হৃদয় ছেদক তীর

হৃদয় ছেদক তীর

স্কুলে যাচ্ছে রোহিত । রাস্তা পার হয়ে স্কুল গেটের সামনে আসতেই তার বন্ধু দীপু এসে সবজান্তার হাসি হেসে বলল, ‘কী খবর , মামা? তুমি তো বেশ রঙ্গে আছো । নীলার সাথে কী চলছে ?’ রোহিত লাজুক হাসি হেসে বলল , ‘ আরে না । ওরকম কিছু না । ‘ মুখে বলল বটে কিন্তু রোহিত নিজেও জানে, যে ও নীলার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে গেছে । সারাদিন পড়ার টেবিলে বই সামনে রেখে নীলার কথা ভাবে । খাওয়ার সময় ভাতের দিকে তাকিয়ে নীলার কথা ভাবে । এমনকি রাস্তা দিয়ে চলার সময় নীলার কথা ভাবতে গিয়ে পরশু আরেকটু হলেই বাসের নিচে চাপা পড়তো । সে ভাবছে ,

কয়েকদিনের মধ্যেই নীলাকে সবকিছু বলবে । নীলা এসব শুনে কীভাবে রিয়েক্ট করবে তা ভাবলেই তার কেমন যেন লাগে । সে জন্মগতই হার্টের রুগী । ডাক্তার তাকে ফাস্ট ফুড খেতে আর উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে । কিন্তু নীলার সাথে পরিচয়ের পর থেকে সে এমনিতেই সবসময় উত্তেজিত থাকে । কল্পনা থেকে বের হয়ে রোহিত ক্লাসে এসে বসল । এখন হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা চলছে । তার পিছনের বেঞ্চেই নীলার সিট । দু মাস ধরে নীলার সাথে পরিচয় । এরপর থেকে তো সারাদিন নীলাকে নিয়েই ভাবে , পড়াশোনার আর সময় কোথায় । তবুও আগের করা পড়ালেখার

জন্য সে মোটামুটি ভালই পরীক্ষা দিচ্ছে । নীলা তার খাতা থেকে দৈনিক নকল করছে। সে তেমন কিছুই পারে না। আজ গণিত পরীক্ষা। বেল বেজে উঠল । পরীক্ষা শুরু হলো । প্রশ্ন সহজই হয়েছে। রোহিতের প্রায় সবকিছুই কমন পড়েছে । নীলা আধঘন্টা পর তাকে দুই নংয়ের গ এর উত্তর জিজ্ঞেস করল । সে বলল। কিন্তু তাদের কথা হলের গার্ড শুনে ফেলল । তিনি এসে গম্ভীর মুখে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কে জিজ্ঞাসা করছে?তিনি নীলার দিকে তাকালেন । রোহিতের মাথায় যথারীতি চিন্তার ঝড় বইছে । সে অনেকদিন ধরেই নীলাকে ইমপ্রেছ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু কীভাবে করবে তা বুঝতে পারছিল না। আজ প্রথমবারের মত নীলার জন্য কিছু করার সুযোগ এসেছে। স্যার

তো খাতা দিয়েই দিবেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল , ‘সরি , স্যার। আমিই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর এরকম করব না। কিন্তু স্যার শুনলেন না। কেড়ে নিলেন রোহিতের খাতা । অনেক আকুতি মিনতির পর এক ঘন্টা পর রোহিতকে খাতা ফেরত দিলেন। এ কারণে রোহিতের পরীক্ষা খারাপ হলো । সে বিশ নাম্বার আনসারই করতে পারল না। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে নীলা রোহিতকে বলল , ‘সরি। আমার জন্য তোমার পরীক্ষা খারাপ হলো। রোহিত বলল , ‘ ইট’স ওকে। নীলা ওকে একটুকরো হাসি উপহার দিয়ে বলল , ‘ তুমি আসলেই খুব ভালো। রোহিতের ত্যাগ স্বার্থক হলো। ও নিজেকে সুখী ভাবতে লাগলো।

বাসায় ফিরেই ফোন নিয়ে বসল । ঘাটতে শুরু করল নীলার প্রোফাইল । কাজটা মোটেও ইন্টারেস্টিং নয় । কিন্তু এই কাজটা করতেও এখন তার অনেক ভালো লাগে । তার ডায়েরীতে সে নিজের ভালোবাসার কথাগুলো লিখতে লাগল । সে ইনবক্সে নীলাকে জিজ্ঞেস করল , ‘ কালকেও তো পরীক্ষা আছে । পড়ালেখা না করে অনলাইনে কী করছ ?’ নীলা বলল , ‘এমনিই বসে আছি । পড়তে ইচ্ছে করছে না ।’

‘আমারো পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না । আচ্ছা, তোমার কি ধরনের ছেলে পছন্দ ?’

‘হাহাহাহা । তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ঘটকালী শুরু করেছো । আমি এখনো খুব একটা ভাবিনি । তবে হ্যা, ছেলের ডিএসএলআর থাকতে হবে । আর ছেলেকে দেখতে হ্যান্ডসাম হতে হবে । চুলে জেল দিতে হবে । হঠাৎ এ কথা কেন জিজ্ঞেস করলে ?’

‘ না এমনেই । আসলে কোনো কিছু ভালো লাগছে না ।’
‘ আমারো । তাহলে এক কাজ করি চলো । কোথাও থেকে ঘুরে আসি । ‘

এমন প্রস্তাব পাওয়ার পর রোহিতকে আর ঠেকায় কে? সে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে ঝড়ের বেগে স্কুল গেটের সামনে চলে গেল । সেখানে নীলা এসে অপেক্ষা করছিল । তখন বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। দুজনে মিলে পার্কে গেল । সেখানে একসাথে ফুচকা খেল। তারপর নৌকা করে নদীর ঐপারে গেল। অনেকক্ষণ ধরে একসাথে হাটল । শেষ বিকেলে নদীর উপর সূর্যের লাল কিরণ দেখা যাচ্ছিল। নীলা – রোহিত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের সেই মনোরম দৃশ্য দেখছিল। রোহিত নীলার দিকে তাকাল। সূর্যের সোনালী আলো নীলার চুলে পড়ে চুলকে সোনালী রঙে রঙিন করে ফেলেছে । নীলাকে দেখে রহস্যময় সুন্দর লাগছে ।নীলাকে অনেককিছুই বলার ইচ্ছা ছিল রোহিতের। কিন্তু

বলার সাহস করতে পারল না । সন্ধ্যা সাতটার দিকে ওরা বাসায় ফিরল। পরীক্ষার আগের দিন এভাবে না বলে পুরো বিকেল বাইরে থাকায় রোহিতকে বাসায় প্রচুর ঝাড়ি খেতে হলো । কিন্তু রোহিত তা গায়েই মাখলো না। কারণ নীলার সাথে কাটানো এই বিকেলটাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিকেল। এমন একটা বিকেলের লোভে সে প্রতিদিন বকা খেতে রাজি আছে । পরীক্ষা চলাকালীন সে সবসময় অপেক্ষায় থাকে, পরীক্ষা কবে শেষ হবে । কিন্তু এবার সে চাচ্ছে, পরীক্ষা যাতে শেষ না হয় । নীলা পিছনের বেঞ্চে থাকলে সে সারাজীবনই পরীক্ষা দিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সুসময় খুব দ্রুত চলে যায় । দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। রোহিত ইতোমধ্যেই চমৎকার হেয়ারকাট করছে। চুলে জেল দিচ্ছে । চোখে অপ্রয়োজনেই সানগ্লাস পড়ছে। বাবা মাকে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল ডিএসএলআরের জন্য । উনারা রাজি না হলে সে যখন খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন তাকে একটা ডিএসএলআর কিনে দেয়। নীলার সাথে সে প্রায়ই ঘুরতে বের হয়। আজ পর্যন্ত নীলাকে তার মনের কথা বলতে পারেনি। তার পরীক্ষার

রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে । কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, এতে তার কোনো আক্ষেপ হলো না। সে এখন শুধু নীলাকে নিয়ে সুখ স্বপ্নে বিভোর ।

অবশেষে অনেক সাহস করে একদিন সে নীলাকে সবকিছু বলল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীলা তার চোখে চোখ রেখে তাকাল। তারপর ফিক করে হেসে উঠলো। বলল , ‘নাইস জোকস। নেক্সট জোকস, প্লিজ।

রোহিত বলল, ‘ আমি জোক করছি না নীলা। আই এম সিরিয়াস । আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।

এবার নীলা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ তোমার সাথে দুদিন হেসে কথা বলেছি ওমনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলে। আরে , আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখ । আমার পিছনে অনেক ছেলে পড়ে রয়েছে । আর আমি কিনা তোমার মতো বাদর চেহারার ছেলেকে হুহহ।  এরপর নীলা ফোন বের করে একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল , ‘এই হলো আমার ক্রাশ রাশেদ । হ্যান্ডসাম না ? নিজেকে তার সাথে তুলনা করে দেখ। আশা করি , তোমার জবাব পেয়ে যাবে।

রোহিত জানত যে , রাশেদ কোনদিনই নীলাকে তার মতো ভালোবাসতে পারবে না । কিন্তু নীলাকে তা বলতে পারল না। আজও বিকেল সেই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজও সূর্য নদীর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ছে। কিন্তু নীলা পাশে না থাকায় চারপাশকে কেমন মৃত মৃত মনে হচ্ছে রোহিতের । আজ আর তার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, তার চারপাশটা ঘুরছে । আসলে এই পৃথিবীতে সবাই সবকিছু পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। আর সবাই সবকিছু বুঝেও না। বুঝলে আজ এই গোধূলিতে রোহিতকে এভাবে চোখে অন্ধকার দেখতে হতো না। বুকের বাম পাশে চিনচিন করে একটা ব্যথা অনুভব করল রোহিত।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত