মানুষ খেকো পিশাচিনী

মানুষ খেকো পিশাচিনী

…(১ম পর্ব)…

-আচ্ছা বাবা! মানুষের মাংস খেতে কেমন লাগে?
….
৬ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের মুখে এই ধরণের প্রশ্ন শুনে যেকোন বাবারই চমকে উঠার কথা!
কিন্তু আবির সাহেব বিন্দুমাত্রও চমকালেন না!
আবির সাহেব মিষ্টি করে হেসে তার ৬ বছরের বাচ্চা মেয়ে শম্মীকে উত্তর দিলেন:
-খুব খারাপ লাগে মা। অনেক গন্ধঁ আসে মানুষের শরীর থেকে। মানুষের শরীর একে বাড়েই খাবার উপযুক্ত না।
এদের মাংস অনেকটা নিম পাতার রসের মতো তিতা লাগে!
-কিন্তু তুমি কী করে জানলে? তুমি কী কখনো মানুষের মাংস খেয়েছো? (শম্মী)
-হ্যাঁ মা! যখন আমি তোমার সমান ছোট ছিলাম তখন খেয়েছিলাম। খুব বাজে স্বাদ মানুষের মাংসের।
-হোক বাজে! তাও আমি মানুষের মাংস খাবো। তুমি প্লিজ এনে দাও না বাবা! প্লিজ প্লিজ প্লিজ বাবা! লক্ষী বাবা!
-আচ্ছা বাবা! কিন্তু এখনতো অনেক রাত হয়ে গেছে! এখনতো আর কোন মানুষ ঘর থেকে বের হবে না! আমার লক্ষী মেয়েটা!
তুমি এখন ঘুমাও! আমি তোমায় কাল সকালে মানুষের মাংস এনে দিবো!
-প্রমিজ?
-ঠিক আছে লক্ষী বাবা! প্রমিজ।
.
বাবার সাথে এতটুকু কথা বলেই শম্মী বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। শম্মীর এই ধরণের ব্যবহার আগে আবির সাহেবের কাছে অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক লাগলেও এখন তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে! কারণ আবির সাহেব জানেন শম্মী আর ৮-১০ টা স্বাভাবিক মেয়ের মতো নয়।
শম্মী জন্মের পর থেকেই বেশ অদ্ভুত রকমের আচরণ করতে শুরু করে। শম্মীর জন্মের সাথে সাথেই তার মা মারা যায়। এরপরে বাড়িতে একটা আয়া রাখা হয় শম্মীর জন্য। কিন্তু আয়াটা বেশিদিন টিকেনি ১৩ দিন শম্মীর দেখাশোনা করার পর আয়াটা পালিয়ে যায়। এরপর আবির সাহেব শম্মীর দেখাশোনার জন্য আরো ৪-৫টা আয়া রাখেন। কিন্তু কোন আয়াই তাদের বাড়িতে টিকেনা। সবাই ৩-৪ দিন শম্মীর দেখাশোনা করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
আবির সাহেব তখন বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না! ভাবেন, রহস্যটা কি?! সব আয়ারা এইভাবে কিছু না বলেই পালিয়ে যাচ্ছে কেন? এরপর তিনি শেষ যে আয়াটাকে রাখেন তার দিকে ভালো করে লক্ষ রাখতে থাকেন।
এরপর তিনি যা দেখলেন তা দেখে তিনি পুরোই অবাক হয়ে গেলেন। শম্মীকে যখন ল্যাকটোজেন বা এই ধরণের খাবার দেওয়া হয় তখন সে খাবার খায় না! এরপর আয়ার হাতকে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে রাখে। ঘটনাটা দেখতে স্বাভাবিক লাগলেও ঘটনাটা মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না! আসলে শম্মী অনেকটা জোকের মতো করেই ঠোঁট দিয়ে চেপে আয়াদের শরীরের রক্ত খেতো। আয়ারা প্রথমে কিছু বূঝতে পারতো না। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতো। পরে যখন ব্যাপারটা ভালোমতো বুঝতে পারে, তখনি তারা বেশ ভয় পেয়ে যায় এবং কাউকে কিছু না বলেই এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়!
আবির সাহেব ঘটনাটা বুঝতে পারে এবং বেশ অবাকও হন। তিনি নিজেও একজন ডাক্তার। কিন্তু তিনি তার পুরো জীবনে এইরকম অদ্ভুত বাচ্চা দেখেনি! এরপর আবির সাহেব এটা ভেবে ভয় পায় যে, হয়তো ঐ আয়া গুলোর মাধ্যমে এই বিষয়টা সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে! কিন্তু অদ্ভুতভাবে আবির সাহেব যখন সেই আয়াগুলোর খোঁজ নিতে যায় তখন জানতে পারে যে ঐ আয়াগুলো যারা শম্মীকে কয়েকদিন করে দেখাশোনা করেছিলো! তারা এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই যার যার বাড়িতে আত্মহত্যা করে মারা যায়। আবির সাহেব কিছুই বুঝতে পারে না তখন! তাই ভয়ে ঐ শহর ছেড়ে এই নতুন শহরে চলে আসেন এবং এরপর থেকে বাড়িতে আর কোন আয়া বা কাজের লোক রাখেনা আবির সাহেব। তিনি নিজেই শম্মীকে লালন-পালন করে বড় করতে থাকেন। যদিও এরপর থেকে শম্মীর ঐ অদ্ভুত রক্ত চুষে খাওয়ার ব্যাপারটা তিনি আর লক্ষ করেননি।
এরপর শম্মীর যখন বয়স ১ বছর। একদিন শম্মীকে সারা বাড়ি খুঁজে পেলেন না আবির সাহেব! এরপর খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন শম্মী খাটের নিচে লুকিয়ে একটা জীবন্ত টিকটিকিকে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। সেদিন আবির সাহেব শম্মীর এই হিংস্র রুপ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো! এরপর আবির সাহেব প্রায়ই লক্ষ করতেন শম্মী সাধারণ খাবার মোটেও পছন্দ করতো না! সে বিভিন্ন সময় লুকিয়ে লুকিয়ে জীবন্ত টিকটিকি বা ইদুঁরকে ছিড়েছিড়ে খেতো। এরপর যখন শম্মীর ৩ বছর বয়স তখন একদিন আবির সাহেব লক্ষ করলেন যে শম্মীর এক ধরণের অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে! যার মাধ্যমে সে যেকোন প্রাণিকে বশ করে তার কাছে আহ্বান করতে পারে। এরপর বেশ নিষ্ঠুর হয়ে ছুরি দিয়ে সেই প্রাণিগুলোকে মেরে তাদের রক্ত আর মাংস খায় সে। প্রথম কয়দিন বিভিন্ন পাখি, এরপর বেড়াল এইভাবে নানান ছোট প্রাণিদের বশ করে তাদের কাঁচা মাংস খেতো শম্মী! প্রথমে কয়েকবার আবির সাহেবকে লুকিয়ে এসব করলেও এরপর আবির সাহেবের সামনেই এই পৈশাচিক কাজ শুরু করে শম্মী। আবির সাহেব নির্বাক দর্শকের মতো শুধু তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে দেখে সে দৃশ্য ! আবির সাহেব বুঝতে পারে না যে তার কী করা উচিত। শম্মী তার একমাত্র মেয়ে । তাই তাকেতো আর ফেলে দেওয়া যায় না। এইদিকে তার এই সমস্যাটা এতটাই অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক যে এইগুলো আবির সাহেব কাউকে বলতেও পারছে না। শম্মীর এই অদ্ভুত আচরণ যদি সবার মাঝে জানাজানি হয়ে যায় তাহলে হয়তো তাদের বাঁচাটাই মুশকিল হয়ে যাবে শম্মী!! তাই এই অদ্ভুত ঘটনাটা একান্তই গোপন রাখেন আবির সাহেব। পুরো সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখেন তার মেয়ে শম্মীকে । যদিও শম্মী এখনো স্বাভাবিক হয়নি। তার বয়স যতো বাড়ছে ততোই সে আরো হিংস্র আর ভয়ানক হয়ে উঠছে ! এখন শম্মীর বয়স প্রায় ৬ বছর।
.
এখনো শম্মীর স্বভাবের বিন্দুমাত্রও কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সে এখনো টিকটিকি, ইদুঁর , গাছের পাখি, বেড়াল ইত্যাদি ছোটছোট প্রাণিকে হত্যা করে কাঁচাই ছিড়েছিড়ে খায়। সে বর্তমানে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে! তার এখন বর্তমানে মানুষের মাংস খাওয়ার নেশা উঠেছে ! আবির সাহেব জানেন যে, শম্মীর একবার যেটার নেশা উঠে সেটা সে করেই ছাড়ে। বড্ড জেদ তার! তাও মানুষের মাংস নিয়ে মিথ্যা কথা বলে শম্মীর মনযোগ নষ্ট করতে চাইছিলো আবির সাহেব! কিন্তু কোন লাভ হলো না! শম্মী মাংসের আশা করেই রাতে ঘুমিয়ে পড়লো! আবির সাহেব নিজেও জানেন না যে সকালে কী হতে চলেছে?! আবির সাহেব শম্মীকে বুঝতে মাজেমধ্যে শম্মীর সাথে শম্মীর মতোই পৈশাচিক কথা-বার্তা বলতে থাকেন। কিন্তু তাও তিনি শম্মীকে বুঝতে পারেন না। আবির সাহেব ভাবতে থাকেন ৬ বছর বয়সের একটা মেয়ে যদি এতটা হিংস্র আর ভয়ানক হয়, তাহলে সে আরো বড় হলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে!! এটা ভাবতেই ভয়ে তার গাঁ শিহরিয়ে উঠলো!
.
রাত এখন প্রায় ১১ টা বাজে। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আবির সাহেব জানালার পাশে বসে বসে বৃষ্টি দেখছেন। আর কাঁদতে কাঁদতে ভাবছিলেন যে, কী দোষ ছিলো তার?! কেনো ইবা তার ঘরেই এমন একটা অদ্ভূত ধরণের মেয়ের জন্ম হলো? কী পাপের সাজা এটা?! একটা বাচ্চা মেয়ের ভেতর এতটা হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা আসলো কিভাবে? শম্মী কী আর কখনো সুস্হ্য হয়ে উঠবে না? সে কী আর ৮-১০ টা মেয়ের মতো স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করবে না?
শম্মী কেন এই রকম পিশাচিনী হলো? আর তাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কী কোনই উপায় নেই? সৃষ্টিকর্তা কী কাউকে পাঠাবে না তাদের এই রকম অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিতে? কেউ কী তাদের সাহায্য করতে পারে না?
.
জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এইসবই ভাবছিলেন আবির সাহেব। এরপর হঠাৎ কারো জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলেন আবির সাহেব । আবির সাহেব বেশ চমকে উঠলেন! এতরাতে বাড়ির ভেতর কে এসেছে? এরপর দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুললেন। দরজাটা খুলতেই আবির সাহেব দেখলেন একজন ভদ্রলোক পুরো বৃষ্টিতে ভিজে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে! আবির সাহেব কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে লোকটাকে প্রশ্ন করলেন:
-কে আপনি? কী চান এতোরাত্রে?
.
লোকটা কিছুটা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো:
-হ্যালো। আমি মিসির আলী। আমি একজন ডিটেক্টিভ । আমার গাড়িটা হঠাৎ আপনার বাড়ির সামনে এসে নষ্ট হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখছি না! আমি কী আজকের রাতটা আপনার বাড়িতে থাকতে পারি? . . . .

…(২য় পর্ব)…
.
লোকটার কথা শুনে আবির সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। আবির সাহেব একবার ভাবলেন, বাড়িতে এখন সে আর তার মেয়ে শম্মী ছাড়া আর কেউ নেই। তাই এতোরাত্রে একজন অপরিচিত লোককে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়াটা কী ঠিক হবে? এরপর আবার ভাবলেন, বাহিরে আসলেই অনেক বৃষ্টি হচ্ছে! লোকটার পক্ষে এখন তার বাড়িতে যাওয়াটাও সম্ভব না। এছাড়াও লোকটাকে দেখেও বেশ ভদ্রমতো লাগছিলো। আর লোকটা যখন বিপদে পড়ে নিজে থেকেই সাহায্যের জন্য এসেছেন তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না!
.
এরপর আবির সাহেব মিসির আলি সাহেবকে নিজের বাড়ির ভেতর নিয়ে আসলেন। বৃষ্টিতে মিসির আলি সাহেবের পুরো শরীর ভিজে গিয়েছিলো। তাই আবির সাহেব তাকে একটা গামছা আর লুঙ্গী দিলেন। এরপর মিসির আলি সাহেব ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলেন।
.
মিসির আলি সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। বাড়িটা ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। বাড়ির ভেতরে ২টা ইউনিট। বাড়িটা বেশ বড়। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন যে বাড়িতে কোন বড় মেয়ে মানুষ বা কাজের লোক নেই। কারণ বাড়িটা বেশ অগুছালো ছিলো । মেয়ে মানুষ থাকলে আর কিছু করুক আর না করুক। বাড়িটা অন্তত গুছানো থাকতো। এছাড়া কোন কাজের লোক থাকলেও বাড়িটা গুছিয়ে রাখতো।মিসির আলি সাহেব এটা ভেবে বেশ অবাক হলেন যে এতো বড় বাড়িতে শুধু এই লোকটা একা থাকে! অবশ্য হয়তো লোকটার একা থাকার কথা না! লোকটার সাথে হয়তো তার কোন বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে থাকে। কারণ লোকটার চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে লোকটা নিস্বঙ্গতায় ভুগছে না!
.
এরপর আবির সাহেব ২কাপ কফি নিয়ে এসে এক কাপ মিসির আলি সাহেবকে দিলেন এবং অন্য কাপ নিজে পান করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ তারা কেউ কারো সাথে কোন কথা বললো না। দুজনেই দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। মিসির আলি সাহেব, আবির সাহেবের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছিলো লোকটাকে ভালোমতো জানার জন্য। আর আবির সাহেব মিসির আলি সাহেবকে পর্যবেক্ষণ করছিলো লোকটা কী আসলেই সুবিধার কিনা এটা জানতে। আবির সাহেব এবং মিসির আলি দুজনেই নীরবতা প্রেমি। খুব একটা অপ্রয়োজনে কথা বলেন না তারা। তারা দুজনেই স্বাভাবিক ভাবে বসেই নীরবে একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো। যদিও লোকটাকে নিয়ে আবির সাহেব একটু বেশিই আতংকে ছিলেন । অচেনা অপরিচিত একটা লোক তার ঘরের ড্রইং রুমে বসে আছে এতরাতে! এটা ভাবতেই তার বেশ ভয় লাগে!
.
এরপর হঠাৎ নীরবতা কাটিয়ে মিসির আলি সাহেব আবির সাহেবকে প্রশ্ন করলেন:
-আচ্ছা! আপনার স্ত্রী কিভাবে মারা গিয়েছিলো?
.
লোকটার প্রশ্ন শুনেই আবির সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। আবির সাহেব কিছুই বুঝতে পারলো না। তার স্ত্রী মারা গেছে এটা এই অচেনা লোকটা জানলো কিভাবে? এরপর কিছুটা অবাক হয়েই বললেন:
-আপনাকে কে বললো যে আমার স্ত্রী মারা গেছে? আপনি কী আমায় আগে থেকেই চিনেন?
– না। আজই আপনার সাথে প্রথম পরিচয় হলো। অবশ্য এখনো পর্যন্ত আপনার নামটাই জানা হলো না!
-ও সরি! আমার নাম আবির চৌধুরী । কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে যে আমার স্ত্রী মারা গেছে?
-প্রথমতো আপনি ছাড়া যদি ঘরে অন্য কেউ থাকতো তাহলে এতক্ষণে নিশ্চই একবার হলেও আমায় দেখতে আসতো। মেয়েদের কৌতুহলতা একটু বেশিই থাকে। আর বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে বেশ অগুছালো। মানে বাড়িতে হয়তো আপনি ছাড়া আর কোন মেয়ে মানুষই থাকে না। থাকলেও হয়তো বাচ্চা থাকে । আর আপনাকে দেখেও মনে হচ্ছে না অবিবাহিত। তার মানে আগে স্ত্রী ছিলো কিন্তু এখন নেই। অনুমান সে মারা গেছে! আর এছাড়াও আপনার পুরো বাড়িতে একটাও কাজের লোক নেই।
-বাহ! বেশ ভালো অনুমান শক্তিতো আপনার। হ্যাঁ আমার স্ত্রী মারা গেছে! আমাদের যখন প্রথম সন্তান হয় তখনি সে মারা যায়। এরপর থেকে আমি আর আমার মেয়ে এই বাড়িতে থাকি। আমার মেয়ের নাম শম্মী। বয়স ৬ বছর। আচ্ছা আপনার কাজটা কী?
-ডিটেকটিভ! রহস্যের পেছনে ছুটাই আমার কাজ। যেখানেই রহস্য থাকে সেখানেই আমি গিয়ে হাজির হই।
-বেশ মজারতো! কিন্তু এতে আপনার লাভটা কী হয়?
-এক ধরনের নেশা বলতে পারেন।
-হুম ভালোই। আর আমি একজন . . .
-ডাক্তার?
-অদ্ভুততো। আপনি বুঝলেন কী করে?
-আসলে আমরা দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের পেশার পেছনে ব্যায় করি। তাই আমাদের আচার-আচরণে সেই পেশার একটা প্রতিফলন ফুটে উঠে! আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে!
-আচ্ছা আপনি কোন ধরণের রহস্য নিয়ে কাজ করেন?
-যেকোন ধরণের রহস্য। খুন, চুরি । এছাড়া আমি একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টও । তাই ভয়ানক মানসিক রোগি অর্থাৎ সাইকোদের নিয়ে কাজ করাটা বেশি হয়ে থাকে। এছাড়াও যে সকল রহস্যের সমাধান কারো কাছে থাকে না সেই সকল সমস্যা নিয়েও কাজ করি।
-আচ্ছা! আপনি যেহেতু একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট। তাহলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করাই যেতেই পারে। আচ্ছা একটা শিশু জন্মের পর থেকেই অদ্ভুত ব্যবহার করা শুরু করে। তার স্বাভাবিক খাবারে মোটেও রুচি নেই। সে অদ্ভুত রকমের খাবার পছন্দ করে। যেমন, কোন প্রাণির রক্ত, কাঁচা মাংস ইত্যাদি। সে বড় হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীর আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠে! এমন কোন বাচ্চার বা শিশুর কথা কী আপনি কখনো শুনেছেন বা দেখেছেন?
-আচ্ছা, আপনার কী কোন বিষয়ে আমার থেকে সাহায্য চাই?
-ইয়ে মানে না! আমি এমনিতেই বলছিলাম। আমাকে একজন এইরকম একটা ঘটনা বলেছিলোতো তাই! বাদ দিন! আচ্ছা আপনার কফিতো শেষ আপনাকে কী আরেক কাপ কফি দিবো?
-না। তবে বৃষ্টিতে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা পুরো ভিজে একাকার হয়ে গেছে! একটা সিগারেট হবে?
.
.
এরপর মিসির আলি সাহেব সিগারেট টানতে টানতে বাড়েবাড়ে আড়চোখে আবির সাহেবের দিকে তাকাচ্ছিলো। আবির সাহেবও প্রসঙ্গটা পাল্টে এ বিষয়ে আর কোন কথা বলেন না। এমনকি আবির সাহেব ভয়ে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে থাকে। মিসির আলির সাথে আর বেশি কথা বলে না সে। আবির সাহেব, মিসির আলির চোখের দিকেও তাকায়না। আবির সাহেব বুঝতে পারেন যে মিসির আলির একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে মানুষকে পড়ে ফেলার। হয়তো তার চোখের দিকে তাকালেই মিসির আলি সাহেব তার সম্পর্কে সব সত্যিটা জেনে যাবেন।
আবির সাহেব প্রথমে একবার ভেবেছিলেন লোকটা বেশ বুদ্ধিমান এবং যেহেতু রহস্য নিয়ে কাজ করে। তাহলে হয়তো সে তার মেয়ের এই অদ্ভুত আচরণের রহস্য উদঘাঁটন করতে পারবেন! কিন্তু তখনো আবির সাহেব তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি। তাই আবির সাহেব তার মেয়ের অদ্ভুত ব্যবহারের পুরো ঘটনাটা লুকিয়ে যায় মিসির আলী সাহেবের কাছ থেকে।
আবির সাহেব ভাবেন এই বিষয়টা যদি মিসির আলি সাহেবকে তিনি বলেন এবং মিসির আলি সাহেবও অন্যদের বলে দেয় তাহলে তাদের এই বাড়িটাও ছেড়ে চলে যেতে হবে!!
.
এরপর দেখতে দেখতে ভোর হওয়ার আগেই বৃষ্টি থেমে যায় এবং মিসির আলি সাহেব , আবির সাহেবকে একেবারে ভোর বেলাতেই ধন্যবাদ আর বিদায় দিয়ে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর এলাকারই একটা গ্রেজ থেকে গাড়িটা ঠিক করে তার বাড়ির পথে রওনা হয়। শম্মী তখনো ঘুমিয়ে ছিলো। তাই শম্মী মিসির আলি সাহেবের সাথে পরিচিত হতে পারেনি। অবশ্য মিসির আলি সাহেব, আবির সাহেবকে বিদায় দেওয়ার আগে কী মনে করে যেনো নিজের ভিজিটিং কার্ড আর বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিলো আর বলেছিলো, প্রয়োজন হলে অবশ্যই যোগাযোগ করতে পারেন।
.
.
আবির সাহেব সকাল সকাল বেশ কিছুক্ষণ মিসির আলি সাহেবকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। ভাবেন, লোকটা বেশ অদ্ভুত ধরনের এবং বেশ বুদ্ধিমান। আবির সাহেব ভেবেছিলো শম্মীর মতো অদ্ভুত বাচ্চাদের আচরণের কথা যে কাউকে বললেই সে হেসে উড়িয়ে দিবে। কিন্তু মিসির আলি সাহেব হেসে উড়িয়ে দিলো না। উল্টো তাকে বললো কোন সাহায্য চাই কিনা?! তাহলে নিশ্চই ঘটনাটার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে! হয়তো সে আবির সাহেবকে সাহায্যও করতে চায় । আবির সাহেব ভাবেন, এখন কী তার উচিত মিসির আলি সাহেবকে সব সত্য ঘটনা খুলে বলা? হয়তো সেই একমাত্র এই রহস্যের উদঘাটন করতে পারে! সেই হয়তো শম্মীকে এইরোকম অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারে!
.
আবির সাহেব একটা চেয়ারে বসে বসে এইসব কথা ভাবছিলেন। এরপরেই হঠাৎ তার পেছন থেকে শম্মী এসে বললো:
-এখানে বসে বসে কী ভাবছো বাবা?
.
আবির সাহেব প্রথমে কিছুটা আৎকে এরপর অনেকটা স্বাভাবিক হয়েই উত্তর দিলেন:
-কিছু না মা। কেমন ঘুম হয়েছে? ভালো?
-হ্যাঁ বাবা। আমি এখন ছাদে যাবো আর আকাশ দেখবো!!
.
এরপর শম্মী ছুটতে ছুটতে ছাদে চলে গেলো। আবির সাহেব যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! আসলে আবির সাহেব ভেবেছিলো শম্মী মনে হয় ঘুম থেকে উঠেই মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য বায়না ধরবে। কিন্তু শম্মী এরকমটা করেনি! সে পুরো স্বাভাবিক আচরণ করেছে! তাই আবির সাহেব বেশ সস্তি বোধ করলেন। কিন্তু দিনে একবারতো তার এই মাংসের কথা মনে পড়বেই! তখন তিনি কী করবেন? এর উত্তর তার কাছে নেই!!
.
এরপর আবির সাহেব ভাবলেন, আর কোন উপায় নেই! এতো বড় সমস্যা নিয়ে এইভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব না! শম্মী যত বড় হবে তার সমস্যা তত আরো বেশি করে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে!!
.
এই সমস্যাটার কথা কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। যে এই বিষয়টা নিয়ে মজা না উড়িয়ে বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিবেন এবং যে করেই হোক এই রহস্যের সমাপ্তি সে করেই ছাড়বে! এমন আর কেউ নেই! একমাত্র মিসির আলি সাহেবই হয়তো এই কথাটাকে সিরিয়াস ভাবে নিবে এবং সমাধান করার চেষ্টা করবে। আবির সাহেব একরাতে মিসির আলি সাহেবকে বুঝতে না পারলেও ভালোমতো চিনতে পেরেছেন! এবার যেনো হঠাৎ মিসির আলি সাহেবের উপর আবির সাহেবের বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করলো এবং তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আজ বিকালেই মিসির আলি সাহেবের সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে যাবেন এবং তাকে সব ঘটনা খুলে বলবেন !
.
.
দুপুর ১টা বাজে। মিসির আলি সাহেব বিছানায় বসে বসে সিগারেট টানছেন। রতন নামের একটি ছেলে তার ঘর পরিস্কার করছে। রতনের বয়স ১৮ বছর। রতন ৩ মাস ধরে মিসির আলি সাহেবের বাড়িতে কাজ করে। সিগারেটটা শেষ করার পর মিসির আলি সাহেব রতনকে ডেকে বললো:
-আজ বিকেলের দিকে আবির চৌধুরী নামের একটি লোক আমার সাথে দেখা করতে আসবেন। উনি আসলে উনাকে বসার ঘরে বসিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দিবে।
-ঠিক আছে বাবু। (রতন)
.
এরপরে মিসির আলি সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। রোজ দুপুরে ঘুমানো তার অভ্যাস । বিকাল ৪টা বাজতেই আবির সাহেব মিসির আলির দেওয়া ঠিকানা অনুসরণ করে মিসির আলির বাড়িতে এসে হাজির হলেন। আবির সাহেব ভাবলো, সে যেহেতু মিসির আলিকে কিছু না বলেই তার বাড়িতে চলে এসেছে। এটা দেখে নিশ্চই মিসির আলি বেশ চমকে উঠবে। মিসির আলিকে বেশ চমকে দেওয়া যাবে!
.
এরপর আবির সাহেব বাড়ির কলিং বেলটা বাজালেন। কলিং বেল বাজাতেই রতন দ্রুত এসে দরজাটা খুলে দিলো। এরপর তাকে দেখে রতন কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো:
-আপনের নাম আবির চৌধুরী? ভেতরে আইসা বসেন। বাবু ঘুমাইতাছে। বাবু কইছিলো আপনে আইলে ডাইকা দিতে।
.
রতনের কথাটা শুনে আবির সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। মিসির আলি সাহেব আগে থেকেই কী করে জানলো যে তিনি আজকে তার বাড়িতে আসবেন?
.
আবির সাহেব ১৫ মিনিট বসতেই মিসির আলি সাহেব ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে তার সামনে এসে হাজির হলো। এরপর আবির সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবেই মিসির আলি সাহেবকে প্রশ্ন করলেন:
-আচ্ছা, আপনি আগে থেকেই জানতেন যে আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইতে আসবো?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব রতনকে ২ কাপ কফি দিতে বলে, সিগারেটে আগুন ধরাতে ধরাতে বললেন:
-হ্যাঁ। জানতাম আপনি আসবেন।
-কিন্তু কিভাবে? আমিতো আপনাকে আমার কোন সমস্যার কথাই বলিনি! আর এখানে আসার সিদ্ধান্ততো নিলাম আজ সকাল বেলা। আপনি বুঝলেন কিভাবে যে আমি আসবো?
-গতকাল রাতেই বুঝেছি এবং আপনি নিজের অজান্তেই আপনার সমস্যার কথা আমায় বলে দিয়েছেন! এতো বড় একটা বাড়িতে শুধু আপনি আর আপনার মেয়ে একা থাকেন! কোন কাজের লোক, আয়া কিংবা দাড়োয়ানও নেই! এটা দেখেই প্রথমে খটকা লেগেছিলো। তখনি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে হয়তো আপনার বাড়িতে কোন সমস্যা রয়েছে। এরপর নিশ্চিত হলাম যখন আপনি একটা অদ্ভুত শিশু সম্পর্কে আমায় প্রশ্ন করছিলেন তখন! আপনি যখন প্রশ্নটা করছিলেন আপনার কন্ঠের সুর তখন বেশ নরম হয়ে যায়। এমন ভাবে প্রশ্নটা করেছিলেন যে, মনে হচ্ছিলো আপনার কোন আপনজনের এই রকম অদ্ভুত আচরণের সমস্যাটা রয়েছে। আর আপনার আপন বলতেতো শুধু আপনার একমাত্র মেয়েই ! যদিও আপনি প্রসঙ্গটা তখনি পাল্টে ফেলেছিলেন! আপনার বলা কথাগুলোর সুত্র ধরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনার মেয়ের সমস্যাটা কী রকম হতে পারে!!
তাই আমি আপনাকে বলেছিলাম যে আপনার কোন সাহায্য চাই কিনা? যাতে করে আমি পুরো ঘটনাটা জানতে পারি। আর পুরো ঘটনাটা জানা ছাড়া এই রহস্যের কোন সমাধাণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব না। আমি জানতাম যে, সেই শিশুটার কথাটা আমি সিরিয়াসলি নেওয়ার কারণে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন এবং আজ আমাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে আসবেন। আর আপনিও এই রহস্যের সমাপ্তি চান । আর আমিও রহস্যের পাগল। যেখানে রহস্য থাকে সেখানে আমিও থাকি।
-আমি আপনাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলছি! আপনি প্লিজ আমার মেয়েটাকে সুস্হ্য করে দিন! যত টাকা লাগে আমি দিবো! আমার এই রহস্যের সমাধান চাই ই চাই।
-আপনি হয়তো জানেন না! আমি কোন কেসের জন্য টাকা নেই না। রহস্য উদঘাটন করাটা আমার নেশা। পেশা নয়! আপনি আমাকে আপনার মেয়ের পুরো ঘটনাটা খুলে বলুন।
.
এরপর আবির সাহেব শম্মীর জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনা মিসির আলি সাহেবকে খুলে বলেন। শুধু সেই আয়াগুলোর আত্মহত্যা করার ঘটনাটা লুকিয়ে যান। মিসির আলি সাহেব পুরো ঘটনাটা শুনে বলেন:
-রহস্য যেখানে রয়েছে এর সমাধানও সেখানেই রয়েছে! এই রহস্য উদঘাঁটনের জন্য আমাকে আপনার মেয়ের সাথে মিশতে হবে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে হবে। আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জেগেছে সেগুলোর উত্তর একমাত্র আপনার মেয়ের কাছেই আছে! তার জন্য আমাকে তার সাথে কিছুদিন থাকতে হবে!!
-বেশতো! আপনি তাহলে আবার আমার বাড়িতে চলে আসুন। আমার মেয়ের সাথে থেকে যা জানার জেনে নিন। কবে আসছেন তাহলে আবার আমার বাড়িতে?
-আগামীকাল সকালে যাবো। কিন্তু আপনার মেয়েকে আমার ব্যাপারে কিছুই বলবেন না। আমাকে আপনার বন্ধু হিসেবে তার কাছে পরিচয় করিয়ে দিবেন।
-ঠিক আছে! তাহলে কাল আপনার অপেক্ষায় থাকবো মিসির আলি সাহেব।
.
.
এতটুকু কথা বলেই আবির সাহেব মিসির আলিকে বিদায় দিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। মিসির আলি সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে আবির সাহেবের মেয়েটার কথা চিন্তা করতে থাকেন। আর ভাবেন, একটা ৬ বছরের বাচ্চা মেয়ে কী কখনো এতটা হিংস্র হতে পারে?
.
.
এইদিকে আবির সাহেবের বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যাঁ হয়ে যায়। আবির সাহেব ভাবেন শম্মী পুরো বাড়িতে একা রয়েছে। খালি বাড়ি পেয়ে শম্মী যে কী করছে এটা তারও জানা নেই। আবার না জানি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। এরপর আবির সাহেব তার এলাকাতে পৌছাতেই দেখলেন তার বাড়ি থেকে একটু দুরেই অনেকগুলো মানুষ ভীর করে দাঁড়িয়ে আছেন!
এরপর আবির সাহেব সেই ভীরের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে একটা মহিলা বসে বসে কাঁদছে। লোকেরা বলাবলি করছে, মহিলাটির একটা ৯ মাসের বাচ্চা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলাটি নাকি তার পাশেই মেয়েটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে ফোনে কথা বলছিলো এরপর হঠাৎ করে খেয়াল করে তার পাশে তার মেয়েটা নেই। এরপরে পুরো রাস্তা খুঁজেও সেই বাচ্চা মেয়েটাকেকে পাওয়া গেলো না। আবির সাহেব কথাটা শুনে বেশ কষ্ট পেলেন। এরপর তার নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। শম্মীর জন্য তার দুঃশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়!
.
এরপর বাড়ির গেটের সামনে যেতেই আবির সাহেব বেশ চমকে যায়। দেখলেন গেটে তালা দেওয়া নেই। গেটটা খোলা রয়েছে। এরপর ঘরের দিকে যেতেই দেখে ঘরের দরজাটা ভেতর দিক থেকে হালকা করে চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু আবির সাহেবের স্পষ্ট মনে আছে যে , বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ভালো করে সে ঘরের দরজাটা বাহির থেকে আটকে রেখে গিয়েছিলো। যাতে শম্মী বাড়ির বাহিরে যেতে না পাড়ে। তাহলে দরজাটা বাহির থেকে খুললো কে? তাহলে কী সত্যি সত্যিই শম্মীর কোন বিপদ হয়েছে?
.
এরপর আবির সাহেব অনেকটা ভয়ের সাথে দ্রুত দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। এরপর আবির সাহেব যা দেখলেন তা দেখার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। দেখলো একটা ছোট্র বাচ্চা মেয়ের মাথাহীন রক্তাক্ত শরীর মেঝেতে পড়ে রয়েছে। আর শম্মী সেটাকে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। আবির সাহেবকে দেখেই শম্মী একটু মিষ্টি করে হেসে বললো:
-বাবা, তুমি ভুল ছিলে! মানুষের মাংস খেতে তিতা লাগে না। মানুষের মাংস আর রক্ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুঃস্বাদু খাবার। আমি এখন থেকে রোজ মানুষের রক্ত আর মাংসই খাবো। . . . . . . . . . .

…(৩য় পর্ব)…
.
আবির সাহেব শম্মীর এই রকম কথা শুনে আর কিছুই বলতে পারেন না। শুধু চুপচাপ মেঝেতে বসে থাকেন। বাচ্চাটার এই ভয়ংকর চেহারা দেখে আবির সাহেবের মাথা জিমজিম করতে থাকে। বাচ্চা মেয়েটার শরীর থেকে কিছুটা দূরেই তার মগজবিহীন মাথা পরে রয়েছে! আর শম্মী সেই বাচ্চা মেয়েটার শরীর ছিড়েছিড়ে খাচ্ছে। যদিও একটা ৯ মাসের শিশুর শরীরকে একটা ৬ বছর বয়সের বাচ্চা মেয়ের পক্ষে পুরোটা একসাথে কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া সম্ভব না! তাই শম্মী ছুরি দিয়ে কেটে শুধু বাচ্চা মেয়েটার মগজ, হৃদপিন্ড আর কলিজা আলাদা করে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে। আর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অল্প অল্প মাংস খায়! একটা ৬ বছরের বাচ্চা মেয়ের পক্ষে এতটা হিংস্রতা প্রদর্শন পুরোপুরি অসম্ভব! তাকে দেখেই বোঝা যায় যে, তার ভেতরে একটা ২য় স্বত্তার উপস্হিতি রয়েছে। শম্মী যখন বাচ্চা মেয়েটার শরীরের রক্ত পান করছিলো তখন সে অনেকটা জোকের মতো করেই ঠোটটা মেয়েটার চামরার উপর রেখে চুষে চুষে রক্ত খাচ্ছিলো!
.
বাচ্চা মেয়েটাকে পুরোপুরি না খেয়ে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গা গুলো খাওয়ার পরেই শম্মী তার বাবা আবির সাহেবকে বললো:
-বাবা, আমি আর খেতে পারছি না। তুমি একে বাড়ির বাহিরে ফেলে দিয়ে আসো। আমি এখন ঘুমাবো।
.
এতটুকু কথা বলেই শম্মী সেই অর্ধ খাওয়া বাচ্চা মেয়েটার শরীরকে মেঝেতে ফেলে রেখেই ঘুমাতে চলে গেলো। আবির সাহেব সেই বাচ্চা মেয়ের এই রকম মাথা, হৃদপিন্ডহীন শরীর দেখে ভয়ে কাপতে থাকে। এরপর বুঝতে পারে যে, তার আর কোন উপায় নেই ! তাকে এখন থেকে এইরকম অদ্ভুত পরিস্হিতীর সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। কারণ সে জানে যে, শম্মী ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। সে হয়তো এই ধরণের পৈশাচিক কর্মকান্ড আরো করতে থাকবে! সে যত বড় হচ্ছে ততো আরো বেশি ভয়ংকর হযে যাচ্ছে! সে হয়তো এরপরে আরো মানুষ খুন করবে!
.
এরপর মাঝরাতে আবির সাহেব সেই অর্ধ খাওয়া বাচ্চা মেয়েটার শরীরটা বাড়ির পেছনে নিয়ে যান এবং একটা গর্ত করে লাশটা পুতে রাখেন । এতে তার বেশ অপরাধবোধ হয়! কিন্তু তার আর কিছুই করার ছিলো না!
.
এরপরে প্রায় সারারাতই আবির সাহেব শম্মীকে নিয়ে নানান ধরণের দুঃশ্চিন্তা করতে করতে জেগে থাকেন।
.
এরপর সকাল হতেই শম্মী ঘুম থেকে উঠে আবার স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করে। সে ছাদে যায় আকাশ দেখে। নিজে নিজেই গুণ গুণ করে গান গায়। স্বাভাবিক যে সকল খাবার গুলো সে অপছন্দ করতো সেগুলোও খেতে চায়! আবির সাহেব শম্মীর এইরকম ভালো ব্যবহার দেখে খুব খুশি হন। কিন্তু তিনি জানেন যে, শম্মীর এই রকম স্বাভাবিক ব্যবহার ক্ষণিকের জন্যই! শম্মী রোজই কয়েক ঘন্টা এইরকম স্বাভাবিক ব্যবহার করেন। এরপরেই শুরু হয়ে যায় তার পৈশাচিকতা। আগের পৈশাচিকতা গুলো একটু ছোট হলেও এইবারের পৈশাচিকতা বেশ বড়, ভয়ংকর আর হিংস্র। একটা মানুষকে খুন করে তার মাংস খাওয়াতো আর কোন সাধারণ বা স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না!
.
সকাল ৮টা বাজে । আবির সাহেব তার ঘরে বসে বসে মিসির আলি সাহেবের আসার অপেক্ষা করছিলেন! মিসির আলি সাহেব বলেছিলেন যে তিনি আজ সকালেই আসবেন। আবির সাহেবের বর্তমান ধারণা মিসির আলি সাহেব বেশ বুদ্ধিমান ব্যক্তি এবং সেই হয়তো একমাত্র এই জটিল সমস্যার সমাধাণ করতে পারবেন! সেই হয়তো শম্মীকে বুঝতে পারবে এবং শম্মীর এই রকম পৈশাচিকতার পেছনের রহস্যটাও বের করতে পারবেন।
.
সকাল ৯টা বাজে । হঠাৎই আবির সাহেবের বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আবির সাহেব দ্রুত গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। দরজাটা খুলেই দেখলেন মিসির আলি সাহেব একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আবির সাহেব তাকে দেখেই বুঝতে পারলেন যে মিসির আলি সাহেব তার মেয়ে শম্মীর সাথে থাকতে এসেছেন।
এরপর তিনি মিসির আলি সাহেবকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসলেন! শম্মী প্রথমে মিসির আলি সাহেবকে দেখে বেশ অবাক হয়। কারণ শম্মী জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত তার বাবার কোন বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনকে এ বাড়িতে আসতে দেখেনি। কেন আসে না সেটা তার জানা নেই! শম্মী যখন আরো ছোট ছিলো তখন সে ভাবতো এই পুরো পৃথিবীতে মনে হয় সে আর তার বাবা ছাড়া আর কোন মানুষ নেই! এ বাড়িটাই হয়তো পুরো পৃথিবী! এই পৃথিবীতে শুধু টিকটিকি, ইদুর, বেড়াল, পাখি ছাড়া আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই । কিন্তু সে যখন প্রথম ছাদে যাওয়া শিখে তখন সে বুঝতে পারে এ পৃথিবীটা অনেক বড়। এই পৃথিবীতে তারা ছাড়াও আরো অনেক মানুষ ও আরো অনেক প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু তাদের বাড়িতে শুধু কেউ আসেনা।
.
এরপর আবির সাহেব, মিসির আলি সাহেবের কথামতোই মিসির আলি সাহেবকে তার বন্ধু হিসেবে শম্মীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। শম্মী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তার সাথে পরিচিত হয়। এরপর তারা ৩ জনে বেশ কিছুক্ষণ একসাথে বসে থাকে। এরপর হঠাৎ আবির সাহেব মিসির আলি সাহেব আর শম্মীকে বাড়িতে রেখে একটা জরুরী কাজ আছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
.
এখন বাড়িতে শুধু শম্মী আর মিসির আলি সাহেব! মিসির আলি সাহেব শম্মীকে খুব ভালো ভাবেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু তার চোখে শম্মীর অস্বাভাবিক কিছুই ধরা পড়লো না! ৮-১০ টা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই ব্যবহার করছিলো শম্মী। তার আচরণ একটা ৬ বছরের বাচ্চার মতই ছিলো!
.
আবির সাহেবের বলা শম্মীর কোন আচরণের সাথেই মিসির আলি এই শম্মীর আচরণের মিল খুঁজে পায় না। বিষয়টা মিসির আলি সাহেবকে বেশ ভাবায়!
.
কিছুক্ষণ পর শম্মী মিসির আলি সাহেবকে কিছু না বলে একা একাই ছাদে যায়। মিসির আলি সাহেবও শম্মীকে অনুসরণ করে ছাদে যায়! ছাদে গিয়ে দেখেন, শম্মী আকাশ দেখছে! এরপর মিসির আলি সাহেব অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই শম্মীকে প্রশ্ন করলেন:
-আকাশ দেখতে তোমার ভালো লাগে?
-হ্যাঁ। খুব ভালো লাগে। (শম্মী)
-আর কী দেখতে ভালো লাগে?
-গাছপালা, পাখি আর শুধু আকাশ।
-হুম ভালো। আচ্ছা তোমার প্রিয় খাবার কী?
-আমি সব কিছুই পছন্দ করি। বিশেষ করে গরম ভাত আর চিংড়ি ভুনা আমার প্রিয় খাবার। আমার বাবা খুব ভালো চিংড়ি ভুনা করতে পারে!
-আচ্ছা শম্মী। তুমিতো এখন অনেক ছোট। তুমি কী জানো যে আফ্রিকার কিছু কিছু শিশুরা সাধারণ খাবার পছন্দ করে না। তারা মানুষ বা বিভিন্ন প্রাণির তাজা রক্ত, কাঁচা মাংস ইত্যাদি কাচা চিবিয়ে খায়।
-ধুর বোকা! আমি কি আফ্রিকা চিনি নাকি! আমিতো আমার এলাকাটাই চিনি না ভালোমতো। আর তুমিতো কিছুই জানো না। একটা মানুষ কি কখনো আবার অন্য একটা মানুষের রক্ত, কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতে পারে নাকি? এগুলোতো খায় জঙ্গলের হিংস্র প্রাণিরা।
-হাহাহা। তাই নাকি? তুমি এসব জানলে কিভাবে?
-আমার বাবা বলেছিলেন।
-আচ্ছা তুমি আর কী কী জানো?
.
.
এইভাবে আরো বেশ কিছুক্ষণ শম্মীর সাথে কথা বলতে থাকেন মিসির আলি সাহেব। কিন্তু শম্মীর ভেতর অস্বাভাবিক কিছুই লক্ষ করলেন না তিনি। যেমনটা আবির সাহেব তাকে বলেছিলেন! তিনি ভাবলেন তাহলে কী আবির সাহেব পুরো ঘটনাটা মিথ্যা বলেছে? নাকি পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলেনি তাকে! অনেক কিছুই হয়তো এড়িয়ে বলেছেন তাকে!!
.
মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারেন যে, পুরো ঘটনাটা বুঝতে হলে তাকে আগে শম্মীর সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে হবে। তাকে শম্মীকে আরো কাছ থেকে চিন্তে হবে। এরপরেই বোঝা যাবে সমস্যাটা কী শম্মীর নাকি আবির সাহেবের নিজেরই!
.
এরপরে দুপুরের একটু আগে আবির সাহেব বাড়িতে ফিরলেন। বাড়িতে কোন কাজের লোক নেই বিদায় আবির সাহেবকেই রান্না করতে হয়! আবির সাহেব রান্না করে মিসির আলি সাহেব আর শম্মী দুজনকেই খাবার টেবিলে ডাকলেন। এরপর তারা ৩ জন মিলে এক সাথেই দুপুরের খাবার শেষ করলেন। এরপর যে যার ঘরে বিশ্রামের জন্য চলে গেলেন। বাকিটা সময় শম্মী,আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেব আলাদা আলাদা যার যার ঘরে বসেই কাটালেন! আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেব দুজনেই অবশ্য যার যার ঘরে বসে শম্মীকে নিয়েই চিন্তা করছিলো!
.
এরপর দেখতে দেখতে প্রায় বিকাল হয়ে গেলো। মিসির আলি সাহেব দেখলেন আবির সাহেব বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। শম্মী কী করছে? এটা দেখতে তিনি শম্মীর ঘরের দিকে গেলেন। শম্মীর ঘরের দিকে যেতেই মিসির আলি সাহেব দেখলেন শম্মীর ঘরের দরজাটা হালকা করে খোলা রয়েছে। দরজার হালকা ফাকা দিয়েই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, শম্মী ঘরের জানালার পাশে অন্য মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসির আলি সাহেব শম্মীর ঘরে ঢুকতে নিয়েও ঢুকলেন না। তিনি লক্ষ করলেন হঠাৎ শম্মীর মুখের ভঙ্গি বেশ অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে! তাই সে শম্মীকে না ডেকে, দরজার সামনে দাঁড়িয়েই শম্মীর সব কর্মকান্ড দেখতে লাগলো!
.
শম্মী প্রথমে চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো । এরপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত ধরণের শব্দ করতে লাগলো । শব্দটা বেশ মধুর । যে কাউকে পাগল করতে পারার মতো! এরপর জানালা দিয়ে বেশ কিছু পাখি উড়ে শম্মীর হাতের সামনে চলে আসলো। শম্মীর কাছে এসেই পাখিগুলো বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। এটা দেখে মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে অস্বাভাবিক ভাবে হলেও মেয়েটা পাখিদের সম্মোহন করতে পারে! এর কিছুক্ষণ পর শম্মী একটা পাখিকে ধরলো আর বাকি পাখি গুলোকে হাতের ইশারা করতেই উড়ে গেলো। সেই একটা পাখির দিকে শম্মী বেশ কিছুক্ষণ হিংস্র ভাবে তাকিয়ে রইলো । এরপর হঠাৎ করেই পাখিটার মাথা ধরে একটা মুচর দিয়ে পাখিটার শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো। এরপর শম্মী অনেকটা জোকের মতো করেই পাখিটার শরীরের রক্ত খেতে লাগলো। মিসির আলি সাহেব ঘটনাটা দেখে বেশ অবাক হলেন। সকালের সেই শম্মীর সাথে এই শম্মীকে মিসির আলি সাহেব কিছুতেই এক করতে পারলেন না। শম্মীর সকালের আচরণ আর এখনকার আচরণ পুরো ভিন্ন।
.
এরপর মিসির আলি সাহেব হঠাৎ দরজাটা ধাক্কা দিয়ে শম্মীর সামনে এসে হাজির হন। শম্মী তখনো পাখিটাকে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছিলো। মিসির আলি সাহেব ভেবেছিলেন যে হঠাৎ করে তাকে দেখে শম্মী বেশ চমকে যাবে! কারণ সকালে শম্মী তার সাথে মিথ্যা কথা বলেছিলো এবং ছলনা করেছিলো। সকালে শম্মী যে রুপটা দেখিয়েছিলো এটা তার আসল রূপ ছিলো না! এখনকারটা আসল রূপ!
.
কিন্তু মিসির আলি সাহেবকে হঠাৎ করে ঘরে ঢুকতে দেখেও শম্মী বিন্দুমাত্র চমকালোনা! সে মিসির আলি সাহেবকে কিছুই বললো না। বড়জোর একবার শুধু তার দিকে আড়চোখে তাকালো! শম্মী এমন ভাব করলো যে, এটাতো হওয়ারই ছিলো! মিসির আলি সাহেবেরতো এখন একবার তাকে দেখার জন্য আসার কথাই ছিলো। এতে এতটা অবাক হওয়ার কী আছে?!
.
শম্মী মিসির আলি সাহেবের দিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং তার পাখিটা খাওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিলো! এরপর পুরো পাখিটা খাওয়ার শেষে শম্মী একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে মিসির আলি সাহেবকে বললো:
– আপনি আমায় নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না! আমি এখন ঘুমাবো। আপনি এখন যেতে পারেন!
.
এরপর শম্মী বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। বিকাল বেলা ঘুম?! মিসির আলি সাহেব কয়েক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর শম্মীর ঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে চলে যায়! এরপর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিসির আলি সাহেব ভাবতে থাকেন, এই শম্মীর আচরণের সাথে আবির সাহেবের ব্যাখ্যা করা শম্মীর আচরণের বেশ মিল আছে! তার মানে এটাই শম্মীর আসল রূপ?! যদিও সকাল বেলার শম্মী অনেকটা ভিন্ন। একটা ৬ বছর বয়সের বাচ্চা মেয়ে ২ বেলা ২ রকম রূপ নেয় কিভাবে এটা নিয়েই ভাবতে থাকে মিসির আলি। তাহলে কি শম্মীর ভেতর দুটো সত্তার উপস্থিতি রয়েছে?!
.
মিসির আলি সাহেব যেনো এবার শম্মীকে কিছুটা বুঝতে পারছেন। তিনি হয়তো এখন থেকেই রহস্যটা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছেন। মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারছিলো যে, শম্মী এবং তার রহস্যকে ভালোমতো বুঝতে হলে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাকে। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে শিগ্রই । শম্মী সম্পর্কে অনেক কিছুই পরিস্কার হতে হবে।
.
এরপর শম্মীর সকালের আচরণ এবং বিকালের আচরণ নিয়ে অনেক্ষণ নানান কথা ভাবতে থাকেন মিসির আলি সাহেব। শম্মীর এই ধরণের অদ্ভুত আচরণের পেছনে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন তিনি! কিন্তু শম্মীর এই হিংস্র আচরণের পেছনে কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলেন না তিনি। শম্মী অবশ্যই কোন পিশাচিনী নয়! এটা তিনি নিশ্চিত। কারণ এগুলো কেবল মানুষের কল্পনা। শম্মীর এই ধরণের অদ্ভুত আচরণের পেছনে নিশ্চই একটা বড় রহস্য রয়েছে। যেটা নিশ্চই এখন মিসির আলির অনেক কাছে আছে! কিন্তু সেটা সে খুঁজে পাচ্ছে না। মিসির আলি সাহেব ভাবলেন, শম্মীর রহস্য উদঘাটনের আগে তার মা সম্পর্কে সব তথ্য ভালো করে জেনে নিতে হবে। কারণ মায়ের অনেক আচরণই সন্তান পেয়ে থাকে। তাই এখন তার আবির সাহেবের সাথে এ বিষয়ে কিছু কথা বলা উচিত!
.
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায় সন্ধ্যাঁ হয়ে যায়। এরপর আবির সাহেবই ২কাপ কফি নিয়ে মিসির আলি সাহেবের সাথে দেখা করতে তার ঘরে প্রবেশ করেন। এক কাপ কফি মিসির আলি সাহেবকে দিয়েই প্রশ্ন করা শুরু করেন:
– এই যে মিসির সাহেব, আজ সারাদিন আপনার কেমন কাটলো? শম্মীকে কেমন দেখলেন? তার অস্বাভাবিকতা কী আপনি লক্ষ করেছেন?
– হ্যাঁ করেছি। কিন্তু আপনি অনেক কথাই আমাকে পরিস্কার ভাবে বলেননি বা আমার থেকে লুকিয়েছেন! তাই বুঝতে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। (মিসির আলি)
– যেমন?
– যেমন ধরুণ আপনার মেয়ে কিন্তু সব সময় হিংস্র আচরণ করে না। দিনের অর্ধেকটা সে সুস্হ্য থাকে এবং বাকি অর্ধেকটা সে অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে। সে একটা শরীরকে দুটো সত্তায় উপস্থাপন করে!
– হ্যাঁ। আমিও এটা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু আমার সমস্যাটা দিনের বাকি অর্ধেকটা নিয়ে। যখন শম্মী অস্বাভাবিক আচরণ করে! তাই ভেবেছিলাম দিনের এই প্রথম অর্ধেক সময়ে তার স্বাভাবিক আচরণের তথ্যটা আপনার কোন কাজে আসবে না!
– বুঝলাম। আচ্ছা, আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলুন? সে কী সব সময় স্বাভাবিক ছিলো? নাকি মাঝেমধ্যে শম্মীর মতই অদ্ভুত আচরণ করতেন? অর্থাৎ আপনার স্ত্রীর কোন আচরণ কী আপনি আপনার মেয়ে, শম্মীর ভেতর লক্ষ করেন?
– না! আমার স্ত্রী একেবারে সাধারণ একটা মেয়েছিলো। তার মধ্যে আমি কখনো কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ করিনি। আর সে একজন শিক্ষিতা মেয়ে ছিলো। সে এইসব অদ্ভুত বিষয়ে কখনোই বিশ্বাস করতো না। যদিও আমিও করতাম না। তবে এখন করি!
– আপনার মেয়ে শম্মী যখন তার গর্ভে ছিলো তখন কী সে আপনাকে কোন অস্বাভাবিক বা অদ্ভুত কথা বলেছিলো? যেটার হয়তো আপনি তখন গুরুত্ব দেননি! তাই হয়তো এখন মনে করতে পারছেন না? একটু ভালোভাবে মনে করে বলার চেষ্টা করুন?
– না। আসলেই এইরকম অদ্ভুত বিষয়ে সে আমায় কখনোই কিছু বলেনি।
– আচ্ছা আপনার স্ত্রীর মৃত্যুটা কী একেবারেই স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো?
– হ্যাঁ। আপনাকেতো আমি আগেই এ বিষয়ে বলেছিলাম যে, শম্মী হওয়ার সময় অপারেশন থিয়েটারেই সে মারা যায় !
– আচ্ছা অপারেশনটা কে করেছিলো? তার কী কোন ভুল হয়েছিলো ?
– প্রশ্নই উঠেনা! অপারেশনটা করেছিলো আমার এক ভালো বন্ধু। ডাক্তার ওয়াজেদ আলি । সে একজন অনেক বড় পর্যায়ের ডাক্তার এবং প্রাণি বিষয়ক গবেষকও ছিলেন। তিনি ভিন্ন জিনের দুটি প্রাণির মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে অনেকগুলো অদ্ভূত ক্ষমতা সম্পন্ন প্রাণি আবিষ্কারের মাধ্যমে অনেক গুলো জাতিয় পুরস্কারও পান। তার অপারেশন কখনোই ভুল হতে পারে না! এছাড়াও তার সাথে আমাদের এমনিতেই অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমার স্ত্রী তাকে ভাই বলেই ডাকতো। সে আমার স্ত্রীকে এক ধরনের বিশেষ ভ্যাকসিন ও দিতো প্রতি মাসে শম্মী আমার স্ত্রীর গর্ভে আসার পর থেকে। যাতে তার শরীর বা মন কখনো দুর্বল না হয়! তাই তার কোন ভুল হতে পারে না। হয়তো শম্মীই খারাপ ভাবে তার মার শরীরে আটকে ছিলো তাই তার মা মারা গেছে!
– হয়তো মানে? আপনিতো নিজেও একজন ডাক্তার। এরপরে আপনি তার কাছে আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণটা জানতে চাননি?
– দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা জানা হয়নি। শম্মীর জন্মের সময়ই তার মা মারা যাওয়ায় তখন আমি বেশ চিন্তায় মন মরা হয়ে বসে থাকি। তাই এই মারা যাওয়ার কারণ বিষয়ে তার কাছ থেকে তখন কিছুই জানা হয়নি ! আর কাকতালীয় ভাবে সেদিনই ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান!
– হুম। কিন্তু ঐ ভ্যাকসিনের বেপারটা একটু খটকা . . . . .
.
.
.
মিসির আলি সাহেব এতটুকু কথা বলার পরেই হঠাৎ তার ঘরের পেছনের দেয়াল বেয়ে কারো নিচে নামার শব্দ পায় সে। মিসির আলি সাহেব সাথে সাথেই আৎকে উঠে! এরপর আবির সাহেবকে বললেন:
– দেয়াল বেয়ে কারো নিচে নামার শব্দ পেলাম! আপনি কী পেয়েছেন?
– না তো! দেয়াল বেয়ে আবার কে নামবে ? আমার বাড়িতেতো আমি আর আমার মেয়ে ছাড়া আর কেউ থাকে না। আর গেটতো তালা দেওয়া। চাবিও আমার কাছে!
– শম্মী এখন কোথায়?
– আজ বিকাল বেলা থেকেইতো দেখলাম সে ঘুমাচ্ছে। এখানে আসার আগেও দেখে আসলাম সে ঘুমাচ্ছে!
.
.
মিসির আলি সাহেব হয়তো ভয়ংকর কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলো ! তাই সে দ্রুত ছুটে শম্মীর ঘরের দিকে গেলেন। আবির সাহেবও তার পিছু পিছু ছুটে শম্মীর ঘরে গেলেন। শম্মীর ঘরে গিয়ে তারা দুঁজনেই পুরো অবাক হয়ে গেলেন। আবির সাহেবতো বেশ আৎকেই উঠলেন। কারণ পুরো ঘরের কোথাও শম্মী নেই! এরপর পুরো বাড়ি খুজেও আবির সাহেব আর মিসির আলি সাহেব কোথাও শম্মীকে পেলো না! এরপর তারা ছাদে গেলো। কিন্তু দেখলো ছাদেও শম্মী নেই ! এইদিকে বাড়ির গেটও তালা দেওয়া। তাহলে শম্মী মুহুর্তের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেলো? আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেব দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন!……

….(৪র্থ পর্ব)….
.
পুরো বাড়িতে শম্মী নেই? তাহলে শম্মী এতো রাতে গেলো টা কোথায়? মিসির আলি সাহেব ইবা দেয়াল বেয়ে কার নীচে নামার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন? একটা ৬ বছরের বাচ্চা মেয়ে কী করে দেয়াল বেয়ে নামতে পারে? যদিও এটা শম্মীর জন্য অসম্ভব কিছু না। কারণ শম্মী আর ৮-১০ টা মেয়ের মতো স্বাভাবিক না! সে এটা করতেই পারে!মেয়েটার হিংস্রতার কাছে যেকোন কিছুই হার মানবে। এরপর মিসির আলি সাহেব আবির সাহেবের দিকে কিছটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন:
– আপনি আবার আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছেন?
– ইয়ে মানে! হ্যাঁ । কথাটা আসলে আমি আপনাকে বলতে চাইনি। গতকাল আপনার বাড়িতে যাওয়ার আগে আমি ভালো করেই আমার বাড়ির গেটটা আটকে রেখে গিয়েছিলাম। আমি সবসময়ই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে এইভাবে শম্মীকে ঘরে রেখে বাহির থেকে গেট আটকে যাই। যাতে করে শম্মী একা একা বাড়ি থেকে বের হতে না পারে। কিন্তু গতকাল আপনার বাড়িতে গিয়ে আপনার সাথে দেখা করে যখন আমি আবার আমার বাড়িতে ফিরে আসলাম তখন এর ব্যতিক্রম কিছু দেখলাম! আমার ঘরের সামনে গিয়ে যেই তালাটা খুলতে যাবো, হঠাৎ দেখলাম দরজায় কোন তালা নেই! আর গেটটা হালকা করে ভেতর থেকে খোলা! এরপর বেশ অবাক হয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম ,শম্মী ঘরের ভেতরে একটা বাচ্চা মেয়েকে ছিড়েছিড়ে খাচ্ছে। আসলে এই কথাটাও আপনাকে বলা হয়নি যে, শম্মী বেশ কিছুদিন ধরে মানুষের মাংস আর রক্ত খাওয়ার জেদ করছিলো। তাই এখন তার হিংস্রতার পর্যায় অনেক বেড়ে গেছে!! সে এখন মানুষ শিকার করতে চায়!
.
.
এতটুকু কথা শোনার পরেই মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে শম্মী এবার কী করতে চলেছে! একটু আগে তাহলে শম্মীই দেয়াল বেয়ে নীচে নেমেছিলো!
.
এরপর আবির সাহেব আর মিসির আলি সাহেব দুজনেই দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলেন!! এরপর দুজনে মিলে এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা পুরোটাই শম্মীকে খুঁজে বেড়ালেন। কিন্তু পুরো এলাকাটা ঘুরেও কোথাও তারা শম্মীকে খুজে পেলো না। আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেব দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এরপর মিসির আলি সাহেব লক্ষ করলেন যে, রাস্তার একপাশে একটা বৃদ্ধ লোক বসে বসে কান্না করছেন। মিসির আলি সাহেব এবং আবির সাহেব দুজনেই দ্রুত লোকটার কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে লোকটা বলেন যে, সে নাকি তার ৭ মাস বয়সের নাতিকে নিয়ে সন্ধ্যার পর একটু রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন । এরপর হঠাৎ অনেকটা বানর আকৃতির একটা বাচ্চা মেয়ে তাকে আক্রমন করে তার নাতিটাকে তার কাছ থেকে কেরে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যায়! কিন্তু কেউ তার এই অদ্ভুত কথাটা বিশ্বাস করছে না এবং তার নাতিকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! তাই সে বসে বসে কাঁদছে!
.
বৃদ্ধ লোকটার এই কথা শুনে আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেবের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না। তারা যেনো খুব সহজেই বুঝতে পারলেন যে, এই বৃদ্ধ লোকটার নাতি আর শম্মী এখন কোথায় রয়েছে! এতক্ষনে শম্মী হয়তো তার শিকার নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে গেছে! এরপর আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেবকে দুজনেই দ্রুত আবার বাড়িতে ফিরে গেলেন!
.
তারা বাড়িতে পৌছেই দেখলো যে ,বাড়ির গেটটা হালকা করে ভেতর থেকে খোলা রয়েছে। যদিও বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আবির সাহেব ভালো করেই বাড়ির আটকে গিয়েছিলো। এ বার যেনো তাদের ভয় আরো বেড়ে গেলো! তাদের সন্দেহ যেনো এবার বাস্তবে রূপ নেওয়া শুরু করলো! মিসির আলি সাহেব এবং আবির সাহেবের যেনো আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না! এরপর তারা দ্রুত ঘরে ঢুকলো । এরপর তারা যা ভেবেছিলো তাই হলো!
.
দেখলো, একটা ছোট শিশুর মাথাহীন শরীর মেঝেতে পড়ে রয়েছে! আর শম্মী তার শরীরটা ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। আবির সাহেব এবং মিসির আলি সাহেব উভয়েই অবাক দৃষ্টিতে শম্মীর দিকে তাকিয়ে রইলো। শম্মী এবারো বাচ্চাটার শুধু রক্ত,মগজ আর হৃদপিন্ড খেলো। এরপর বাকি শরীরটা মেঝেতে ফেলে রেখেই শম্মী বললো:
– আমি আর খাবো না। তোমরা একে বাহিরে ফেলে দিয়ে আসো! আমি এখন ঘুমাবো।
.
এতটুকু কথা বলেই শম্মী তার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো! মিসির আলি সাহেব এতক্ষণ ধরে নির্বাক হয়ে শুধু শম্মীর হিংস্রতা আর পৈশাচিকতা দেখছিলো! আবির সাহেব যেনো ঘটনাটাতে অব্যস্থ! এরপর গতদিনের মতো আজো আবির সাহেব বাড়ির পেছনে একটা গর্ত করে বাচ্চা শিশুটার লাশটা পুতে রাখলো। মিসির আলি সাহেব নিজের চোখেই দৃশ্যটা দেখলেন! কিন্তু তার কিছুই বলার ছিলো না!
.
এরপর আবির সাহেব আর মিসির আলি সাহেব যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। যদিও তারা সারা রাতই জেগে কাটালেন। আবির সাহেব মোটামোটি এই ঘটনাতে অভ্যস্ত হলেও মিসির আলি সাহেব ঘটনাটা মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বসে বসে ভাবছিলেন, শম্মীর বর্তমান আচরণ অনেকটা বনের হিংস্র প্রাণিদের মতো। তার এই আচরণের পেছনেতো একটা ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে! ব্যাখ্যাটাতে অবশ্য রহস্য দিয়ে ভরা। কিন্তু যে করেই হোক দ্রুত এই রহস্যটার সমাধান করতে হবে!
.
নির্ঘুম একটা রাত কাটায় মিসির আলি সাহেব! এরপর সকাল হতেই তিনি একবার শম্মীর ঘরে যায়! শম্মীর ঘরে যেয়ে দেখে শম্মী ঘরে নেই! এরপর হাঁটতে হাঁটতে ছাদে যায় মিসির আলি সাহেব । তিনি জানতেন শম্মী হয়তো সকালে ছাদেই থাকবে! এরপর মিসির আলি সাহেব ছাদে গিয়ে দেখেন, শম্মী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। শম্মীর এখনকার আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক! গতদিনের সকালের আচরণের মতোই! এরপর মিসির আলি সাহেব শম্মীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন:
– আচ্ছা শম্মী? গতকাল রাতে তুমি কী করেছিলে এটা কী তোমার মনে আছে?
– রাতে আবার কী করবো? সবাই যা করে তাই করেছি! ঘুমিয়েছি!
– আচ্ছা কালকে বিকেলের পর থেকে তুমি কী কী করেছিলে এটা কী তোমার মনে আছে?!
– ধুর বোকা! আমি কিছু করবো কী করে? আমি কী তখন জেগে থাকি নাকি? আমিতো দুপুর পর্যন্ত জেগে থাকি। এরপর চোখ দুটো লেগে আসে আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুম ভাঙে সকালে। আর আমি সকালে আকাশ দেখি!
.
.
এবার যেনো মিসির আলি সাহেব শম্মীকে পুরোপুরি বুঝতে পারলেন। তার জটিল সমস্যাটার অনেকটাই ধারণা করতে পারলেন। শম্মীর শরীরটা দিনের অর্ধেকটা সময় তার নিজের আয়ত্তে থাকে। বাকি অর্ধেকটা সময় হিংস্র প্রাণির দখলে থাকে! তবে শম্মীর এইরকম অদ্ভুত হিংস্র আচরণের পেছনে যে রহস্যটা রয়েছে তার কিছুটা মিসির আলি সাহেব আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে তাকে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হবে!
.
শম্মীর এই সমস্যাটার রহস্য শুধু জানলেই চলবে না। এর সমাধানও বের করতে হবে! নাহলে শম্মী ধীরে ধীরে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে এবং আরো প্রাণ যাবে অনেকগুলো নিষ্পাপ শিশুর। শম্মীকে এই কাজে বাঁধা দিতে গেলেও উল্টো কিছু ঘটতে পারে! বিপদটা আবির সাহেবেরও হতে পারে!
.
তাই যত দ্রুত সম্ভব শম্মীর এই রকম সমস্যার পেছনের সঠিক রহস্যটা বের করতেই হবে। এর জন্য অবশ্য মিসির আলি সাহেবকে আগে এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে! বাড়ির রহস্যটুকু তার মোটামুটি জানা হয়ে গেছে ! এখন বাড়ির বাহিরের রহস্যটা জানা বাকি!
.
এরপর সকাল সকালই মিসির আলি সাহেব আবির সাহেবকে একটা জরুরী কাজ আছে বলে তার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। মিসির আলি সাহেব নিজের বাড়িতে গিয়েই এই ধরণের অদ্ভুত শিশু সম্পর্কে কোন বই আছে কিনা তা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু এই রকম শিশুকে নিয়ে কোন বইই পাননি তিনি!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব ভাবলেন, শম্মীর জন্মের সময় যে ডাক্তার তার মায়ের অপারেশন করে ছিলো তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে হবে নিশ্চই সে আবির সাহেব এবং তার স্ত্রীর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের সাথে একটা ভয়ংকর গবেষণার পরীক্ষা চলিয়েছিলো! যার ফল আজ এই ভয়ংকর হিংস্র মেয়ে শম্মী! সেই ডাক্তারই তার গবেষণার বস্তু বানায় শম্মী এবং তার মা কে। তাই সে ভেকসিনের নাম করে তার গবেষণায় উৎপন্ন কোন মেডিসিন শম্মীর মায়ের শরীরে প্রয়োগ করে।
.
কিন্তু তার গবেষণার বিষয়টা কী ছিলো? সে কী কোন হিংস্র মানুষ তৈরি করতে চাইছিলো! কিন্তু কেন? এইসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিলো মিসির আলি সাহেবের মাথায়। এইসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে মিসির আলি সাহেবকে ৬ বছর আগে ফিরে যেতে হবে যখন শম্মীর জন্ম হয়। এবং তখন ডাক্তার ওয়াজেদ আলি কী নিয়ে গবেষণা করছিলো এটাও জানতে হবে!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব প্রায় ৬ বছর আগের শম্মীর জন্মের পরেরদিনের পত্রিকাগুলো অনেক কষ্টে একজনকে দিয়ে খুঁজিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আবির সাহেবের কথাই ঠিক ছিলো। শম্মীর যেদিন জন্ম হয় সেদিনই একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এবং খবরটা পরের দিন প্রকাশিত হয় খবরের কাগজে! খবরের কাগজ গুলো পড়ে ডাক্তার ওয়াজেদ আলি অনেক কিছু সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা পায় মিসির আলি সাহেব। খবরের কাগজে ওয়াজেদ আলির বাড়ি কোথায়, তিনি গবেষণা কোথায় করতেন, তিনি কী কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সফল হয়েছেন, কী কী বিষয়ের উপর পুরষ্কার পেয়েছেন, তার বিশ্বস্ত সহযোগি কারা ছিলো, তার প্রিয় বন্ধু কারা ছিলো এসব কিছু সম্পর্কেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া ছিলো! যদিও মৃত্যুর আগের সময়টাতে ওয়াজেদ আলি কী নিয়ে গবেষণা করছিলেন এই বিষয়ে পত্রিকাতে কিছুই প্রকাশ পায়নি!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব খবরের কাগজ থেকে ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বিশ্বস্ত সহযোগিদের নাম দেখে তাদের ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার বের করে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। যদিও অনেক জনকেই পায় না সে! শুধু অল্প কয়েক জনের সাথেই কথা বলার সুযোগ পান তিনি। তারা মিসির আলি সাহেবকে জানান, ডাক্তার ওয়াজেদ আলির শেষ গবেষণাটা ছিলো অনেকটা গোপন গবেষণা! সে স্বভাবতই যেকোন গবেষণা একা করতেন না। তার সহযোগিদের সাথে নিয়ে তিনি তার জীবনের প্রায় সবগুলো গবেষণাই করেন!
কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগে যে গবেষণাটা করছিলেন সে গবেষণায় তিনি তার সাথে আর কাউকেই নেয়নি! তিনি একা একাই তার শেষ গবেষণাটা পরিচালনা করেন। তিনি তার নিয়মিত গবেষণা যে গবেষণাগারে করতেন এই গবেষণাটা সেখানেও করেন না। গবেষণাটি করেন ব্যাক্তিগত ভাবে তার নিজস্ব বাড়িতে। তাই তার কোন সহযোগিই জানেন না যে , মৃত্যুর পুর্বে ডাক্তার ওয়েজেদ আলি কী নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন।
.
কিন্তু মিসির আলি সাহেব ভালোমতই বুঝতে পারেন যে ডাক্তার ওয়াজেদ আলি তখন কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি বিভিন্ন হিংস্র প্রাণির জিনকে একটা গর্ভবতী মহিলার শরীরে প্রবেশ করাতে চাইছিলেন। তিনি চাইছিলেন সেই জিনটা রক্তের মাধ্যমে সেই গর্ভের শিশুটির শরীরে প্রবেশ করুক এবং এরপর অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পন্ন একটা শিশুর জন্ম দিক। যে শিশুটা দেখতে মানুষের মতোই হবে কিন্তু তার ভেতর জঙ্গলের যে কোন হিংস্র প্রাণির বৈশিষ্ট থাকবে! সে যেমন হিংস্রতা প্রদর্শন করতে পারবে ঠিক তেমন ভাবে সেই সকল প্রাণিদের রুপও ধারণ করতে পারবে। যদিও তিনি গবেষণাটা পুরোপুরি শেষ করার আগেই মারা যান। মৃত্যুটা হয়তো কাকটালীয়! সে এই আবির সাহেবের বাচ্চা মেয়ের মাধ্যমেই তার এই অদ্ভুত গবেষণার প্রথম পরীক্ষাটি করেন ! তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো এইরকম আরো অনেক হিংস্র মানুষের সৃষ্টি করতে পারতেন।
.
মিসির আলি সাহেব ভাবতে থাকেন, যেহেতু ডাক্তার ওয়াজেদ আলি একজন গবেষক। তাই হয়তো সে মৃত্যুর আগেই কোথাও না কোথাও তার এই অদ্ভুত গবেষণার নথিপত্র তৈরি করে রেখে গিয়েছেন। তিনি কোথাও না কোথাও এই রহস্যের থিওরিতো অবশ্যই লিখে রেখে গিয়েছেন! হয়তো তিনি এই গবেষণাটা যেই জায়গাতে করেছিলেন অর্থাৎ তার বাড়িতে গেলে এই গবেষণার বেশ কিছু সুত্র অবশ্যই পাওয়া যাওয়ার কথা। হয়তো ঐখানে গেলেই এই গবেষণায় সৃষ্ট শিশুর জটিলতা সম্পর্কে বিস্তারিত অনেক কিছু জানা যাবে ,হয়তো এর সমাধানও সেখানে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই ৬ বছরে কী বাড়িটা তার আগের অবস্হাতেই আছে? নাকি সেই সব কিছুই বদলে ফেলা হয়েছে? এটাই একটা বড় প্রশ্ন!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বাড়ি সম্পর্কে নানান তথ্য জোগাড় করেন। তিনি জানতে পারলেন যে ডাক্তার ওয়াজেদ আলির এই পৃথিবীতে আপন কেউ ছিলো না। তাই তার মৃত্যুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ঐ বাড়িটা পরিত্যাক্ত অবস্হাতেই পড়ে রয়েছে। ঐ বাড়িতে অবশ্য যে কারোই প্রবেশ নিষেধ। আর কেইবা ঐ বাড়িতে প্রবেশ করবে? তার বাড়িতে মূল্যবান জিনিস বলতে কিছুই তো আর পড়ে নেই! তার মৃত্যুর পরেই নানান চোর তার ঘরের মূল্যবান জিনিস পরিস্কার করার দায়িত্ব নেন।
.
এছাড়াও মিসির আলি সাহেব ছাড়া আর কেউই ডাক্তার ওয়াজেদ আলির এই অদ্ভুত গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানে না! তাই কারো ঐ বাড়ি সম্পর্কে আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক!
.
এরপরেই মিসির আলি সাহেব ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বাসার দিকে রওনা হলেন। ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বাসাটা আসলেই বেশ নির্জন একটা জায়গায়। তার বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে মিসির আলি সাহেবের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। তাই বাড়ির আশেপাশে তিনি কাউকেই দেখতে পেলেন না! এরপর বাড়ির সামনে যেতেই তিনি দেখলেন বাড়ির বড় গেটে তালা দেওয়া। মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে তালা ভেঙে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করাটা ঠিক হবে না! তাই তিনি দেয়াল টপকে পাইপ বেয়ে জানালা দিয়ে ওয়াজেদ আলির বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন। মিসির আলি সাহেব আগে থেকেই জানতেন যে বাড়িতে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ থাকবে না! তাই তিনি আগে থেকেই সাথে করে একটা টর্চ লাইট নিয়ে এসেছিলেন। এরপর সেই লাইটের আলোতে তিনি পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। বাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কেউ এই বাড়িতে প্রবেশ করেনি। এতদিন ধরে বাড়িটা বন্ধ থাকায় পুরো বাড়িটা মাকরসার জাল আর ধুলাবালিতে ভরে গেছে! ঘরের জিনিস-পত্র ও সব এলোমেলো ভাবে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে! মিসির আলি সাহেব ভাবলেন, ডাক্তার ওয়াজেদ আলি যদি তার গবেষণা সম্পর্কে কোন নথিপত্রও রেখে যান এখানে সেগুলোও হয়তো এতদিনে ইদুরে কেটে শেষ করে ফেলেছে! এরপর তিনি হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বাড়ির লাইব্রেরিতে গিয়ে পৌঁছালেন!! লাইব্রেরিতে এসে তিনি বেশ চমকে গেলেন। লাইব্রেরিটা বেশ বড়! লাইব্রেরিতে মোট ৪টা বুক সেলফ রয়েছে! বুক সেলফ গুলোর উপর দিয়ে ধুলা-বালি আর মাকরসার জালে ভরা থাকলেও এর ভেতরের বইগুলোতে এর একটু আচও পড়েনি। আসলে বুক সেলফগুলো শক্ত ষ্টিল এবং কাঁচের তৈরী। যার ফলে কোন মানুষ ছাড়া এই বুক সেলফের ভেতর অন্য কোন প্রাণি ঢুকে বইগুলো নষ্ট করতে পারবে না। মিসির আলি সাহেব বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলেন যে, একটা বইও নষ্ট হয়নি! ৩টা বুক সেলফ ভরাই অনেক রকমের বই। অবশ্য ৪র্থ বুক সেলফটা একটু ব্যাতিক্রম! এই বুক সেলফে কোন বইই নেই! তবে অনেকগুলো হাতের লেখা ডায়েরি রয়েছে। এরপর বুক সেলফটা খুলে কয়েকটা ডায়েরি বের করে পর্যবেক্ষণ করেই মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে এই ডায়েরি গুলো কিসের! মিসির আলি সাহেব যেটা খোঁজার জন্য এই বাড়িতে এসেছেন সেগুলো এখন তার সামনে। প্রত্যেকটা ডায়েরিতেই ডাক্তার ওয়াজেদ আলির নানান গবেষণা সম্পর্কে নানান তথ্য নিজের হাতে লিখে ওয়াজেদ আলি এখানেই ক্রমিক নাম্বার দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। তার বিভিন্ন সময়ের সব গবেষণা সম্পর্কিত ডায়েরিই এখানে রয়েছে! এরপর মিসির আলি সাহেব ডাক্তার ওয়াজেদ আলির শেষ গবেষণাটা নিয়ে যে ডায়েরিটা রয়েছে সেটা খুঁজতে লাগলেন। এরপরেই তিনি একটা ডায়েরি পেলেন। ডায়েরির উপর লেখাছিলো, “গবেষণা নাম্বার ৩৯, মানুষের জিনে হিংস্র প্রাণির জিনের প্রবেশ।” মিসির আলি সাহেব ডায়েরিটা দেখেই বুঝতে পারলেন যে, এটাই সেই ডায়েরি যেই ডায়েরিতে শম্মীর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। এই ডায়েরিটা পড়লেই হয়তো জানা যাবে যে, শম্মীর এই আচরণের প্রধান কারণটা কী? সে দিনের অর্ধেকটা সময় স্বাভাবিক এবং বাকি অর্ধেকটা সময় অস্বাভাবিক আচরণ করে কেনো? তার এই হিংস্রতা আর কতটা বৃদ্ধী পেতে পারে বা তার এই হিংস্রতার আয়ু আর কয় বছর?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব ভাবলেন, এত বড় ডায়েরিটা এই বাড়িতে এই লাইটের আলোতে পড়াটা বেশ মুশকিল হবে! তার চেয়ে ভালো ডায়েরিটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েই ভালোমতো পড়া যাবে! তখন এই গবেষণার রহস্যটাও ঠান্ডা মাথায় চিন্তাও করা যাবে।
.
এরপর মিসির আলি সাহেব যেই লাইব্রেরি থেকে বেড় হতে যাবেন, ঠিক সেই সময়েই জানালা দিয়ে অন্য কারো এই বাড়িতে ঢুকার শব্দ শুনতে পেলেন! মিসির আলি সাহেব পুরো আৎকে উঠলেন! তিনি ভাবলেন, এই বাড়িতেতো কারো আসার কথা না! তাহলে এতোরাতে জানালা দিয়ে কে বাড়িতে ঢুকলো? . . . . . . . . . . . .

. . . . . (৫ম পর্ব ). . . . .
.
মিসির আলি সাহেব এই রকম কোনো পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মিসির আলি সাহেব হঠাৎ করেই বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এরপর মিসির আলি সাহেব লাইব্রেরির পরিবেশ টাকে স্বাভাবিক বোঝাতে দ্রুত বাকি ডায়েরিগুলো গুছিয়ে সেই বুক সেলফে রেখে দিলো। নিজের কাছে শুধু রেখে দিলো ডাক্তার ওয়াজেদ আলির হাতে লেখা সেই ৩৯ নং গবেষণা নিয়ে লেখা ডায়েরিটা! এরপর মিসির আলি সাহেব টর্চের আলোটা নিভিয়ে দ্রুত লাইব্রেরির একটি ডেস্কের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন! এরপর শুধু অপেক্ষা করতে লাগলেন এটা দেখতে যে এতরাতে এই বাড়িতে কে ঢুকলো এবং কেনো ঢুকলো?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন, যে মানুষটা মাত্র জানালা দিয়ে এই বাড়িতে ঢুকলো সে টর্চ জালিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এই লাইব্রেরির দিকেই এগিয়ে আসছে! মিসির আলি সাহেবের হৃদকম্পন যেনো ধীরে ধীরে আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। মিসির আলি সাহেব কল্পনাও করতে পারছিলেন না যে এই সময়ে এই বাড়িতে কে ঢুকতে পারেন? তার কৌতূহলতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে!
.
মিসির আলি সাহেব কিছুটা ভয় আর অনেকটা কৌতুহলার সাথেই অপেক্ষা করছিলেন এটা দেখার জন্য যে, কে হঠাৎ এতো রাত্রে এই বাড়িতে প্রবেশ করলো? সে কী চায়? সেও কী তার মতো ডাক্তার ওয়াজেদ আলির মৃত্যুর আগের গবেষণাটা সম্পর্কে জানতে চায়?! কিন্তু সে জানবে কী করে এই গবেষণাটা সম্পর্কে? কারণ শম্মীর এইরকম আচরণের কথাতো একমাত্র মিসির আলি সাহেব আর আবির সাহেবই জানেন! এছাড়া ডাক্তার ওয়াজেদ আলির গবেষণাওতো খুব গোপন একটা গবেষণা ছিলো!
.
এরপর টর্চ লাইটের আলোটা ধীরে ধীরে লাইব্রেরির ভেতরে এসে পড়লো। মিসির আলি সাহেব নিজেকে ডেস্কের আরেকটু ভেতরে নিয়ে গেলেন। ডেস্কের ফাকা জায়গা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন লাইব্রেরিতে কে প্রবেশ করলো?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব দেখতে পেলেন একটা ২২-২৫ বছর বয়সের মেয়ে লাইব্রেরির ভেতর টর্চ হাতে প্রবেশ করেছে! মেয়েটাকে দেখে মিসির আলি সাহেব বেশ অবাক হলেন! ভাবলেন, এই মেয়েটা আবার কে?! এরপর মেয়েটার হাতের টর্চ লাইটের আলোতেই মিসির আলি সাহেব স্পষ্ট ভাবে মেয়েটার চেহারা দেখতে পেলেন! মেয়েটা মাঝারি উচ্চতার, গায়ের রং শ্যামলা, চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা, চেহারার মধ্যে একটা গম্ভীরতার ভাব রয়েছে। মেয়েটার চেহারা দেখেই যেনো বোঝা যায় যে মেয়েটা কোন একটা রহস্যের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে ছুটছে!
.
এরপর মেয়েটা লাইব্রেরিতে ঢুকে মিসির আলি সাহেবের মতই বুক সেলফগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। প্রথম ৩টা বুক সেলফ স্বাভাবিক ভাবেই দেখার পর ৪র্থ বুক সেলফটার ডায়েরি গুলো বেশ ভালো করেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো মেয়েটা। মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমান! মেয়েটা একটা একটা করে ডায়েরি দেখছিলো আর রাগে সেগুলো ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলছিলো। মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটাও হয়তো একটা নির্দিষ্ট কিছুই খুজঁছে! হয়তো সেই হিংস্র মানুষের গবেষণা নিয়ে লেখা ডায়েরিটা! কিন্তু কেনো? এই গবেষণার সাথে মেয়েটার কী সম্পর্ক? মিসির আলি সাহেব কিছুই বুঝতে পারছিলেন না!
.
এরপর মেয়েটা একটা একটা করে সবগুলো ডায়েরিই মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো। কিছু একটা খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভে মেয়েটা সেই বুক সেলফটার কাঁচে হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে। নিজের হাতের টর্চ লাইট টা ছুড়ে মারে দেয়ালে। সাথে সাথে পুরো লাইব্রেরিতে অন্ধকার নেমে আসে! এরপর মেয়েটা মেঝেতে বসে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে! যেনো কিছু একটা না পাওয়ার কষ্ট!
.
মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারেন যে, এই মেয়েটা কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করেনি। সেও হয়তো তার মত একজন রহস্য পিপাসু। হয়তো তার মতোই ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এর গবেষণার পেছনের রহস্যটা খুঁজতে মেয়েটা এই বাড়িতে এসেছে! কিন্তু মেয়েটার এই রহস্য জানার পেছনের কারণটাও একটা রহস্য। কে এই মেয়ে? এই রহস্যটা জানতে হলে অবশ্যই মিসির আলি সাহেবকে আগে মেয়েটার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলতে হবে!
কিন্তু মেয়েটা কী তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করবে? মেয়েটা কি তার এখানে আসার পুরো কারণটা তাকে খুলে বলবে? মিসির আলি সাহেব কথাগুলো ভাবতে থাকেন!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব তার মনের ভয়টা কিছুটা কাটিয়ে অনেকটা কৌতূহলতা নিয়ে হঠাৎ করেই তার হাতের টর্চের আলোটা জ্বালিয়ে সেই ৩৯ নাম্বার গবেষণার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটা কল্পনাও করতে পারেনি যে, সে ছাড়া আর কোন লোক এই বাড়িতে থাকতে পারে! তাই হঠাৎ করে মিসির আলি সাহেবকে দেখে সে পুরো আৎকে উঠলো! মেয়েটার চোখে-মুখে পুরোই ভয়ের ছাপ দেখতে পেলেন মিসির আলি সাহেব! এরপর মেয়েটা ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মিসির আলি সাহেবকে প্রশ্ন করলো:
– কে আপনি? এই বাড়িতে কী করছেন? আপনি কী ডাক্তার ওয়াজেদ আলির পুরোনো কোন সহযোগি?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব একটু মুচকি হেসে মেয়েটাকে উত্তর দিলেন:
– না। আমি তেমন ভাবে ডাক্তারকে চিনি না । কিন্তু আপনি কে? আর এতরাত্রে আপনি ইবা এই বাড়িতে কী করছেন?
– সেটা আমি আপনাকে বলতে যাবো কেন? আপনি আগে বলুন আপনি কেনো এই বাড়িতে এসেছেন? এই বাড়িটাতো ৬ বছর ধরে পরিত্যাক্ত অবস্হায় পড়ে রয়েছে! আপনি কী কোন কিছু চুরি করতে এখানে এসেছেন? (সেই মেয়েটা)
– না। আপনি যেটার জন্য এসেছেন! আমিও ঠিক সেটার জন্যই এসেছি! অবশ্য আমি আপনার আগেই এসেছি!
– মানে কী? আপনিও কী ডাক্তার ওয়াজেদ আলির মৃত্যুর পুর্বের সেই হিংস্র মানুষ নিয়ে গবেষণার বিষয়টার রহস্য জানতে এখানে এসেছেন?
.
এরপর মিসির আলি সাহেব টর্চের আলোতে সেই ৩৯ নাম্বার ডায়েরিটা মেয়েটাকে দেখালেন আর বললেন:
– আপনি কী সেলফে এই ডায়েরিটাই খুঁজছিলেন?
.
ডায়েরিটা দেখে মেয়েটা বেশ চমকে উঠলো! এরপর বললো:
– এই ডায়েরিটা আপনি পেলেন কোথায়? আপনি ও কী আমার মতো এই গবেষণার পেছনের রহস্যটা খুজঁছেন? আপনি কী জানেন এই গবেষণার ভয়ংকর পরিণতি কী হয়?
.
.
মেয়েটার কথা শুনে মিসির আলি সাহেব বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটা হয়তো ডাক্তার ওয়াজেদ আলির এই গবেষণা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। তাই মেয়েটাকে যদি মিসির আলি সাহেব এই গবেষণা সম্পর্কে যতটুকু জানেন সেটা বলেন। তাহলে মেয়েটাও হয়তো এই গবেষণা সম্পর্কে সে কী কী জানে এবং কিভাবে জানে এটা তাকে বলবে!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব তার পুরো ঘটনাটা সেই মেয়েটাকে গুছিয়ে বললেন। সেই শম্মীর জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত শম্মীর নানান হিংস্র আচরণের কথা, আবির সাহেবের সাথে তার দেখা হওয়ার কথা, ডাক্তার ওয়াজেদ আলির শম্মী এবং তার মাকে ভিকটিম বানিয়ে ভেকসিনের নামে মেডিসিন প্রয়োগ করা, পুরো ঘটনাটাই মেয়েটাকে মিসির আলি সাহেব গুছিয়ে বললেন। মিসির আলি সাহেবের বলা পুরো ঘটনাটাই বেশ মনযোগ দিয়ে শুনছিলো মেয়েটা! ঘটনাটা বলার পর মিসির আলি সাহেব মেয়েটাকে বললেন:
– বুঝলেনতো পুরো ঘটনাটা! আসলে এইসব জানার পেছনে আমার কোন স্বার্থ নেই। আমি একজন রহস্য প্রেমী। যেখানেই রহস্য লুকিয়ে থাকে, সেখানেই আমি যাই। এই শম্মী মেয়েটার এইরকম জানোয়ারের মতো হিংস্র ব্যবহার বেশ অস্বাভাবিক। তাই আমি তাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে এই ডাক্তার ওয়াজেদ আলি পর্যন্ত এসেছি! এরমধ্যেই আমি অনেক গুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি এবং এখনো অনেক গুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। হয়তো এই গবেষণা নিয়ে ডায়েরিটা পড়লে বাকি প্রশ্ন গুলোরও উত্তর পেয়ে যাবো!! কিন্তু আপনি কে? আর আপনি ইবা এই গবেষণাটা সম্পর্কে জানলেন কিভাবে? আমার জানা মতে এটি ডাক্তার ওয়াজেদ আলির একটা গোপণ গবেষণা ছিলো। শম্মীর রহস্য সম্পর্কে না জানলে আমিও হয়তো এই গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতাম না! এই গবেষণাটা সম্পর্কেতো আপনারও জানার কথা না! তাহলে আপনি কে আর কিভাবে ওয়াজেদ আলি এর এই গবেষণাটা সম্পর্কে জানলেন?!
.
মিসির আলি সাহেবের প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর তার পুরো ঘটনাটা মিসির আলি সাহেবকে বলতে লাগলো:
-আসলে আপনার বলা ঘটনাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। এই গবেষণাটা ডাক্তার ওয়াজেদ আলি একা করেননি। তার সাথে অন্য একজন গবেষকও ছিলেন। যার নাম, ডাক্তার আসিফুর রহমান। তিনি আমার বাবা হন। অবশ্য এই গবেষণায় তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না! আসলে আমার নাম ডাক্তার জেরিন আক্তার। আমার যখন ৩ বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। এরপর থেকে আমার বাবাই আমার দেখাশোনা করে আমাকে বড় করেন। ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ৬-৭ বছর ঘটনা! আমি তখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশুনা করতাম। আমার বাবা একজন খুব ভালো প্রাণী বিষয়ক গবেষক ছিলেন। তিনি নানান নতুন প্রাণির প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করতেন এবং বেশ কয়েকবার সফলও হয়েছিলেন । আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রি ছিলাম। তাই আমার বাবা তার প্রায় প্রত্যেকটা গবেষণায়ই আমাকে সহযোগি হিসেবে রাখতেন। এতে অবশ্য আমি অনেক নতুন কিছুই শিখতে পারতাম। আমার বাবা তার প্রত্যেকটা গবেষণা নিয়েই প্রায় আমার সাথে কথা বলতেন। এই সব গবেষণার পরেই আমার বাবার সাথে পরিচয় হয় আরেক প্রাণি বিষয়ক গবেষক ডাক্তার ওয়াজেদ আলির সাথে। তিনি তার একটা ব্যাক্তিগত গবেষণায় আমার বাবাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রন জানায়।
তার এই গবেষণাটা অনেক গোপন একটা গবেষণা ছিলো! আমার বাবা তার প্রায় সব গবেষণা সম্পর্কে আমাকে বললেও এই অদ্ভুত গবেষণার বিষয়টা আমার থেকেও গোপন রাখেন। আমি যখন তার কাছে জানতে চাইতাম যে, তিনি ডাক্তার ওয়াজেদ আলির বাড়িতে কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন? তখন তিনি প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতেন, আর বলতেন জীব বৈচিত্রের একটা বড় বিষয় নিয়ে তারা গবেষণা করছেন। এই গবেষণাটা যদি একবার সফল হয় তাহলে তারা দুজনেই অনেক খ্যাতি লাভ করবেন এবং এই গবেষণাটা পৃথিবীর উন্নয়ণের জন্য ব্যবহার করা যাবে। তিনি তার এই গবেষণার বিষয়টা সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলতে চাইতেন না তাই আমিও এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাতাম না! আমার বাবা রোজ সকাল বেলা কাজে হাসপাতালে যেতেন এরপর দুপুর বেলা বাড়িতে এসে খেয়ে আবার তার গবেষণার জায়গাতে যেতেন। কিন্তু একদিন আমার বাবা সকাল বেলা বেড়িয়ে দুপুর বেলা বাড়িতে ফিরলেন না! আমি তার নাম্বারে কল দিয়ে তার নাম্বারটা বন্ধ পেলাম। এরপরে আরো কয়েকবার আমি তাকে কল দিলাম কিন্তু তার মোবাইল আর চালু হয়নি। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। সারাদিনে আর বাবা আমায় কল দেয়নি। প্রায় সন্ধ্যাঁ ৭টার দিকে আমার মোবাইলে থানা থেকে একটা কল আসলো ! তারা আমাকে থানায় দেখা করতে বললেন। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ! এরপর অনেকটা ভয়ে ভয়েই থানায় গেলাম। থানায় গিয়ে আমি যা দেখলাম সেটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না! দেখলাম থানার সামনেই আমার বাবার গাড়িটা ভেঙে-মুচরে পড়ে রয়েছে! গাড়ি পুরোটা ভেজা কাঁদা পানিতে! এরপর থানার একটু ভেতরেই যেতে দেখলাম সেখানে চাদরে মোড়া একটা লাশ পড়ে রয়েছে! লাশটা দেখে আমার চিনতে বাকি রইলো না যে এটা আমার বাবার লাশ! হঠাৎ বাবার লাশটা এইভাবে দেখে আমি পুরো আৎকে উঠি!
এরপর থানার পুলিশ আমায় জানায় যে তারা বিকাল বেলা বাবার গাড়িটা খাদ থেকে উদ্ধার করেছে! বাবা হয়তো গাড়ির নিয়ন্ত্রন হারিয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিল! তারা বললো এটা একটা সড়ক দুর্ঘটনা। তখন সাথে সাথেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার পাশে সেদিন কেউ ছিলো না। এরপর বাবার লাশটা আমি আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। এরপর বাবার অনেক বন্ধু, সহযোগিরা আসে আমাদের বাড়িতে বাবার লাশটা দেখতে। তারা আমাকে নানান ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে! তারা আমার বাবার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করে সেদিন আর বলে, যে কোন প্রয়োজনে তারা আমার পাশে থাকবে। সেদিন ডাক্তার ওয়াজেদ আলিও আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন! তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তিনিও যে কোন প্রয়োজনে তার কাছে যাওয়ার জন্য আমাকে বলেন। এরপরে বাবার দাফন কাজ শেষ করে সবাই মিলে। এরপরেও আমি আমার বাবার স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না! যদিও আমার কাছে আমার বাবার মৃত্যুটা একটা স্বাভাবিক সড়ক দুর্ঘটনাই ছিলো। আমি জানতাম আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাই তার কোন শত্রু থাকতে পারে না! আমার বাবার মৃত্যুর ৭ দিন পড়ে আমি সেদিন বাড়িতে একা একা বসে ছিলাম। আমি সাধারণ খুব একটা মোবাইল ব্যবহার করতাম না। তাই মোবাইলের ম্যাসেজগুলোও খুব একটা চেক করতাম না কখনো।সেদিন কী মনে করে যেনো মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে মোবাইলের ইনবক্সে ঢুকে গেলাম! মোবাইলের ইনবক্সে ঢুকতেই একটা ম্যাসেজ চোখে পড়লো! ম্যাসেজটা এসেছিলো আমার বাবার নাম্বার থেকে। ম্যাসেজটা বাবা কখন পাঠিয়েছিলো এটা দেখতে গিয়ে আমি পুরো আৎকে উঠলাম! বাবা যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ম্যাসেজটা ঠিক সেইদিন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে বাবা আমাকে পাঠিয়েছিলো! ম্যাসেজটাতে লেখাছিলো, “মামনি, তুমি ভালো থেকো। আমি মনে হয় আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না! ডাক্তার ওয়াজেদ আলি মোটেও ভালো মানুষ না। তিনি আমাকে দিয়ে একটা ভয়ংকর গবেষণা করিয়ে এখন এর পুরো কৃতিত্ব নিজে নিতে চাইছেন। তিনি হয়তো আমাকে আর বাঁচতে দিবে না। আমি তোমাকে কল দিতে পারছি না! কিন্তু তুমি ডাক্তার ওয়াজেদ আলিকে কখনো বিশ্বাস করবে না। তুমি তার ধারে কাছেও কখনো যাবে না! সব সময় তার থেকে দুরত্ব বজায় রাখবে।”
.
ম্যাসেজটা আমি কাঁদতে কাঁদতেই সেদিন পড়েছিলাম। তার মানে আমার বাবার মৃত্যুটা কোন দুর্ঘটনা ছিলো না! একটা পরিকল্পিত খুন ছিলো! আর আমার বাবার খুন করেন ডাক্তার ওয়াজেদ আলি! যদিও আমার বাবা বলেছিলো লোকটা থেকে অনেক দুরে থাকতে! কিন্তু আমি কিছুতেই আমার বাবার খুনটা মেনে নিতে পারছিলাম না! আমি শুধু ভাবছিলাম, যে আমার বাবাকে বাঁচতে দেয়নি, তারও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তাই আমি একদিন প্লান করেই ডাক্তার ওয়াজেদ আলিকে খুন করে ফেলি। সেদিন ডাক্তার ওয়াজেদ আলি তার একটা অপারেশন শেষ করে তার বাড়িতে ফিরছিলো। পথেই আমি তার কাছে লিফট চাই। ডাক্তার ওয়াজেদ আলি আমাকে ভালোভাবেই চিনতেন। তাই অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলো সে আমার সাথে সেদিন। কথাগুলো এমন ভাবে বলছিলো যে, তাকে দেখে মনে হয় সে ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে পারে না। কিন্তু আমি তার ভেতরের শয়তানি রুপটাকে চিনতে পেরেছিলাম। তাই তাকে হঠাৎ করেই গাড়ি থামাতে বলি। সে কিছুটা অবাক হয়ে গাড়িটা থামায়। এরপর আমি যা করি তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। হঠাৎ করেই ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বের করে তার হাতে ঢুকিয়ে দেই। সাথে সাথেই তার পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়। ইনজেকশনটা দ্রুত মানুষের শরীর অবশ করার ইনজেকশন ছিলো। এরপরে সে আর কিছুই করতে পারে না। যা করার সব আমিই করি! আমি গাড়িটা চালু করে স্ট্যায়ারিংটা তার হাতে ধরিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যাই। তার পুরো শরীর অবশ ছিলো তাই সে আর কিছু করতে পারে না। গাড়িটা একটু সামনে যেতেই একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায়! সবাই ভাবে ডাক্তার ওয়াজেদ আলি স্বাভাবিক একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে! কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না যে, আমিই তাকে খুন করেছিলাম! আমি আমার বাবার খুনের প্রতিশোধ নিয়েছিলাম!
আমার বাবাকে ডাক্তার ওয়াজেদ আলি যেভাবে খুন করেসি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছিলো, ঠিক তেমনি ভাবে আমিও তাকে খুন করে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেই। আমার বাবার মৃত্যু এবং ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এর মৃত্যু দুটোকেই সবাই স্বাভাবিক ভাবে নেয় আর তাঁদের সবাই ভুলে যায়! আমিও এই কয় বছরে বাবাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তার স্মৃতিগুলো যেনো আমাকে ছেড়ে যেতেই চায় না। এরমধ্যে আমিও লেখাপড়া শেষ করে ডাক্তার হই। নানান অদ্ভুত বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে থাকি। এরই মধ্যে ৬ মাস আগে অ্যামেরিকার একদল গবেষক একটা ইমেইল ফরয়ার্ড করে বিভিন্ন দেশের প্রাণিবিদ্যার গবেষকদের কাছে পাঠায়। সৌভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে এই ইমেইলের একটা কপি আমাকেও পাঠানো হয়। ইমেইলটিতে কিছু অদ্ভুত শিশুর বর্ণণা দেওয়া ছিলো। ইমেইলটা পড়ে আমি যা বুঝতে পারি, অ্যামেরিকাতে বর্তমানে কিছু হিংস্র শিশুর জন্ম হচ্ছে! তারা যত বড় হয় তাঁদের হিংস্রতা আরো ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা এতটাই জঙ্গলের হিংস্র প্রাণির মত হিংস্র হয়ে যায় যে, তারা মানুষ হয়ে মানুষের রক্ত, মাংসও খেতেও ধিধা করে না! এই ধরণের শিশুদের সম্পর্কে তারা ব্যাখ্যা জানতে চাইছিলো! আমি এই ইমেইল টা দেখে বেশ অবাক হই। কারণ রোগটা বেশ অদ্ভুত ছিলো! যদিও পরে এই বিষয় নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তা করলাম না। কারণ আমি একজন সাধারণ গবেষক ছিলাম। এ বিষয়ে তেমন একটা ধারণা ছিলো না আমার। এছাড়া এই ইমেইল টা হয়তো আমার মতো আরো হাজারো গবেষকের কাছে পাঠানো হয়েছিলো! ইমেইলটার কথা কয়মাস পর প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে গত ৭ দিন আগে একবার আমি বাবার গবেষণা গাড়ে গিয়েছিলাম। আমার যখনি বাবার কথা খুব মনে পড়ে তখনি আমি সেই গবেষণা গাড়ে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। সেদিনও গবেষণাগাড়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। এরপর হঠাৎ চোখ গেলো আমার বাবার লেখা কিছু ডায়েরিতে। আমার বাবা ডায়েরি লিখতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি দিনে কী কী কাজ করেছেন এবং পরের দিন কী কী কাজ করবেন সব এই ডায়েরি গুলোতে লিখে রাখতেন। তবে তার অনুমতি ছাড়া কেউ তার ডায়েরি পড়লে সে খুব রেগে যেতো। তাই আমি আগে কখনো তার লেখা ডায়েরিগুলো পড়িনি! তাই সেদিন ভাবলাম, এখনতো বাবা বেঁচে নেই। তার ডায়েরিগুলো পড়লে হয়তো তাকে কিছুটা অনুভব করা যাবে! তাকে আরেকটু গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারবো! এরপর আমি তার লেখা শেষ ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলাম। ডায়েরিটা পড়ে আমি পুরো অবাক হয়ে গেলাম! কারণ ডায়েরিতে বাবা স্পষ্ট লিখে গিয়েছিলো যে বাবার মৃত্যুর পুর্বে সে ডাক্তার ওয়াজেদ আলির সাথে কী বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন! বিষয়টা দেখে তখন আমি পুরো চমকে উঠি! কারণ সেই ডায়েরিতে বাবা নিজেই লিখেছিলো যে তারা মানুষের জিনের ভেতর অন্য কোন হিংস্র প্রাণির জিনের প্রবেশ ঘটিয়ে একটা হিংস্র প্রাণির মতো মানুষকে তৈরি করতে চায়! যে প্রাণী দেখতে অবিকল মানুষের মতই হবে! কিন্তু তার আচরণ হবে হিংস্র প্রাণিদের মতো। আমি এতটুকু পড়েই বুঝতে পারলাম যে, অ্যামেরিকা থেকে গবেষক দলটা যে ধরণের শিশুর বর্ণণা দিয়েছিলো সেই শিশুদের সাথে হয়তো এই গবেষণার কোন সম্পর্ক রয়েছে! আমি বাবার ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারি যে, এই গবেষণার প্রধান গবেষক যেহেতু ডাক্তার ওয়াজেদ আলি ছিলো তাই নিশ্চই এই গবেষণার থিওরিটা তার বাড়িতে গেলেই পাওয়া যাবে এবং ডাক্তার ওয়াজেদ আলি যে তার গবেষণার থিওরি গুলোকে একটা করে ডায়েরিতে নথিভুক্ত করে রাখে এটাও আমার জানা ছিলো। তাই আমি ভাবলাম এই ধরণের শিশু তৈরির থিওরি যার কাছে আছে! তার কাছে হয়তো এই ধরণের শিশুদের আবার স্বাভাবিক করার থিওরিটাও রয়েছে। তাই অনেক কষ্ট আর চেষ্টা করার পর আজ অবশেষে এই বাড়িতে ঢুকতে পারলাম। তবে ডায়েরিটা প্রথমে খুঁজে না পেয়ে বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে এবার মনে হচ্ছে ডাক্তার ওয়াজেদ আলির হাতের লেখা এই ডায়েরিটা পড়ে এই গবেষণা সম্পর্কে ব্যাখ্যামূলক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ডায়েরিটা আপনি আমাকে দিন! আমাকে দ্রুত ডায়েরিটা পড়তে হবে। তাহলে আপনার ঐ শম্মীর অদ্ভুত আচরণের রহস্যটাও সমাধাণ হবে! আর আমেরিকার সেই নিষ্পাপ শিশু গুলোও রক্ষা পাবে!
.
.
দীর্ঘক্ষণ মেয়েটার কথা শুনার পর এবার মিসির আলি সাহেব পুরো ঘটনাটা পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারলেন। তার মনে জাগা অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরই সে সহজে খুঁজে পেলেন। সে বুঝতে পারে যে ডায়েরিটাতেই এই গবেষণা সম্পর্কে সবকিছুর ব্যাখ্যা রয়েছে! ডায়েরিটা পড়তে পারলেই হয়তো এই রহস্যের সমাধাণ করা সম্ভব হবে। এরপর মিসির আলি সাহেব সেই মেয়েটার হাতে ডায়েরিটা দিলেন। এরপরে যেই মেয়েটা ডায়েরটা পড়া শুরু করবে হঠাৎ মিসির আলি সাহেবের টর্চ লাইটটা বন্ধ হয়ে গেলো! সাথেসাথেই পুরো লাইব্রেরি আবার অন্ধঁকার হয়ে গেলো। মিসির আলি সাহেব বুঝতে পারলেন যে তার টর্চের ব্যাটারির চার্জ শেষ! ……………

……(৬ষ্ঠ এবং শেষ পর্ব)……
.
তারা বুঝতে পারলো যে এখন আর তাদের এই বাড়িতে থাকা উচিত হবে না। তারাতো এই অদ্ভুত গবেষণা এর রহস্যের ডায়েরিটা পেয়েই গেছে! এখন বাহিরে গিয়ে এটা পড়লেও তাদের কোনো সমস্যা হবে না! এরপরে অন্ধঁকারের ভেতরেই মিসির আলি সাহেব এবং সেই ডাক্তার মেয়েটা ঠিক যেভাবে এই বাড়িতে ঢুকেছিলো ঠিক সেই ভাবেই জানালা দিয়ে বাড়ির বাহিরে বেড়িয়ে আসলেন! এরপর তারা দুজনেই ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এর বাড়ির পাশের সেই নির্জন রাস্তাটা ধরে হাঁটতে থাকেন। এরই মধ্যে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তাই রাস্তায় কোন মানুষও ছিলো না। এছাড়াও চারিদিকে বেশ অন্ধঁকার। এই অন্ধকারে কিছুতেই ডায়েরিটা পড়া যাবে না। এরপর মিসির আলি সাহেব এবং সেই মেয়েটা দুরে একটা লেমপোস্ট দেখতে পেলো। লেমপোস্টের নিচে বেশ আলো রয়েছে। এরপর তারা সেই লেমপোস্টের আলোতে গিয়ে ডায়েরিটা পড়তে শূরু করলেন! সেই ডাক্তার মেয়েটা ডায়েরিটা পড়ছিলেন আর মিসির আলি সাহেব শুনছিলেন। ডায়েরিটা ডাক্তার ওয়াজেদ আলির নিজস্ব ভাষায় লেখা। শুরু থেকে ডায়েরিটাতে যা যা লেখাছিলো:
.
.

১. এটা আমার জীবনের ৩৯ নাম্বার গবেষণা। এটা আমার জীবনের একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও বটে। এই গবেষণায় সফলতা অর্জনটা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমার এবারের গবেষণার বিষয়টা হলো মানুষ খেকো মানুষ তৈরি করা। এই মানুষ খেকো মানুষ তৈরির থিওরিটা আমাকে দিয়েছিলো আমেরিকার একটা বড় প্রাণী বিষয়ক গবেষক দল। তারা চাইছিলো তাদের দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলতে। তাই তারা আমাকে অনেক টাকার অফার করে এই ভয়ংকর গবেষণাটা করার জন্য। তারা আরো বলে আমি যদি এই গবেষণায় সফল হই তাহলে তাদের দেশে তাদের সাথে আমি গবেষণার কাজ করতে পারবো। তখন আমার খ্যাতি আরো বাড়বে। আমি তাই সিদ্ধান্ত নেই যে এই মানুষ খেকো মানুষ তৈরি করার মেডিসিন তৈরি করবো। যার মাধ্যমে সৃষ্ট একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খেতেও দ্বিধা করবে না। তারা আমাকে গবেষণাটা সম্পর্কে কাউকে কিছু না জানাতে বলে। তাই এখন থেকে আমি এই মানুষ খেকো মানুষ তৈরির গবেষণা নিজের বাড়িতে একা একাই শুরু করবো।
.
২. গবেষণাটা আসলেই অনেক জটিল একটা গবেষণা! এই ধরণের গবেষণা এর আগে আমি কখনোই করিনি। তাই অনেক কষ্ট করে মানুষ খেকো মানুষ তৈরির একটি তত্ত্ব তৈরি করলাম। আসলে মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্য রুচি ইত্যাদি অনেকটা ডি.এন.এ থেকে পাওয়া। একটা শিশুর সেই ডি.এন.এ এর সহযাত আচরণে পুরোপুরি প্রভাব পড়তে প্রায় ৯ মাস সময় লাখে যখন সে তার মায়ের গর্ভে থাকে! তাই সেই সময়টাতে শিশু ভ্রুন অবস্হায় থাকার সময় থেকে যদি তার শরীর অন্যকোন হিংস্র প্রাণির জিনের প্রবেশ ঘটানো হয়, তাহলে হয়তো জন্মের পর থেকে সেই শিশুটি দেখতে অবিকল মানুষের মতো হলেও তার আচরণ হবে জঙ্গলের হিংস্র প্রাণিদের মতো!
.
৩. আমার তত্ত্বটি সঠিক কিনা এটা জানার জন্য গত কয়েকদিন যাবত একটা পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। পরীক্ষাটি শুনতে হাস্যকর হলেও এতে আমার পরীক্ষার সফলতা নিশ্চিত হয়। আমি একটা সদ্য গর্ভবতী ইদুরের শরীরে একটা টিকটিকির জিনের প্রবেশ ঘটাই। এরপর সেই ইদুঁরটিকে একটি কাঁচের জারে আটকে রাখি। এরপর যখন ইদুঁরটার বাচ্চা হলো, তখন বেশ কিছুদিন তারা স্বাভাবিক ইদুর ছানার মতোই আচরণ করলেও এরপর থেকে তারা দেয়ালে দেয়ালে টিকটিকির মতো ঘুরে ঘুরে মশা আর মাছি খেতে থাকে। তাই আমি বুঝতে পারি আমার তত্ত্বটি ভুল নয়!
.
৪. মানুষের শরীরের ভেতর কোন হিংস্র প্রাণির জিনের প্রবেশ করানো বেশ মুশকিল একটা কাজ হবে। কোন হিংস্র প্রাণির শরীর থেকে তার জিন আলাদা করাও বেশ কঠিন! তাও মানুষখেকো মানুষ তৈরির জন্য বেশ কিছু প্রাণির জিনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমতো জোকের জিনের প্রয়োজন। কারণ মানুষ যদি তার শরীরে জোকের মতো সহজাত আচরণ পায় তাহলে সে খুব সহজেই অন্য একটা মানুষের চামড়ার উপর দিয়ে তার রক্ত চুষে চুষে খেতে পারবে। এছাড়াও একটা হিংস্র প্রাণির জিনকে যদি মানুষের শরীরে ভেতরে ঢুকানো হয় তাহলে মানুষ স্বভাবতই অন্য প্রাণির কাঁচা মাংস খেতে পারবে। কারণ জঙ্গলের হিংস্র প্রাণিরা কাঁচা মাংসই খেয়ে থাকে। এইভাবে দুটো জিনের মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে সেই জিনটা যদি কোন গর্ভবতী মহিলার শরীরে প্রবেশ করানো হয় তাহলেই হয়তো মানুষ খেকো মানুষ তৈরি করা সম্ভব!
.
৫. অনেকটা জটিলতার মধ্যে দিয়েই জোঁক, একটা হিংস্র প্রাণি এবং আরো কিছু সাধারণ বন্য প্রাণির জিনের মিশ্রন ঘটিয়ে নতুন এক ধরণের মেডিসিন তৈরি করলাম। এই মেডিসিনটাই ইনজকশনের মাধ্যমে গর্ভবতী মহিলার শরীরে প্রতি মাসে একবার করে দিলেই হয়তো সেই গর্ভবতী মহিলার যে সন্তান হবে সে হবে হিংস্র, অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক একটা শিশু। সে সাধারণ খাবার পছন্দ করবে না। সে যখন ছোট থাকবে তখন রক্ত, ছোটখাটো প্রাণির কাঁচা মাংস ইত্যাদি খেতে বেশি পছন্দ করবে। এবং এক পর্যায়ে সে মানুষ হয়ে মানুষের মাংস খেতেও দ্বিধা করবে না!
.
৬. মেডিসিন পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু আসলেই কী এই মেডিসিনের সাহায্যে মানুষের শরীরে হিংস্র প্রাণির জিনের প্রবেশ করিয়ে মানুষ খেকো মানুষ তৈরি করা সম্ভব? এর জন্য অবশ্যই একটা নিশ্চিত পরীক্ষা করার প্রয়োজন। কিন্তু কোন গর্ভবতী মহিলা পাবো কোথায় এই গবেষণাটা করার জন্য? আর পেলেও তার শরীরেই বা এই মেডিসিন কিভাবে প্রবেশ করাবো? আমাদের দেশে এই ধরনের পরীক্ষা নিষিদ্ধ! এটা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। এরপরেই আমার বন্ধু আবির চৌধুরী আমার জন্য একটা সুখবর নিয়ে আসে। সে বলে তার স্ত্রী নাকি অন্তঃস্বত্তা। আবির আমাকে অনেক বিশ্বাস করে তাই তার এই বিশ্বাসের সুযোগটাই আমি কাজে লাগাই। তার স্ত্রীকে ভেকসিনের নাম করে প্রতিমাসে আমি তার শরীরে এই মেডিসিন প্রয়োগ করতাম। আর এইভাবেই আমার পরীক্ষাটি চালু থাকে! এরই মধ্যে এই মেডিসিনের কয়েকটা কপি আমি অ্যামেরিকার সেই গোপন গবেষক দলের কাছে পাঠিয়ে দেই। যাতে তারাও এই মেডিসিন নিয়ে পরীক্ষা করতে পারে!
.
৭. যেকোন মেডিসিন তৈরির পর তার পরীক্ষা করার আগে তার প্রতিষেধক তৈরি করাটা আবশ্যক। কারণ পরীক্ষাটির ভয়াবহতা বেড়ে গেলে তাহলে প্রতিষেধক ব্যবহার করে পরীক্ষাটি বন্ধ করা যায়। তাই আমিও এই পরীক্ষাটির প্রতিষেধক তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোন থিওরি বা তত্ত্বই আমার মাথায় আসছিলো না! তাই আমি গোপনে আরেক জন প্রাণি বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক ডাক্তার আসিফুর রহমান কেও এই গবেষণায় যুক্ত করি। আসিফুর প্রথমে এই গবেষণায় যোগ দিতে চায়নি। কিন্তু পরে অর্থ আর আমেরিকার গবেষকদের কাছে খ্যাতির লোভে সেও আমার সাথে এই গবেষনার কাজে সহায়তা করেন। যেহেতু আমি আগেই এই গবেষণার মেডিসিন তৈরি করে ফেলেছিলাম তাই তার একমাত্র কাজ ছিলো শুধু এই গবেষণার প্রতিশেধক তৈরি করা। তবে এই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ডাক্তার আসিফুর রহমান আমাকে নতুন দুটি তত্ত্ব দিয়েছিলো। একটি তত্ত্ব হলো এই গবেষণায় যে শিশুটি ভিকটিম হবে সেই শিশুটি সারা জীবনের জন্য হিংস্র মানুষ অর্থাৎ মানুষ খেকো মানুষ থাকবে না। এমন ক্ষমতা এই জিন দ্বারা তৈরি মেডিসিনে নেই! এমনকি একটা পুরো দিনও সে তার হিংস্র আচরণ প্রকাশ করবে না! দিনের অর্ধেকটা সময় সে স্বাভাবিক থাকবে বাকি অর্ধেকটা সময় সে এই মেডিসিনের প্রভাবে হিংস্র আচরণ করবে। অপর তত্ত্বটি পুরোই অন্যরকম একটি তত্ত্ব। এই ভিকটিমের শিশুটি যদি পৃথিবীতে আসার পর জোকের মতো করে কোন মানুষের শরীরের রক্ত পান করার পর তাকে খুন নাও করে তাও সেই মানুষটা বেশিদিন বাঁচবে না। খুব দ্রুতই সে মারা যাবে। কারণ এই ধরণের শিশুদের ঠোটে এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ এসে জমা হবে। যা কোন মানুষের রক্ত খাওয়ার সাথে সাথে তার শরীরের ভেতর চলে যাবে এবং সেই রাসায়নিক পদার্থটা তার মস্তিস্কে গিয়ে তাকে নানান ধরণের চাপ প্রয়োগ করবে এবং এক পর্যায়ে সে বাধ্য হয়ে আত্মাহত্যা করে মারা যাবে!
.
৮. আমাদের গবেষণাটা বেশ ভালো ভাবেই চলছিলো। আমেরেকির সেই গবেষক দলও আমার বেশ প্রশংসা করছিলেন এবং তারাও বেশ কিছু গর্ভবতী মহিলাদের এ গবেষণা সম্পর্কে কিছু না জানিয়েই ভেকসিনের কথা বলে তাদের শরীরে এই মেডিসিন প্রয়োগ করে এর পরীক্ষা করছিলো এইদিকে ডাক্তার আসিফুর রহমানের প্রতিষেধক তৈরির কাজও প্রায় শেষের দিকে।
.
৯. ডাক্তার আসিফুর রহমান আমার সাথে বেঈমানি করলো। এই গবেষণার প্রতিষেধক সে ঠিকই তৈরি করেছে কিন্তু সে আমায় সেটা দিচ্ছে না। সে চাইছে এই প্রতিষেধকটার পুরো কৃতিত্ব নিজের নামেই নিতে। এই মেডিসিনের রোগটা যখন পুরো আমেরিকায় মহামারি আকার লাভ করবে তখন সে নাকি এই প্রতিষেধকটা সেখানে রপ্তানি করবে। এতে সে আরো অনেক অর্থ আর খ্যাতি অর্জন করতে পারবে। আর এই ভয়ংকর গবেষণাটার পুরো দোষ এসে পড়বে আমার ঘারে। আমি এই গবেষণাটা কিছুতেই এইভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না। এটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত একটা গবেষণা এবং এর কৃতিত্ব শুধু মাত্র আমার। ডাক্তার আসিফুর রহমান একটা বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাকে এর জন্য অবশ্যই প্রস্তানো উচিত। তার আর এই পৃথিবীতে বেশিদিন বেঁচে থাকা উচিত না। আমার চাই না এই গবেষণার কোন প্রতিষেধক!”
.
.
এতটুকু কথাই লেখাছিলো এই ডায়েরিটাতে। এরপর পুরোটা ফাঁকা পৃষ্ঠা। অনেক খুঁজেও এই ডায়েরিটা থেকে এই গবেষণা সম্পর্কে আর কোন তথ্য পায় না মিসির আলি সাহেব আর ডাক্তার জেরিন আক্তার। তবে ডায়েরির শুরুর দিকে একটা গবেষণা ইন্সটিটিউটের নাম লেখা ছিলো। ডাক্তার জেরিন আক্তার বুঝতে পারলেন এটাই হয়তো সেই আমেরিকার সেই গোপন গবেষক দলের গবেষণাগাড় যারা ডাক্তার ওয়াজেদ আলিকে এই ভয়ংকর গবেষণার থিউরি টা দেয়।
.
তবে এখন মিসির আলি সাহেব এবং ডাক্তার জেরিন আক্তারের কাছে এই তথ্যটা বেশি গুরুত্বপুর্ণ না । তারা যেটার জন্য এতদূর ছুটে এসেছিলো, সেই প্রশ্নের উত্তরটা এখন খুঁজে পেয়েছে। এই হিংস্র মানুষের হিংস্রতা দুর করার জন্য যে একটা প্রতিশেধক রয়েছে এটা তারা জানতে পেরেছে! মিসির আলি সাহেবও এবার শম্মীর এই অস্বাভাবিক ব্যবহারের পুরো রহস্যটা বুঝতে পারেন এবং সমাধাণের পথটাও দেখতে পারছিলেন। ডায়েরি পড়ে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই রোগের প্রতিষেধকটা ডাক্তার আসিফুর রহমানই তৈরি করেছিলেন। যদিও এরপর সেই প্রতিষেধকটা লুকিয়ে রাখেন। কাউকে দেখান না! এই কয় বছরে তাদের এই গবেষণা সম্পর্কে কেউই কিছু জানতে পারে নি। তাই এর প্রতিষেধকও কেউ খুঁজেনি। হয়তো ডাক্তার আসিফুর রহমান এর গবেষণা গাড়ে গিয়ে ভালোমতো খুঁজলেই সেই প্রতিষেধকটা পাওয়া যেতে পারে!!
.
এরপর মিসির আলি সাহেব এবং ডাক্তার জেরিন আক্তার দুজনে মিলেই ডাক্তার আসিফুর রহমানের গবেষণাগাড়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে প্রায় পুরো গবেষণাগাড়টাই তার খুঁজলো। কিন্তু কোথাও এইরকম হিংস্র মানুষ নিয়ে গবেষণার প্রতিষেধক তারা খুঁজে পায় না। এরমধ্যে মিসির আলি সাহেব এবং সেই ডাক্তার মেয়েটা, ডাক্তার আসিফুর রহমানের এই গবেষণার সময়ের বেশ কয়েকটা ডায়েরি পড়ে ফেলেন। কিন্তু কোন ডায়েরিতেই এই গবেষণার প্রতিষেধক তৈরির প্রসঙ্গে ডাক্তার আসিফুর রহমান কিছুই লিখেন নি! তারা দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে যান। এরপর মিসির আলি সাহেব ভাবেন, যেহেতু এই প্রতিষেধকটা ডাক্তার আসিফুর রহমানের জন্য একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিলো! তাই হয়তো সে ভেবেছিলো প্রতিষেধকটা এই গবেষণাগাড়ে রাখলে, যে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারে! তাই হয়তো এই প্রতিষেধকটা ডাক্তার আসিফুর রহমান কোন গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলো। এরপর মিসির আলি সাহেব ডাক্তার আসিফুর রহমানের বেডরুমে যান। তার গবেষণা গাড় থেকে বেশ কিছুটা দূরেই তার বেডরুম। বেডরুমটা অনেকদিন ধরেই পরিত্যাক্ত অবস্হায় পড়েছিলো। ডাক্তার আসিফুর রহমানের মৃত্যুর পর তার মেয়ে বর্তমান ডাক্তার জেরিন আক্তারও খুব একটা তার ঘরে যায় না। এরপর তারা পুরো ঘর ভালো করে খুঁজতে থাকে সেই প্রতিষেধকটার জন্য। কিন্তু এখানেও তারা এই প্রতিষেধকটা খুঁজে পায় না! এরপর অনেকটা হতাশ হয়েই মিসির আলি সাহেব খাটে বসে পড়েন। হঠাৎ তার পা গিয়ে লাগে খাটের নিচের একটা ষ্টিলের বাক্সে! এরপর খাটের নিচ থেকে বাক্সটা নিতেই মিসির আলি সাহেব দেখলেন বাক্সটাতে তালা দেওয়া। এখন তাদের পক্ষে এই তালার চাবি খোঁজা প্রায় অসম্ভব! তাই আর কোন উপায় না দেখে তার ট্রাংকের তালাটা ভেঙে ফেলেন। এরপর তারা তাঁদের বহু আকাঙ্খিত সেই প্রতিষেধকটা দেখতে পেলেন। প্রতিষেধকটা একটা কাঁচের শিশিতে সংরক্ষণ করা ছিলো। শিশি টার উপরের লেভেলেই লেখা ছিলো যে এটা কিসের প্রতিষেধক। কাঁচের শিশিটার পাশেই একটা ডায়েরি রাখা ছিলো। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ডাক্তার জেরিন আক্তার বুঝতে পারলেন যে, এই ডায়েরিতেই তার বাবা এইরকম হিংস্র মানুষ খেকো মানুষের জন্য প্রতিষেধক তৈরির ফর্মুলা লিখে রেখে গিয়ে ছিলেন। এই ফর্মুলার সাহায্যে এখন ডাক্তার জেরিন আক্তার নিজেও নতুন করে এই রোগের প্রতিষেধক তৈরি করতে পারবেন। হয়তো এই ফর্মুলার কপি আমেরিকার সেই ইমেইল পাঠানো গবেষকদের কাছে পাঠালে তারা নিজেরাই প্রতিষেধক তৈরি করে তাদের দেশের এই সমস্যাটার সমাধান করতে পারবেন!
.
কিন্তু এখন এই প্রতিষেধক যতটুকু তৈরি করেছিলেন ডাক্তার আসিফুর রহমান সেটুকুই ইনজেকশনের মাধ্যমে শম্মীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে আগে তাঁকে সুস্হ্য করতে হবে!
.
এরপরে দ্রুতই মিসির আলি সাহেব এবং ডাক্তার জেরিন আক্তার আবির সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লেন। ডাক্তার ওয়াজেদ আলি এর গবেষণার মেডিসিনের পরীক্ষাটিতো সফল হয়েছিলোই। এইবার দেখার পালা ডাক্তার আসিফুর রহমানের গবেষণার প্রতিষেধক তৈরির পরীক্ষাটি সফল হয় কি না?
.
তারা যতক্ষণে আবির সাহেবের বাড়িতে পৌছালেন ততক্ষণে শম্মীয়র ৩ নাম্বার খুনটা করা হয়ে গিয়েছিলো। শম্মী আজ আরেকটা শিশুকে খুন করেছে! কিন্তু মিসির আলি সাহেবের বিশ্বাস ছিলো, এটাই হয়তো শম্মীর শেষ হিংস্র খুন ছিলো! এরপর থেকে মেয়েটা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শুধু দিনের অর্ধেকটা সময় না, সারাটা জীবনের জন্যই হয়তো এখন মেয়েটা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
.
এরপর আবির সাহেবকে মিসির আলি সাহেব পুরো ঘটনাটা খুলে বলেন। আবির সাহেব বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে তার বন্ধু তার সাথে এমন কাজ করতে পারে?!!
.
এরপর ডাক্তার জেরিন আক্তারকে আবির সাহেব শম্মীর ঘরে নিয়ে যান। শম্মী তখন ঘুমাচ্ছিলো। এরপর ডাক্তার জেরিন আক্তার সেই প্রতিষেধকের শিশি থেকে বেশ কিছুটা প্রতিষেধক ইনজেকশনে ভরে সেটা শম্মীর শরীরে প্রবেশ করান। শম্মী ঘুমের ভেতর শুধু একটু নড়ে উঠলো! এর বেশি কোন প্রতিক্রিয়াই করলো না।
.
এরপর আবির সাহেব, ডাক্তার জেরিন আক্তার এবং মিসির আলি সাহেব নতুন একটা দিনের অপেক্ষায় রইলেন। তারা এটাই জানতে চায় যে, শম্মী সুস্হ্য হয়েছে কি না?
.
এরপর সকাল হতেই শম্মী আবার স্বাভাবিক ব্যবহার করা শুরু করে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যাঁ হয়ে যায়। তাও শম্মীর ভেতরে আর কোন অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যায় না। এরপর টানা ৭ দিন কেটে গেলো। শম্মী এখন পুরোপুরি সুস্হ্য। সে এখন বাকি ৮-১০ টা মেয়ের মতই স্বাভাবিক আচরণ করে। তার ভেতর আর কখনো হিংস্রতা জেগে উঠেনি। এই ব্যাপারটা নিয়ে আবির সাহেব মিসির আলি সাহেবের প্রতি চিরো কৃতজ্ঞ হয়ে রইলেন।
.
এইদিকে ডাক্তার জেরিন আক্তারও সেই প্রতিশেধকের ফর্মুলার এক কপি সেই গবেষণা সংস্হাকে ইমেইল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো যারা তাকে কয়েক দিন আগে ইমেইল করেছিলো! তারা সেই ফর্মুলায় প্রতিষেধক তৈরি করে আমেরিকান সেই হিংস্র শিশুদের উপর প্রয়োগ করে এবং সেই শিশু গুলোও আবার সেই হিংস্রতা ভরা অভিশপ্ত জীবন থেকে চিরোমুক্তি পেয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। এরপর জেরিন আক্তার সেই ভয়ংকর থিওরি যেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ডাক্তার ওয়াজেদ আলিকে দিয়েছিলো সেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামও সেই আমেরিকান গবেষকদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। এরপর সেখানে তাঁদের এই ভয়ংকর গবেষণার জন্য তাঁদের কঠোর ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়! আর এই ফর্মুলাটার জন্য সাথে সাথেই ডাক্তার জেরিন আক্তারের নাম এবং খ্যাতি হয়ে যায় পুরো বিশ্বে।
.
মিসির আলি সাহেব খুব একটা খ্যাতি পছন্দ করেন না। তাই তিনি আড়ালেই রয়ে গেলেন। তিনি রহস্য পিপাসু। শম্মীর এই অদ্ভুত হিংস্র আচরণের রহস্যটা তিনি ভেদ করতে পেরেছেন, এটা ভেবেই তিনি বেশ স্বস্তি পাচ্ছেন! রহস্যের পেছনে ছুটাটা মিসির আলি সাহেবের একটা বড় নেশা। তাই তিনি এখন পরবর্তী রহস্যে ঘেরা একটা কেসের অপেক্ষায়!

* * * * * সমাপ্ত * * * * *

 

 

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত