শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০১৭
এস আর শানু খান
বাড়ির লোকজনের হৈ-হুল্লা আর চেঁচামেচিতেই সেদিন সকালের ঘুম নষ্ট হলো। চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। আমাদের বাড়ির উঠান থেকে নদীর জোয়ার ভাটা পর্যন্ত ঠাওর করা যায়। নদীর ক‚লেই আমাদের বসবাস। বাপ- চাচারা সাত ভাই! দাদা মারা যাওয়ার পর মাঠাম জমিজাতি সব ভাগাভাগি করে নিলেও সাত ভাই সেই বাপের ভিটায়ই আছেন।
সবার আলাদা বাড়ি সব কিছু আলাদা হলেও সাতটা বাড়ি মিলে যেন একটা মাত্র পরিবার। বাইরের থেকে কেউ আসলে সহজে বুঝতেই পারবেন না যে আসলে সবাই আলাদা। মনে করবেন সবাই যেন এক সঙ্গে মিলে একটা যৌথ পরিবার। আমাদের বাড়ির ঠিক পূর্ব পাশে আমার ছোট কাকুর বাড়ি। তার লাগা পূর্ব পাশেই নদী। নবগঙ্গা নদী। নদীর ঘাটে কেমন যেন একটু হৈ-হুল্লার মতো লাগছে। ব্রাশ নিয়ে নদীর দিকে এগোতেই দেখি আমার মা ফিরছেন। করুণ গলায় বললেন, আমাদের ঘাটে নাকি একটা মরা মানুষের লাশ এসে ঠেকেছে। মায়ের কথা শুনেই আমার গায়ে কাঁটা দিল। আমি খুবই ভয় কুড়ো মানুষ।
গ্রামের কোনো মানুষ মারা গেলে যদি দেখতে যায় তাহলে কত দিন যে একা একা চলতে পারি না! শুধু চোখের সামনে সেই লাশের ছবি ভেসে ওঠে। আমাদের নদীর ঘাটের ওপারে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় লোক মারা যায়। আর কেউ মারা গেলে নদীর ক‚লে পোড়াতে নিয়ে আসেন। যেদিন শুনতাম যে ওপারে মানুষ পুড়াচ্ছে সেদিন থেকে কম করে হলেও দুই-তিন সপ্তাহ ঘাটের দিকে মুখই দিতাম না। টিউবওয়েলে গোসল করতাম। মায়ের মুখে যখন শুনলাম ঘাটে একটা মরা লাশ এসে ঠেকেছে তখনই আমার সারা শরীর কেমন যে ভার হয়ে গেল। পা আর নড়ছেই না। আমি কোনোভাবেই সাহস পাচ্ছিলাম না যে ঘাটে গিয়ে দেখি লাশটাকে। বাঁশের ঝাড়ের আবডালে দাঁড়িয়ে একটু দেখার চেষ্টা করলাম দেখি ঘাট ভর্তি মানুষ আর মানুষ। আরো মানুষ আসতেছে তো আসতেছেই।
সারা গ্রামে হিড়িক পড়ে গেছে। আসলে হিড়িক পড়বারই কথা। বিষয়টা আসলেই খুব সহজ বিষয় নয়। ছোট কাকি ঘাট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। আমাকে দেখে বললেন ভয়ের কিছু নেই ঘাটে দেখ কত মানুষ যা একটু দেখে আয়। কারা যেন একটা জোয়ান মদ্দ মানুষকে মেরে প্লাস্টিকের বস্তায় পুরে নদীতে ভাসায় দিছে। কে জানে কোনো মার কোল খালি হয়েছে। খানেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সাহস জুগিয়ে আস্তে আস্তে ঘাটের নিচে নেমে গেলাম। নেমে গিয়ে দেখি ঘাটে পা ফেলবার জায়গা নেই। মানুষ আর মানুষ। মানুষের জন্য আমি দেখতে পারছিলাম না।
কেননা তখন আমি অনেক ছোট। ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি সম্ভবত। অবশেষে পাড়ার এক কাকা তিনার কাঁধে চড়িয়ে উঁচু করে ধরলেন আমাকে। তারপর আমি দেখলাম। পানিতে অনেক কচিরি পানা এক জায়গায় করে তার ওপর ইয়া বড় একটা লম্বা চওড়া লাশ। তবে লাশের কিছু দেখা যাচ্ছে না তখনো। কেননা পুরা লাশটাই প্লাস্টিকের সাদা বস্তা দিয়ে মোড়ানো। অনেকে বলছেন মানুষ পচা গন্ধ বের হচ্ছে হালকা হালকা। কেউ আবার বলছেন তবে বেশি দিন আগের লাশ না।
লাশের বয়স বেশি দিন হলে নিশ্চিত গন্ধের যন্ত্রণায় এখানে টিকা যেত না। মানুষ পচা গন্ধ বিরাট ভয়ানক গন্ধ। এক মুরব্বি লোক বললেন- মানুষ পচার কথা যখন উঠলোই তাহলে একটা বাস্তব গল্প শোন। আমার ছোট শালারে বিয়ে দেয়া পশ্চিমে। অনেক পশ্চিমে। প্রত্যন্ত একটা এলাকা। বাজার ঘাট নেই তেমন। শুধু বাগান আর বাগান। গ্রাম থেকে তা প্রায় মাইল দশেক দূরে একটা বাজার আছে সেখানে সপ্তাহে একবার হাট বসে। আশপাশের কয়েক গ্রামের লোকজন সেই হাট করেন। সারা সপ্তাহের সব প্রকার কেনা কাটা ওই হাটের দিনেই সেরে নেন। তা একবার এক লোক হাটে গেছে। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। একদিন দুদিন তিন করতে করতে সপ্তাহ পার হয়ে যায় কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে না। অবশেষে বহু খোঁজাখুঁজির পর খবর এল সেই লোকটাকে পাওয়া গেছে। আমি আর আমার শালা বাবু সেবার ওখানে ছিলাম। ওই তোড়জোড় শুনে আমি, শালা বাবু, আর শালা বাবুর শালা তিনজনে দেখতে গেলাম সেই লোকটাকে।
একটা বাগানে পাওয়া গেছে তাকে। তবে জীবিত নয় মৃত। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো এক লোক গন্ধ পেয়ে বাগানের ভিতর খোঁজ নিতেই পেয়ে গেছেন। সেই বার বুঝেছিলাম মানুষ পচা গন্ধ কারে কয়। কারা যেন সেই লোকটাকে মেরে বাগানের ভিতর পাতা-পুঁতি দিয়ে ঢেকে রেখে গিয়েছিল। আরো শোনো গল্প এখানেই শেষ নয়। সেই লাশটাকে করব দিতে গিয়েছিল যে কয় জন পচা গন্ধের জন্য বমি করতে করতে তিনজন মারাই গিয়েছিল। আরও অনেকের পেটে সমস্যা হয়েছিল। সে যে কি দৃশ্যরে ভাই সেটা বলার মতো না। না দেখলে বিশ্বাস করবা না।
এমন কোনো লোক ছিল না যে সেই লাশ দেখে বমি না করে থাকতে পেরেছিল। কথায় কথা উঠে, শোন তাহলে আর এক গল্প.. এবার শুরু করলেন দক্ষিণ পাড়ার অনীল বুড়ো। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরের কথা। তখন আমরা টাবুরে নৌকায় মিটাপুরের হাট করতে যেতাম। কোনো দিন ছয়-সাত জন আবার কোনো দিন তিন-চারজন। সকালে খেয়ে নৌকা বাওয়া শুরু করতাম দুপুর নাগাদ হাটে পৌঁছে যেতাম। কেনাবেচা করতাম। সন্ধ্যা হলেই আবার নৌকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। তো সেদিন একটু দেরি হয়ে গেছে ফিরতে।
জ্যোৎস্না রাত। আকাশ ভরা তারা। আমরা স্্েরাতের অনুক‚লে বাইছি নৌকা। উত্তরে বাতাসে দেহটা ঠাণ্ডা করে দিয়ে যাচ্ছিল। আমার চারজনে নৌকা বাইছিলাম আর দুজনে নৌকার ওপর বসে পিট পিট করে চ্যারাগ জ্বালিয়ে হাটের কেনাবেচা করা টাকার হিসাব মিলাচ্ছিল। আমরা নদীর পূর্ব ক‚ল দিয়ে বেয়ে আসতেছি নৌকা। ছয় জন। নাপিত ঘাটে আসতেই নাকে কেমন যেন একটা বিদঘুটে গন্ধ আসতে লাগল। নৌকা যতই সামনের দিকে এগোচ্ছিল গন্ধ ততই বেশি নাকে পৌঁছাচ্ছিল। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। নৌকা নদীর মাঝ দিয়ে নিতে লাগলাম। হঠাৎ করে গনি সর্দার সামনে থেকে বলে উঠল ওপারের দিকে তাকিয়ে দেখ অনীল। দেখেছিল! কিছু দেখতে পারছিল।
আমি তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটা শিয়ালের মতো কোনো কিছু টানাটানি করছে। আমাদের মধ্যে অশ্বিনী গোসাই ছিল বিরাট সাহসী লোক। ও বলল কি নৌকা ওই ঘাটে ভিড়াতে হবে। নাছোড়বান্দা। সে দেখবেই আসলে কি। অবশেষে গণি সর্দার বলল আরে শালা আজ পূর্ণিমা রাত। তোর মাথা ঠিক আছে। ঠাণ্ডা হয়ে বাড়ি চল। অবশেষে জিতেনের ব্যাগ থেকে টর্চ লাইট বের করে মারতেই স্পষ্ট দেখা গেল। ওটা আসলে শ্মশানের পাশে কোনো একটা লাশ পুঁতে রেখেছে কারা। সেটাকে শেয়ালে টেনেহিঁচড়ে উপরে উঠিয়েছে। আর তাই নিয়ে কয়েকটা শেয়াল টানাহেঁচড়া করছে। আমার তারপর তিন চার সপ্তাহ হাটে যেতাম। সবার তো খাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সব সময় গলা টেনে টেনে বমি করতে হতো। সে যে কি গন্ধরে বাবা। মহাবুল অনীল বুড়োর কাছে গিয়ে জানতে চাইল একটু ভালোভাবে বুঝেশুনে দেখদি কাকা। সেই গন্ধ আর এই গন্ধ এক নাকি। সেই রকমই মনে হচ্ছে। তবে মনে বেশি পচে নাইতো তাই একটু কম গন্ধ হয়েছে। তবে মন বলছে পচন ধরে গেছে। বলে অনীল নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগলেন।
ততক্ষণে শুধু আমাদের গ্রাম নয়, আশপাশের কয়েক গ্রাম পৌঁছে গেছে লাশের খবর। মানুষ উপচে পড়ছিল। গ্রামের মেম্বার বোর্ড অফিসে খবর পাঠালেন। তখনো মোবাইল ফোনের বিস্তার ঘটেনি তেমনটা। সাইকেলে করে বোর্ড অফিসে খবর পাঠানো হলো। কিছু সময়ের মধ্যেই চৌকিদার এসে ঘাটে হাজির হলেন। লাঠি দিয়ে লোকজন সরাতে লাগলেন। লাল পতাকা উড়িয়ে দিলেন ঘাটে। হঠাৎ টেম্পোর আওয়াজ কানে এল।
টেম্পোতে করে থানা থেকে দশ-বারো জন পুলিশ এসেছেন। সঙ্গে একটা অদ্ভুত চেহারাওয়ালা মানুষও নিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ বলাবলি করছেন ওই লোকটা নাকি ডোম। মরা মানুষ কাটাকাটি করেন বেচারি। ভয়ঙ্কর গোঁফ আর চেহারাটাই কেমন ভয়ঙ্কর। পুলিশ এসে ঘাট থেকে লোকজন সরিয়ে দিলেন একটু দূরে। একজন পুলিশ মোস্তফা কাকাকে ডেকে ঘটনা শুনতেছেন আর খাতায় লিখতেছেন।
লাশটা কখনো আপনারা দেখেছেন? কে প্রথম দেখেছে? তখন জোয়ার ছিল নাকি ভাটা ছিল? আর ওদিকে সেই ভয়ঙ্কর লোকটা পানিতে নেমে গিয়ে লাশটার পায়ের কাছের বস্তা ধরে টেনে নিয়ে আসলেন একদম ক‚লের কাছে। চৌকিদার কলার পাতা কেটে এনে বিছিয়ে দিল মাটিতে। লাশটা উঠিয়ে ওর ওপরই রাখবেন। সবার চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ। ডোম সোজাসাপ্টা করে ঠিক মানুষের লাশের মতোই উঠিয়ে এনে কলার পাতার ওপর রাখলেন।
বস্তার মুখ খুলতেই অবাক হলেন। জোরেশোরে একটা হাই ছাড়লেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই লাশ নিয়েই চলছে কত না গবেষণা। অবশেষে সব গবেষণার অবসান ঘটিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়ে দিল লাশটা। আসলে ওটার ভিতরে কোনো লাশ ছিল না। ওটার ভিতরে কচুরিপানা ভর্তি করে ঠিক লাশের প্রতিকৃতি দিয়ে কোনো এক দুষ্ট লোকরা মানুষদের বোকা বানানোর জন্য নদীতে ছেড়েছে।
পাদটীকা : ‘কারও সম্পর্কে সম্পূর্ণ না জেনে যেমন কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়! ঠিক তেমনিভাবে কোনো ঘটনাকে ঘাঁটিয়ে না দেখে হৈ..হুল্লা করাও অনুচিত। কেননা এতে করে মানুষের মনে এমন কিছু উৎকণ্ঠা (সাসপেন্স) তৈরি হয় যেটা কিনা ভবিষ্যতে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিয়ে উপনীত করতে পারে।