প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে তৌফিক। এমন ভয় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হাত-পা ঠাণ্ডা, অসার। শীতল একটা স্রোত মাথার পিছন থেকে শুরু হয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে নিচে নামছে। হরমোনের কার্যকারিতায় সড়সড় করে খাড়া হয়ে গেছে ঘাড়ের চুলগুলো। হৃৎপিণ্ড যেন পাগলা ঘোড়া, লাগামহীন ছুটে চলেছে। খুলে গেছে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। আর সেগুলো দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে অবিরাম। ইতোমধ্যে ভিজিয়ে দিয়েছে শরীরের কাপড়-চোপড়, এমনকি তার পিঠের নিচের বিছানার চাদরও। অথচ ও ভয় পেয়েছে বেশিক্ষণ হয় নি।
ঘুমিয়ে ছিলো ও। ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাৎ করেই। ভাঙ্গার কারণটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না মোটেই। ওর ঘরটা থিকথিকে কুয়াশায় ভরা। ঘন ধোয়ার মত সেই কুয়াশা পাক খাচ্ছে, কুণ্ডলিত হতে হতে আবার তা ভেঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হিম ঠাণ্ডায় শরীরের রক্ত পর্যন্ত জমে যাবার জোগাড়। অথচ এখন এরকম হবার কথা নয়। একে তো এখন গ্রীষ্মকাল, তার উপর ঘরের ভিতর কুয়াশার এমন নৃত্যের কথা কে কবে শুনেছে!
তৌফিক যখন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে তখন কিছু একটা হঠাতই স্থির হয়ে গেল। ঘন কুয়াশার ভিতর লাল লাল আকৃতি ফুটতে শুরু করেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলো চারিদিকে। বিদ্যুৎ চমকের মত আকৃতির রেখাগুলো পরস্পরকে জড়িয়ে সংখ্যায় বাড়ছে। তৌফিকের মনে হল ওগুলোর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে। কিছু একটা করার চেষ্টা করছে ওগুলো। কিছু কিছু রেখা আকারে মোটা হচ্ছে ,আর বেশির ভাগই সূক্ষ্ম থেকে আরো সূক্ষ্মতর রেখায় বিভক্ত হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন-সংখ্যা যদি ভয় নির্ণায়ক হত তবে ও এখন তার চরম সীমায় অবস্থান করছে। চিৎকার করার চেষ্টা করে বিফল হল ও। হাত-পা কেউ যেন আঠা দিয়ে বিছানার সাথে সেটে রেখেছে।
আবার সামনে তাকালো ও। অজস্র রেখার জটিল বিন্যাস এবার কিছুটা বোধগম্য হলো ওর। মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরা, ধমনীর সাথে বড় বেশি মিল ওগুলোর। আর চতুর্দিকে অবস্থান করা কুয়াশা যেন ত্বকের কাজ করছে। এখন ওর সামনে একটা অস্পষ্ট মনুষ্যাবয়ব।
হঠাৎ তৌফিক তার রুম এর লাগোয়া বাথরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শুনতে পেল। শব্দ শুনেই বুঝতে পারল বেসিন সহ বাথরুমের সমস্ত ট্যাপ হতে অঝোরে পানি পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে, সারা দিন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না তাই ট্যাংকে পানি নেই একটুও। তাহলে এত পানি আসছে কোত্থেকে!
ইতোমধ্যেই পানি বাথরুম ছাপিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে পড়েছে। দ্রুত বাড়ছে পানির উচ্চতা। এমন তো হবার কথা নয়। ভয়ে আধমরা হয়ে তৌফিক দেখল হাঁটু পানি হয়ে গেছে রুমের ভিতর। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে শুরু করল সে। দ্রুতই পানি যখন বিছানা স্পর্শ করল, তখনই তৌফিক বুঝতে পারল তার সময় সমাগত। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?
আব্বু-আম্মু, ছোট বোনটার কথা মনে পড়ল। পাশের রুমেই নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে তারা। ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না তৌফিক নিজের রুমের ভিতরই মরতে বসেছে। শেষ চেষ্টা করল সে পানি তার শরীর স্পর্শ করতে। কিন্তু একচুলও নড়তে না পেরে হতাশায় কেঁদে ফেলল।
এতক্ষণে আবার কুয়াশা মোড়া মনুষ্য-মূর্তির দিকে চোখ ফেরালো তৌফিক। তীব্র আতংকে ওটার কথা মনেই ছিল না। দেখল আগের জায়গাতেই চুপচাপ ভেসে আছে সেটা। যেন ধৈর্য ধরে উপভোগ করছে তার আতংক। তৌফিকের মনে হল এসব কিছুর পিছনে একটা কারণ অবশ্যই আছে। কিন্তু হাজার চেষ্টায়ও মনে করতে পারল না। ঠিক তখনই মূর্তিটার মুখমণ্ডল পরিষ্কার হতে শুরু করল, যেন ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই।
সহসাই সে বুঝে ফেলল এসবের পিছনে কি কারণ রয়েছে। কিন্তু আর কিছুই করার নেই নিয়তিকে বরন করে নেয়া ছাড়া। পানি নাক ছুঁয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। মাথা জ্বালা করছে। পানিতে সম্পূর্ণ ডুবে যাবার আগে লক্ষ্য করল ছায়ামূর্তিটা আর নেই, তার জায়গায় পরিচিত এক রক্ত-মাংসের এক মানবশরীর। কিন্তু মুখটা কি বীভৎস! গাড় অন্ধকার গিলে ফেলবার আগে তৌফিক খ্যানখ্যানে একটা হাসির আওয়াজ পেল। বড়ই পৈশাচিক সে আওয়াজ।
এক.
সময়টা বিকেল। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের এক কোনে বসে আছে কয়েকজন ছেলে। প্রত্যেকের মুখ থমথমে, তাতে শোকের চিহ্ন।
“কিভাবে কি হল কিছু খবর পেয়েছিস?” জিজ্ঞেস করল খালেদ রশিদকে।
“তেমন কিছু না,” বলল রশীদ। “নিজের বেডরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ওকে। শরীরে কোন আঘাত নেই।তবে চোখ দুটো নাকি খোলা ছিলো। ডাক্তার বলেছে তীব্র আতংকে হার্ট এটাক হয়েছে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওর ফুসফুসে পানি পাওয়া গেছে।’’
“কি বলছিস?’’ অবাক হয়ে বলল শুভ। “লাশ পাওয়া গেল বিছানায়, ফুসফুসে পানি আসবে কোত্থেকে?’’
“সেটাই তো রহস্য। ডাক্তার-পুলিশ কেউ বের করতে পারছেনা। কি জানি কি।’’
“খুব ভাল ছেলে ছিলো তৌফিক,’’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল রবি। “চাচা-চাচি ছেলে হারানোর শোক সইবেন কিভাবে কে জানে।’’
আরো কিছু সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলল তারা। তারপর সন্ধ্যা হতে উঠে পড়ল সেখান হতে। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করল না পাশের ঝাঁকড়া গাছটার ডালে বসে একটা কুচকুচে কালো রঙয়ের দাঁড়কাক ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওটা কোন সাধারণ কাক নয়। ওটার গভীর কালো চোখে কিসের যেন আভাস। অশুভ কিছু। নিচের ওরা যদি তা টের পেত তাহলে মৃত বন্ধুর জন্য শোক করা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবত।
এ ঘটনার তিনদিন পরে টিউশনি করে রাতে হলে ফিরছিল রশীদ। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। দুপুর থেকেই কেমন কেমন যেন লাগছে। মাঝে মাঝেই শরীরটা এমনিতেই শিরশির করে উঠছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। আশেপাশে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও তার মনে হচ্ছে সে একা। আর মনে হচ্ছে কেউ আড়ালে আবডালে তার উপর চোখ রাখছে। পরে বিক্ষিপ্ত মনের চিন্তা বলে উড়িয়ে দিয়েছে ভাবনাটা। ঘড়িতে সময় দেখল সে। সাড়ে বারটা বাজে। ফিরতে আজকে দেরী হয়ে গেছে অনেক, ভাবল সে। আগেই আসতে পারত কিন্তু আসার পথে পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হওয়াতে গল্প করতে করতে দেরী হয়ে গেলো।
জোর পা চালাল রশীদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে হলের দিকে চলল। নির্জন রাস্তা অন্ধকার হয়ে আছে। আকাশ মেঘে ঢাকা তাই চাঁদও আলো দিতে পারছেনা। আবারও সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা ফিরে এলো রশীদের মনে। শরীরটা অজানা কোন কারণে শিরশির করে উঠলো। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেলো গলা শুকিয়ে মরুভূমি। ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকাল কেউ আছে কিনা দেখতে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। একদম শুনশান। মাঝে মাঝে রাস্তায় গার্ড মামারা থাকে, রশীদ আশা করছিল তাদের একজনকে দেখতে পাবে। কিন্তু টের পেলো আজ সে একা। হলের আলো চোখে পড়ল তার। ভাবল আর কিছুদূর গেলেই স্বস্তি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যত কারণই থাকুক না কেন এত রাত করে হলে ফিরবে না।
হলের পুকুর ঘাট পর্যন্ত যখন পৌঁছল রশীদ তখন হঠাতই তার ঘাড়ের সমস্ত চুল সড়সড় করে দাড়িয়ে গেল। কিছু একটা শুনতে পেয়েছে সে। আস্তে আস্তে পিছন ফিরল। ঝেড়ে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ফিরে দেখল কেউ নেই। ফেলে আসা রাস্তাটা একাকী অন্ধকারে শুয়ে আছে। আবার যখন সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই চোখে পড়ল তার। কেউ একজন হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে পুকুরপাড়ের নারকেল গাছটার গোঁড়ায় তার দিকে পিছন ফিরে। এক্সপ্রেস ট্রেনের মত ছুটতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা ঠাণ্ডা করে সেদিকে এগোল রশীদ। চাপা কান্নার এই আওয়াজটাই পেয়েছিল একটু আগে।
কাছে গিয়ে দেখল ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে একটা ক্ষীণকায় ছেলে বসে আছে মাটিতে। মৃদু দুলছে সামনে পিছে আর কাঁদছে। কান্নার শব্দটা মনে কাঁপন ধরালেও সাহস নিয়ে রশীদ বলল, “কি হয়েছে তোমার? এত রাতে এখানে বসে কাঁদছ কেন?’’
কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না। সুর করে কেঁদেই চলল একটানা। রশীদের মনে দরদ জেগে উঠল। ভাবল, কোন সিনিয়র বোধহয় রাগ করেছে তাই কাঁদছে ছেলেটা। দেখলেই বোঝা যায় জুনিয়র ব্যাচের ছাত্র। এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রশীদ এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখল। “কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?’’ আবার প্রশ্ন করল সে।
এবার কান্না থামাল ছেলেটা। আস্তে আস্তে ঘুরে রশীদের দিকে ফিরল। সেই মুহূর্তে চাঁদকে আড়াল করে থাকা মেঘটা সরে গেল। আলো পড়ল ছেলেটার মুখে। সাথে-সাথে রশীদের মনে হল হৃৎপিণ্ডটা কেউ চেপে ধরেছে তার। একটা পৈশাচিক বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
কুচকুচে কালো কোঁচকান চামড়া মুখটার, জায়গায় জায়গায় ফেটে লাল মাংস বের হয়ে আছে। ঠেলে বের হওয়া কপালের নিচে লাল রঙয়ের চোখ দুটো ভাটার মত জ্বলছে। নাক নেই, তার জায়গায় বড় দুটো গর্ত। মোটা দুই ঠোটের কষ বেয়ে লালচে রঙয়ের আঠালো রস গড়িয়ে পড়ছে। মুখের ফাকে দেখা যাচ্ছে সূচাল দাঁতের সারি। তার ফাঁক দিয়ে কালো রঙয়ের চেরা একটা জিহ্বা বের হয়ে ঠোটের দুপাশ থেকে রস চেটে নিলো একবার।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না রশীদ। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় দিল। কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে তাল হারিয়ে গিয়ে পড়ল গভীর পুকুরে। ডুবে গিয়ে আবার ভাসল সে। দেখল পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান আতঙ্কটা। বীভৎস ঠোটের কোনায় হাসি লটকে আছে। হঠাৎ সেটা তাকে লক্ষ্য করে ঝাপ দিল পুকুরে। সরাসরি তার উপর এসে পড়ল। একটা বোটকা গন্ধ পেল রশীদ। তারপর ডুবে গেল পানিতে। বজ্র-বাধনে তাকে বেঁধে ফেলেছে পিশাচটা। সেটার জ্বলতে থাকা লাল চোখের দিকে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দল রশীদ।
দুই.
রশীদের মৃত্যু বন্ধু খালেদের মনে গভীর রেখাপাত করল। কেমন যেন হয়ে উঠল দিনগুলো। কিছুই ভালো লাগে না। সবসময় মনে হয় কিছু একটা ঘটবে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বন্ধুকে কবরে নামানোর সময় পাশে ও। হঠাৎ এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মনে হয় কবরের অন্ধকারটা অনেক বেশী গাড় হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আতংকে পিছিয়ে আসে সে ওখান থেকে। তারপর থেকে আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। গান সুনে, মুভি দেখে, কম্পিউটারে গেমস খেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা বিশেষ ফল দিচ্ছে না। ভাল গান গাইতো ও, গীটারটা এখন একাকী পড়ে থাকে। গাইতে ভাল লাগে না।
ইদানীং আরও একটা উপসর্গ যোগ হয়েছে। কুকুর দেখলে একদমই সহ্য হচ্ছে না তার। আগে থেকেই যে ওদের দেখতে পারত না তা নয়। কিন্তু এখন দেখলে মনে হয় ওরা তার শত্রু। কাউকে যে খুলে বলবে ব্যাপারটা সে সাহস হচ্ছে না, পাছে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে এই ভয়ে। এইতো সেদিন একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেল।
হলের পাশে একটা দোকানের সামনে বসে চিন্তিত মনে জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করল তিনটা কুকুর তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে যে আশেপাশে কুকুর থাকেনা তেমন নয় ব্যাপারটা। দোকানের সামনে অনেক কুকুর বসে থাকে, ঘোরাঘুরি করে। কেউ কিছু খেলে সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নারে, খেতে চায়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা কেমন যেন ভিন্ন। কুকুরগুলোর কোন চাহিদা নেই যেন। একচুল নড়ছে না। শুধু তাকে দেখছে চুপচাপ। ওদের কালো চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য তার মনে হল রশীদের কবরে দেখা অন্ধকারের সাথে ওগুলোর অনেক মিল।
হঠাৎ তীব্র আতংক পেয়ে বসল তাকে। তাড়াহুড়োয় চেয়ার ছাড়তে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ল পিছন দিকে। গিয়ে পড়ল এক আমড়া বিক্রেতার উপর। তারপর দুজন মিলে পড়ে গেল মাটিতে। আমড়াগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। দোকানদার মামাসহ আশেপাশের সকলে হেসে অস্থির। তারপর অবশ্য সবাই মিলে সাহায্য করল ওদের। কিন্তু কেউ টের না পেলেও ও ঠিকই টের পেল নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে। কেউই খেয়াল করেনি আমড়া-বিক্রেতার হাতের ধারাল ছুরিটা কখন শূন্যে ছিটকে উঠে ওর গলার কেবলই পাশে মাটিতে গেঁথে গেছে। ও ছুরিটাকে ঠিকই উপর থেকে নিচে নামতে দেখছিল। একদম গলা বরাবর নামতে নামতে শেষে এসে যেন দিক পরিবর্তন করেছে সেটা। মাটি থেকে উঠে গা ঝাড়তে ঝাড়তে দেখল কুকুর তিনটা চলে যাচ্ছে একসাথে। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করেই ওগুলো তাকে ফেলে দিয়েছিল।
খালেদ টের পেল দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। সারাদিনই প্রায় রুমে শুয়ে থাকে। ক্লাসও ঠিকমত করে না। শুভাকাঙ্খীরা পরামর্শ দিল বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। তাদের কথা মেনে দুইদিন হল বাড়ি ফিরেছে সে। পরিবারের লোকদের মাঝে থেকে ভালোও লাগতে শুরু করেছে।
এক সপ্তাহ পার হবার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসল সে। বিকেলে গ্রাম্য বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেয় মাঠে। বই নিয়ে এসেছিল ভার্সিটি থেকে, তাই পড়ে। এরকমই একদিন মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। দেখল পাশের বাড়ির সম্পর্কে চাচা কিন্তু সমবয়সী ছেলে সুজন তাড়াহুড়ো করে তাদের দিকে আসছে।
“ভাতিজা, একটু শুইনা যাও,’’ ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল সে।
খালেদ উঠে তার দিকে এগোল। কাছে গিয়ে দেখল তার চোখ দুটো চকচক করছে। কি যেন একটা চেপে রেখেছে সে।
“কি হইছে?’’ প্রশ্ন করল খালেদ।
পকেট থেকে কি যেন বের করল সুজন। মুঠো খুলতে খালেদ দেখল কাগজে প্যাঁচানো কতগুলো ছোট ছোট প্যাকেট দেখা যাচ্ছে। নিমেষে বুঝে ফেলল ওতে কি আছে।
“চলব নাকি?’’ ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল সুজন।
আশেপাশে একটু তাকিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, “কোথায়?’’
“ক্যান, আমাগো সেই পুরাইন্যা জায়গায়!’’ যেন ওর প্রশ্নে একটু অবাক সে।
“রাইতের বেলা। সজাগ থাইকো। আমি ডাইকা নিবানি,’’ বলে আর দাঁড়ালো না সুজন।
সন্ধ্যা হতেই খালেদের উত্তেজনা বাড়তে লাগলো। কয়েকদিন আগের কথা চিন্তা করে কিছুটা ভয় লাগলেও গাঁজার কথা মনে পড়তে ভয়টা উবে গেল। সুজন আর ও আগে প্রায় প্রায়ই গাঁজা খেত। সুজনই তাকে শিখিয়েছিল। ওদের গ্রামে পুরানো এক জমিদারবাড়ি আছে। লোকজন বিশেষ একটা যায় না ওদিকে। ঝোপ-জংগলে ঘেরা ভাঙ্গা জমিদারবাড়ি বসে দুজনে মনের সুখে গাঁজা টানত আর চোখের সামনে রঙ্গিন দুনিয়া দেখত। ভার্সিটিতে ওঠার পর আর তেমন খাওয়া হয় না। আজ অনেক দিন পর আবার খেতে পারবে মনে করে খুশির একটা আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে মনে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই খুশিই তাকে চরম সর্বনাশের পথে নিয়ে যেতে চলেছে।
রাত গভীর হতে জানালায় কাক্সিক্ষত টোকাটা শুনতে পেল। সুজন ডাকছে। নিঃশব্দে রুমের একটা দরজা খুলল খালেদ। এটা দিয়েই বাইরে বের হওয়া যায়। বেরিয়ে দেখল সুজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
“চল,’’ বলেই ঘুরে হাঁটা ধরল সুজন।
খালেদও তার সাথে চলল। কোন কথা না বলে হাঁটছে দুজন। দ্রুতই জমিদারবাড়িটা চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ আগে থেকেই একটা বোটকা বোটকা গন্ধ পাচ্ছিল খালেদ। সুজনের কাছ থেকেই আসছে মনে হচ্ছে।
“এই শালা, কয়দিন গোসল করিস না,’’ অস্বস্তিকর নিরবতা ভাঙ্গার জন্য বলল খালেদ।
কিন্তু সুজন কোন কথা না বলে হাটতে লাগল। খালেদ ভাবল আজ কেমন যেন রহস্যময় আচরণ করছে সুজন। পরে ভাবনাটা উড়িয়ে দিল সে। জমিদারবাড়ির সীমানায় এসে হঠাতই ভয় করতে লাগল খালেদের। কেন যেন মনে হল আঁধারটা কেমন যেন গাড়, ভীতিকর। প্রকৃতিও থম মেরে গেছে। এমন সময় ওর ভয়টা বাড়িয়ে দিতেই যেন দূর থেকে ভেসে এলো কুকুরের প্রলম্বিত চিৎকার। আঁধারে দাঁড়িয়ে ডাকটা খুব অপার্থিব শোনাল তার কাছে।
“কি হইল, খাঁড়ায় রইলা যে?,’’ সুজন খালেদকে বলল। সে একটু এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে।
সুজনের কণ্ঠস্বরে কি যেন একটা ছিল। তা শুনে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠল তার। তাও সামনে বাড়ল সে। জমিদারবাড়ির মধ্যে পুরানো একটা কুয়া আছে। তলা একদম খটখটে শুকনো। ওটার পাশ দিয়ে এগিয়ে দুজনে তাদের পরিচিত জায়গাটায় বসল। জমিদারবাড়ির ভাঙ্গা কাছারির মধ্যে। সুজন গায়ে জড়ানো চাদরের নিচ থেকে গাঁজা-ভরা সিগারেট বের করল। বাড়ি থেকেই বানিয়ে নিয়ে আসে সে।
হাতে নিয়েই খালেদ টের পেল জিনিসটা কেমন ভেজা ভেজা। “আজ কি হল তোর?’’ প্রশ্ন করল সে। “ভিজায় ফেলছিস মালটা।’’
সুজন শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিছু না বলে আগুন ধরিয়ে দিল। টানতে লাগল খালেদ। গাঁজার গন্ধটাও তেমন সুবিধার না। বাজে মাল ধরিয়ে দিয়েছে বোধহয়। তবে গন্ধটা ভাল না লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। নেশা হতে শুরু করেছে। এরপর কতক্ষণ কাটল খেয়াল নেই খালেদের। দুইটা শেষ করেছে ইতোমধ্যে। নেশায় পুরো বুঁদ। ওই অবস্থায় দেখল সুজন উঠে দাঁড়াচ্ছে।
“বইস ভাতিজা। ত্যাল ফ্যালাইয়া আসি।’’
হাসল খালেদ। শালা, এখন প্রস্রাব করতে যাচ্ছে। সুজন ওর কাছ থেকে চলে যেতেই পুরানো ভয়টা ছেঁকে ধরল ওকে। মনকে বুঝ দিল এখনই ফিরে আসবে সে। ভয় কাটাতে আরেকটা কেবল ধরাতে যাবে, এমন সময় কুকুর ডেকে উঠল। এবার আর দূরে নয়। কাছাকাছি কোথাও থেকে ডাকটা ভেসে এলো। তারপর অন্যদিক থেকে আরেকটা। তারপর আরেকটা। ওর মনে হল যেন একপাল কুকুর চলে এসেছে আশেপাশে। নেশা পুরো টুটে গেছে ওর। হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। উঠে দাঁড়ালো টলমল পায়ে। বেরিয়ে আসল বাইরে। প্রস্রাব করতে কতদূর গেল শালা।
“সুজন,’’ কেঁদে ফেলল খালেদ, চিৎকার করল, “সুজন। কোথায় গেলি?’’
ওকে ভেংচি কাটতেই যেন থম মেরে থাকল প্রকৃতি। কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই ওর। দেখল কুয়াটার কাছে চলে এসেছে। আরেকবার ডাকতে যাবে এমন সময় কুকুরটাকে চোখে পড়ল তার। আকারে বিশাল, কুচকুচে কালো রংয়ের কুকুর, একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা উপরে তুলে রক্ত হিম করা একটা চিৎকার ছাড়ল সেটা। ঘুরে দৌড় দিল খালেদ। ছুটে গিয়ে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেল। ভাল করে তাকাতে সুজনের চাদরটা দেখতে পেল। তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাবে তখনই ঘুরে মুখোমুখি হল সুজন। কিন্তু একি? সুজন কোথায়?? যেন একতাল পচা মাংসের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বোটকা গন্ধটা কিসের বুঝতে পারল এতক্ষণে। তবে কি এতক্ষণ…আর ভাবতে পারল না খালেদ।
বীভৎস মুখে হাসল সুজন-রূপী আতংকটা। “ডরাইছ ভাতিজা?’’ পরিচিত কিন্তু অন্য আরেকটা কণ্ঠস্বর। খুবই পরিচিত।
আবার দৌড়ালো খালেদ। কিন্তু নিয়তি যাকে নিয়ে খেলছে কোনদিকেই নিস্তার নেই তার। কুয়ার পাশে ফিরতে দেখল সাক্ষাৎ যমদূতের মত পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা ভয়াল-রূপী কুকুর। আগেরটার সাথে আরও দুইটা যোগ দিয়েছে। তিনদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলল কুকুরগুলো। আস্তে-আস্তে বৃত্ত ছোট করে আনছে। পায়ে পায়ে পিছাচ্ছে খালেদ, হঠাৎ পায়ে কি যেন বাঁধল। দেখল কুয়ার দেয়ালে পা ঠেকে গেছে। কি ঘটতে চলেছে বুঝতে পারল সে। পিশাচটার হাতের ইশারায় মাঝখানের কুকুরটা ঝাপ দিল সামনের দিকে। টলে উঠে কুয়ার ভিতর পড়তে শুরু করল খালেদ। হাত দুটো বৃথাই বাতাস খামচালো কয়েকবার। ভেবেছিল শুকনা মাটিতে আছড়ে পড়বে। তার বদলে কটু গন্ধযুক্ত তেল চিটচিটে পানিতে আছড়ে পড়ল খালেদ। প্রায় সাথে সাথেই সাক্ষাৎ পাথরের মত তার উপর পড়ল কুকুরটা। পড়েই দু’চোয়ালে তার টুটি চেপে ধরল। সেটার নিঃশ্বাসের বোটকা গন্ধ পেল সে। একটা অন্ধকার চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে তাকে। অন্ধকারটা অতি পরিচিত।
তিন.
স্বল্প-সময়ের ব্যবধানে তিন তিনজন সহপাঠীকে হারিয়ে ক্লাসে শোকের ছায়া নেমে এলো। তাও আবার তিনটা মৃত্যুই অস্বাভাবিক। স্যারেরাও ক্লাস নিতে এসে ঠিকমত পড়াতে পারছেন না। এরকমভাবে দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার পর ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা ট্যুরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। গন্তব্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এ ঘোষণায় সবাই যেন একটু স্বস্তি পেল।
কিন্তু রবির মন থেকে খচখচানিটা মোটেও যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে তিনটা মৃত্যুর মধ্যে অবশ্যই একটা যোগসাজশ আছে। মৃত্যু যেন বেছে বেছে তাদের সার্কেলটাতেই হানা দিচ্ছে বারবার। সে, শুভ, তৌফিক, খালেদ, রশীদ এই পাঁচজন সবসময় একসাথেই থাকত। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তাদের মধ্যে দোস্তি। ক্লাসের অন্যান্যরা তো আর সাধেই তাদের “পঞ্চপাণ্ডব’’ বলে ডাকত না। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে?
তৌফিক নিজের রুমের মধ্যে মারা গেল ব্যাখ্যাতীতভাবে, অনেক রহস্যের জন্ম দিয়ে। যে রশীদ সাঁতার জানত না ভালোমতো, সে অত রাতে পুকুরপাড়ে কি জন্য গিয়েছিল? আর খালেদটাই বা রাতে বাড়ি থেকে দূরে জমিদারের কুয়োর ভিতর মরতে গেল কোন দুঃখে? আর ওর গলার, মুখের রহস্যময় দাগগুলো কিসের?
এমন সব প্রশ্ন পাক খেতে লাগল রবির মাথায়। মনে মনে পিছনের দিনগুলো হাতড়াতে লাগল। মনে হল কি যেন একটা ধরেও ধরতে পারছে না। এ নিয়ে শুভর সাথেও আলোচনা করল। নিজের ভীতির কথা বলল। কিন্তু শুভ সেগুলো আমলেই নিলো না। বরং তাকে বলল, “তুই একটু বেশিই চিন্তা করছিস এই নিয়ে। মৃত্যু মানুষের যে কোন সময় হতে পারে। দুর্ঘটনাও যে কোন সময় ঘটতে পারে। চিন্তা বাদ দে। দেখবি ট্যুরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের এখন একটু খোলামেলা পরিবেশ দরকার।’’
ট্যুরের আয়োজন শেষ করতে করতে দু’সপ্তাহ সময় লেগে গেল। শেষে নির্ধারিত দিনে তিনটি বাসে করে ছাত্র-ছাত্রী আর স্যার-ম্যাডামেরা রওয়ানা দিল গন্তব্যের দিকে। সকলেই খুশি। ছাত্রদের বাসে তীব্র-স্বরে রক গান চলছে, হাসিঠাট্টা করছে সকলে, কেউ কেউ আবার মনের সুখে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। কিন্তু এসবের কিছুই রবিকে স্পর্শ করছে না। সে একটা জানালার পাশে বসে বিরস বদনে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
এত হাসি-আনন্দ-উত্তেজনার মাঝে কেউ খেয়াল করল না, একেবারে পিছনের সিটের নিচে একটা কালো রংয়ের বিড়াল চুপচাপ বসে আছে। এক দৃষ্টিতে সেটা নির্দিষ্ট একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষণিকের জন্যও পলক পড়ছে না অস্বাভাবিক লাল রংয়ের চোখদুটোতে।
গন্তব্যে পৌছাতে-পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ভাড়া করা হোটেলের সামনে বাস থেকে নেমে সবাই হইচই করতে করতে হোটেলে ঢুকতে লাগল। রবিও তার ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে নেমে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ কানে ঢুকল তার। যেন দ্রুত পায়ে কিছু একটা দৌড়ে যাচ্ছে। পিছন ফিরে তাকাতে চোখের কোনে ধরা পড়ল কালো মতো কি যেন একটা স্যাত করে একটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েকটা হার্ট-বিট মিস হল তার। তারপর হোটেলের ঝলমলে লবিতে ঢুকে পড়ল।
পরপর দুটো দিন যেন ঝড়ের বেগে কেটে গেল তাদের। সারাদিন সৈকতে ঘোরাঘুরি, ইচ্ছামত গোসল করা, ছবি তোলা, কেনাকাটা আরও কত কি! দ্বিতীয় দিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল রবির। ভাঙ্গার কারণটা অনুমান করতে কষ্ট হল না তার। প্রচণ্ড শীত করছে। ঘরে এসি চলছে। ডিজিটাল ইনডিকেটরে যে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে তাতে তো এত শীত লাগার কথা নয়। পাশে চেয়ে দেখল শুভ সহ আরও দুজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। একটা চাদর টেনে আবার ঘুমাতে যাবে এমন সময় আওয়াজটা কানে গেল তার। মনে হচ্ছে কেউ যেন টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শরীর কাটা দিয়ে উঠল। শব্দটা খুব কাছে কোথাও হচ্ছে বলে মনে হল। ভয়ে ভয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকাতে দেখতে পেল সেটাকে।
ওদের পায়ের কাছে বিছানার উপর সাত-আট বছরের একটা ছোট ছেলে হাতদুটো কোলের উপর নিয়ে বসে। সারা শরীর ফ্যাকাসে সাদা, রক্তহীন। চোখের সাদা অংশের কোন অস্তিত্বই নেই। মুখ হা করে আছে। আর শব্দটা ওই মুখ থেকেই বের হয়ে আসছে। বুক ফাটা চিৎকার করে উঠল রবি। চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল অন্য তিনজন। ফ্যাকাসে মূর্তিটা ততক্ষণে গায়েব।
“কী হইছে রবি?’’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করল শুভ।
“একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি,’’ ঘটনাটা চেপে গেল রবি।
পরদিন গাঁ কাঁপিয়ে জ্বর আসল রবির। রুমে থেকে গেল সে। আজই কক্সবাজারে তাদের শেষ দিন। তাই খুব মজা করল সকলে। রবির কথা মনে করে মন খারাপ লাগল শুভর। বেচারা আসতে পারল না। সন্ধ্যায় আর সবার সাথে হোটেলে ফিরছিল শুভ। হঠাৎ কি মনে করে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। সর্বনাশ! ডিজিটাল ক্যামেরাটা নেই। মনে পড়ল সর্বশেষ সৈকতে একটা ছাতার নিচে বীচ চেয়ারে বসেছিল। বোধহয় ওখানেই রয়ে গেছে। জায়গাটা বেশি দূরে নয়। জোর পায়ে গেলে সাত-আট মিনিট লাগবে। দৌড় লাগাল সে। কাউকে ডাকার প্রয়োজন মনে করল না।
অন্ধকারে ডুবে আছে সৈকতটা। সাগরের গর্জন কানে আসছে। আশেপাশে কোন লোক দেখল না। লোকজন কি আজ সব তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরেছে নাকি? জোর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল সে। আর অল্প একটু দুরেই তার গন্তব্য। মনে-মনে যখন ভাবছিল ক্যামেরাটা থাকলে হয়, তখন হঠাতই সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে কানে এলো নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ। আর প্রায় সাথে সাথেই ভেসে এলো গানের সুর- “এক পায়ে নূপুর আমার, অন্য পা খালি/এক পাশে সাগর, একপাশে বালি…’’
হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পেল শুভর। কোন মেয়ের কণ্ঠস্বর এত সুরেলা হতে পারে! সেই সাথে অবাক হয়ে ভাবল এত নির্জন সৈকতে একটা মেয়ে এখন কি করছে? আরেকটু এগোতেই আলোটা চোখে পড়ল তার, সেই সাথে মেয়েটাও। সে যে জায়গার উদ্দেশ্যে এসেছে সেটায়ই বসে আছে মেয়েটা। শুভ নিঃশব্দে গিয়ে পিছে দাঁড়াল, তারপর উঁকি দিল সামনে। একটা ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে আলোটা আসছে। শুভ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তারই ছবি দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। মেয়েটা এতক্ষণ বসে-বসে আমার ছবি দেখছিল!
এতক্ষণে মেয়েটার পোশাকের দিকে চোখ পড়ল। চিনল সে। এখানে আসার প্রথম দিন থেকেই দেখছে সে। বলতে গেলে ও যেখানেই গেছে মেয়েটাকে দেখেছে। কালো পোশাক পরে থাকে সবসময়। সবচেয়ে অদ্ভুত হল, মেয়েটা একটা কালো বিড়াল পোষে। সব সময় তার সাথেই ঘোরে সেটা। তবে কি আমাকে পছন্দ করে ফেলল নাকি?
“এক্সকিউজ মি,’’ বলে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শুভ।
ক্যামেরা স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকাতে শুভর বাকি কথাগুলো গলায়ই থেকে গেল। তার দিকে যেটা তাকিয়ে আছে তার চোখ বলতে কিছু নেই। কোটরের ভিতর শুধুই অন্ধকার। সুচালো দুপাটি দাঁতকে আবৃত করে রাখার চামড়াটাও উধাও। কালো রংয়ের মাড়ি দেখা যাচ্ছে। সারা মুখে দগদগে ক্ষতচিহ্ন।
শুভ জায়গায় জমে গেছে। ওই অবস্থায়ই দেখতে পেল উঠে দাঁড়াচ্ছে বিভীষিকাটা। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল শুভ। দৌড়াতে গিয়ে দেখল সাগরের পানি তার গোড়ালি পর্যন্ত উঠে এসেছে। দৌড়ে কিছুদূর যাবার পর থামতে হল ওকে। পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার সাথে দেখা কালো বিড়ালটা কিন্তু পার্থক্য হল এখন ওটা আকারে অনেক বড়। যেইনা মাত্র থামল অমনি পিছন থেকে ঘাড়ের উপর এসে পড়ল মেয়ে-রূপী আতংক। দুজন মিলে পানিতে পড়ল মুখ থুবড়ে। সুচালো দাঁতগুলো ঘাড়ে বসতে ব্যথায় চিৎকার করতে গেল শুভ কিন্তু মুখে পেল নোনা পানির স্বাদ।
রবির জ্বর কমে গেছে প্রায়। রুমে শুয়ে আছে ও। অনেক রাতেও যখন শুভ রুমে ফিরল না তখন সে স্যারদের ব্যাপারটা জানাল। তখন একজন জুনিয়র টিচারসহ একটা দল খুঁজতে বের হল। আগেই ফোন দিয়ে দেখা হয়েছে শুভকে, ঢুকছে না। হাঁটতে হাঁটতে দলটা চলে এলো সৈকতে। একটা ছেলে জানিয়েছে সন্ধ্যায় নাকি ওখানেই শেষ দেখা গাছে তাকে। ছেলেটার কথামত জায়গায় এসে শুভর নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে লাগল সবাই। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।
রবিরই প্রথম চোখে পড়ল জিনিসটা। তুলে নিলো চেয়ার থেকে। শুভর ক্যামেরাটা। স্যারকে দেখাতেই বললেন, “আশেপাশেই কোথাও আছে হয়ত।’’ মিনিট কয়েক পরে অর্ধেক পানিতে, অর্ধেক বালিতে এই অবস্থায় শুভর শরীর খুঁজে পাওয়া গেল। দূর থেকে শক্তিশালী টর্চের আলোতে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে শুভর লাশ দেখতে পেল সকলে। অবশ্য যেটুকু বাকি আছে শরীরের সেটুকু।
কঠিন আক্রোশে শুভর শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাংস খুবলে তুলে ফেলা হয়েছে। মুখ ধারালো কিছুর আঁচড়ে ফালা ফালা। চোখ দুটো কোটর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। হ্যাঁ করা মুখের ভিতর জিহ্বার কোন চিহ্নই নেই। শুধু কালচে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে ভিতরে। দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে একজন বমি করে ফেলল। সেই মুহূর্তে বিনা নোটিশে অন হয়ে গেল রবির হাতে থাকা ক্যামেরাটা। ওটার স্ক্রিনে তাকিয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল দুর্বল রবি।
চার.
বিকালবেলা মার্কেট থেকে টুকটাক কেনা-কাটা করে হলে ফিরছিল তানভীর। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেখল সাধারণ লোকজন, ছাত্ররা সব দৌড়ে যেন কোথাও যাচ্ছে।
“কি হয়েছে?’’ ছুটতে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করল সে।
“হলের পানির ট্যাংকে নাকি এক ছাত্রের লাশ পাওয়া গেছে’’ উত্তর দিল সে।
বুক ঢিপঢিপ করে উঠল তার অমঙ্গল আশংকায়। তড়িঘড়ি করে এগোল সেও। হলের সামনেই পেল ভিড়টাকে। বুঝল লাশটা এখানেই রাখা হয়েছে। কষ্টে সৃষ্টে ভিড় ঠেলে এগোল সে। লাশের মুখ দেখে বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল। সাদা কাপড়ে ঢাকা রবির লাশটা যেন তাকে বলছে, “বলেছিলাম তোকে আগেই।’’
আর দাঁড়াতে পারল না তানভীর। ভিড় থকে বেরিয়েই ছুটল নিজের রুম অভিমুখে। মনে পড়ছে সেদিনের কথা যেদিন রাতে রবি এসেছিল টার কাছে। চোখের নিচে কালি, চুল উস্ক-খুস্ক, চোয়ালের হাড় বেরিয়ে গেছে, এক কথায় ভয়াবহ অবস্থা ছিল রবির। ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের দুইজন তাই সচরাচর দেখা হত না। তাই তাকে এই অবস্থায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায় সে।
“একি দোস্ত,’’ অবাক হয়ে বলেছিল সে। “তোর এ অবস্থা কেন?’’
“সব জানবি,’’ উত্তরে বলেছিল রবি। “তবে আজ নয়। একটা রিকোয়েস্ট নিয়ে এসেছি। বল রাখবি।’’
“আচ্ছা রাখব। কি বল।’’
রবি পকেট থেকে ব্রাউন পেপারের একটা এনভেলপ বের করে দেয়। “এর ভিতর সব আছে। তোর প্রশ্নের উত্তর পাবি। রিকোয়েস্টটা হল, তোকে কথা দিতে হবে আমার কিছু না হবার আগ পর্যন্ত এটা খুলবি না আর আমাকে একটা প্রশ্নও করবি না। কথা দে।”
“আচ্ছা, দিলাম,” বলেছিল সে। আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় রবি। এনভেলপটা এখনও ওই অবস্থায়ই আছে। এক লাফে সিঁড়ির তিনটা ধাপ টপকে উপড়ে উঠছে তানভীর। রুমে ফিরে টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে খুলল। ভিতরে কিছুক্ষণ হাতড়ে পেল জিনিসটা। হাত কাঁপছে ওর। একটানে এনভেলপের মুখ ছিঁড়ে উপুড় করে ধরল সেটা। হাতে এসে পড়ল ভাগ করা একটা কাগজ। পড়তে শুরু করল সে:
পাপের স্বীকারোক্তি বলতে পারিস এটাকে। যে পাপ করেছি আমি, যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি এখন সেই পাপ। আমরা পাঁচ বন্ধু সবসময় একসাথে থাকতাম আমি, রশিদ,খালেদ, শুভ, আর তৌফিক। যেখানে যেতাম, যা কিছু করতাম পাঁচজন মিলে করতাম।
ঘটনাটা যখনকার তখন আমরা সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। জুনিয়র ব্যাচ এসেছে। আমরা সিনিয়র হয়েছি সবে তাই জুনিয়রদের র্যাগ দেওয়াটা খুব উপভোগ করতাম। দিনে-রাতে যেকোনো সময় ডেকে ওদের নানাভাবে হ্যারাস করতাম। অকারণে অপমান করা, শারীরিকভাবে শাস্তি দেয়া, গালাগালি করা এগুলো করতাম নির্দ্বিধায়। আসলে আমরা ও তো এর মুখোমুখি হয়েছিলাম আগেই, তাই এগুলো করতে বিবেকে খুব একটা বাঁধত না। তবে সবকিছুরই একটা লিমিট থাকা উচিত, যা অতিক্রম করলে খারাপ কিছু ঘটতে বাধ্য। আমরা একদিন লিমিটটা ক্রস করে ফেললাম। আমরা বলতে পাঁচ জন।
জুনিয়রদের মধ্যে রুদ্র নাম করে একটা ছেলে ছিল। নাম ওরকম হলে কি হবে, ছেলেটি ছিল ভদ্র আর খুব লাজুক। একারণে প্রায়শই র্যাগ দেবার সময় বলির পাঠা হতো ও। ওকে ঘাটাতে সবাই খুব মজা পেত। ওর মুখ দিয়ে খারাপ কথা বলিয়ে নেবার সময় যেভাবে ওর চোখ মুখ, কান, লাল হয়ে উঠত তা দেখে খুব আনন্দ পেতাম। অন্যান্য ছেলেরা মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করলেও রুদ্র কোনদিন প্রতিবাদ করেনি। তাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমরা যাই বলি না কেন ও সেটা করবে।
তারপর একদিন একটা ঘটনায় আমরা পাঁচজন ওর উপর খুব রেগে যাই। সিদ্ধান্ত নেই রাতে ওকে একা ডেকে মনের ঝাল মেটাবো। সেই মতো রাতে ওকে পুকুর ঘাটে ডাকি। তখন শীতকাল ছিল। শীতও পড়েছিল প্রচণ্ড সেবার। ও আসে ভারী জামাকাপড়ে শরীর ঢেকে। সাড়া শীতকালই ওকে এরকম কাপড়-চোপড়ে মোড়া অবস্থায় দেখতাম। কিন্তু কারণটা জিজ্ঞেস করা হয় নি। জিজ্ঞেস করলেই বোধহয় ভাল হত।
ও আসার পর যাচ্ছেতাই ভাষায় ওকে গালিগালাজ করি আমরা, অপমান করি। ও কাঁদতে শুরু করে দুঃখে, অপমানে। কিন্তু আমরা তখন বিবেক-বর্জিত নরপশু একেকজন। শুভ বলে, “আর একটা কাজ করবি তারপর তোর ছাড়া, যা হাঁটু পানিতে গিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাক।’’
“পারব না,’’ মুখ শক্ত করে বলে রুদ্র। এমন উত্তর শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। মাথায় রক্ত চড়ে যায় সবার। এত বড় স্পর্ধা রুদ্রর! মুখের উপর না বলল। শুভ উত্তেজিত হয়ে বলে, “পারবি না মানে?’’
“পারব না। সমস্যা আছে আমার,’’ আবারও বলে রুদ্র।
“সমস্যার গুল্লি মারি তোর। নাম শালা,’’ বলে তাকে মৃদু ধাক্কা দেয় শুভ। পুকুরের বাঁধানো ঘাটের ধাপে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল দুজনে। মাত্র দুই ধাপ নিচেই ঠাণ্ডা পানি। শুভর ধাক্কায় পিচ্ছিল ধাপ থেকে তাল হারিয়ে পানিতে পড়ে যায় রুদ্র।
ও পানিতে পড়ে যেতেই যেন সম্বিত ফেরে আমার। এ আমরা কি করছি? শেষে আমিই গিয়ে পানি থেকে তুলি ওকে। ওর মেসে নিয়ে যাই। পরদিন সকালেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে রুদ্র। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে বাড়ি থেকে ওর বাবা-মা চলে আসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়াতে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে থাকতে ওর এক আত্মীয়ের কাছে শুনি, ছোটবেলা থেকেই ওর নিউমোনিয়ার প্রকোপ ছিল। শীতকালকে ও খুব ভয় পেত, ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারত না বলে।
পরে বেশ কয়দিন নিয়মিত ফোনে খোঁজ নিতে থাকি আমি। খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওর কিছু হলে আমরা ফেঁসে যাব। তারপর মাস-দেড়েক পরে রুদ্রর বাবা এসে ওর ভর্তি বাতিল করে কাগজপত্র নিয়ে যায়। তারপর ওর আর কোন খবর পাইনি। ওই রাতে কি ঘটেছিল তা শুধু আমরা পাঁচজন আর রুদ্র জানত। ওর অসুস্থতাকে সবাই আকস্মিক বলে ধরে নিয়েছিল। তাই ও আর ফিরে না আসাতে আসল ঘটনাটা কেউ জানল না। আমরাও ওই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা মনে করে মনকে বুঝ দিলাম যে, এরকম তো অনেকেই করে।
কিন্তু সেই রুদ্র যে এভাবে ফিরে আসবে আমরা কি তা ভাবতে পেরেছিলাম? একে-একে যখন তৌফিক, রশীদ আর খালেদ মারা গেল তখন কেন যেন মনে হল ওদের কাতারে আমাকেও দাঁড়াতে হবে একদিন। কিন্তু কেন? শেষে শুভর বীভৎস মৃত্যুর দিন আমি কারণটা বুঝতে পারলাম। আমি ওকে দেখলাম! রুদ্রকে দেখলাম আমি! শুভর ক্যামেরা স্ক্রিনে দেখলাম রুদ্রর রুদ্র-মূর্তি। উহ! কি বীভৎস! কি ভয়াবহ!
অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ওদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে আমি যাই সেখানে। গিয়ে ওর সেই আত্মীয়ের কাছেই শুনি সব। রুদ্র সেই অসুস্থতা থেকে আর সেরে ওঠেনি। কয়েক মাস অসুস্থ থাকার পর কোমায় চলে যায় সে। তারপর প্রায় দুই বছর কোমায় থাকার পর মারা যায় ও। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে ওর বাবা পাগলপ্রায় হয়ে যায়। উনি নাকি শেষদিকে বলতেন, “আমার ছেলের এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের আমি ছাড়ব না।” সবাই এটাকে পুত্রশোকে কাতর পিতার প্রলাপ বলে ধরে নিয়েছিল। তারপর তিনি নাকি স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় চলে গেছেন কেউ জানেনা।
ওদের বাড়ি থেকে ফেরার পথেই প্রথমবার রুদ্রকে আমি সামনা-সামনি দেখি। শুধু আমিই দেখি ওকে, আর কেউ না। তারপর থেকে প্রত্যেকদিন আমি ওকে দেখছি। যেখানে যাই না কেন অনুভব করতে পারি ওর উপস্থিতি। রাতে আরও বেশি করে অনুভব করি। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে। আমি না পারি নড়াচড়া করতে, না পারি ওর ভয়াবহ দুই চোখ থেকে আমার চোখ সরাতে। যেন ওই দুই চোখ দিয়ে সে দিন দিন শুষে নিচ্ছে আমার প্রাণ। ও কি চাচ্ছে আমি জানিনা। কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আর পারছি না…
আর কিছু লেখা নেই কাগজে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তানভীর। র্যাগ নামক ঘৃণিত জিনিসটার উপর ঘৃণা আরও বাড়ল তার।
পরিশিষ্ট…
যোজন যোজন মাইল দূরে রহস্যময় ঘন কুয়াশায় ঢাকা গভীর, দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এক জীর্ণ কুটীরের জমাটবদ্ধ অন্ধকারের ভিতরে খুলে গেল এক জোড়া লাল শিরাযুক্ত চোখ। চোখ দুটোর মালিকের দৃষ্টিটা গিয়ে পড়ল সামনে বসা ভিনদেশী লোকটার দিকে। তার কালো ঠোটের কোনে ফুটে থাকা নিঃশব্দ হাসিই বলে দিচ্ছে, যে কাজ হাতে নিয়েছিল সে সফলভাবেই তার সমাপ্তি ঘটেছে।