সেদিন বিকালের ট্রেনেই আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম । অরুণ সকাল থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে । আমার সাথে তেমনএকটা কথা বলছে না । অরুণকে আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে দেখেছি । এমন গম্ভীর মুখে তাকে কখনোই দেখিনি । আমি শতবার তাকে
জিজ্ঞেস করেছি –কিরে কি হয়েছে ? একবারও সে উত্তর দেয়নি ।
রাত তখন আটটা কি নয়টা । অরুণ আর আমি ট্রেনে সামনাসামনি বসে আছি । ট্রেনের এ কামরাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন । ট্রেনের সকল বাতি নিভানো হয়েছে অনেক আগে…ই । পাশের জানালাটা খোলা । খোলা জনালা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে । চাঁদের আলো খানিকটা এসে পড়েছে অরুণের মুখে । আর এতেই আমি তাকে আবছাভাবে দেখছি । এ অদ্ভূত পরিবেশে হঠাৎ অরুণ আমার দিকে ফিরে আচমকা বলল
–আচছা,শহিদ, তুই কি আত্নায় বিশ্বাস করিস?
আলো ছায়াময় সেই নির্জন ট্রেনের কামরায় এমন একটা প্রশ্ন শুনে আমি শিউরে উঠলেও বলি
– না । আমি বিশ্বাস করিনা । হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি যে ।
অরুণ কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবল , তারপর বলতে লাগল,
– তাহলে শোন , তোকে একটা ঘটনা বলি ,অনেকদিন আগে মধুপুরে দুইজন মানুষ মারা যায় ।
একজনকে মসজিদের পাশের আমগাছটায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় । এর একমাস পরেই আরেকজন সেই একই গাছে আত্নহত্যা করে ।
গ্রামাঞ্চলে এইসব ঘটনা নিয়ে খুব তোলপাড় হয় । তখন থেকে আমগাছটা সবাই এড়িয়ে চলতে শুরু করে ।পারতপক্ষেকেউ রাতে ভুলেও আমগাছটার তলা দিয়ে যায়না ।
গতকাল রাতে ফজরের নামাজ পড়তে এই আমগাছটার তলা দিয়েই যাচ্ছিলাম । তখনো অন্ধকার কাটেনি । চাঁদের আলো হয়তো ছিল । কিন্তু আমি যখন যাচ্ছি তখন ঘোর অন্ধকার । এমনিতে আমি বেশ সাহসী । কিন্তু আমগাছটার তলা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম , তখন খেয়াল করলাম আমি আসলে ভয় পাচ্ছি, সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভয় । নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে একা গেলে যে কেউ ভয় পেতে পারে । কিন্তু আমার ভয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম । আমার মনে হল ঠিক আমগাছের গোড়ায় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । আমি কিছু দেখিনি , তবুও মনে হল কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
তারঅস্তিত্ত্ব নেই , শরীর নেই , কিছু নেই , তবুও মনে হইল কিছু একটা আমার পাশে ঠিকই আছে । ঠ
কি তখনি ,অন্ধকারে দেখলাম ঠিক মানুষ বলা যায়না , তবুও অনেকটা মানুষের মত অবয়ব ঠিক আমগাছের গোড়ায় দাড়িয়ে আছে ।
তখন এক জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করল । এমন তীব্র ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি । তখন আমি খেয়াল করলাম আমার পা কাঁপছে ।
আমি এক চিৎকার দিয়ে মসজিদের বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে যাই । তারপর কি হয় জানিনা । জ্ঞান ফিরলে দেখি মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি । অনেকমানুষ ভীড় করে আছে ।
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে অরুণ হাপাতে লাগল । আমি প্রচন্ড ভয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছি । সেদিন ট্রেনে অরুণের সাথে আর কোন কথা হয়নি। অরুণ সারা পথই কি যেন ভাবছিল । রাত তিনটায় যখন ট্রেনটা ঢাকায় আসে তখন ট্রেন থেকে নেমে অরুণ শুধু বলেছিল – যাই । পরে দেখা হবে ।
অরুণ থাকে মগবাজারে , তার বাবা মাকে নিয়ে । আরআমি থাকি মালিবাগে , একা একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে । বাসায় ফিরে সেদিন আর ভয়ে ঘুমুতে পারিনি । বই পড়ে , আলো জ্বালিয়ে রাতটা কোনমতে পার করেছিলাম ।
কিছুদিন পর প্রচন্ড কাজের চাপে অরুণের গল্প ভুলেই গেছিলাম । মধুপুরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ অরুণ আমাকে ফোন করে উদভ্রান্তের মত বলল
– দোস্ত তুই আমারে বাঁচা
– কেন কি হয়েছে ?
–আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
–কি হয়েছে । খুলে বল ।
–সেদিন গভীর রাতে মধুপুর থেকে ফিরে , ট্রেন স্টেশন থেকেই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম ।
রিকশাটা চলতেচলতে যখন একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকল , ঠিক তখনি আমার মনে হল কিছু একটা আমার পাশের খালি জায়গায় বসে আছে ।
অনুভূতিটা এতই তীব্র যে আমি আমার পাশে একঝলক তাকিয়েও দেখলাম । সেখানে কিছুই নেই ।আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার মনের ভুল । ঠ
কি তখনই আমার মনে একটাঅদ্ভুত চিন্তা আসল , ভয়ানক কোনকিছু মধুপুর থেকে আমি আমার সাথে করে নিয়ে আসিনি তো ?
মন থেকে যতই চিন্তাটা ফেলে দিতে চাইলাম ততই তা ঝাকিয়ে বসল ।কিন্তু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে যখনই আমাদের বাড়ির গলিটাতে ঢুকলাম তখনই ঐটাকে দেখলাম ।
সামনেই অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে । তার চোখ নেই ,মুখ নই, পা নেই , তবু মনে হল ওটা চেয়ে আছে আমারই দিকে , তার মুখে ক্রুরহাসি ।।
আমি দৌড়ে বাড়ির গেটে যেয়ে দারোয়ানকে ডাকতে থাকি । দারোয়ান আমাকে ধরে নিয়ে পৌছে দিয়ে আসে আমাদের ফ্ল্যাটে ।
এতকথা অরুণ একনাগাড়ে বলে হাপাতে লাগল । আমি বললাম
–এ সবই তোর কল্পনা । চিকিৎসা নিলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে ।
–প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম । তিনজন সাইকোলজিস্টের সাথে দেখাকরেছি , সব বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি ।এখন আমি আমার রুমে তাকে দেখি , দেখি কিছু একটা হাটছে আমার অন্ধকার ঘরে । -ঘর অন্ধকার করে ঘুমালে প্রায়ই দেখি মশারির ওপাশে কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । তাই এখন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই ।
–ঠিক আছে তোকে আরো কিছু সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিই , তুই গিয়ে দেখা করে আয় ।
ঠিকানা নিয়ে অরুণ ফোন রেখে দেয়।
আমার দেয়া ঠিকানাগুলোতে সে গিয়েছিল কিনা জানিনা । কিন্তু মাসখানেক পর অরুণ যখন তার রুমের ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে আত্নহত্যা করে তখন খুবই অবাক হই । বহু কাজেরমধ্যেও তার জানাজায় যাই । তার বাবা সেদিন আমাকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেকক্ষন । কেন অরুণ আত্নহত্যা করেছে তা কেউ বলতে পারেনি । তবে শেষের দিকে অরুণ নাকি গভীররাতে- কে কে বলে চেচিয়ে উঠত আর একা একা কথা বলত ।
অরুণের লাশ কবর দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । অরুণ আমার অনেক কালের বন্ধু । সে আর আমি একসাথে কত জায়গায় ঘুরতে গেছি । তার আর আমার বহু স্মৃতি মনে পড়ে কষ্ট হতে লাগল । জানিনা কতক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হেটেছি , জানিনা কেদেছি কিনা , কত কি ভেবেছি তাও জানিনা । রাত দশটায় বাড়ির গেটে আসতই দারোয়ান বলল
–ভাইজানের কি মন খারাপ ?
–না ।
–তাইলে মুখ অমন শুকনা কে ?
আমি ঊত্তর না দিয়েগেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম । সিড়ি দিয়ে উঠার সময় পাশের বাসার বিড়ালটাও উঠতে লাগল আমার সাথে ।
আমার ফ্ল্যাট তিনতলায় । ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে তাকাতেই এক তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল ।
আমার রুম তখন পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে ,
পাশের বাড়ি থেকে কিছু আলো এসে পড়েছে আমার রুমে ।
আর এই অস্পষ্ট অদ্ভূত আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার শোয়ার ঘরের সিলিং ফ্যানটায় ঝুলে আছে অরুণের লাশ !
তীব্র ভয়ে কাপতে কাপতে দৌড়ে নিচে নেমে ,গেটের কাছে এসে হাপাতে লাগলাম । দারোয়ান দৌড়ে এসে বলল — আরে ভাইজান কি হইছে?
–লাশ!
– লাশ ? কোথায় ?
–আমার রুমে দারোয়ান পানি দিয়ে বলল
– লন পানি খান । আর কি হইছে একটু খুইলা কন ।
–রুমের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি , সামনের রুমে যে ফ্যানটা তাতে রশি পেচিয়ে কেউ একজন ঝুলে আছে ।
–কন কি? চলেন তো আমার সাথে ।
ফ্ল্যাটে এসে দেখি কিছুই নেই । দারোয়ান মৃদু হাসি দিয়ে বলল– বেহুদাই ভয় পাইছেন ।
দারোয়ান চলে গেলেও আমি ফ্ল্যাটে ঢুকতে সাহস পেলাম না । আধ ঘন্টা পরেযখন ঢুকলাম তখন আগের ঘটনাটা নিজের কাছেই কেমন হাস্যকর লাগছে।
রাতে আরেকবার গোসল সেরে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম ।
গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার ঘুম এত সহজে ভাঙ্গে না । তারমানে কিছু একটা হয়েছে ।
ভালো করে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করলাম তখন হঠাৎ মনে হল কিছু একটা নিশব্দে হাটছে আমার বিছানার চারপাশ দিয়ে ।
মশারির জন্য ভালো করে কিছুই দেখতে পারছি না তবু মনে হল গাঢ় অন্ধকারে আরো গাঢ় কিছু একটা নড়াচড়া করছে । তীব্র একটা ভয় আমাকে গ্রাস করল ।
এতো তীব্র ভয় আমি জীবনে পাইনি ।
ঘরে বাতাস নেই , ফ্যান বন্ধ, তবুও আমি স্পষ্ট দেখলাম , আমার মশারিটা হঠাৎ নড়ে উঠল ।
হঠাৎ পায়ের দিকে মশারির দিকে আমার চোখ গেল , আর তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম , সেখানে একজন মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে
অনেকখানি জিভ বের হয়ে আছে , মুখ রক্তে কালো , চোখটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে বাইরের দিকে ।
জ্ঞান হারানোর পূর্বে টের পেলাম মানুষ পচা তীব্র দুর্গন্ধ আমার রুমজুড়ে ছড়িয়ে গেছে ।
গভীর রাতে এখনো আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । তাকিয়েথাকি অন্ধকারে । কিছুই দেখি না । তবু মনে হয় কিছু একটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে!!ভয়ানক কিছু একটা হওয়ার প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনছি ।
বারান্দায় কিছু একটা হাটছে । ধীর পদশব্দ শোনা যাচ্ছে , আর কিছু ফিস ফিস শব্দ । নাহ! আজ আর লিখতে ইচছে করছে না , জানিনা আর কোনদিন লিখার সুযোগ পাব কিনা ।
৩ সেদিন বিকালের ট্রেনেই আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম ।
অরুণ সকাল থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে ।
আমার সাথে তেমন একটা কথা বলছে না ।
অরুণকে আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে দেখেছি । এমন গম্ভীর মুখে তাকে কখনোই দেখিনি । আমি শতবার তাকে জিজ্ঞেস করেছি –কিরে কি হয়েছে ?
একবারও সে উত্তর দেয়নি । রাত তখন আটটা কি নয়টা । অরুণ আর আমি ট্রেনে সামনাসামনি বসে আছি । ট্র
েনের এ কামরাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন । ট্রেনের সকল বাতি নিভানো হয়েছে অনেক আগেই । পাশের জানালাটা খোলা ।
খোলা জনালা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে । চাঁদের আলো খানিকটাএসে পড়েছে অরুণের মুখে । আর এতেই আমি তাকে আবছাভাবে দেখছি ।
এ অদ্ভূত পরিবেশে হঠাৎ অরুণ আমার দিকে ফিরে আচমকা বলল –আচছা,শহিদ, তুই কি আত্নায় বিশ্বাস করিস? আলো ছায়াময় সেই নির্জন ট্রেনের কামরায়এমন একটা প্রশ্ন শুনে আমি শিউরে উঠলেও বলি – না । আমি বিশ্বাস করিনা । হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি যে ।
অরুণকিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবল , তারপর বলতে লাগল, –
তাহলে শোন , তোকে একটা ঘটনা বলি ,অনেকদিন আগে মধুপুরে দুইজন মানুষ মারা যায় ।
একজনকে মসজিদের পাশের আমগাছটায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় ।এর একমাস পরেই আরেকজন সেই একই গাছে আত্নহত্যা করে ।
গ্রামাঞ্চলে এইসব ঘটনা নিয়ে খুব তোলপাড় হয় ।তখন থেকে আমগাছটা সবাই এড়িয়ে চলতে শুরু করে ।পারতপক্ষে কেউ রাতে ভুলেও আমগাছটার তলা দিয়ে যায়না ।
গতকাল রাতে ফজরের নামাজ পড়তে এই আমগাছটার তলা দিয়েই যাচ্ছিলাম । তখনো অন্ধকার কাটেনি । চাঁদের আলো হয়তো ছিল।
কিন্তু আমি যখন যাচ্ছি তখন ঘোর অন্ধকার। এমনিতে আমি বেশ সাহসী ।
কিন্তু আমগাছটার তলা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম , তখন খেয়াল করলাম আমি আসলে ভয় পাচ্ছি , সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভয়।
নির্জনএকটা রাস্তা দিয়ে একা গেলে যে কেউ ভয় পেতে পারে ।কিন্তু আমার ভয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম ।
আমার মনে হল ঠিক আমগাছের গোড়ায় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । আমি কিছু দেখিনি , তবুও মনে হল কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
তার অস্তিত্ত্ব নেই , শরীর নেই , কিছু নেই , তবুও মনে হইল কিছু একটা আমার পাশে ঠিকইআছে । ঠিক তখনি ,অন্ধকারে দেখলাম ঠিক মানুষ বলা যায়না , তবুও অনেকটা মানুষের মত অবয়ব ঠিক আমগাছের গোড়ায় দাড়িয়ে আছে।
তখন এক জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করল । এমন তীব্র ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি। তখনআমি খেয়াল করলাম আমার পা কাঁপছে।
আমি এক চিৎকার দিয়ে মসজিদের বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর কি হয় জানিনা। জ্ঞান ফিরলে দেখি মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি । অনেক মানুষ ভীড় করে আছে ।
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে অরুণ হাপাতে লাগল । আমি প্রচন্ড ভয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছি । সেদিন ট্রেনে অরুণের সাথে আর কোন কথা হয়নি । অরুণ সারা পথই কি যেন ভাবছিল ।
রাত তিনটায় যখন ট্রেনটা ঢাকায় আসে তখন ট্রেন থেকে নেমে অরুণ শুধু বলেছিল – যাই।
পরে দেখা হবে । অরুণ থাকে মগবাজারে , তার বাবা মাকে নিয়ে। আর আমি থাকি মালিবাগে ,একা একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে ।
বাসায় ফিরে সেদিন আর ভয়ে ঘুমুতে পারিনি। বই পড়ে , আলো জ্বালিয়ে রাতটা কোনমতে পার করেছিলাম ।
কিছুদিন পর প্রচন্ড কাজের চাপে অরুণের গল্প ভুলেই গেছিলাম । মধুপুরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ অরুণ আমাকে ফোন করে উদভ্রান্তের মত বলল – দোস্ত তুই আমারে বাঁচা – কেন কি হয়েছে? –আমি বোধহয় পাগলহয়ে যাচ্ছি ।
–কি হয়েছে । খুলে বল।
–সেদিন গভীর রাতে মধুপুর থেকে ফিরে , ট্রেন স্টেশন থেকেই একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম ।
রিকশাটা চলতে চলতে যখন একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকল , ঠিক তখনি আমার মনে হল কিছু একটা আমার পাশের খালি জায়গায় বসে আছে ।
অনুভূতিটা এতই তীব্র যে আমি আমার পাশে একঝলক তাকিয়েও দেখলাম । সেখানে কিছুই নেই ।আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার মনের ভুল । ঠিক তখনই আমার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসল , ভয়ানক কোনকিছু মধুপুর থেকে আমি আমার সাথে করে নিয়ে আসিনি তো ? মন থেকে যতই চিন্তাটা ফেলে দিতে চাইলাম ততই তা ঝাকিয়ে বসল । ক
িন্তু রিকশা ভাড়া মিটিয়ে যখনই আমাদের বাড়ির গলিটাতে ঢুকলাম তখনই ঐটাকে দেখলাম ।
সামনেই অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে । তার চোখ নেই ,মুখ নই, পা নেই , তবু মনেহল ওটা চেয়ে আছে আমারই দিকে , তার মুখে ক্রুর হাসি।। আমি দৌড়ে বাড়ির গেটে যেয়ে দারোয়ানকে ডাকতে থাকি । দারোয়ান আমাকে ধরে নিয়ে পৌছে দিয়ে আসে আমাদের ফ্ল্যাটে । এতকথা অরুণ একনাগাড়ে বলে হাপাতে লাগল। আমি বললাম –এ সবই তোর কল্পনা । চিকিৎসা নিলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে । –প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম ।
তিনজন সাইকোলজিস্টের সাথে দেখা করেছি , সব বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি ।
এখন আমি আমার রুমে তাকে দেখি , দেখি কিছু একটা হাটছে আমার অন্ধকার ঘরে ।
-ঘর অন্ধকার করে ঘুমালে প্রায়ই দেখিমশারির ওপাশে কিছু একটা দাড়িয়ে আছে । তাই এখন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই ।
–ঠিক আছে তোকে আরো কিছু সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিই , তুই গিয়ে দেখা করে আয় ।
ঠিকানা নিয়ে অরুণ ফোন রেখে দেয়। আমার দেয়া ঠিকানাগুলোতে সে গিয়েছিল কিনা জানিনা ।
কিন্তু মাসখানেক পর অরুণ যখন তার রুমের ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে আত্নহত্যা করে তখন খুবই অবাক হই । বহু কাজের মধ্যেও তার জানাজায় যাই ।
তার বাবা সেদিন আমাকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেকক্ষন । কেন অরুণ আত্নহত্যা করেছে তা কেউ বলতে পারেনি ।
তবে শেষের দিকে অরুণ নাকি গভীর রাতে- কে কে বলে চেচিয়ে উঠত আর একা একাকথা বলত ।
৪ অরুণের লাশ কবর দিয়ে যখন বাসায় ফিরছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । অরুণ আমার অনেক কালেরবন্ধু ।
সে আর আমি একসাথে কত জায়গায় ঘুরতে গেছি । তার আর আমার বহু স্মৃতি মনে পড়ে কষ্ট হতে লাগল ।
জানিনা কতক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হেটেছি , জানিনা কেদেছি কিনা , কত কি ভেবেছি তাও জানিনা । রাত দশটায় বাড়ির গেটে আসতই দারোয়ান বলল –ভাইজানের কি মন খারাপ ? –না ।
–তাইলে মুখ অমন শুকনা কে ? আমি ঊত্তর না দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম ।
সিড়ি দিয়ে উঠার সময় পাশের বাসার বিড়ালটাও উঠতে লাগল আমারসাথে । আমার ফ্ল্যাট তিনতলায় । ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে তাকাতেই এক তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল । আমার রুম তখন পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে , পাশের বাড়ি থেকে কিছু আলো এসে পড়েছে আমার রুমে । আর এই অস্পষ্ট অদ্ভূত আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার শোয়ার ঘরের সিলিং ফ্যানটায় ঝুলে আছে অরুণের লাশ ! তীব্র ভয়ে কাপতে কাপতে দৌড়ে নিচে নেমে ,গেটের কাছে এসে হাপাতে লাগলাম । দারোয়ান দৌড়ে এসে বলল — আরে ভাইজান কিহইছে? –লাশ! – লাশ? কোথায় ? –আমার রুমে দারোয়ান পানি দিয়ে বলল – লন পানি খান ।
আর কি হইছেএকটু খুইলা কন । –রুমের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি , সামনের রুমে যে ফ্যানটা তাতে রশি পেচিয়ে কেউ একজন ঝুলে আছে । –কন কি? চলেন তো আমার সাথে । ফ্ল্যাটে এসে দেখি কিছুই নেই ।
দারোয়ান মৃদু হাসি দিয়ে বলল– বেহুদাই ভয় পাইছেন ।
দারোয়ান চলে গেলেও আমি ফ্ল্যাটে ঢুকতে সাহস পেলাম না । আধ ঘন্টা পরে যখন ঢুকলাম তখন আগেরঘটনাটা নিজের কাছেই কেমন হাস্যকর লাগছে।
রাতে আরেকবার গোসল সেরে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম । গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমার ঘুম এত সহজে ভাঙ্গে না । তারমানে কিছু একটা হয়েছে ।
ভালো করে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করলাম তখন হঠাৎ মনে হল কিছু একটা নিশব্দে হাটছে আমার বিছানার চারপাশ দিয়ে ।
মশারির জন্য ভালো করে কিছুই দেখতে পারছিনা তবু মনে হল গাঢ় অন্ধকারে আরো গাঢ় কিছু একটা নড়াচড়া করছে । তীব্র একটা ভয় আমাকে গ্রাস করল ।
এতো তীব্র ভয় আমি জীবনে পাইনি । ঘরে বাতাস নেই , ফ্যান বন্ধ, তবুও আমি স্পষ্ট দেখলাম , আমার মশারিটা হঠাৎ নড়ে উঠল ।
হঠাৎ পায়ের দিকে মশারির দিকে আমার চোখ গেল , আর তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দেখলাম ,
সেখানে একজন মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে , অনেকখানি জিভ বের হয়ে আছে , মুখ রক্তে কালো , চোখটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে বাইরের দিকে ।
জ্ঞান হারানোর পূর্বে টের পেলাম মানুষ পচা তীব্র দুর্গন্ধ আমার রুমজুড়ে ছড়িয়ে গেছে । ৫ গভীর রাতে এখনো আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । তাকিয়ে থাকি অন্ধকারে ।
কিছুই দেখি না । তবু মনে হয় কিছু একটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে!!
ভয়ানক কিছু একটা হওয়ার প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনছি । বারান্দায় কিছু একটা হাটছে । ধীর পদশব্দ শোনা যাচ্ছে , আর কিছু ফিস ফিস শব্দ । নাহ! আজ আর লিখতে ইচছে করছে না , জানিনা আর কোনদিন লিখার সুযোগ পাব কিনা ।
……………………………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………………………………….