দ্য কম্প্যানিয়ন

দ্য কম্প্যানিয়ন

এবার ডক্টর লয়েড, বলল মিস হেলিয়ার, এমন কোনও গল্প বলুন আমাদেরকে, যা শুনলে গা ছমছম করবে। অপূর্ব সুন্দর দুই চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে।

ডক্টর লয়েড বয়স্ক মানুষ, চিরকুমার। গত পাচ বছর ধরে আছেন তিনি সেইণ্ট মেরি মীড গ্রামে, স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসীদের। অনিন্দ্যসুন্দর মিস হেলিয়ারের কথা শুনে কেমন আনমনা হয়ে আছেন তিনি, কিছু একটা মনে করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সম্ভবত। খানিক বাদে বললেন, যেসব গল্প শুনলে গা ছমছম করে, মানে ভূতের গল্প, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা কিন্তু আমাদের টুয়েস ডে নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্য না। আমাদের আলোচনার বিষয় রহস্য। সেসব কাহিনি শুনলে সাধারণত কারোরই গা ছমছম করে না, মিস হেলিয়ার। তারপরও যখন অনুরোধ করেছেন একটা গল্প বলছি, কেমন লাগবে আপনাদের কাছে জানি না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম অনেক বছর আগের ঘটনাটা। এখন আস্তে-আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সব।

চেয়ার টেনে নিয়ে ডক্টরের আরেকটু কাছে গিয়ে বসল মিস হেলিয়ার।লিপস্টিক বের করে লাগাল ঠোটে। বাকিরাও কৌতুহলী চেহারায় তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে।

ক্যানারি আইল্যাণ্ডের নাম শুনেছেন আপনারা কেউ? বললেন লয়েড।
কোথায় ওটা? পাল্টা প্রশ্ন করল জেন হেলিয়ার।
‘দক্ষিণ সাগরে? নাকি ভূমধ্যসাগরে?

একবার দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার সময় ওখানে গিয়েছিলাম আমি, বললেন কর্নেল ব্যান্ট্রি। টেনেরিফ দ্বীপের পর্বতের চূড়ায় সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দারুণ লাগে।

‘আমি যে-গল্প বলছি সেটা গ্র্যাও ক্যানারি আইল্যাণ্ডের, টেনেরিফের না। অনেক বছর আগের কথা। তখন হঠাৎ করেই স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেছে আমার । এত খারাপ যে, প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে পারছি না। ভাবলাম, ইংল্যাণ্ড ছেড়ে বাইরে কোথাও যাই, কিছুদিন কাটিয়ে আসি। দরকার হলে ডাক্তারিও করতে পারব, আবার বায়ু পরিবর্তনও হবে। গেলাম লা পালমায়-গ্র্যাণ্ড ক্যানারির রাজধানী শহর বলা যায় ওটাকে।

মনের সুখেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছি সেখানে, বিভিন্নভাবে উপভোগ করছি জীবনটা, হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাচ্ছি আস্তে-আস্তে। দ্বীপটার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, রৌদ্রোজ্জ্বল।

সার্ফিং করার ভাল ব্যবস্থা আছে। খেয়াল করলাম, বন্দর এবং সেটার আশপাশের সমুদ্রভিত্তিক জীবন চুম্বকের মত টানছে আমাকে। দুনিয়ার প্রায় সব জায়গা থেকে জাহাজ এসে ভেড়ে লা পালমায়। স্রোতের আঘাত ঠেকানোর জন্য তীর বরাবর পাথরের দেয়াল বানানো হয়েছে, প্রতিদিন সকালে ওই দেয়াল ঘেষে হাটতে-হাটতে অনেক দুর চলে যাই আমি।

আগেই বলেছি, বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জাহাজ আসে লা পালমায়। কখনও মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে কোনও-কোনও জাহাজ, কোনওটা আবার দু-একদিন। তাই শহরের এক নম্বর হোটেল মেট্রপোল সবসময় ভর্তি থাকে বিভিন্ন জাতের মানুষ দিয়ে। এমনকী যারা টেনেরিফে যাবে, তারাও সেখানে যাওয়ার আগে কয়েকদিন থেকে যায় ক্যানারি আইল্যাণ্ডে।

জানুয়ারির এক বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা।
নাচ চলছে মেট্রোপলের বলরুমে, আমি আর আমার এক বন্ধু একটা টেবিলের পাশে বসে দেখছি। যারা নাচছে তাদের কেউ-কেউ ইংরেজ, কেউ আবার অন্য দেশের-বেশিরভাগই স্প্যানিশ। ট্যাঙ্গো বাজাতে শুরু করল অর্কেস্ট্রা একসময়, এবার আধ ডজন স্প্যানিশ যুগল নাচার জন্য গেল ড্যান্সফ্লোরে । চমৎকার নাচতে পারে ওরা, তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি আমরা আর প্রশংসা করছি। বিশেষ করে এক মহিলা আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। সে যেমন লম্বা তেমন সুন্দরী, শরীরটাকে সাপের মত পাক খাওয়াতে পারে সুরের সঙ্গে মিল রেখে, ওর প্রতিটা মুদ্রা যেন অর্ধেক পোষমানা চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্র ও সাবলীল। দেখতে যেমন ভাল লাগে, তেমনই বিপদের অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করে দর্শকের মনে ।

কথাটা বললাম আমার বন্ধুকে। মুচকি হেসে বলল সে, “ও-রকম মহিলাদের জীবনে কোনও-না-কোনও ঘটনা থাকেই। ওদের জীবন এমনি-এমনি কেটে যায় না।”

“কোনও-কোনও মেয়ের জন্য,” বন্ধুর উপর থেকে সরিয়ে তাকালাম মহিলার দিকে, “সৌন্দর্যই সবচেয়ে বড় বিপদ ।”
“শুধু সৌন্দর্য না,” আমার সঙ্গে একমত হতে পারল না বন্ধু, “আরও কিছু আছে। ভালমত দেখো মহিলাকে । মনে হয় না, কিছুনা-কিছু ঘটবেই ওর? অথবা মনে হয় না, ওর কারণে কিছু-না-কিছু হবেই অন্য কারও? অদ্ভুত আর উত্তেজক ঘটনা সবসময় ঘিরে থাকে এদেরকে। শুধু দেখে যাও, নিজেই বুঝতে পারবে আমার কথা ঠিক, না বেঠিক।” আরও একবার মুচকি হেসে বলল, “কিন্তু ওই দুই মহিলাকে দেখো, ওদের কিছু হবে না। আটপৌরে জীবন যাপন করার জন্যই দুনিয়াতে এসেছে ওরা।”

বন্ধুর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম আমি। কিছুক্ষণ আগে হল্যাণ্ড লয়েড নামের একটা জাহাজ ভিড়েছে বন্দরে, জেটি ধরে নেমে আসছে যাত্রীরা, বেশিরভাগই এগিয়ে আসছে মেট্রোপলিসের দিকে। ওদের মধ্যে ওই দুই মহিলাও আছে। বিদেশে গেলে ও-রকম ইংরেজ পর্যটকের দেখা মেলে হরহামেশাই। দু’জনের বয়সই চল্লিশের কাছাকাছি, উচ্চতাও সমান, এমনকী চেহারাতেও মিল আছে কিছুটা। একজন সুন্দরী, মেদ জমতে শুরু করেছে শরীরে, তবে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়। আরেকজন খানিকটা রোগাটে। দু’জনের পরনেই চমৎকার ছাটের পরিপাটি কিন্তু সাধারণ টুইডের কাপড়, তাই পোশাকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয় না। কোনওরকম মেকআপ ব্যবহার করেনি কেউই। ওদেরকে একনজর দেখলেই বলে দেয়া যায়, খানদানি ইংরেজ মহিলা।

‘ঠিকই বলেছ আমার বন্ধু, আটপৌরে জীবন কাটানোর জন্যই দুনিয়াতে এসেছে এরা। ‘চোখ ফিরিয়ে আবার তাকালাম সেই স্প্যানিশ মহিলার দিকে। নাচের আবেশে তখন জ্বলছে ওর আধবোজা দু’চোখ। নিঃশব্দে হাসলাম আমি।

‘কৌতুহলী হয়ে সে-রাতেই গেলাম হোটেলের রিসেপসন কাউন্টারে, চেক-ইন রেজিস্টারটা দেখলাম। সদ্য আসা দুই ইংরেজ মহিলার নাম খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। একজন মিস মেরি বার্টন। আরেকজন মিস অ্যামি ডুরান্ট।

পরদিন পিকনিকে আয়োজন করল আমার কয়েকজন বন্ধু, যোগ দিলাম আমিও। ব্যাপারটা এ-রকম-গাড়িতে করে দ্বীপের আশপাশে চক্কর লাগাব আমরা, তারপর লা নেইভ নামের উপসাগরের কাছাকাছি জায়গায় লাঞ্চ সারব। কারও ইচ্ছা হলে লাঞ্চের পর এবং বিকেলের নাস্তার আগে সমুদ্রয়ান করতে পারে সেখানে। রওনা হতে দেরি হয়ে যাওয়ার কথাটা বাদ দিয়ে বললে সব ঠিকমতই চলছিল। ঝামেলাটা হলো লা নেইভে গিয়ে।

সৈকতের কাছাকাছি পৌছে গেছি আমরা, হঠাৎ তুমুল হইচইয়ের আওয়াজ এল কানে। সৈকতে বেশ ভিড়, মনে হচ্ছে শহরের সব লোক সেখানে জড় হয়েছে বুঝি। আমাকে দেখামাত্র আমাদের গাড়ির দিকে ছুটে এল বেশ কয়েকজন-ওরা জানে আমি ডাক্তার, হড়বড় করে বলছে কী হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা গাড়িতে আছি তারা কেউই স্প্যানিশ ঠিকমত পারি না। কাজেই আসলে কী হয়েছে তা বুঝতে বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল আমার। দুই ইংরেজ মহিলা গোসল করার জন্য নেমেছিল সাগরে, সাতার কাটতে-কাটতে বেশ দূরে চলে গেছে একজন এবং বিপদে পড়েছে। অন্যজন যখন বুঝতে পেরেছে ওর বান্ধবী ডুবে যাচ্ছে, তখন ফিরে গিয়ে বাচানোর চেষ্টা করেছে মহিলাকে । কিন্তু ততক্ষণে, যে বাচাতে গেছে তার গায়ের সব শক্তি শেষ। এই মহিলাও ডুবে মরত, কিন্তু তখন ওদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল একটা নৌকা, আরোহী ভদ্রলোক নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে তুলোছে মহিলাকে।

দেরি না-করে ছুট লাগালাম আমি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছি জড় হওয়া লোকগুলোকে, কত তাড়াতাড়ি পৌছব সৈকতে সে-চিন্তা খেলা করছে মাথায়। ও, বলে রাখি, ঘটনার বর্ণনা শুনে আমি কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি কোন দুই ইংরেজ মহিলার কথা বলা হয়েছে।

দূর থেকে দেখতে পেলাম, সৈকতে চিৎ হয়ে নিথর শুয়ে আছে এক মহিলা। পাশে হাটু গেড়ে বসে আছে আরেকজন, কৃত্রিম উপায়ে আনাড়ী কায়দায় শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করছে সংগীনীর। পরনের আটসাট কালো স্টকিনেট কস্টিউম আর রাবারের সবুজ বেদিং ক্যাপের কারণে হৃষ্টপুষ্ট মনে হচ্ছে ওকে।

‘কাছে গিয়ে বললাম আমি একজন ডাক্তার, সঙ্গে-সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মহিলা। সৈকতের ধারের কোনও একটা কটেজ থেকে তোয়ালে আর শুকনো কাপড় নিয়ে আসতে বললাম ওকে। সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল সে, আমাদের পিকনিক পার্টির এক মহিলাও গেল ওর সঙ্গে। আমি ততক্ষণে ডুবে-যাওয়া মহিলাতে বাচিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু যার কপালে মরণ লেখা আছে, তাকে সারানোর ক্ষমতা নেই পৃথিবীসেরা ডাক্তারেরও।

‘আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো, স্থানীয় এক জেলের ছোট একটা কটেজে জড় হলাম আমরা কয়েকজন। সবাইকে জানালাম দুঃখজনক খবরটা। যে মহিলা বেঁচে গেছে সে সুইমিং কস্টিউম ছেড়ে হাতাকাটা ব্লাউয আর ঝুলওয়ালা লম্বা স্কার্ট পরে এসেছে-ওগুলোও আটসাট। এবার ওকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না আমার-গতকাল যে দুই ইংরেজ মহিলা এসেছে দ্বীপে তাদের একজন। সঙ্গিনীর মৃত্যুর খবর শুনে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না ওর, কারণ নিজেও ফিরে এসেছে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে, সেই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনী এখনও।

“বেচারী অ্যামি,” ছলছল চোখে কোনওরকমে বলল সে, “কত আশা করে এসেছিল এখানকার সাগরে সাতার কাটবে! সাতার ভাল জানত বলেই চলে গিয়েছিল অতদূর। কিন্তু হঠাৎ করেই যে কী হলো বুঝতে পারলাম না। বড়-বড় ঢেউও তো ছিল না সাগরে!” আমার দিকে তাকাল। “ডক্টর, আপনার কী ধারণা? আসলে কী হয়েছিল অ্যামির?

“আমি নিশ্চিত না-ক্র্যাম্প, মানে অতিরিক্ত পরিশ্রমে পেশীর সঙ্কোচন হয়ে থাকতে পারে। আমার চেয়ে তো আপনারই ভাল বলতে পারার কথা ঠিক কী ঘটেছিল।”

“মিনিট বিশেক একসঙ্গে সাতার কাটি আমরা। তারপর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই আমি। কিন্তু অ্যামি বলে, আরও কিছুক্ষণ সাতার কাটবে। হঠাৎ করেই শুনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে সে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি সৈকত থেকে বেশ দূরে ডুবে যাচ্ছে বেচারী। তখন যত তাড়াতাড়ি পারি এগোতে শুরু করি ওর দিকে । ওর কাছাকাছি যখন গেছি তখনও ভাসছিল সে, আমাকে পাওয়ামাত্র জাপ্টে ধরে, দু’জনই তলিয়ে যাই। সে-সময় নৌকা নিয়ে এক ভদ্রলোক না-এলে হয়তো আমিও লাশ হয়ে যেতাম এতক্ষণে।”

তারমানে, ভাবছি আমি তখন, যে মহিলা ডুবে মারা গেছে তার নাম অ্যামি ডুরান্ট। আর যে বেঁচে গেছে সে মিস মেরি বার্টন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলতে লাগল মিস বার্টন, মানুষের জীবন কত অনিশ্চিত! গতকাল এসেছি আমরা এখানে, আসার পর থেকে সমানে হাসিতামাশা করছিলাম, কে জানত সাগরে গোসল করতে নামলেই এত বড় একটা দুর্ঘটনা”

“আপনার বান্ধবীর ব্যাপারে কিছু জানাবেন?” বললাম আমি। “অ্যামি আসলে আমার বান্ধবী না। ওকে সঙ্গে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি আমি।

ওকে আমার ব্যক্তিগত সহকারী বলতে পারেন। মাস পাচেক আগে আমার কাছে চাকরি নিয়েছে। আমরা একসঙ্গে আরও কয়েক জায়গায় ঘুরতে গেছি। সে কিছুটা চাপা স্বভাবের ছিল, জোরাজুরি না করলে নিজের ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইত না। কম বয়সে বাবা-মাকে হারায়, বড় হয় ওর এক আঙ্কেলের কাছে। একুশ বছর বয়স থেকে নিজের জীবিকা নিজেই উপার্জন করছিল।”

‘আমার মনে ততক্ষণে অদ্ভুত এক খুঁতখুঁতানি শুরু হয়ে গেছে। অ্যামি ডুরান্ট আমার কেউ না, আমি পুলিশের লোকও না। তারপরও গিয়ে দেখা করলাম স্থানীয় কয়েকজন জেলের সঙ্গে, যারা দূর্ঘটনাটা নিজ চোখে দেখেছে। কিন্তু তেমন কিছু জানা গেল না। তখন এক স্প্যানিশ মহিলা, তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মত এক কাহিনি শোনাল আমাকে।

‘জোর দিয়ে বলল সে, অ্যামি যখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল তখন ওর অবস্থা নাকি ততটা খারাপ ছিল না । কিন্তু ওর কাছে যাওয়ার পর মিস বাটন নাকি জোর করে ওর মাথাটা চেপে ধরে রেখেছিল পানির নীচে ।

‘পাত্তা দিলাম না কথাটা। জেলেরা যা দেখেছে তার সঙ্গে এটা মেলে না একটুও। তা ছাড়া তীরে দাড়িয়ে দূর সমুদ্রের সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখাও সম্ভব না। আমার ধারণা, মিস ডুরান্ট যাতে জ্ঞান হারিয়ে না-ফেলে সেজন্য ওর মাথাটা পানির উপর ভাসিয়ে রাখতে চাচ্ছিল মিস বার্টন। কারণ ডুবন্ত মানুষ আতঙ্কিত হয়ে এমন কাজ করে বসে, যার ফলে যে তাকে বাচাতে যায় তারই মরণদশা হয়। অথচ ওই স্প্যানিশ মহিলা ভাবছে ঠিক উল্টোটা।

যা-হোক, মিস ডুরান্ট মারা যাওয়ার পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। মিস বাটন ওর সঙ্গিনীর কোনও আত্মীয়কেই চেনে না, আদৌ কোনও আত্মীয় আছে কি না তা-ও জানে না। এ-ব্যাপারে আমার কাছেই সাহায্য চেয়ে বসল সে, বলতে পারব না কেন। আমিও কী ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। মিস ডুরান্টের সঙ্গে যা-যা ছিল, সেগুলো নিয়ে হোটেলরুমে বসলাম দু’জনে ।

‘মেয়েরা ব্যবহার করে এমন কিছু টুকটাক জিনিস ছাড়া উল্লেখ করার মত কিছু পাওয়া গেল না। তবে হ্যা, লণ্ডনের একটা ঠিকানা পাওয়া গেল। দেরি না-করে সব জানিয়ে সে ঠিকানায় চিঠি লিখলাম আমি। জবাব পেতেও দেরি হলো না।

“ডক্টর লয়েড, আপনি পরোপকারী মানুষ, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক। দুঃখের বিষয়, যে-ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন সেব্যাপারে বিশেষ কিছু জানি না আসলে। আমার এখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত মিস ডুরাস্ট। একটু অদ্ভুত ধরনের ছিল সে-কেমন মুখচোরা আর চাপা স্বভাবের। ভাড়ার টাকাটা আদায় করার সময়ের কথা বাদ দিয়ে বললে ওর সঙ্গে দেখা হত না আমার। বাড়িওয়ালি হিসেবে অন্যান্য তাঁড়াটেদের সঙ্গে বেশ খাতির আছে আমার কিন্তু মিস ডুরান্ট ব্যতিক্রম। আপনার কাছ থেকে দুঃখজনক ঘটনাটা জানতে পেরে তালা ভেঙে গিয়ে ঢুকলাম ওর ঘরে। কিম্ভ দু-একটা পুরনো আর সস্তা আসবাব, বেশ কয়েকটা পেইণ্টিংস আর এক ট্রাঙ্কভর্তি হাবিজাবি কিছু জিনিস ছাড়া ব্যক্তিগত এমন কিছু পাইনি, যা থেকে ওর পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে কিছু জানা যেতে পারে। তবে ভাড়া নেয়ার সময় আমাকে বলেছিল, সে যখন শিশু তখন ওর বাবা-মা নাকি মারা গেছে ভারতে। এক আঙ্কেল বড় করেছেন ওকে। ভদ্রলোক পেশায় যাজক। তবে তিনি ওর চাচা নাকি মামা তা বলেনি কখনও। এবং আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার সামনে নামটাও উচ্চারণ করেনি কখনও। ভাল থাকবেন। আবার যদি কোনও দরকার হয়, নিঃসঙ্কোচে যোগাযোগ করবেন। ”

‘এখন আপনারাই বলুন কী বলা যায় ঘটনাটাকে? রহস্যজনক? তারচেয়ে বরং অসন্তোষজনকই বলি। মিস ডুরান্টের মত এ- রকম নিঃসঙ্গ, মুখচোরা, চাপা স্বভাবের হাজার- ; হাজার মহিলা আছে লণ্ডনে। ব্যস্ত নাগরিক অজুহাত দিয়ে সে-পরিচয় জানতে চায়ও না কেউ।

‘এক জোড়া ফটোগ্রাফ পাওয়া গেল মিস ডুরান্টের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করে। দুটো ছবিই অনেক পুরনো, তাই মলিন হয়ে গেছে; যে-ফ্রেমে আছে সেখানে যাতে আঁটে সেজন্য কেটে ছোট করা হয়েছে। কাটার কাজটা যে করেছে, খুব একটা সতর্ক ছিল না সে, তাই বাদ পড়েছে ফটোগ্রাফারের নাম। একটা দাগেরোচিত্রও (ফরাসি উদ্ভাবক জাক দাগের কর্তৃক ১৮৩৮ সালে উদ্ভাবিত আলোকচিত্রগ্রহণ পদ্ধতি অনুযায়ী গৃহীত আলোকচিত্র) পাওয়া গেল-সম্ভবত মিস ডুরান্টের মা অথবা নানির।

‘কী করব ভেবে পাচ্ছি না, এমন সময় মিস বার্টন বলল, “আমাকে একবার দু’জন আত্মীয়ের কথা বলেছিল অ্যামি।” ‘আগ্রহী হয়ে উঠলাম। “যেমন?”

“একজনের নামধাম ভুলে গেছি পুরোপুরি।”

ফু দিলে যেভাবে জ্বলন্ত মোমবাতি নিভে যায় সেভাবে নিভে গেল আমার উৎসাহ ;তারপরও বললাম, “আরেকজন?”
আরেকজন…আরেকজন… সম্ভবত বিদেশে থাকে…অস্ট্রেলিয়া না কোথায় যেন। নাম-ঠিকানা কিছুই জানি না।”
হতাশ হয়ে চলে এলাম হোটেল থেকে।

আমার মনের সব শান্তি শেষ ততক্ষণে। কে এই অ্যামি ডুরান্ট? দেখা যাচ্ছে কেউই কিছু জানে না ওর ব্যাপারে। অদ্ভুত ওই গল্প কেন বলল স্প্যানিশ মহিলাটা? আরেকটা কথা। মিস ডুরান্টকে যখন বাচানোর চেষ্টা করছি আমি, সৈকতসংলগ্ন কটেজের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছে মিস বার্টন, তখন ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে, বলা বাহুল্য মিস ডুরান্টের দিোক তাকায় সে। আশ্চর্য, ওর চেহারায় একইসঙ্গে ক্রোধ আর অনিশ্চয়তার ছাপ! সঙ্গিনীকে বাচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে—এতে রাগ করার কী আছে? তা ছাড়া যে-অবস্থায় পাওয়া গেছে মিস ডুরান্টকে, তাতে ওর বাচা-মরা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকতেই পারে, তা-ই না?

তবে একটা কথা ঠিক-মিস ডুরান্টকে পছন্দ করত মিস বার্টন, এবং সঙ্গিনীর মৃত্যুতে মনে চোট পেয়েছে সে। তখন বিদ্যুচ্চমকের মত একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার । স্প্যানিশ মহিলার কথা যদি আসলেই ঠিক হয়, মানে যদি ঠাণ্ডা মাথায় মিস ডুরান্টকে খুন করে থাকে মিস বার্টন, তা হলে আমার মত একজন ইংরেজ ডাক্তারের হঠাৎ আবির্ভাবে রাগ করতেই পারে সে। আর অনিশ্চয়তা? সঙ্গিনীকে বাচানোর অভিনয় করে খুন করল; এখন যদি সুস্থ হয়ে যায় সঙ্গিনী, যদি আসল কথা বলে দেয় সবার কাছে? তাহলে পুরোপুরি ফেসে যাবে মিস বার্টন। কাজেই ওর চেহারায় অনিশ্চয়তা দেখা দেবে না তো কার চেহারায় দেখা দেবে? ব্যাপারটা নিয়ে যতই ভাবছি আমি, বের করতে পারছি না কীভাবে সমাধান করা যায় রহস্যটার। আমার সন্দেহ মিস বার্টনকে, কিন্তু ওর মত একজন চমৎকার ব্যবহারের মানুষ কেন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে যাবে মিস ডুরাণ্টের মত কাউকে? নিয়োগদাত্রী হয়ে অধীনস্থ কাউকে এত নিষ্ঠুরভাবে। কথাটা ভাবতে গিয়ে মনে-মনে লজ্জিত হলাম নিজেই। ‘স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল মিস বার্টন, ভেবে দেখলাম একজন ইংরেজ হিসেবে ওকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য, তাই যথাসম্ভব করলাম। তারপরও আমার মন থেকে সন্দেহ দূর হলো না। টের পেলাম পরোপকুার করছি ঠিকই, কিন্তু আসলে তীব্র বিতৃষ্ণা টের পাচ্ছি মিস বাটনের প্রতি।

দু’সপ্তাহের মত ওই দ্বীপে থাকল সে। তার অনেক আগেই দাফন করা হয়ে গেছে মিস ডুরান্টকে। যতদূর মনে পড়ে, দাফনকাফনের দশ-বারোদিন পর ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে রওনা হয় মিস বার্টন। যাওয়ার আগে বিষগ্ন চেহারায় আমাকে বলে, “প্ল্যান করেছিলাম এই দ্বীপে পুরো শীতকালটা কাটিয়ে তারপর ফিরব দেশে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! মন ভেঙে গেছে আমার। এখানে থাকলে একাকীত্ব সহ্য করতে না-পেরে হয়তো পাগলই হয়ে যাব!”

“যেদিন সে চলে গেল তার আগেরদিন সন্ধায় লোক মারফত খবর পাঠাল আমার কাছে—সম্ভব হলে যেন দেখা করি। গেলাম ওর কাছে।

“আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না,” আমি ওর রুমে যাওয়ার পর বলল ভদ্রতা করে । “আমার জন্য যা করেছেন আপনি, আজকালকার দিনে অচেনা কারও জন্য সে-রকম কিছু করে না কেউ ”

“এখানে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। একজন ইংরেজ হয়ে যদি নিজের দেশের মানুষের জন্য কিছু না-করি, তা হলে জংলিদের সঙ্গে পার্থক্য থাকল কই? আমি যা করেছি, আমার জায়গায় অন্য কোনও ইংরেজ থাকলেও তা-ই করত।” “আচ্ছা, ডক্টর,” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল মিস বার্টন, “একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?”

বিব্রত হয়ে গেলাম খানিকটা। “জানা থাকলে অবশ্যই দেব ।”
“কী মনে হয় আপনার-নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া উচিত কারও?”

“আপনি এমন একটা প্রশ্ন করেছেন, যার জবাব দেয়া খুব কঠিন । তারপরও বলব, কাজটা করা উচিত না কারোই । আইন

আইনই, আমাদের তা মান্য করে চলতে হবে।
আইনের যদি কোনও ক্ষমতা না-থাকে তারপরও?
আমি আসলে…আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

বোঝানোটা মুশকিল। আমার মনে হয়, উপযুক্ত কারণ থাকলে, আইন বা সমাজের দৃষ্টিতে যা অপরাধ তা করলে দোষ দেয়া ঠিক না কাউকে । মুচকি হাসলাম,

দুনিয়ার সব ক্রিমিনালই কিন্তু নিজের সাফাই গাইবার জন্য ওই কথাই বলে। যে চুরি করে, তাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, পেটের দায়ে করি কাজটা । আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি ব্যাপারটা, যদি ক্ষমা করে দিই চোরকে, তা হলে একদিন আমার-আপনার সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাবে সে । সেদিন কোথাও অভিযোগ জানাতে পারব না আমরা, কোনও প্রতিবাদ করতে পারব না। ঠিক না?

‘সোফায় হেলান দিল মিস বাটন। “বীভৎস!” বলল বিড়বিড় করে। তারপর গলার সুর পাল্টে বলল,

“আচ্ছা, ডক্টর, এমন কোনও ওষুধ দিতে পারবেন আমাকে যা খেলে ভাল ঘুম হয়? অ্যামি মারা যাওয়ার পর থেকে ঠিকমত ঘুমাতে পারছি না।”

দুশ্চিন্তায় ভুগছেন?
কিসের দুশ্চিন্তা?

“সেটা তো অ্যামির চেয়ে ভাল আপনার জানার কথা। অনেক সময় টানা দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকলে ঠিকমত ঘুম হয় না।”

কী বোঝাতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না আসলে । আমার অতীতের কোনও ঘটনার কথা বলছেন? নাকি ভবিষ্যতের এমন কিছু যা চেষ্টা করলেও ঠেকাতে পারব না?

যে-কোনওটা হতে পারে।

দেখুন, ডক্টর, অতীত নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই কোনও। যা ঘটে গেছে, হাজার চেষ্টা করলেও তা পরিবর্তন করা যায় না। ফিরিয়ে আনা যাবে না…” কথা শেষ না-করে থেমে গেল সে । ‘ওকে হালকা ঘুমের ওষুধ দিয়ে চলে এলাম আমি। ফুটপাত ধরে হাটছি আর ওর কথাগুলো ভাবছি। কী, অথবা কাকে ফিরিয়ে আনার কথা বলছিল সে?

যা-হোক, সে-বছর মার্চ মাসে, পত্রিকায় একটা খবর পড়লাম : কর্নওয়ালের রহস্যময়ী। ব্যাপারটা এ-রকম-ওখানকার এক সভ্যতার- ছোয়াবঞ্চিত গ্রামে, সাগরের ধারে, এক সরাইকানায় য়েকদিন ধরে থাকছে মিস বার্টন নামে অদ্ভুত স্বভাবের এক মহিলা। ছিটপাগলামির কারণে ইতোমধ্যে সবার নজরে পড়েছে সে। গভীর রাতে নিজের ঘরে পায়চারি করে বেড়ায়, কথা বলে নিজের সঙ্গেই। কখনও-কখনও চিৎকার করে ওঠে, এবং ওর এই চেচামেচির কারণে আশপাশের ঘরের কেউ ঘুমাতে পারে না ঠিকমত। মহিলা একদিন হঠাৎ করেই গ্রামের যাজকের কাছে গিয়ে বলে, কী নাকি সাংঘাতিক এক কথা বলার আছে তাকে । মারাত্মক এক অপরাধ করে ফেলেছে, সেটাই স্বীকার করতে চায়। কিন্তু কিছু না- বলেই লাফিয়ে উঠে দাড়ায় হঠাৎ বলে, আরেকদিন এসে সব জানাবে। যাজক ধরে নেন, মহিলার মাথায় সমস্যা আছে, তাই কিছু বলেন না। এবং ওই “সাংঘাতিক কথা” অথবা “মারাত্মক অপরাধের” ব্যাপারেও কৌতুহল দেখান না ।

পরদিন সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না ওই রহস্যময়ীকে। সরাইখানায় নিজের জন্য যে-ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে, সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল খা-খা করছে সেটা। তবে করোনারকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেছে ওই ঘরে, যার বিষয়বস্তু:

গতকাল যাজকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, ইচ্ছে ছিল সব বলব তাকে, কিন্তু পারিনি। আসলে কাজটা করতে দেয়া হয়নি আমাকে। সে দেয়নি। এখন ভুল শোধরানোর একটা উপায়ই আছে আমার-জীবনের বিনিময়ে জীবন। এবং ওর জীবন যেভাবে শেষ হওয়া উচিত। আমাকেও বাঁপিয়ে পড়তে হবে সাগরে, ডুবে মরতে হবে । অ্যামির ক্ষমা পেতে চাইলে ওর কাছে যেতে হবে আমাকে । সুতরাং আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। -মিস বাটন।

সৈকতে, নির্জন এক খাড়ির ধারে পাওয়া যায় মহিলার কাপড়। বোঝাই যাচ্ছে ওখানে কাপড় ছেড়ে খাড়িতে নেমে পড়েছে সে,  তারপর সাতার কেটে এগিয়ে গেছে উত্তাল সাগরের দিকে। সবাই জানে, ওই জায়গার স্রোত ভীষণ বিপজ্জনক।

‘রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি মিস বার্টনকে, এবং অতিবাহিত সময় বিবেচনা করে ধারণা করা হয়, আর পাওয়া যাবেও না। খোজখবর করে জানা গেছে, মহিলা যথেষ্ট ধনী, ওর সম্পত্তির মোট মূল্য আনুমানিক এক লক্ষ পাউণ্ড। মৃত্যুর আগে কোনও উইল নাকরে যাওয়ায় সব সম্পত্তি পাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা কয়েকজন নিকটাত্মীয়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মস্তিষ্কবিকৃতিজনিত আত্মহত্যা, থামলেন ডক্টর লয়েড। চুপ করে আছেন।

কিছু বলছেন না যে? জিজ্ঞেস না-করে পারল না জেন হেলিয়ার ।

আর কি বলব? মিস ডুরান্ট মরল, ওদিকে আত্মহত্যা করল মিস বার্টন।

“কিন্তু আপনার কাহিনি নিশ্চয়ই শেষ হয়নি? আমার ধারণা, সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং অংশটা বাকি আছে এখনও।’
মিস হেলিয়ার, এটা বাস্তব জীবনের গল্প । চলতে হঠাৎ থেমে যায়, পরে কী হবে বলতে পারে না কেউ।

ঠিক আছে, ডক্টর লয়েড বললেন স্যর হেনরি । আপনি দম নিন, এই ফাকে একটু ব্রেইনওয়ার্ক করি আমরা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন নিজের সঙ্গিনীকে খুন করল মিস বার্টন?

‘অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, বলল মিস হেলিয়ার। হয়তো আদেশ মানেনি মিস ডুরান্ট, তাই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল মিস বার্টনের। অথবা হতে পারে ঈর্ষান্বিত হয়ে করেছে সে কাজটা ! আবার ভালবাসাবাসিও জড়িত থাকতে পারে ঘটনাটার সঙ্গে। ডক্টর লয়েড সেভাবে কোনও পুরুষের কথা উল্লেখ করেননি, কিন্তু নৌকার ওই লোকটা…যে জীবন বাচিয়েছে মিস বার্টনের .. জড়িত থাকতে পারে এসবের সঙ্গে ।

‘ডক্টর লয়েড, মুখ খুললেন মিস মার্পল, কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। সৈকতে যখন শুশ্রুষা করছেন মিস ডুরান্টের, তখন মিস বার্টনের পরনে কি ছিল?

কেন-সাতারের পোশাক? কালো স্টকিনেট কস্টিউম আর রাবারের সবুজ বেদিং ক্যাপ।
ওগুলো টাইট হচ্ছিল ওর গায়ে, না?

আ…খুব একটা না। তা ছাড়া সাতারের পোশাক তো একটু টাইট ফিটিং-ই পরে সবাই, তা-ই না?
কিন্তু যখন হাতাকাটা ব্লাউয, আর ঝুলওয়ালা লম্বা স্কার্ট পরে এসেছিল, তখন?

‘হ্যা, তখন বেশ মোটা দেখাচ্ছিল ওকে মহিলা মনে হয় আঁটসাট কাপড় পরতেই পছন্দ করে। আবার এটাও হতে পারে, কোন সাইযের জামা লাগবে ওর গায়ে জানে না ঠিকমত। যারা মুটিয়ে যেতে থাকে তারা এ-রকম সমস্যায় ভোগে হরহামেশা।”

আমার কী মনে হয় জানেন? বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি। আমার মনে হয় অ্যামি ডুরান্টের বাবাকে ঠকিয়ে বিষয়-সম্পত্তি হাত করেছিল মিস বার্টনের বাবা। সেগুলোই পরে উত্তরাধিকার সূত্রে পায় সে। শোধ নেয়ার জন্য মিস বার্টনের কাছে চাকরি নেয় অ্যামি, ইচ্ছা ছিল সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে। কিন্তু ব্যাপারটা টের পেয়ে যায় মিস বার্টন, নিজের হাতে পথের কাটা দূর করে ক্যানারি আইল্যাণ্ডে গিয়ে। আবার এ-রকমও হতে পারে, কমবয়সী কোনও ভাই ছিল মিস বার্টনের, যে মজেছিল অ্যামির প্রেমে.। কিন্তু লোকটাকে পাত্তা দেয়নি অ্যামি, তাই অভিমানে আত্মহত্যা করে ওই লোক। মিস বার্টন ঠিক করেন, ভাইয়ের মৃত্যুর শোধ নেবেন, আর তাই…’

‘বেশি-বেশি অনুমান করা হয়ে যাচ্ছে আসলে, স্ত্রীকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন কর্নেল ব্যাট্রি। আমার মনে হয় মিস হেলিয়ারের কথাই ঠিক-নৌকার ব্যাটাছেলেটা কোনও-না কোনওভাবে জড়িত এ-সবের সঙ্গে। ওর সঙ্গে আইল্যাণ্ডে গিয়েছিল খচ্চর মহিলাটা-আর কোনওভাবে তা জেনে ফেলে মিস ডুরান্ট। তখন ওই লোক আর মিস বার্টন মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, চিরতরে মুখ বন্ধ করে দেবে মিস ডুরান্টের । আহা, বেচারী’

আমার অনুমান, মুখ খুললেন স্যর হেনরি, আগে থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল মিস বার্টন। মানসিক সমস্যা যে কতরকম হয়, বললে বিশ্বাস করবেন না আপনারা। এরকম কত কেস দেখেছি আমি! আমার মনে হয়, আসলে একরকম বাতিক ছিল মিস বার্টনের। হতভাগী মহিলাদেরকে সহ্য করতে পারত না সে, ওদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে সেটাই করেছে মিস ডুরান্টের বেলায়। ওই মহিলার অতীত সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না। ওর বাড়িওয়ালি যে-চিঠি পাঠিয়েছে ডক্টর লয়েডের কাছে, সেটা থেকে বোঝা যায় হতভাগ্য জীবন ছিল মহিলার। তা ছাড়া যেভাবে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছে মিস বার্টন, যেভাবে আত্মহত্যা করেছে, শুনলে কারোই সন্দেহ থাকার কথা না-আসলেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল সে।

কিছু মনে করবেন না, স্যর হেনরি, মুখ খুললেন মিস মার্পল, আপনার ধারণাটা সম্ভবত ঠিক না। মানসিক দিক দিয়ে আপনি-আমি যতটা সুস্থ, আমার মনে হয় মিস বার্টনও ততটা সুস্থ । সে আসলে খুব চালাক ।

চুপ হয়ে গেছে ঘরের সবাই। বুঝতে পারছে, চমকে ওঠার মত কিছু একটা বলবেন এখন মিস মাপল ।

কৌতুহলী হয়ে হোটেলর রেজিস্টার দেখলেন ডক্টর লয়েড। কিন্তু তিনি কি জানতেন কে মিস বার্টন, আর কে মিস
ডুরান্ট? জবাব নেই কারও মুখে ।

কথাটা, ওই দুই মহিলা, বলা ভাল অ্যামি ডুরান্টও জানত। ওদেরকে কেউ চেনে না ক্যানারি আইল্যাণ্ডে । ডক্টর লয়েড যদি বলতেন, দ্বীপসংলগ্ন সাগরে ডুবে মরেছে মিস বার্টন, কপালগুণে যে-মহিলা বেঁচে গেছে তার নাম মিস ডুরান্ট-তা হলে কী করার ছিল আমাদের?

বিড়বিড় করে কি যেন বললেন স্যর হেনরি, ঠিক বোঝা গেল না।

আলোচনার খাতিরে আগের নাম দুটাকেই রাখি আমরা। আচ্ছা বলুন তো, মিস বার্টনের মত একজন ধনী মহিলা কী কারণে_ওর অধীনস্থ আর আপাতদৃষ্টিতে নম্রভদ্র সঙ্গিনীকে খুন করবে? কিন্তু যদি উল্টোটা হয়—যদি বলি মিস ডুরান্টই খুন করেছে মিস বার্টনকে, তা হলে?

তাহলে আমি বলব, বললেন মিসেস ব্যান্ট্রি, অবাস্তব এক হত্যাকান্ডের কথা বলছেন আপনি ।

ঠিক এ-সুযোগটাই নিয়েছে মিস ডুরান্ট। চিন্তা করে দেখেছে, ক্যানারি আইল্যাণ্ডের মত অপরিচিত জায়গায় মিস বার্টনকে খুন করে যদি নিজেকে মিস বার্টন বলে চালিয়ে দিতে পারে ঘুণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করতে পারবে না
কেউ ‘

“কিন্তু…
হাত তুলে মিসেস বাস্ট্রিকে থামিয়ে দিলেন মিস মার্পল। আমি বলছি, শুধু শুনে যান আপনারা। ডক্টর লয়েড, আমার কোনও ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন। মিস বার্টন আর মিস ডুরাণ্টের চেহারায় মিল আছে। দু’জনেরই বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, উচ্চতাও সমান। ইংল্যাণ্ড থেকে গেছে-কাজেই ক্যানারি আইল্যাণ্ডের কর্মকর্তারা ওদের পাসপোর্টও ভালমত খেয়াল করে দেখেনি। দেখলে এত বড় একটা ধোকা দিয়ে পার পেয়ে যেত না মিস ডুরান্ট। যাহোক চেহারার সাদৃম্য, কাছাকাছি বয়স, স্পানিস কর্মকর্তাদের গাফিলতি –সবই খেয়াল করে ডুরান্ট। খুনের প্ল্যানটা তখনই খেলে যায় ওর উর্বর মস্তিষ্কে । তারপর খুন করে মার্চ মাসে গিয়ে উপস্থিত হয় সভ্যতার ছোয়াবঞ্চিত এক কর্নিশ গ্রামে, মিস বার্টন নামে ভাড়া নেয় সরাইখানার একটা ঘর। অদ্ভুত আচরণ করে নিজের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবার। ঘরে লিখে রেখে যায় একটা চিরকুট, নির্জন জায়গায় কাপড় ফেলে রেখে প্রমাণ করার চেষ্টা করে “আত্মহত্যা” করেছে সে। তারপর.তারপর কী করেছে, বলুন তো? পারবেন না, তা-ই তো? ঠিক আছে, আমিই বলে দিচ্ছি। তারপর সোজা চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়, মিস বার্টনের সেই নিকটাত্মীয় হয়েছে। আমার ধারণা, সে সত্যি-সত্যিই মিস বার্টনের সেই নিকটাত্মীয়।”

আপনার তুলনা হয় না! বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে মিস মাপলের দিকে তাকিয়ে আছেন ডক্টর লয়েড। ঘটনার বর্ণনা শুনেই’

“তারমানে আমার অনুমান ভুল না?
‘অবশ্যই না।”

ইন্টারেস্টিং অংশটুকু বলুন এবার।
ঠিক আছে।” দম নিয়ে শুরু করলেন ডাক্তার লয়েড। স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হলো আমার। ডাক্তার হিসেবে চাকরি নিলাম সমুদ্রগামী এক জাহাজে। নিয়তির কী খেলা…সেই জাহাজ আমাকে সবচেয়ে আগে যে-জায়গায় নিয়ে গেল তার নাম মেলবোর্ন। বন্দরে নেমে জেটি ধরে কিছুদূর এগোনোমাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত থমকে দাড়াতে হল। রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছে এক মহিলা, যে কি না কর্নওয়ালের এক গ্রামসংলগ্ন সাগরে ডুবে মরেছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ ।

আমাকে দেখামাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত থমকে দাড়াল সে-ও, বুঝতে পেরেছে খেল খতম । তবে…মিস মাপল যেমনটা বলেছেন..মহিলা ভীষণ চালাক, আর কে না জানে চালাক মানুষরাই সাহসী হয়? ধীর পায়ে এগিয়ে এল সে আমার দিকে, কাছে এসে বলল, “ভাল আছেন, ডক্টর লয়েড?”

‘আমি তখন বুঝতে পারছি না কী করব। তাই জবাব দিলাম না প্রশ্নটার। মহিলা বলল, “চলুন, কোনও বারে গিয়ে বসি । গলা ভেজাতে-ভেজাতে কথা বলি আপনার সঙ্গে। প্লিয ।”

‘গেলাম কাছের একটা বারে, বসলাম এককোনায়, মহিলা ড্রিঙ্কের অর্ডার দিতে চাওয়ায় বিরক্ত হয়ে বললাম, “আমি মদ খাই না। আপনার যা বলার সংক্ষেপে বলুন, তাড়া আছে আমার ।”

“আমরা নয় ভাইবোন,” বলতে শুরু করল মহিলা । “বাবা ছিলেন হতদরিদ্র । আমাদের সবচেয়ে ছোট তিন ভাইবোন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল একবার, কিন্তু ওদের চিকিৎসার খরচ বহন করার সামর্থ্য ছিল না তার ৷ সাহায্যের আশায় তিনি তখন গেলেন ইংল্যাণ্ডে, একমাত্র ধনী আত্মীয় এক চাচার কাছে কিছু সাহায্য চাইতে । কিন্তু চাচা ততদিনে মারা গেছেন, বাবাকে মুখের উপর মানা করে দিল চাচাতো বোন মিস বার্টন। শুধু তা-ই না, যাচ্ছেতাই বলে অপমান করল সে বাবাকে ।

“পৃথিবী এমন এক জায়গা, ডক্টর লয়েড, সেখানে যদি প্রাণ খুলে হাসতে থাকেন আপনি তা হলে দু-চারজন দুধের মাছি জুটে যাবে আপনার সঙ্গে, অথচ যদি হাপুস নয়নে কাদতে শুরু করেন তা হলে আপনার আপনজনরাও চলে যাবে যতদূরে সম্ভব । শোক আর অসহায় দারিদ্র্য সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করল বুড়ো বাপটা। একের পর এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মনকে, চোখেরপানি মুছতে-মুছতে সান্তুনা দিলাম এই বলে,যদি এক বাপের মেয়ে হয়ে থাকি তা হলে শোধ নেবই একদিন-না-একদিন । “কাজে লেগে গেলাম। রক্ত পানি করে, হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে টাকা জমাতে লাগলাম। তারপর একদিন রওনা হলাম ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে । সেখানে গিয়ে প্রথমেই শুরু করলাম ধাত্রীর কাজ-যেটা সবচেয়ে ভাল পারি। নিজের থাকার জন্য ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিলাম, পুরনো আর সস্তা অথচ মজবুত কিছু আসবাব তুললাম সে-ঘরে যাতে আমার রুচির পরিচয় পায় বাড়িওয়ালি । তারপর একদিন দেখা হলো মিস বার্টনের সাথে, নিজের পরিচয় দিলাম, আপাতদৃষ্টিতে ভাল কিন্তু আসলে দয়ামায়াহীন মহিলাটার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে চাকরী শুরু করলাম। বাকিটা আপনি জানেন… ক্যানারি আইল্যাণ্ডে গিয়ে বুঝতে পারলাম মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেছি, তখন খাণ্ডারনিটাকে খুন করে ফিরে এলাম অস্ট্রেলিয়ায়। আজ থেকে বেশ ক’বছর আগে আমার বাবা টাকা ধার চাইতে গিয়েছিল ওর কাছে, কিন্তু দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল সে, ওর মৃত্যুর পর ন্যায্য উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা ছ’ভাইবোন সে-সম্পত্তির পুরো হিস্যা পেয়েছি।”

“‘কী সাংঘাতিক চালাক মহিলা!” বিস্ময় প্রকাশ না-করে পারলেন না স্যর হেনরি। হ্যা, মিসেস ব্যাস্ট্রি, ঠিকই বলেছেন আপনি-অবাস্তব আর অসম্ভব এক-হত্যাকাণ্ড । ক্যানারি আইল্যান্ডে যদি “অ্যামি ডুরান্টের” বদলে “মিস বার্টন” মরত, তা হলে সবাই সন্দেহ করত অ্যামিকেই। পুলিশ ঠিকমত তদন্ত করলে মিস বাটনের সঙ্গে ওদের আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা বের করে ফেলত। নাহ, নিখুঁত অপরাধ!
ডক্টর লয়েড? জানতে চাইলেন মিসেস ব্যাট্রি।

“সেদিন বারে ওর কথাগুলো শুনে ওর আবেগ স্পর্শ করল আমাকে-জানি না কেন । সে বলাতে গেলাম ওদের বাসায়, দেখলাম পরিবারটাকে । হাসিখুশি একটা সংসার, মা মারা গেছে অনেক আগেই, তাই বাকিরা মা’র মত সন্মান করে বড় বোনটাকে, পারলে জান দিয়ে দেয় অ্যামির জন্য এমন অবস্থা। সে কত বড় অপরাধ করেছে সে-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কারোই । ওদের ওখানে বসে ধূমায়িত চা খেতে-খেতে ভেবে দেখলাম, ইচ্ছা করলেই যেতে পারি পুলিশের কাছে, কিন্তু তাতে কি বিশেষ কোনও লাভ হবে? এতদিন পরে কীভাবে প্রমাণ করতে পারব, অ্যামি ডুরান্টের বদলে ক্যানারি আইল্যাণ্ডের সাগরে আসলে ডুবে মরেছে বলা ভাল মারা হয়েছে হয়েছে মিস বার্টনকে? কীভাবে প্রমাণ করব, কর্নওয়ালের সাগরে আসলেই আত্মহত্যা করেনি “মিস বার্টন?” মেলবোর্নের বারে বসেেআমার কাছে নিচু গলায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে অ্যামি, কিন্তু তখন ধারেকাছে কেউ ছিল না; তাই এমন একটা লোকও নেই, যে আমার হয়ে কিছু বলতে পারবে আদালতে।

কাজেই বিধাতার দুনিয়া ছেড়ে দিলাম বিধাতার হাতেই। আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে আসার ছ’মাস পর

আকস্মিকভাবে মারা গেল মিস ডুরান্ট। যে-রকম ফুরফুরে মেজাজে এবং কৃতকর্মের জন্য অনুতাপহীন অবস্ঞায় দেখেছি ওকে মেলবোর্নে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেরকমই ছিল কি না কে জানে!”

মনে হয় না, মিসেস ব্যান্ট্রির কণ্ঠে দ্বিধা। ‘আমার মনে হয়, মুচকি হেসে বললেন মিস মার্পল। মিসেস ট্রাউটও সে-রকমই ছিল।

“মিসেস ট্রাউট?’ আশ্চর্য হয়ে মিস মাপলের দিকে তাকালেন ডক্টর লয়েড।
‘হ্যা, মিসেস ট্রাউট । তার কথা মনে পড়ে গেল বলেই তো আপনি বলার আগে সমাধান করে ফেললাম রহস্যটার।’ ‘কী করেছিলেন তিনি?’ ‘আমাদের গ্রামের ওই বুড়িকে দেখলে মনে হবে সাধু-ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। অথচ ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়েছে সে চেহারার সাদৃশ্যের কারণে এবং জাল কাগজপত্রের কল্যাণে মাসের পর মাস ধরে বয়স্কভাতা তুলেছে মারা-যাওয়া অন্য তিন বুড়ির নামে। কিন্তু ধরা পড়ার পর দোষ তো স্বীকার করেইনি, উল্টো চোরের মা’র বড় গলার মত বলেছে যা করেছে ঠিকই করেছে এবং সেরকমই করা উচিত সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে, বুড়োবুড়িদের।

“কিন্তু মিসেস ট্রাউটের সঙ্গে অ্যামি ডুরান্টের ঘটনাটা মিল করলেন কী করে?
ওর গায়ে সুইমিং কস্টিউম টাইট হচ্ছিল-ব্যাপারটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ব্লাউয-স্কার্ট টাইট হবে কেন? জাহাজ থেকে নামার সময় টুইডের যে-কাপড় পরে ছিল, সেটা তো ঠিকই ছিল? কোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে আরামদায়ক কাপড় নেয় লোকে, নাকি বেছে-বেছে আটসাট কাপড়গুলো নেয়? আসলে মিস বার্টনকে খুন করার পর, ওই মহিলার কাপড় পরে এসে নিজেকে মিস বার্টন বলে চালানোর চেষ্টা করছিল অ্যামি। চলে যাওয়ার আগেরদিন সন্ধ্যায় ডক্টর লয়েডকে ডেকে নিয়ে গেল সে নিজের হোটেলরুমে। এমন একটা ভান করছিল তখন, যেন চেষ্টার ক্রটি না-থাকার পরও ওর কারণেই মরেছে “অ্যামি ডুরান্ট”। সঙ্গিনীর মৃত্যুতে ওর নাকি ঘুম আসে না! ঢং আর কাকে বলে? আসলে ডক্টর লয়েডকে বোঝাতে চাইছিল, অ্যামি ডুরান্টের মৃত্যুতে অপরাধবোধে যারপরনাই জর্জরিত “মেরি বার্টন”। আরেকটা কথা। সাগরসংলগ্ন এবং সভ্যতার ছোয়াবঞ্চিত এক কর্নিশ গ্রামে যাবে কেন সে শুধু-শুধু? পাপ স্বীকার করতে চাইলে গির্জার কি অভাব পড়েছে লণ্ডনে? ওখানে থাকেনি, কারণ ওখানকার সবাই তো আর ক্যানারি আইল্যাণ্ডের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের মত দায়িত্বজ্ঞানহীন না যে, পাসপোটের ছবির সঙ্গে আসল মানুষটার চেহারাই মেলায় না! সে লণ্ডনে থাকলে কেউ-না-কেউ বুঝে ফেলত, ক্যানারি আইল্যাণ্ড থেকে ফিরে-আসা “মেরি বাটন” আসল মেরি বার্টন না ।”

ওহ, কত কিছুই না ঘটে গ্রামে!’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেন হেলিয়ার। আমি যদি গ্রামে থাকতাম তা হলে আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে যেত বোধহয়।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত