গ্রামে একের পর এক শিশুদের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম-প্রথম গোয়াল থেকে গরু, ছাগল উধাও হওয়া শুরু হয়েছিলো। গ্রামের লোকজন এটাকে ভেবেছিলো চোরদের কাজ। কিন্তু যখন মাটিতে বাঘ জাতীয় হিংস্র প্রাণীর পায়ের ছাপ পাওয়া গেলো তখন থেকে সকলের ধারনা বদলাতে শুরু হলো। নিখোঁজ হওয়া গরু, ছাগল গুলোর হাড্ডি পাওয়া যেত গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে ফসলের ক্ষেতের আইল ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা বড় বটগাছের গোঁড়ায়। গ্রামের কয়েকজন দেখেছে মানুষের মতো শরীর কিন্তু বাঘের মতো মুখ, সারা শরীরে বড় বড় লোমে ভরা জন্তুটি রাতের আঁধারে এসে প্রাণীগুলোকে ধরে নিয়ে যায়। খবরটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে গ্রামে লোকের মুখে মুখে।
গরু, ছাগল হারানোর কিছুদিন পর শুরু হলো নতুন কাহিনী। গ্রামের বাথরুমগুলো শোবার ঘর থেকে কিছুটা দূরেই থাকে। রাতের বেলায় বাথরুম থেকে ফেরার পথে ঘোষ বাড়ির ছোট ছেলে উধাও হয়ে যায়। দু’দিন পর তার হাড্ডিসার কংকাল পাওয়া যায় সেই বটগাছের নীচে। অদ্ভুত ব্যাপার ছেলেটার কলিজা, চোখ, কিডনি এগুলো কিছুই ছিলো না তার মৃতদেহে। হিংস্র প্রাণীর নখের আঁচড় তার সারা শরীরে বিদ্যমান। তিনমাসের ভেতর গ্রামের চারটা বাচ্চার সাথে এমন ঘটনা ঘটে গেলো। এ ঘটনা ঘটার কারণে সন্ধ্যার পর আর কোন মানুষ ঘর থেকে বের হতো না।
শান্তা ও তার বাবা মা শহরে থাকে। বছরে দুবার ঈদে তারা গ্রামে আসে। এ খবর শোনার পর গত ঈদে শান্তার আর গ্রামে যাওয়া হলো না।
হঠাৎ শান্তার বাবার বড় কাকার মৃত্যুর খবর পাওয়াতে শান্তা ও তার বাবা-মা গ্রামে এসে হাজির হলো। শান্তা ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাদের বাড়ি গ্রামে হলেও শহরের মতোই দোতলা বিল্ডিং। সামনে বিরাট বড় উঠান। উঠানের ওপাশে একটা বড় পুকুর। পুকুরে তাদের বাড়ির পুরনো কাজের মহিলা আমেনা খালার মেয়ে রুমা লালপদ্মের বীজ লাগিয়েছিলো। তার থেকেই পুকুরের মাঝে বড় বড় পদ্ম ফুটে থাকে।
রুমা ও শান্তা সমবয়সী। গ্রামে আসার পর শান্তা জানতে পারলো বাড়ির কোন ছেলেমেয়েদের একলা ঘর থেকে বাইরে, এমনকি বাড়ির সামনের উঠানেও বের হওয়া নিষেধ । বাড়িতে বড় দাদুর মৃত্যুর ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর কদিন পর মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো। মিলাদের কারণে গ্রামের অনেক লোক এসে হাজির হয় শান্তাদের বাড়িতে। ঠিক যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে তখনি শুরু হয় গণ্ডগোল। চারদিকে খোঁজ-খোঁজ রব। রুমা’কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ছোটবেলা থেকেই সে এ বাড়িতে মানুষ। আমেনা খালা নাকি মিলাদের কিছু খাবার রুমা’র হাতে দিয়ে বাড়িতে রেখে আসতে বলেছিলো দুপুরবেলা। খাবার রেখে আর মেয়েটা এ বাড়িতে ফেরেনি।
শান্তাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আমেনা খালার বাড়ি। বাড়িতে বৃদ্ধা রুমার দাদী একা থাকেন। বয়সের ভারে একা একা হাঁটাচলা করতে পারেন না। তাই রুমার মা ওনার জন্য কিছু খাবার বাড়িতে পাঠান ৷ তারপর আর রুমাকে দেখতে না পেয়ে ভাবেন, হয়তো এত বড় বাড়ির কোথাও রুমা আছে। কাজের চাপে তিনি রুমার খোঁজ নেওয়ার সময় পান না। কিন্তু বিকেলবেলা এ বাড়ির সব জায়গা খুঁজেও যখন রুমাকে দেখতে পেলেন না তখন নিজের বাড়িতে রুমার খোঁজে যান। সেখানেও রুমাকে না পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। তার কান্না শুনে আশেপাশের লোকজন এসে হাজির হয়। তারপর সারা গ্রামে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে।
তিনদিন পর আগের মতোই রুমার হাড্ডিসার কংকাল পাওয়া যায় গ্রামের সেই বটগাছের নীচে। দেখে চেনার উপায় ছিলো না, এটা রুমার মৃতদেহ। হিংস্র প্রাণীর নখের আঁচড় বিদ্যমান মেয়েটার চোখ, মুখ সহ সমস্ত শরীরে। বুক থেকে পেট অবধি ফাড়া, নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে শরীর থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে আছে। কোনরকম দেহটাকে তুলে এনে দাফন করা হয়।
শান্তার দাদীর অনুরোধে রুমার মৃতদেহটাকে মাটি দেওয়া হয় শান্তাদের পারিবারিক কবরস্থানে।
রুমার লাশটাকে মাটি দিয়ে যখন সকলে এক এক করে বাড়ি ফিরে চলে যায় তখন কবরের পাশে এসে হাজির হয় শান্তা ও তার কাকাতো ভাই রবি এবং কাকাতো বোন সাথী। ছোটবেলা থেকেই শান্তা, রবি, সাথী এবং রুমা একসাথে মিলেমিশে বড় হয়েছে। রবি শান্তা ও সাথীর থেকে বয়সে বেশ বড় হলেও ঠিক বন্ধুর মত মিশত তারা। ছুটির সময় শান্তারা যখন গ্রামে আসতো তখন রুমা তাদের তিনজনকে নিয়ে বিলে ঘুরতে যেত, পদ্মপুকুর থেকে পদ্ম এনে দিত। বরই, তেঁতুল, আম, লিচু যখন যেটা পাওয়া যেত নিজে গাছে উঠে পেড়ে এদের খাওয়াতো, আরো কত-শত দস্যিপনা যে ছিলো এদের চারজনের! শান্তা কবরের পাশে বসেই হুহু করে কেঁদে ফেলে। রবি এবং সাথী শান্তাকে কবরের কাছ থেকে সরিয়ে আনে।
কিছু সময় পর রবি একটা বেলি ফুলের চারা এনে পুঁতে দেয় রুমার কবরের ওপর। বেলি ফুল রুমার খুব পছন্দের ছিলো। হয়তো বেলিফুলের চারাটা বেঁচে যাবে। বেলির ঝাড়ে ভরে যাবে রুমার কবর। থোকা-থোকা ফুলে ভরে থাকবে বেলির ঝাড়। রুমা কি এসব দেখতে পাবে?-কথাটা ভাবতেই শান্তার কান্না পায়। যতবারই গ্রামে বেড়াতে আসবে ততবারই গোরস্থানের কবরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বেলি গাছটার দিকে তাকিয়ে রুমার কথা মনে পড়বে তার। কিন্তু জীবনে আর কখনো রুমার সাথে দেখা হবে না।
এমন ঘটনা ঘটার পর শান্তার দাদী অসুস্থ হয়ে পড়েন। যতই কাজের মহিলার মেয়ে হোক না কেন, রুমাকে তিনি ছোটবেলা থেকেই তো নিজের নাতিপুতিদের সাথে মানুষ করেছেন। এবং তাঁর দেখাশোনা সবটাই রুমা করতো। বাড়ির যাবতীয় কাজকাম রুমার মা করতো।
বাড়িতে ডাঃ সুকুমার সেনকে ডেকে আনা হলো। তিনি গ্রামের হসপিটালে বদলি হয়ে এসেছেন বছর দুই হলো। কিন্তু এই দু বছরেই তিনি জনগণের আপনজন হয়ে উঠেছেন। ডাঃ সাহেব এসে কিছু টেস্ট এবং পরীক্ষা করানোর পর জানালেন শান্তার দাদী মানসিক টেনশনের কারণে অসুস্থ হয়েছেন। এখন ওনার পূর্ণ বিশ্রাম এর প্রয়োজন। কোনরকম মানসিক টেনশন দেওয়া যাবে না এবং বেশি হাঁটাহাঁটি করাও নিষেধ। শান্তার দাদীর এমন শারীরিক অসুস্থতার কারণে শান্তার বাবা একাই শহরে ফিরে যেতে বাধ্য হন। গ্রামে সকলের সাথে থেকে যায় শান্তা ও তার মা।
গ্রামে পঞ্চায়েত এর মতামতে গ্রামের লোকজন পালাক্রমে এলাকা পাহারা দিতে শুরু করে। মাসখানেকের মাঝেই গ্রামের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসে। এই কয়দিনে বাড়ির বাইরে কোন মানুষ একলা পা বাড়ায়নি। কিন্তু এখন গ্রামের পাহারা বাড়ানো হয়েছে, এবং বেশ কিছুদিন কোন ঘটনা না ঘটার কারণে একটু একটু করে সকলেই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করেছে।
রুমার মৃত্যুটা শান্তা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারে না। কয়েকটা বিশেষ কারণে তার মনে সন্দেহের ডানা বাঁধা শুরু হয়। এই কয়দিনে শান্তা, রবি এবং সাথী অনেক পরামর্শ করে রুমার মৃত্যুর দোষীকে শাস্তি দেবার জন্য। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক তারা একটা কিছু করে দেখাবেই। কিন্তু তারা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। তাদের দলে যোগ দেয় রবির বন্ধু আশিক এবং রাতুল। এই পাঁচজন মিলে শপথ করে, যে করেই হোক ওই হিংস্র জানোয়ারটাকে ধরবেই। কিন্তু তাদের এই প্লানের কথা পাঁচজন ছাড়া বাইরের একটা কাক-পক্ষীও জানতে পারে না।
দুপুরবেলা যখন সকলে খেয়েদেয়ে বিশ্রামের জন্য নিজেদের ঘরে চলে গেলো তখন শান্তা, রবি, এবং সাথী ঘর থেকে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়লো। বড় রাস্তায় অপেক্ষা করছিলো আশিক এবং রাতুল। তারা সাথে করে কয়েকটা পায়রা নিয়ে এসেছিলো। শান্তার ব্যাগে ছিলো গরু জবাই করা ছুরি। রবির কোমরে গোজা একটা ছোট চাকু। সকলে চোখমুখে যুদ্ধে যাবার মতো অধীর আগ্রহ ফুটে উঠেছে। শান্তার পরামর্শ মতোই আজকের এই পদক্ষেপ। তারা সকলে আজ সেই বটগাছটার কাছে যাবে, যেখানে সকল মৃতদের কঙ্কাল পাওয়া যায়। ওই গাছটার তলায় দিনে দুপুরেও কোন মানুষ আসা যাওয়া করে না।
ধানগাছের আইল ধরে হেঁটে প্রায় আধা-কিলোমিটার যাবার পর বটগাছের দেখা পেলো তারা পাঁচজন। শান্তা ঘুরে ঘুরে গাছটার আশেপাশে দেখে নিলো। তারপর রবি ও তার বন্ধুদের বললো দ্রুত কাজটা করতে। রবি কাঁচি দিয়ে পায়রার পালকগুলো কেটে দিলো, যাতে পায়রাগুলি উড়ে না যায়। তারপর সাথীকে ঈশারা করলো। সাথী গাছের থেকে পাঁচ হাত দূরে গাছের চারপাশ ঘুরিয়ে বেশ পুরু করে পাউডার ছড়িয়ে রাখলো, যেনো কোন জন্তু এখানে আসলে তার পায়ের ছাপটা পাওয়া যায়।
বিকেল হবার আগেই সকলে বাড়ি ফিরে আসলো। বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে সকলে ঘরে প্রবেশ করলো। পরদিন সকালে আশিক এবং রাতুল এসে জানালো, তারা ভোরবেলা বট গাছতলায় গিয়ে দেখে পায়রাগুলো মৃত। শিয়াল বা বনবিড়াল জাতীয় প্রাণী ব্যতীত অন্য কোন হিংস্র প্রাণীর পায়ের ছাপ সেখানে নেই। এমন খবরে শান্তাসহ বাকি সকলেই বেশ অবাক হলো। শান্তা রুমার মৃত্যুর জন্য যে আশঙ্কা করেছিলো সেটাই তবে সত্য হতে চলেছে।
এক সপ্তাহ কেটে গেলো। শান্তার দাদী অনেকটা সুস্থ। শান্তার বাবা এসেছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। এই দু’মাসে শান্তার পড়ালেখার বেশ ক্ষতি হয়ে গেছে। আর মাত্র সাতদিন পর শান্তা শহরে ফিরে যাবে। গ্রামের এমন পরিবেশে শান্তার বাবা কিছুতেই আর তার পরিবারকে এখানে রেখে যাবেন না; সিদ্ধান্ত হলো, এবার শহরে যাবার সময় শান্তার দাদীকেও সাথে নিয়ে যাবেন। সব কিছু গোছ-গাছ করতেই কেটে যাবে আরো কয়েকটা দিন।
রাত যখন প্রায় তিনটা বাজে তখন অনেক লোকের চেঁচামেচিতে গ্রামের লোকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সকলেই ডাঃ সুকুমার সেন এর বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। কারণ ওদিক থেকেই চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। বাড়ির চতুর্দিকে লোকজনের সমাগম। ডাঃ সুকুমার সেন যে বাড়িতে থাকতো সেটা ছিলো হাসপাতাল এর কোয়ার্টার। একটা পুরানো বিল্ডিং। সেখানে ডাঃ এবং তার কম্পাউন্ডার থাকতো। বাড়ির ভেতরে কোনো দিন বাইরের কেউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না; সব সময় সদর দরজায় একজন দারোয়ান বসে থাকতো।
বাড়ির উঠানে একটা বড় কাঁঠালগাছ। গ্রামের লোক এসে অবাক হয়ে দেখলো কাঁঠাল গাছটার সাথে ডাঃ সুকুমার সেন, তার কম্পাউন্ডার এবং দারোয়ানকে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের পায়ের নীচে পড়ে আছে একটা বাঘের মুখোশ। দরোয়ানের শরীরে জড়ানো বড় বড় লোমওয়ালা এক ধরনের পোশাক। সারারাত তাদের তিন জনকে বেঁধে রাখা হলো গাছটার সাথে। সকালবেলা থানার দারোগা বাবু আসলেন। তিনি সব কথা খুলে বললেন গ্রামের লোকদের।
আসলে ডাঃ সুকুমার সেন হলেন মানব অঙ্গ পাচারকারী। তার সহযোগী দুজন হলো, দারোয়ান এবং কম্পাউন্ডার। দারোয়ান হিংস্র জানোয়ার এর পোশাক পরে গরু, ছাগল চুরি করে মানুষকে ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস যুগিয়েছিলো যে, গ্রামে ভয়ঙ্কর কোন হিংস্র প্রাণী ঢুকেছে। তারপর তারা শুরু করে আসল কাজ। ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে আনতো দারোয়ান এবং তাদের চোখ,কলিজা, কিডনি এসব বের করে পাচার করতো ডাঃ সুকুমার সেন। সব শেষে লাশগুলোকে ফেলে রেখে আসতো বটগাছের নীচে।
দারোগা বাবু আরো জানেন, শান্তা ও তাঁর সহযোগী চারজন না থাকলে কখনোই পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারতো না। মূলত রুমার লাশ দেখার পর শান্তার মনে নানা প্রশ্ন জাগে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো রুমার মৃত্যুর দিন সে শান্তার জামা, পাজামা, ওড়না পরেছিলো। রুমার কঙ্কালের পাশে তার জামা ও পাজামা পাওয়া গিয়েছিলো। সারা শরীরে নখের আঁচড় থাকলেও রুমার জামার কোথাও কোন ছেঁড়া বা নখের আঁচড় ছিলো না। জামাটা পাওয়া গিয়েছিলো রুমার লাশের পাশে। শান্তা খুব গোপনে জামাটা সরিয়ে রাখে। লাশের ভয়াবহতা দেখে জামার দিকে কেউ সেদিন খেয়াল করেনি। তার কিছুদিন পর, সেদিন রুমার পরনের ওড়নাটা দারোয়ান এর বউ এর গায়ে দেখে শান্তা। তখন থেকেই সন্দেহের ডানা বাঁধা শুরু হয় তার মনে।
ওদিকে দুই তিন রাত বটগাছের মগডালে ক্যামেরা বসিয়েও হিংস্র প্রাণীর কোন দেখা পায় না তাঁরা। কিন্তু গত রাতে দারোয়ান বটগাছের গোঁড়ায় গিয়ে উপস্থিত হয় আরো একটা মৃতদেহ রেখে আসার জন্য। মৃতদেহটা ছিলো শান্তার কাকাতো বোন সাথীর। তাদের প্লান অনুযায়ী সাথী একা-একা দারোয়ান এর বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। কথা ছিলো সাথীকে কেউ আক্রমণ করতে এলেই তাঁরা চারজন ঝাঁপিয়ে পড়বে আক্রমণকারীর ওপর; কিন্তু হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়াতে চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। ঠিক তখনি জানোয়ারটা এত নিঃশব্দে সাথীকে তুলে নিয়ে যায় যে তারা চারজন টেরও পায় না। তবুও হিংস্র জানোয়ারটাকে ধরার জন্য শান্তা, রবি, আশিক এবং রাতুল বুকে পাথর বেঁধে চুপচাপ পড়ে থাকে। তাদের চোখ কান আরো খোলা রেখে মরিয়া হয়ে ওঠে জানোয়ারটাকে ধরার জন্য। সাথীর নিখোঁজ এর ব্যাপারে তারা মুখ খোলে না কারো কাছে। অবশেষে সাথির কঙ্কাল বটগাছের নীচে রাখতে গেলে ক্যামেরায় বন্দি হয় দারোয়ান, এবং সাথে সাথেই ঝোপের ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা আশিক, রাতুল এবং রবি এসে জাপটে ধরে দারোয়ানকে। তার মুখ থেকে জবানবন্দি নিয়ে ডাঃ সুকুমার সেন এবং তার কম্পাউন্ডারকে ধরে বেঁধে রাখে গাছের সাথে। এরপর পুলিশকে খবর দেয় রবি ও তার বন্ধুরা।
দিনের আলো ফুটতে শুরু করলেই গ্রামে হৈ-চৈ পড়ে গেলো। মানুষরূপী হিংস্র জন্তু তিনটিকে দেখতে গ্রামের লোকজন ভেঙ্গে পড়লো। চারপাশের গ্রাম থেকেও লোকজন আসছে দেখতে। শুধুমাত্র পুলিশের পাহারার কারণে জানোয়ার তিনটা এখনো প্রাণে বেঁচে আছে। শান্তা মেয়ে হয়েও এত বড় একটা কাজ করেছে শুনে সকলে জানোয়ারগুলোকে দেখার পর শান্তাকে দেখতে আসছে।
শান্তার কিছুই ভালো লাগছে না। সে চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে সাথীর কবরের পাশে যায়। রুমার কবরের পাশেই সাথির কবর দেওয়া হয়েছে। রুমার কবরের উপর লাগানো বেলি ফুলগাছটা ফুলে-ফুলে ভরে আছে। শান্তা গিয়ে সাথী আর রুমার কবরের মাঝে ফাঁকা জায়গাটায় বসে পড়ে। কবরের ওপর হাত রাখতেই শিউরে ওঠে সে; হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘তুই নিজের জীবনের বিনিময়ে মানুষরূপী জানোয়ারগুলোর মুখোশ খুলে দিতে পেরেছিস। আমি পারলাম না তোকে বাঁচাতে। আমাকে ক্ষমা করিস। কিন্তু তোদের যে বা যারা মেরেছে আমি তাদের শাস্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পেরেছি।
কথাগুলো শেষ করে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না সে; সাথীর কবরের ওপর হাত রেখে ঝর-ঝর করে কাঁদতে থাকে।