গান বাজনার আসর ভালো। তবে একনাগাড়ে দেখতে গিয়ে একসময় খুব বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে। যেমনটা আমার এখনের অবস্থা। ঠোঁট বাঁকা করে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তারও মুখে বিরক্তির ছাপ। তার মানে দু’জনই বাজনা আর সইতে পারছি না। ওকে চিল্লিয়ে বললাম, ‘ভাইয়া চল। আমার মন আর বসছে না।’
সে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমরা দু’জনই চেয়ার ছেড়ে কোলাহলে চলে এলাম। আমরা সামনে ছিলাম। আমাদের চেয়ার কয়েকজন কাড়াকাড়ি করছে। এসবের প্রতি অন্যদের উৎসাহ দেখে বিরক্তি আরেকবার ছেয়ে গেল আমার মুখে। একসময় ভাইয়াকে বলে ফেললাম, ‘হোসেন সাহেব এসব লোকের কারণেই হয়ত বিয়েতে এত আয়োজন করেছেন। তা না হলে তাঁর মতো বিরস মুখী লোক আমি আর দেখিনি। বিয়েও করছেন, চল্লিশ পার হওয়ার পর।’
‘হু, এমন মানুষের জীবনে স্বাদ খুবই কম। সারাজীবন দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন। এখন এসে বিয়ে করছেন। তাও শুনেছি, যাকে বিয়ে করছেন, সে নাকি খুব দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। হয়ত তাকে ভালো একটা জীবন দিতে গিয়ে বিয়ে করছেন। তাছাড়া মেয়েটি নাকি খুব সুন্দর।’
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম আমরা। ভাইয়ার সিনিয়র ইন্সপেক্টর জাকির স্যারও আছেন আমাদের সাথে। মূলত তাঁর পক্ষ থেকেই আমরা বিয়েতে এসেছি। তিনি ভাইয়াকে বলেছিলেন, ‘আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। অগত্যা আমার বন্ধুর বিয়ে বলেই আসা। তাছাড়া সাথে কেউ না থাকলে ভালো লাগে না। আরিয়ান, তুমি আমার সাথে এসো। আর হ্যাঁ, তোমার ভাই আবিরকেও এনো।’
মেহমান প্রায় সকল গান বাজনায় শরীক হয়েছে। আমরা একটি রুমে সোফায় বসে আছি। হাতে গোনা কয়েকজনকে এদিক ওদিক যেতে দেখছি। তার মধ্যে এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। চিনতেই আমরা সালাম দিলাম। লোকটির চেহারা বড়ই কঠিন, স্বভাবের সাথে খাপে খাপে মিলানো। এতক্ষণ তাঁর কথাই স্যার বলছিলেন আমাদের। তিনি হোসেন সাহেবের বড় ভাই ফারুক। বলেছিলেন, ‘তাঁকে বিয়েতে দেখে বড়ই অবাক হচ্ছি। বাহিরে আছে। যতটুকু জানি, এখনও তিনি হোসেনকে পছন্দ করেন না। একদা তিনি খারাপ সঙ্গের সাথে হাত মিলিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন। কারো খোঁজ নেননি। তখন হোসেনের সুদিন আসতে থাকে। ফারুক ফিরে এলেন বছর দশেক পর। ততদিনে তাঁর মা মারা যান। শুনেছিলাম, ছোট ভাইকে টাকা কামাতে দেখে তিনি হিংসায় ফুঁসতেন। যার দরুন তিনি হোসেনের সাথে থাকেন না। আজ ভাইয়েরই বিয়েতে এসেছেন দেখে কিঞ্চিত অবাক লেগেছিল। পরক্ষণে ভাবলাম, হয়ত তাঁর নিঃসঙ্গতাই হিংসাকে হার মানিয়েছে।’
কঠিন মুখো লোকটি আমাদের সোফা ডিঙিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন। আমরা তাঁকে নাস্তা যেচেছি, নেননি। বললেন, ডিনার সেরেছেন। তিনি পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করলেন। কিন্তু আশেপাশে কোনো এশট্রে নেই দেখে বিচলিত হচ্ছেন। আমি আশপাশ তাকাতে লাগলাম। দরজার দিকে দেখলাম, সেদিকে নতুন বউ হাঁটাহাঁটি করছে। এতক্ষণ পাশের রুম থেকে মেলা হাসাহাসি শুনেছি। সম্ভবত ওখানেই ছিলেন এতক্ষণ। তিনি আড়চোখে তাকালেন ফারুক সাহেবের দিকে। আমরা পরিবেশকে সহজ করতে মেয়েটিকে ভেতরে আসতে বললাম। তার সাথে দুটো মেয়ে সঙ্গীও আছে। একজন আমাকে দেখে কেবল মিটিমিটি হাসে। সে আমার কথায় এক মেয়ের মাধ্যমে এশট্রে আনাল। আমতা আমতা করে মুচকি হেসে বলল, আপনাদের তিনজনকে খেতে ডাকা হয়েছে। সে হয়ত আগে থেকেই জানত আমরা কারা। বউয়ের চোখের পিটপিটানো দেখে লাগছে, সম্ভবত ফারুক সাহেবের সাথে কথা বলতে সহসা পারছেন না। তাই তিনি আমাদের সাথেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফারুক সাহেব রুম নিজের দখলে পেয়ে লাইট অফ করে দিলেন। আমরা খেতে চলে এলাম। যারা গান বাজনায় মশগুল, তারা হয়ত পরেই খাবে। তা না হলে পেটের ভাত নাচার তালে বেরিয়েই আসবে।
খুব বিরক্তিকর লাগছে। ভাইয়ার মাঝে একটা ছটফটানো ভাব। পুলিশদের মাঝে সবসময় একটা তাড়া থাকে খুব সম্ভবত।
হোসেন সাহেবকে অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। তাঁর রুমে বসেছিলেন। তিনি একা থাকতে চাওয়ায় গান বাজনায় শরীক হয়েছিলাম। তখন তিনি তাঁর মায়ের স্মৃতিতে ডুবে কাঁদছিলেন। আমরা একা থাকতে দিলাম তাঁকে। দুই ভাইয়েরই হয়ত অন্ধকারে থাকা স্বভাব।
যাই হোক, খাওয়া সেরে আমরা মিনিট দশেক বসে রইলাম। হঠাৎ কেউ একজন এসে গান বাজনা বন্ধ করিয়ে দিল। ভেতরের রুম থেকে চিৎকারের শব্দ আসছে। কৌতূহল বশত তিনজনই গেলাম। মানুষের ভিড়ে গিয়ে যা দেখলাম, মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! হোসেন সাহেবের লাশ পড়ে আছে বিছানায়। পেটের দিকটা রক্তাক্ত। কে যেন ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে খুন করেছে। জাকির স্যার ভেঙে পড়লেন। ভাইয়া তাঁকে সামলাচ্ছেন। আমি এখনও হতবাক! হোসেন সাহেবের আপন কেউ না থাকায় মেয়েপক্ষের লোকেরা সবাই এসেছে। তাঁরা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন। নতুন বউ মেঝেতে বসে পড়েছেন। এত অল্প বয়সী তরুণীর এই লোককে পছন্দ করার কথা নয়। বয়স তার চেয়ে যে দ্বিগুণ! তারও কি কান্না পাচ্ছে? লোকটা এতই কি সহমর্মিতা দেখাতেন?
জাকির স্যারের হুকুমে পুলিশ ফোর্স এসে তদন্ত শুরু করেছেন। ঘরের সব মানুষকে একত্রিত করা হলো। ফারুক সাহেবকে দেখছি না। তিনি সম্ভবত অন্ধকারে থাকায় পুলিশেরা রুমটায় মানুষ আছে বলে খেয়াল করেনি। আচ্ছা, খুনটা কে করেছে? ফারুক সাহেব? না, যে কেউ হতে পারে। স্যার বলে উঠলেন, ‘ফারুক সাহেবকে দেখছি না।’
‘উনি একটা রুমে আছেন।’ আমি বললাম।
‘আবির,’ ভাইয়া বলল, ‘উনাকে নিচে নিয়ে আয়।’
আমি সাথে সাথে গিয়ে উনার রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। উনি নতুন এক সিগারেট ধরিয়েছিলেন তখন। এশট্রে ছাই ভর্তি হয়ে আছে। আমি তাঁকে নিচে নিয়ে এলাম। ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে উনার হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। সম্ভবত কেমন প্রতিক্রিয়া দেবেন, ভেবেই পাচ্ছেন না। তবে তিনিই কি…
ভাইয়াসহ পুলিশেরা যথারীতিতে রুমগুলোতে তালাশি শুরু করেছে। বাহিরে কিছুই পাওয়া যায়নি। খুন করার ছুরি কী অস্ত্রটা কোনো একদিকে পাওয়াই যাবে হয়ত। একসময় পুলিশেরা জটলা পাকালো একটি রুমের সামনে। একটু আগে যে রুম থেকে ফারুক সাহেবকে এনেছিলাম, সেই রুমে। জাকির স্যার ওদিকে তাড়াতাড়ি গেলেন। পুলিশদের সাথে আমার পূর্ব পরিচিতি আছে বিধায় সাধারণ লোকের ভেতর থেকে আমিও চলে গেলাম। একটি ছুরি পাওয়া গেছে। বড় আকারের একটি রুমালে আবৃত সেটি। রক্ত লাগানো তাতে। পুলিশেরা বিছানার বালিশের নিচে পেয়েছে ছুরিটি। নানান জিজ্ঞাসাবাদে কথা এই পর্যন্ত এসে থামল যে, এই রুমে একমাত্র ফারুক সাহেবই ছিলেন। হোসেন সাহেবের রক্ত এখনও শুকায়নি। খুনটা এইমাত্রই হলো। সম্ভবত আমরা খেতে যাওয়ার পর। তখনই ফারুক সাহেব উনার খুন করেছেন। সম্ভবত বিদ্বেষের বশেই। কিন্তু তিনি কথাটি অস্বীকার করে চলেছেন। সব সন্দেহ একমাত্র তার দিকেই যায়। শেষমেশ তিনি বোবা বনে গেলেন। কালকের অপেক্ষা। খুন করার তাড়ায় সম্ভবত ছুরিতে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছতে ভুলে গেছেন। হতে পারে রুমাল দিয়ে ছুরির সবটুকুই ঢাকা ছিল না। কাজেই কাল হয়ত ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ফারুক সাহেবের অপরাধ ধরে ফেলা যাবে। নিজের ভাইকে খুন করেছেন তিনি? এতদিন না করে বিয়ের দিনই কেন? সন্দেহ সব লোকভর্তি বাড়ির কেউ একজনের ওপর যাওয়ার জন্য? না, কোথাও যেন খটকা লাগছে। তবে জেলের কথা শুনে বিচলিত হচ্ছেন না কেন? খুনি তো নিজের অপরাধকে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করে।
পরদিন হোসেন সাহেবের পোস্ট মর্টেমের মাধ্যমেও কিছু জানা যায়নি। এবং ছুরিতেও কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। ছুরিটি থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না মুছলেও রুমালের ভাঁজে থেকে বালিশের চাপে থাকায় হয়ত মিটে গেছে। নয়তো তিনিই মিটিয়ে দিয়েছেন। উনার বসে থাকা রুম থেকে ছুরি উদ্ধার করার প্রমাণটির কারণেই উনাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি যাওয়ার আগে নির্লিপ্ত ভাবে কেবল কয়েকবার বলেছিলেন, ওর খুন আমি করিনি। কিন্তু প্রমাণটা উনাকেই কালপ্রিট বলছে।
রাতের দিকে কান্নার আওয়াজে পূর্বের রাতের জুলুস সবই ঢাকা পড়ল। বিয়ে বাড়িতেই মৃত্যু। আমার তবু খটকা লাগছে। ফারুক সাহেব নিছক এক গম্ভীর মানুষ, উগ্র মেজাজিও। উনি খুন করে থাকলে, ধরা পড়ায় মেজাজের উগ্রতা বেড়ে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি শান্ত ছিলেন। জেলে যাওয়া সবার পক্ষে সাধারণ একটি বিষয় নয়। উনার ক্ষেত্রে কেন লাগছে, উনি সাধারণভাবে নিয়েছেন এই বিষয়? ওহ হ্যাঁ, তিনি তো একসময় খারাপ সাঙ্গপাঙ্গের সাথে থাকতেন। হয়ত আগেও জেলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে দেখে আমার এমন কেন লেগেছে যে, উনার গাম্ভীর্যের মুখোশের নিচে একটি শোকের আবরণ আছে?
আমার সন্দেহের কথা সবই ভাইয়াকে জানালাম। সে পুলিশদের মতো করেই জানাল, ‘প্রমাণটা উনাকেই খুনি সাব্যস্ত করে।’
‘কিন্তু উগ্র মেজাজের হয়েও তিনি জেলে নিশ্চুপভাবে গিয়েছেন। খুনিরা সম্ভবত নিজের ধরা না পড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।’
‘তাহলে কী করতে পারি আমি বল। উনি খুনি নয়, এটার তো প্রমাণ আমার নেই।’
‘আচ্ছা, রুমটা কি ভালোভাবে চেক করা গেছে?’
‘না, ছুরিটা শুরুতেই পাওয়া গিয়েছিল। উত্তেজনার বশে আর কিছুই চেক করিনি। আবির?’
‘হু’
‘তুইও কি ওই রুমে যাওয়ার কথা ভাবছিস? ওটা কিন্তু আগের অবস্থায় পড়ে আছে এখনও।’
ভাইয়া এমন বলতেই ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টেনে ওই রুমে নিয়ে গেলাম ওকে। দুইজনই মিলে খুঁজতে লাগলাম। খুনি ছুরি এখানে রাখার সময় রুমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। সে কোনো ভুল করতেও পারে। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিশেষ কিছু পাইনি। যা পেয়েছি তা খুনি ধরার মতো নয়।
একরাশ হতাশা নিয়ে জাকির স্যারের সাথে ভাইয়া বসে রইলেন। মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। আমি সেদিকে গেলাম। নজর বুলিয়ে একবার দেখে নিলাম সবাইকে। সবাই মোটামুটি শোকাহত। কালকের মুচকি হাসা মেয়েটি এককোণে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানায় ছড়ানো গয়নাগাটি। মেয়ের মা কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘পোড়া কপাল আমার। আমার মেয়ের পোড়া কপাল। বিয়ের আগেই স্বামী হারিয়ে ফেলল। এই গয়নাগাটি কার জন্য? কীভাবে পরবে?’
আহামরি ধরনের কান্নাকাটি। এরকম মহিলার মন পাষাণ হয়। ধনী লোক দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। কমবয়সী মেয়ে বিয়ে দিতে সঙ্কোচ করে না। আমি ভাবতে ভাবতে একটি হার দেখে চমকে উঠলাম। আমি বিছানার পাশে গিয়ে আড়চোখে হারটি দেখে নিলাম। সেই স্টোনটি এই হারের নয়তো? এখানের একটি স্টোনের জায়গা তো খালি। ওই মেয়েটিকে কাজে লাগানো যায়। ভাব জমাতে গেলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘গয়নাগুলো কার?’
‘নাহিদার।’
‘যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তার নাম নাকি?’
‘জ্বি, মেয়েটি কথা শেষ করার আগেই তার হাতের মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল।
রাজিব নামের একটি ছেলে কল করেছে। মেয়েটি মোবাইল নিয়ে নাহিদাকে দিল। তার মানে সেটি নাহিদার। এবং আশ্চর্য হওয়ার বিষয়, এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে কলটি সে রেখে দিয়েছে। মেয়েটি কাছে আসতেই আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, উনার মৃত্যুর সময় নাহিদা কোথায় ছিল? আমরা যে ঘরে বসেছিলাম, তার পাশের রুমটাতে?’
‘না, আপনারা যাওয়ার একটু পর আমরা লাইট বন্ধ করে বেরিয়ে যাই। অবশ্য সে সময় রাজিব ভাইয়ার সাথে শেষবার কথা বলার দরুন নাহিদা অনেক কেঁদেছিল। কাজল তার লেপ্টে গিয়েছিল বলে সে আমাকে বলে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছিল। এরপর আমরা মেয়েরা স্টেজের দিকে চলে যাই।’
‘আর এই রাজিব কে?’
মেয়েটি মুখ গোমড়া করে ফেলল।
‘ওর প্রাক্তন প্রেমিক। ছেলেটি দরিদ্র আর অসৎ হওয়ায় তার সাথে নাহিদার বিয়ে হয়নি। বেচারি কালও তার ভালোবাসা ভুলতে না পেরে কাঁদছিল।’
‘অসৎ’, বিড়বিড় করতে লাগলাম।
‘কী?’
‘কিছু না।’
আমি তাড়াতাড়ি ভাইয়ার কাছে গেলাম। জাকির স্যারও আছেন তার সাথে। ভাইয়ার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, হোসেন সাহেবের সম্পত্তিগুলো কার নামে? এখনও উনার?’
‘আরে না, উনি অনেক আবেগপূর্ণ একটা লোক ছিলেন। বিয়ের আগে হবু স্ত্রীর নামে করে দিয়েছিলেন সবকিছু।’
‘ওহ… আই সি।’
‘কী হলো?’
‘এখন আমার সবকিছু পরিষ্কার হয়েছে।’
‘কী?’
আমি সকল ঘটনা খুলে বললাম, ‘ফারুক সাহেবের নির্দোষিতার প্রমাণ আমার আছে। আমরা যখন এসেছিলাম, তখন দরজাটি চাবি দিয়ে চাকর খুলেছে। কারণ এটা গেস্ট রুম। থাকার কেউ নেই। বাকি সবাই বাহিরে গান বাজনায় মশগুল ছিল।’
‘আমরা আসার পর তো বউও এসেছিল।’
‘উনি আমাদের সাথে কথা বলতে সোফা পর্যন্ত এসেছিলেন। বিছানা পর্যন্ত নয়। আর আমার সন্দেহের বড় একটা অংশ জুড়ে কী রয়েছে জানো? একটি এশট্রে। আমরা পনেরো মিনিটের মতো বাহিরে ছিলাম। আমরা যাওয়ার সময় ফারুক সাহেব সিগারেট পান করতে মোটে শুরু করলেন। এরপর যদি উনি খুন করতে যেতেন, তবে এশট্রে ভর্তি ছাই থাকত না। উনি এখানে বসেই সিগারেট পান করছিলেন।
পরে আমি আর ভাইয়া ওই রুমটিতে খোঁজার সময় আমি একটি স্টোন পাই। অপ্রয়োজনীয় হলেও রেখে দিই। মেয়েদের রুমে গিয়ে দেখি এটি নাহিদার হারেরই স্টোন। তার মানে ও কাল বিছানার পাশে গিয়েছিল। সম্ভবত ওই খুন করেছে। আমি ব্যাখ্যা দিই, ওর একটা প্রাক্তন প্রেমিক আছে, রাজিব। সেই ছেলেটি দরিদ্র। নাহিদা তাকে খুব ভালোবাসে। এই ভালোবাসাই হয়ত তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করেছে। সম্পত্তি সব ওর নামে হয়ে যাওয়ায় ও নিশ্চিন্তে প্রেমিকের সাথে পালাতে পারত। কিন্তু পালায়নি। পথের কাঁটা হোসেন সাহেব যে ছিলেন! নাহিদা কীভাবে ফারুক সাহেবের দিকে দেখছিলেন, আপনারা জানেনই। সেই চাহনিই বলে, নাহিদা তাঁর সম্বন্ধে জানত। এই কারণেই উনাকে ফাঁসালেন। আমি বলি, কী করে নাহিদা কাজটা করল। ওর শাড়ির আঁচল হাত পর্যন্ত ছড়ানো ছিল। কাজেই রুমাল আর ছুরি সহজেই লুকানো যায়। ফারুক সাহেব অন্ধকারাবৃত রুমে ছিলেন। পাশের রুমের লাইটও বন্ধ করা হয়েছিল। তাই নাহিদা হোসেন সাহেবের খুন করে এসে নিঃশব্দে ফারুক সাহেবের বসা বিছানায় বালিশের নিচে সন্তর্পণে ছুরি রেখে দেয়। অপরদিকে হোসেন সাহেবের রুমও অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় নাহিদা তাঁকে সহজে মারতে পেরেছে। এখন বলি, একদম ঘন অন্ধকারও ছিল না, যার কারণে সে মারতে পেরেছিল। হোসেন সাহেব কান্না করায় হয়ত চোখ বুজে এসেছিল। অপরদিকে ফারুক সাহেব একের পর এক সিগারেট টানায় চোখের সামনে চারিদিকে ধোঁয়াশা ভাব দেখেছেন, যেটা চোখের ওপর প্রভাব ফেলে। এরপর আমরা তিনজনকে খাবার খেতে পাঠিয়ে দেয়া হলো, মেয়েদের স্টেজে, আর বাকিরা তো গান বাজনার তালেই ছিল। এরই মাঝে খুব সহজে সে কাজটি সেরে ফেলেছে। আপনারা হয়ত দেখেছেন নাহিদা কীভাবে হোসেন সাহেবের লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল। সবই অভিনয় ছিল তার। তাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল একটি বয়স্ক লোকের সাথে। কাজেই এমন মেয়ের মধ্যে তাঁর মৃত্যু নিয়ে শোক হওয়ার কথা নয়!’
জাকির স্যার ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘আমার বন্ধু কী দোষ করেছে? এত নরম মনের মানুষ ছিল ও! মেয়েটি সম্পত্তি খুঁজলেই দিয়ে দিত। তাঁকে কেন খুন করেছে? কেন?’
‘মেয়েটি অল্পবয়সী। কাজেই উচিত কী তা ভেবে পায়নি। তাছাড়া তার প্রেমিক অসৎ এক ছেলে। সেই হয়ত নাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।’
মেয়েদের রুমটির দরজা এখন খোলা। নাহিদাকে দেখা যাচ্ছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। কেন হাতে মেহেদি পরার জায়গায় হাতকড়ি পরার জোগাড় করলে সে! কেন? প্রেমের কারণে?
(সমাপ্ত..)