান সাহেবকে কাছে ডাকলেন হাতের ইশারায়। অন্যরা অপেক্ষায় উত্তেজিত- কী ঘটতে যাচ্ছে? চার.

ইনিই ইকবাল চৌধুরী। কামরান সাহেবকে দেখিয়ে বললেন নূর সিদ্দিক। উপস্থিত লোকগুলো কথাটা বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। মৃদু একটা গুঞ্জনও উঠলো। তারপর তারা দেখলেন কামরান সাহেবের দাড়ি গোঁফ পরচুলা চশমা খুললে কীভাবে বনে যান ইকবাল চৌধুরী। ইকবাল চৌধুরীকে বাস্তবে দেখে রুমের কোণ থেকে ছুটে এলেন তার স্ত্রী। লজ্জার মাথা খেয়ে সবার সামনেই জড়িয়ে ধরলেন স্বামীকে।

নূর সিদ্দিক পূর্বের কথার রেশ ধরলেন- ইকবাল চৌধুরী একজন নামকরা সার্জন। সার্জারি করে একজন মৃত মানুষের চেহারা নিজের মতো করে নিতে তার জন্যে দুঃসাধ্য হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ইকবাল চৌধুরী একটা মৃতদেহকে তার চেহারায় আনিয়ে কেটেকুটে ফেলে রেখেছিলেন নিজের রুমে।

কৃত্রিম রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছেন ঘরের মেঝেতে। আমাদের এঙ্পার্টরা যখন ব্লাডের নমুনা কালেক্ট করে তখন তারা জানিয়ে ছিলো যে, এগুলো আসল রক্ত নয়। স্রেফ কৃত্রিম! সার্জন ইকবাল চৌধুরী আসলে একটা এঙ্পেরিমেন্ট করছিলেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে মৃত্যুর পর কতোটা ভালোবাসে। কিন্তু আপনারা জানেন, এই খামখেয়ালি ডাক্তারের একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো।

আমি যখন কামরান সাহেবকে কথা বলতে দেখি কেমন যেন মোটা টানা স্বরে, তখনই দেখলাম স্বর্ণের দাঁতটা ঝিক করে উঠলো। সেই থেকে সন্দেহ করলাম। ধরলাম ছদ্মবেশ ধারণের খুঁতটা! দারোয়ানের পাল্লায় পড়ে কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়েছিল ইতস্ততঃ করে সেটাও স্বীকার করলেন নূর সিদ্দিক। অবশেষে বিজয়ীর একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে পুলিশদের বললেন, আপনারা আজ না খেয়ে যাবেন না।

ওসি সাহেব ঘটনার মোড়ে মোড়ে হতবাক। বিশ্বাস সামলিয়ে বললেন, আর আমি ভেবেছি বীভৎস খুন? ছিঃ ছিঃ!! নূর সিদ্দিক এবার ইকবাল চৌধুরীর দিকে ফিরলেন। আশ্চর্য তিনি সেখানে নেই। সম্ভবত সার্জন সাহেব এঙ্পেরিমেন্টে ধরা খেয়ে কেটে পড়ছেন। একটু পরেই নূর সিদ্দিক সাহেব আর একদল পুলিশকে খাবারের টেবিলের দিকে এগুতে দেখা গেলো।

মনে হচ্ছে খুনি ধরতে এসে বেশ নাকানি চুবানি খেয়ে খিদেটা বেড়ে গেছে তাদের!! উৎসর্গ: মাহফুজ, আনিকা, নাজমা, রাবু, রাইহান, আজিম, ফয়সাল- এই এক ঝাঁক কিশোরকে, যাদের সাথে প্রায়ই দেখা হলে বলতো, একটা গোয়েন্দা গল্প লেখেন না।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত