দোসর

দোসর

অনির্বাণের কেবিনে দাঁড়িয়ে সেদিনের কথা ভাবছিলাম। অবশ্য দাঁড়িয়ে ঠিক নয় তবে রয়েছি। আজ থেকে ঠিক এক বছর তিন দিন আগেকার কথা। ষ্ট মনে আছে। আর মনে থাকবে নাই বা কেন? আমি এখন অতীতকে সিনেমার মত স্পষ্ট দেখতে পাই। সেদিনটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের পিছনে আমি। ম্পিডোমিটারের ডিসপ্লেতে গাড়ির গতি ঘন্টায় পচানব্বই কিলোমিটার দেখাচ্ছে। ছোউ লাল মারুতি কে-টেন গাড়িটা যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। একদম সোজা মসৃণ রাস্তা অনেকদূর অব্দি দেখা যায়, আমি শুধু স্টিয়ারিং-এ হাত আর এক্সেলেটরে পা দিয়ে বসে আছি। চার লেনের হাইওয়েতে আমার ডানপাশের দুটো লেন দিয়ে হুশ হুশ করে গাড়ি বেরিয়ে যেতে দেখে আমাদের গতিটা বোঝা যাচ্ছে নয়তো একটা মৃদু কম্পন ছাড়া গাড়ির ভেতরে গতির কোন আভাস নেই। কাঁচ বন্ধ থাকায় বাইরের আওয়াজ বা হাওয়া কিছুই ঢুকছে না। আমার বাঁ দিকে সানগ্লাস চড়িয়ে বসে আছে অনির্বাণ আর পিছনের সিটে ওর সহধর্মিণী অর্পিতাযাচ্ছি তারাপীঠে পূজো দিতে। অনির্বাণ নতুন গাড়ি কিনেছে সেই উপলক্ষেই যাওয়া। গত পরশু শুক্রবার হঠাৎ করে ফোন করে অনি বলে কি ‘তোর এই রবিবার কোন কাজ আছে?” আমি যে গাড়ির শোরুমে কাজ করি সেটা রবিবার বন্ধ থাকে তাই রবিবার আমার ছুটি।

বিয়ে থা করিনি, দাদার সংসারে থাকি। কোন পিছুটান নেই তাই মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক চলে যাই ঘুরতে তবে এই রবিবার সেরকম কোন প্রান ছিল না।

বললাম
“হ্যাঁ ফাঁকাই আছি, কেন?”

ও বলল “চল তারাপীঠ যাবো পূজো দিতে। গাড়ি কিনলাম পূজো না দিলে হয়? আর এই ছুতোয় লং ড্রাইভও হয়ে যাবে। তাছাড়া তুই গেলে অতদূরের রাস্তায় একটু ভরসাও পাই আর একা ড্রাইভ করতেও হবে না”।

আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমি বেশ ড্রাইভিং জানি। পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিলাম না। তাই গ্রাজুয়েশন এর পর চাকরি বাকরির সুবিধা করতে না পেরে একটা গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ড্রাইভিং শিখে একটা পুরনো মারুতি ওমনি গাড়ি কিনে ভাড়া খাটাতাম। কিন্তু কয়েক বছর চালিয়ে আর ভাল লাগছিল।  না। রোজগার খুব বেশি কিছু হত না অথচ ঝঙ্কাট ছিল। রাত বিরেতে লোকে ডাকাডাকি করত। কাউকে হয়ত মাঝরাতে প্লেন ধরাতে হবে বা কাউকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। তাই অনেকদিন ধরেই অন্য কিছু করার কথা ভাবছিলাম। তারপর এই চাকরিটা পেয়ে গেলাম।

গাড়ি চালানোর সূত্রে যেখানে চাকরি করি সেই শোরুমের মালিকের সাথে পরিচয় ছিল, তিনিই অফারটা দিতে আর না করিনি। এখন আমি চাকরিও করি আর পাশাপাশি একটা ছেলেকে দিয়ে গাড়িটা ভাড়াও খাটাই। ভালোই চলে যাচ্ছে। অনির্বাণ কিন্তু পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। স্কুলে একসঙ্গে পড়ছি তারপর ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল। সেখান থেকে পাস টাশ করে এখন মোটা মাইনের চাকরি করে।

দুজনের রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেলেও আমাদের বন্ধুত্বটা অবশ্য একই রকম রয়ে গেছে। আগে অনির একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি ছিল সেটা বিক্রি করে এই গাড়িটা। নতুন কিনল আমাদের শোরুম থেকে। পরিকল্পনা মাফিক রবিবার সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম। বেশ পিকনিক পিকনিক লাগছিল। একে ডিসেম্বর মাস তায় আবার লং ড্রাইভ। ভালোয় ভালোয় তারাপীঠও পৌছে গেলাম। পূজো টুজো দিয়ে একটু আশেপাশে ঘুরলাম। অনেকদিন পর নির্ভেজাল আন্ডা দিয়ে দিনটা ভালোই কাটল। বিকেল নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ওখান থেকে। অনেকটা রাস্তা তাই পালা করে গাড়ি চালানো হবে। আসার সময়েও সেই ভাবেই এসেছি। প্রথমে আমিই চালালাম। হিসেব করে দেখলাম রাত নটার মধ্যে বাড়ি পৌছে যাবে। শীতটাও বেশ পড়েছে।

রোদের তেজ নেই। হাইওয়ে দিয়ে চলেছি, দুদিকে ক্ষেত। দূরে ক্ষেতের সঙ্গে যেখানে আকাশটা মিশেছে সেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে আর ক্ষেতের ওপর একটা ধোঁয়ার আস্তরণ অনুভূমিক ভাবে ছেয়ে আছে। আকাশটা কমলা হয়ে হয়ে দৃশ্যটা দারুণ লেগেছে।

অর্পিতা দেখে বলল “ওয়াও কি সুন্দর, ওই দূরে যে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে ওখানে যদি আমাদের একটা বাড়ি থাকত তাহলে দারুণ হত” অনিৰ্বাণ হেসে জবাব দিল- “হ্যাঁ এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই যদি থাকতে হত তখন বুঝতে।”

অর্পিতা  বলল- “রোজ কেন থাকতাম? মাঝে মাঝে এসে দুদিন থেকে যেতাম” বলে গাড়ির জানলা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের ছবি তুলতে লাগল। তখনও জানি না এত সুন্দর একটা ট্রিপ ওরকম ভাবে শেষ হবে।

শীতকালের সন্ধ্যা হঠাৎই ঝুপ করে নেমে গেল। অনিৰ্বাণ একটা ধাবা দেখে দাঁড়াতে বলল। বলল “চ একটু কফি টফি খেয়ে নি, সাথে যদি সিঙ্গারা বা পাকোড়া পাওয়া যায় তাহলে ভালোই হয়।” অনিৰ্বাণ খেতে খুব ভালোবাসে আর আমিও অনেকক্ষণ গাড়ি চালাচ্ছি এবার একটু পালা বদল করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড় করলাম। সেখানে কফি ও গরম গরম সিঙ্গারা খেয়ে আবার রওনা হলাম।

এবার অনির্বাণ স্টিয়ারিংয়ে, আমি ওর পাশে আর অর্পিতা পিছনের সিটে এলিয়ে বসে পড়ল। এখন বাইরে অন্ধকার আর কোন দৃশ্য দেখার নেই। ইতিমধ্যে ছটা বেজে গেছে, আর ঘন্টা তিনেক লাগবে। যদি জ্যাম না থাকে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। আমরা সবাই চুপচাপ। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি, সারাদিনেও অনেক ধকল গেছে, তিনজনেই বেশ ক্লান্ত। বেশ গতিতেই গাড়ি চলছে। হালকা কুয়াশা আছে। গাড়ির কাঁচ তোলা বলে ঠাণ্ডাটা তেমন টের পাচ্ছি না কিন্তু কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। দুদিকে ফুটফুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে দু একটা আলোর বিন্দু দেখে বোঝা যায় যে সেগুলো কোন গ্রাম। মাঝে মাঝে রাস্তার ওপর ধোঁয়ার স্তর। মনে হয় আশেপাশের কোথাও আগুন ধরানো হয়েছে।

ভারী বাতাসে ধোঁয়া উড়ে যেতে অর্পিতার সাড়াশব্দ পাচ্ছি না, মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারও একটু ঘুমডুম পাচ্ছে কিন্তু ড্রাইভারের পাশে বসে ঘূমনো উচিত নয় বলে জোর করে জেগে আছি। অনিৰ্বাণ ও মাঝে মাঝে হাই তুলছে। এরকমই একবার অনির্বাণ হাই তুলেছে আর গাড়িটাও সেই সময়ে একটা ধোঁয়াশার স্তরে ঢুকেছে। হাই তুলতে গিয়ে অনির্বাণে চোখ বুজে যেতে এক সেকেন্ডের জন্য গাড়িটা রাস্তা থেকে বাঁ দিকে সরে যেতেই মুহুর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল।

কোথেকে এক সাইকেল আরোহী আমাদের সামনে এসে পড়ল আর গাড়িটা বাঁ দিকে বেঁকে যাওয়ার ফলে গাড়ির বাঁ কোনটা গিয়ে সাইকেলের পিছনে ঠেকল। অনিৰ্বাণ মুহুর্তের মধ্যে সামলে নিলকিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমাদের দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কা ঠিক যেন স্ট্রাইকারের পা ফুটবলে গিয়ে পড়ার মত সাইকেলের ওপর আছড়ে পড়ল এবং নিমেষে সাইকেল শুদ্ধ আরোহী বাঁ দিকের ক্ষেতে ছিটকে গিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের গাড়িটায়। শুধু একটা ঝাঁকুনি লাগল আর দড়াম করে আওয়াজ হল কিন্তু গাড়ির গতিতে কোন হেরফের হল না, গাড়ি চলতেই লাগল।

অর্পিতা ঘম থেকে জেগে উঠেছে ঝাঁকুনিতে বুঝেছে গাড়িটার কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। ধড়মড় করে উঠে বলল – “কি হল? কিছুর সাথে ধাক্কা লাগল? অনির্বাণ ব্ৰেক কষছে। উত্তেজিত হয়ে বলল
“একটা লোক সাইকেলে করে যাচ্ছিল তার সাথে ধাক্কা লেগে গেল।”

অর্পিতা আঁতকে উঠে বললে- “সেকি! মরে যায়নি তো?” আমি বাঁ দিকেই বসেছিলাম আমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটতে সাময়িক হতবস্ত হয়ে গেছিলাম।

পরিষ্কার দেখলাম একজন লোক সাইকেল চালিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে যাচ্ছিল, পরনে ধুতি চাদর মাথায় মাফলার জড়ানো। বয়স্কই হবে কারণ কমবয়সীরা আজকাল ধুতি পরে না। ধোঁয়ার স্তরটা থাকার জন্য আগে থাকতে লোকটাকে দেখা যায়নি আর এমন কপাল অনির্বাণেরও ঠিক ওই সময়েই হাই উঠতে হল। আর গাড়ি বেঁকল তো বেঁকল ঠিক লোকটার সামনেই! ধাক্কা লাগতেই লোকটা যেন পিং পং বলের মতে দুবার পাক খেয়ে ছিটকে পড়ল।

দুর্ঘটনা একেই বলে। অনিৰ্বাণ রাস্তার ধারে গাড়িটা দাঁড় করাল। ওর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ও বলল”সরোজ চল দেখি, হয়ত লোকটাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে”।

ততক্ষণে গাড়ি অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আমি নেমে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম বাঁদিকের বনেটটা একটু ভুবড়ে গেছে আর রং উঠে গেছে। আমাদের গাড়ি প্রায় দুশো তিনশো মিটার এগিয়ে এসেছে। তিনজনেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অন্য একটি গাড়ি ওই জায়গাটায় বাঁ দিকের ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে পড়ল। উল্টোদিকে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটে বুঝলাম ওটা একটা লরি। অনির্বাণের মুখ শুকিয়ে গেছে, অর্পিতাও কাঁদো কাঁদো।

আমি বললাম- “পাগল হয়েছিস নাকি? এরকম ঝুট ঝামেলায় কেউ পরে? ”

অনিৰ্বাণ বলল- “লোকটার কি হল দেখব না?”

বললাম- “ওখানে গিয়ে কোন লাভ নেই , দেখে কি করবি? যদি মরে গিয়ে থাকে শুধু মুধু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব।”

ও বলল- ” বেঁচে থাকতেও তো পারে, এই অবস্থায় ফেলে চলে যাব? হয়ত হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে।”

আমি বললাম- “ওই লরিটা আমাদের পিছনেই আসছিল, ওরা এক্সিডেন্টটা দেখতে পেয়েছে। এখন যদি ওদের সামনে যাই ওরা পুলিশ কেস হলে আমাদের এগেনস্ট এ সাক্ষী দেবে কিন্তু আমরা যদি চলে যাই কেউ জানবে না। আর ওরা তো দাঁড়িয়েছেই। যদি বেঁচে থাকে ওরাই হাসপাতালে নিয়ে যাবে। চল গাড়িতে ওঠ।”

অনিৰ্বাণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাড়িতে গিয়ে বসল। অর্পিতা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। প্রায় কেদে ফেলার মত অবস্থা। আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম- লোকটা বেঁচে যাবে চিন্তা কোর না। গাড়ি আবার ছটতে লাগল। অনিৰ্বাণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল

“বিশ্বাস কর আমি লোকটাকে দেখতে পাইনি। হুট করে কিভাবে যে সামনে এসে গেল বুঝলাম না।” ওর গলার স্বর আবেগে উদ্বেগে কাঁপছে। আমিও জানি এটা একটা নিছকই এক্সিডেন্ট। এক্সিডেন্ট অনেক সময় এমনিই হয় তাতে কারোর দোষ থাকে না।

আমি বললাম- “না তোর দোষ নেই, ধোঁয়ার মধ্যে লোকটাকে দূর থেকে দেখা যায়নি, তাহলে তুই সাবধান হতে পারতিস, আর লোকটারও তো এই হাইওয়েতে সাইকেলে চালানোই উচিত হয়নি। এসব রাস্তায় সাইকেল চালানো তো নিষিদ্ধ। না আছে কোন টেল লাইট না আছে রিফ্রেকটার। এই অন্ধকারে বুঝবিই বা কি করে।”

মনটা কিন্তু খচখচ করতে লাগল, লোকটাকে ফেলে রেখে আসার জন্যে। রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমার বাড়ি আগে পরে বলে ওরা আমায় বাড়িতে নামিয়ে দিল। আমি অনির্বাণ কে বললাম “শোন যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর কিছু করার নেই। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়ে শুয়ে পর। কাল সকালে তোর বাড়ি আসছি। তখন কথা হবে।”

অর্পিতা বলল- “সরোজদা আমার খুব ভয় । করছে, পুলিশের ধরবে না তো?”

আমি বললাম- “না না পুলিশের কাছে প্রমাণ কি আছে যে আমাদের গাড়িতেই ধাক্কা লেগেছে? ওখানে তো কেউ ছিল না যে সাক্ষী দেবে”।

অনিৰ্বাণ বলল- “আমাদের পিছনের লরিটা তো এক্সিডেন্ট হতে দেখেছে?”

আমি বললাম- “ওই লরিটা অনেক দূরে ছিল। আমাদের গাড়ির নম্বর অত দূর থেকে দেখতে পাবে না। শোন ভেবেও আর কিছু লাভ নেই। এবার যা হবে ফেস করতে হবে। ভাব এটা একটা নিছকই এক্সডেন্ট যেখানে তোর কোন দোষ ছিল না।” অনিৰ্বাণ আমার সান্ত্ৰনা বাক্যে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল। বাড়ি ফিরে আমি দুটো চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। সকালে উঠবো উঠবো করছি এমন সময়ে অনির্বাণের গলার আওয়াজ পেলাম।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতেই অনিৰ্বাণ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ল। বলল- “আমি কাল সারারাত ধূমইনি। ওই লোকটার কথা খালি মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল একবার গিয়ে দেখলেই ভাল হত। রাত্তিরে অসহ্য লাগছিল। তাই সকাল হতেই তোর কাছে চলে এসেছি। চল একবার ওই জায়গাটা ঘুরে আসি। খোঁজ নিয়ে আসি লোকটার কি হল।”

আমি অবাক হয়ে বললাম- “আবার যাবি! পাগল নাকি? লোকটা যদি মরে গিয়েই থাকে সে সব জেনে আরো খারাপ লাগবে তো।”

অনির্বাণ বলল “সে লাগে লাগবে তবু রহস্যটা থাকবে না। পরিণতি জানতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগবে। তাছাড়া যদি দেখি আহত হয়েছে তাহলে কিছু সাহায্য টাহায্য করা যেতে পারে।”

আমি রাজি হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম “তোর গাড়ি নিয়ে যাবি?” ও বলল ” না। তোর ওমনিটার যদি ভাড়া না থাকে ওটা নিয়ে চল, আর তোর ড্রাইভারকে ডাকতে হবে না, তুই ই চালিয়ে নিয়ে চল।”

আমি বললাম  “তুই এখন বাড়ি যা, আমি আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যাচ্ছি।” দ্রুত তৈরি হয়ে অনির্বাণকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রওনা হলাম। জায়গাটা মোটামুটি জানাসিঙ্গুরের কাছে। ফেরার সময় ওই ঘটনার পর ভবানী পেট্রল পাম্প দেখেছিলাম। তার মানে ভবানী পেট্রোল পাম্প থেকে চার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হবে এক্সিডেন্ট স্পটটা। নটা নাগাদ ভবানী পেট্রোল পাম্পে পৌছে গেলাম। আমিই চালাচ্ছি জানি অনির্বাণের এখন কিছুদিন স্টিয়ারিংয়ে বসতে সময় লাগবে।

আমরা যে লেন দিয়ে যাচ্ছি তার উল্টোদিকের লেনে ঘটনাটা ঘটছে। যদি কোন চিহ্ন থেকেও থাকে তবে উল্টোদিকের ক্ষেতে রয়েছে যেটা এপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা তাই খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা বাঁক থেকে ইউটার্ন নিয়ে আবার ফিরতে লাগলাম। গাড়ির গতি বেশ ধীর, অনির্বাণ আর আমার চোখ রাস্তার পাশে মাটিতে। কিছুদূর এগোতেই মাটিতে একটা ঘষটানোর দাগ দেখা গেল। গাড়ি আস্তে করে রাস্তার পাশে দাঁড় করলাম। ঘষটানোর দাগটার পাশেই নিচু আলক্ষেতের এক জায়গায় কিছু গাছ মাটিতে নেতিয়ে পড়েছে। গাছগুলো মাড়ানো হয়েছে আর মাটিতে অনেকগুলো পায়ের ছাপ। মাটিতে এক জায়গায় কালচে ছোপ। পরিষ্কার বোঝা যায় এখানে কিছু একটা হয়েছে।

আমি অনির্বাণের দিকে চাইলাম। দেখি এই শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ও বলল “চল কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখি, কেউ কিছু জানে কি না।”

কিন্তু এখানে আশেপাশে কোন লোক নেই। দুদিকেই ক্ষেত আর দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। আমি বললাম “কাকে জিজ্ঞাসা করবি এখানে। দুদিকেই তো অনেকদূর পর্যন্ত কেউ নেই।”

ও বলল- “চল না। আশেপাশের কোন ধাবা বা চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করে দেখি।’ আমরা অনেকটা এগিয়ে এসে একটা ধাবাতে বসলাম। চা আনতে বলে ধাবার ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম। “ভাই কাল কি এখানে কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে?” সে বলল সে জানে না। আজ সকালে কাজে এসেছে কাল বিকেলে সে বাড়ি চলে গেছিল। সে বলল
“দাঁড়ান জিজ্ঞাসা করে আসছি।”

ছেলেটা চলে যেতে আমরা বসে চা খাচ্ছি এমন সময় দেখি একটা পুলিশের গাড়ি ধাবায় ঢুকল। ওরা কাউন্টার গিয়ে কিছু বলে টেবিলে এসে বসল। এমন সময় ধাবার ছেলেটা ফিরে এসে বলল হাঁ কাল রাতে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। একটা গাড়ি একটা লোককে ধাক্কা মেরে পালিয়েছে। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করল “লোকটা মরে গেছে?”

ছেলেটা বলল জানে না, হাসপাতালে নিয়ে গেছে শুনেছে। আমরা আরো কিছু প্রশ্ন করতে যাব এমন সময় একজন পুলিশ ছেলেটাকে হাঁক দিয়ে ডাকল। ছেলেটা যেতে ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞাসা করল, তারমধ্যে “এক্সিডেন্ট” কথাটা দুবার শুনলাম। আমার মনে একটা বিপদের ঘটা বেজে উঠল। বঝলাম এখানে বেশিক্ষণ থাকলে বা এক্সিডেন্ট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমরা সন্দেহের তালিকায় পড়ে যেতে পারি। আমি অনির্বাণ এর হাতে একটা মৃদু চাপ দিলাম। অনির্বাণ প্ৰথমে কিছু বোঝেনি আমি পুলিশগুলোর দিকে ইশারা করতে ও ঘাড নেড়ে বলল উঠে পড়তে চুপচাপ দাম মিটিয়ে গাড়িতে উঠে আমরা বেরিয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি। বললাম “দেখ এখানে আর ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই বরং লোকের বা পুলিশের নজরে পড়ে যেতে পারি। চল বাড়ি ফিরে যাই যা হওয়ার হবে।” বাড়ি ফিরে এলাম। তারপর দুদিন বাড়িতে খুব উৎকঠায় কাটল। কিন্তু কেউ আমাদের খোঁজ করতে এলো না।

তারপর দুদিন যত খবরের কাগজ ছিল তার প্রতিটায় খুঁজেও ওই এলাকায় দুর্ঘটনায় কারোর মৃত্যু হয়েছে এরকম কোন খবরই দেখতে পেলাম না। আমি অনিৰ্বাণ কে বললাম মনে হয় লোকটা মরেনি, মরলে খবরের কাগজে বেরত। অনির্বাণ বলল। এরকম রাস্তায় এক্সিডেন্টে রোজ লোক মরছে, সব খবর কি বেরোয়? আমাদের কাছে রহস্যই রয়ে গেল ব্যাপারটা। এরপর দিন গেল রাত গেল। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ঝাপসা হয়ে গেল। কয়েকমাস পরে মাঝে মাঝে মনে পড়ত। তারপর আরো কিছুদিন পর মনে হল আমরা বেশি ভেবে ফেলেছিলাম। হয়ত এখন দিব্যি সাইকেলে চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্রমশ ব্যাপারটা তির অনেক নীচে চাপা পড়ে গেল।

সেই ঘটনার বছর ঘুরতে চলেছে এমন সময় একদিন অনির্বাণের বাড়ি আন্ডা মারছি। কথায় কথায় ও বলল

-“আমাদের তারাপীঠ যাওয়ার এক বছর হতে চলল। ষোলোই ডিসেম্বর গেছিলাম আর আজ ন তারিখ। চল আর একবার যাই তারাপীঠ।” আমি বললাম আবার? ও

বলল- “হ্যাঁ, গতবারের অভিজ্ঞতাটা ভাল হয়নি। মনটাও কেমন যেন খচখচ করছে সেই থেকে। একবার ভাল করে পুজো না দিলে মনটা ঠিক শান্তি পাচ্ছে না।” আমিও ভেবে দেখলাম আর একবার ওই একই জায়গায় ভালভাবে যদি ঘুরে আসি তাহলে পুরনো স্মৃতিটা ভাল স্মৃতির নীচে চাপা পড়ে যাবে তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম। কথামত ষোল তারিখ সকালে আমরা আবার বেরিয়ে পরলাম তারাপীঠের উদ্দেশ্যে তবে এবার অর্পিতা গেল না শুধ আমি আর অনির্বাণ রওনা হলাম। নির্বিঘ্নেই পৌঁছলাম।

অনেকদিন পর দুই বন্ধু আবার গাড়ি নিয়ে কথাও লং ড্রাইভে বেরলাম। গত এক বছর আর অনির্বাণের সঙ্গে কোথাও যাওয়া হয়নি। তারাপীঠে পুজোটুজো দিয়ে সারাদিন ওখানে কাটিয়ে আবার বিকেলে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। আগেরবার যে সময়ে বেরিয়েছিলাম। এবারও সেই সময়ে বেরিয়ে আসছি। এবারে সন্ধে হয়ে যেতে অনির্বাণ আর গাড়ি চালায়নি। যতক্ষণ দিনের আলো ছিল ও চালিয়েছে তারপর বলল আমায় চালাতে। আমিই চালাচ্ছি। খুব কুয়াশা পড়েছিল সেদিন। দুজনেই গল্প করতে করতে আসছি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাব, মনটাও বেশ উৎফুল্ল। মনে হল যেন পাপ কাটল। সিঙ্গুরের কাছে এসেছি এমন সময় হঠাৎ সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠল। দেখি গাড়ির ঠিক হাত দশ বারো দূরে একটা লোক সাইকেল নিয়ে রাস্তার মাঝমধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে।

একদম চুপচাপ। কোখেকে এলো, কখন এলো জানি না। দু সেকেন্ড আগেও তো দেখতে পাইনি। অবশ্য চারিদিকে ভালোই কুয়াশা। দূর থেকে কিছু দেখার উপায় নেই। গাড়ির গতি বেশি ছিল আমি আঁতকে উঠে সজোরে ব্রেক কষলাম। গাড়ি ঘাঁস করে রাস্তাতে কিছুটা ঘষটে গিয়ে এঁকে বেঁকে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়িয়ে বন্ধ হয়ে গেল। চাকার ঘষটানিতে গাড়ির চারিদিকে ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে গেল। অনিৰ্বাণ সতর্ক ছিল না, ও হুমড়ি খেয়ে সামনের কাঁচে ধাক্কা খেল। কি ভাগ্যি কাঁচ ভাঙেনি কিন্তু ওর মাথা জোরে ঢুকে গেল। অনিৰ্বাণ “আহঃ বলে সেঁচিয়ে উঠল। ধোঁয়াটা সরতে এদিক ওদিক চেয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। অনিৰ্বাণ বলল- “যাহ বাবা লোকটা কোথায় গেল? তারমানে অনির্বাণও লোকটাকে দেখেছে। আমরা এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থেকে একে অপরের দিকে চাইলাম। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের ভুল একজনের হতে পারে কিন্তু দুজনের হতে পারে। না। হেডলাইটের আলোতে পরিষ্কার দেখলাম একজন বয়স্ক লোক সাইকেল নিয়ে কালচে রঙের একটা চাদর গায়ে এক তে আমাদের দিকে চেয়ে আছে।

মাথায় মাফলার বাঁধা আর পরনে ধুতি, আর এখন একদম উধাও হয়ে গেল! অনির্বাণের চাহনিটা অন্যরকম হয়ে গেছে। ভয়ার্ত চাপা গলায় বলল”এই জায়গাটা চিনতে পারছিস?” বুঝলাম আমি যা ভাবছি ও ও তাই ভাবছে। আমি অফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম “সেই লোকটা” অনিৰ্বাণ সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল শুধু। গাড়ি স্টার্ট করতে গেলাম কিন্তু স্টার্ট হল না। অনেকবার চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট হল না। ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেল যেমন আওয়াজ হয় তেমন কয়েকবার আওয়াজ হয়ে আর কোন সাড়াশব্দ দিল না। হেড-লাইট আসতে আসতে কমে গিয়ে নিভে গেল। গাড়িতে আর কোন আলো জ্বলছে না, ব্যাটারি একদম ডেড হয়ে গেলে যেমন হয় এখানেও তাই অবস্থা। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। চালু গাড়ির ব্যাটারি ডাউন তো কখনো হয় না, হলটা কি?। আমি বললাম দাঁড়া বনেটটা খুলে দেখি। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে দেখি দরজা খুলছে না। টানাটানি করেও কিছুতেইদরজা খলতে পারলাম না। আমি অবাক ভাবে অনির্বাণের দিকে তাকাতে ও ওর দিকের দরজা খুলতে গেল। আশ্চর্য ঘটনা যে ওর দিকেরও দরজা খুলল না। বেশ জোরেই টানাটানি করে কোন মতেই দুদিকের দুটো দরজা খোলা গেল না। এবার একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাত বাড়িয়ে পিছনের দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। সেটাও খুলল না। এখন গাড়িতে কোন রকম স্পন্দন বা আলো নেই। অনির্বাণ বলল “সে বদলা নিচ্ছে”। চমকে উঠলাম। সাহস আনার জন্য বললাম। ধুর কি বলছিস, একে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে তারপর তোর আবার উল্টোপাল্টা কথামাথা ঠাণ্ডা রাখ কোথায় কি গণ্ডগোল হল দেখি৷  ও বলল- “এ গাড়ি খারাপ হয়নি। এরকম ভাবে গাড়ি খারাপ হয়? গাড়ি যদি খারাপই হবে তবে দরজা খুলবে না কেন?” ওর কথার কোন উত্তর আমার কাছে নেই। চুপ করে বসে রইলাম। ভাবছি এ আবার কি? কি হচ্ছে এসব। কোন রকম অলৌকিক কিছু আমি মানি না। গত বছর এরকম একটা জায়গাতেই এক্সিডেন্ট হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এটাই সেই জায়গা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদিও বা হয়, সেই জন্যেই যে আমাদের গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে সেটাও মানি না। ঘাবড়ে গেছি সেটা স্বীকার করতে লজ্জা নেই তবু মনে জোর এনে বললাম এসব গাড়িতে তো সব ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল, চাবি টিপেই তো লক করা যায়। মনে হয় কোনভাবে শর্ট সার্কিটের ফলে গাড়ির ইলেকট্রিক্যাল প্রবলেমের জন্যে. আমার কথা শেষ হল না অনির্বাণের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। শ্চেচিয়ে বলল “তোর পেছনে দেখ!” আমাদের গাড়ি আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আছি যেদিকে, সেটা হল যেদিক থেকে আসছিলাম সেদিক আর অনির্বাণ আছে যেদিক যাচ্ছিলাম সেদিকে।

আমি এতক্ষণ অনির্বাণের দিকে ফিরে কথা বলছিলাম। এবারে ওর কথামত উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখি একটা গাড়ির হেডলাইট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এই ঘটনার আকস্মিতায় খেয়াল ছিল না আমাদের পিছনের গাড়িগুলো একের পর এক ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। এদিকে আমাদের গাড়ির কোন আলো নেই, রাস্তাতেও কুয়াশা ফলে আমাদের গাড়িকে দূর থেকে দেখাও মুশকিল। এবার কোন লরি বা বড় গাড়ি হঠাৎ করে আমাদের সামনে এসে পড়লে থামতে পারবে না, আমাদের গাড়িকে পিষে দিয়ে চলে যাবে। আমরা দুজনেই কাঠ হয়ে বসে রইলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুটো ছোট গাড়ি শেষ মুহূর্তে কোন রকম আমাদের পাশ কাটিয়ে জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে কি সব বলে গেল। বুঝলাম সবাই এরকম শেষ মুহুর্তে কাটিয়ে বেরোতে পারবে না। বিশেষ করে যদি কোন দশাসই ট্রেলর হয়। আমরা দুজনেই নিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় মরিয়া হয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু কোন কিছুই হলনা।

হঠাৎ দেখি সেই লোকটা রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক আমাদের মুখোমুখি। উলটো দিকের লেনের একটা গাড়ির আলো লোকটার ওপর পড়তেই একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলাম। লোকটার মাথার মাফলারটা চক চক করছে চাপ চাপ রক্তয়। ও যে জীবিত কোন মানুষ নয় তা আমরা নিশ্চিত। ও যে আমাদের মারতে চাইছে সে ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই। কি বীভৎস ব্যপার! আমরা আতঙ্কিতের মত গাড়ির কাঁচে ধাক্কা মারতে শুরু করলাম। অনিৰ্বাণ পাগলের মত আচরণ করছে আর জানলার কাঁচ ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। জলীয় বাষ্পে জানলা ঝাপসা হয়ে গেছে, গাড়িটাকে যেন অন্ধকূপ মনে হচ্ছে, আমরা যেন বদ্ধ জায়গায় পিষে মরার জন্য অপেক্ষা করছি। আবার দেখি আমার ডান দিক থেকে কোন গাড়ির আলো এসে পড়ছে। যদি এটা কোন লরি বা ট্রেলার হয় তাহলে আমরা একদম ছাতু হয়ে যাব। আমাদের এই ছোউ গাড়িটা তালগোল পাকিয়ে যাবে। প্রিয়জনদের মুখ মনে পড়তে লাগল। আলো ক্রমে আরো তীব্র হতে লাগল ও আলোর বিন্দু দুটো ক্রমশ বড় হতে লাগল। গাড়ির আওয়াজে বুঝলাম এটা কোন বড় গাড়ি। কয়েক সেকেন্ড মাত্র তারপরই একটা বিশাল একটা ট্রেলার দ্রুতগতিতে এসে আমাদের গাড়ির ঠিক সামনে জোরে ব্ৰেক কষল। কিন্তু অত বড় গাড়ি থামতে পারল না। আমি যেদিক বসেছিলাম সেদিকে সজোরে ধাক্কা মারল। প্ৰচণ্ড এক আওয়াজে আমাদের গাড়ি দুটো পাক খেয়ে ছিটকে পাশের ক্ষেতে গিয়ে পড়ল। শুধু ট্রেলার ধাক্কা মারার আগের মুহূর্তে দেখেছিলাম। উল্টোদিকের সেই যে ছায়ামূর্তি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পরিণতি দেখছিল তার মখে যেন এক স্মিত হাসি । ট্রেলার থেমে গেছে। তার বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি। ড্রাইভার আর খালাসি রাস্তায় নেমে পড়ে আমাদের গাড়ির দিকে ছটে গেল। পর পর অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সেই সব গাড়ি থেকে লোকজন ছটে গিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে গেল। আমিও দেখছিলাম আমাদের। আমি আর অনির্বাণ তোবড়ানো গাড়ির মধ্যে আটকে পড়ে রয়েছি। ধাক্কার কিছুক্ষণ পর থেকেই আমি সব কিছু দেখতে পাচ্ছি এক তৃতীয় ব্যক্তির মত। ওই তো লোকজন শাবল, লোহার রড দিয়ে গাড়ির দরজা ভেঙ্গে আমাকে আর অনির্বাণকে শুইয়ে রাখল মাটিতে। তারপর সেখান থেকে হাসপাতাল।

আমি অনির্বাণকে আমার পাশে দেখতে পাচ্ছি না। আমি একাআমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আমি এক অদ্ভুত অবস্থায় রয়েছি এখন আমার খিদে তেষ্টা ঘুম কিছুই নেই। দেহের কোন ওজন নেই, আমায় হেঁটে কোথাও যেতে হচ্ছে না। আমার শুধু ইচ্ছা আছে আর দৃষ্টি আছে। যেখানে যা দেখতে ছাইছি সেটাই দেখছি। যেখানে যেতে চাইছি নিমেষে সেখানে হাজির হয়ে যাচ্ছি। কেন দেখতে চাইছি জানি না। এক অদৃশ্য নির্দেশে যেন চালিত হচ্ছি। জাগতিক হিসাবে তিনদিন কেটে গেছে যদিও আমার কাছে সময় অনন্ত। সেই থেকে এইভাবে আমি রয়েছি।

গত তিনদিনে অনেকবার অনির্বাণের কাছে কাছে এসেছি কিন্তু ওর জ্ঞান ছিল না, তাই অপেক্ষা করছি একবার দেখা করে যাওয়ার জন্যে। মাঝে একবার মর্গে গিয়ে শুধু আমার দেহটাকে শেষ একবার দেখে এসেছি। একটা মায়া ছিল। বত্রিশ বছর দেহটায় ছিলাম। এই তিনদিনে অনেক জায়গায় গেছি। যে জায়গাগুলো আমার স্মরণীয়। যারা আমার প্রিয় তাদের সবার কাছে গেছি। পাড়ার ক্লাবে, আমার ঘরে, অদিতির ঘরে, হাইওয়ের সেই জায়গায়, দাদা বৌদির কাছে, দুএকজন বুঝতে পেরেছে আমার উপস্থিতি। বেশিরভাগই বোঝেনি তাদের কত পাশে আমি ছিলাম। তবে আর থাকতে পারব না। আমায় কেউ একজন নির্দেশ দিচ্ছে চলে যেতে হবে।

আমায় কে যেন বলে দিয়েছে আজই অনিৰ্বাণের জ্ঞান ফিরবে। জ্ঞান ফিরেছে। এখন ভিজিটিং আওয়ার্সে অনেক লোকজন দেখতে এসেছে ওকে। আমি পর্দার আড়াল থেকে দেখছি। সেদিনের পর থেকে আমি উজ্বল আলো সহ্য করতে পারছি না। অনির্বাণ খুব আস্তে আস্তে দু একটা কথা বলছে। অর্পিতার সঙ্গে। আমায় একজন ডাকছে। দেখি আমার পাশে কখন এসে দাঁড়িয়েছে শশধর মান্না। তাড়া দিচ্ছে ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে। সেই এক ধুতি, চাদর আর মাফলার গায়ে। ওর দেহ আসলে দেহ নয় যদিও জীবিত দেহের ছায়া মাত্র। এখন আমার কাছে কিছুই অজানা নয়। কে যেন আমায় বলে দিয়েছে।

চাদর আর মাফলার গায়ে। ওর দেহ আসলে দেহ নয় যদিও জীবিত দেহের ছায়া মাত্র। এখন আমার কাছে কিছুই অজানা নয়। কে যেন আমায় বলে দিয়েছে। আমার পাশে যে দাঁড়িয়ে, যাকে আমরা চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিলাম তার নাম ছিল শশধর মান্না। এও জানি যে সেদিন শশধর বেঁচে ছিল অনেকক্ষণ। সেই লরি দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু তারা শশধরকে উদ্ধার করেনি, দেখে চলে গেছিল। সামনের এক পুলিশ পোস্টে খবর দিয়েছিল, অনেকক্ষণ পর যখন পুলিশ শশধরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শশধর তখন শেষ। আমরা যদি তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতাম হয়ত বেঁচে যেত। ও কিন্তু ইহলোক ছেড়ে যেতে পারেনি। এতদিন ও একজন দোসরের অপেক্ষায় ছিল। আমি হলাম ওর সেই দোসর। ওর আমার নিয়তি এক সুতোয় বাঁধা। ওর মুক্তির সময় এসে গেছে। সাথে আমারও। ও আমার দোসর, আমি ওর। ও আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। বেডের পাশে টুলে অর্পিতা বসে আছে। ওর ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অনির্বাণ আমায় দেখতে পেয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে আমার দিকে আঙুল তুলে সরোজ সরোজ বলে দুবার ডাকতেই অর্পিতা ওর হাত ধরে ফেলল। আমি জানি অর্পিতা ভাবছে অনিৰ্বাণ ভুল বকছে। আমার অন্তিম ইচ্ছাও পূরণ হল, আমার ধরাধামের বন্ধন ছিন্ন হল, চললাম অনি, আমি জানি তুই যখন সুস্থ হয়ে আমাকে দেখার কথা বলবি তখন কেউ তোর কথা বিশ্বাস করবে না।

******************************************(সমাপ্ত)*************************************

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত