গভীর রাত। মেঘলা আকাশের চোখে চোখ রেখে বয়ে চলেছে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। মিরাজ ব্যালকনিতে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে। একমনে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে সে। নির্জন রাতকে সঙ্গী করে এই গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার ভার বয়ে যাচ্ছে সে। আশেপাশে বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কাকতালীয় বলে
একটা ব্যপার সত্যিই আছে। তাই বলে ধামাচাপা দেয়া বাস্তব ঘটনার সাথে একটা উপন্যাসের প্রায় আশি থেকে নব্বই ভাগ কীভাবে মিলে যেতে পারে?
তার চোখের সামনে বার বার সেই খাতার লেখাগুলো ভেসে আসছে। উপন্যাসটা যে সে পড়ে ফেলেছে এটা জেরিন জানে না। প্রতিটা লেখাই সে মিরাজকে পড়তে দেয়। হয়তো এটাও দিতো। কিন্তু জেরিন কিছু বলার আগেই উপন্যাসটা তার চোখে পড়ে যায় এবং সে পড়ে ফেলে। আচ্ছা, জেরিন কীভাবে এই কাহিনী লিখলো?
সে তো কিছুই জানে না। জানার মত কোনো প্রকার উপায় অবশিষ্ট রাখেনি মিরাজ। শুধু মাত্র কল্পনা থেকেই কি কোনো কাহিনী বাস্তবতার সাথে প্রায় এতটা মিলে যেতে পারে? রাতে উপন্যাসটা পড়ার পর থেকেই মিরাজের মনটা ছটফট করছে। অনিশ্চিত ভয়ে
বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। জেরিনের কাছে এখনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে। সে জানে তার স্ত্রী ডা. জেরিন তার কাছে কখনো, কোনো দিন, কোনো কিছু লুকায় না।
সুতরাং, জেরিনকে জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই সত্যটা জানা যাবে। কিন্তু মিরাজের মনে ভয় কাজ করছে। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি মুখ ফসকে বেফাস কিছু একটা বেরিয়ে যায়?
মিরাজ চায় না তার কোনো বেফাস কথায় তাদের সম্পর্কে একটু হলেও অবিশ্বাসের কাদা লাগুক। কিন্তু জেরিনকে জিজ্ঞেস না করলে তো তার ভাবনার কোন্দলগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে মিরাজ। নাহ! এভাবে অস্থিরতার যাতাকলে পিষ্ট না হয়ে বিষয়টা খোলাসা হওয়াই ভাল। জানতে হবে এই উপন্যাসের প্লট সে কোথায় পেয়েছে? বেশী কথা বলা যাবে না। বলা তো যায় না, মুখ ফসকে এমন কিছু বলে ফেলতে পারে যেটা শুনে জেরিন তাকে সন্দেহ করবে।
প্রমাদ গুনলো মিরাজ। এখনই জেরিনের সাথে কথা বলবে সে। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। বেডরুমে পা রাখতেই দেখলো জেরিন ঘুমিয়ে গেছে। মিরাজ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ২:৩০ মিনিট। কীভাব যে রাত এতটা বুড়িয়ে গেছে তা বুঝতেই পারেনি সে। সে অপলক তাকিয়ে রইলো স্ত্রীর মুখের দিকে। জেরিনের মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটা সারাদিন ব্যস্ত থাকে।
ডাক্তার মানুষ, অবসরের সুযোগ কই?
সেই প্রেমের সম্পর্ক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো কিছুতে মিরাজকে কষ্ট দেয়নি সে। সেই জেরিন যদি এই লুকানো ঘটনাটা জেনে গিয়ে উপন্যাসটা লিখে থাকে, তাহলে কোনোদিন জেরিনের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না মিরাজ। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছে সে। সত্যিই তো সে অপরাধী!
পায়ের ভার বদল করলো সে। সারাদিন ব্যস্ততা শেষে ক্লান্তি মাখা চোখে যেহেতু মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, তাহলে ঘুমাক। এখন আর বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া এই মাঝ রাতে জেরিনের ঘুম ভাঙ্গিয়ে উপন্যাসের কথা জিজ্ঞেস করলে ব্যপারটা আরো সন্দেহজনক হবে। ধীরে
ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল মিরাজ। বিষয়টা নিয়ে কাল কথা বলতে হবে। সকালে নিজের অফিস আছে। তাই জোর করে হলেও ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। বিছানায় শুয়ে জেরিনের কপালে চুমু খেল সে। তারপর দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
আজ মঙ্গলবার। সপ্তাহের এই দিনটায় জেরিনের ছুটি থাকে। তাই সপ্তাহের বাকী দিনগুলোয় গাধীর খাটুনী খাটার পর এই দিনটায় রিল্যাক্স করে সে। অবশ্য এটাকে
রিল্যাক্স বলা যায় না। এই দিনটায় সংসারের সব কাজের প্রতি অধিক সময় দিতে চেষ্টা করে সে। মিরাজ যখন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে ডাইনীং টেবিলে এলো, জেরিন তখন ডাইনীঙে নাস্তা দিলো।
মিরাজ খেয়াল করলো, কলাপাতা রঙের শাড়িতে জেরিনকে অনেক সুন্দর লাগছে। তার মন বলে, সে যদি কবি হোমার হতো, তাহলে জেরিনকে নিয়ে একটা মহাকাব্য লিখতো। কিন্তু মিরাজ লেখালেখি পারে না। এই বিষয়ে জেরিনের দক্ষতা দারুণ! একত্রে এত গুন খুব কম মানুষের মাঝেই থাকে। একে তো জনপ্রিয় ডাক্তার, তার মধ্যে বর্তমান সময়ে প্রবল সম্ভাবনাময় এক তরুণী লেখিকা। উপরওয়ালা কী দেয়নি ওর মাঝে! টুকটাক কথাবার্তার ফাকে হঠাৎই মিরাজ বলে ওঠলো, ‘আচ্ছা এবারের বইমেলায় সার্জিল ভাইয়ের প্রকাশনী থেকে তোমার যে একক উপন্যাস বের হওয়ার কথা ছিল, সেটার কী হলো?’
জেরিন ব্রেডের পিস মুখ থেকে সরিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘ওটা বের হবে ইন শা আল্লাহ্! গতকাল বিকেলেই পান্ডুলিপির কাজ শেষ করেছি।’
‘বাহ! আমার বউটা শত ব্যস্ততার মাঝেও নির্দিষ্ট সময়ে পান্ডুলিপি তৈরী করে ফেলেছে দেখছি। তা ম্যাডামের পান্ডুলিপিটা পড়ার সৌভাগ্য কি আমার হবে?
নাকি বইমেলা থেকে বই কিনেই পড়তে হবে?’
‘কী যে বলো তুমি। তোমাকে পড়তে না দিয়ে কোনো গল্প কোথাও দিয়েছি বলো? আজ তুমি অফিস থেকে ফিরলেই ওটা পড়তে দেব। বরাবরের মতোই ভুলত্রুটি ধরে দিতে হবে কিন্তু!’
‘তোমার এই উপন্যাস পড়ে ভুলত্রুটি তো খুঁজেই পাইনি, আরো আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি!’ কথাটা বলতে গিয়েও ঠোঁটের দুয়ারে এসে আটকে গেল কথাটা। তারপর মুচকি হেসে চোখ টিপে বলল, ‘অবশ্যই ধরে দেব। তবে বিনিময়ে ঐ জিনিসটা আমাকে দিতে হবে!’
জেরিন লাজুক ভঙ্গিমায় বলল, ‘কোনো কিছুই দেয়া হবে না জনাব।’
কথাটা শেষ হতেই অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো মিরাজ। সে তার আবদার নিয়ে আর দ্বিরুক্তি করল না। সে জানে, জেরিন যতই অস্বীকার করুক, সেই প্রেম
চলাকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত সে মিরাজকে ঐ জিনিসটা দিতেই বেশী আনন্দবোধ করে।
আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জেরিন আধ শোয়া অবস্থায় খাটে হেলান দিয়ে বই পড়ছে। জানালা গলে আসা মৃদু ঠান্ডা বাতাস রুমে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এদিকে মিরাজ চেয়ারে বসে সেই উপন্যাসের পান্ডুলিপিটা পড়ছে। পড়ছে বললে ভুল হবে, সে পড়ার অভিনয় করছে। সব তো আগেই পড়েছে সে। এখন শুধু জেরিনকে দেখানোর জন্য গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার অভিনয় করছে। অভিনয়ের ফাকে ফাকে যখন কিছু লাইন তার চোখে পড়ছে, নিজের অজান্তেই তখন শরীরটা শিউরে ওঠছে! এ কী করে সম্ভব! ঘটনা তো প্রায় হুবহু মিলে যায়!
প্রায় আট মাস আগে তিন দিনের জন্য জেরিন তার বাবার বাড়ি গিয়েছিল। মিরাজ অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি বলে বাধ্য হয়েই বাসায় রয়ে
গিয়েছিল। মিরাজের নেশা করার অভ্যাস নেই। কিন্তু ঐদিন রাতে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে বেখেয়ালেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গিয়েছিল সে। সেই মাতাল অবস্থায় বাসায় ফিরে মানসিক অসুস্থতার
বশবর্তী হয়ে কিশোরী কাজের মেয়ে মিতুকে ধর্ষণ করেছিল সে। পরবর্তীতে মেয়েটা আশেপাশের মানুষদের ঘটনাটা জানানোর চেষ্টা করতে যাচ্ছিলো বলে স্রেফ একটা বুলেট খরচ করেছিল মেয়েটার পেছনে।
বুকের বাম পাশে হৃৎপিন্ড বরাবর বুলেট বিদ্ধ হয়। কিছুক্ষণ পর মিতুর লাশটা গাড়িতে তুলে বহু দূরের এক জলাশয়ে ফেলে আসে সে। মিতুর বাবা মা ছিল না। এক মহিলার মাধ্যমে সে মিরাজদের বাসায় কাজ করতে এসেছিল। ওর বাড়ি কোথায় সেটাও মিরাজ বা জেরিন কেউ জানে না। তাই জেরিন যখন তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসে, তখন মিরাজ তাকে বলেছিল, মিতুর এক পরিচিত আত্নীয় এসে তাকে নিয়ে গেছে। কিছু দিন
পর নাকি আবার চলে আসবে। বেস! জেরিনও তার কথা বিশ্বাস করল। গত আট মাসেও যখন মিতু আর ফিরে আসেনি, তখন জেরিন এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে নিয়েছে। কত কাজের মেয়ে থাকে এমন, একবার বাড়ি চলে গেলে আর ফিরে আসে না!
জেরিনের লেখা উপন্যাসের কাহিনীও প্রায় হুবহু এক! শুধু একটু আধটু অমিল রয়েছে। শেষের দিকে এসব পুরুষদের
জন্ম নিয়ে কথা তুলে উপন্যাসের ইতি টানা হয়েছে। কিছু কিছু লাইন আবার চোখে পড়তেই মিরাজের কপালটা ঘেমে গেল। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ
অনুভব করল। যেমনই হোক, মিরাজকে তো এই কাহিনী জানতেই হবে। তাই কালবিলম্ব না করে, যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবে জেরিনকে বলল, ‘লাজবাব! এমন
দুর্দান্ত কাহিনী আমার জীবনে খুব কম পড়েছি। আমার বউটা সত্যিই ট্যালেন্টেড!’
‘আমিতো সবসময়ই তোমার কাছে ট্যালেন্টেড!’ হো হো করে হেসে ওঠলো জেরিন।
‘তুমিতো ট্যালেন্টেডই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, এমন দুর্দান্ত উপন্যাসটা লেখার আইডিয়া কীভাবে তোমার মাথায় এলো?’
‘সত্যি কথাটা বলি।’ নড়চড়ে বসলো জেরিন, ‘সার্জিল ভাইয়ের প্রকাশনী থেকে বই বের করার ইচ্ছাটা অনেক আগে থেকেই ছিল। সার্জিল ভাই আমাকে সেই
সুযোগটাও দিয়েছেন। কিন্তু সময় যতই যাচ্ছিলো, আমার অস্থিরতা ততোই বাড়ছিল। কারণ মনমতো প্লট গোছাতে
পারছিলাম না। হঠাৎ একসময় মনে হলো, মিতুকে নিয়েই কাহিনীটা বানিয়ে ফেললে কেমন হয়! কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করা এবং তাদের অত্যাচার করার মতো
কাজ আমাদের সমাজে কিছু কুরুচির ক্ষমতাবান লোকেরা নির্দ্বিধায় করে থাকে। পরবর্তীতে টাকা দিয়ে এসব ঝামেলা মিট করে ফেলে। মিতু তো আর ফিরে এলো না। তাই আমিও সেই মনে হওয়া থেকেই
এভাবে লিখে ফেলেছি।’
কথাটা শুনে মিরাজ স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, জেরিন তাহলে কিছু বুঝতে পারেনি। নিজের ভাবনা থেকেই এমন কাহিনী সাজিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু উপন্যাসে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করা এবং তার লাশ অনেক দূরে জলাশয়ে ফেলে আসাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। কী অদ্ভুত ব্যপার স্যপার! জেরিনের ডাকে মিরাজের ভাবনায় ছেদ পড়লো।
‘কী ভাবছো তুমি?’
‘না তেমন কিছু না। তোমার গুনের কথা চিন্তা করছি। আমার মত ভ্যাবলা ছেলেকে কী দেখে যে বিয়ে করেছিলে! সত্যিই, তুমি আমার থেকে অনেক ভাল ছেলে ডিজার্ভ করো জেরিন।’
‘আমি তোমার সাথেই সুখী আছি মিরাজ। সো ডোন্ট থিংক দ্যাট ইউ আর নট ইলিজেবল ফর মি হানি!’
মিরাজের চোখে মুখে হাসির ছাপ ফুটে ওঠলো। জেরিনের এই দিকটাই তার বেশী ভাল লাগে। এমন যোগ্যতাসম্পন্ন একজন মেয়ে হয়েও তার মাঝে কোনো অহংকার বোধ নেই। সবকিছু মাটিতে ফেলে সে কেবল মিরাজের ভাল লাগার মত করেই তাকে ভালবাসে।
‘থ্যাংক্স বেবি। চলো, আজ আমি তোমাকে চা করে খাওয়াবো।’
‘এটাতো সুখবর! কত দিন তোমার হাতের চা খাই না।’ বলেই বেড ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালো জেরিন।
চা বানাতে গিয়ে স্বস্তি পেল না মিরাজ। উপন্যাসের কাহিনীটা তার মাথায় জেঁকে বসেছে। ওটা যারপরনাই অশান্তি তৈরী করছে তার ভেতরে। আচমকা মিরাজের মনে হলো, উপন্যাসের পান্ডুলিপিটা পুড়িয়ে ফেললে কেমন হয়? ‘কেমন হয়?’ এই কথাটা ভাবতে চাচ্ছে না সে। যে করেই হোক, পান্ডুলিপিটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নয়তো এই লেখাটাই তার মাথা নষ্ট করে ছাড়বে।
ভাবতে ভাবতেই সে পান্ডুলিপিটা কিচেনে নিয়ে এলো। জেরিন তখনও ডাইনিং রুমে। মিরাজ পান্ডুলিপির দিকে একবার চোখ বুলালো। তারপর গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটার একাংশ গ্যাসের চুলার আগুনের উপর ফেলে দিলো। কাগজগুলোতে আগুন
লেগে গেল! মিরাজের শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। কাগজগুলোর কিছু অংশ পোড়ার পর সে কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে জেরিনকে ডাকলো। অমঙ্গল আশঙ্কায় জেরিন দৌঁড়ে এলো কিচেনে। এসে যা দেখলো তাতে জেরিনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল!
পান্ডুলিপিটার ষাট ভাগ পুড়ে গেছে! মিরাজ দক্ষ অভিনেতার মত মন খারাপ করে, অস্থির ভঙ্গিমায় জানালো, সে উপন্যাসটা আবার পড়ার জন্য এখানে
নিয়ে এসেছিল। এরপর চুলার ঠিক উপরের তাকে সেটা রেখে চায়ের কাপ পরিষ্কার করছিলো সে। এর মধ্যেই
কাগজগুলো উপরের তাক থেকে সোজা চুলার আগুনের উপর পড়ে গিয়েছিল। মিরাজের অভিনয় দেখে তার সব কথা বিশ্বাস করলো জেরিন। জেরিন জানে, মিরাজ কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে তার খারাপ চাইবে না।
জেরিনের হাতে হাত রেখে বেশ কয়েকবার দুঃখ প্রকাশ করলো মিরাজ। সে নিজেকে অপরাধী বলে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মিরাজ সত্যিই কাঁদতেছিল। কিন্তু সেই কান্নাটা শুধু আজকের এই ঘটনার জন্য নয়, বরং জেরিনের অনুপস্থিতে নেশার ঘোরে, অসুস্থ মস্তিষ্কে লোকচক্ষুর আড়ালে যে পাপটা করেছে, সেটার জন্যেও।
মিরাজ জেরিনকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। সেদিন যে কীভাবে যে কী করে ফেলেছে সেটা সে ঠাহর করতে পারেনি। ঐ ঘটনার পর থেকে তার বার বার মনে হয়েছে, সে জেরিনের মত সরল মেয়েটার কাছে অপরাধী। সে যা করেছে সব অন্যায় করেছে। এসব ভেবে ভেবে গত আট মাস সে একবারের জন্যেও ফুরফুরে
মেজাজে জেরিনের সাথে মিশতে পারেনি।
আসলে নেশার ঘোরে অনেক বড় ঘটনাটা ঘটে গেছে তো, তাই সে মনে শান্তি পাচ্ছিলো না। কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে
সে জেরিনের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলো, ‘আমাকে মাফ করো জেরিন। আমি ইচ্ছা করে ঐ অন্যায়টা করিনি। আমি তোমাকে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবতেও পারি না। আমার মনের অশান্তি দূর করার জন্যেই আজ উপন্যাসটা পুড়িয়ে ফেলতে হলো। পুড়িয়ে ফেললেও আড়ালে তোমার সৃষ্টির প্রতি আমার অগাধ ভালবাসা আছে। আমি মন থেকে দোয়া করি তুমি একদিন অনেক বড় লেখিকা হবে। এ যাত্রায় আমাকে মাফ করে দিও বউ পাখিটা।’
দুই মাস পর বইমেলা শুরু হয়ে গেল। জেরিনের উপন্যাসটা আর বেরুলো না। নানা ব্যস্ততার মাঝে নতুন করে আর উপন্যাসটা লেখা হয়ে ওঠেনি। এদিকে জেরিন সন্তান সম্ভবা। উপন্যাস বের না হওয়াটাকে দূর্ভাগ্য মেনে নিয়ে মিরাজ ও জেরিন তাদের আগত অতিথি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মিরাজ জেরিনের যত্নের কোনো ত্রুটি করছে না। সবকিছুই এখন স্বাভাবিক চলছে। কিন্তু এতসব স্বাভাবিক কাজের মধ্যে আবার একটা অস্বাভাবিক কান্ড ঘটে গেল!
মিরাজ বইমেলায় গিয়ে কিছু বই কিনে নিয়ে এলো। প্রত্যেকটা বই পড়তে গিয়ে ‘সন্তান’ নামক বইটা পড়ে তার মাথা ঘুরে গেল! এটা কীভাবে সম্ভব? এতো দেখছি তার করা ধর্ষণ ও খুনের কাহিনীর উপর রচিত বই! মনে হলো তার মাথায় বোম ফাটলো! তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মুহুর্মুহু শ্বাস নিয়ে বইটার লেখকের নামটা দেখলো সে। ডা. রাইয়ান। লেখক পরিচিতিতে তার সম্পর্কে বিস্তারিত দেয়া আছে।
মিরাজ এক মুহূর্ত দেরী না করে ডা. রাইয়ানের সাথে দেখা করলো। সে ডা. রাইয়ানকে জানালো, এমন দুর্দান্ত উপন্যাস সে খুবই কম পড়েছে। লেখক এই উপন্যাসের প্লটটা কীভাবে তৈরী করেছে সেটা কৌশলে জানতে চাইলো সে। ডা. রাইয়ান একজন শিল্পপতীর কাছ থেকে এত প্রশংসা পেয়ে খুশীতে গদ গদ হয়ে গেল। তারপর সে তার উপন্যাসের প্লট পাওয়ার ঘটনাটা এভাবে বর্ণনা করলো-
‘আমি একদিন জরুরী কাজে আটকা পড়ে ডাক বাঙলোতে রাত কাটিয়েছিলাম। ভোর বেলা যখন গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে ফিরছিলাম, তখন রাস্তার ধারে জলাশয়ের পাড়ে একটা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখি। কাছে গিয়ে দেখি মেয়েটা জীর্ণ অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার বুকের বাম পাশটা গুলিবিদ্ধ ছিল। আমি তাকে গাড়িতে করে হসপিটালে নিয়ে আসি। আল্লাহর অশেষ রহমতে মেয়েটা বেঁচে যায়। যে তাকে গুলি করেছিল সে হয়তো ভেবেছিল হৃৎপিন্ড বরাবর গুলি করলে তার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মেয়েটা ছিল ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক। অর্থাৎ, তার হৃৎপিন্ড ছিল বুকের ডান পাশে। তাই তাকে বাঁচানো গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলাম মেয়েটার আপনজন কেউ নেই। তাই মেয়েটাকে আমার কাছেই রেখে দিলাম।
পরবর্তীতে মেয়েটার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলেও, অনেক চেষ্টা করেও সেই মানুষ রূপী পশুর পরিচয়টা জানতে পারিনি। মেয়েটা এ ব্যপারে আর কিছুই বলেনি। সবচেয়ে অবাক করা ব্যপার কী জানেন? মেয়েটা এখন সন্তান সম্ভবা। কোনোভাবেই সে তার সন্তান নষ্ট করতে রাজী হয়নি। আগামীকাল তার ডেলিভারী হবে।’
মিরাজ কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল! মনে হচ্ছে তার পৃথিবীটা দুলছে। মাই গুডনেস! মেয়েটা তাহলে মারা যায়নি! কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো মেয়েটা কেন পরিচয় প্রকাশ করেনি? চাইলেই তো মেয়েটা তার পরিচয় সবাইকে বলে দিয়ে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে পারতো। জেরিনের কাছে তার পাপের কথা বলে দিয়ে তাদের সুখী সংসারে বিষ ঢেলে দিতে পারতো। কিন্তু মেয়েটা তা করেনি। হয়তো তাদের সংসারের অনেক দিন কাজ করার কারণে সংসারে প্রতি ভালবাসা থেকেই মিতু কোনো কিছু প্রকাশ করেনি। আবার মেয়েটা তার সন্তান নষ্ট করেনি! কেন সে অন্যায়ের শিকারী হয়ে তার ফল পেটে ধারণ করে আছে? সব কিছুর আড়ালেই হয়তো ছিল ভালবাসা।
এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই তার। মেয়েরা অনেক আশা ও গভীর মায়ার প্রকাশ থেকেই পেটে সন্তান লালন করেন। কিশোরী মিতুও হয়তো এই অল্প বয়সেই সন্তানের প্রতি মায়ার আঁধার বুকে জমিয়ে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। উফ! আর ভাবতে পারছে না মিরাজ। তার মাথাটা চক্কর দিলো। মিতুর বেঁচে থাকার কথা শুনে তার মনে অপরাধবোধ তীব্রভাবে কাজ করেছে। এই প্রথমবারের মতো এই পাপের প্রায়শ্চিত করতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু কীভাবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে সেটা জানা নেই তার।
……………………………………………………….(সমাপ্ত)…………………………………………………