রহস্য লোহার ফটক ধরে বাইরে দাড়িয়ে আছে হাসান এবং মীরা।
“বাহ, আপনার ট্রান্সফার হয়েতো বেশ হলো! শহরের জঞ্জাল থেকে বহুদূর চলে এসেছি, ভাবতেই ভালো লাগছে! আর বাড়িটা দেখেছেন? ঠিক যেন ছোট্ট খাট্ট রাজবাড়ি! শুধু চারপাশের এই দেয়ালটা না থাকলেই হতো। যাক বাবা, তবুও তেমন উঁচু দেয়াল নয়, বাঁচা গেল। নাহলে মনে হতো, জেলখানার ভেতর আছি…”
ফটকের ধুলোয় হাত বুলাতে বুলাতে বলে মীরা। হাসানের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। প্রতিউত্তরে হাসান মৃদু হেসে মাথা দুলায়। অতি গোপনে চাপা শ্বাসটাও ছাড়ে। মীরা মেয়েটা ভীষণ চঞ্চলা। সারাদিন ফরফর করে কথা বলেই যাচ্ছে, অথচ হাসান কে এখনও সহজ ভাবে নিতে পারেনি। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে আসতে কত সময় নিতে পারে কে জানে! আচ্ছা, হাসানের সাথে মীরার বয়সের তফাৎ-ই কি এর মূল কারন? হতে পারে। মীরা সবে অষ্টাদশে পা দিল। এদিকে হাসানের বয়স ত্রিশ ছাড়িয়ে। বিয়ের রাতে মীরা বড়বড় চোখ করে বলেছিল,
“সে কি! আপনার গোঁফ ও আছে দেখছি! কই, ছবিতে তো ছিল না?!”
মীরার কণ্ঠে গভীর বিস্ময় দেখে হাসান অবাক হয়েছিল। গোঁফ রাখাটা যেন বিরাট অপরাধ। অথবা, এমন বিস্ময়কর বস্তু বুঝি পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
“ইয়ে,মানে, ওই আর কি। তোমার ভালো না লাগলে কেটে ফেলবো…”
আমতা আমতা করে বলেছিল হাসান। মীরা তখন অদ্ভুত হেসে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছিল।
“আরেহ, আরেহ! দেখুন! তাড়াতাড়ি……!”
ভাবনা তাড়িয়ে মীরার দৃষ্টি অনুসরণ করে হাসান।
ফটক খুলে মীরা বাড়ির সীমানায় দাড়িয়ে। হাসান ঠিক ওর পেছনেই। দুজন অবাক বিস্ময়ে দেখল, বাড়ির পেছন থেকে ডানা ঝাঁপটিয়ে অনেক গুলো পাখি তাদের দিকে উড়ে এসে মাথা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। ঠিক সমুদ্রের ওপার থেকে এপারে গাঙচিল যেভাবে উড়ে আসে, সেরকম।
“দারুন তো!”
মুগ্ধ হয়ে বলে মীরা। এরপর গুটি পায়ে দুজন সামনে এগিয়ে গেল। একতলা দালানটি যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোন রাজকীয় কুঠির। শুধু কি এই বাড়ি? পুরোটা এলাকাই তো সৃষ্টিকর্তার অনবদ্য কারুকাজ। ঘন সবুজ, স্বচ্ছ জলাধার, এর মাঝে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ছবির মতন বাড়ি গুলো।
“ঘাস গুলো দেখেছেন? কতো লম্বা!?নিশ্চয় অনেকদিন থেকে পড়ে আছে বাড়িটি?”
“হতে পারে। তুমি ভেবো না, শিগ্রই একজন লোক খুঁজে বের করবো। ঘষেমেজে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে দেবে।”
“আচ্ছা…”
বলেই মীরা গভীর মুগ্ধতায় সবকিছু পরোখ করতে লাগলো। বাড়িটির ছাদের এক অংশে লতানো গেইট ফুল নেমে এসে একটি জানালার কাঁচ ছুঁয়েছে। টানা বারান্দার পাশের ঘাস গুলো মাথা উঁচিয়ে যেন ঘরের ভেতরটা দেখতে চাইছে। চারপাশে পরিচিত গাছ যেমন আছে, তেমনি নাম না জানা গাছ ও অসংখ্য। কোথাও কোথাও, থোকা থোকা রং-বেরঙা বন্য ফুল ফুটে আছে। এক সময় নিশ্চয় পরিপাটি একটি বাগান ছিল এটি। মীরা চকচকে চোখে বলল,
“কি দারুন…!”
বলেই পেছনের দিকে ছুটে গেলো। হাসান মুচকি হেসে ওকে অনুসরণ করে। যাক, মেয়েটার তাহলে পছন্দ হয়েছে। সে ভয়ে ভয়ে ছিল, হয়তো এমন নিরালায় এসে মুখ ভোঁতা করে মীরা বলবে, এখানে সে থাকতে পারবে না, ভয় করবে। এমনিতেই ভয় কাতুরে মেয়ে সে। বিশেষ করে, বেশ ক-বছর আগে দাদা বাড়িতে বেড়াতে যেয়ে, নদীতে ডুবে ওর বোন বন্নি মারা যাবার পর এই ভয়ের শুরু। মাঝে মাঝে দিন দুপুরে চিৎকার করে হাত-পা খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে মীরা। জ্ঞান ফিরলে একটা কথাই বলে, বন্নি কাঁদছে। মীরার ভাষ্য অনুযায়ী, সে বন্নিকে দেখতে পায়। বিয়ের আগে হাসান এই ঘটনা জানতো না। তাকে ইচ্ছে করেই জানানো হয় নি। এখন জানলেও কিচ্ছু করার নেই। মীরাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে কষ্ট হয়। জগৎ এ আপন বলতে এই মীরা-ই আছে তার। কেন যেন, এই অল্প ক-দিনেই ভীষণ মায়া পড়ে গেছে মেয়েটির উপর। রোজ রাতে মনে করিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিচ্ছে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই মীরার গায়ে হাত রেখে দেখছে, নাহ, সব ঠিক আছে। হাসানের মনে তখন শান্তি অনুভূত হয়।
“দেখুন দেখুন! কি সুন্দর জলাধার!” দেয়ালের ওপাশে উঁকি দিতে দিতে বলে মীরা।”
“সাবধানে মীরা, দেয়ালের উপর কাঁচ গাঁথা আছে।”
সতর্কতার কণ্ঠে বলে হাসান। মীরা’র সেদিকে খেয়াল কোথায়? সে মগ্ন হয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করায় ব্যস্ত।
বাড়ির পেছনে ছোট্ট জলাধার, যদিও তাতে পায়ের পাতা ভিজবে কিনা সন্দেহ। তবে জলটুকু বড্ড বেশি-ই স্বচ্ছ। নিচের পাথরগুলো সুস্পষ্ট। জলাধারের ওপাশেই হালকা ঝোপঝাড় ধীরে ধীরে গিয়ে মিশেছে ঘন সবুজে।
“এটা কি নদী?”
জানতে চায় মীরা।
“উম…হবে হয়তো।”
“আচ্ছা…”
বলেই মীরা সুন্দর করে হাসলো। হাসান সেদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা বড্ড বেশি-ই সুন্দর। উপরের পাটির একটি দাঁত বাঁকা হওয়াতে হাসিটা অদ্ভুত মায়াময় রূপ ধারণ করে।
বিকেলের আলতো রোদ গলে গলে ঝরছে সব কিছুতে। চারিদিকে সোনালী আভা। বাতাসে মীরার দীর্ঘ চুল এলোমেলো উড়ছে। সেগুলো ঠিক করতে করতেই হাসানের কোন এক কথায় খিলখিলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে মীরা। দূর থেকে ওদের দেখতেই মনে হয়, বাহ, বেশ তো সুখী এরা। ঠিক মিষ্টি এক জোড়া কপোত কপোতীর মতন।
তরিকুল্লাহ হাঁটুর উপর দু-হাত রেখে বাগানে বসে আছে। মীরা ফিসফিসিয়ে হাসানের কানে কানে বলল,
“লোকটা কেমন অদ্ভুত দেখেছেন?”
হাসান কি বলবে ভেবে পেলো না। তরিকুল্লাহকে তার কাছে স্বাভাবিক-ই মনে হচ্ছে। বয়স ৫৫ ছাড়িয়ে। অফিসের নীলকান্ত বাবু এর সন্ধান দিয়েছেন। মানুষের বাড়িতে ছুটা কাজ করে পেট চালায় লোকটি। পৈতৃক ভিটা থাকলেও, বন-বাদারে ঘুরেই সময় কাটে তার। তিন কূলে কেউ নেই। লম্বাটে মুখ, ভাঙ্গা চোয়াল, হ্যাংলা শরীর, ভীষণ লম্বা। এমন সাস্থের অধিকারী হয়েও, এই বয়সে শরীরে অনবদ্য শক্তি তার। চোখ দুটো সারাক্ষণ ঝকঝক করছে। কান্নার আগ মুহূর্তে মানুষের চোখ যেমন রূপ ধারণ করে, ঠিক তেমন।
“লোকটা বাগান পরিষ্কার করে চলে যাবে মীরা। আর হ্যাঁ, একটা ছোট মেয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।”
“আচ্ছা…”
বলেই মীরা বাগান বরাবর এগিয়ে গেল। এরপর তরিকুল্লাহ সহ বাগান পরিষ্কারে লেগে গেলো। হাসান ও তাদের সাথে যোগ দেয়।
“একদিনে এই বাড়ি পরিষ্কার হইবো না। আমি আগামীকাল আবার আসমুনে।”
ঘাসের গোঁড়ায় কাঁচি চালাতে চালাতে বলে তরিকুল্লাহ।
হাসান মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
তরিকুল্লাহ বেশ স্বাভাবিক ভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। মাঝে গুনগুন করে গান ও গাইলো। সেই গানের কোন শব্দ বোধগম্য নয়।
মীরা আড়চোখে তরিকুল্লাহকে দেখছে। লোকটাকে কেন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে তার কাছে। কেন, কে জানে?!
পুরো বাড়ি গুছাতে পাক্কা ৬ দিন লেগে গেল। বাগানের আগাছা, বুনো লতা-পাতা ছেঁটে একদম পরিপাটি করে ফেলা হয়েছে। ঘরের ভেতর সহ চারপাশ ঝকঝকে তকতকে। ও হ্যাঁ, মীরা’র খরগোশ ছানার কথা তো বলা-ই হয়নি। বাগান পরিষ্কার করার সময় কোথা থেকে যেন বেড়িয়ে এলো ওটা। টুকটুক করে হেটে বেড়ানো খরগোশটি অল্পতেই পোষ মেনে গেল। সেদিনই বাজার থেকে কাঠের কুঠুরি আনিয়ে বাগানের এক কোনে রাখা হলো। সেখানেই বসত হল ডুমু’’র। ডুমু খরগোশ ছানার নাম। সবকিছু গুছিয়ে আসতেই হাসান অফিসে নিয়মিত হয়ে পড়লো। আসমা নামের ১০ বছর বয়সী মেয়েটা মীরা’র নিত্যদিনের সঙ্গিনী এখন। মাঝে মাঝে তরিকুল্লাহ এসে খোঁজ খবর নিচ্ছে এবং টুকিটাকি ফরমায়েশ খাটছে।
শুরুতে লোকটাকে অস্বাভাবিক মনে হলেও, এখন ভালোই মনে হচ্ছে। এই এলাকার কি এমন নেই যে সে চিনেনা? এই তো সেদিন বিকেলে, বাগানের মৃদু রোদে বসে মীরা এবং আসমাকে অনেক গল্প শুনালো তরিকুল্লাহ। নানারকম গল্পের মধ্যে আছে ‘নিশি খেকো’র’ গল্প। তরিকুল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় তিন যুগের-ও আগের কথা, এই এলাকায় এতো জনপদ ছিল না তখন। পাশের জংগল ছিল আরও বিস্তৃত এবং ঘন। সেখানেই বসবাস ছিল ‘নিশি খেকো’র। মানুষ হলেও, শয়তানের উপাসনা করে, এই ব্যেক্তি রূপান্তরিত হয়েছিল ভয়ংকর পিশাচ সাধকে। জংগলের ভেতরে প্রাচীন একটি জবা গাছ ছিল। কোন এক অদ্ভুত কারনে, সারাবছর-ই তাতে ফুল ফুটে থাকতো। সেই গাছের ধার ঘেঁষে ছিল একটি দিঘী। দিঘী ভর্তি রক্ত রঙা জবা ফুল ভাসতো বলেই নাম ছিল ‘রক্ত দিঘী’। ওখানেই এই পিশাচ সাধকের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। প্রতি বছর এক বিশেষ রাত্রিতে, গুম হতো যে কোন তরুনি কন্যা। মীরা মগ্ন হয়ে তরিকুল্লাহ’র কথা শুনে যায়।
“ওটা কি কোন নির্দিষ্ট রাত্রিতে হতো?”
“জ্বে না। নির্দিষ্ট ছিল না।”
“আচ্ছা, এই ‘নিশি খেকো’ কি এখনও আছে?!”
“জ্বে না। নাই। সাধনার শেষ পর্যায়ে আইসা, সে শয়তানের বাসনা পূরণ করতে পারে নাই। তাই শেষমেশ শয়তানের ক্রোধের শিকার হয়েই মরতে হইছিলো তার।”
“কি বাসনা পূরণ হয়নি?” কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চায় মীরা।
“শেষ মাইয়াটারে সে উপাসনায় বলি দিতে পারে নাই। সম্ভবত মাইয়াটা পালাইয়া গেছিলো।”
“আর ঐ যে, জবা গাছ আর রক্ত দিঘী, ওগুলো এখনও আছে কি?”
“জ্বে না। নাই। শয়তানটা মরার পর ওগুলাও নষ্ট হইয়া গেছে। জবা গাছটা মইরা গেছে। দিঘীটা ভরাট হইয়া গেছে।”
“আপনি এতো কিছু জানেন কিভাবে?” অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে মীরা।
“তেমন কিছু তো জানিনা।” শীতল কণ্ঠে বলেই উঠে দাড়ায় তরিকুল্লাহ।
“চলে যাচ্ছেন? আচ্ছা, পিশাচ সাধকের নাম ‘নিশি খেকো’ ছিল কেন? সে কি তরুনিদের লাশ গুলো খেয়ে ফেলতো?”
“জ্বে না। তয়, বনের শিয়াল দিয়া খাওয়াই ফেলতো। এইটাও সাধনার অংশ ছিল।”
“বন্য শেয়াল দিয়ে খাওয়াতো!”
দৃশ্যটা কল্পনা করতেই মীরার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
“জ্বে। আমি যাই।”
বলেই হনহনিয়ে হাটা শুরু করলো তরিকুল্লাহ। মীরার দৃষ্টি আসমার দিকে যেতেই দেখলো, ভয়ে এতোটুকুন হয়ে গেছে মেয়েটা।
“কিরে, ভয় পেয়েছিস?”
“হুম…”
ছোট্ট করে জবাব দেয় আসমা।
“ধুর। ভয় পাচ্ছিস কেন? উনি তো বললেন-ই, এই ঘটনা অনেক বছর আগের। সেও আবার সত্যি কিনা কে জানে? এমন বন-জংগল ঘেরা জায়গাগুলোতে অনেক রকম মিথ্যা রটনা থাকে, বুঝলি?”
বলেই মীরা বাড়ির পেছনের দিকে তাকালো। ঐ তো, ছোট্ট দেয়ালের পর, দূরে ঘন বনের উপর সন্ধ্যা নামছে। সেদিকে তাকিয়ে ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠে তার। দৃষ্টি ফেরাতে যেয়েও পারেনা। কোন এক আশ্চর্য শক্তি বাধ্য করছে, একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে।
“আপামনি, ঘরে চলেন। সন্ধ্যা নামতেছে।”
মীরা যেন অন্য জগৎ এ ছিল। আসমা’র কথায় ঘোর কাটতেই তরিঘরি করে উঠে দাড়ালো। বারান্দার চৌকাঠ পার হতে হতেই পেছন ফেরে আবার। অন্ধকারে কুয়াশার মতন ঝাপসা হয়ে আসছে দূরের বন। সেখান থেকেই যেন কোন অশুভ আহ্বান হাতছানি দেয়। মীরা ধ্রুত পা চালাতে যেয়ে দরজার কপাটে ঢুঁ খেল।
‘মাগো!’ বলে মৃদু চিৎকার করে সে। আসমা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে জ্বালিয়ে দিয়েছে সমস্ত বাতি। নিকশ আকাশে নক্ষত্র জ্বলে উঠার মতোই ঝলমলিয়ে উঠে বাড়িটি।
হাসান বসার ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছে। চায়ের কাপে সবে চুমুক দিচ্ছিলো, মীরার চিৎকারে থেমে গেলো। ছুটে আসা মীরার কণ্ঠ ভেসে আসছে।
“এই দেখো দেখো, কি পেয়েছি এটা!”
হাসান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না, মীরা তাকে ‘তুমি’ করে বলছে! সেও আবার কতটা সহজ ভাবে, যেন এতদিন এভাবেই ডেকে এসেছে।
“কি হল? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
“এমনি। মৃদু হেসে বলে হাসান।”
“ওহ! বুঝেছি!” বলেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল মীরা। হাসান সেদিকে তাকিয়ে সজোরে হেসে উঠে।
“হাসবে না বলছি!”
“আচ্ছা, আর হাসবো না।”
মুখে নিষেধ করলেও, হাসি চলতেই থাকে। মীরা বাচ্চাদের মতন ঠোট উল্টিয়ে দাড়িয়ে থাকে। হাসান এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বল, কি দেখতে বলছিলে যেন?”
“ওহ! হ্যাঁ, এইযে দেখো? স্টোর রুমে কি খুঁজে পেয়েছি!”
বলেই হাসানের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিলো মীরা। বেশ পুড়নো কাগজে হাতে আঁকা ছবি। ছবির ভেতর একটি ঘন জংগল, সেই জংগলে কচুরিপানায় ভরা একটি পুকুর।
“দেখেছ?!”
“দেখলাম তো…”
“কি দেখলে?”
“কচুরিপানা ভর্তি পুকুর। গাছপালা… এইতো…”
“আহা, ভাল করে দেখো!”
মীরার কণ্ঠে উত্তেজনা বিরাজ করছে। হাসান মোটেও ভাল করে দেখছেনা ছবিটা। পুকুরের অগুলো মোটেও কচুরিপানা নয়। ফুল, সম্ভবত জবা ফুল। আরেকটি বিশেষ ব্যাপার-ও সে লক্ষ্য করেনি।
হাসান এবার তীক্ষ্ণ চোখে ছবিটির দিকে তাকালো। সত্যি বলতে, কোন অদ্ভুত কিছুই তার চোখে পড়ছে না।
“গাছ-পালার আড়ালে একটি মেয়ের অবয়ব দেখছ? আজব না?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে মীরা।
“ওহ! তাইতো। তবে আজব কেন হবে? নিছকই হাতে আঁকা একটি ছবি। আমি খোঁজ নিয়েছি। আমাদের আগে এখানে যেই ভদ্রলোক থাকতেন, তিনি শিল্পী মানুষ ছিলেন। ছবি আঁকতে বেশ পছন্দ করতেন। নিশ্চয় তার-ই আঁকা। রয়ে গেছে।” বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে হাসান।
“হুম, সে না হয় মানলাম। তবে এই ছবিটির সাথে তরিকুল্লাহ চাচার কথাগুলোর কেমন মিল……”
এতটুকু বলেই থেমে যায় মীরা। হাসান বোধহয় ওর কথাটা খেয়াল করেনি। ভালোই হলো, না হলে ফের ভাবতো, আবার কোন পাগলামী মাথায় ভর করেছে। এমনিতেই তো এতদিন পাগল খ্যতি নিয়ে চলে আসছিল। সে নিয়ে কম ঝাক্কি ঝামেলা পোহায়নি বাবা-মা। থাক বাবা, হাসানকে এইসব জানিয়ে কাজ নেই। এগুলো ভাবছিল বলেই হয়তো মীরা টের পেলো না, হাসান ঝরঝরে হাসি নিয়ে তার দিকে-ই তাকিয়ে আছে। সে চোখে গভীর ভালোবাসার নিখুঁত ছাপ।
দেখতে দেখতে বর্ষা কাল চলে এলো। ঘন সবুজে টিপটিপ বৃষ্টি, অথবা ঝুম বৃষ্টির কোন শেষ নেই। বাড়ির পেছনের জলাধারে জল জমতে শুরু করেছে। দিনরাত ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ তাতে বিদ্যমান। সবকিছু মিলিয়ে মীরার তেমন খারাপ লাগছেনা। মাঝে মাঝে হাসানের অফিসের নীলকান্ত বাবুর স্ত্রী এসে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ভদ্রমহিলা অনেক গল্প গুজব করতে পারেন। সেদিন কথায় কথায় ‘নিশি খেকো’র গল্পটা করেছিলো মীরা। এতে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
“পাগল হয়েছো তুমি ভাই! এও বিশ্বাস করতে বলছো আমায়?”
মীরা চাপা রাগ দমিয়ে মুচকি হাসে। এরপর স্টোর রুমে খুঁজে পাওয়া ছবিটি দেখায়। কি আশ্চর্য। ইনিও ঠিক হাসানের মতোই বললেন,
“হুম, জংগলের মাঝে পুকুর। তাতে ঘন কচুরিপানা।”
“ভালো করে দেখুন। আর কিছু কি চোখে পড়ছে না?”
তড়িৎ গতিতে বলে মীরা।
“দেখলাম তো!ওহ, হ্যাঁ, গাছের ফাঁকে একটি কিশোরীর মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে বটে…?”
“আচ্ছা, এই ছবিটার সাথে কি ‘নিশি খেকো’র কাহিনীর মিল পান না?”
ভদ্রমহিলা এবার অবাক হয়ে তাকালেন। তার দৃষ্টিতে ‘তুমি পাগল’ কথাটি সুস্পষ্ট। মীরা ঠোট কামড়ে ছবিটি সড়িয়ে নিলো। ইশ! যেন এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কোনের খবর ইনি রাখেন। আরে, রহস্য বলেও তো কিছু আছে নাকি? মুখ ভোঁতা করে ভাবে মীরা।
এই ঘটনার পর নীলকান্ত বাবুর স্ত্রী সচারাচার আর আসেন না। কে জানে, হয়তো মীরা’র ‘নিশি খেকো’ রহস্য নিয়ে এতো উদ্বিগ্নতা তার ভালো লাগেনি।
তবুও সময় কেটে যাচ্ছে। হাসান, আসমা, ডুমু, আর নিশি খেকো রহস্য… এদের নিয়েই মীরার জগৎ। যদিও নিশি খেকো রহস্যের ব্যাপারে হাসান একেবারেই অবগত নয়। ইচ্ছে করেই বলছেনা মীরা। ভয় হয়, হাসান না পাগল ভেবে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। অসুস্থ মেয়েকে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন মীরার বাবা-মা। তবুও এ নিয়ে কখনো কটু কথা শুনতে হয়নি। বরং পরম ভালোবাসায় হাসান তাকে গ্রহন করে নিয়েছে। দিন দিন অপরিসীম মায়া এবং যত্নে সুস্থ করে তুলছে তাকে। কি দরকার, এই ভালোবাসার সাগরে আবার নতুন কোন উত্থান-পতন এর। এরচেয়ে বরং নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের মনকে এভাবেই বুঝ দেয় মীরা। তবুও ‘নিশি খেকো রহস্য’ আশ্চর্য চুম্বুকের ন্যায় টানছে তাকে। কোন এক অজানা কারনে, ইচ্ছে হচ্ছে সেই স্থান পরোখ করে।
কিভাবে সম্ভব তা? ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে। কখনোই সম্ভব না। একেতো বনের গহীনে, তার উপর কোন আলামত-ই আর অবশিষ্ট নেই। আচ্ছা, তরিকুল্লাহ কে বলে দেখবে নাকি? তার কথা শুনেতো মনে হলো সেই স্থান চেনে। দেখা যাক, পরের বার এলে, খুঁটিয়ে সব জেনে নেবে মীরা। যদি তরিকুল্লাহ বলতে ইচ্ছুক হয়, তো। বড়ই অদ্ভুত চরিত্র লোকটির। ইচ্ছে হবে তো গলগলিয়ে সব বলে যাবে, আবার হুট করেই কথার মাঝে উঠে চলে যাবে। বাগানে ডুমু’র সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই এগুলো ভাবছিলো মীরা। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, মুশুল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। চটজলদি বারান্দায় উঠে আসলো সে। হালকা ভিজে গেছে। ডুমু হাতের মাঝে তিরতির করে কাঁপছে। ওকে গালের কাছে আদুরে ভঙ্গীতে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতেই চোখ গেল ওপাশের ঘন সবুজে। তীব্র বর্ষণে গাছের পাতা নুয়ে পড়ছে। মনের ভুল কি? এই মাত্র যেন সবুজের ফাঁকে একটি অবয়ব ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। মীরা দীর্ঘক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। নাহ, আর দেখা যাচ্ছে না। চুল বেয়ে কপালে ঝরা বৃষ্টির পানি এক হাতে মুছে নিয়ে ঘরে পা বাড়ায় সে।
চোখ মেলতেই নিখুঁত অন্ধকার। অবিরত ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। সেই যে বিকেলে বৃষ্টি নেমেছে, আর থামার নাম নেই। অভ্যাসমতো বিছানার আরেক পাশে হাত রাখে হাসান। মীরা নেই। বাথরুমে নাকি? উঠে বসে সে। ধীরে ধীরে আবছা আবছা সব নজরে আসছে। ঘরটা কেমন শীতল হয়ে আছে। একটু শীত শীত ও করছে। ওটাকে প্রাধান্য না দিয়ে মীরার উদ্দেশে চারদিকে তাকায়। জানালার কাছে দাড়িয়ে মীরা। কি আশ্চর্য, এত রাতে না ঘুমিয়ে ওখানে কি করছে ও! একে তো অন্ধকার, তারউপর সামনেই জানালার কাঁচে গেইট ফুলের লতানো ডাল-পালা এবং বৃষ্টি ফোটা ঘোলাটে করে রেখেছে বাইরের জগৎ। তবুও কেমন মগ্ন হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। বেড সুইচটা জ্বালাতে যেয়ে থেমে যায় হাসান। গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। টেনে টেনে বাচ্চাদের মতন গান গাইছে মীরা। পুরোটা না বুঝলেও কিছু শব্দ বোধগম্য। এরমধ্যে ‘জবা’, ‘লাল’ শব্দগুলো একদমই স্পষ্ট।
“মীরা!”
সাথে সাথেই কোথাও বাজ পড়লো। বিদ্যুৎ চমকে কিছু মুহূর্ত আলোয় ঝলকে উঠলো সমস্ত ঘর। মীরা মূর্তির মতন ঘুরে দাড়ালো।
“এই মীরা! ওখানে কি করছো?”
বলেই বাতি জ্বালিয়ে দিল হাসান। মীরা চমকে উঠলো। হাসান চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো, ভয় পেয়েছো?!”
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চায় হাসান।
“উহু, এমনি, ঘুম আসছিলো না। বৃষ্টি দেখছিলাম।”
চাপা কণ্ঠে বলে মীরা।
“ওহ! এসো, শুয়ে পড়। আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি…”
মীরা বাধ্য মেয়ের মতন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। হাসান ওর চুলে আলতো হাত বুলাতে থাকে। একসময় মীরার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। হাসান চিন্তিত হয়ে মীরার ঘুমন্ত অবয়বে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা ঔষধ গুলো ঠিক ভাবেই তো খাচ্ছে। আগের মতন বন্নি কে দেখছে এটাও বলেনা বেশ কয়েক মাস হলো। আবার কি হলো?! ঘুমের ঘোরে মীরা বিরবির করে কিছু বলে, হাসান অতি সাবধানে নিকটে কান বাড়ালো। নাহ, কিছুই বোঝা গেলো না। বাতি নিভিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিলো সে। রাত বড় রহস্যময়। রাতের সাথে পুরো পৃথিবী রহস্যময় হয়ে উঠে। ঐ তো, জানালার কাঁচে লতানো গাছের ডাল যে শব্দ তৈরি করছে, ওটাকেও অস্বাভাবিক লাগে হাসানের কাছে।
সকাল হতেই সব স্বাভাবিক। মীরা বেশ হাসি খুসি ভাবেই হাসানকে বিদায় দিতে ফটক অব্দি এলো।
“চাইলেতো নীলকান্ত বাবু’র বাসায় বেড়াতে যেতে পারো। উনার স্ত্রী সারাক্ষণ ঘরে-ই থাকেন।”
বেরুবার আগ মুহূর্তে বলে হাসান। মীরা মুচকি হেসে বলে,
“যাব। আজ-কালের মধ্যে।”
“আচ্ছা আসি।”
বলে-ই হাসান সরু পথ ধরে হাটা ধরে।
এই রাস্তা ধরে এগুলে কিছুটা দূরে বড় রাস্তার মোড়। ওখানে রিকশা পাওয়া যায়। হাসানের চলে যাওয়ার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরা। গেলো রাতে সে মিথ্যে বলেছিল। বলেছিল, ভয় পায় নি, কিন্তু মীরা ভয় পেয়েছে। অন্ধকারে বৃষ্টির মাঝে কালো একটি ছায়ামূর্তি বাগানের এক কোনে দাড়িয়ে ছিল। এসব বললে ফের তাকে পাগল ভেবে হসপিটালে পাঠানো হবে। নাহ, কিছুতেই এগুলো বলা যাবে না।
মেঘ হটিয়ে বিকেলের টুকরো রোদ বাগানের একাংশ জুড়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। মীরা রোজকারের মতন ডুমু’’র খোঁজ নিতে এসে অবাক হয়ে গেল। কোথাও নেই ওটা। পুরো বাড়ি, বাগানের আনাচে কানাচে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। একসময় মীরা নিজেকে বাড়ির পেছনে জলাধারের কাছে আবিষ্কার করলো। ডুমু’র খোঁজে কখন চলে এসেছে টের-ই পায়নি। আচ্ছা, ওপারে যেয়ে দেখবে নাকি? ভাবনাটা তার মনে ধরলেও কেমন করে উঠলো ভেতরটা। অদম্য কৌতূহল, ওপারটা দেখবে। সাথে ডুমুকেও খোঁজা হলো। কৌতূহলের কাছে পরাজয় মেনে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দিলো মীরা। স্বচ্ছ জলে হাঁটু অব্দি ডুবে গেলো। পা টেনে টেনে কিছুক্ষণের মাঝেই ওপাশে যেয়ে উঠলো। ভেজা কাপড় থেকে চুইয়ে জল পড়ছে। সেদিকে মীরার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে গভীর বিস্ময়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। ওর মনে হচ্ছে, যেন লোকালয় থেকে বহু দূরে…… অজানা এক নির্জন দ্বীপে চলে এসেছে। এক দম একা…
ভীত চোখে পেছন ফিরে নিজের বাড়ির দিকে তাকায় মীরা। ওটি যেন বলছে, যাসনে মীরা… যাসনে…। আবার ঐ দূরের রোমাঞ্চকর সবুজ হাত ছানি দেয়, আয়… এদিকে আয়…। ভেতরটা ডিপডিপ করছে। ভিরু ভিরু পায়ে এগোয় মীরা। নাহ, বাড়ি বরাবর নয়। রহস্য ঘেরা বনের পথে। এখানেই মিশে আছে নিশি খেকো’র ইতিহাস…! সা করে কানের কাছে বাতাস ছুঁয়ে যেতেই চমকে উঠে মীরা। শীতল বাতাস। আকাশের কোনে মেঘ জমে ততক্ষণে রোদের লুকোচুরি শুরু হয়ে গেছে আবার। ঘোর লাগা অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে হেটে চলে সে। পায়ের জুতো জোড়া ভিজে চপচপ করছে।
বিরক্তি নিয়ে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ভেজা মাটিতে পা দিতেই শিহরণ বয়ে গেলো শরীরে। দিন-রাত বৃষ্টি হওয়ায় মাটি অনেক নরম। হাটতে বেশ আরাম হচ্ছে। যদিও গাছের পাতা পচে সেঁটে আছে তাতে, এবং অনেক সময় পা পিছলে যাচ্ছে। কিছুটা পথ এগুতেই মাটির পথ শেষ হয়ে শুরু হলো ঘাস, বুনোলতা যুক্ত জংলী পথ। যা কিনা ধীরে ধীরে গিয়ে মিশেছে গহীন বনে। মীরা শেষ বারের মতন পেছন ফেরে। বাব্বাহ, বেশ দূরে চলে এসেছে ! এখান থেকে বাড়ির চিমনি-ও দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা ভয় গ্রাস করে তাকে। তবুও সেটা নাকচ করে দিয়ে সাবধানী পায়ে এগোয়। এখানে সেখানে কাঁটালতা বিদ্যমান। যা কিনা জামাতে আটকে যাচ্ছে। পায়ের অবস্থা ও বেগতিক, ছিলে গেছে অনেক জায়গায়। এভাবেই ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে একসময় টুপ করে বনের ভেতর ঢুকে পড়ে মীরা। ডুমু’র খোঁজে? নাকি অন্য কোন রহস্যের টানে?
কু কু কু স্বরে একটি অদ্ভুত পাখি থেমে থেমে ডেকে উঠলো কোথাও। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে পাতার শনশন শব্দ মিশেছে। মীরা বনের বেশ ভেতরেই চলে এসেছে। ঘন গাছ গুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে বহু কসরত করে আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। আচ্ছা, এই যে এভাবে এতোটা গহীনে চলে এলো সে, ফিরে যেতে পারবে তো? রাস্তাটা ভুলে গেলে? কি করা যায় ভাবতে থাকে মীরা। অবশেষে একটি দুর্বল বুদ্ধি অনুযায়ী ঝোপঝাড় থেকে গাছের ডাল ভেঙ্গে নিলো। এরপর যে পথ দিয়ে এগুতে থাকে, সে পথে, ঘাস মারিয়ে মাটির উপর ডাল দিয়ে দাগ দিতে লাগলো। তবে কিছুটা পথ যেয়েই সে হাঁপিয়ে উঠে। এভাবে হয় নাকি?!
ডালটা সজোরে ছুড়ে ফেলে দেয়। দরকার নেই কোন চিহ্নের। কোন নির্দিষ্ট জিনিস মনে রাখলেই হবে। যেভাবে এসেছিল, সেভাবে ফিরে যাবে। আচপাচ ভাবতে ভাবতেই সুবিশাল এক গাছের নিচে এসে দাড়ায়। সে কি ?! অবাক বিস্ময়ে সামনে তাকিয়ে থাকে মীরা। ওর দু-চোখ বিশ্বাস করতে পারছে না। নিশ্চয় এটা ওর মস্তিষ্কের ভ্রান্ত কল্পনা। নিশ্চয় ঔষধ গুলো কোন প্রকার কাজ করছে না। মীরা যেখানে দাড়িয়ে আছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে জলে ডোবা ঢালু রাস্তাটি। দৃষ্টি আরেকটু সামনে নিতেই টকটকে লাল কিছু ফুল ভাসতে দেখা গেল। নিজের অজান্তে জলে নেমে গেলো মীরা।
টলমলে স্বচ্ছ শীতল জল। কিছু ফুল ওর পায়ে মৃদু টোকা দিয়েই আলতো ঢেউ এ দোল খেতে খেতে চলে যাচ্ছে। শরীরটা কেঁপে উঠলো। এ কি জলের শীতল ছোঁয়ায়, নাকি স্বচক্ষে ‘রক্ত দিঘী’ দেখার উপলব্ধি থেকে?! আচ্ছা, এটাই ‘রক্ত দিঘী’ তো? তরিকুল্লাহ চাচার বর্ণনা অনুযায়ী, তা-ই হওয়ার কথা। মীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ওর সামনেই দীঘির ঠিক মাঝখানে, ছোট্ট দ্বীপের মতন একটি টিলা। সেখানে ঠিক মাঝবরাবর একটি রক্ত জবা গাছ ঘার হেলিয়ে প্রসস্ত ডালপালা ছড়িয়ে জল স্পর্শ করছে। সমস্ত দীঘির জল ফুলে ঢেকে আছে। যেন লাল কার্পেট ভাসিয়ে রেখেছে কেউ। আশেপাশের দৃশ্য বেশ রহস্যময়। কুয়াশার মতন ধোঁয়াটে। বাহ! কি নিদারুন সৌন্দর্য!
মীরা লক্ষ্য করলো, দূরে… বেশ দূরে… ঘণ্টা বাজালে যেমন, তেমন শব্দ ভেসে আসছে। খুব ধীরে, তবে শুক্ষ। সম্মোহিতের মতন জলের গভীরে এগুতে থাকে মীরা। যতই ছোট্ট দ্বীপটির কাছাকাছি যাচ্ছে, ততোই ঘণ্টার শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। সাঁতারের জন্য ডুব দেয়ার আগ মুহূর্তে আবছা দেখলো, গাছের কিছু ডালেই ধোঁয়ার মাঝে ঝুলছে ঘণ্টাগুলো। বেশ পাকা সাঁতারুর মতন গন্তব্যে চলে এলো মীরা। পুরোটা জায়গা জুড়ে গাছের শিকর ফুলের পাপড়ির মতন ভাগ ভাগ হয়ে জল অব্দি নেমে গেছে। শিকরের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ কচি ঘাস। যার সিংহভাগ জবা ফুলে ঢাকা।
মীরা’র ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছে। এমনিতেই সমস্ত শরীর ভেজা। এর উপর কুয়াশা ছুঁয়ে যেতেই কেঁপে উঠছে মেয়েটা। হাত দুটো বাচ্চাদের মতন বুকে গুটিয়ে, গাছের গুড়ি’ ঘেঁষে বসলো সে। কৌতূহল কিছুটা উবে যেয়ে সেখানে ভয় উদয় হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, চারপাশে তাকিয়ে বনের কোন অংশই দেখতে পাচ্ছেনা সে। যেন এক লাল সমুদ্রের ছোট্ট দ্বীপে হাড়িয়ে গেছে। অথচ অতোটা দূরে তো ছিল না এই টিলাটি। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে আৎকে উঠে উপরে তাকায় মীরা। ওর চুল ছুঁয়েই ঘণ্টাগুলো তীব্র ভাবে দুলছে। যেন সজোরে কেউ নাড়িয়ে দিচ্ছে অগুলো। ভয়ে ছিটকে সরে এলো সে। মোহ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ভেতরে। নিজের ভুলের জন্য আফসোস হতে লাগলো। কোন দুঃখে যে এসেছিল এখানে! সত্যি কি নিশি খেকো বিনাস হয়েছে? নাকি এখনও………
মৃদু ছলাক ছলাক শব্দে ভাবনার তোড় ছিড়লো। জলের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় এবং আতংকে জমে যায় মীরা। দীঘির জলে সমুদ্রের ঢেউ এর মতন সৃষ্টি হয়েছে। যেন কেউ জলের চাদর ধরে খেলা করছে। ওপার থেকে এপার অব্দি লাল ঢেউ এসেই আবার ওপারে ফিরে যাচ্ছে। তবে জলের ছিটেফোঁটা কোথাও পড়ছে না। কি আশ্চর্য! মীরা চাপা আতঙ্কে নিজেকে গাছের সাথে মিশিয়ে ফেলল। হাসানের কথা মনে পড়ছে। কেন সে হাসানকে সব খুলে বলল না?! কেন?! চোখ ফেটে অশ্রু গড়ালো। অনেক চেষ্টার পরও কান্না থামছে না। থেমে থেমে হেঁচকির মতন হচ্ছে। কত ভালবাসার সংসার তার। কেন ঘাড়ে এই সমস্যা টেনে তুল্ল?!
ঝপাং করে শব্দ হতেই সতর্ক হয়ে গেল মীরা। কিছু একটা পড়েছে জলে। বেশ ভারী। ততক্ষণে অবশ্য ঢেউ থেমে শান্ত হয়েছে দীঘি। কিন্তু কি পড়লো ? ঐ তো, জলের একটি অংশের ফুল গুলো ভীষণ ভাবে দুলছে। সেদিক চোখ ফালা ফালা করে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ফুল গুলো চিঁরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মীরার ইচ্ছে হচ্ছে, চিৎকার দিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। ঐ তো! একটি জন্তুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে! লোমশ দুটো কান ভেসে উঠলো জল ফুঁরে। এরপর ভাসলো জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ। বুকের ভেতর ধক করে উঠে মীরা’র। বন্য শেয়াল! নিশি খেকো’র বন্য শেয়াল! অজান্তেই বিরবির করে উঠে। ঠিক তখনি তাকে চমকে দিয়ে আশেপাশের জল ফুঁরে ভেসে উঠে আরও কয়েক জোড়া চোখ, কান। হিংস্রতায় গর্জে উঠতে উঠতে এগুচ্ছে অগুলো। চোখ গুলোয় অদ্ভুত এক ধরনের চকচকে আলো। শিকারি সামনে পেলে যেমন হয় কোন বন্য পশুর, ঠিক তেমন। মীরা আর কিছু ভাবতে পারছে না। পালাতে হবে তাকে, যে করেই হোক। নাহলে এখানেই প্রাণটা যাবে। বহু কষ্টে জড়তা কাটিয়ে, পেছনের জলে ঝাপ দিলো সে। ঠিক তখনি শেয়াল গুলো’র হিংস্রতা আরও প্রকট রূপ ধারন করলো। মীরা আপ্রাণ সাঁতার কেটে যাচ্ছে। একবার কোনমতে পেছন ফিরতেই পাগলের মতন সাঁতারের ধ্রুততা বাড়িয়ে দিলো। জন্তু গুলো রীতিমত ঝাপিয়ে এদিকে আসছে!
কতক্ষণ এভাবে সাঁতার কাটছে ঠিক নেই। একসময় ভাগ্য সহায় হলো। মীরা পারে যেয়ে উঠলো এবং আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে দৌড়াতে শুরু করে দিলো। পেছনে ফিরবার প্রয়োজন নেই। পদধ্বনির শব্দ-ই বলে দেয় শেয়াল গুলো এখনো তার পিছু নিচ্ছে। ক্ষত-বিক্ষত পা দুটো নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটছে মীরা। অনেক সময় নিচু ডালপালার আঘাতে ছিলে যাচ্ছে গাল, হাত। আবার পদতলে কাঁটা ফুটতেই কুঁকড়ে উঠছে। বুনোলতায় ঘষা খেয়ে পা জ্বলে যাচ্ছে। তবুও থেমে থাকলে চলবে না! শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে চলে। কিন্তু বিধি বাম। গাছের মরা ডালে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে মীরা।
হেঁচকির মতন কাঁদতে কাঁদতে পায়ে হাত বুলোয় মেয়েটা। চামরা ছিলে গলগল করে রক্ত ঝরছে। ব্যাথা ভুলে ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে। আশ্চর্য! শেয়াল গুলো নেই! অবাক হয়ে ফেলে আসা শূন্য পথে তাকিয়ে থাকে সে। এরপর যখন সামনে ফিরে, পাথর মূর্তির ন্যায় স্তব্দ হয়ে যায়। যেন বিদ্যুৎ গর্জে ওর উপর পড়েছে। বাকরুদ্ধ হয়ে, ফালা ফালা চোখে তাকিয়ে থাকে সামনের অদ্ভুত মানুষটির দিকে। আলখাল্লা জাতিও পোশাক পরিহিত। হাতে সাপের মতন একেবেকে যাওয়া একটি লাঠি। হাতের নখ গাছের শিকরের ন্যায় কালো এবং বেঁকে আছে। কুচকুচে কালো অবয়বে চোখ দুটো থেকে লালাভ আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। এ নিশ্চয় নিশি খেকো! ব্যাপারটা মনে হতেই অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে মীরা’র। ওর চিন্তা গুলো পড়েই যেন ভয়ংকর শব্দ করে হেসে উঠলো মানুষটি। অথবা মানুষ রুপী পিশাচটি। সন্ধ্যার মরা আলোয় সেই হাসি ভয়ংকর ভাবে মিশে গেলো সমস্ত বনে। সৃষ্টি করলো এক অপার্থিব প্রতিধ্বনি। পিশাচ সাধক এবার ঘাড় বাঁকিয়ে ঝুঁকে এলো মীরার দিকে। মিরা বিকট চিৎকার দিয়ে খোরা পা নিয়ে-ই আবার দৌড় শুরু করে। তখনি কথা নেই বার্তা নেই, শুরু হলো শিলা বৃষ্টি। সাথে এলো-পাতারি বাতাস। গাছের পাতা- ডাল ভেদ করে, শিলা গুলো গায়ে এসে বিঁধতেই ব্যাথায় মূর্ছা যেতে চায় মীরা। কিন্তু থেমে গেলে হবেনা। তাকে যে করেই হোক, এই ভয়ংকর, অভিশপ্ত বন পেড়িয়ে লোকালয়ে ফিরতে-ই হবে।
………যেন কতকাল দৌড়ে যাচ্ছে মীরা। পেছন থেকে ভেসে আসছে সাপের মতন হিসহিসে শব্দ। একসময় মনে হয়, সেই শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে। তখন শরীর নেতিয়ে পড়তে চায়। আবার পরমুহূর্তেই হুট করে ওটা তীব্র হয়ে কানের পাশ কাটিয়ে যায়। তখন আবার বেঁচে থাকার তাগিদে হুরমুর করে বেগ বাড়ায় সে। শেষবারের মতন পেছন ফিরতেই থমকে গেলো। ততক্ষণে শিলা বৃষ্টি থেমে গেছে। পেছনে পিশাচ সাধক নেই। তার বদলে ওপারের গাছের পাহাড় ছাড়িয়ে আকাশে ভরাট চাঁদ। গাঢ় রাত্রি কে আলোকিত করে এক গভীর মায়া ছড়িয়ে দিয়েছে সেই চাঁদ। রুপোর আলোয় ভাসছে চারপাশ। এই উতাল পাতাল অপরূপ জ্যোৎস্না মীরা’র মনে কোন ভাবান্তর ঘটায় না। ভয়ংকর পরিশ্রান্ত সে। ঘাড় এলিয়ে বসে পড়ে। হু হু করে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কাঁদবার শক্তি টুকুও পাচ্ছে না। নিস্তেজ হয়ে আসছে দেহ।
হঠাৎ খুট করে শব্দে ভীত চোখে সামনে তাকায় মীরা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলো, একটি অচেনা তরুনি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। ভয় পাবার বদলে, বিস্ময়ে মন অভিভূত হলো মীরা’র। মেয়েটি-ও কি তার মতন পিশাচ চক্রে আটকে গেছে?! মনে মনে ভাবে। ঠিক তখনি তরুনি মেয়েটি এক ছুটে ওর বেশ কাছে চলে এলো। গোল, ভরাট, মায়াবী মুখশ্রী। এলোমেলো দীঘল কেশ। কপালের বা পাশে বড় এবং কালো গোলাকার দাগ এই ম্লান আলোতেও চোখ এড়ায় না।
“আমাকে বাঁচাও। ও আমায় মেরে ফেলবে…!”
টেনে টেনে, ফিসফিসিয়ে বলল মেয়েটি। মীরা-ও ওর মতন করেই বলল,
“কে…? কে মারবে…?!”
যদিও সে জানে, নিশি খেকো’র কথা বলছে এই মেয়ে। তবুও, কথার জবাবে কিছু বলতে-ই যেন, জানতে চাওয়া।
“ও… ঐ যে…”
বলেই বা দিকে আঙ্গুল তুলে নির্দেশ করলো। ঝট করে মীরা উঠে দাড়ালো। সেই কালো পোশাকধারী পিশাচ সাধক এবং তার পেছনে বন্য শেয়ালের পাল। সাধক সহ সব গুলো শেয়ালের জ্বলজ্বলে চোখ ওদের দুজনের উপর। মেয়েটি আবার ফিসফিস করে বলল,
“চল! দেরী করলে ওরা আমাদের খেয়ে ফেলবে!”
বলেই দৌড়াতে শুরু করলো। মীরা আর এক মুহূর্ত দেরী না করে ওকে অনুসরণ করতে থাকে। চাঁদের রহস্যময় আলো-আধারিতে দুই অপরিচিতা নারী ব্যাকুল হয়ে ছুটছে। পেছনে ছায়ার মতন তাড়া করছে মৃত্যু! ভয়ংকর মৃত্যু!
অদ্ভুত গোঙানির শব্দে পেছন ফিরে দাড়িয়ে পড়ে মীরা। ওর পেছনে-ই বন্য শেয়াল গুলো ছিঁড়ে-ছুঁড়ে একটি তরুনি’র লাশ খাচ্ছে। ঝাঁজরা দেহখানা থেকে ছিটিয়ে আসা রক্ত মীরাকেও স্পর্শ করলো। কিছুটা দূরে দাড়িয়ে পিশাচ সাধক বিরবির করে কি এক মন্ত্র পড়ছে এবং পুরোটা জংগল কাঁপিয়ে হেসে উঠছে। মীরা হরবরিয়ে বমি করে দিলো। নাহ! আর পারবে না সে। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ফিসফিস করা পরিচিত সেই কণ্ঠ,
“আর দেরী করোনা… চল… পালাতে হবে……আরেকটু পথ বাকি……”
মীরার দেহ ভার শূন্য হতে লাগলো। ঠিক যেন পাখির পালক। বসা থেকে শুয়ে পড়লো সে। উপরে ঘুরপাক খেতে থাকে ভরাট চাঁদ। বাতাসে উড়তে থাকে ফিসফিসানি, রক্তের গন্ধ। যেন এক মৃত্যু পুরীতে এসে আটকে গেছে সময়। চোখ দুটো বুঝেই আসছিল, তার আগমুহূর্তে আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। ভরাট চাঁদটাকে আড়াল করে একটি অবয়ব ভেসে উঠলো চোখের সামনে। ভীষণ পরিচিত সেই অবয়ব। কে? কে ওটা…? … বিরবির করে বলতে বলতে চোখ বুঝে মীরা। জ্ঞান হারাতে হারাতেই টের পায়, কেউ একজন তাকে মাটি থেকে তুলে নিচ্ছে। তারপর আর কোন অনুভূতি নেই। অন্ধকারে ডুবে যায় মীরা…
ধবধবে সাদা বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করতেই, কিছুক্ষণ চুপচাপ কোথায় আছে বুঝতে চেষ্টা করে মীরা। সব কিছু মনে পড়তেই, এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে উঠে মন। যাক! বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি ঘটলো তাহলে! বিছানার ওপাশেই জানালায় ফিনফিনে সাদা পর্দা উড়ছে। সেখানে হাসান দাড়িয়ে। মিহি কণ্ঠে ওকে ডাকতেই ভীষণ চমকে উঠে হাসান। এরপর যখন বুঝতে পারে, মীরার জ্ঞান ফিরেছে এবং সে-ই তাকে ডাকছে। দৌড়ে ছুটে আসে।
“আল্লাহ! জ্ঞান ফিরলো তোমার ! কি যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম…!”
কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে এলো হাসানের। মীরা’র ইচ্ছা হলো, হাসানের চুলে হাত বুলিয়ে দিক। কিন্তু, বহুচেষ্টা করেও জোর পেলো না। তা ছাড়া দু-হাত ভর্তি কতরকম ব্যান্ডেজ আর নল লাগানো !
“মীরা……”
“হু……”
“এখন ভালো লাগছে একটু…?”
“হু, লাগছে। আচ্ছা, আমাকে ওখান থেকে কে এনেছে? তরিকুল্লাহ চাচা?”
“হ্যাঁ, তরিকুল্লাহ চাচা।”
“উনি কোথায়? উনার সাথে কথা বলবো।”
“না না, সেসব কথা এখন না বললেও চলবে!”
হই হই করে উঠলো হাসান।
“না, আমার সাথে যা হয়েছে……”
“অগুলো নিতান্তই হ্যেলুসিনেশন মীরা।”
“ধরে নিলাম তা হ্যেলুসিনেশন। কিন্তু, একটি রহস্য’র জট খোলার প্রয়োজন আছে।”
“সেটা দেখা যাবে। তুমি সুস্থ হয়ে নাও। ডাক্তার এখন এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে নিষেধ করেছেন।”
মীরা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। এরপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে চোখ বুঝলো। মাথা দপদপ করছে। যেন, ছিঁড়ে পড়বে।
মীরা বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। আসমা তার পাশেই। হাসান ঘরের ভিতর, লোক আনিয়ে জিনিস পত্র গোছাতে ব্যস্ত। বাড়িটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওরা। মীরা’র সাথে যা ঘটে গেছে, সেটার পর কিছুতেই এখানে থাকতে ভরসা পাচ্ছেনা হাসান। হোক তা হ্যেলুসিনেশন। মীরা’র অনুভূতি মিশ্র। মাঝে মাঝে মনে হয়, যা ঘটেছে, তা ওর উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা মাত্র। আবার কখনও ভেবে অবাক হয়, কি করে অবিশ্বাস করবে সেই জীবন্ত অনুভূতিগুলো কে। আর সেই মেয়েটি? যার কপালের বা পাশের কালো দাগটি পর্যন্ত এখনও চোখে ভাসে। ফুঁপানির শব্দে ভাবনায় ছেঁদ পড়লো। আসমা কাঁদছে। মীরা’রা চলে গেলে এই মেয়েটি হয়ত ফিরে যাবে তার পুরনো অবস্থানে। মায়া পড়ে গেছে একে অপরের প্রতি।
“আসমা…”
“জ্বে…”
“কাঁদিস না। আমাদের সাথে যাবি অন্য শহরে?”
“জ্বে। যাব।”
“মায়ের জন্য মায়া লাগবে না?”
“জ্বে না। আমার মা নাই।”
“আচ্ছা।”
আশ্বাসের কণ্ঠে বলেই চোখ বুঝতে যেয়েও, গেটে কড়া নারার শব্দে ফিরে তাকায় মীরা। আসমা দৌড়ে গিয়ে ওটা খুলে দিতেই তরিকুল্লাহ ঢুকলো। মীরা বড় বড় চোখ করে তরিকুল্লার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর এই পর্যন্ত লোকটি একবার ও আসেনি। মীরার ধারনা ছিল, হাসান আসতে বারন করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেই ধারনা ভুল। তরিকুল্লাহ ইচ্ছে করেই আসেনি।
“ভালো আছেন চাচা?”
“জ্বে আম্মা। আপনার শরীর টা কেমন?”
“ভালো।”
“আম্মাজান, আমারে তলব করছিলেন?”
“জ্বী, কিছু প্রশ্ন ছিল।”
“বলেন।”
“সেদিন বনের ভেতর……”
“ওইটা কল্পনা ভাইবা ভুইলা যান। নিশি খেকো বাইচা নাই। জবা গাছটা আমি নিজের হাতে কাটছি। দীঘিটা লোকজন মিল্লা ভরাট করছি। তবে শয়তানের সীমানায় চইলা গেছিলেন, তাই হয়তো আবোল-তাবোল কিছু দেখছেন।”
“আপনি জবা গাছ কেটেছেন?!”
মীরার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়।
“জ্বে।”
“কিন্তু, কেন?!”
তরিকুল্লাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে উদাস নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর হাতের নখ খুটতে খুটতে বলল, “ঐ জংগল, ঐ রক্ত দীঘি, জবা গাছ আর নিশি খেকো আমার জীবনডা আউলাইয়া দিছে। সেই জন্য।”
“মানে?!”
দীর্ঘ কথোপকথনের প্রস্তুতি নিয়ে বলতে শুরু করে তরিকুল্লাহ, “সে বহুকাল আগের কথা। তখন আমার যৌবন বয়স। পেয়ারী নামের একটা মাইয়ারে মুহাব্বত করতাম। বাবা, মায় জানতে পাইরা বিবাহ দিয়া দিলো। পেয়ারী ছিল বাচ্চা পোলাপানদের মতন। কথায় কথায় রাগ অভিমান। ধরেন, আড়ং এ গেলে, তার জন্য যদি কিরিম-সুনু না আনতাম, সেইদিন আর ভাত খাইতো না। গাল ফুলাইয়া বন-বাদারে লুকাই থাকতো। কতবার এমুন হইছে, লণ্ঠন নিয়া তারে খুঁজতে বাইর হইছি। বনের কিছুটা ভিতরে গিয়া ভয়ে ফিরা আইছি। কিন্তু পেয়ারীর ভয় ডর কিচ্ছু ছিল না। সেই সাহস-ই কাল হইলো। এক অমাবইস্যা রাইত্রে, পেয়ারী গোস্বা কইরা বনে যাইয়া লুকাইলো। সেই যে লুইকাইলো, আর কেউ তারে খুইজা পাইলাম না!”
এতটুকু বলতে বলতে তরিকুল্লাহ চোখের কোন মুছে নিলো। এরপর বিষাদময় কণ্ঠে আবার বলতে লাগলো, “পেয়ারীরে পাওয়া যায় ৭ দিনের মাথায়। আউলা চুলে, আজব পোশাক পইড়া হাজির হইলো এক গভীর রাইত্রে। আব্বা, আম্মা মানতে না চাইলেও, পেয়ারীর প্রতি আমার আবেগ, ভালবাসা দেইখা আর বাধা দিলো না। পেয়ারীরে ঘরে তুল্লাম। কিন্তু কপাল, সেই যে পেয়ারীর জ্বর হইলো, আর ভালা হইলো না। অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখাইছি। কিন্তু কেউ সেই জ্বর কমাইতে পারে নাই। বাড়িতে ফিরার ১৯ দিনের মাথায় পেয়ারী মইরা গেলো। মরার আগে, জ্বরের ঘোরে অনেক কথা বলতো সে। সেইসব কথা ছিল এই নিশি খেকোরে নিয়া। তার কর্মকাণ্ড নিয়া। কিভাবে সে মন্ত্রের বসে পেয়ারীরে মোহের জালে ফেইলা বন্দী করলো, কিভাবে সেইখান থাইকা ভাগ্য আর আল্লাহ পাকের দয়ায় ছাড়া পাইলো, সব, সব কইলো পেয়ারী। নিশি খেকো’র আস্তানা কই, ওইটাও জানলাম।”
মীরা স্তব্দ হয়ে শুনছে। কখন যে ওর গাল বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়েছে, টের পায়নি। তরিকুল্লাহ আবার বলতে শুরু করে, “পেয়ারী মইরা যাবার পর, আমি বন-বাদারে ঘুরা শুরু করলাম। আগে যেমুন ভয় পাইতাম, ওইটা কাইটা গেলো। আমি শুধু খুঁজতাম সেই নিশি খেকো’র আস্তানা। পেয়ারী বলছিল, শয়তানের উপাসনায় নিশি খেকো’র শেষ উৎসর্গ ছিল পেয়ারী। পেয়ারীরে বলি দিতে না পারলে তার কি হইবো, এইটাও নিশি খেকো’র মাইদ্ধমে পেয়ারী জানছিল। সেই কারনে, আমিও জানতাম, সব কিছু সত্যি হয়ে থাকলে, নিশি খেকো’র অস্তিত্ব আর নাই। আছে শুধু ওর উপাসনার জায়গা, বস্তু, চিহ্ন। একদিন খুইজা পাইলাম সব। বিনাস কইরা দিলাম লোকজন মিল্লা।
জানতাম, পেয়ারী আর আসবো না। তবুও, যেই বনে ওরে হারাইলাম, সেই বনেই ওরে খুইজা বেড়াই। মাঝে মাঝে চোক্ষে ধান্দা দেখি, মনে হয়, পেয়ারী সামনেই দাড়াই আছে। সেইদিন রাইত্রে, তেমনি কইরা ঘুরতে ঘুরতে আপনেরে দেখলাম, আম্মাজান। আপনে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, মনটা বড় উতাল পাতাল করতেছিল। বারবার মনে হইতেছিল, পেয়ারী বিপদে। তাইতো পাগলের লাহান ছুইটা গেছিলাম আবার সেই আস্তানায়।”
এক নিশ্বাসে বলে থামে তরিকুল্লাহ। তার তামাটে চামরা বেয়ে স্বচ্ছ জল। মীরা নিরবে চোখের পানি মুছে নিলো।
“চাচা…”
“জ্বে আম্মাজান।”
“আপনার পেয়ারী’র কপালের বা পাশে কি বড় একটি কালো দাগ ছিল?”
তরিকুল্লাহ ফালা ফালা চোখে তাকিয়ে আছে মীরা’র দিকে। পেয়ারী’র কপালের বা পাশে সত্যি ভীষণ বড় একটা জন্ম-দাগ ছিল। সেটাকে তরিকুল্লাহ আদর করে শুকতারা ডাকতো।
মীরা দ্বিতীয় বার আর প্রশ্ন করলো না। তরিকুল্লাহ’র দৃষ্টি বলে, পেয়ারী’র কপালে দাগ ছিল। এর মানে, বনের গহীনে, মৃত্যু’র তাড়া থেকে বাঁচাতে তাকে পেয়ারী-ই সাহায্য করেছিলো। হোক সে হ্যেলুসিনেশন। হোক সে উর্বর মস্তিস্কের কল্পনা, তবুও মেয়েটির জন্য মায়ায় মন ভরে উঠে মীরা’র। আর একটি প্রশ্ন যে প্রশ্ন ই থেকে যায়, সবটা যদি কল্পনা-ই হবে, তবে পেয়ারী? কিভাবে আসলো সেই কল্পনায়?! পুরোটা-ই কি নিতান্ত হ্যেলুসিনেশন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মীরা। কিছু রহস্য সবসময় রহস্য-ই থেকে যায়। এটাই হয়তো সৃষ্টির নিয়ম।
ফটকের তালা লাগাতে লাগাতে শেষবার বাড়িটির দিকে তাকালো মীরা এবং হাসান। মন খারাপ লাগছে। কতনা যত্ন সহকারে পুরোটা বাড়ি গুছিয়েছিল ওরা।
একটু দূরেই তরিকুল্লাহ দাড়িয়ে। মীরা’র ইচ্ছে হলো, বৃদ্ধকে একবার জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সেই ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নিলো না। মৃদু হেসে হাত নাড়লো শুধু। তরিকুল্লাহ-ও হাত নাড়লো। আশ্চর্য। লোকটা কাঁদছে! তরিকুল্লাহ খেয়াল করলো, পেয়ারী, আব্বা, আম্মা মারা যাবার পর, এই প্রথম অন্য কোন মানুষের জন্য তার মন নরম হলো।
বড় রাস্তার উদ্দেসে ওরা হাঁটছে। হাটতে হাটতে-ই পেছনে তাকায় মীরা। রাজপ্রসাদের মতন বাড়িটা দুলে দুলে দূরে সরে যাচ্ছে। আরও একটি দৃশ্য চোখে পড়লো, একজন পরাজিত তরিকুল্লা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের বনে। হয়তো জীবনের শেষ নিশ্বাস থাকা অব্দি, ওখানেই খুঁজে বেড়াবে সে তার প্রিয় মানুষটাকে। চোখের ধান্ধা হয়ে যদি আবার একবার পেয়ারী’র মুখ খানা ভেসে উঠে চোখের সামনে! কিছু ভালবাসা এমনি হয়। সীমানার ওপারে গিয়েও ফিরে আসে। বারবার ফিরে আসে।
*************************************(সমাপ্ত)***********************************