ঘটনাটা ৩১জুলাইয়ের। জ্বর জ্বর লাগছে সেই গতকাল দুপুর থেকে। তার ওপর প্রচন্ড গরম- কারেন্ট নেই। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করছি। ঘেমে বিছানার চাদর ভিজিয়ে ফেলেছি। ফেনারগান খেয়েছিলাম সর্দি আর কাশির জন্য। সারা দুপুর-রাত মাতালের মত বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। বার কয়েক মেঝেতে শুয়ে গরমের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। মশার কামড় শুরু হতেই আবার বিছানায় মশারির ভেতর ঢুকে পরতে হয়েছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুম। ওষুধ খেয়ে ঘুমালে স্বপ্নে যা দেখি সব হয় আবোল তাবোল। কিন্তু গতকাল সেরকম দেখিনি। প্রত্যেক ঘুমের ছোট ছোট অংশে অনেকটা খন্ড নাটকের মত স্বপ্ন দেখেছি দুপুর থেকে একেবারে ভোর রাত পর্যন্ত। স্বপ্নটা আবোল তাবোল নয়। খুব স্পষ্ট এবং প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে আমি ঐ সময়টায় সে জায়গাতেই ছিলাম। স্বপ্নের প্রথম অংশে আমি একটা মাদ্রাসার পুকুর পাড়ে বসে ছিলাম। যোহরের আযান দেয়নি তখনো। দেবে দেবে এমন সময়। পুকুরের সবুজ শ্যাওলা ভরা পানি দাপিয়ে মাদ্রাসার বাচ্চাগুলো গোসল করছে।
আমি সিঁড়িতে বসে দেখছি তা। দৃশ্যটায় কোনো বৈচিত্র নেই। খুব স্বাভাবিক। ওদের পানির ছিটে এসে আমার গায়ে পড়ছে। শ্যাওলার জমাট পানি শার্টটা ভারি করে তুলছে ক্রমশ। এ অবস্থায় হঠাৎ খেয়াল করলাম এতগুলো বাচ্চাদের ভীড়ে পানির মাঝে আরো একজন। দেখতে অনেকটা বাচ্চা ন্যাড়া মেয়েদের মত। কিন্তু গায়ের চামড়া অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে। চুপচাপ গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। এবং আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কেমন গা শিরশিরে অনুভূতি হল হঠাৎ। আমার প্রথম বারের মত ঘুম ভাঙ্গল। এবং আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ের শার্টটা সবুজ শ্যাওলায় রীতিমত মেখে আছে। শার্টের এ দশা হবার পেছনে কোনো যুক্তি সে সময়ে দাঁড় করাতে পারিনি। তারওপর কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে যুক্তি-তর্ক- বিশ্লেষণ
– কোনোটাই খাটছিল না মাথার ভেতর। লাগছিল সবটাই খুব স্বাভাবিক। মাতালের মত বিছানা থেকে সে সময় উঠে পড়তে হয়েছে, হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছে ছেলেটা। সেটা রেখে দিতে হল। খাবার নেয়ার সময় আমার শার্টের এ অবস্থা দেখে কেমন ভাবে যেন তাকাতে লাগল ছেলেটা। কিছু জিজ্ঞেস করল না অবশ্য। বুড়ো মানুষের ভীমরতি ভাবল বোধ হয়। নামায পড়ার জন্য গোসল সেরে নেয়া উচিত। তাই আর বিছানা মুখো হলাম না। যদিও এখনো ঘুমে শরীর অবশ প্রায়। আমার দ্বিতীয় দফা ঘুম থেকে স্বপ্ন গুলো এতই জীবন্ত হতে লাগল যে আমি একবারও বুঝতে পারিনি এগুলো স্বপ্ন, এবং কোনো ধরনের প্রশ্নও জাগেনি আমার ভেতরে সে সময়। আমি গোসল সেরে নামায পড়ে শুয়ে পড়ি। খেতে ইচ্ছা করছিল না তখন। খালি পেটেই ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। ঘুমে মাতালের মত লাগছে। শুয়ে চোখ বন্ধ করা মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। প্রায় সাথে সাথে চোখ মেললাম। আমি মাদ্রাসার মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি। ছোট ছোট বাচ্চারা পাঞ্জাবী পাজামা পরে নামায পড়ছে আমার সামনের দিকে।
আমি ওদের পেছন দিকে। কেউ আমাকে খেয়াল করছে না মনে হল। তাকাচ্ছে না কেউ আমার দিকে দেখলাম। আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। চারপাশে তাকালাম। সরাসরি চোখ চলে গেল মসজিদের দান বাক্সের গায়ে লেখাটার ওপর। মসজিদের বারান্দার একটা থামের গায়ে ঝোলানো ওটা। “ হিঙ্গুলী জামিয়া মাদ্রাসা মসজিদ মেহেদীনগর, বারইয়ার হাট, মিরসরাই, চট্টগ্রাম” আমি উঠে দাঁড়ালাম। টলছি মাতালের মত। আস্তে আস্তে হেটে এলাম দান বাক্সটার সামনে। ওখানে আরো একটা নতুন কাগজ টানানো দেখলাম। “অসুস্থ মাদ্রাসা ছাত্রের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসুন” একটা ছোট নোটিস দেয়া। বোধ হয় কোনো ছাত্র অসুস্থ। আমি মানিব্যাগ বের করে একটা দশ টাকার ছেঁড়া নোট বের করলাম। টাকা ঢোকানোর ছিদ্রটা জ্যাম হয়ে গেছে। ঢোকানো যাচ্ছে না। তালাটা খোলা। এমনি ছিটকিনিটার হুকে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। চুরি টুরির ভয় নেই মনে হয়। আমি তালাটা খুলে ছিটকিনি উঠিয়ে ঢাকনাটা খুললাম। সবে মাত্র টাকাটা ফেলেছি হঠাৎ দেখলাম উঠানে গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মাথার মেয়েটা এককোনায় বসে রয়েছে! এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! ঝটকা দিয়ে জেগে উঠলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কারেন্ট আসেনি এখনো। কিন্তু ভীষণ অবাক হলাম একটা জিনিস দেখে। আমার হাতে ছোট একটা তালা! মসজিদের দান বাক্সের সেই তালাটা আমার তৃতীয় দফার ঘুমটা হল শেষ বিকেলের দিকে।
কারেন্ট এসেছে তখন। ক্যাপাসিটর নষ্ট ওয়ালা ফ্যানটা ঘটর ঘটর করে মাথার ওপর ঘুরছে। হাত দিয়ে ঘোরালে হয়ত আরো জোরেই ঘুরতো। চোখ বোজার সাহতে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এবারেও নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই মাদ্রাসাটায় আবার চলে এসেছি আমি। এবার বেশ অবাক হয়ে দেখলাম মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো একটা লাশ নেয়া খাটিয়ার চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নিচু স্বরে ফোঁপাচ্ছে কেউ। আমি মাথা উঁচিয়ে দেখলাম। কোনো ছোট বাচ্চা মারা গেছে। কাফন দিয়ে পেঁচানো। কেবল মুখটা বার করা। চার পাঁচ বছর হবে বয়েস। জানাযা পড়ানো হবে এখন। মাদ্রাসার হুজুর- আলেমরা সহ সবাই এসে সারি করে দাঁড়িয়ে পরতে বললেন। ঈমাম সাহেব লাশটাকে সামনে রেখে জানাযা পড়ানো শুরু করলেন। আমি একরকম ঘোরের মধ্যেই নিয়ত বেঁধে জানাযায় দাঁড়িয়ে গেলাম। এখানে অনেক লোকজন এসেছে। গ্রামের লোকজন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যে মারা গেছে- তার কেউ বোধ হয় আসেনি। অন্তত আসলে সেটা হাব ভাবেই প্রকাশ পেত। একবার সন্দেহ হল- বাচ্চাটা অনাথ না তো? লাশটা কবর দেয়ার জন্য মসজিদের পাশের গোরস্থানের দিকে যখন নিয়ে যাচ্ছে খেয়াল করলাম গ্রামের লোক গুলো খুব অবাক মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না। আমি নিজেও কিছুটা দ্বিধা দন্দ্বে ভূগছি। সবার সাথে আমিও কবর দিতে এলাম। প্রকৃয়াটা খুব দ্রুত হল। মাটি দেয়ার সময় কয়েক মুঠো মাটি দেয়ার পর যেই আবার মাটি নিয়েছি হাতে- দেখলাম আমার ঠিক সামনে, কবরের অন্য পাশে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা! লোকজনের আড়াল থেকে স্থির চোখে চেয়ে আছে আমার
দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবং এ দফায় আবিষ্কার করলাম আমার ডান হাতে মুঠো ভরা কাঁচা মাটি! আমার চতুর্থ ও শেষ স্বপ্নটা দেখি মধ্য রাতে। তখন জ্বর বেড়েছে ভীষণ। থেকে থেকে কাঁশছি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছি। জ্বরে সারা শরীর কাঁপছে। ঘুম আসতে সময় নিচ্ছিল তাই। কখন ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম আমি মসজিদের পাশের গোরস্থানটার একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে আছি।
আমার ঠিক সামনেই নতুন বাঁশের বেড়া দেয়া সেই কবর। আকাশে অর্ধেক চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট একটা শব্দ পাচ্ছি গোরস্থানের ভেতর। অনেকটা ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া কান্নার মতশব্দ। কিন্তু শব্দটা কেমন যেন চাপা। আমি ভয় পেলাম হঠাৎ ভীষণ রকমের একটা ভয়। হাত পা সব অসাড় হয়ে আসতে নিল- এমন একটা ভয় খুব হাচড়ে পাচড়ে এক রকম উঠে দাঁড়ালাম গাছটা ধরে। চাঁদের আলোয় কবরটার দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে উষ্ণ রক্তের একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ডের ওপর দিয়ে। আমার স্পষ্ট মনে হল কবরটা নিঃশ্বাস নেয়ার সময় যে ভাবে বুক ওঠা নামা করে- সে ভাবে বেশ জোরেই ওঠা নামা করছে! তারপর লাগল কবরের মাটিগুলো থেকে থেকে লাফিয়ে উঠে নেমে যাচ্ছে! যেন নিচ থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে বের হতে চাচ্ছে! সেই সাথে ছোট বাচ্চার ভয় পাওয়া গুমোট- চাপা কন্ঠস্বর! আমি এত ভয় পেলাম যে দ্বিগ্বীদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে গোরস্থানের মাঝ দিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। তার মাঝেই দেখলাম সেই ন্যাড়া মাথার মেয়েটা একটা কোঁদাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের নিচে। হাত তুলে সেই নতুন কবরটার দিকে যেতে বলছে ইসারায় আমাকে। হাতের কোঁদালটা দেখিয়ে বোঝাচ্ছে কবরটা খোঁড়ার জন্য আমাকে! আমি প্রচন্ড ভয়ে তখন সংজ্ঞাহীন প্রায়। পেছন থেকে আসা কবরের ধুপ ধুপ শব্দটা তাড়া করছে যেন আমাকে আমি জেগে উঠি ফযরের আযানের মুহূর্তে। আমার সারা গায়ে ধূলো বালি, মাটি আর নানান জায়গায় ছিলে গেছে কাঁটার ঘষা খেয়ে বিমূঢ়ের মত বসে রইলাম আমি আমি পেশায় সরকারী চাকুরীজীবি। টাইপিস্টের কাজ করি।
নিজের চলে না বলে বিয়ে থা আর করিনি। পঞ্চাশের মত বয়স হয়েছে বলে এখন আর ওসব করার চিন্তাও মাথায় আনিনা। একা একা থাকি বলে নানান রোগে শোকে ভূগি। ছোট বেলা থেকে এক ফুফুর কাছে মানুষ হয়েছি। তাকে টুকটাক সাহায্য করি এখন। এছাড়া আমার জগৎ খুব সীমাবদ্ধ। সে রাতের স্বপ্ন গুলো নিয়ে খুব যে ব্যস্ত হয়ে পরব এমন মানুষও নই আমি। একা থাকি বলে হয়ত মনের ভূলে এসব দেখেছি। শার্ট, তালা, মাটি- এসবের ব্যাখ্যা মনের ভূল বলেই হয়ত চালিয়ে দিয়ে ভূলে যেতাম পুর ব্যাপারটা। কিন্তু নিছক স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি আমি সেটাকে। ৩১ জুলাইয়ের বিচিত্র ঘটনা গুলো আমার পক্ষে ভূলে যাওয়া সম্ভব হল না পত্রিকায় একটা লেখা দেখে। ৩রা আগস্টের একটা পত্রিকায় “হিঙ্গুলী মাদ্রাসা গোরস্থানে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে জীবন্ত কবর দেয়া হয় ভূল বশত” শিরোনামে একটা আর্টিক্যাল চোখে পড়ে আমার। সব ওলোট পালট লাগতে শুরু করে তখন। কারণ সেখানে বলা হয়েছেঃ ৩১ জুলাই বিকালে জুবায়ের আলী নামের এক ছোট পাঁচ বছরের মাদ্রাসা ছাত্র মারা যায়। স্থানীয় ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করার পর বাদ আসর তাকে মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে কবর দেয়া হয়। পরদিন ভোরবেলা ফযরের নামায শেষে ঈমাম সাহেব কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখেন কবরের মাটি সরে গেছে অনেক। যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেয়েছে। তাঁর সন্দেহ হলে স্থানীয় লোকজন দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় এবং সবাই বাক রুদ্ধ হয়ে দেখে কবরের কোনায় সাদা কাফন পরে ছেলেটা বাঁকা হয়ে বসে আছে। তার বসে থাকার ভঙ্গিটা খুব অস্বাভাবিক। কবরের দেয়াল জুরে ছেলেটার আঙ্গুলের আচোঁড়ের চিহ্ন। শ্বাস নিতে না পেরে দেয়াল খাঁমচে বের হবার চেষ্টা করেছিল বোঝা যায়। চোখ গুলো কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায়। পা দিয়ে কবরের মেঝে ঘষে লম্বা লম্বা খাঁজ করে মাটি উঠিয়ে ফেলেছে ভয়াবহ মৃত্যু যন্ত্রণায়! আমি এই ঘটনা জানার পর টাকাপয়সা জমিয়ে সেই গ্রামে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন পর। সেখানে গিয়ে আমি আরো কিছু ধাঁধাঁর মাঝে পড়ে যাই।
চিনকী আস্তানা স্টেশনটা বেশ নির্জন। যখন ওখানে ট্রেনটা গিয়ে থামল তখন রাত সাড়ে দশটার মত বাজে। বাহিরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার- তার মাঝে টিপটিপিয়ে বৃষ্টি। ছাতা আনা হয়নি। ব্যাগ হাতে প্লাটফর্মে নামার সাথে সাথে ভেজা শুরু করলাম। লোকাল ট্রেনে করে এসেছি বলে স্টেশনের বৃষ্টিতে নামা মাত্র মনে হল একটু শান্তি পেলাম। এতক্ষণ ট্রেনের টয়লেট বিহীন কামড়ায় মুরগীর খাঁচার মত অবস্থায় ছিলাম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে বেশি সেটা লোকাল ট্রেনে উঠলেই বোঝা যায়। ঘামে পাঞ্জাবী পিঠের সাথে লেগে গেছে। বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা গুলো গায়ে লাগতেই মনে হচ্ছে শান্তিতে ঘুম এসে যাবে। ব্যাগ হাতে হাটতে লাগলাম। হিঙ্গুলী গ্রামটা এখান থেকে আরো মাইল খানেক উত্তর-পূর্ব দিকে। এত রাতে সেখানে যাওয়াটা সামান্য ঝামেলার মনে হল। একে তো ইলেক্ট্রিসিটি নেই এ অঞ্চলটায়, তার ওপর রাত দশটার পর রিক্সা-ভ্যান কোনোটাই যাবে না। স্টেশন মাষ্টার আক্ষরিক অর্থেই মাছি মারা কেরানী গোছের লোক। দশটা প্রশ্ন করার পর একটা জবাব দেন। যাওবা দেন সেটা কাজে লাগার মত না। মাষ্টার সাহেব ম্যাচের কাঠি দিয়ে খুব যত্নের সাথে কান খোঁচাচ্ছিলেন আমি যখন তার অফিসে ঢুকি। কেবল একটা হারিকেন জ্বলেছে। ময়লা হারিকেনের তেল যাই যাই অবস্থা, আলোই নেই। “আসসালামুয়ালাইকুম, ভাই- হিঙ্গুলী গ্রামটায় যাওয়ার নিয়মটা বলতে পারবেন? এখানের কোনো রিক্সা- ভ্যান যাবে না বলছে।
“উঁ?” “হিঙ্গুলী যাওয়ার ব্যবস্থাটা কি?” ভাবলাম শুনতে পায়নি, তাই আবার বললাম। “ঊঁ?” আবারো কোনো জবাব না দিয়ে বিদঘূটে শব্দ করলেন। “ভাই আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।” সামান্য উষ্ণ গলায় বললাম। কান চুলকাতে চুলকাতেই বেদম জোরে কেঁশে উঠলেন মাষ্টার সাহেব। ম্যাচের ভাঙ্গা কাঠিটা চোখের সামনে এনে বিরক্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। বাকি অংশটা কানের ভেতরে আটকা পড়েছে বোধ হয়। দেখলাম মাথা একপাশে কাত করে বার কয়েক ঝাঁকি দিলেন। আমি গলা খাকারি দিলাম,
“ ভাই? হিঙ্গুলী” হাত তুলে থামিয়ে দিলেন, “ যে কোনো ভ্যান ধরে উইঠা যান, লয়া যাইবো। এখানে খাঁড়ায়া লাব নাই।” একটা চিমটা বের করে কানের কাঠি নিয়ে ব্যস্ত
হয়ে পরলেন। বোঝাই গেল ভাঙ্গা কাঠি প্রায়ই কানে আটকা পড়ে তার, এবং সেটা উদ্ধার কাজেও সিদ্ধ হস্ত। কারণ আমি থাকা অবস্থাতেই কাঠিটা টেনে বের করলেন। মুখে প্রশান্তির হাসি। আমি বেরিয়ে এলাম বিরক্ত হয়ে। হাত ঘড়িতে রাত এগারোটা দশ বাজে। বৃষ্টির পরিমান বেড়েছে আরো অনেক। এ বয়সে ভিজলে জ্বর আসতে সময় নেবে না। হিঙ্গুলী গ্রামটায় পৌছানো জরুরী। আগে যদি বুঝতাম এত রাত হবে, তাহলে আরো সকাল সকাল করে বের হতাম। ভ্যান- রিক্সা কোনোটাকেই রাজী করাতে পারলাম না শত চেষ্টার পরেও। শেষে মহা বিরক্ত হয়ে স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম সকাল হবার। এর বেশি আর কিছু করার নেই আমার। রাত যত গভীর হয় স্টেশন তত বিচিত্র ভাবে জেগে উঠতে থাকে। গাঁজা আর জুয়ার আড্ডা বসল সামনে একটা প্লাটফর্মে। ট্রেন আসলে স্টেশনটা জীবন্ত হয়, নয়ত মরার মত পড়ে থাকে। গাঁজার আড্ডায় গান ধরেছে কয়েকজন, তাস খেলা চলছে। আমি দেখছি তা এক সময় ঝিমানির মত শুরু হল গাঁজার আড্ডার গানটা কানে বাজছে ক্রমশ চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে লাগল দূরে কোথাও ঘন্টা বাজছে অদ্ভূত শোনাছে শব্দটা মনে হচ্ছে অনেক লোকজন কথা বলছে তার মাঝ দিয়ে গানটা ঘুর পাঁক খাচ্ছে মাথার ভেতর “বলেছিলে আমার হবে মন দিয়াছি এই ভেবে সাক্ষি কেউ ছিলনা সে সময়” চোখ মেললাম যখন- তখন প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই গোরস্থানের গাছটার নিচে! যেখানে নিজেকে পেয়েছিলাম জুলাইয়ের ৩১ তারিখে! ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে গোরস্থানের ভেতর দিকে চার্জার লাইটের আলো। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ঠিক সামনেই আবছা ভাবে সেই বাচ্চা ছেলেটার কবরের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে। আমার হৃদপিন্ডটা অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। চার্জারের আলো আসছে আরো ভেতরের দিক থেকে। আমি প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে দ্বিধান্বিত পায়ে হাটতে লাগলাম আলোটার দিকে। পায়ের নিচে প্যাঁচ প্যাঁচে কাঁদা। বার কয়েক পুরনো কবরে পা ঢুকে যেতে যেতে সামলে নিলাম। গাছ গুলোর অন্য পাশ থেকে আলো আসছে, তাতে বেশ কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা করছে সবাই। সবার হাতে ছাতা, ছাতার জন্য
বোঝা যাচ্ছে না কি করছে তারা। আমি এগোতে এগোতে টের পেলাম অসম্ভব একটা ভয় ভেতরে দানা বাধতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে যতই এগোচ্ছি, ভয়টা ততই বাড়ছে চার্জারের আলো ভেবেছিলাম যেটাকে এতক্ষণ- কাছে আসায় স্পষ্ট হল, হ্যাজাক বাতি। সাদা কাপড় পরা বেশ কিছু লোক ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমি আর হাটতে পারছিলাম না, একটা গাছে হেলান দিয়ে কোনো মতে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে দেখলাম একটা লাশের দাফন কাজ চলছে। দুজন লোক একটা নতুন খোঁড়া কবরে নেমেছে। ওপর থেকে কাফন পরা লাশটা নামিয়ে ওদের হাতে দিচ্ছে লোক গুলো। কেউ একজন জোরে জোরে দরুদ পাঠ করছে সুর করে। আমি টলতে টলতে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ছাতা হাতে ওরা কেউই আমাকে লক্ষ করছে না। হ্যাজাকের আলোয় দেখলাম কবরের ভেতর জমে ওঠা পানির মাঝে কাফন পরা লাশটাকে উত্তর
– দক্ষিণ মুখ করে নামাচ্ছে লোক দুটো। লাশটার দৈর্ঘ্য দেখেই অনুমান করলাম বয়ষ্ক, বড় মানুষের লাশ। কবরের পানিতে রাখা মাত্র কাফন ভিজে অনেকখানি ডুবে গেল লাশটা। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ভয়টা ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে শুধুই। তীব্র একটা ভয়। কেউ একজন বলল, “লাশের মুখ শেষবারের মতন দেখবেন কেউ? নাইলে বাঁশ লাগায় দিক।” দেখলাম কেউ মুখ দেখার মত আগ্রহ দেখাল না। লোক দুটো কবরের ওপর আড়া আড়ি বাঁশ দেয়া শুরু করল। দ্রুত চাটাই বিছিয়ে ঢেকে ফেলল কবরের ওপরটা। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি দেয়া শুরু করল লোক গুলো। আমি বসে পড়েছি মাটিতে। কেউ লক্ষ করছে না আমাকে। কিন্তু হ্যাজাকের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম কবরের অন্য পাশে ছাতা ওয়ালা লোক গুলোর ভীড়ে সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে! শীতল শান্ত চোখ দুটোয় ক্রুড়ো একটা দৃষ্টি। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে তখনি মাথার ভেতর তীব্র ব্যথা শুরু হল আমার! মনে হল কেউ যেন আমার মগজটা ধারাল ক্ষুর দিয়ে পোঁচ দিচ্ছে ঝটকা দিয়ে জেগে উঠলাম। আমার দু পা আর প্যান্টের নিচের দিক কাঁদায় মেখে আছে! ঘড়িতে দেখলাম- রাত আড়াইটা বাজে। ট্রেন এসেছে স্টেশনে। জীবন্ত মনে হচ্ছে রাতের মৃত এ স্টেশনকে এখন। কতক্ষন জীবন্ত থাকবে? আমার হিঙ্গুলী গ্রামে আসাটা যে বিরাট একটা ধাক্কা দিয়ে শুরু হবে জানা ছিল না। আমি পরদিন সকাল বেলা একটা চা দোকানে পাউরূটি আর কলা খেয়ে রওনা দিলাম ভ্যানে করে হিঙ্গুলীর দিকে। তবে তার আগে ওয়েটিং রুমে গিয়ে কাঁদা মাখা প্যান্টটা বদলে নিলাম। সকালে ভ্যান ওয়ালারা কেউ ‘না’ বলল না, বলা মাত্রই আমাকে নিয়ে রওনা দিল। হিঙ্গুলী যাওয়ার পথটা পাঁকা না, কাঁচা রাস্তা। তারওপর বর্ষা কাল বলে রাস্তা ঘাটের করুণ অবস্থা। ভ্যান একেকবার এমন কাত হয়ে যাচ্ছে যে মনে হয় তখন সোজা গিয়ে কাঁদার ওপর পড়বো! হিঙ্গুলী প্রামে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট খাট ধাক্কার মত খেলাম। আমি শৈশবে যে গ্রামটায়
মানুষ হয়েছিলাম অবিকল সেই রকম গ্রাম এটা। ধাক্কাটা যে কারণে খেলাম তা হল- আমি যেখানে, যে রকম বাড়ি, গাছপালা, সাঁকো, রাস্তা দেখেছি আমার শৈশবের গ্রামে- এখানে ঠিক সে রকম- হুবহু এক! কোথাও কোনো অমিল নেই! অবাক হবার কারণটা হল আমার শৈশবের গ্রামটা দিনাজপুরে! আর এটা চট্টগ্রামে। “হিঙ্গুলী” গ্রামটা আমার জন্য বেশ কিছু রহস্য নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার প্রথমটার সাথে সাক্ষাত হল গ্রামে ঢোকা মাত্রই। হিঙ্গুলী মাদ্রাসার মোয়াজ্জ্বেনের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেল গ্রামে ঢুকেই। বাজারে যাচ্ছিলেন সম্ভবত। এখানে থাকার মত কোনো হোটেল কিম্বা বোর্ডিং আছে নাকি আর মাদ্রাসাটা কোন দিকে তাকে জিজ্ঞেস করার জন্য আমি ভ্যান থেকে সবে নেমেছি – আমাকে নামতে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন! কিছু বোঝার আগেই চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালালেন! আমি ব্যাপারটা বোঝার জন্য কাউকে যে জিজ্ঞেস করব তা সম্ভব হল না- গ্রামের কেউ আমাকে যে’ই দেখছে এখন- সবাই ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে! আমি ভীষণ অবাক হলাম। এক রকম হতভম্ব! আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে এমন? ভ্যান ওয়ালা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ ফালাইলো ক্যান বাই?” আমি বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়ালাম, “জানি না, আপনি মাদ্রাসায় চলেন।” আমি ভ্যান ওয়ালাকে নিয়ে মাদ্রাসাটা খঁজে বের করলাম। আমার স্বপ্নে দেখা মাদ্রাসাটার সঙ্গে খুব একটা মিল নেই। পুকুরটা বেশ ছোট, পানিও পরিষ্কার।
শ্যাওলা নেই। তবে মিলও রয়েছে। মসজিদের সেই বারান্দা অবিকল এক। এখানে এসেই আমি প্রথম রহস্যটার সাথে জড়িয়ে পড়ি। মাদ্রাসার প্রধান ঈমাম মোহাম্মদ ইদ্রীস শেখের সঙ্গে পরিচয় যখন হল তিনি আমাকে দেখে অবাক হলেন ঠিকি, কিন্তু ভয় পেলেন না। মাদ্রাসার শত শত ছাত্র ততক্ষণে আমাকে দেখতে চলে এসেছে। মসজিদের বারান্দায় বসে আমি প্রথম ইদ্রীস সাহেবের কাছে জানতে পারলাম- আমি “মোঃ নজরুল হোসেন” গত চার দিন ধরে এই হিঙ্গুলী মাদ্রাসায় ছিলাম! এবং গত কাল বিকেলে আমার মৃত্যু হয়েছে- মৃত্যুর আগে আমি বলে গেছি এখানের গোরস্থানে আমাকে কবর দিতে। এবং আমার ফুফুর জন্য চিঠিও লিখে গেছি আমি! গত রাতে আমাকে তারা সবাই কবর দিয়েছে গোরস্থানে! আমি মসজিদের বারান্দায় বসে ঘোরের মধ্যে সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়লাম যেটা ‘আমি’ ঈমাম সাহেবকে দিয়েছি আমার ফুফুকে দিতে! আমার’ই হাতের লেখা! আমি কাঁপতে শুরু করলাম মৃগী রোগীর মত। সে অবস্থাতেই আমি কবরটা খুঁড়তে অনুরোধ করলাম ঈমাম সাহেবকে। বলা বাহুল্য আমি বলার আগেই কবর খোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। মোয়াজ্জ্বেন সহ আরো কয়েকজন লোক কবরটা খুঁড়লো। আমি নিজে সেখানে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। তাই ঈমাম সাহেব আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন সেখানে। এটা সেই জায়গা, গত কাল রাতে স্বপ্নে যেখানে আমি কবর দিতে দেখেছিলাম
কাউকে! দিনের বেলা সূর্যের আলোতেও আমার ভয়ংকর একটা অশুভ ভয় করছিল কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে। কাঁদা আর পানিতে অর্ধেক ডুবে আছে কাফন জড়ানো লাশটা। কবরের ভেতর অনেক পানি। একজন লোক নামল কবরে মুখ দেখানোর জন্য। মুখের কাপড় সরানোর পর যাকে দেখলাম- আয়নায় একে আমি বহুবার দেখেছি- আমি, মোঃ নজরুল হোসেন। কাঁদা লেগে থাকলেও না চেনার কোনো কারণ নেই আধ খোলা চোখে পৃথিবী দেখছে কবরের পানিতে ভাসতে ভাসতে। নিজের পায়ের ওপর ভর টিকিয়ে রাখতে পারলাম না আর এ যদি নজরুল হোসেন হয়, তাহলে আমি কে? আর আমিই যদি আসল জন হয়ে থাকি- তবে এ কে? আমি সেদিন গোরস্থানে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারাই। ঈমাম সাহেব উপায় না দেখে আমাকে মস্তান নগর হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে আমি প্রচন্ড জ্বরের মাঝে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তিন দিন ছিলাম। অবশ্য টানা তিন দিন অজ্ঞান থাকিনি। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরতো।
কিন্তু বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারতাম না। প্রচন্ড ভয় আর জ্বরের ঘোরে বার বার জ্ঞান হারাতাম। বলা বাহুল্য এই দীর্ঘ সময়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে। কিন্তু প্রতিটাই একটার সাথে আরেকটা যুক্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল এই দীর্ঘ সময়ে আমি নাকি কিছুই খাইনি। আমার ঠিক মনে নেই কখন স্বপ্ন দেখা শুরু করি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। কেবল মনে আছে প্রথমবার হঠাৎ করেই আমার নাকে মুখে পানি ঢোকা শুরু করে। মাথায় যেতেই ভীষণ জোরে কেঁশে উঠে চোখ মেলে তাকাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে! আমি পানির ভেতরে রয়েছি অর্ধেক! ভেসে আছি পানিতে! অবাক হয়ে চারপাশে হাত বুলাতে লাগলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাটু পানি জমে থাকা একটা ছোট ঘরের ভেতর। সেটা যে একটা কবর বুঝতে সময় লাগল আমার। জায়গাটা কবর কারণ মাথার ওপরে হাত দিতেই বুঝলাম শক্ত বাঁশের টুকরো দিয়ে ঢেকে দেয়া। চার কোনা আয়তাকার ছোট একটা ঘরের মত। হাটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছি। উঠে দাঁড়ানো যায় না, মাথা লেগে যায় বাঁশের ছাদের সাথে। ওপরে ছাদ মাটি দিয়ে ঢেকে থাকায় সমস্ত গায়ের শক্তি দিয়েও ধাক্কা দিয়ে বাঁশের পড়ত গুলো সরাতে পারলাম না। তবে অবাক হবার বিষয় হলঃ আমি এক সময় খেয়াল করলাম আমার গায়ে কাপড় বলতে একটুকরো থান কাপড়। কি রঙের সেটা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারলাম কাপড়টা বেশ লম্বা। আমি অজানা একটা ভয় পেতে শুরু করলাম। কারণ যতই সময় যেতে লাগলো, মনে হল আমি দম নিতে পারছি না
বাতাসের জন্য ফুসফুসটা আঁকু পাঁকু করা শুরু করেছে আমি পাগলের মত মাথার ওপরের ছাদটা ধাক্কা মেরে ওঠাতে চাইলাম। কিন্তু একটু নড়েই স্থির হয়ে গেল। আমি আবারও ধাক্কা দিতে লাগলাম। শক্তি কমে আসছে শরীরের ধাক্কা দিয়ে একচুলও নড়াতে পারছি না আর। মনে হল কবরের ওপর খুব ভারী কিছু একটা জিনিস চাপিয়ে দেয়া হল আমার ভয়টা দ্রুত আতংকে রুপ নেয়া শুরু করল। আমি অক্সিজেনের জন্য দেয়াল খাঁমচাতে লাগলাম, আচঁড়াতে লাগলাম পাগলের মত
পানিতে পা ছুড়তে লাগলাম পশুর মত তার মাঝেই খেয়াল করলাম এই ঘুটঘুটে অন্ধকার কবরের অন্য মাথায় কেউ একজন বসে আছে কেবল অবয়বটা বোঝা যায় অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম সেই ন্যাড়া ফ্যাকাসে মেয়েটা জ্বলন্ত অঙ্গার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির হয়ে বসে আছে কবরের পানির মাঝে আমি জান্তব একটা চিৎকার করে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য দেয়াল খাঁমচাতে লাগলাম। কিন্তু ফুসফুসের বাতাস ফুরিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে পানিতে ডুবতে শুরু করেছি এখনো মেয়েটা আমার দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছে গভীর রাতে জ্ঞান ফিরল আমার। হাসপাতালের সব বাতি নেভানো। তারপরও বুঝতে পারলাম আমার সারা শরীর কাঁদায় লেপ্টে আছে। আমার নাকে মুখে কাঁদা পানি কেঁশে উঠলাম। মাথা জ্বালা করছে প্রচন্ড। পাগলের মত বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলাম। আহা! বেঁচে থাকাটা কত অদ্ভূত! আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসলাম। আমি এখন জানি- হিঙ্গুলী মাদ্রাসা গোরস্থানে কাল সকালে আবারো খোঁড়া হবে “মোঃ নজরুল হোসেন”
-এর কবরটা। কারণ সেটার ওপর থেকে মাটি সরে গেছে অনেকখানি। আর অনেকেই একটা চিৎকার শুনেছে আমি শুয়ে পড়লাম ধীরে ধীরে। ভয় লাগছে ভীষণ। কেন যেন মনে হচ্ছে হাসপাতালের অন্ধকার করিডোরে, জানালার পর্দার ওপাশ থেকে সেই ন্যাড়া- ফ্যাকাসে মেয়েটা শীতল শান্ত চোখে আমার প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ করছে আমি তখনো জানতাম না আমার জন্য আরো কিছু অপেক্ষা করছে
আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারলাম না। জ্বরটা লেগেই থাকল। জ্বরের কাঁপুনি নিয়েই হাসপাতাল ছাড়লাম। সাথে টাকা পয়সা তেমন ছিল না যে আরো কিছুদিন হাসপাতাল-ওষুধের খরচ চালাবো। ঈমাম ইদ্রীস শেখের কাছে আমি কৃতজ্ঞ- কারণ শেষের দিকের প্রায় সব খরচ’ই উনি দিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে ওখানে থাকাটাও সম্ভব ছিল না। টাকা পয়সার টান পড়তেই বাধ্য হলাম শহরে ফিরে আসতে। অবশ্য চলে আসার আগে মাদ্রাসায় একদিন ছিলাম। ইদ্রীস সাহেবের সঙ্গে সে সময়টায় আমার অনেক কথা হল। সে সময় তাঁকে জানালাম এখানে আমার আসার কারণ সম্পর্কে। যদিও তিনি আগে থেকেই জানেন আমি কেন এসেছি এখানে। কারণ অন্য “নজরুল হোসেন” তাঁকে নাকি সব বলেছিল।
“সে” স্বপ্ন দেখে তার সত্যতা যাচাই করতে এসেছিল। তবে ঈমাম সাহেব সে সময় তাকে যা বলেছিলেন- তা আমি জানতাম না, তাই নতুন করে আমাকে তিনি বলা শুরু করলেন। সে রাতে খাওয়ার পর ঈমাম ইদ্রীস শেখ মসজিদের বারান্দায় আমার সাথে বসে অনেক গল্প করলেন। চারপাশে নিরেট ঘন অন্ধকার। কেবল বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বলছে। মাদ্রাসার ঘর গুলোর দু- একটা থেকে ছাত্রদের আরবী পড়ার মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। বাকিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আলো নেই সে সব ঘরে। রাত তখন সাড়ে এগারোটার মত। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে, এখন আর হচ্ছে না, তবে হালকা বাতাস এদিক সেদিক থেকে দু- এক ফোঁটা বৃষ্টির ছটা উড়িয়ে এনে গায়ে ফেলছে। ইদ্রীস সাহেব মুখে সবে পান পুড়েছেন। বারান্দায় হেলান দিলেন দেয়ালে। আমার দিকে তাকিয়ে সমবেদনার সুরে বললেন, “আমি বুঝতে পারতেছি আপনে অনেক পেরেশানির মধ্যে আছেন। আল্লাহ পাক কাকে কখন কি পরীক্ষায় ফালায়- তিনিই কইতে পারেন কেবল।” আমি নড়ে চড়ে বসলাম। শীত লাগছে। গায়ে একটা চাঁদর দিয়েও শীতে পোষ মানছে না। জ্বরটা ভাল মত জাকিয়ে বসেছে হাঁড়ের ভেতর। সামান্য দ্বিধা মেশানো গলায় বললাম, “আমি এখনো বুঝতে পারছি না আমার পরিচয়ে কে এসেছিল এখানে? আর সেই ফ্যাকাসে ন্যাড়া মেয়েটাই বা কে? কেন আমি বার বার তাকে দেখি? গত পঞ্চাশ বছরেও আমার এরকম সমস্যা ছিল না- নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ আমি। কারো ক্ষতিও করিনি কখনো।” ঈমাম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না। দীর্ঘ একটা গুমোট নীরবতা। বৃষ্টি থামায় দু- একটা ঝিঁ ঝিঁ পোঁকা এখান- ওখান থেকে চাপা স্বরে ডাকা শুরু করেছে। আমি বাহিরের ঘুট ঘুটে কালি গুলে দেয়া অন্ধকারের মাঝ দিয়ে গোরস্থানের দিকে তাকালাম। কিছু বোঝা যায় না। শুধু অদ্ভূত একটা ভয় উঁকি দেয় মনের ভেতর। মিলিয়ে যায় না সেটা। ঈমাম সাহেব কেঁশে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলেন, “আপনে জিজ্ঞাস করছিলেন জুবায়ের আলীর কোনো বোইন আছিল নাকি?”
“আমি?” অবাক হয়ে তাকাল, “কখন?” “না মানে আপনে না, আপনের আগের জন।” “কি বলেছিলেন জবাবে?” “কেউ ছিল না। জুবায়ের এতিম ছেলে। মা, বাপ, ভাই-বোইন কেউ আছিল না। তিন বৎসর বয়স যখন তখন থেইকা এই মাদ্রাসায় ছিল। বলতে পারেন এই মাদ্রাসার ছেলে।” একটু বিষাদ মেশানো কন্ঠে বললেন। আমি কিছু বললাম না। চুপ হয়ে বসে আছি। ইদ্রীস সাহেব আপন মনেই বলতে লাগলেন, “জুবায়ের খুবই শান্ত কিসিমের ছেলে আছিল। একদম কথা বার্তা বলত না। এই পাঁচ বছর বয়সেই পুরা অর্ধেক কুরান মুখস্ত করে ফেলছিল!” আনমনেই বললাম, “তাই নাকি?” “হ্যা ভাই। খুবই ভাল স্বরণ শক্তি আছিল ছেলেটার। একটা আজব খেয়াল আছিল ওর। সারা দিন রাত গোরস্থানের ভিতর গিয়া নতুন কবরের নাম, তারিখ, সাল- মুখস্ত করত।” আমি অন্য মনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম। কথাটা কানে যেতেই ঝট করে সোজা হয়ে বসলাম। শিরদাঁড়া পুরো টান টান, “কি বললেন?” “ইয়ে- কবরের নাম, তারিখ, সাল মুখস্ত করত।” একটু অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি বেশ বিষ্মিত মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “ মানে? মুখস্ত করত?” “জী ভাই।
আরো একটা কাজ করতো- কবরের পাশে বসে কান পাইতা থাকত, যেন কিছু শুনবার চেষ্টা করতেছে।” আমি স্থির দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মূর্তির মত দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নড়লাম না। “ভাই? কী ভাবতেছেন?” অবাক গলায় বললেন ইদ্রীস সাহেব। আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথায় বিচিত্র একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে তখন। আমি ঠিক জানি না আমি যেটা ভাবছি- সেটা ঠিক কিনা। কিন্তু আমার যুক্তিতে সব খাঁপে খাঁপে মিলে যাচ্ছে
আমি সে রাতটা মসজিদের বারান্দায় শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। এক মুহূর্তের জন্য দু চোখের পাতা এক করলাম না। কারণ ঘুমালেই আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করবো। আমার জেগে থাকা এখন ভীষণ দরকার। ভীষণ। জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার গোরস্থানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম সারা রাত। অপেক্ষা করতে লাগলাম সূর্যের জন্য। অজানা আশংকায় বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা পাগল হয়ে গেছে। আমি পরদিন খুব ভোরে চলে আসি রেল স্টেশনে। আসার আগে ফযরের নামাজ শেষে বিদায় নেই ঈমাম সাহেবের কাছ থেকে। আমাকে এগিয়ে দিতে তিনি রেল স্টেশন পর্যন্ত এলেন। ভদ্রলোক বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বিদায় জানালেন। বহুকাল মানুষের এমন গভীর ভালবাসা পাইনি। খারাপ লাগল কেন জানি। আসার আগে তাঁকে বললাম, “ ভাই, একটা কথা বলি?” “অবশ্যি বলেন ভাই।”
“আমাকে পাগল ভাববেন না। কথাটা শুনলে পাগল মনে হতে পারে আমাকে।” স্টেশনের প্লাটফর্ম দিয়ে হাটতে হাটতে বললাম। ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে। “কি কথা?” বেশ অবাক হলেন। “জুবায়ের আলী নামের সেই ছেলেটার ছবি আর বর্ণনা দিয়ে পত্রিকায় একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি দেন। ছেলেটাকে খুঁজে পাবেন আমার মনে হয়।” ঈমাম সাহেব এমন ভাবে তাকালেন যেন আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে তাঁর কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলাম, “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন ভাই, আমি বুঝে শুনে কথাটা বলেছি আপনাকে।” ট্রেনের বাঁশি দিল। আমি দরজার হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়লাম। ঈমাম ভদ্রলোক তখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্লাটফর্মে। ট্রেনটা ছেড়ে দিল। ঈমাম সাহেবের সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা।