অচেনা গলি রহস্য

অচেনা গলি রহস্য

বসিরের বাসায় ফিরতে  ফিরতে প্রায় রাত বারোটা  বেজে গেল। বাসায় ফিরে  তার মনে হল বিরাট ভুল হয়ে  গেছে। ঘরে চাল নেই।

ফেরার পথে চাল কেনার  কথা ছিল। দুনিয়ার চিন্তা  ভাবনা করতে করতে শেষ  মুহূর্তে চাল কেনার কথা  ভুলে গেছে।এখন বের হয়ে  কিনে আনা যায় কিন্তু  বারোটার মধ্যে গেট বন্ধ  হয়ে যায়।

ওদিকে পেটের  ভিতরে ক্ষুধার চোটে  হাতুড়ির বাড়ি পরছে।বাইরে গিয়ে যে খেয়ে  আসবে তারও উপায় নেই। কতবার ভেবেছে ঘরে বিস্কিট জাতীয় কিছু কিনে  রাখবে। কেনা হয় ঠিকি কিন্তু রাখা হয় না। কেনার  সাথে সাথেই খেয়ে ফেলে  ও।

যেহেতু রাতে খাবার  দাবারের কোন সম্ভাবনা  নেই তাই বসির খাবারের চিন্তা বাদ দিয়ে প্যান্ট, শার্ট আর ব্যাগ খাটে ছুড়ে  ফেলে লম্বা শাওয়ারের  উদ্দেশ্যে বাথরুমে ঢুকে  গেল।এই বাসায় পানি, গ্যাস  আর বিদ্যুতের কোন ঝামেলা  নেই।বসির একটি এনজিওতে  চাকরি করে। ফিল্ড ওয়ার্কার।

সারাদিন এখানে সেখানে দৌড়া  দৌড়ী করে খেটে মরতে হয়। অফিস থেকে ওকে একটি  ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। এতেই  সে ভীষণ খুশী।

ক্ষুধার কারনে বসিরের ঘুম পরীও ফাঁকি দিল । বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসল।পরের দিন শুক্রবার। ছুটির  দিন। সারারাত ঘুম না এলেও  সমস্যা নেই। সকালে  তাড়াতাড়ি উঠতে হবে না।  ল্যাপটপে দুনিয়ার কাজ  অকাজ করে  ঘুমোতে ঘুমোতে  ভোর চারটা বেজে গেল।

ঘুম  ভাঙল সারে বারোটার  দিকে। উঠেই মনে হল, আজ  তো শুক্রবার। জুম্মার নামাজটা ধরা উচিত। তড়িঘড়ি করে বিছানা  ছাড়তে গিয়ে মনে হল, গতকাল খাওয়া হয় নি। ক্ষুধার চোটে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে  গেছে।

নামাজ শেষ করে  খাবারের পার্ট শুরু করলেও কিছু আসবে যাবে না। বসির টুপিটা খুঁজে পাচ্ছে  না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে,  পাঞ্জাবীর অবস্থাও করুন।  আয়রন করলে যদি একটু ঠিক  হয়।

টি-শার্ট পরে তো আর  নামাজে যাওয়া যায় না। মসজিদটা বেশ দূরে। বসির  যেখানটায় থেকে তার নাম  আমতলার পার।খুব বেশিদিন  হয়নি ও এখানে এসেছে। ওর  রুমটা বিল্ডিংয়ের  নীচতলায়।

দেখলেই বোঝা  যায় দারোয়ান বা কাজের  লোকের জন্যে বানানো।বসির এখন পর্যন্ত কোন  দারোয়ান দেখেনি। হয়ত  নেই। বাড়িওয়ালা বোধহয়  বাজে খরচ বলে বিদায় করে  দিয়েছে।

বসির দ্রুত পা চালায়। ওকে পুরোপুরি দশ রাকাত  নামাজই পেতে হবে।ও  অন্যদের মত দুই রাকাত পরে বের হয়ে আসার পাবলিক  না। অনেকে তো জুতা বগলে নিয়েও মোনাজাত ধরতে  ধরতে বের হয়।মসজিদ ভর্তি লোক।পা  দেবার জায়গা নেই।

এরা  কেন শুধু শুক্রবারেই নামাজ  পড়তে আসে? এদের দোষ  দিয়ে লাভ কি? ও নিজেও  তো শুধু শুক্রবারেই আসে।  নামাজ শেষ করেই বসিরের  প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেল।কি  করা যায়? এখন কি আর  বাসায় গিয়ে রান্না করে খাওয়া সম্ভব? নাকি বাইরে  খেয়ে নেবে? বসির বাইরে খাবার চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল।

বিশাল খরচের ব্যাপার। একবাটি ভাত দশ  টাকা। তাও বাটির সাইজ খুবি ছোট। এক পিচ মুরগীর  মাংশ আশি টাকা। পুরাই  ডাকাতি।বিভিন্ন ধরনের খাবারের  কথা চিন্তা করতে করতে  বসির হাঁটা শুরু করল।

হাঁটতে  হাঁটতে অনেকটা পথ আসার  পর ওর কেমন খটকা লাগল। গলিটা অন্যরকম লাগছে। এই গলি দিয়েই কি ও এসেছিল?  বসির আরও জোরে হাঁটা শুরু  করল। গলির শেষ মাথা বন্ধ। একটা ছোট গেট দেখা  যাচ্ছে।

এরকম তো হবার কথা  না।গলিটা এখানে কেন বন্ধ  হয়ে গেল? বসির ভাবল সে  বোধহয় ভুল রাস্তায় চলে এসেছে।সত্যিকার গলিটা  নিশ্চয়ই আসেপাশেই কোথায় আছে।গেটটা বেশ পুরনো মনে  হচ্ছে। বসির গেট খুলে ভিতরে ঢুকল।ভিতরে  বিশাল আকারের উঠোন।

এখানে এতবড় উঠোন এল  কোথা থেকে? উঠোনটা  কেমন যেন চেনা চেনা মনে  হচ্ছে। হঠাৎ করেই বসির বুঝে ফেলে এই উঠোন আসলেই  তার চেনা। খুব চেনা। এটা  তার দাদাবাড়ির উঠোন। এই  উঠোনে খেলাধুলো করেই ওর  শৈশব কেটেছে। বসির উঠোন ধরে হাঁটা শুরু  করল।

কিছুদূর যেতেই  ডানদিকে একটা ঘর চোখে পড়ল।খুবই সুন্দরী এক মহিলা  পরম যত্নের সাথে গোবর দিয়ে ঘরের চারপাশ  লিপছে। এই মহিলাই ওর মা।বসির অবাক হয়ে তার মাকে  দেখতে লাগল। কতদিন হল  মায়ের সাথে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে না গিয়ে  আর দেখার উপায় নাই।

এক বুড়ো মানুষ ওর পাশ দিয়ে  হেঁটে গেল। বসিরের চোখে  পানি চলে আসল। কতদিন পর  দাদুকে দেখল।হঠাৎ বুড়ো  গলায় কে যেন বলে উঠল, ওই  ফজল। বসিররে দেখছ? বসির তাকিয়ে দেখল ওর  দাদী দাড়িয়ে আছে।

দাদীর হাতে খুন্তি। নিশ্চয়ই রান্না করছিল। ফজল  ওর বাবার নাম।বাবাকে  খুঁজতে আশেপাশে চোখ বুলাল  বসির। হঠাৎ ওর বাম দিকের  মাথার উপরে বসে কেউ বলল, না আম্মা। বসির তো আমার  সাথে না।

বসির দেখল তার বাবা  পেয়ারা পাড়তে ভীষণ  ব্যস্ত। বাবা কি মজা করেই  না পেয়ারা পাড়ছে। বসির  এগিয়ে যেতে থাকে। একটা  ছেলে টেনিস বল নিয়ে  খেলছিল। ওকে দেখে খেলা  বন্ধ করে দেয়। বসির  ধাক্কার মত খায়। কেউ তো ওকে দেখল না। এই বাচ্চাটা  দেখছে কিভাবে? হঠাৎ ও  বুঝতে পারে এই বাচ্চাটা ও  নিজে।

এটা ওর নিজের  ছোটবেলা। ওর সামনে  দাড়িয়ে আছে ছোটবেলার  বসির। বয়স চার কি পাঁচ  হবে। ওর দিকে তাকিয়ে  হাসছে। বসিরের কেমন  কেমন লাগতে থাকে। হঠাৎ বাচ্চাটার কি হল, সে ঘুরেই  উল্টো দিকে দিল দৌড়।

বসিরও পিছনে পিছনে হাঁটা  শুরু করল। সামনে একটা  বিরাট পুকুর।বাচ্চাটা  পুকুরের দিকে দৌড়াচ্ছে। বসিরের মনের মধ্যে ঝড় বয়ে  গেল । সে বুঝতে পাড়ছে বাচ্চাটা কি করতে যাচ্ছে। বসির ঝেরে দৌড় লাগাল  বাচ্চাটাকে ধরতে।

কিন্তু  তার আগেই বাচ্চাটা  পানিতে ঝাপ দিল।বসির  পারে দাড়িয়ে দেখল  বাচ্চাটা ডুবে যাচ্ছে। ওর  অস্থির লাগা শুরু করল। ওর  অবশ্যই কিছু একটা করা  দরকার। এটা তো ওরই  ছোটবেলা।

মানে ও  নিজেই। বাচ্চাটা মারা  গেলে তো ও নিজেই মারা  যাবে। বাচ্চাটাকে  বাঁচাতেই হবে। বসির চোখ  বন্ধ করে পুকুরে ঝাঁপ দেয়।  চোখ খুলে দ্যাখে রাস্তার  মাঝে শুয়ে আছে। দুনিয়ার  লোক তাকে ঘিরে দাড়িয়ে  আছে ।

এরা কি দেখছে?  বসির উঠে বসার চেষ্টা  করতেই একজন বলল, এ দেখি  জীবিত। ধুর? ভাবছিলাম  মরে গেছে।

সবাই একে একে চলে যেতে  থাকে। ওর বেঁচে থাকাটা  বোধহয় এদের কাছে ভাল  লাগেনি। বসির দেখল সে  তার চেনা গলিতেই আছে।

কোথায় কোন অস্বাভাবিক কিছু নেই।খুব ভাল করে খাওয়া দাওয়া  করে গভীর রাতে বসির পুরো  ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে  বসল।

ভেবে ভেবে ও বের করল, পুরো ব্যাপারটাই  আসলে হ্যালুসিনেসন। ক্ষুধার্ত মনের চিন্তা। গত  রাতে কিছু পেটে পরেনি, সকালেও  না। ঘুমিয়েছে  দেরী করে উঠেছেও দেরীতে। তাই হয়তো  মাথায় জট পাকিয়ে গেছে।

কিন্তু একটা ব্যাপার ওর ক্যামন খটকা লাগে।খুব  ছোটবেলায় আসলেই ও একবার  পুকুরে পরে গিয়েছিল।পুকুরে  পরে ভয়ে আতঙ্কে কত  চিৎকার চেঁচামেচি  করেছে। কেউ শোনেনি।

আব্বা, আম্মা, দাদা, দাদী  কেউ না।যখন ভেবেছিল  মরেই যাবে তখন কোথা  থেকে এক লোক এসে লাফ দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে ফেলল।

ঘটনার অনেক পরে ওকে  অজ্ঞান অবস্থায় পুকুরের  পারে পাওয়া গিয়েছিল। কেউ জানে না কে ওকে  বাঁচিয়েছিল? কে ছিল সে??

দাদীর ধারনা ছিল জীনের  কাজ। এদের অনেক ক্ষমতা। মনে ভীষণ দয়া। বসিরও তাই  বিশ্বাস করত।

কিন্তু আজ কেন যেন বসিরের  মনে হচ্ছে, সেই লোকটা আর  কেউ না ও নিজেই ছিল। প্রকৃতি কি ওকে ঘটনাটা এপাশ থেকে দেখিয়ে দিল?

যার ওপাশটা দেখেছিল ২৬ বছর আগে। মন্

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত