শালার লিফটের খ্যাতায় আগুন! ‘বিড়বিড় করে একটা গাল দিয়ে নষ্ট লিফটটার সামনে থেকে সরে এল সাব্বির।
সিড়ির সামনে এসে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল সিড়ির দিকে। এখন এটা বেয়ে পাঁচতলায় উঠতে হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসতে চাইছে।
বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে উঠতে শুরু করল সিড়ি বেয়ে।সারাদিনের অফিসের ধকলে শ্রান্ত পাদুটোকে টেনে নিতে বেশ পরিশ্রম হচ্ছে সাব্বিরের।দোতলা পর্যন্ত উঠতেই বুঝতে পারল, মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে এত কেন হইচই! ঘরে নতুন বউ অপেক্ষা করছে, তারওপর এই জ্বালাতন সহ্য হয়?
যেন অনন্তকাল পর নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাড়াল সাব্বির। ও কলিংবেল চাপবে, আখিঁ এসে দরজা খুলবে, এই ধৈর্যটুকুও হলনা সাব্বিরের।ওর কাছে বাড়তি চাবি আছে, ওটা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
‘আখিঁ, আখিঁ,’ হাক ছাড়ল সাব্বির।কোনো সাড়া নেই।
কী ব্যাপার? কই গেল মেয়েটা? অন্যান্য দিন তো ও বাসায় ঢুকতেই ছুটে আসে। ‘ ভাবতে ভাবতে একরুম থেকে আরেক রুমে উঁকি দিতে লাগল সাব্বির। উঁহু, কোথাও নেই। বাইরে গেছে বোধহয়। সেলফোনটা বের করে ডায়াল করল আখিঁর নাম্বারে।
আপনার কাংখিত নাম্বারটিতে এইমূহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা,অনুগ্রহ করে একটু পরই আবার ডায়াল করুন। আপনি আপনার নাম্বার থেকে, এক, দুই, তিন ডায়াল করে দুইটাকা প্রতি মিনিটে . . .ইত্যাদি ইত্যাদি।পর পর কয়েকবার সুরেলা কন্ঠে একঘেয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে মেজাজটাই বিগড়ে গেল সাব্বিরের।খানিকটা ভয়ও করতে লাগল । আঁখি তো কখনো একা বাইরে যায়না। দোকান টোকানেও যাতে না যেতে হয় সেজন্য সাব্বির একটা দোকানে বলে রেখেছে, ফোন করলেই প্রয়োজনীয় জিনিসটা দিয়ে যায় ওরা। তাছাড়া ঢাকা শহরে কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই আখিঁর। তারওপর মোবাইলটাও বন্ধ। তাহলে?
মাত্র একমাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। সাব্বিরের বাবা মা দুজনেই গ্রামে থাকে। সাব্বিরের নিজের ব্যবসা আছে।বেশ বড় ব্যবসাটা।আয়ও যথেষ্ঠ ভাল। প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা পাঠায় বাবা মা ‘র কাছে।
আর আঁখি? সাব্বিরের পারিবারিক অবস্থা যতটাই ভাল আখিঁর পারিবারিক অবস্থা ততটাই সঙিন।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সৎমায়ের কাছে বড় হওয়া মেয়ে আখিঁ।ওর নিজের মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। এরপর বাবা আরেকটা বিয়ে করলে পুনরাবৃত্তি ঘটে সৎমায়ের সেই চিরায়ত ইতিহাসের।
এর আগেও একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিল আখিঁর। বিয়ের কয়েকদিন আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় ছেলেটা।
এদেশে এধরনের মেয়েদের সাধারণত ‘অপয়া’ জাতীয় বিশেষনে ভূষিত করে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাদের বিয়ে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাবস্থা করা হয়।আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোই করে।
সাব্বির যখন ওর অফিসের এক কর্মচারীর পিড়াপিড়িতে আখিঁকে দেখার জন্য ওদের এলাকায় আসে তখনই এধরনের কিছু মানুষ নিজ দায়িত্বে সাব্বিরের কানে কথাগুলো পৌঁছে দেয়।আর সাব্বির তাদের উদ্দেশ্যে দেয় একটুকরো করুণার হাসি।এধরনের স্টুপিড কথাবার্তা কখনোই কানে তোলে না সাব্বির।
আখিঁকে দেখার সাথে সাথেই সাব্বির ঠিক করে ফেলে, বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করবে। হোক সে অপয়া।ডাইনী হলেও কোনো সমস্যা নেই।এত রুপবতী একটা ডাইনীর সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে পারলে মন্দ হয়না!
একসপ্তাহের মধ্যে ওদের বিয়ে হয়ে যায়।পরবর্তী একটা মাস যেন উড়ে উড়ে চলল।সাব্বিরের মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে, এইতো সেদিনই না ওরা কবুল বলে পরস্পরের হাত ধরল!
ওরা দুজনে প্ল্যান করেছে আগামী সপ্তাহে হানিমুনে যাবে দেশের বাইরে।
প্রায় আধঘন্টার বেশি হয়ে গেছে এখনও কোন খবর নেই আখিঁর। ফোনটা এখন পর্যন্ত বন্ধ।ঝগড়া ঝাটিও তো ওদের মধ্যে হয়নি যার কারণে রাগ করে কোথাও চলে যাবার প্রয়োজন পড়তে পারে আখিঁর।
সাব্বির ঠিক করল পুরো ফ্ল্যাটটা আবার ভালভাবে দেখবে।কোথাও অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে পারে আখিঁ।
খুঁজতে শুরু করল সাব্বির। একপর্যায়ে ওদের বেডরুমে এসে জিনিসটা চোখে পড়ল সাব্বিরের।একটা ভাঁজ করা কাগজ।দেখেই বোঝা যায়। সযত্নে কেউ রেখেছে খাটের শিথানে।পেপারওয়েটটা সরিয়ে কাগজটা হাতে নিল সাব্বির। আখিঁর হাতে লেখা বেশ বড় একটা চিঠি।কী এমন ঘটল যার জন্য এতবড় চিঠি লিখতে হবে, ঠিক মাথায় ঢুকলনা সাব্বিরের।একটা ফোন করলেও তো হতো।
চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল সাব্বির।
প্রথম লাইনটা পড়ার সাথে সাথেই যেন বাজ পড়ল সাব্বিরের মাথায়।
চিঠির শুরুতে কোনো ধরনের সম্বোধন নেই। প্রথমেই লেখা, ‘নাইমকে মনে পড়ে? তোমার প্রিয় বন্ধু নাইম? ‘
এই একটা লাইনই সাব্বিরের সমস্ত অস্তিত্ব ধরে ঝাঁকি দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ।
হ্যাঁ, নাইমকে ওর মনে আছে, খুব ভালভাবেই মনে আছে, এবং বাকি জীবন ওকে ভোলার কোন সুযোগই নেই সাব্বিরের।
নেংটাকালের দোস্ত ‘বলতে যা বোঝায়, আক্ষরিক অর্থে তা না হলেও নাইম এবং সাব্বিরের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়, অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত।
ওদের পরিচয় কলেজের প্রথম দিনে। এরপর বন্ধুত্ব। একটু একটু করে সেই বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি কলেজ ছাড়িয়ে ভার্সিটির গন্ডিতে গিয়ে ঠেকে। একসাথেই পড়াশোনা শেষ করে ওরা।পারিবারিক দিক দিয়ে দুজনের পরিবারই ছিল মোটামুটি সচ্ছল।
ওদের আগে থেকেই প্ল্যান ছিল ওরা ব্যবসা করবে।সুতরাং পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে জুতোর তলা ক্ষয় করার পেছনে সময় নষ্ট না করে দুজনের পুঁজি এক করে একটা ব্যবসা দাড় করায়।এক্সপোর্ট -ইমপোর্টের ব্যবসা। প্রথম বছরটায় ব্যবসায় বড় ধরনের একটা মার খেয়েও হালটা ওরা ছাড়েনি। পুরষ্কার হিসেবে দ্বিতীয় বছর থেকেই লাভের মুখ দেখা শুরু করে।
এরপরের বছরই শক্ত যমীনের উপর দাড়িয়ে যায় ওদের ব্যবসাটা।দুজনেই ফ্ল্যাট কেনে, গাড়িও হয়।চলছিল ভালই।
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন মানুষ যখন সম্পদের মুখ দেখে তখন একরকম দিশেহারা হয়ে পড়ে।ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখে বড় হওয়া এই মানুষগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধরা স্বপ্ন হাতের মুঠোয় পুরতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে অনেক কিছুই। যার মধ্যে অন্যতম হল চরিত্র।
সাব্বিরও ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল।ড্রিংকস, বার, জুয়ার মত ব্যাপারগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড সোসাইটির মাপকাঠি ভেবে নিয়ে “জাতে ওঠার “জন্য এগুলোকে সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
নাইম সবসময়ই নিজে যতটা না এগুলো থেকে দুরে থেকেছে তার চাইতে আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সাব্বিরকে পথে আনবার।লাভ হয়নি।
মাত্র তিনমাস আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় নাইম।
জয়দেবপুরে একটা কাজে গিয়েছিল ওরা দুবন্ধু। ফেরার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা গাছের সাথে গাড়ির প্রচন্ডে সংঘর্ষে নিহত হয় নাইম।স্পট ডেড।
ড্রাইভ করছিল সাব্বির।বড়ধরনের কোনো ক্ষতি না হলেও বেশ ইনজুরড হয় সাব্বিরও।
কিন্তু প্রশ্ন হল, আখিঁ কিভাবে নাইমের কথা জানল? নাইমের মৃত্যুর পরই তো সাব্বির আর আখিঁর পরিচয়।
চিঠির বাকিটা পড়তে শুরু করল সাব্বির।
আখিঁ লিখেছেঃ
‘অবাক হচ্ছ অনেক, তাইনা? নাইমকে আমি কিভাবে চিনলাম কিংবা তোমাদের বন্ধুত্বের খবরই বা আমি কিভাবে জানলাম?
তুমি বোধহয় জেনেছ, আমার এর আগেও একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিল, বিয়ের কয়েকদিন আগে আমার হবু বর রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, নাইমই ছিল আমার সেই হবু বর।
ও মারা যাবার দিন পনের আগে আমাদের এন্গেজমেন্ট হয়।নাইমের সাথে আমার পরিচয় মাত্র পনের দিনের হলেও ওই পনেরটা দিনের জন্য আমি হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারব।
জানোই তো, ছোটবেলাই আমার নিজের মা মারা যান। এরপর বড় হয়েছি অনেক কষ্টে। সৎমা বাবার কান ভারী করে করে আমার প্রতি তাঁর মন বিষিয়ে তুলেছিলেন। আমাকে দেখতে পারেনা আমাদের বাড়ির কেউ। আজীবন ভালবাসা বন্চিত আমি ওই পনেরদিনে পেয়ে গিয়েছিলাম ভালবাসার এক অফুরন্ত আধার।
ওই ক ‘দিনে নাইম চারবার ঢাকা থেকে ছুটে আসে নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাড়িতে।মা ‘কে বলে আমাকে নিয়ে বের হত। গল্প করতাম আমরা, দেখতাম স্বপ্ন। অদ্ভুত রংমাখা ছিল আমাদের সেই স্বপ্নগুলো। ভালবাসা নিয়ে এত গল্প, কবিতা, গান কেন রচিত হয়েছে, আমি একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম। মনে হত, বেচেঁ থাকাটা তাহলে এত আনন্দের!
নাইমের কাছেই তোমার সম্পর্কে জানি আমি। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বাইরে নাইমের একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল একটাই, সাব্বির। সারাদিন তোমার কথা। আমি একদিন ওকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, “এতদিন জানতাম, মেয়েরা মেয়েদের সতীন হয়, এখন দেখছি তোমার এই বন্ধুই আমার সতীন হবে।”
তোমার সাথে আমার দেখা হবার অনেক আগেই তোমাকে আমি দেখেছি। নাইম সবসময় ওর মানিব্যাগে তোমার একটা ছবি রাখত। ওখান থেকেই দেখেছিলাম।
নাইমের সান্নিধ্যে নিজেকে হারিয়ে যখন জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেতে চাইছি ঠিক তখনই চলে গেল ও। উহুঁ, ভুল বললাম ,চলে যায়নি, তুমি ওকে সরিয়ে দিয়েছ। ‘
এপর্যন্ত এসে থামল সাব্বির। পরিষ্কার বুঝতে পারছে এয়ারকুলারের শীতল হাওয়াও কপালে জমে ওঠা ঘামের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারছেনা।
এটা কী লিখেছে আখিঁ? চরম সত্যটা তাহলে জেনে ফেলেছে ও!
নাইম আর সাব্বির যখন ব্যবসা শুরু করে, তখনই ওদের মাঝে একটা চুক্তি হয়।ওদের দুজনের কেউ যদি মারা যায় তবে পুরো ব্যবসার মালিক হয়ে যাবে অপরজন। আর একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রতিমাসে মৃতের পরিবার পাবে।
সাব্বির ততদিনে রঙিন পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। জুয়া খেলেও প্রচুর দেনা হয়ে গেছে। কিন্তু নাইম হিসাবের বাইরে একটা পয়সাও দিতনা সাব্বিরকে। পাওনাদারদের চাপে সাব্বির যখন দিশেহারা ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর প্ল্যানটা মাথায় খেলে যায় ওর।
নাইমের একটা অভ্যাস ছিল, নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করত। কাউকে ড্রাইভিং সীটে বসতে দিতনা, এমনকি সাব্বিরকেও।অন্য কারো গাড়িতে উঠলেও সম্ভব হলে নিজেই ড্রাইভ করত।এবং খুবই সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাত নাইম।হয়ত এব্যাপারে কোনো ভীতি কাজ করত ওর মধ্যে।
সেদিন ওরা দুজন ব্যবসার কাজে জয়দেবপুর যাওয়ার পর ফেরার পথে এরকরকম জোর করেই সাব্বির ড্রাইভিং সীটে বসে পড়ে।প্রথমে অনেক বাধা দিলেও একপর্যায়ে সাব্বিরকে চাবিটা দিয়ে দেয় নাইম।
কিছুদুর আসার পরই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু করে সাব্বির।প্রায় নব্বই কিলোমিটার বেগে গাড়িটাকে ছুটিয়ে দেয় বড় একটা গাছের দিকে।এমনভাবে,যেন গাছের সঙ্গে গাড়ির বা দিকটার প্রচন্ড সংঘর্ষ ঘটে।
নাইম সামনের বা দিকটাতেই বসেছিল।সংঘর্ষের ফলে ওর মাথা ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে মারাত্মকভাবে ঠুকে যায়। মাথা ফেঁটে গিয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে নাইমের।
পুরো ব্যাপারটার মধ্যে সাব্বিরের জন্যও প্রচুর ঝুঁকির উপাদান ছিল।সাব্বির গুরুতর আহত হলেও হিসেবের সামান্য গড়মিলেই মারা যেতে পারত সাব্বিরও। কিন্তু প্ল্যানটা ফুলপ্রুফ করতে এর বিকল্প ছিলনা।
নাইম মারা যাবার পর পুরো ব্যবসার একচ্ছত্র মালিক বনে যায় সাব্বির। কেউ এতটুকু সন্দেহ করেনি।
কিন্তু আখিঁ ব্যাপারটা জানল কিভাবে?
‘আবার চমকে দিয়েছি তাইনা? ‘আখিঁ লিখেছে। ‘ভেবেছিলে পরম বন্ধুকে খুন করে বেঁচে যাবে? তুমি হয়ত ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারোনি তোমার নীচ মানসিকতা নাইম আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল।মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া মানুষ অনেক কিছু বুঝতে পারে, যদিও নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকেনা।
নাইম মারা যাবার দুইদিন আগে ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়। সেদিন একেবারেই অন্যরকম দেখেছিলাম ওকে।একপর্যায়ে আমাকে আমাকে এমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে,ওর খুব কাছের একজন ওর ক্ষতি করতে চাইছে।তখন আমল দেইনি কথাটাকে। কিন্তু ওর মৃত্যু আবার সবকিছু গোড়া থেকে ভাবতে বাধ্য করে আমাকে। জানতে পারি সেদিন তুমিই গাড়িটা ড্রাইভ করছিলে, অথচ আমি জানি নাইম কোনোভাবেই অন্যের হাতে নিজের গাড়ির চাবি তুলে দেবেনা।নিজেই সবসময় ড্রাইভ করে।কিন্তু কী ঘটল? তুমি যেদিন ড্রাইভ করলে অ্যাক্সিডেন্টটা সেদিনই হল।এতটা কাকতালীয় ঘটনা সাধারণত ঘটেনা।নাইমের বলা সেই কথাগুলো মুহূর্তেই অর্থবহ হয়ে ধরা দেয় আমার কাছে। ব্যাস দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে কোনো সমস্যাই হয়নি। এরপর নাইমের মৃত্যুতে তুমি পুরো ব্যবসার মালিক বনে যাওয়ার পরও কি আর সামান্য সন্দেহটুকুও থাকে?
ওর মৃত্যু আমার জন্য কতবড় আঘাত, সেটা ব্যাখ্যা করার মত ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি।ধনী জামাইকে হারিয়ে মা বাবার অবস্থা তখন তথৈবচ। তাদের সমস্ত রাগ আমার ওপর জমা হল। সব দোষ যেন আমারই। অত্যাচারের মাত্রাও বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মেয়েরই একমাত্র পছন্দ আত্মহত্যা। আমিও সে পথটাই বেছে নিতে চেয়েছিলাম।তখনই মনে হল আমি আত্মহত্যা করলে কার কী লাভ? না নাইমের আত্মা শান্তি পাবে, না আমার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়া হবে,না তোমার অপরাধের শাস্তি দেয়া হবে। প্রমাণ ছাড়া আমি একা একটা মেয়ে কিভাবে তোমার মত পিশাচের সাথে আইনী লড়াইয়ে নামব ?তাই বলে ছেড়ে দেব তোমাকে? বন্ধুকে খুন করেও পার পেয়ে গিয়ে তার সম্পদ ভোগ করে যাবে আজীবন? আল্লাহর দুনিয়া এতটা নির্মম না।
ঠিক করলাম তোমার মৃত্যুদণ্ড আমিই দেব, তবে মৃত্যুটা হবে ভয়ঙ্কর, একটু একটু করে।
নাইমের সাথে আমার এন্গেজমেন্ট হয়েছিল তোমাদের অফিসের একজন কর্মচারীর মাধ্যমে। তিনি আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন। নাইমের মৃত্যুর পর একদিন তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, তোমাকে যেন একদিন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমার বিশ্বাস ছিল আমাকে দেখলে তোমার পছন্দ হবেই। হলও তাই। বিয়ে হয়ে গেল আমাদের।
বিয়ের পর একটা মাস তোমাকে ভালবাসার অভিনয় করে গেলাম। যখন বুঝতে পারলাম তুমি আমার প্রেমে পুরোপুরি মজে গেছ তখন বুঝলাম আমার কাজ শেষ। আমি চলে যাচ্ছি। এখন তুমি তোমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করতে পারবে ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেললে কতটা শুন্য মনে হয় নিজেকে। যে শুন্যতায় তুমি আমায় ডুবিয়েছিলে আজ আমি তোমাকে সেই শুন্যতা উপহার দিলাম।আমার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু নাইমের রক্তও তো বৃথা যেতে পারেনা। সে ব্যাবস্থাও হয়েছে।
আমি আজ চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার কোনো চেষ্টা কোরোনা। অবশ্য চিঠিটা শেষ করার পর এমনিতেও তোমার সে ইচ্ছা বাকি থাকবেনা। ‘
এপর্যন্ত পড়ে বাকিটুকু পড়ার সাহস অর্জন করতে পারলনা সাব্বির।সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর। এই চিঠিটা পড়ার আগ পর্যন্ত নাইমের মৃত্যুর জন্য কোনো অপরাধবোধ কাজ করেনি ওর মধ্যে। কিন্তু আখিঁর লেখা প্রতিটা শব্দ ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ও একজন কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার ছাড়া আর কিছুইনা। অমানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে ওর। সেই সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করতে পারছে, আখিঁকে ও কতটা ভালবেসে ফেলেছিল।বিয়ের পর সাব্বির সব খারাপ অভ্যাসগুলো আস্তে আস্তে ছাড়তে শুরু করেছিল, শুধু আখিঁর প্রতি ওর ভালবাসাকে সম্বল করে। সেই আখিঁ . . .না, উপযুক্ত প্রতিশোধই নিতে পেরেছে মেয়েটা।
সাব্বির জানে চিঠির শেষটা ওর জন্য আরো ভয়াবহতা নিয়ে অপেক্ষা করেছে।ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের বাকি অংশটুকু কী হতে পারে সেটা সম্পর্কে কোনো ধারনাই ওর নেই। তবে সেটা নিছক মৃত্যুর চাইতেও আরো বেশি কিছু হবে এব্যাপারে নিশ্চিত ও।ওর সহজ মৃত্যু আখিঁকে ক্ষান্ত করতে পারবেনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিক্ত সত্যটার মুখোমুখি হল সাব্বির।
তোমাকে আমি বলেছিলাম তোমার মৃত্যুটা হবে তিল তিল করে। নিজেকে ধ্বংস করে হলেও আমি সেটা করতে পেরেছি।
যাওয়ার আগে তোমাকে একটা উপহার দিয়ে গেলাম আমি।কী সেটা, জানো? এইচআইভি এইডসের জীবাণু! যেটা এখন আমার মাধ্যমে তোমার শরীরে গিয়ে বাসা বেঁধেছে।
বিদায় সাব্বির, বিদায়!