চাপা প্রতিশোধ

চাপা প্রতিশোধ

সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। ইফতারের আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। ৬:৪৭ এ ইফতার। দূত পায়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে রেদওয়ান।বাজার থেকে রেদওয়ানের বাড়ি ৫ মিনিটের রাস্তা।বাজার পেরিয়ে এসেই বাড়ি পাবার আগে ৩ রাস্তার মোড় পরে রেদওয়ানের বাড়ির পথে। দিনের বেলাতেও গাঁ ছমছম পরিবেশ ৩ রাস্তার মোড়ে। কারণ ৩ দিকেই ঘন বাঁশ ঝাড়। আর এই মোড়ে অনেক বার বেকায়দাতে অনেক গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে আর অনেক মানুষ মারা গেছে।লোকে বলে জায়গাটা নাকি অশুভ। আজ প্রথম রোজা।বাজার থেকে ইফতারি কিনে নিয়ে যাচ্ছে রেদওয়ান।৩ রাস্তার মোড়ে

আস্তেই থমকে দাঁড়ালো সে।মোড়ের মাথায় একটা দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে সে দিকে এগিয়ে গেলো রেদওয়ান।এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা ফ্রিজ বসানো রয়েছে মোড়ের মাথায়।উল্টো দিকে মুখ করে বোরকা পরা এক মহিলা সেই ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে দিচ্ছে সবাই কে।যারা পানি নিচ্ছে কম বেশি সবাই কে প্রায় চিনে রেদওয়ান।ইফতারের সময় হয়ে গেছে বিধায় আর না দাঁড়িয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছিল রেদওয়ান।কিন্তু মেয়েলী কন্ঠের ডাকে পিছে ফিরে তাকালো সে।

কি ব্যাপার সবাই ঠান্ডা পানি নিয়ে গেলো আপনি নিবেন না।না নিয়ে চলে যাচ্ছেন যে,,!

বোরকায় নেকাব পরা বিধায় মুখ দেখা যাচ্ছে না।কিন্তু কন্ঠ খুব চেনা লাগলো রেদওয়ানের।

কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না।

না লাগবে না আমার বাড়িতে ফ্রিজ আছে।আমি আসি।(রেদওয়ান)

বলেই ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি দিয়ে রেদওয়ান আবার চলে যাচ্ছিল তখনি হাতে কিছু ঠাণ্ডা জিনিসের স্পর্শ পেল। চমকে উঠে হাতের দিকে তাকালো।কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে মহিলাকে দেখার উদ্দেশ্য করে তাকালো রেদওয়ান।বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। এক মূহুর্তে কই চলে গেলো মহিলাটি আর ফ্রিজ। খারাপ কিছু একটা ঘটে চলেছে রেদওয়ানের সাথে। ও সেটা বুঝতে পেরে প্রায় দৌড়েই বাড়িতে চলে গেলো। রেদওয়ানের বাড়িতে শুধু ওর মা আর বাবা থাকে।রেদওয়ান বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান।দেশের বাইরে পড়ালেখা করে ৫ বছর পর দেশে ফিরেছে।

বাড়িতে এসে দরজার সামনে মা বলে জোরে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেলো রেদওয়ান। জ্ঞান ফিরে দেখে বিছানায় শুয়ে আছে পাশে মা বাবা আর একজন ডাক্তার। রাত ১১ টা বেজে গেছে।এতক্ষণ অজ্ঞান ছিল রেদওয়ান। রেদওয়ানের মা রেদওয়ানের কাছে জানতে চাইলো সে কি ভয় পেয়েছে।রাস্তায় ঘটে যাওয়া সব কথা খুলে বললো রেদওয়ান।

ঘটনা শুনে সবাই চমকে উঠল।

তোমার ভাগ্য ভালো বেচে ফিরেছো আর ঐ পানি নাওনি ওর থেকে।যেই ঐ পানি নিয়েছে সেই কোনো না কোনো অসুখে মারা গেছে।(ডাক্তার)

কি বলছেন আপনি এসব।শুধু আমি না ওখানে এই একালার অনেকেই পানি নিচ্ছিল।কে ঐ মহিলা।আর এই ভাবে পানি দিচ্ছিলো কেন সবাই কে।(রেদওয়ান)

তুই তো দেশে ৫ বছর ছিলিস না তাই জানিস না।৩ বছর আগে পাশের গ্রাম থেকে এক মহিলা তার ১৫ বছর বয়সের এক মেয়ে কে নিয়ে আমাদের গ্রামে মানে ৩ রাস্তার মোড়ের পাশে জায়গা কিনে বাড়ি করে।মেয়েটার নাম ছিল ঝুম।ওরা মা মেয়ে বাড়ি থেকে তেমন বের হতো না।মহিলার স্বামী মারা গিয়েছিল।সে বার ছিল রোজার মাস। রোজার মাসে প্রচুর রোদ আর গরম ছিল।ঐ মহিলার মেয়ে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি ইফতারের সময় খাওয়ার জন্য বায়না করছিল।নিজের বাড়ি ফ্রিজ না থাকায় বাধ্য হয়ে মহিলা টা মেম্বারের বাড়িতে ফ্রিজে পানি রেখেছিল।তখন আমাদেরও ফ্রিজ

ছিল না।ইফতারের ১০ মিনিট আগে ঝুম মেম্বারের বাড়িতে পানির বোতল আনতে যায়।সেদিন ঘটনা ক্রমে মেম্বারের বাড়িতে শুধু মেম্বারের ছেলে আজাদ ছিল।আজাদের স্বভাব বরাবরি খারাপ ছিল।ঝুমের সাথে ও খারাপ আচরণ করেছিল।পানি না নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বাড়িতে আসছিল। মোড়ের উপর আসতেই রাস্তায় মাটি টানার মিনি ট্যাঁকের সাথে ঢাক্কা খায় ঝুম।হাসপাতালে নিতে নিতেই মারা যায় ঝুম।মারা যাবার আগে সব কথা বলে যায় ওর মা কে।গ্রামের আরো অনেকেই মেম্বারের বাড়িতে পানি রাখতে যেত।ঝুমের মৃত্যুর কোনো আইনি প্রতিবাদ করেনি ঝুমের মা।কারণ তিনি জানেন যে টাকার শক্তির কাছে মিথ্যার বলের কাছে হেরে যাবেন তিনি। কিন্তু থেমে থাকেননি।

ঝুমের মৃত্যুর ৭ দিন পর ৩ রাস্তার মোড়ে ঝুমের মা একটা ফ্রিজ বসায় আর সবাই কে ডেকে ডেকে ফ্রিজে পানি রাখতে বলে।সবাই ভাবে মেয়ের মৃত্যুর শোকে এমন হয়ে গেছে।শান্তনা দেওয়ার জন্য লোকজন ও পানি রাখতো নিতো। আজাদের কুনজর ঝুমের মায়ের উপর ও পরলো।যদিও তিনি বোরকা পরে মুখ বেধে রাখতেন।আজাদ শয়তানি করে পানি রাখতে যেতো ঝুমের মায়ের কাছে আর আনতে যেতো ইফতারের সময়। পানি নিবার অজুহাতে ছুঁইয়ে দিতো ঝুমের মায়ের হাত।লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসতো।আমি নিজেও দুই দিন পানি

রেখেছিলাম।একদিন সকালে শুনি আজাদ মারা গেছে বিষ খেয়ে।আর সেই বিষ ফ্রিজে রাখা পানির বোতলেই পাওয়া গেছে।সেদিন মোড়ের মাথা একজনের প্রাণ ভরা হাসি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম মেয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবার আত্ততৃপ্তি।ঝুমের মায়ের হাসি দেখে আনন্দ দেখে সবাই বুঝে গেলো আজাদের পানির বোতলে উনিই বিষ মিশিয়ে

ছিলেন।সেদিন অইচ্ছাকৃত ভাবে ট্যাঁকের সাথে ঝুমের এক্সিডেন্ট হয়। কিন্তু ঝুমের মায়ের এক্সিডেন্ট মেম্বার করিয়েছিল।মেম্বারের ইশারায় ট্যাঁক এসে ঢাক্কা দেই ঝুমের মাকে। পিষিয়ে দেই মোড়ের উপরের ফ্রিজ। ঘটনা স্থলেই মারা যায় ঝুমের মা।সেদিনের পর থেকে প্রায় মানুষ ফ্রিজ সহ ঝুমের মাকে দেখতে পেতো। যারা উনার মহে পরে পানি নিয়েছে আর সেই পানি খেয়েছে তারাই কোনো না কোনো অসুখ করে মারা গেছে।তুই যাদের পানি নিতে দেখেছিস উনার কাছে তারা সবাই মৃত আর তাদের মৃত্যু ঐ পানিতেই হয়েছে।(রেদওয়ানের মা)

কিন্তু মা যখন ঐ মহিলা আমাকে পানি নিবার জন্য ডেকেছিল তখন আমার মনে হয়েছিল খুব পরিচিত চেনা গলার সর।(রেদওয়ান)

জানিনা তুই কেমন কন্ঠ শুনেছিস। তবে লোকে বলে সে নাকি চেনা গলাতেই কথা বলে লোক কে কাছে ডাকে।তুই আর সন্ধ্যার সময় ঐ দিকে যাস না।(রেদওয়ানের মা)

পরেরদিন আবার ইফতারের সময় রেদওয়ানের খুব ইচ্ছে করছিল ৩ রাস্তার মোড়ে যেতে।কেউ যেন তাকে টানছে।এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো রেদওয়ান মোড়ের উপর।কালকের মত বোরকা পরা নয় আজ এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে ফ্রিজের কাছে একে একে পানি নিয়ে সবাই চলে গেলো। মেয়েটা হাতের ইশারায় রেদওয়ান কে ডাকলো।মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেন রেদওয়ান এগিয়ে যাচ্ছিল তার দিকে।সন্ধ্যার লোগোনে নীল ড্রেস, নীল চুড়ি আওলা চুলে যেন অপ্সরীর মত লাগছিল মেয়েটা কে। এক পলকে তাকিয়ে আছে রেদওয়ান আর ভাবছে এটাই বুঝি ঝুম।মেয়েটা ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি বের করে রেদওয়ান কে দিলো। হাত বারিয়ে পানি নিলো রেদওয়ান।

ইফতারের সময় হয়ে গেছে পানি নিয়ে বাড়ি যান।(ঝুম)

ঝুমের কথা মত পানি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো রেদওয়ান। কিছুতেই ভুলতে পারছেনা ঝুমকে।বার বার চোখের সামনে ভাসছে ঝুমের হাতছানি।

সেহেরী সময়ে আৎতনাদ চিৎকার কান্না শুনা গেলো রেদওয়ানের বাড়ি থেকে।প্রতিবেশিরা সবাই ছুটে এলো।বিছানায় পরে আছে রেদওয়ানের নিথর দেহ। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে।পাশে পরে আছে পানির বোতল।

………………………………………………………………..সমাপ্ত……………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত