রাত প্রায় তিনটে। দেওয়াল ঘড়ি তেমনই জানান দিচ্ছে। ফেসবুকে সেই নতুন আলাপ হওয়া মেয়েটার নামের পাশে সবুজ আলোটা জ্বলে উঠলো। রোজ ঠিক এই সময়েই মেয়েটা অনলাইনে আসে। জানে নবারুণ; এরপরেই মেসেজ আসবে “হাই”
আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপটা বুকের ওপরে টেনে নেয় নবারুণ। এবার শুরু হবে ভার্চুয়াল অভিসার। কথায় কথায় রাতের বয়স বাড়বে। হাওয়া এই পুরো পৃথিবীটায় কয়েকটা চক্কর কেটে নাবারুণের ফ্ল্যাটের বন্ধ জানালায় এসে ধাক্কা দিয়ে যাবে। রাস্তার কুকুরগুলো এই প্রাক- জানুয়ারির ভীষণ শীতে রাস্তার আলো আঁধারির মাঝে হয়তো কোন কায়াহীনের উপস্থিতি জানান দিতে অদ্ভুতসুরে ডেকে উঠবে। সামনের বাড়ীর আধপাগল বুড়ো লোকটা ঘুমের চোখে কুকুরগুলোকে শাপশাপান্ত করবে। তবুও নবারুণ নির্বিকার হয়ে ইহজগতের নৈশকালীন ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য করে ফেসবুকের দুনিয়াতে তলিয়ে যাবে একটু একটু করে।
নবারুণ সেন। বয়স বাইশ। বাড়ী থেকে বহুদূরে কলকাতায় ওদের এই ফ্ল্যাটে একা থাকে বেশ কয়েক বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নবারুণ পড়াশোনায় তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছে সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু আর পাঁচজন মেধাবী ছাত্রের মতো তার উৎসাহ শুধু অধ্যাপকদের লেকচার বা কোন সায়েন্স সেমিনারে যোগদানের মধ্যে আবদ্ধ ছিলো না কোনওদিনই। নবারুণের অস্বাভাবিক তীব্র আকর্ষণ বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি। এ বয়সে হয়তো তা স্বাভাবিক; কিন্তু নবারুণের ক্ষেত্রে এই আকর্ষণ অদ্ভুতমাত্রায় বেশী। অমোঘ এক আকর্ষণে ও বারেবারে নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে ছুটে ছুটে গেছে।
শুরু সেই সহপাঠীর দিদিকে দিয়েই। সেই অসম বয়সের প্রেমে কোন মনের আদানপ্রদান ছিলো না; ছিলো শুধুই শরীর। ধীরে ধীরে নবারুণ নিজেকে, নিজের ক্ষমতাকে বুঝতে পেরেছিলো। শুধু ওর মেধায় মুগ্ধ হয়ে নয়, সুদর্শন নবারুণের পৌরুষের আগুনে নিজেদের আহুতি দিতে চেয়ে ললনার দল বারেবারে ওকে টেনে নিয়ে গেছে রঙীন এক দুনিয়ার দিকে। সময়ের সাথে সাথে নবারুণ আবিষ্কার করেছে সে দুনিয়ার চড়াই উৎরাই।
একে একে কতোজন এলো; আবার চলেও গেলো। নবারুণ যখন যাকে কাছে পায়, তখন তার অস্থি, মজ্জার গল্পগুলোও পড়ে ফেলে। শেষে ছিবড়ে করে ফেলে দেয়। এ এক নেশা। এ নেশায় আশক্ত নবারুণ নিজেও জানেনা এর থেকে মুক্তির উপায়; অবশ্য মুক্তি পেতে কি নিজেই চেয়েছে কখনও! এর জন্যে কুঁড়িও হারিয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে। ওর জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। যেদিন কুঁড়ি বুঝেছিলো, ও ছাড়াও নবারুণের আলাদা একটা জগৎ আছে, সেদিন নিজেকে শেষ করে দিতে এক মূহুর্তও সময় নেয়নি। কিন্তু কি আশ্চর্যজনকভাবে কুঁড়ির এই আত্মহত্যার জের নবারুণকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনি; না সামাজিকভাবে না মানসিকভাবে।
ফেসবুকে কথা এগোয় ধীরে ধীরে। শিকারে অভ্যস্ত নবারুণ গন্ধ পায় শিকারের। এ তো মেঘ না চাইতে জল। কোন পরিশ্রম ছাড়াই এ মেয়ে তো সমর্পনের জন্যে প্রস্তুত।
ফেসবুকে ফুটে ওঠে নীলচে চোখের সেই রূপসীর লেখা…” ইচ্ছে করছে তোমার সাথে এই রাতের ঠান্ডা হাওয়ায় হেঁটে যাই অনেক দূরে।”
মুচকি হেসে নবারুণ টাইপ করে… ” চলে এসো!”
মেয়ে লেখে… ” আর ইউ সিরিয়াস?”
নবারুন লিখে পাঠায়… ” হ্যাঁ।”
উত্তর আসে… ” আসছি তবে।”
তারপরে হঠাৎ করেই মেয়েটা অফলাইন হয়ে যায়।
ল্যাপটপটা পাশে রেখে, উঠে বসে নবারুণ। একটা সিগারেট ধরায়। মুখে মৃদু হাসি। ও জানে, রাস্তাটা তৈরী হয়ে গেছে। এবার শুধু দেখা করার অপেক্ষা। কোথায় দেখা করবে ভাবতে ভাবতে ঠিক করে এখানেই, এই ফ্ল্যাটেই ডেকে নেবে কোন একদিন দুপুরে।
রাস্তার কুকুরগুলো হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে একসাথে ডেকে উঠলো। তারপরে কেমন অস্বাভাবিক করুন সুরে যেন কাঁদতে থাকলো; থেমেথেমে, বারেবারে। শীতের রাতের নির্জন পৃথিবীতে ফিসফিস করে কারা যেন আকুতি জানাতে থাকলো; যেন দীর্ঘদিনের বন্দীদশা থেকে অতৃপ্ত আত্মারা মুক্তি চাইছে। রাতজাগা পাখি ডানা ঝাপটে পালাতে চাইলো দূরে। বাতাস হাহাকার করে উঠলো।
সিগারেটটা শেষ করে, ঘরের উত্তর দিকের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলো নবারুণ। চোখে ঘুম নেমে আসছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ কুঁড়ির মুখটা ভেসে উঠলো মনে। ঘরের আলোটা যেন একটু কমে গিয়ে আবার জোরালো হলো। কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে ঘরে। কিছু একটা ঘটেছে…কেমন অন্যরকম লাগছে। ঘুমে প্রায় বন্ধ হওয়া চোখে নবারুণ দেখলো বিছানার পাশে রাখা বেতের চেয়ারটায় একটা মেয়ে বসে; পরনে শাড়ী; ওর দিকে তাকিয়ে মৃদুমৃদু হাসছে। চিনতে পারে ও। একটু আগে ফেসবুকে কথা বলা নীলচে চোখের সেই সুন্দরী। এমন অস্বাভাবিক ঘটনায়ও নবারুণের মনে কোন প্রশ্ন জাগলো না। কি ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর! চোখ জড়িয়ে আসছে। ভালোভাবে তাকাতেই পারছে না।
মেয়েটা চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় এসে বসলো। আস্তে আস্তে বললো, “বলেছিলাম না আমি আসবো!” হঠাৎ সম্বিত ফিরলো নবারুণের। কেমন একটা আতঙ্ক মিশ্রিত কৌতূহল মূহুর্তে ও নিজের মধ্যে টের পেলো। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে বললো, “কিন্তু এলে কি করে?” মেয়েটা নিচুগলায় বলে উঠলো, “আমি সব পারি!”
সুন্দরী আলতো করে নবারুণের হাতের ওপরে হাত রাখে; কি ভীষণ শক্ত আর ঠান্ডা সে হাত! নবারুণ চমকে ওঠে সেই স্পর্শে। ঘরের মধ্যে যেন বাইরের ঘন কুয়াশা ঢুকছে; সবকিছু খুব আবছা লাগছে। নবারুণ তাকিয়ে আছে মেয়েটার হাতের দিকে। হাতের নখগুলোতে যত্নের ছোঁয়া। কিন্তু নখের কোনায় যেন শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ। নবারুণের নাকে হঠাৎ ধাক্কা মারে ভীষণ বোঁটকা, পচা একটা গন্ধ। সোজাসুজি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই দেখে, কোথায় সেই সুন্দর মুখ! সেখানে একজন বৃদ্ধার মুখ বসানো। কোঁচকানো, ভাঁজপড়া মুখের চামড়া। কপালে সিঁদুরের একটা বড় টিপ। আর চোখদুটো একেবারে মরা মাছের চোখের মতো। হেসে ওঠে সে বৃদ্ধা একেবারে কিশোরী মেয়ের মতো আওয়াজ করে। মুখের ভেতর থেকে উঁকি দেয় দাঁতের সারি; যা কখনও কোনও মানুষের হতে পারে না।
ভীষণ আতঙ্কে নীল হয়ে নবারুণ ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে দরজার দিকে। কিন্তু সেই লোলচর্ম বৃদ্ধা জোরে ওর ডানহাতটা ধরে থাকে। কি ভীষণ কঠিন সে আঙুল; একেবারে শক্তিশালী পুরুষের মতো।তারপরে বলে ওঠে একেবারে কুঁড়ির মতো গলায়, “আমাকে পছন্দ হয়নি!”
ঘরের উজ্জ্বল আলো এ মূহুর্তে একেবারে নিষ্প্রভ। নবারুণ সম্মোহিতের মতো হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে মেঝেতে। বৃদ্ধা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চায় নিজের আলিঙ্গনে। চারিদিকে অসহ্য পচা একটা গন্ধ। বৃদ্ধার মুখ এগিয়ে আসে নবারুণের মুখের খুব কাছে। কি ভীষণ সে চোখের চাউনি! সেই মরা মাছের মতো চোখদুটো যেন ওকে গিলে ফেলতে চাইছে।
সকাল দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। লোকাল থানার সাব ইন্সপেক্টর নবারুণের সাদা চাদরে ঢাকা ডেডবডিটার পাশে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। ছেলেটার বাবা-মা’কে খবর পাঠানো হয়েছে। এখন আরও কতো কাজ বাকী!ইন্সপেক্টর সুশোভন মিত্র জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বুঝতে পারলে ঘোষাল? মার্ডার না সুইসাইড? ” সিগারেটে টান দিয়ে নবারুণের চাদরে ঢাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে ঘোষালবাবু বললেন,”কিছুই বুঝতে পারছি না স্যর! মাথা কাজ করছে না। কেউ বা কিছু যেন ছেলেটার শরীর থেকে সব রক্ত শুষে নিয়েছে।”