রহস্য ঘেরা রজনী

কোণের লোকটি মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর ঝুঁকে তাকালেন। তার দুটি তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসু চোখ মেলে শ্বেত পাথরের কারুকাজ মণ্ডিত টেবিলটি ভালো করে দেখলেন।

তারপর তিনি উঠে সোজা মিস মেরির রুমের দিকে গেলেন। রুমটাকে তিনি নগ্ন দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। এভাবে বাড়ির প্রতিটা রুম তিনি পর্যবেক্ষণ করছিলেন,এমন সময় করিডোরে হৈ চৈ শোনা গেলো।

আবির রয় কিছু বলার চেষ্টা করছেন। বারবার জানালা দিয়ে বাইরের বকুল গাছ টিকে দেখাচ্ছিলেন।
অদ্ভুত প্রকৃতির ইফতেখার মাহমুদ, ইতি মধ্যেই রয় পরিবারের দু’একজনের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছেন। যদিও তাতে ইফতেখার মাহমুদের কিছু আসে যায় না। ইফতেখার মাহমুদ তার মাথা থেকে তেল চিটচিটে ক্যাপ টা খুলে বকুল গাছটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখে গাছের নিচ থেকে কিছু একটা তুলে তার ব্যাগে রাখলেন। আবির রয় তখনও হৈ চৈ করেই চলেছে। মিস তিশা আবির রয়কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। মিস তিশা, রয় পরিবারের ছোট ছেলে প্রদীপ রয়ের হবু বউ।

ইফতেখার মাহমুদ,রয় পরিবারের কর্তা অশুক রয়ের কাছ থেকে রয় পরিবারের মেইন গেটের ডুব্লিকেট চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
নিজের অফিসরুমে ঢুকে ইজি চেয়ারে বসে দুলছেন ইফতেখার মাহমুদ। তবুও তার কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট হয়ে আছে।
গর্কি ইফতেখার মাহমুদের জন্য এককাপ কফি হাতে রুমে প্রবেশ করল। এমন সময় ইফতেখার মাহমুদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন আর গর্কির হাতের কফি ধাক্কা লেগে কিছুটা ইফতেখার সাহেবের সাদা শার্টে লেগে যায়। সাদা কাপড়ে কফির দাগ টা লালচে বর্ণ ধারণ করে। ইফতেখার মাহমুদ গর্কিকে কিছু না বলে দ্রুত ব্যাগ থেকে একটা কাপড়ের টুকরা বের করে, যা তিনি রয় বাড়ির বকুল গাছের নিচ থেকে এনেছিলেন।

রাত ১ টার সময় ইফতেখার মাহমুদ হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে রয় বাড়ির গেট খুলে বকুল গাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাঁদের আলোতে পুরা বাড়িটা আলো আধাঁরের খেলায় যেন মেতে উঠেছে। আবছা আলোতে ইফতেখার মাহমুদ দেখলেন, কবিতা রয়ের বেলকনিতে কেউ একজন তার লম্বা চুল ছেড়ে করুণ কণ্ঠে গান করছে। আর দাঁড়িয়ে না থেকে ইফতেখার মাহমুদ বাড়ি ফিরে এলেন।
সকালে ইফতেখার মাহমুদ, রয় বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়লো কবিতা আবির রয়ের রুম থেকে কিছু কাপড় নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা ধোপার দিকে যাচ্ছে। সেই কাপড়গুলোর মধ্যে একটা সাদা ছেঁড়া ওড়না চোখে পড়লো ইফতেখার মাহমুদের। তিনি এগিয়ে গিয়ে কবিতাকে ঐ ওড়নাটা কার জানতে চায়লে কবিতা তাকে জানায় ওড়নাটা তার।

ইফতেখার মাহমুদ ছেঁড়া ওড়নার বাকি অংশটুকু তার ব্যাগ থেকে বের করে রয় বাড়ির সবার সামনে ওড়না ছেঁড়ার ঘটনা জানতে চায় কবিতার কাছে। কবিতা জানায় মেরির জন্মদিনে ওর ড্রেসে জুস ঢেলে পড়ায় সে কবিতার ড্রেসটা পরেছিল।
তার ব্যাগ থেকে একটা ডাইমন্ড রিং বের করে জানতে চায় এই রিং কার। অনিশা রয় মানে আবির রয়ের বড় বোন জানায় এই রিংটা মেরির।
এই রিং টা কবিতার রুম থেকে পাওয়া গেছে ইফতেখার মাহমুদ সবাইকে অবগত করে।

রহস্য! ঘুরপাক খায় সবার মনে। দু’দিন পর মিস মেরির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসে ইফতেখার মাহমুদরে হাতে।
রিপোর্ট বলছে, মিস মেরির শরীরে ঘুমের ঔষধ পাওয়া গেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় তার শরীরে অসংখ্য বার ছুরি চালানো হয়েছে।
সেদিন রাতে কাউকে কিছু না বলে আবার রয় বাড়ি ঢুকলেন ইফতেখার মাহমুদ। চারদিক কোন সাড়াশব্দ নেই। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
আবির রয়ের রুমের পাশ দিয়ে যেতেই কারও কথা শুনে থেমে গেলেন ইফতেখার মাহমুদ। তিনি ভিতরে কে বা কী কথা হচ্ছে জানার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন কিছুই দেখতে বা শুনতে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ শোনলেন তিনি। ইফতেখার মাহমুদ দেখলেন কবিতা আবির রয়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। আর আবির রয় হুইল চেয়ার ছেঁড়ে নিজের পায়ে হেঁটে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এবার রহস্যের জাল ভেদ করে খুনি সবার সামনে চলে আসছে ধীর পায়ে।
সেই রাতেই ইফতেখার মাহমুদের হাতে পড়লো ঘুমের পিলের খালি পাতা। যা তিশার রুমের জানালার পাশে পরে ছিল।
ইফতেখার মাহমুদ খালি পাতা ও প্রদীপ রয়ের রুমে পাওয়া ছুরি ফরেনসিক ল্যাবে পাঠালেন। দু’দিন পর রিপোর্ট চলে আসে। ঔষধের পাতায় শুধু তিশার হাতের ছাপ পাওয়া যায়।

ইফতেখার মাহমুদ রয় বাড়ি ঢুকে সবাইকে এক সাথে ডাকেন। একে একে সবাই এসে করিডোরে হাজির হলে ইফতেখার মাহমুদ অশুক রয়ের কাছে মিস মেরি সম্পর্কে জানতে চায়।
তিনি বলেন ,
“মিস মেরি আমার বন্ধুর একমাত্র কন্যা। মিস মেরি দুই শত কোটি টাকার মালিক। আমার বন্ধু মৃত্যুর আগে মেরির বিবাহ আমার বড় ছেলের আবিরের সাথে দেবার কথা বলেছিল। মেরি তখন অনেক ছোট। মেরিকে তার পিসি আমেরিকা নিয়ে যায়। আজ প্রায় পনেরো বছর পর মেরি গত পরশু তার ১৮তম জন্মদিনে আমাদের বাড়ি আসে। আসার আগে আমি বাড়ির সবাইকে এটা জানিয়ে দেই যে,মিস মেরির সাথেই আবিরের বিয়ে পাকা হয়ে আছে।”

ইফতেখার মাহমুদ এবার কবিতা ও আবিরকে কিছু বলার জন্য বললেন।
আবির জানালো এ বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। তখন ইফতেখার মাহমুদ বললেন, তাহলে আমিই বলব কি যে, আপনার সাথে কবিতার গভীর প্রেমের সম্পর্কের কথা?

একথা শুনে অশুক রয় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আর উঠবেনই বা না কেন? কে চায় বাড়িতে আশ্রিত কোন মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দিতে!
এবার ইফতেখার মাহমুদ কবিতাকে বললেন,কবিতা দেবি আমি বললে সেই ভাষা আপনাদের ভালো লাগবে না তাই নিজের মুখেই সত্য টা বলেন।

কবিতা এবার ওড়না দিয়ে নিজের কপালটা মুছে বলতে শুরু করলেন,
“কাকাবাবু যেদিন আবিরের বিয়ে মিস মেরির সাথে দেবার কথা জানায় তখন আমার গর্ভে আবিরের সন্তানের বয়স তিন মাস। আমি একথা শুনে ছুটে যাই আবিরের কাছে। আবিরকে সব কথা বলাতে আবির জানায়, সে এ বিয়ে কিছুতেই করবে না। তার আগেই সে আমাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাই আমি আর এ বিষয়ে কিছুই বলি না। ”

এবার তিশা দেবি আপনি বলুন, আপনি কেন সেদিন জন্মদিনের পার্টিতে মিস মেরির জুসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছিলেন?
আর হ্যাঁ মিথ্যা বলার চেষ্টাও করবেন না। কারণ এই ইফতেখার মাহমুদ উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কথা বলে না।
তিশা কোন ভণিতা না করেই বলে দিল যে,
“আমি সেদিন প্রদীপের ঘরে প্রদীপের একটা ডাইরি পাই যাতে লেখা ছিল সে কবিতাকে খুব বেশি ভালোবাসে। তাকে সে যে কোন মূল্যে চায়।তাছাড়া আমি কবিতার প্রেগন্যান্সির কথাও জানতে পারি আমার এক ডাঃ বন্ধুর কাছে। তখন আমার মনে হয় এই সন্তান প্রদীপের। আর তাই আমার কবিতার উপর ভীষণ রাগ হয়। কারণ প্রদীপকে খুব ভালোবাসি। তার সাথে ক’দিন পর আমার বিয়ে। আর সে কি না কবিতাকে ভালোবাসে!তাই আমি কবিতাকে এই বাড়ি থেকে বের করার প্লান করি। আমি পার্টিতে মিস মেরিকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে তার ডাইমন্ডের রিংটা চুরি করে কবিতার রুমে রেখে আসি। এর বেশি আমি কিচ্ছু করিনি।”

এবার আসল খুনিকে সবার সামনে আনতে ব্যাগ থেকে বের করে সেই ছুরি যা দিয়ে নির্মম ভাবে খুন করা হয় মিস মেরিকে। যদিও তাকে খুন করা খুনির উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল কবিতাকে খুন করা কি আমি ঠিক বলেছি তো মিস্টার অশুক রয়। ইফতেখার মাহমুদের এমন কথায় যেন বাজ পড়লো সবার মাথায়।

অশুক রয় বললেন, এই ছুরি আপনি কোথায় পেলেন?
ইফতেখার মাহমুদ জানায় এটা বড় বিষয় না বড় বিষয় হলো আপনি কেন মিস মেরিকে খুন করলেন তা সবাই কে নিজের মুখে বলুন। আর বলতে না চাইলে আমি বলে দিচ্ছি।

অশুক রয় দেখলেন আর কোন রাস্তা নেই তাই বাধ্য হয়ে নিজের দোষ শিকার করে বললেন,
“আমি সেদিন কবিতা আর আবিরের সব কথা শুনি। কবিতা আমার বাড়ি আশ্রিত একটা মেয়ে তাকে আমি কোন ভাবেই আমার বাড়ির বউ হিসাবে মানতে পারবো না। তাছাড়া কবিতার জন্যই মিস মেরির দুইশত কোটি টাকার প্রোপার্টি আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে এটাও মানতে পারলাম না। আর তাই আমিও সুযোগ খুঁজছিলাম কবিতাকে খুন করার।
পার্টি চলা কালে কবিতা একা সেখান থেকে বেরিয়ে ওর ঘরে যায় আমি সেই সুযোগে ওর পিছু নেই। কিন্তু আমি ভুল করে কবিতা ভেবে মেরির বুকে ছুরি চালিয়ে দেই।”

হুম আসলে মিস মেরি তার কাপড়ে জুস পড়াতে কবিতার ড্রেস পরে। আর ঘুমের ঔষধের দরুন সে কবিতার রুমেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আর আপনি বড় ভুলটা তখনি করেন।
আর নিজের দোষ ঢাকতে রাতের অন্ধকারে আপনি আপনার ছোট ছেলের রুমে ছুরিটা রেখে আসেন। কারণ আপনি এটাও জানতেন যে, আপনার ছোট ছেলেও কবিতাকে ভালোবাসে।
আর সেই রাগে কবিতাকে খুন করতে গিয়ে ভুল করে সে মেরিকে খুন করে ফেলেছে।
এটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন আপনি,আমি ঠিক বলেছি তো মিস্টার অশুক রয়?
কিন্তু আপনার দুর্ভাগ্য শেষ রক্ষা হলো না। কারণ আপনি যখন ছুরিটা প্রদীপের রুমে রেখে আসেন তখন আমি দেখে ফেলি।

আবির রয় আপনি এবার হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন। আর কবিতা দেবি ভুত সেজে গল্পের মোড় ঘুরানোর ভালো চেষ্টাই করেছিলেন। আপনাদের নাটকও এবার বন্ধ করুণ।

আর একটা কথা, প্রদীপ রয়ের এক তর্পা ভালোবাসা টা ভুল না হলেও তা ডাইরি বন্ধী করাটা একটা অপরাধের জন্ম দিয়েছে। যদিও তাতে প্রদীপ রয়ের কোন দোষ নেই।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত