১৮ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। আমি একটি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। এমন একটি পরিবারে আমার জন্ম, যেখানে ভদ্র মেয়েরা বাবা-মা’র মুখের উপর কখনো কিছু বলতে পারে না।
‘বাবা আমার বিয়ে দিতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘আমার বিয়ে দিয়ে যদি তোমরা ভালো থাকো, তাহলে ঠিক আছে। বিয়েতে আমি রাজি।
বিয়ে হল। আর এই বিয়ের ফলাফল মোটেও ভালো কিছু হয়নি। আমাদের বিবাহিত জীবন কখনও সুখের ছিল না।’
‘আজ থেকে নয় বছর আগের কথা বলছি।সেটা বিয়ের প্রায় দুই বছর পরের ঘটনা। আমি একটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হই। গাড়ি চালাতে চালাতে আমার স্বামী হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এই বেখেয়ালে গাড়িটি পড়ে যায় একেবারে গভীর খাদে। আমার স্বামী গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করে। কিন্তু আমি গাড়িটির মধ্যেই আঁটকে থেকে যাই।
এতে আমি গুরুতর আহত হই এবং আমার ক্ষয়ক্ষতির তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ।
আমার ডান হাতের রেডিয়াস-আলনার হাড় ভেঙ্গে যায়। হাতের কব্জি ভেঙ্গে যায়। কাঁধের হাড় ও কণ্ঠনালি প্রচন্ড ক্ষতবিক্ষত হয়। বুকের অস্তিমজ্জা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে যায়।কিন্তু আমি বেঁচে ছিলাম।’
‘তবে আমার যে ইনজুরিটি পুরোপুরিভাবে আমাকে বা আমার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা ছিল মেরুদন্ডের ইনজুরিটি।’
‘সেই দুর্ঘটনার পর পরই অনেকে আমাকে উদ্ধার করতে এল। তারা আমাকে জরুরি সিপিআর দিল। আমকে দ্রুত গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে। যখন তারা আমাকে গাড়ি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছিল, মেরুদন্ডহীন একদলা মাংসের টুকরোর মত অবস্থা ছিল আমার।’
‘আমার হাসপাতালের এই আড়াই মাসের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকর। আমি হতাশার চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলাম।’
‘একদিন ডাক্তার এসে আমাকে বললো, আমি শুনেছি তুমি একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলে, কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। তোমার জন্য একটা খুব খারাপ সংবাদ আছে। তুমি আর কখনই ছবি আঁকতে পারবে না।’
পরেরদিন ডাক্তার এসে বলল, ‘তোমার মেরুদন্ডের অবস্থা এতই খরাপ যে, তুমি আর হাঁটতেও পারবে না।’
কথাটি শুনে আমি কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
তার পরেরদিন ডাক্তার এসে বলল, ‘তোমার মেরুদন্ডের ইনজুরি আর পিঠের হাড়গোড় এক হয়ে যাওয়ায়, তুমি আর কখনও ‘মা’ হতে পারবে না।’
‘সেদিনই আমি খুব ভেঙে পড়ি।
আমি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, তাহলে কেনই বা আমি বেঁচে আছি? কী দরকার বেঁচে থাকার?’
এরপরই আমার নতুন যাত্রা শুরু হয়
‘একদিন আমি আমার ভাইদেরকে বললাম, আমি জানি আমার একটি হাত অকেজ। কিন্তু হাসপাতালের এই সাদা দেয়াল আর গায়ের এই সাদা পোশাক দেখে দেখে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে রং আর কিছু ছোট ক্যানভাস এনে দাও। আমি ছবি আঁকতে চাই।’
‘আমি সর্বপ্রথম যে ছবিটি আঁকি সেটি ছিল বিছানায় আমার মৃত্যুর ছবি। এটাযে আমার জন্য কি দারুণ একটি ঔষধ হিসেবে কাজ করেছিল তখন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিঃশব্দে যেন আমি আমার হৃদয়েে ছবিটাই ভেতর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে এলাম। ছবিতে আমি আমার জীবনের গল্প বলতে পারতাম।’
‘মানুষজন আমার কাছে এসে বলত, বাহ! কি অসাধারণ ছবি এঁকেছ তুমি। কি দারুণ রংয়ের খেলা দেখিয়েছ এখানে। কিন্তু কেউই এর ভেতরের যন্ত্রণাটা দেখতে পায়নি। যেটা শুধুমাত্র আমিই দেখতাম।’
‘সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি শুধু নিজের জন্যই বেঁচে থাকবো। আমি আর অন্য কারো জন্য একজন পারফেক্ট মানুষ হতে চাইবো না। আমি শুধুমাত্র নিজের জন্যই পারফেক্ট মানুষ হবো। আমি আমার ভয়ের সাথে যুদ্ধ করবো।’
‘তারপর আমি, আমার কিসে কিসে ভয়, তার সবগুলোকে একে একে একটি কাগজে লিখে ফেলি। আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমার এই সকল ভয়কে একটি একটি করে জয় করবো।’
‘জানতে চান, আমার সবচেয়ে বড় ভয়টি কিসে ছিল?’
-ডিভোর্স।
‘কিন্তু আমি যখন ভেবে দেখলাম যে, এটা শুধুমাত্র আমার নিজের ভয় ছাড়া আর কিছুই না। তখন আমি নিজেকে আমার স্বামীর কাছ থেকে বন্ধনমুক্ত করতে চাইলাম।এবং আমি তা পেরেছিও। ’
‘আমি আমার আমার আবেগের জায়গাটা এমনভাবে শক্তিশালী করে ফেলি যে, যেদিন আমি শুনলাম সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, আমি তাকে একটি চোট্ট টেক্সট পাঠাই।
আমি লিখি, আমি খুবই খুশি হয়েছি, তোমার জন্য আমার শুভকামনা রইল। এবং সে এখনও জানে তার জন্য সবসময় আমার শুভকামনা আছে।’
‘আমার দ্বিতীয় ভয়টি ছিল, আমি আর কখনই মা হতে পারবো না। এটা মেনে নেওয়াটা সত্যিই আমার জন্য খুব কষ্টের ব্যাপর ছিল।
কিন্তু আমি একসময় অনুভব করি, পৃথিবীতে এমন অনেক শিশু আছে যাদের দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। তাই কান্না বা অনুতাপের কিছু নেই। সেখানে গিয়ে একজনকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নাও। ব্যাস! আর যেটা আমি করেছিও।’
‘তারপর আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে যুক্ত করি। অনেকগুলো এতিমখানার কাছে আমি আমার আগ্রহের কথা জানাই। তারপর অপেক্ষা করতে থাকি কবে সেই দিনটি আসবে।’
‘দুই বছর পর, আমি পাকিস্তানের ছোট্ট একটি শহর থেকে একটি ফোন কল পাই।’
‘তারা বলে, আমাদের কাছে একটি ছেলে শিশু আছে, আপনি কি ওকে নিতে ইচ্ছুক?’
–সেই মুহূর্তে আমি যেন সত্যিকারের প্রসব বেদনাটা অনুভব করেছিলাম। আমি সাথে সাথে তাদের বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি অবশ্যই ওকে নিতে চাই। আমি এক্ষণই আসছি ওকে নেওয়ার জন্য।
‘তখন ওর বয়স ছিল মাত্র দুই দিন। এখন ওর বয়স ছয় বছর।’
‘আসলে আমরা যখন নিজেকে একটি হুইল চেয়ারের ভিতর আবদ্ধ করে ফেলি, তখন সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার কি জানেন?
সবাই ভেবে বসে, আমরা অন্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এর কারণ হচ্ছে, আমরা এই পরিপূর্ণ পৃথিবীতে অসম্পূর্ণ মানুষ। তাই আমি আরও বেশি মানুষের কাছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
‘আমি ছবি আঁকতে শুরু করলাম। আমি প্রচুর মডেলিং কেম্পেইং করেছি। তারপর আমি পাকিস্তানের একটি ন্যাশনাল টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি পাকিস্তানের নারী সংঘের শুভেচ্ছা দূত ছিলাম।
আর এখন আমি কথা বলি নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে।’
‘২০১৫ সালে বিবিসির সেরা ১০০ জন নারীর মধ্যে আমাকে স্থান দেয়। ২০১৬ সালে ফোবসের সেরা ৩০ জন নারীর তালিকায় আমার অবস্থান হয় ৩০তম।’
‘তাই অবস্থান যাই হোক না কেন, আপনি যদি নিজেকে নিজে গ্রহণ করতে পারো, সারা পৃথিবী আপনাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে। আর এর শুরুটা করতে হয় একেবারে নিজের ভেতর থেকে। আমাদের জীবনে এমনই চমৎকার একটি ব্যাপার আছে। এভাবেই সবকিছুর সুচনা হয়।’
‘এটা আমার পরিকল্পনা। তাই আমার নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই চলা উচিত। কিন্তু যদি আমাদের নিজেদের মত করে কোনো কিছু না হয়, তখনই আমরা ছেড়ে দিই।’
‘আমি কখনও হুইল চেয়ারে থাকতে চাইনি। কখনও হুইল চেয়ারে থাকার চিন্তাও করিনি। জীবন হলো একটি পরীক্ষা ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের জায়গা। আর পরীক্ষা কখনও সহজ হয় না।’
‘ জীবনকে যদি আমরা শুধু উদযাপন করতে চাই, জীবন আমাদেরকে নিয়ে সেই আয়োজন করে দেবে। আমরা সেই আয়োজনে একেবারে মিলেমিশে
একাকার হয়ে যেতেই পারি। কিন্তু দিনশেষে নিজেদের ফলাফলের জন্য আমরা কোনেভাবেই জীবনকে দায়ি করতে
পারি না। কারণ, আমরা স্বেচ্ছায় তা বেছে নিয়েছি। সতর্কতার জন্য যেমন এটাই
যথেষ্ট, তেমনই আফসোসের জন্যও।’
‘সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু হতাশ হয়ে ছেড়ে দেওয়াটা কখনই কোনো কাজের শেষ কথা নয় । বিখ্যাত মানুষেরা সবসময় বলে
থাকেন, জীবনে ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই।’
‘কিন্তু আমি বলি, ব্যর্থতা অবশ্যই থাকবে।
কারণ, যখন আমরা ব্যর্থ হই, তখন কিন্তু পুনরায় উঠে দাঁড়াতে শিখি। হয়তো আবার
পড়ে যাবেন, আবার উঠে দাঁড়াতেই হবে। এই গতিই আমাদের সামনের দিকে নিয়ে চলবে।’
‘জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসকে উপভোগ করতে হবে। জীবনকে উদযাপন করুন। জীবন্ত থাকুন। মৃত্যুর আগেই যেন মরে যাবেন না। সুখ থাকে কৃতজ্ঞতায়। তাই বলি, নমনীয় হউন, বেঁচে থাকুন। আর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অমর করে তুলুন।’