১২.০০ এ.এম

১২.০০ এ.এম

ঘড়ি 12.00 A.M
অস্থির লাগছে রাফির।আসলে মাঝে মাঝে এমন দিন আসে, যেদিন কিছুই ঠিকমত হয় না! আজ তেমনই একটা দিন। সামনের দেয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকাল সে। গত একঘণ্টায় মনে হয় দশবার সে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে সময় এগুচ্ছেই না!চেয়ারে হেলান দিয়ে রাফি তার চোখদুটি বন্ধ করে কাল রাত থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে। আসলেই কি তার কোনো দোষ আছে, নাকি…? অদ্রি, রায়হান, ইরিনা।এদের ব্যাপারগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। নাহ, এ নিয়ে ভাবাভাবির আর কিছুই নেই। সে মনে মনে দুটো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজই এসবের একটা সমাধান করে ফেলবে। বেটার লেট দ্যান নেভার!
ঘড়ির লম্বা কাঁটাটা বারোর উপরে আসতেই বেতোভেনের চমৎকার একটা সুর বেজে উঠল। রাফি ড্রয়ার থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটাতে ভরে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।রাতের অন্ধকার কেটে কালো রঙের নিসান জিউক গাড়িটা বেশ দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে উত্তরার দিকে।

নিরব রাতের চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে আদ্রি। হঠাৎ কিছু একটা আওয়াজ শুনতে পেল।তাকিয়ে দেখলো দেওয়ালে একটা ছায়ামূর্তি। ভয়ে আঁৎকে উঠল অন্তরাত্মা। ছায়ামূর্তির বিপরীত দিকে ধীরেধীরে ভয়ার্ত চোখে তাকাল আদ্রি। হু হু করে হেসে উঠল রায়হান।আদ্রির রাগ তখন আকাশছোঁয়া। রাগে বলল,”এত রাতেও তোমার ফাজলামো গেল না।আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।” রায়হান রহস্য হাসি হেসে আদ্রির পাশে বসে বলল,”আহালে আমার রাগকুমারী বুঝি ভয় পেয়েছে।” এই বলে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,”অনেক সাধনার পর আমার প্রিয়াকে আমি পেয়েছি। আমি তো ভাবতাম তোমাকে হয়ত কখনও পাবো না। কখনো আমাকে ভালোবাসবে না।”
আদ্রি বলে উঠল, “ছাড়ো! নেকামো করতে হবে না এখন ঘুমাও।”

কালো নিসান জিউকটা চুপিসারে এসে ফ্লাটের নিচে থামল। রাফি হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে পাঁচিল টপকিয়ে বাসায় ঢুকে পরলো। বিরহের রাত্রির ন্যায় অন্ধকারের মধ্যে ধীর পায়ে আদ্রি আর রায়হানের রুমে ঢুকল। “বাহ! রাজ-রাণী তো ভালই ঘুমাচ্ছে। নেক কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেক। এই তো শেষ ঘুম।এরিমধ্যে আমি ইলেক্ট্রিক স্টিকটা ঠিকঠাক করে নেই।”
মনে মনে বলে উঠল রাফি।

রাফি মনে মনে ভাবতে লাগলো আদ্রি রিফাত কিভাবে তার সাথে বেইমানি করেছে। কিভাবে ইরিনার নামে তার সাথে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে।যার কারণে আজ তার বাবা পৃথিবীতে নেই। রাগ তার এখন ৫০০ ডিগ্রীর চেয়েও বেশি।প্রতিশোধের নেশায় সে অন্ধ। ‘আমি কোনো দুষ করিনি।আমি ইরিনার সাথে কিছুই করেনি।ইরিনার আত্মহত্যার জন্য আমি দায়ী না।”
ভাবতে ভাবতেই লাফ দিয়ে আদ্রি আর রায়হানের খাটের উপর চলে গেল। হকচকিয়ে উঠল রায়হান আর আদ্রি। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই ইলেক্ট্রিক স্টিক তাদের হৃদয় স্পন্দন থামিয়ে দিল।

বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে রাফি….
হঠাৎ কারো চিল্লাচিল্লিতে তার ঘুম ভেঙে গেল।উঠে চেয়ে দেখে ইরিনা। “কি হইছে এত সকাল এসে ডাকছিস কেন?”
কান্না কান্না চোখে ইরিনা নিস্তব্ধের মত তার দিকে চেয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠল, “কাল রাতে আদ্রি আর রায়হান কারেন্টে লেগে মারা গেছে।”
রাফির মনে হল তার কানে এই মাত্র কেউ যেন পারমানবিক বিস্ফুরণ করেছে।”
“কি বলিস? কিভাবে কারেন্ট লাগলো? “প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠল রাফি। ইরিনা জবাব দিল,”কাল রাতে নাকি তাদের খাটের পাশে থাকা মাল্টিপ্লাগ শট হয়ে স্টিলের সম্পূর্ণ খাটে কারেন্ট ছড়িয়ে পরে। তুই তাড়াতাড়ি চল।”
তখনই পাশের ঘর থেকে রাফির বাবা বলে উঠলেন,”রাফি আমি রেডি হয়েগেছি। তুই উঠে রেডি হো, ওখানে যেতে হবে।সকালে পাশের ফ্ল্যাটের লোক পুলিশকে খবর দেয়। এখন পুলিশ সেখানে ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
লাশ দাফনের পর রাফি গাড়িতে বারবার ফুঁপিয়ে উঠতেছে।রায়হান শুধু তার ভালো বন্ধু নয় বরং আপন ভাইয়ের মত ছিল।রায়হান ইরিনা আর আদ্রি এক সাথে কলেজ ভার্সিটি শেষ করে।কিছুদিন আগেই জব পাওয়ার পর রায়হান আদ্রিকে বিয়ে করে।তাদের আগে থেকেই এংগেজম্যান্ট করা ছিল।

রাফির বাবা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে ধীরেধীরে হাটতেছিলেন। হাতে দুটি ডায়রি। উদ্দেশ্য হল নিজের বন্ধু, নাম করা সিক্রিয়াটিস্ট জনাব হাসান রাহমানের বাসা।

গিয়ে হাসান সাহেবকে প্রথমে ডাইরি-১ দিয়ে বললেন সম্পূর্ণ পড়তে। যেখানে এমন কিছু তথ্য লিখা যার অস্তিত্ব এই পৃথীবিতে নেই।
ডাইরি ওয়ানে রাফির অন্য এক জগতের কথা লেখা। তার মা-বাবা কে হত্যা করা হয়েছে। সে লন্ডন পড়া লেখা করার সময় তার বাবা তার মাকে ডিভোর্স দিয়েছেন।আবার সে আদ্রিকে ভালোবাসতো।রায়হানও আদ্রিকে ভালোবাসে। রায়হান ইরিনার সাথে রাফির মিথ্যে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত বানিয়ে আদ্রির কাছে তাকে দুষী বানিয়েছে।ইরিনা সেই অপবাদে আত্মহত্যা করেছে।আগাগোড়া মিলহীন এমন অনেক অবাস্তব কথা লিখা। প্রত্যেকটা পাতায় সেইম টাইম দেওয়া। ১২.০০ এ.এম।

দ্বিতীয় ডাইরেতি লিখা কিভাবে আদ্রি আর রায়হানকে খুন করেছে।একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবরণ দেওয়া। তারপর কিছু পেজ ফাঁকা। তারপর আবার অন্যরকম লিখা। “ইরিনা আর তার মা রাফির বাবাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন।ইরিনার বিবাহ ঠিক করা হয়েছে রাফির সাথে।কিন্তু বিয়ের আগেই ইরিনা আর তার মা রাফির বাবার সম্পূর্ণ সম্পত্তি হাতাতে চাইছিল।আজ ইরিনার আর তার মায়ের কর্মকান্ডের শাস্তি দিতে হবে।”
“হাসান আমার মাথা কাজ করতেছে না। এসব কী?”
“আচ্ছা আমাকে ভাবতে দে।”
কিছুক্ষণ ভেবে আবার জিজ্ঞাস করলেন,”আচ্ছা তর ছেলে কি রাতে একা ঘুমায়? ছোটকাল থেকে?
“হ্যা, ছোটবেলায় ওর মা আমি প্রায়ই বিজি থাকতাম একাই ঘুমাত।”
“ছোট বেলা থেকেই একাকীত্ব পছন্দ করত? ফ্রেন্ড বন্ধু কেমন ছিল?”
“ধর স্বাভাবিক থেকে খুব কম।মানুষের সাথে কম মিশত। কলেজ ভার্সিটি লাইফ সব মিলিয়ে ৪/৫ জন বন্ধু।”
“আই সি, তর আর তর স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন?
“একেবারে খারাপ না আবার বেশি ভালো না।ধর যে যার মত”
“এটা মেন্টাল ডিসঅর্ডার এর এক প্রকার। ডিপারসনালাইজেশান ডিসঅর্ডার।একই মানুষ একই সময়ে নিজের ভেতরে দুই স্বত্বাকে লালন করে।নিজের ভেতর একটা জগত বানিয়ে নেয় যা পরে এক সময় বাস্তবে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে।এরা নিজেকে নির্দিষ্ট টাইমের সাথে এক স্বত্বায় ভাবে পরে আসল স্বত্বায় ফিরলে কিছুই মনে থাকে না। তর ছেলের সময় ১১/১১.৩০ তখন স্বত্বা আসা শুরু করে আর পূর্ণ হয় ১২.০০ টায়।”
“মাই গড! তার মানে আজ রাতে তার টার্গেট ইরিনা? এক্ষুণি বের হতে হবে।কারণ এখন রাত ১১.৪৪।

ঘড়ির লম্বা কাঁটাটা বারোর উপরে আসতেই রাফি ড্রয়ার থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটাতে ভরে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।রাতের অন্ধকার কেটে কালো রঙের নিসান জিউক গাড়িটা বেশ দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে ইরিনার বাসার দিকে।
ইরিনা শান্ত ঘুমে ঘুমিয়ে আছে।অন্ধকারে প্রতিশোধের অগ্নিময় চোখে ইরিনার দিকে তাকিয়ে আছে রাফি। এখনই সময় প্রতিশোধ নেওয়ার।এসব মনে মনে প্রলাপ করতেছে এমন সময় জ্বলে উঠল ঘরের আলো।হকচকিয়ে উঠল রাফি। পেছন ফিরে দেখে তার মৃত বাবা তার আংকেল হাসান সাহেব কে নিয়ে।রাফি ভেবে পাচ্ছে না তার মৃত বাবা কিভাবে জীবিত হলেন।মাথা ঘুরে পড়ে গেল রাফি।

রাফিকে বিশেষ সাইক্রিয়াটিস্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তার ট্রিটমেন্ট চলতেছে।প্রধান ডক্টর হিসেবে আছেন হাসান সাহেব।আর ইরিনা সর্বক্ষণ রাফির পাশে থাকে।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত