পাড়ার গলির মুখে ছোট্ট দোকান বন্ধ করে বাজারে মামার দোকানে গিয়ে হাজির হলাম, মামার হিসেব নিকাশে একটু হাত লাগানোর উদ্দেশ্য।
ঘড়ি তে তখন রাত ১০ – ১০:২০। শীতের শেষ গরমে ভাবটা নিয়ে রাত খুব একটা হয়নি মনে হচ্ছে ।
মোবাইল ব্যাংকিং,টাকা রিচার্জ, কম্পিউটার লোড এ সব নিয়ে মামার দোকানে ছোট খাটো একটা ঝটলা লেগেই থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
ভীড়টা কেন জানতে একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম মাঝ বয়সি (৪০-৪৫) , ৫.৮” কি ৫.৯” লম্বা, ক্লিন সেভ করা এক লোক হাসি মুখে সামনে বসে থাকা কম্পিউটারে ছোট ভাই টাকে কিছু বলছে এবং দোকানে থাকা কিছু লোক ও তার কথা কৌতুহলে শুনছে।
কৌতুহলে হলেও কেন যেন একটু ভয় ও কাজ করছে সবার। তাদের কৌতুহল নিয়ে আমার ও লোকটাকে দেখার ও শুনার ইচ্ছা হল।
লম্বা মানুষ গুলার চেহারায় একটু বোকা বোকা ভাব কাজ করে কিন্তু লোকটার চেহারা তেমনটা দেখাচ্ছে না। খুব হাসি মুখ তারপর কেন জানি চাপা গম্ভীরতা কাজ করে তার। কথা বলার সময় স্থির জড়তা চলে আসে। এই বয়সে ভুড়ি ছাড়া ইন করা সুতির শার্ট এর সাথে জিন্স কাপড়ের পেন্ট ভালোই মানিয়েছে। লোকটা দেখতে যতনা রোমাঞ্চকর তার কথা গুলো আরো রোমাঞ্চকর মনে হল। তার কথার বিষয় বস্তু মনোবিজ্ঞান বা psychology । কে কেমন, তার স্বভাব কেমন, কার চিন্তা দ্বারা কি এই সব।আগে কখনো মনোবিজ্ঞানীর সাথে দেখা হয়নি তাই ব্যাপারটা ভালোই interesting মনে হল।
তার কথা ও আশেপাশের লোকদের হাবভাব দেখা বুঝলাম কয়েক জন মানুষের ভেতরের কথা বলে এইবার পালা আসল কম্পিউটারে বসে থাকা রূপকের কাছে।
পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছু জেনে থাকলে ও নিজেকে নিজে খুব কম জানা হয়। তাই ”আমি কেমন” কথাটা কাউকে জিজ্ঞেস করার কৌতুহল কম বেশি সবার থাকে। তা যদি আবার কোন মনোবিজ্ঞানী কোন ব্যাক্তির কাছে জানা হয় তাহলে তো কথাই নেই।
রূপকের যথারীতি জিজ্ঞাসা আমি কেমন??
লোকটা খুব একটা চিন্তা ভাবনা না করে বলে ফেলল-তুমি খুব কর্মঠ, কিন্তু নিজের দিকটাই বেশি চিন্তায় মগ্ন as like স্বার্থবাজ একটা মানুষের মত। মানুষকে যাছাই বাছাই করে বিশ্বাস কর আর তোমার মধ্যে confusion খুব বেশি কাজ করে।
লোকটার কথার ধরন হাবভাব দেখে যে কেউ তাকে অর্ধ পাগল বলতে পারে কিন্তু মজার ব্যাপার হল রূপককে নিয়ে সে যাই বলল ঠিক ঠিক মিলে গেল। আমি আর রূপক অবাক হয়ে পিক করে হেসে দিলাম।
আমার হাসির কারন ঠিক বলার কারনে আর রূপকের হাসি ভয়ের এ জন্য এইরে লোকটা আমায় জানল কেমন করে????
কথার পাকে সত্যি মিথ্যা যা ই জানলাম তা হল…..,
লোকটির নাম মাসুদ, ঢাকায় থাকে, মনোবিজ্ঞানের ডাঃ, ধানমন্ডি কোন এক শাখায় তার বাসা ও চেম্বার। নোয়াখালীতে ছেলেকে দেখা আর ছেলেকে সারপ্রাইজ দিবে এ উদ্দেশ্যে আসা। নতুন ফোনে নতুন সিম কার্ড লাগানোর উদ্দেশ্য মামার দোকানে সিম এর জন্য আসা।সমস্যা হল নতুন করে বায়োমেটিক এ আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে সিম কার্ড এর ওনার আঙ্গুলের ছাপ নিচ্ছে না।
মাসুদ নামে অদ্ভুত লোকটা আর তার মস্ত বড় ওজন ব্যাগ টা নিয়ে আমি রাস্তার অন্য দোকানে যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হলাম যদি তার জন্য কিছু করা যায়। মূলত তার সাথে যাবার আগ্রহ টা সে ই দেখায়। আর আমি ও ভাবলাম মন্দ কী? মজাই তো হচ্ছে।
দোকানি পরিচিত হওয়ায় তাঁকে লোকটার কথা বুঝিয়ে বললাম এবং সিম কার্ড জন্য। কিন্তু দূরভাগ্য এখানে ও হল না। এ দোকানে আসার পর ও লোকটির স্থীরতা একটু ও আসেনা।
আশে পাশে মানুষগুলো নিয়ে বলাটা তার যেন অসুস্থতা হয়ে পড়েছে। একটা ছেলেকে দেখিয়ে বলল এ ছেলেটা pure কালো হলে কি হবে এর বাইরে যেমন ভিতরে তেমন সুন্দর। আবার ও বিশ্বাস হল লোকটা ভুল না। সে সত্যিইটাই বলছে।
কিন্তু তার কথাগুলো কেমন জানি পাগলাটে ভাব টা বেশি। সবাই কেমন জানি তাকাছে। তার অবস্থা দেখে হাত ধরে দোকানে বাইরে আনলাম। হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলাম এখন কী করবেন।
বাচ্চা সুলভ ভাব নিয়ে বলল : ক্ষুধা লাগছে আমার, এখন খাব! আমি ও বললাম চলেন।
ভালো খাবার হোটেলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।লোকটা হুট করে বলল তোমার ফোনটা দাও তো।
কি নাম্বার, কাকে ফোন করবেন কিছুই না জিজ্ঞেস করে তার হাতে ফোনটা দিলাম। একটা ফোন কল করল, কয়েক সেকেন্ড পর রেখে দিল।
খাবার হোটেল দূরে হওয়ায় তাকে রাস্তা এক পাশে দাঁড় করিয়ে আমি তার মস্ত বড় ব্যাগ মামার দোকানে রাখতে গেলাম আর বললাম নড়চড় হবেন না।
মামার দোকানে তখনো চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, আর লোকটা কে নিয়ে কথা হচ্ছে তখনো। মামা আমাকে দেখে বলল, বেশি সময় সাথে থাকিসনা, লোকটা বেশি সুবিধার মনে হয়নি। আমি ও হাসি নিয়ে বললাম আচ্ছা।
দোকান থেকে কয়েক মিনিট পরে এসে দেখি লোকটা হাওয়া ।
এইরে কই গেল লোকটা, কোন বিপদ হয়নি তো, কোন বাজে মানুষের পালায় পড়ে নি তো? তার কোন বাজে উদ্দেশ্য নেই তো?
তার ব্যাগ এত ওজন কেন, অবৈধ বা অস্ত্র সস্ত্র নেই তো নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছিল তখন!!! ………॥!!
কত গুলো প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, মাথায় আসল তার ফোন কলের কথা। ফোন বের করলাম এবং নাম্বারটায় ফোন দিলাম। লোকটার ভয়েজ না শুনে ফোনটা কেটে হোটেলর উদ্দেশ্যে চললাম, চলার পথে ঔষধ দোকানে দেখলাম ঝটলা। এগিয়ে যেতে দেখি আরে এইতো লোকটা।
এখানেও তার কর্ম সে ঠিক ই উদ্ধার করছে। বিরক্তি নিয়ে টেনে বের করলাম আর খাবার হোটেলে নিয়ে আসলাম। হোটেলে বসিয়ে আমি হাত ধুয়ে আসতে না আসতে দেখি, হোটেলের মেসিয়ার দের নিয়ে খুব কথা চলছে। যথারীতি মনসতাত্তিক বা মনোবিজ্ঞান।
কথা গুলো এমন : এ ছেলেটা এখন যে অবস্থানে থাকুক না কেন সে অনেক বড় হবে। তার ইচ্ছা শক্তি অনেক। জেদটা অনেক বেশি। এ লোকটা অনেক ভীতু যা আছে তা নিয়ে অনেক খুশি। এমন সব কথাবার্তা চলছে। তারা ও অগ্রাহ্য নিয়ে শুনছে। আর আমায় ইশারায় বলছে পাগল কিনা?
ও বলতে তো ভুলেই গেছি এত কিছুর পাকে নিজের কথা টা জিজ্ঞেস করে নিলাম আমি কেমন??। মূলত যাছাই বাছাই করার জন্য বা বলার জন্য বলা।কিন্তু র্দূভাগ্য আমার তার কথার সাথে আমার কিছুই মিলছে না।এইটা কি সে ইচ্ছা করে করল না অন্য কিছু আমি আজ ও বুজি নাই। যাই হোক……..,
তার সাথে আমার প্রশ্ন উত্তর গুলো এমন ছিল…..
তুমি তোমার পরিবারে বড় বা মেজ।
আমি বললাম না আমি সেজ। আমরা ৪ ভাই।
তোমার ফ্যামিলিতে তোমার মূল্যায়ন অনেকটা।
আমি বললাম ” হু” ।
তোমার ফ্যামিলি তে তোমার বাবার আধিপত্য টা খুব বেশি।
আমি বললাম না আমার মায়ের। কারন আমার মা চাকুরি করেন।সংসার নিজেই চালান।
এতটুকু হয়ে চুপ। কিছু সময় পর বললাম আপনি তো আমায় নিয়ে কিছুই বললেন না। বলল সবার কথা তো হুট করে রাস্তায় বলা যায় না। তোমায় নিয়ে বসতে হবে। তার কথা শুনে কিছুটা আমি হতাশ, আমায় নিয়ে কি তার কনফিউশন ছিল কিনা বুঝতে পারি নি। আচ্ছা যাক আবার খাবার টেবিলে ফিরে আসি। তার সামনে রুটি আর গরুর কালো ভূনা। আমার সামনে দধী। খুদা পেট নিয়েও বললাম আমি খেয়ে এসেছি।
ছোট খাটো কথা হতে হতে তার দিকে ঝুঁকে আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না এই যে আপনি সবাই কে নিয়ে স্ব ইচ্ছায় বলছেন এই টা কি ঠিক হচ্ছে? সবাই তো সব কিছু সব ভাবে নেয় না।
খাওয়া বন্ধ করে একটু রাগি চোখে বলল, তুমি হয়তো আমাকে জানো না। আমার যে অভিজ্ঞতা তা ধারনা নেই। আমি যখন পি. এইচ. ডি করি তখন তোমার জন্ম কি তোমার ইয়ে টার তখনো হয়নি ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম হয়ত আপনি ঠিক বলছেন। আমার তেমন যোগ্যতা নেই এমন টা বলার কিন্তু আপনি যা করছেন তা আমার চোখে বা সবার চোখে ঠিক না। আর আরেকটি কথা Psychology বিষয় আপনার পেশা, আমার এক আদটু শখ আছে এইটার প্রতি। সবাইকে নিয়ে তো আপনি বললেন আমি একটু আপনাকে নিয়ে বললে কেমন হয়।
তার সম্মতির আগেই আরেকটু মাথা ঝুঁকে বললাম, আপনি চরম ডিপরেশনে ভুগছেন,আপনার স্ত্রী আপনার সাথে নেই, এখন অন্যকোন পুরুষের সাথে। আর আপনি আপনার ছেলে আর স্ত্রীর জন্য এসেছেন। তারা না থাকায় আপনি নিজেই মানসিক রোগী হয়ে আছেন। আপনাকে ভালো সাইকোলজিসট দেখানো দরকার।
মাংসের ঝাল না নাকি আমার কথা শুনে লাল টকটকে চোখ নিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জানলে আমার স্ত্রী যে…..
আমি বললাম আমি কি ভুল বললাম।
লোকটি দীর্ঘশ্বাস পেলে বলল ” না” , ঠিক তখনী বললাম আমাদের উঠা দরকার। হোটেলের বিল পরিশোধ করে সিগারেটের আগুন ছাড়তে ছাড়তে বলল তোমার বদ্ধ হাত খুলে দেয়া দরকার। আমি মজার ছলে তার হাত ধরে রাস্তা পার হতে হতে বললাম এই তো খুলে দিলাম। লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি মুখ নিয়ে বলল তোমায় নি বসতে হবে। তুমি আমার সাথে যাবে?
থাকার হোটেলের সন্ধান দেখিয়ে রিকশায় চড়লাম দু জনে।
লোকটি বলল আমি তো তোমার নাম্বার থেকে ফোন করেছি তোমার সিম টা কি আমায় দেয়া যাবে।
আমি খুব সহজ ভাবে বললাম না।
Do you trust me?
Of course, not ! গলির মুখে হাসি দিয়ে রিকশা থেকে নামতে নামতে বললাম আমি।
রিকশার টুং টাং শব্দ নিয়ে ছুটতে লাগল।।। আমি ও গলির মধ্যে ফিরে এলাম নিজ গন্তব্যে।
পুনশ্চঃ সকালে মামার দোকানে আবার হাজির হল মাসুদ নামের লোকটা। আমায় দেখে hey young man তোমার সাথে তো বসা হল না?
আমি আবারো হাসলাম ।এরপর আর কখনো দেখা পাইনি তার, ইচ্ছা ও জাগেনি কখন।থাকুক সে তার নিজের মতন আর আমরা আমাদের মতন। আর থাকুক না সবার জীবনে এমন কিছু ধোয়াটে বিভ্রান্তী ।