রাহাত আর অর্পার নতুন বিয়ে হয়েছে। ছোট্ট সুখের সংসার তাদের। তারা ১ মাস হলো ঢাকার বনশ্রী তে একটা ফ্যাট ভাড়া নিয়েছে। রাহাত একটি প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরিরত,আর অর্পা গৃহিণী। নতুন বাসায় ওঠার পরে তারা তাদের বাসাটা গুছিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই দুই মাস কেটে গেলো। তাদের বাসায় প্রায় সব জিনিস কেনা হয়ে গেছে।কিন্তু কোনো ড্রেসিং টেবিল তখনো কেনা হয়নি। অর্পা দেখতে অনেক সুন্দর, তাই রাহাত ভাবলো অর্পার সাজগোজের জন্য একটি ড্রেসিং টেবিল খুবই দরকারি। এরই মধ্যে সে এক দোকানে কথা বলে এসেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো যে নতুন ড্রেসিং টেবিল বানাতে অথবা কিনতে গেলে অনেক টাকার দরকার, রাহাতের হাতে এতো টাকা তখন ছিলো না,হঠাৎ ওর চোখে পড়ে এক পুরনো ফার্নিচার এর দোকান। সে সেখানে গিয়ে খুব সুন্দর একটি ড্রেসিং টেবিল পছন্দ করে আসে। ওদিকে অর্পার পুরনো জিনিসে কোন আগ্রহ নেই।বাড়ি গিয়ে রাহাত অর্পাকে বলে অর্পা শুনছো আমি একটা ড্রেসিং টেবিল পছন্দ করে এসেছি। অর্পারো অনেক ইচ্ছে সে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে বসে আয়না দেখবে আর সাজবে। তাই অর্পা উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো -আমি অনেক খুশি রাহাত। রাহাত বললো কিন্ত ড্রেসিং টেবিল টা অনেক পুরনো, এটা শুনে অর্পা কিছুটা দমে গেলো,কারণ পুরনো জিনিস ওর একদম ভালো লাগে না। অর্পা বললো রাহাত পুরনো জিনিস দিয়ে কি হবে তারথেকে আমরা নতুন কিনি?
রাহাত অর্পাকে বললো ডিজাইন টা অনেক সুন্দর, তোমার পছন্দ হবেই। শেষমেশ রাজি হল অর্পা, তাদের বাড়িতে দোকান এর লোক ড্রেসিং টেবিলটি পৌঁছে দিয়ে গেলো। ওটা আসলেই অসাধারণ। রাতে অর্পা ইচ্ছে মতো সাজলো ওটার সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরে এসে রাহাতকে জিজ্ঞেস করলো যে- দেখতো কেমন দেখাচ্ছে আমায়? রাহাতঃ অনেক সুন্দর। এভাবে দুই দিন কাটলো। তৃতীয় দিন যথারীতি সাজতে বসেছে অর্পা। তারমনে হতে থাকলো এই ড্রেসিং টেবিল এর আয়নায় মুখ দেখার পর ওর। রূপ যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে, অর্পা এটা ভেবে নিজের মনেই হাসলো কিছুক্ষণ । অর্পা তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে।হঠাৎ ও খেয়াল করলো আয়নায় ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। আঁৎকে উঠলো ও, আয়নায় ও যা দেখল তা অবিশ্বাস্য, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না অর্পা। ও জোরে রাহাত বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো, কি দেখেছিলো অর্পা?
অর্পার তীব্র চিৎকার শুনে শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এলো রাহাত,এসে দেখলো অর্পা মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাহাত অর্পাকে জিজ্ঞেস করলো তোমার কি হয়েছে অর্পা? এভাবে কাঁদছ কেন? আর চিৎকার করেছ কেন? অর্পা ভয়ে ভয়ে বললো রাহত আমি এই আয়নায় কিছু একটা দেখেছি,আমি হঠাৎ করে দেখলাম, আয়না থেকে আমার মুখ সরে গিয়ে দুটো অস্পষ্ট অবয়ব ফুটে উঠলো আয়নাতে।
একটা লোক একটা মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করছে,আর মেয়েটা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে ছাড়া পাওয়ার জন্য,কিন্তু লোকটা কোন কথাই শুনছে না,আঘাত করে যাচ্ছে মেয়েটাকে। সব শুনে রাহাত বললো -অর্পা তুমি সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছো তাই তোমার হ্যালুসিনেশন হয়েছে। কিন্তু অর্পা বললো, রাহাত আমি সত্যি দেখেছি, তুমি বিশ্বাস করো,আমি প্রথমে ভেবেছি আমাদের পেছনের ফ্ল্যাটের মানুষ হবে হয়তো,স্বামী-স্ত ্রী ঝগড়া করছে ভেবেছি।কিন্তু পরে দেখি সামনের ফ্ল্যাটের যে জানালা আয়না দিয়ে রুমের ভেতরাটা দেখা যাবে সেই রুমে কোনো লোক নেই,এমনকি আলো জ্বালানো নেই পর্যন্ত। রাহাত বললো – কিন্তু অর্পা ওই ফ্ল্যাট টা তো এখনো খালি পড়ে আছে,ওটা তে কোনো লোক থাকে না,আমি কাল ও ওই বাসার দারোয়ান এর কাছে শুনে এসেছি। এসব শুনে অর্পা হতবাক হয়ে গেলো। রাহাত অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অর্পাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো, মেয়েটা খুবই ভয় পেয়েছে।এরপরে কয়দিন আর তেমন কিছুই ঘটলো না,অর্পা নির্ভয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজতে পারলো।
এর সাত দিন পরের ঘটনা,রাহাত তখন অফিসে, অর্পা গোসল শেষে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে, হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো আয়নার দিকে, ও দেখলো দেখে একটা অপূর্ব সুন্দর মেয়ে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মেয়েটার চোখের মণি বাদামী, অর্পা অনেক চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছে না, কিছুক্ষণ পরে প্রবল ঝাঁকি দিয়ে উঠলো অর্পার শরীর, সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। সন্ধ্যা ৭ টায় বাসায় ফিরলো রাহাত, এসেই বাজার কলিং বেল বাজালো,কিন্তু অর্পার কোনো সাড়া নেই,কি হয়েছে মেয়াটার, আবার কিছু হয়ে গেলো না তো,সারাদিন বাসায় অর্পা একাই থাকে,তাই এই প্রশ্নটা বার বার রাহাতের মাথায় আসতে লাগলো। অনেকবার কলিং বেল বাজানোর পরেও দরজা খুললো না অর্পা, রাহাত দরজায় টোকাও দিলো বেশ কয়েকবার, এতেও কাজ হলো না।
এবার রাহাত অর্পার নাম ধরে ডাকা শুরু করলো- অর্পা কোথায় তুমি দরজা খোলো, এবাবে তিন বার ডাকার পরেও ও এলো না দরজা খোলার জন্য। এবার রাহাত আস্তে করে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে গেলো। অদ্ভুত! রাহাত ভাবলো।কারণ একটু আগেও সে দরজায় জোরে টোকা দিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি, আর এবার সামান্যা ধাক্কাতেই দরজা খুলে গেলো,এটা কি করে সম্ভব! যাইহোক এতো ভাবার সময় রাহাতের নেই,তার সমস্ত চিন্তা অর্পাকে নিয়ে।সে ঘরে ঢুকে দেখতে পেলো অর্পা আয়নার সামনে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। রাহাত ভয় পেয়ে গেলো, সে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে এসে অর্পার মুখে পানির ছিটা দিলো। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো অর্পা,কিন্তু রাহাত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, এটা তো অর্পার চোখ নয়।
অর্পার চোখের মণি কালো আর এখন অর্পার চোখের মণি বাদামী হয়ে আছে।এও কি সম্ভব? রাহাত অর্পাকে উঠিয়ে শোবার ঘরে নিয়ে যাইতে চাইলো,কিন্তু অর্পা রাগত সুরে বলে উঠলো- “আমার কাছে আসবেনা বলছি,তুমি চলে যাও”। রাহাত অর্পার এই কথা শুনে বিষ্ফোরিত চোখে অর্পার দিকে চেয়ে রইলো, কারণ এই কন্ঠ অর্পার নয়। রাহাত অর্পাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে তোমার? অর্পা গর্জে উঠলো রাগে আর বললো “আমার কিছু হয়নি, তোকে বললাম না চলে যেতে”। এই বলে অর্পা আবার জ্ঞান হারালো। এবার রাহাত অর্পাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে আবার ওর চোখেমুখে পানি দিল,অর্পা চোখ মেলে চাইলো। এবার আর অর্পার চোখের মণি বাদামী নয়,কালো ঠিক আগের মতো, অর্পা খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলো রাহাত তুমি এসেছো,কি হয়েছে আমার? রাহাত অর্পাকে বললো যে সে অজ্ঞান হয়ে পরে ছিল ড্রেসিং টেবিল এর সামনে,তখন অর্পার মনে পড়ে গেলো ও কি দেখেছে,ও রাহাতকে সব খুলে বললো, রাহাত কিছুই মেলাতে পারছে না।তবে কি সেইদিন আয়নায় দুজন মানুষ কে দেখা, একটা মেয়েকে আয়নায় দেখে অর্পার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া,দরজা একাই খুলে যাওয়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে?
সেইদিন অর্পা অজ্ঞান হয়ে পরে যাওয়ার পর থেকে সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগতে থাকে রাহাতের কাছে।একা কিভাবে দরজা খুলে যেতে পারে এই চিন্তাটা ওর মাথে থেকে কিছুতেই দূর হচ্ছে না,কিন্তু এই নিয়ে অর্পাকে কিছুই বলে না রাহাত।নিজের মনেই এর কারণ খুঁজতে থাকে,দরজায় কোন ত্রুটি আছে কিনা তাও দেখে নিয়েছে,দরজায় কোন রকম সমস্যা নেই। রাহাত কিছুই মেলাতে পারে না। ওই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে আর এসেছে কিছু পরির্তন। হ্যা,তার চিরপরিচিত অর্পা কেমন বদলে গেছে। ও এখন আর রাহাতের সাথে তেমন কথা বলে না। চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা,কিন্তু এটা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ।
আর সবথেকে বিস্ময়কর হলো অর্পা একেক সময় একেক কন্ঠে কথা বলে,মাঝেমাঝে ওর নিজের কন্ঠ আর অন্যসময় অচেনা এক কন্ঠে কথা বলে,আর সেই মুহূর্তে পরিবর্তন হয় ওর চোখের মণির রঙ,আর অর্পা নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ড্রেসিং টেবিল এর আয়নায় চোখ রেখে। রাহাত ভাবে অর্পাকে একটা ভাল ডাক্তার দেখানো উচিৎ। রাহাতের এক বন্ধু মনরোগ বিশেষজ্ঞ। রাহাত ভাবে তার কাছেই নিয়ে যাবে। এরপর দিন রাহাত নাস্তা করে অফিসে গেলো,যাওয়ার সময় অর্পা স্বাভাবিক ছিলো,হাসি মুখে বিদায় দিলো রাহাতকে। আজ রাহাত অফিসে এসে কিছু কাজ শেষ করে ছুটি নিয়ে নিলো। ছুটি নিয়ে রাহাত বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো অর্পা। রাহাত ঘরে ঢুকে অর্পাকে বললো- অর্পা রেডি হয়ে নাও, তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
এই কথা শুনে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে অর্পা বললো-ডাক্তার! আমার আবার কি হলো রাহাত?তুমি কি যে বলো। এই পর্যন্ত বলেই থেকে গেলো অর্পা, হঠাৎ সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো ওর, গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে গেলো,আর চোখের মণির কালার পলকে বদলে গেলো। চেহারায় হিংস্র ভাব ফুটিয়ে তুলে ও বললো, আমি তোমার সাথে কোথাও যাবো না,তুমি সরে যাও আমার সামনে থেকে। এটা শুনে রাহাত প্রচণ্ড ভয়ে পিছিয়ে গেলো অর্পার সামনে থেকে। অর্পা হিংস্র কন্ঠে আবার বলে উঠলো – আমি সাজতে খুব পছন্দ করি,কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে সাজতে হয়,বসার জন্য কোন টুল নেই,সাজার সুবিধার জন্য একটা টুল নিয়ে এসো।
এবার রাহাত বললো – তোমার কি হয়েছে অর্পা?তুমি তো আগে কখনো আমার সাথে এ ধরণের ব্যবহার করনি। অর্পা বললো – তোমাকে যা করতে বলেছি তাই করবে। রাহাত বললো -আচ্ছা, কাল ছুটির দিন,আমি তোমার টুল নিয়ে আসবো। একথা শোনার পরে অর্পা অন্য ঘরের দিকে পা বাড়ালো। রাতে অর্পা রাহাতকে জিজ্ঞেস করলো ও খাবে কিনা। রাহাত উত্তরে বললো খাবে না। এটা শুনে অর্পা বেশ খুশিই হল আর কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বললো- তুমি খাবে না,ভালোই হয়েছে। আমিও খাবো না, এখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজবো। এই কথায় রাহাত অনেক কষ্ট পেলেও কিছু বললো না অর্পাকে।রাহাত শুয়ে পড়লো, আর অর্পা ড্রেসিং টেবিল এর আয়নার সামনে এসে নিজেকে দেখতে থাকলো। পরদিন সকালে রাহাত বাজার করবে বলে বের হলো।
ও ভাবলে যে আগে অর্পার জন্য একটা টুল কেনা দরকার। তাই ও সেই দোকানে গেলো যেখান থেকে ও ড্রেসিং টেবিলটা কিনেছিলো। দোকানদার ওকে দেখেই ভেতরে আসতে বললো। রাহাত ড্রেসিং টেবিলটা এই দোকান থেকে নেয়ার পরে ওদের বাসার অনেক ফার্নিচার এখান থেকেই কিনেছে,তাই দোকানদারের সাথে ওর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ও দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বললো- ভাই,আপনার ভাবির একুটা ছোট টুল দরকার, আপনার দোকান থেকে যে ড্রেসিং টেবিল নিয়েছিলাম সেটার সামনে রাখার মতো কোনো টুল আছে কি? দোকানদারঃ হ্যা,ভাই আছে। (একটা টুল দেখিয়ে) দেখেন তো এটা পছন্দ হয় কিনা? রাহাতঃ বাহ, চমৎকার। ড্রেসিং টেবিল এর সাথে দারুণ মানাবে।আমি তাহলে এটাই নিচ্ছি।
রাহাত দোকানদারের সাথে কথা বলে ওটার দাম ঠিক করলো। তারপর দোকানদারকে বললো- আপনার ভাবি বাসায়ই আছে,আপনি যদি আপনার ছোট ছেলেকে দিয়ে টুল টা আমায় বাসয় দিয়ে পাঠান তাহলে ভালো হতো। দোকানদারঃকোনো সমস্যা নাই ভাই। আমার ছেলে তো আগেও অনেকবার আপনার বাসায় জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছে। রাহাতঃতাহলে আমি বাজার করে এসে আপনার টাকা টা দিয়ে যাবো। দোকানদারঃঠিক আছে। রাহাত বাজারে চলে গেলো। দোকানদার এর ছোট ছেলে জালাল, বয়স ১২ বছর।সে তার ছোট ছেলে জালাল কে বললো টুলটা রাহাতের বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। জালাল অনেকবার ওই বাসায় গিয়েছে তাই বাসা চিনতে ওর কোনো সমস্যা হলো না। জালাল রাহাতের বাসায় গিয়ে দেখলো যে দরজা খোলা।
জালাল বুঝতে পারছে না যে কি করবে। অবশেষে ও ভয়ে ভয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ও আন্টি বলে ডাক দিলো।কিন্তু অর্পার সাড়া নেই,জালাল অনেকবার আন্টি আন্টি বলে ডাকলো।কিন্তু কাজ হলো না। জালাল ভাবলো হয়ত বা আন্টি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ও শোবার ঘরের দরজার কাছে গেলো,গিয়ে যা দেখলো তাতে ও বেশ ভয় পেয়ে গেলো। অর্পার মুখ চুল দিয়ে ঢাকা, চুল গুলো পেছন থেকে সামনে নিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে।জালাম ছোট মানুষ, ওর মাথায় আসলো না কি করবে,তাই ও অর্পার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত দিয়ে ডাকলো-আন্টি, আপনাগো টুল লইয়া আইছি। এবার অর্পা নড়ে উঠে চেঁচিয়ে বললো – আমাকে বাঁচাও, ও আমাকে মেরে ফেলবে,ও আমাকে মেরে ফেলবে। অর্পার চোখেমুখে আতংক, কে যেন ওর সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে,পাংশুটে মুখ ওর, অর্পার উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে চাইলো জালাল,কিন্তু অর্পা জালালের হাত ধরে ফেলে শুধু বলতে লাগলো – বাঁচাও, ও আসছে,আমায় মেরে ফেলবে। ভয়ে জলিলের মুখ শুকিয়ে গেলো। জালাল চিৎকার করে বললো – আন্টি আমারে
ছাইড়া দেন,আমি বাড়ি যামু। এই কথা বলে অনেক কষ্টে অর্পার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে জালাল চলে আসলো ওর বাবার দোকানে। ওর বাবা ওকে পানি খেতে দিলো,প্রচণ্ড হাপাচ্ছে জালাল। এরই মধ্যে রাহাত দোকানে চলে এসেছে টাকা পরিশোধ করার জন্য। রাহাত জালালের এই অবস্থা দেখে দোকানদার কে জিজ্ঞেস করলো- কি হয়েছে ওর? দোকানদার-জালাল দৌড়াতে দৌড়াতে দোকানে এসেছে। এরপর জালাল কিছুটা ধাতস্থ হলে জালাল সবকিছু খুলে বললো। এসব শুনে রাহাত যেন কথা বলতেও ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাহাত দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো – জালাল কি এরকম ভয় আগে কখনো পেয়েছে? অথবা এ ধরণের ঘটনা আগে কখনো ঘটেছি কি?
দোকানদার কিছুটা ইতস্তত করে উত্তর দিলো, হ্যা ঘটেছে। এরপর দোকানদার একটা কাহিনী বললো রাহাতকে, যা শুনে রাহাত বিস্মিত হলো।
ঘটনাটা এই রকমঃ এই দোকান থেকে কিছুটা দূরে এক দোতালা বাড়িতে বাস করত দুই দম্পতি,নাম শোভন আর মুমু। শোভন ব্যবসায়ী। তাদের নতুন বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু কিছুদিন পর শোনা যায় মুমু নাকি পাগল ।
একদিন শোভন এই দোকনদারের দোকানে এসে বলে যে তার বাড়ির কিছু আসবাবপত্র লাগবে,সব আসবাবপত্র তার দোকানেই তৈরি হয়। আর আসবাবপত্র পত্র শোভন সাহেবের বাড়িতে দিয়ে আসার সময় জালাল গিয়েছিল, আরওই বাড়িতে গিয়ে মুমুকে ঠিক ওই অবস্থায় দেখতে পায় জালাল,যেমনটা আর্পাকে দেখেছে। সেদিন ও জালাল এভাবে ছুটতে ছুটতে বাড়ি চলে আসে।আর আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে মুমুও বলেছিল- “আমাকে বাঁচাও,ও আমাকে মেরে ফেলবে” এর কিছুদিন পরে মুমু আত্নহত্যা করে। এরপর শোভন তাদের বাড়িটা বিক্রি করে দেয়।আর তাদের বাড়ির সব আসবাবপত্র এই দোকানে বিক্রি করতে আসে, এই সব আসবাবপত্র কিছু ওই দোকানের বানানো আর কিছু শোভনদের আগে থেকেই ছিলো।
দোকানদার কম দামে সব কিনে নেয়। এরপর আর শোভনকে এই এলাকায় দেখা যায়নি। ঘটনাটা শোনার পর রাহাতের মনে হয় এর সাথে কি অর্পার এই পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে? সে দোকানদারকে আর কিছু বলে না,টাকা দিয়ে দেয়। রাহাত দোকান থেকে বের হতে যাবে এই মুহূর্তে ডাক দেয় রাহাতকে। দোকানদার বলে – ভাই আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি,হয়তো বা এতে আপনার উপকার হতে পারে। আপনি যে ড্রেসিং টেবিলটা আমার দোকান থেকে নিয়েছেন ওটা শোভন সাহেব আমাকে যে ফার্নিচার গুলো বিক্রি কিরেছিলো তার মধ্যে ছিলো।
এই কথা শোনার পর রাহাত দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেললো,তার কাছে এখন সব জলের মতো পরিষ্কার। রাহাত খুব দ্রুত বাসায় চলে গেলো,যে করেই হোক অর্পাকে বাঁচাতে হবে,নিজের থেকেও অর্পাকে বেশি ভালোবাসে রাহাত। রাহাত বাসায় পৌঁছে দেখে দরজা এখনো খোলা আর অর্পা সেই নতুন টুলটিতে বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে মুখ রেখে। রাহাত মনে অনেক সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো বলো কে তুমি? তখন অর্পার বলে উঠলো -আমি মুমু। বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আর বললো – তুমি বুঝতে পেরে গেছো? রাহাত বললো – হ্যা, তুমি অর্পাকে ছেড়ে চলে যাও, ও তো তোমার ক্ষতি করেনি,তুমি কেন কষ্ট দিচ্ছ ওকে? অর্পার ভেতরে থাকা মুমুর আত্মা বলে উঠলো আমি ছাড়বো না,মেরে ফেলবো তোমার অর্পাকে,আর তোমার সাথে থাকলেও তো ও মরেই যেতো। সব ছেলেরাই এক। এ কথা বলেই আবার হাসতে থাকলো ও।রাহাত বললো- তুমি অর্পাকে মেরো না।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো,আমি অর্পাকে ভালোবাসি আমি ওকে মারব না,তুমি কেন বলছ আমার কাছে থাকলে ও মরে যাবে? অর্পার ভেতরে থাকা মুমুর আত্মা বললো- আমি ছেলেদের ঘৃণা করি,জানতে চাও কেন? রাহাত বললো- হ্যা, বলো।কিন্তু অর্পাকে ছেড়ে যাও। মুমুর আত্মা বলতে থাকলোঃ আমার বাবা অঢেল সম্পত্তির মালিক ছিলেন।তার একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি,আমার কোনো ভাই বোন ছিলো না,উনার মৃত্যুর পরে সব সম্পত্তি আমি পাই।
আমার বিয়ে হয় বেশ বড় ব্যবসায়ী শোভনের সাথে,ওর কোন কিছুর কমতি ছিল না,সব ছিলো ওর। আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতাম, তাই আমি চেয়েছিলাম তার সব সম্পত্তি আমি এতিমখানায় দান করতে।কিন্তু শোভন তা জেনে ফেলে।ওর অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও আমার বাবার সম্পত্তির উপর ছিলো ওর লোভ। ও কিছুতেই চাইতো না আমি সম্পত্তি দান করি। তাই ও গভীর ষড়যন্ত্র করে। ও একদিন আমাকে পানির সাথে এক ধরণের জড়িবুটি খাওয়ার, যা খাওয়ার সাথে সাথে আমার মাথার মধ্যে তোলপাড় শুরু হত,মাথা ঘুরতো, আমি কথা বলতে পারতাম না,গলা আটকে যেতো। এভাবে প্রতিদিন আমাকে খাওয়াতে লাগলো, আমি পাগলের মতো আচরণ করতাম জড়িবুটি খাওয়ার পর। কোনোএক ছুটির দিনে ও বাসায় পার্টি করতে চাইলো এবং সব লোকজন আসার আগেই আমাকে জড়িবুটি খাইয়ে দিল জোর করে, আমাকে সবার সামনে নিয়ে আসলো, আমি পাগলের মত আচরণ করতে লাগলাম, আসলে আমি পুরোপুরি ভারসাম্যহীন ছিলাম,সবাই আমাকে পাগল ভেবে একে একে চলে গেলে,তখন থেকে আত্মীয়স্বজন সহ সবাই ভাবতো আমি পাগল হয়ে গেছি।কিন্তু আসল ঘটনা কেউ জানতে পারলো না।
এরমধ্যে আমি একদিন আমার উকিল কে সম্পত্তি দানের জন্য দলিল করার জন্য ফোন করি,সেটা শোভন কিভাবে যেনো জেনে ফেলে। এরপরে আমাকে মারায় ভয় দেখিয়ে সব সম্পত্তি ওর নামে করে নেয়। আর শেষে কি করে জানো? আমার সিগনেচার নিয়ে আমার গলা টিপে হত্যা করে, ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। হত্যা করার সময় হাতে গ্লাভস পরে ছিলো আর সবাই জানতো আমি পাগল তাই কেউ ওকে সন্দেহ করেনি, ও পার পেয়ে গেলো, আর সব কিছু বেচে দিয়ে চলে গেলো। তাই আমি ছেলদের ঘৃণা করি,ওরা শুধু বিশ্বাসঘাতকতা আর অত্যাচার করতে জানে। সব শুনে রাহাত বললো তুমি অর্পার ক্ষতি কর না,আমি ওকে ভালোবাসি, তুই যা চাও তাই করবো।বলো কি করলে ওকে ছেড়ে দেবে? মুমুর আত্মা বললো – তোমাকে ৭ দিন সময় দিলাম শোভন কে এনে দাও আমার সামনে আমি প্রতিশোধ নেব,আর অর্পাকে চিরদিনের মত ছেড় দেবো। রাহাতঃআমি এনে যেভাবেই হোক শোভনকে এনে দেবো
তোমার কাছে। কিন্তু তুমি অর্পার মধ্যে ঢুকলে কিভাবে? মুমুর আত্মাঃ আমাকে যখন শোভন মারত, জড়িবুটি খেয়ে যখন আমি কষ্ট পেতাম, তখন আমার হাহাকার দেখাএ মতো কেউ ছিলো না,আমি নিজের ঘরে কাঁদতাম, এই ড্রেসিং টেবিল এর আয়না যা তোমরা কিনেছো তাতে আমার প্রতিবিম্ব পড়তো, এটাই ছিলো আমার কষ্টের একমাত্র সাক্ষী, এমনি আমার খুনের ও। শোভন এই আয়নার সামনেই আমাকে খুন করে। তাই অর্পা যখন প্রথম এই আয়নায় তাকিয়ে ওর মুখ দেখলো রাতে তখন আমার খুনের আগ মুহূর্তের ছবি ভেসে ওঠে ওতে।
অর্পা এভাবে প্রতিদিন আয়নায় মুখ দেখতো,আমি ওর চোখ থেকে ফিরে আসার শক্তি পাই,আর এই চোখ দিয়েই ওর মাঝে ঢুকে পড়ি। আমি অতৃপ্ত আত্মা, শোভনের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। এরপর দিন সকালে রাহাত খুঁজতে বের হলো শোভনে কে। মুমুর আত্মাই ওকে বলেছিল শোভনকে কোথায় পাওয়া যাবে। অনেক বুঝিয়ে শোভনের বসুন্ধরার অফিস থেকে ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে রাহাত। নিয়ে এসে অর্পাকে দেখিয়ে বলে ও আর্পা আমার স্ত্রী, পরিচিত হোন ওর সাথে। ওকে দেখে অর্পার মধ্যে থাকা মুমুর আত্মা কথা বলে ওঠে- শোভন কেমন আছো? শোভন চমকে যায়,এ কি করে সম্ভব। এটা তো মুমুর গলা।মুমুর আত্মা বলতে থাকে- কি খুব অবাক হচ্ছ? ঠিকই ধরেছ আমি মুমু, না মুমুর আত্মা।তুমি ভেবেছিলে আমাকে খুন করে আমার সব সম্পত্তি একাই ভোগ করবে।কিন্তু আমি তা হতে দেবো না। কি দোষ ছিলো আমার? আমি তো সব লিখে দিয়েছিলাম তোমায়, তবুও কেন খুন করলে?জানি কোন উত্তর নেই তোমার কাছে।কিন্তু আমি প্রতিশোধ নেবো, চরম প্রতিশোধ, তাই আমি মরে গিয়েও
ফিরে এসেছি। হা হা হা। শোভন- আমাকে ক্ষমা করে দাও মুমু। আমি ভুল করেছি। মুমুর আত্মা- ভুল? এতই সহজ মুক্তি পাওয়া! আমি বিনাদোষে শাস্তি পেয়েছি। আমি তোমাকে হত্যা করবো। কিন্তু এবার কথা বলে রাহাত- মুমু তুমি ওকে খুন করো না,তুমি খুন করলে যে সবাই অর্পাকে খুনি ভাববে,কারণ তুমি তো ওর শরীরেই আছো। তুমি শোভনকে অন্য শাস্তি দাও। মুমুর আত্মাঃ ঠিক আছে,আমি ওই পিশাচটাকে মারবো না,তবে ওকে এমন শাস্তি দেবো যে ও না পারবে মরতে,না পারবে বেঁচে থাকতে। মুমুর আত্মা আবারো হেসে উঠলো।শোভন তুমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও,আর তুমি স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ ভোগ করতে পারবে না। শোভনঃ কি শাস্তি দেবে তুমি?
মুমুর আত্মাঃ তুমি আমাকে পাগল বানিয়েছিলে সবার সামনে তাই না? এবার সবাই তোমাকে পাগল বলবে,তুমি তোমার সব হারাবে। আমি অর্পার শরীর ছেড়ে তোমার শরীরে প্রবেশ করবো,তুমি কিছু সময়ের জন্য তুমি থাকবে আর অন্য সবসময় তুমি আমি(মুমু) হয়ে থাকবে।আমি তোমার মধ্যে বেঁচে থাকব। তুমি আমাকে মারতেও পারবে না,আমি তো মরেই গেছি।আমাকে তোমার শরীর থেকে বের করতে হলে আগে তোমার নিজেকে মারতে হবে,মানে আত্মহত্যা করতে হবে,তাই তুমি না পারবে আমাকে বের করতে আর না পারবে নিজে মরতে,এক অসহ্য যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তোমাকে, এভাবেই কষ্ট পেয়ে পেয়ে তিলে তিলে মরবে তুমি। এই কথা গুলো শেষ করার পরেই অর্পার শরীর কেঁপে উঠলো। অর্পার শরীর থেকে মুমুর আত্মা বের হয়ে শোভনের শরীরে ঢুকলো। অর্পা অজ্ঞান হয়ে গেলো।
ও নিচে পড়ে যাওয়ার আগেই রাহাত ওকে ধরে ফেললো। শোভনের শরীরে মুমুর আত্মা প্রবেশ করে ওর আত্মা শোভনের শরীর থেকে বলতে থাকলো- রাহাত তোমরা আমার অনেক বড় উপকার করেছো, আমার আত্মাকে শান্তি দিয়েছো,তোমাদের দুজনের মাধ্যমেই আমি শোভনে শাস্তি দিতে পারলাম। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাদের জীবনে ফিরে আসবো না। বিদায়। এই কথা গুলো বলে শোভনের শরীরে ভর করা মুমুর আত্মা ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। পরিশিষ্টঃ অর্পার জ্ঞান ফেরার পরে সব ঘটনা রাহাত মুমুকে জানায়। মুমুর আত্মা কথা দিয়েছিল আর ফিরে আসবে না ওদের জীবনে,কিন্তু ওরা দুজন মিলে ঠিক করলো ওরা এই অভিশপ্ত ড্রেসিং টেবিল আর ওদের ঘরে রাখবে না। ওরা সেইদিনই কাচ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলে সেই ড্রেসিং টেবিল। আর সাথেসাথে সমাপ্তি বিলীন হয়ে যায় সেই রহস্যঘন দর্পণ। এরপর থেকে অর্পা আর আয়নায় মুখ দেখে না। তবে ওরা অনেক সুখেই আছে, এই ঘটনার পরে অনেক বছর পার হয়ে গেছে,তবুও অর্পার প্রতি রাহাতের ভালোবাসা একটুও কমেনি, বরং বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। “পাপী তার পাপের শাস্তি পাবেই।”
………………………………………………………………….সমাপ্ত…………………………………………………….