উজবুক

উজবুক

–আপা আপনার পাশের সিটটা তো খালি, এনারে বসতে দেন না?( হেল্পার)
— আরে আজব তো, এটা আমার হ্যাজবেন্ডের সিট, অন্য কাউকে কেন বসতে দিব?
দাত খিচিয়ে বললাম আমি।
— ভাইরেও তো বসতে দিচ্ছেন না, সিটটা তো খালিই আছে, কেউ বসুক না (কাতর কন্ঠে)
— ভাড়া দিয়েছি না, বার বার জালাচ্ছেন কেন?
আরেকবার এ কথা বললে কিন্তু বাস ভেঙ্গে নেমে যাব।
পাশ থেকে সুমন বলে উঠল, “রুপা দাও না বসতে, আমাকে না দাও অন্য কাউকে দাও প্লিজ”।
–এই তুমি একদম চুপ থাকবে, নয়ত পায়ে হাটিয়ে নিয়ে যাব বলে দিলাম।
হেল্পার ভয়ে আর কথা বাড়ায় না।

আশপাশ থেকে ” কি দজ্জাল বউ রে, আহা বেচারা, কি কপাল ” এসব কথা কানে আসছে। তাও চোখ গরম করে বসে রইলাম।

সুমনের এই দুর্গতি বুঝার জন্য মাত্র কয়েকটা দিন আগের ঘটনা জানতে হবে। হ্যা এই সেই সুমন, বই পাগলা। সেদিন আমাদের বিবাহ বার্ষিকি ছিল। আমি প্রায় এক মাস ধরে নানা জল্পনা কল্পনা করে অপেক্ষা করছে এই দিনটার। সকাল বেলায় উঠেই গদগদ কন্ঠে সুমনকে বললাম,

–এই শুনো, আজ না অফিস থেকে জলদি এসো আর আসার সময় কিছু ভাল দেখে ফুল আনবে।
সুমনও হাসি মুখে বলে গেল,,”আচ্ছা”।

সারাদিন নানা পদের বাহারি রান্না করলাম। সন্ধ্যায় একগাদা মেক আপ করে আমার স্বামীর অপেক্ষায় বসে রইলাম। সুমন ফিরল।

–এই তুমি ফুল আননি?
–এনেছি,এই যে ব্যাগে
–এগুলা তো ফুলকপি। ( রেগে গিয়ে)
–হ্যা, ফুলকপিই তো। একটা বইয়ে পড়েছিলাম
বুঝলে ফুলকপির অনেক উপকারিতা, খুবই পুষ্টিকর সবজি। তাই এনেছি।
–আমি তোমাকে ফুল আনতে বলেছিলাম, ফুলকপি না,
— নামের আগে তো ফুল আছে তাই না, আর এটা মস্তিস্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তোমার কথা ভেবেই এনেছি।
আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল।
–তোমার নিজের মস্তিস্কের ঠিক নেই, আমার মাথা নিয়ে ভাবতে এসেছ?

চিৎকার করে বলেই ওর হাত থেকে ফুলকপিগুলো নিয়ে ওকেই ঢিল মারলাম। উজবুকটা সরে গেল, ওর গায়ে লাগল না। আর পারলাম না, চোখ দুটো মুহূর্তেই পানিতে ভেসে গেল। দৌড়ে সেখান থেকে পালালাম।

অনেক বার উকি দিলাম, ভাবলাম একটু পর হয়ত রাগ ভাঙাতে আসবে। আসল না সে। এক ঘন্টা পর দেখি সে খেয়েদেয়ে বই পড়ছে।

–তুমি আমাকে রেখেই আজকের দিনে খেয়ে নিলে?
–খিদে পেয়েছিল আর রান্নাটা ভাল হয়েছে।
তবে গরুর মাংসে লবণ কম ছিল। পরের বার খেয়াল রাখবে কেমন?
–তাই বলে আজকের দিনেও আমাকে ডাকলে না একবারও? আর আমাকে রান্না শেখাচ্ছো তুমি?
–কেন আজকের দিনে কি, তুমি তো রোজই রাগ করে না খেয়ে থাক, তাই ডাকিনি। আর তোমার রান্না বেশি সুবিধার নয়।
–উজবুক কোথাকার, আজ আমাদের এনিভার্সারি ছিল।
আবার কেঁদে ফেললাম। উজবুকটাও চুপ করে রইল।

পরদিন অফিস থেকে ফিরেই উজবুকটা বলল,
–চল একটু বেড়িয়ে আসি।
আমি নাচতে নাচতে রেডি হলাম। ভেবেছিলাম
আমাকে নিয়ে কোথাও খেতে যাবে।
–এই তুমি আমাকে এখানে কেন আনলে?
–কেন ভাল লাগছে না?
–এটা ঘুরবার জায়গা?
–এই লাইব্রেরীতে অনেক বই, তুমিও পড় না
খুব ভাল লাগবে।
— তুমি আমাকে এখানে কেন আনলে?
–বই পড়ার জন্য।

ঠিক সেই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আমি এখন আমার বাপের বাড়ি যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। এই উজবুকটার সাথে আর সংসার করতে পারব না। সে বই নিয়েই থাকুক। বাসে আমার পাশের সিটে বসতে এসেছিল। বসতে দেইনি। অন্য কাউকেও দিব না।

হঠাৎ বাসের জোরে এক ব্রেকের জন্য উজবুকটা টাল সামলাতে না পেরে পরে গেল। চশমাটা কোথায় ছিটকে গিয়ে পরল তার হদিস নেই। আমার সাদাসিধে বরটা কপালে, হাতে, পায়ে ব্যাথা পেল, কনুইয়ের দিকটা ছিলে গেছে। আমি সাথে সাথে লাফ দিয়ে সিট থেকে উঠে ওকে তুললাম। পাশের সিটে বসালাম, পানি খাওয়ালাম।
এরপর উঠেই হেল্পার আর ড্রাইভারকে এক সের গালাগালি দিয়ে বাস থামিয়ে উজবুকটাকে নিয়ে নেমে পরলাম। বাসের লোকগুলো কেমন মিটিমিটি হাসছে।

–রুপা, আমি কিছুই দেখতে পারছি না।
ওর হাত ধরে উলটা পথে হাটতে লাগলাম।

–রুপা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
–বাড়ি যাচ্ছি।
–তুমি না আমাকে ছেড়ে চলে যাবে বলেছিলে?
— চুপ করে হাটো তো ( রেগে গিয়ে)
–রুপা, রিক্সা ডাকব?
–নাহ
–“রুপা, আমাকে ছেড়ে বার বার যাও।

কিন্তু আবার ফিরেও আসো। তাই এখন আর ভয় লাগে না তুমি যেতে চাইলে। ”
দাত কেলিয়ে হাসল উজবুকটা। অন্য সময় ওর হাসিতে আমার গা পিত্তি জ্বলে যেত। কিন্তু আজ হাসি আমারও পাচ্ছে। যতই জালাতন করুক বরটা আমারই! নিজের চশমাটা যে ঠিক মত সামাল দিতে পারে না, তাকে একা ছেড়ে কিভাবে চলে যাই।

আচ্ছা উজবুকটা এত বই পড়ে এটা কেন বুঝে না যে আজকে এই জোৎসা রাতে আমার ওকে হুূমায়ুন আহমেদের হিমু বানাতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে না বুঝুক আমি হাত ধরে এই আধা কানা মানুষটাকে নিয়ে এই রাতের রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুনতে গুনতে বাড়ি যাব।

রাতের আকাশে লক্ষ লক্ষ তারার ছুটাছুটি আর আমি চলছি আমার উজবুক উহু সাদাসিধে বরটার হাত ধরে। এই হাত কোনদিনও ছাড়ব না

নিজেকেই কথা দিলাম। আড়চোখে মানুষটার মুখভরা হাসি কিন্তু আমার নজর এড়াল না।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত