হাওরজলের আতঙ্ক

হাওরজলের আতঙ্ক

প্রচণ্ড টেনশনে আছি। কয়েকদিন ধরে সুনামগঞ্জের বিখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা যাচ্ছে এক বিশালাকার প্রাণী,অতিকায় অজগর সাপের মত। লোকে বলছে একশ ফুট বা তারও বেশি লম্বা, চওড়ায় মোটা তালগাছের মত। অনায়াসে গিলে ফেলছে মানুষ, গবাদি পশু। কিন্তু একটা ছবিও কেউ তুলতে পারেনি। ওটা নাকি অত্যন্ত দ্রুতগতির, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানি থেকে ভুস করে ভেসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে মানুষসমেত বিভিন্ন গবাদি পশু। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারিনি। লোকে কত কিছুই না বলে। তবুও লোকজন নিখোঁজ হবার অভিযোগ নিয়ে আসলেই থানায় আসছে।

প্রায় ১৫০ বর্গকিলোমিটারের বেশি জায়গা জুড়ে এই হাওর, বর্ষায় সাগরের মত বিশাল লাগে। এত বিস্তৃত জলাশয়ে এমন একটা প্রাণী খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। তাছাড়া লোকমুখে বিবরণ শুনে মনে হয়, খুব দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করছে ওটা, পানির একেবারে নিচ দিয়ে মুভ করছে, ট্র্যাক করা যাচ্ছে না। এত বড় সাপের কথা কখনও শুনিনি। প্রাগৈতিহাসিক টাইটানোবোয়া ছিল ৪২ ফুট লম্বা, ওজনে এক টনেরও বেশি। তাই বলে একশ ফুট আর তালগাছের মত মোটা? আমরা অবশ্য সবসময়ই বাড়বাড়ন্ত জাত, সবকিছুই ভাঁড়িয়ে বলা অভ্যেস। লজিক্যালি চিন্তা করলে ওটা মেঘালয় বা আসামের জঙ্গল থেকে নেমে আসা কোন  বড় অজগর। বছরখানেক আগে আমি নিজেই একটা মাঝারি মাপের অজগর বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছিলাম, মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এখানেই ধরা পড়েছিল। তবে এখানে অজগরের আবাস নেই। কিন্তু অজগর কি কখনও এভাবে অ্যাটাক করে?

ও, একটা ব্যাপার বলা হয়নি। আমি এখন সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় এসি ল্যান্ড হিসেবে পোস্টেড আছি, জায়গাটা টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছেই। জুন জুলাইয়ে হাওরের পানিবেড়ে আমার উপজেলা পর্যন্ত চলে আসে। প্রায় আটশো  বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবিয়ে দেয়। এখন আমার অফিসের সামনের কড়চার হাওর টাঙ্গুয়ার সাথে মিশে গেছে। এক বিশাল সাগর, অদ্ভুত ঢেউ। এমন ঢেউ নদী বা সাগর কোনটাতেই দেখিনি। আগস্ট মাসের  ঢেউ গুলো বেশ বড়, কিন্তু সামগ্রিকভাবেপ্রশান্ত লাগছে হাওরটাকে।

বিকেলেযখন হাওরের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই বুঝি সেই জীবটা ফোঁস করে মাথা তুলে আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে জলের তলায়; এমনি সময় আমার কাঁধে কার যেন হাত পড়ল, চমকে উঠলাম। ঘুরে দেখি নৈর্ঋত, আমার ব্যাচমেইট, হবিগঞ্জের আরেকটা উপজেলার এসি ল্যান্ড। আমার উপজেলার ইউএনও স্যার একটা বিদেশ ট্যুরে আছেন, তাই আমিই দায়িত্বে, থাকতে হবে আরও মাসখানেক। নৈর্ঋত এসেছে বেড়াতে।

‘নিশ্চয় ঐ অতিকায় দীঘির দানোর কথা ভাবছিলে?’,নৃ বলল মুচকি হেসে। নৃ নৈর্ঋতের ডাকনাম। ‘তোমার ঐ চমকানো দেখেই বুঝেছি, ভেবেছ এই বুঝি ঘাড় কামড়ে ধরল। কিন্তু বন্ধু, ওটা আসলে তো আসবে সামনে থেকে, পিছন থেকে তো নয়, জল যে সামনে!’, আমুদে ঢঙে বলে চলল সে। গত পাঁচ বছরে একটুও বাড়েনি বয়স, সেই উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, ধনুকের ছিলার মত টানটান পেটানো শরীর। আমি জানি, নিয়মিত ব্যায়াম আর ঠিকমত খাওয়া দাওয়াই নৃ’র এভারগ্রীন থাকার রহস্য।

হেসে ফেললাম আমি। বুঝলাম অদ্যবধি নৃ মোটেও বিশ্বাস করেনি ঐ সাপের গল্প। অবশ্য এটাও সত্য যে, ফটোগ্রাফ বা অন্য কোন এভিডেন্স এখনও মিলেনি যা যুক্তিবাদীদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

‘তারমানে তুমি এখনও বিশ্বাস করনি?’

‘না, ব্যাপারটা তেমন না, আমি বিশ্বাস অবিশ্বাস কোনটাই করিনি। প্রমাণ পেলে বিশ্বাস করতে আপত্তিও নেই।’

‘লোকগুলো কিন্তু আসলেই নিখোঁজ।’

‘হতে পারে অন্য কোনভাবে হারিয়ে গেছে, হতে পারে কোন দৈত্যাকার প্রাণীই ওদের গিলে খেয়েছে; তবে সেটার জন্য যৌক্তিক প্রমাণ চাই, প্রাণীটার হদিস চাই। ম্যাক্সিমাম মানুষ যুক্তিহীনভাবে কিছু কিছু ব্যাপার বিশ্বাস করে মজা পায়, আমি পাই না। স্কটল্যান্ডের লক নেসের  সেই দানো, কানাডার ওগোপোগো, বা আফ্রিকার মকলে মবেম্বের  কোন অস্তিত্ব কিন্তু পাওয়া যায়নি, সব হোয়াক্স, সব বোগাস!’

নৃ’র সাথে সামান্য একটা ট্রাভেলিং ব্যাগ। আমার অফিসের সামনে হাওরের ধার দিয়ে কয়েকটা কংক্রিটের বেঞ্চ, আমরা বসে পড়লাম। সন্ধ্যা নামতে আর দেরি নেই, অফিসের অর্ডার্লি ডেকে কিছু নাশতা আনালাম। খেতে খেতে নিখোঁজ কেইসগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম।

এ পর্যন্ত ছয়জন খোয়া গেছে, প্রত্যেকেই বেরিয়েছিল নৌকোয় করে মাছ ধরতে। ষাট বছরের বৃদ্ধ থেকে তের বছরের কিশোর পর্যন্ত রয়েছে। কাউকেই আর পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের তিনটা কেইসে পাওয়া গেছে, সংখ্যা মোট পাঁচ। বাকিরা অক্ষির অগোচরে হারিয়ে গেছে, কিভাবে কেউ দেখেনি।তবে সন্দেহ সবারই একটাই, সেই অতিকায় সাপ। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায় বিশাল কোন অজগর টাইপের সাপ নৌকার পাশ থেকে হঠাৎ জেগে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে জলের তলায়। একেবারেই আজগুবি লাগে শুনতে, বিশ্বাস করা বড়ই শক্ত।

‘এ যাবৎ প্রাপ্ত যুওলোজির যাবতীয় তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায়, এই ক্লেইম পুরাই ভিত্তিহীন। তবুও একটু খটকা লাগছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। নয়ত এত মানুষের বিবরণ একই রকমের কেন হবে?’, একটা কলার ছাল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল নৃ।

এমন সময় আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। এটা যে কিভাবে লিখব, বুঝতে পারছি না। তবুও লিখছি, যতটুকু পারি। আমার অফিসের অর্ডার্লি সমর বিশ্বাস একটা জগে পানি এনে বেঞ্চের পাশে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ আমার একেবারে সামনের হাওরের পানি থেকে ভোঁস করে জেগে উঠলসুবিশাল, পিচ্ছিল, সবুজ হলুদ দেহের ওপর কালো রুহিতনমার্কা গোল গোল ছাপমারা, বয়সী তালগাছের মত মোটা একটা সাপ, অজগরসদৃশ মাথাটা বিকট হা করে মুহূর্তের মধ্যে ছোঁ মেরে সমরের মাথাটা কামড়ে প্রায় বুক পর্যন্ত মুখে ঢুকিয়ে পুরো শরীরটা নিয়ে পানিতে ফিরে গেল সাঁৎ করে। পরিষ্কার দেখেছিলাম, গিলে ফেলার আগমুহূর্তে মোটা রশির মত গোলাপী চেরা জিহ্বাটা অন্যান্য সাপের মতই বের হচ্ছিল আর ঢুকে যাচ্ছিল নিচের চোয়ালের একটা ছিদ্র থেকে! সমর একেবারে পাশেই থাকাতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম সারি সারি দাঁতগুলো কিভাবে বুকের পাঁজরের হাড়গুলোয় দেবে গেল, বিষাক্ত সাপের মত বিষদাঁত নেই ওটার। পানিতে ফিরে যাবার সময় অত বড় প্রাণীটা তুলনামূলকভাবে খুব কম আলোড়ন তুলল। অবিশ্বাস্য ঘটনাটার সবটুকু ঘটতে সময় লাগল বড়জোর দু’ সেকেন্ড। বিস্ফোরিত চোখে মুখ হা করে দেখলাম শুধু। মনে হল মাথাটা কাজ করাই বন্ধ করে দিল, কিন্তু মুখের হা আর বন্ধ হল না। ঘটনাটা মুহূর্তের বিভ্রম নাকি ক্ষণিকের দুঃস্বপ্ন সেটা আমার ব্রেইন কার্যতঃ প্রসেস করতে ব্যর্থ হল। শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরে আমরা দু’জন বেঁচে গেছি।

সম্বিৎ ফিরল নৃ’র গলায়, ‘ঠিক চার দিন পর।’

পরদিন সকালে টেবিলের অপর উবু হয়ে আছে নৈর্ঋত, একটা ম্যাপের ওপর। ম্যাপটা এই এলাকার, বেশ ডিটেইল্ড। থানা থেকে যোগাড় করা হয়েছে সব কয়টা অকারেন্সের পয়েন্ট, সেগুলোতে ডট বসিয়েছে ও, তারপর একের পর এক জয়েন করেছে পেন্সিল দিয়ে। রাতে কারো ঘুম হয়নি এক ফোঁটাও। সমরের জায়গায় আমরাও সাপটার পেটেযেতে পারতাম।

‘প্রতিটা ঘটনা ঘটছে চার দিন পর পর, জাস্ট চার দিন। একই জায়গায় দুইবার দেখা যায়নি জীবটাকে’, অব্জারভেশন জানাল নৃ।

‘তাতে কি বোঝা যায়?’

‘এর মানে হল, যা খাচ্ছে তা হজম করতে লাগছে কমবেশি চার দিন, একবার একটা মহিষ নিয়ে গিয়েছিল, সেবার লেগেছে ছয়দিন। আর সিরিয়ালি দেখলে আরেকটা অদ্ভুত বিষয় দেখা যাচ্ছে। এই চার দিনে জানোয়ারটা সব সময়ই প্রায় সমান ডিস্ট্যান্স অতিক্রম করেছে, গতিবেগের গড় খুব বেশি না, তারমানে মাঝে মাঝে থামছে। একটা হাফ লুপের মত এটার গতিপথ, তবে মনে হচ্ছে লুপটা কমপ্লিট হবে শিগগিরি, কেননা এটা একই জায়গায় দুবার অ্যাটাক না করলেও শেষমেশ যাবে কোথায়?’

‘কেন? নদীতেও তো যেতে পারে!’

‘অজগর বা অ্যানাকোন্ডা টাইপের জীব চওড়া নদীতে সাধারণতঃ যায় না, আর হাফলুপটা এক্সটেন্ড করলে দ্যাখো, মনে হচ্ছে ওটা ঘুরতে শুরু করেছে, শিগগিরি ফিরবে শুরুর বিন্দুতে।’

‘কিন্তু ওটা কি জাতের সাপ? এমন সাপ কি আরও আছে? থাকলে তো বিপদ! এর আগে কেউ কখনই দেখেনি?’

‘সেটা তো আমারও প্রশ্ন। তবে একটা খটকা লাগছে।’

‘কি সেটা?’

‘পরে বলব, আগে ওটাকে খতম করার আঞ্জাম করতে হবে, এখন দরকার উপযুক্ত সরঞ্জাম।’

‘যে সাইজ, তাতে তো মনে হয় রকেট লাঞ্চারেও কাজ হবে না।’

‘রকেট লাঞ্চার টারগেট করে ছোঁড়া মুশকিল। এটার জন্য দরকার হেলিকপ্টার গানশিপ, আকাশ থেকে টার্গেট করতে হবে। ফ্রিগেট হাওরে চালান সম্ভব না। তবে ছোটখাট গানবোট দরকার হতে পারে।’

‘একটারাশান এমআই টুয়েন্টি এইট কপ্টার কেনা হয়েছে বিমান বাহিনীর জন্য। ওটায় শিপুনভ গান লাগানো আছে, তিরিশ মিলিমিটারের বিশাল গুলি ছুঁড়তে পারে। ওটা এনে দেগে দিলেই তো হয়, একবারেই খতম হয়ে যাবে বিভীষিকাটা’, বললাম আমি।

‘তা হবে, কিন্তু ওটা আনবে কে?’

‘ব্যাপার না। কেইসটা এখন জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আমি এখুনি প্রতিবেদন পাঠাব কয়েকটা মন্ত্রণালয়ে, সাজেশন দিব গানশিপ পাঠাতে, সাথে পারলে গানবোট। বিষয়টা যেহেতু জরুরী সেহেতু দেরি হবার কথা না।’

হেলিকপ্টার গানশিপ চলে এল পরদিনই, সেই সাথে সেনাবাহিনীর লোকজনও। গানবোটও আসছে, তবে সময় লাগবে।  একজন তরুণ অফিসারকে পাঠান হয়েছে টীম লিডার হিসেবে, সাথে এসেছে এভারেস্ট জয়ী বঙ্গললনা সাধনা কর্মকার। মেয়েটাশিহরণ আর রোমাঞ্চের লোভে এসেছে, বাবা নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তাই আসাটা কঠিন হয়নি।তাদের সাথেঅনেকক্ষণ আলাপ করলাম বিষয়টা নিয়ে। মেজর কাওসার খুবই উৎসাহী আর হেল্পফুল মানুষ, প্রচুর আগ্রহ নিয়ে শুনল সবকিছু। কিন্তু যেহেতু আমাদের কাছে ছবি বা অন্যকোন এভিডেন্স নাই, সেহেতু পুরোপুরি বিশ্বাস করল না। আমরাও কিছু মনে করলাম না। প্রাণীটাকে মারতে পারলে তবে দেখা যাবে।

‘অবিশ্বাস্য! এত বড় একটা জানোয়ার! কোথায় ছিল এত দিন? কি খেয়ে এত বড় হল? আগে কেন দেখা দেয় নি?’, চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে সাধনা শুধাল। বিশালবপু মেয়ে, বলশালী হাতদুটো বেশ পুরুষালি; উচ্চতায় মনে হয় নৈর্ঋতের চেয়েও প্রায় ইঞ্চিখানেক লম্বা হবে। রোদে পোড়া চকচকে তামাটে রঙ দেখেই বোঝা যায় মেয়েটা অ্যাডভেঞ্চারার। জিন্সেরশর্টসআরটিয়াসবুজরঙেরবুশশার্টেমনেহচ্ছে, এখুনিঅভিযানেবেরুতেপ্রস্তুত।

‘সব কিছু জানা যাবে ওটাকে পেলে’, শান্ত কণ্ঠে বলল নৃ। ‘তবে মনে হচ্ছে আপনি আসার আগেই বোয়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এসেছেন’।নৃ’র চোখ সাধনার কাঁধের ঝোলায় একটা মোটা বইয়ের দিকে, নাম দেখলাম “বোয়াস অ্যান্ড পাইথনস”, লেখক মার্ক ও’শিয়া।

‘ও!ভালই খেয়াল করেন দেখছি, এক বন্ধুর কাছ থেকে আনলাম। ও ভার্সিটিতে যুওলোজির লেকচারার।’, বেশ রাশভারী গলায় বলল সাধনা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে বেমানান মনে হল। এই ধরণের মেয়েরা হবে খুব চঞ্চল,মুখে থাকবে সারাক্ষণ হাসি, যেকোন কথার জবাব দিবে তারিয়ে তারিয়ে। কিন্তু এ তেমন না।

নৃ ম্যাপের মাধ্যমে সাপটার গতিবিধি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিল। তবে কেউই তেমন একটা কনভিন্সড হল বলে মনে হল না। তবে সমরের ঘটনাটা বিশ্বাস করল, কেননা সেটা শুধু আমরাই না, আরও কয়েকজন দেখেছে। একজন হার্ট এটাক করে হাসপাতালে, বাঁচবে কিনা ঠিক নাই।

ম্যাপের একটা জায়গায় আঙ্গুল রেখে বলল নৃ, ‘হিসেব মোতাবেক এই লোকেশনের আশপাশেই ওটাকে পাওয়া যাবার কথা।’

‘ধরুন পাওয়া গেল, কিন্তু বুঝব কিভাবে?’, মেজর জিজ্ঞেস করল।

‘আমাদের টোপের আয়োজন করতে হবে। পাঁচ ছয়টা গরু ভাসমান মাচায় বা ভেলায় রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। খাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই লোকেশনের আশপাশেই রাখতে হবে।’

‘প্রায় খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজা। আকাশ থেকে পানির নিচে দেখা যায় এমন কোন যন্ত্র যদি আনতে পারতাম। পানি স্বচ্ছ হলেও হত। কিন্তু হাওরে ওপরের আকাশ থেকে পানির নিচে দেখা অসম্ভব। পানিতে থাকলে কিন্তু সম্ভব ছিল, ইকোসাউন্ডার সোনার ইউজ করে, যেভাবে ফিশিং বোট মাছের অবস্থান নির্ণয় করে। তবে যে গানবোট পাঠান হচ্ছে তাতে সোনার থাকতেও পারে।’

‘গানবোট এসে পৌঁছুতে আরও তিনদিন সময় লাগবে। নদীতে নাব্যতা সব জায়গায় এক না। তারপর আবার হাওরে আনতে হবে; নদী থেকে এখানে আসার রুটটা যথেষ্ট প্যাঁচালো’, জানালাম আমি।

‘ধরলাম পাঁচ ছয়টা গরু টোপ হিসেবে ভাসিয়ে রাখলাম কিন্তু কোন গ্যারান্টি আছে যে ওখানেই যাবে ওটা? আর তাছাড়া হেলিকপ্টার নিয়ে ওখানে কতক্ষণ উড়ব?’, সাধনার গলায় অনিশ্চয়তার শঙ্কা বাজল।

‘কপ্টারের শব্দে না পালায় আবার! পানির নিচ থেকে যদি দেখে ফেলে? তবে যদ্দুর জানি, বেশিরভাগ সাপের দৃষ্টি খুব দুর্বল, শুধু মুভমেন্ট ধরতে পারে। র‍্যাটলস্নেকের থারমাল সেন্সর আছে কিন্তু এটাতো পাইথন টাইপের কিছু’, আমি বললাম।

‘জানি অনেক কিছুই অনিশ্চিত, কিন্তু কিছু একটাকে বেইজ করে অপারেশন শুরু তো করতে হবে! আমার হিসেব মতে আর দুই দিন বাকি, এর মধ্যে মাচাগুলো রেডি করে গরু বসিয়ে ফেলতে হবে, হেলিকপ্টারে পিন্টল মাউন্টেড গান আছে নিশ্চয়? ধরুন আমাদের কপ্টারের নিচেই সে ভেসে উঠল, তখন কিন্তু আর ফিক্সড শিপুনভ গান চালাতে পারবেন না। কপ্টারের ভেতর থেকেই গুলি চালাতে হবে। মাউন্টেড গান দিয়ে সহজেই পয়েন্ট করা যাবে’, নৃ’র কণ্ঠে লীডারশিপের আওয়াজ পেলাম।

মেজর কাওসার জানাল, মাউন্টেড গান আছে। পর্যাপ্ত  গুলিও আনা হয়েছে।

অতিথিদের আমরা রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করলাম। সেনারা অস্থায়ী নিবাস বানিয়ে ফেলেছে।

দুই দিন পর, দুপুরবেলা। আমরা মানে মেজর কাওসার, সাধনা আর আমি উড়ন্ত হেলিকপ্টারে বসে আছি। নিচে হাওরের পানি, পানিতে ভাসমান মাচায় পাঁচটা নাদুসনুদুস গরু রাখা হয়েছে, তিনশো মিটার পরপর। গরুগুলোর শিং বেশ চোখা দেখে নেওয়া হয়েছে, তারপর বসানো হয়েছে চোখা স্টিলের চোঙ, নৈর্ঋতের উপদেশে; গিলে ফেললে যেন পেটে গিয়ে ফুটো করে দিতে পারে। সার্চ এন্ড রেস্কিউ টাইপের অপারেশন, তাই আগেরটা পালটে গ্রিফন কপ্টার আনা হয়েছে। কপ্টারের দুইপাশের ডালা খুলে রাখা হয়েছে। রেডি রাখা হয়েছে ভয়ংকর মিনিগান, ফুল অটোম্যাটিক রোটারি মেশিনগান, মিনিটে তিন হাজার রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে পারে, সিরিজ গুলি করে মোটা গাছ পর্যন্ত কেটে ফেলা সম্ভব। আমাদের সাথে আছে আরও ছয় জন ক্রু আর সহযোগী সেনা।

নৈর্ঋত কপ্টারে নেই, আছে পানিতে; দুইটা গানবোট চলে এসেছে, তার একটাতে। সোনার ডিটেক্টর লাগানো আছে ওগুলোতে, পানির নিচের কোন কিছুর অবস্থান জানা যায় উপর থেকেই। ও ফোনে আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছে। এই অগভীর পানিতে একেকটা নৌকার নিচের আধা বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত সার্চ করতে পারে সোনার ডিভাইসগুলো। এই সোনারের সমস্যা হল, এটা শুধু বায়ুভর্তি অংশবিশিষ্ট বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে পারে, ঘনত্বের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে। তবে সাপের ফুসফুস আছে, বেশ বড়ই হবে নির্ঘাত, সুতরাং সেটাও ডিটেক্টেবল।

আমরা গানবোটগুলো থেকে কিছু দূরে প্রায় স্থির হয়ে উড়ছি। কপ্টারের প্রোপেলারে বেশ শব্দ, আমরা ইয়ার ডিফেন্ডার ইউজ করছি, ভেতরে ইয়ারফোন লাগানো। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা শোনার জন্য কনফারেন্সিং চালু করা আছে গোটা সিস্টেমে। একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ কমিউনিকেশন সিস্টেম, বাইরের সাথে কোন যোগাযোগ নাই।

গানবোটগুলোও স্থির, ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছে। সময় পেরিয়ে গেছে মোট চারদিনেরও বেশি। ব্যাটার পাত্তা নাই। তবে কি খিদে পায়নি? সমরকে হজম করতে এত সময়? বেচারার কথা মনে আসতেই খারাপ লাগল। বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে গেছে। পানিতে ভয় এখন আর কেউ নামছে না, এমনকি হাওরের ধারেও কেউ যাচ্ছে না। তাছাড়া গোটা এলাকায় বাহির থেকে মানুষের আসাও বারণ করা হয়েছে। দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর সবাইকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জায়াগাটায় ভূতুড়ে আবহ বিরাজ করছে।

যা তেল আছে, তাতে আরও তিন ঘন্টা উড়বে কপ্টার। তারপর হেলিপ্যাডে নামিয়ে রিফুয়েলিং করতে হবে। নৈর্ঋতের কাছ থেকে কোন সাড়া নাই। আমরা তিনজন কফি খাচ্ছি।

‘কি অদ্ভুত এক অভিযানে এসেছি, সারা দুনিয়া তোলপাড় হয়ে গেছে ওদিকে, বিভিন্ন দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা, অভিযাত্রীরা আসতে চাইছে। আমার কয়েকজন বন্ধু ইতোমধ্যেই কন্টাক্ট করেছে আমার সাথে’, কফির কাপে চুমুক দিয়ে সাধনা বলল।

‘কিন্তু আমরা চাইছি না এখন কোন বিদেশি গ্রুপ ঢুকুক দেশে, বিভিন্ন সিকিউরিটি সমস্যার সম্ভবনা থাকে’, মেজর বলল।

‘আমার তো মনে হয় এটাও কোন বিদেশি ষড়যন্ত্র, হয়ত জেনেটিক্যালি মডিফায়েড কোন স্পিশিজ, আমাদের দেশের মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ইউজ করছে’, আমি মতামত দিলাম।

‘ধরতে পারলে সব জানা যাবে, কিন্তু মিস্টার নৈর্ঋতের পদ্ধতি আমার মনে হয় না কোন কাজে আসবে!আমিও বা কেন তার কথাতেই এখানে উড়ে চলেছি সেটাই বুঝলাম না! যাই হোক, আমি আজকেই শেষ ট্রায়াল দিচ্ছি। এর পর অন্য কোন স্বীকৃত পদ্ধতি। তবে এমন সমস্যায় আগে কোন জাতি পড়েছে কি না সন্দেহ! কাকে ফলো করব?’

আমারও অবশ্য নৃ’র প্ল্যানে যথেষ্ট ফাঁকফোকর আছে বলে মনে হচ্ছে। এত বড় হাওর, এইখানেই যে আসবে তার কোন ঠিক আছে? তবুও কেন যেন ওর কথাতেই এত কিছু করে ফেললাম। সুবিশাল হাওরের প্রান্তরে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

‘চার নম্বর মাচার দিকে কিছু একটা এগুচ্ছে’, আমাদের সবার এয়ারফোন কড়কড় করে উঠল নৈর্ঋতের গলায়।

পাইলট তৎক্ষণাৎ সাইক্লিক স্টিক নাড়াল, কপ্টার ঘুরতে শুরু করল চার নম্বর মাচার দিকে। আমরা যখন প্রায় তিনশো ফুট দূরে, তখুনি আলোড়ন উঠল জলে, জীবটার বিশাল মাথা জাগতে শুরু করছে।   মেজর আর সাধনার দুচোখ কপালে উঠল, আর্টিলারী অপারেটর সেলিম মিনিগান তাক করল টার্গেটে।কিন্তু তিনশো ফুট দূরে মিনিগানের ভারী গুলি গ্রাভিটি পুলের শিকার হবে। তাই মেজর ওকে বলল মাজল একটু উপরে রাখতে।

আমরা আর পঞ্চাশ ফুট এগুতেই সাপটা মাচায় পৌঁছে গেল। বিশাল দেহটার প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে এল পানি থেকে, হাঁ হল চোয়াল, গরুটার হাম্বা হাম্বা ডাক পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল আতঙ্কে। বিকট শব্দ তুলে চালু হল আমাদের মিনিগান। অজস্র গুলি বেরুতে লাগল ঘরঘর শব্দ তুলে, কিন্তু টার্গেটে পৌঁছুতে পারল না ঠিকমত। আসলে হেলিকপ্টারের বেগ আর গুলির বেগের ভেক্টর টার্গেট মিস করিয়ে দিচ্ছে। তবুও সেলিম পানিতে গুলির আলোড়ন লক্ষ্য করে সাপের মাথার দিকে মিনিগানের মুখ নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ঐ বিশাল গরুর দেহটাকে সাপের দুই চোয়ালের মাঝে বিলীন হয়ে যেতে দেখলাম, সাপের চোয়ালদুটোর জয়েন্ট আলগা থাকে, ফলে যেকোন সাইজের শিকার গলাধকরণ করতে সক্ষম। সাথে সাথেই সাপটা ডুব দিল। পানিতে রক্ত দেখা গেল। মনে হল, কিছু গুলি সাপটার গায়ে লেগেছে। কেননা গরুটার গা থেকে তেমন রক্ত বেরুবার সুযোগ হয়নি।

তাদের আরেক অভাবনীয় দৃশ্য। হঠাৎ করেই নৃ’র গানবোটটাকে তুমুল বেগে ছুটে আসতে দেখলাম স্পটের দিকে। আমাদের হেডফোনে আবার চিৎকার শুনলাম ওর, ‘আমিওটাকে ফলো করছি, আপনারাআমাকে ফলো করেন।’ বুঝলাম নৃ এখন সোনারে সাপটাকে দেখতে পাচ্ছে।

আমরা ফলো করতে থাকলাম। মাঝে মাঝে কোন কোন অগভীর স্পটে উপর থেকেই সাপটাকে দেখতে পেলাম। কি বিশাল রে বাবা, অন্ততঃ আশি পঁচাশি ফিট হবেই। দেখামাত্র সেলিম মিনিগান চালানো শুরু করছে। ট্রিগার চাপার পর মিনিগানটা চলা শুরু হতে দুই তিন সেকেন্ড সময় লাগে, তাতেই সাপটাকে আবার হারিয়ে ফেলছি আমরা। পানির ভেতর সাপটার গতি যে কত দ্রুত হতে পারে তা বুঝতেয়া পারলাম। কপ্টারটা প্রায় ষাট কিলো বেগে ছুটছে, গানবোটটাকেও প্রায় ফুল স্পীডে ছুটতে হচ্ছে।

সামনে হাওর শেষ; একটা দ্বীপের মত চর দেখতে পেলাম। চরে ঘন হিজল করচ গাছের বন; বেশ পুরনো মনে হল, গাছ গুলো বেশ উঁচুও। সাপটাকে বের হয়ে জঙ্গলে ঢুকে যেতে দেখলাম। তার মানে পানিকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। গভীর জঙ্গলে রুইতনের নকশা আঁকা লেজটাকে হারিয়ে যেতে দেখলাম। প্রায় সাথে সাথেই থামল নৃ’র বোট, লাফিয়ে নামল ওরা। সবার হাতেই মেশিন গান, শুধু নৃ’র হাতে একটা চকচকে কুড়াল; সুন্দর হাতল দেখে বুঝলাম ওটা গানবোট থেকেই নেওয়া, স্পেশাল আইটেম। কুড়াল নিয়ে ঐ দানবের মোকাবিলা? এত শিহরণের মাঝেও হাসি পেল!

আমরা কপ্টার থেকে নামলাম দড়ির সিঁড়ি বেয়ে, একেবারে জঙ্গলের কিনারে। আমার আর সাধনার সাথে কোন অস্ত্র নেই, তাই একসাথে থাকতে বলল মেজর কাওসার। নরম মাটিতে চলার ছাপ রেখে গেছে প্রাণীটা। নৈর্ঋতরা আগেই রওনা করেছে। একরাশ আতঙ্ক নিয়ে আমরা ট্রেইলমার্ক ফলো করলাম।

হিজল, করচের বনটা বেশ ঘন। আকাশে মেঘ থাকায় ভেতরটা আরও অন্ধকার লাগছে। ছমছম করা অনুভূতিটা বেড়ে শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। পা টিপে টিপে এগুচ্ছি আমরা। নৈর্ঋতদের দেখা নেই। এতদূরে গেল কি করে এত তাড়াতাড়ি? নাকি সবাই ঐ দানবটার পেটে গেছে? সেটাই বা গেল কোথায়? হঠাৎ সামনে বেশ হইচই শুনলাম, সাথে নৃ’র গলাও। আমরা ছুট লাগালাম।

ঘন জঙ্গলের ভেতর সামান্য ফাঁকা জায়গা, সেইখানেই লেগেছে ধুন্ধুমার! একটা বিশাল গাছ কাত হয়ে বেড়ে উঠেছে, সেটা প্যাঁচিয়ে জড়িয়ে মাথাটা উঁচু করে তুমুল তর্জন গর্জন করছে দানবটা, ফোঁস ফোঁস আওয়াজে মনে হচ্ছে যেন ঝড় উঠেছে। দৈর্ঘ্য বরাবর মাঝামাঝি জায়গায় পেটটা ফুলে আছে, বুঝলাম গরুটা এখনও হজম হয়নি। সবাই এম সিক্সটিন তাক করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আসলে যে কত জটিল এইবার বুঝলাম। গুলিগুলো প্রায় ঢুকছে না বললেই চলে। প্রচণ্ড দুর্ভেদ্য আঁইশে লেগে পিছলে যাচ্ছে প্রতিটা গুলি, তবে পেটের দিকটায় লম্বালম্বিভাবে যেগুলো আঘাত হানছে, সেগুলোর কয়েকটা ঢুকে যাচ্ছে, কিন্তু গুলি লাগতেই শরীর মুচড়িয়ে পিঠের দিকটা পেতে দিচ্ছে সাপটা।

আমরা স্পটে পৌঁছুতেই নরকের আগন্তুকটা আমাদের দিকে তাকাল। সে কি চোখ, কি দৃষ্টি, আতঙ্কে জমে গেলাম আমরা, শরীরে ঝিম ধরে গেল! একেই মনে হয় বলে সাপের সম্মোহনী দৃষ্টি, আশ্চর্য রকমের শীতল। আর এই চোখ তো প্রায় প্রমাণ সাইজের কমলার মত। লিকলিকে জিহ্বাটা ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, যেন আহ্বান করছে ঐ অতল গহ্বরে।

হঠাৎ করেই মাথাটা ঘুরিয়ে ছোঁ মারল আমাদের দিকে, এত দ্রুত, চিন্তা ভাবনার বাইরে। সাধনাকে লক্ষ্য করে মুখটা যেই হাঁ করেছে, সাথে সাথে তীব্র ব্যাথায় একটা গগণবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এল ওটার মুখ থেকে, অনেকটা হাতির বৃংহতির মত। সাপ ডাকতে পারে না বলেই জানতাম, হয়ত এটাও এই প্রথম ডাকল, গলা থেকে তীব্রবেগে বাতাস বেরুবার ফলেই এই আওয়াজের উৎপত্তি। এইবার ব্যাথার উৎপত্তির দিকে তাকালাম, দেখলাম নৈর্ঋত লেজের দিকে একটা জায়গায় কুড়াল বসিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত ধারাল কুড়ালের ফলাটা প্রায় পুরাই দেবে গেছে, সম্ভবত স্পাইনাল কর্ড গেছে কেটে।  সাপের স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হলে সেটা প্রায় প্যারালাইজড হয়ে যায়। ক্লান্ত মাথাটা ডানে বামে দোলাতে দোলাতে ওটা নৈর্ঋতের দিকে ঘুরল। সবাই মাথা লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়ল। মাথার নিচের দিকটা অর্থাৎ গলার অপেক্ষাকৃত নরম অংশে গুলি ঢুকতে শুরু করল। এইবার নেতিয়ে পড়ল বেচারা। নৈর্ঋতের পায়ের কাছে থ্যাপ করে বিশাল মাথাটা এসে পড়ল, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গলার কাছে আরেকটা কোপ লাগাল ও। প্রায় জবাই হয়ে গেল প্রাণীটা, মরণযন্ত্রণায় সারা শরীর আছড়াতে থাকল, ফিনকি দিয়ে বেরুনো রক্ত নৈর্ঋত আহমেদকে গোসল করিয়ে দিল। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অবসন্ন নৃ।

সফল অভিযানের রিপোর্ট পাঠানো হল সরকারের কাছে। সারা দেশে হইচই লেগে গেল। নৈর্ঋতের দুইটা অনুরোধ ছিল। এক, এই অভিযানে তার সম্পৃক্ততার কথা রিপোর্টেবা সংবাদ সম্মেলনে জানানো যাবে না। দুই, ও সাপের মাথাটা একটু পর্যবেক্ষণ করতে চায়। প্রথমটা রাখতে পারব কি না জানিনা, তবে মাথাটা কেটে নিয়ে আসলাম, দিলাম ওকে একটা বক্সে ভরে, ও জানাল, জাস্ট একটু দেখেই ফেরত দিয়ে দেবে।বাকী দেহ আনাবার ব্যবস্থা করলাম, সেজন্য অনেক মানুষ আর ভারী যন্ত্রপাতি দরকার।

আমাদের সামনেই ও মাথাটা একটা টেবলের ওপর রাখল, কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে, ওজন মন খানেকেরও বেশি হবে, আঁশটে গন্ধে ভরে গেল ঘর। একটা টাইল কাটার ইলেক্ট্রিক করাত আনিয়ে রেখেছিল ও, খুলির মাঝখানের চিরে ফেলল। ‘ভয় নাই, আমি খুব সাবধানেই কাটছি, পরে গবেষকরা ইউজ করতে পারবে’, নৈর্ঋতের কথায় আশ্বস্ত হলাম আমরা, বাধা দিলাম না। আরও কিছু কাটাকাটি করে সে মগজটাকে উন্মুক্ত করল। হাত ঢুকিয়ে দিল গভীরে, দুই হাত দিয়ে ফাঁক করল একটা জায়গা, ভেতরে তাকাল।

‘যা ভেবেছিলাম ঠিক তাইই, এইখানে দেখ’, নৃ ডাকল আমাদের। আমি , মেজর আর সাধনা এগুলাম ওর দিকে।

সাপের ব্রেইন তো দূরের কথা মানুষের ব্রেইন সম্পর্কেই আমার কোন ধারণা নেই। তবুও তাকালাম। ধূসর প্যাঁচালো লোবগুলোর মাঝে একটা জায়গায় দুই হাত ঢুকিয়ে ফাঁক করে রেখেছে নৃ, মুখে একটা টর্চলাইট, ‘এই যে সেরিবেলাম, আর তার নিচে এইটা হল পিটুইটারি গ্ল্যান্ড, দুনিয়ার সব মেরুদণ্ডী প্রাণীতে থাকে। খুব ছোট্ট জিনিস, কিন্তু এই গ্ল্যান্ডটায় অস্বাভাবিক গ্রোথ দেখা যাচ্ছে, মানে হাইপারপ্লেসিয়া ফর্ম করেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা মানুষ আমেরিকার রবার্ট ওয়াডলো ছিল নয় ফুট লম্বা, চিকন মানুষ কিন্তু ওজন দুইশ কেজি। তারও হাইপারপ্লেসিয়া ছিল। জর্জ নামের একটা কুকুর পাওয়া গেল  একবার, সাতফুট লম্বা, তারও এই একই অ্যাবনরমালিটি ছিল। আসলে এই সাপটা সাধারণ পাহাড়ি অজগরের জাতেরই সদস্য। কিন্তু এই অসুখের কারণে সাইজ বাড়তে বাড়তে এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, স্বাভাবিক সর্বোচ্চ আকারের তিনগুণ হয়ে গেছে। মানুষ হলে ট্রিটমেন্ট করে গ্রোথ থামানো যেত, কিন্তু এরটা করবে কে? আকারের সাথে বেড়েছে এর খিদে, কেননা পিটুইটারি হাইপারপ্লেসিয়া বিপাকের হার এবং খিদেও বাড়িয়ে দেয় ব্যপকভাবে। যা পেয়েছে খেয়েছে। কিন্তু সবার শেষে এটা আসলে একটা অসুস্থ প্রাণী ছাড়া আর কিছুই না।’

‘তবুও আরও প্রাণহানির আগেই বিভীষিকাটাকে বিনাশ করার কোন বিকল্প ছিল না। কিন্তু একটা কথা, যে প্রাগইতিহাসিক টাইটানোবোয়ার কশেরুকা পাওয়া গেছে সেটাও তো তাহলে একই রকমের কেইস হতে পারে!’, আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘হ্যাঁ, পারে হয়ত, আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না। প্রায় সব ফসিলেরই জীন এমনভাবে নষ্ট হয়, আমরা অত গভীর বিশ্লেষণে যেতে পারি না, টাইটানোবোয়ার স্বাভাবিক আকারের ধারণা এক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই পারে’, ব্রেইনের ওপর হাড়গুলো সাজাচ্ছে ও।

‘আরেকটা প্রশ্ন রয়ে যায়, এটা মানুষের কীর্তি, নাকি ন্যাচারালি অকার্ড?’, সাধনা শুধাল।

‘এইটার জবাব বের করা খুব সহজ হবে না আপাততঃ। দেখি এক্সপার্টরা কি বলে। তবে আমি যে কেইসগুলোর কথা বললাম, সব ক’টা ন্যাচারাল। আর হ্যাঁ, বস্তা সেলাই করার মোটা সুঁই আর নাইলনের সুতো দরকার, মাথাটা সেলাই করতে হবে, ড্রিল মেশিনও লাগবে, ফুটো করার জন্য, সুঁই ঢোকে কিনা কে জানে?’, মুচকি হেসে ফরমায়েশ করল নৃ। আমরা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আশ্চর্য মানুষটার দিকে।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত