-স্যার দুইটা টেকা দিবেন?
খনখনে কন্ঠটা শুনে ঘাড় ঘোড়ালাম। জীর্ণ কাপড় পড়ে ততোধিক শীর্ণ এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধার গায়ে শতচ্ছিন্ন শাড়ি। তার ওপর একটা চেক কাটা কাঁথা। এই চরম শীতে যেখানে আমি গেঞ্জি, শার্ট, সোয়েটার তারওপরে একটা কোট পড়েও শীতে কাপছি সেখানে এই বৃদ্ধা ছেড়া একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে এই অজপাড়াগায়ের অজ রেলওয়ে স্টেশনে ভিক্ষে করছে। আমি পকেটে হাত দিলাম। বেশ কিছু টাকা আছে সাথে। পল্লী অঞ্চলের মেডিক্যাল অফিসার হয়ে আসা কতটা কষ্টকর এটা ভুক্তভোগীরাই জানে। পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম বৃদ্ধাকে, “খালা এই টাকাটা রাখেন। গরম কাপড় কিনে নিয়েন”।
বৃদ্ধা কাপা হাতে টাকাটা নিল, “আল্লাহ আপনের ভালা করব বাজান”।
“আপনের বাড়ি কই? ছেলেপুলে নাই?” প্রশ্ন করলাম আমি। বৃদ্ধা এবার মুখ উচু করে পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি চমকে উঠলাম। বৃদ্ধার চেহারাটা কুৎসিত। অসংখ্য বলিরেখায় ভরা। তারচেয়েও বড়
কথা একটা চোখ নেই।
বাম চোখটা।
নেই মানে একেবারেই নেই। শুন্য আধার কোটর কেবল চোখের জায়গায়।
আমি ঢোঁক গিললাম।
“না গো বাবা। ছেলে পুলে নাই। বাড়ি সুজনদীঘি”।
সুজন দীঘি? আমি চমকে উঠলাম। ওই গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতেই থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে আমার। আমি মহিলাকে বললাম, “গ্রামটা কেমন এমনিতে?”
-ভালা সবই ভালা।
-লোকজন?
-সবাই ভালা খালি একজন বাদে।
-কে?
-ডাইনী সখিনা।
-মানে?
-আপনেরা শহুইরা মানুষ বিশ্বাস করবেন না তা জানি। তয় অনেক কিছু আছে বাজান যেগুলা মানুষ বিশ্বাস না করলেও আছে।
-ডাইনী মানে……?? সে করে কি?
গল্পের আভাস পেয়ে নড়ে বসলাম। ট্রেন আসতে দেরী আছে। গল্পে গল্পে সময় পার হয়ে যাবে। বৃদ্ধা গল্প শুরু করলেন।
-সখিনা আগে ডাইনী ছিল না। একবার গ্রামে এক সাধু আইল। সে সখিনারে কইল যে তার মধ্যে নাকি কি এক ক্ষমতা আছে। সে কি তার লগে থাইকা মন্ত্র নিব নাকি? সখিনা রাজি হইয়া গেছিল সেই বুড়া সাধুর কথায়। তার লগে গ্রাম ছাড়লো অয়।
-তারপর?
-বিশ বছর পরে ফিরা আইল সখিনা। কেউ তারে ঠাই দিল না। কইল কলঙ্কিনী। ডাকিনী। রাইগা গিয়া সে গ্রামেরে অভিশাপ দিল। গেরামের যত বাচ্চা আছে সবগুলারে সে বলি দিব শয়তানের নামে। গ্রামের মাঝে একটা বিশাল বটগাছ আছে হেইডার নিচে খাড়াইয়া সে অভিশাপ দিল। গ্রামের লোকজন বাইরে আইসা সখিনারে মারলো। তারপর আধামরা কইরা শ্মশান ঘাটে নিয়া ফেইলা দিয়া আইলো। দুইদিন পর মারা গেল সখিনা। ডোমেরা মিলা ভয়ে ভয়ে সখিনার লাশ কব্বর দিল।
-ইন্টারেস্টিং। তারপর?
-গ্রামের কলিম মুন্সীর ঘরে তখন পোলা হইছে। কলিম মুন্সী রাইতে বউ আর পোলারে লইয়া এক খাটে ঘুমায়। এক রাত্রে পোলা খুব কানতেছিল। কলিমের বউ দুধ খাওয়ায়, পিঠ থাবায় পোলায় ঘুমায় না খালি কান্দে। তখন ধানের মরশুম। সারাদিন কাম কইরা কলিমের বউ চেগাইয়া গেছে। ঘুমাইতে বেশী দিরং হইল না। রাইতে হঠাত পোলা চুপ মাইরা গেল। আর কান্দে না। শ্যাষ রাইতের দিকে কলিমের বউ চেতন পাইছে। পোলা ঘুমে তহন। পোলার গায়ে হাত দিছে গতর ঠান্ডা। পোলারে ডাকে। পোলায় উঠে না। পোলার খ্যাতা সরাইয়া দেখে পোলার সারা শরীর খামচাইয়া খামচাইয়া মারছে। জাগায় জাগায় হড্ডি বাইর হইয়া গেছে। রক্তে বিছানা সয়লাব। কলিমের বউ আগে আন্ধারের মইধ্যে দেহে নাই।
-হুম। কি সর্বনাশ।
-হয়। এইডা লইয়া চিরকাচিরকি হইল বহু। পুলিশ আইল। পেপারেও ঊঠছিল। কলিমের বউ কসম খাইয়া কইল হ্যায় রাইত্র বেলা বুড়ি মাইনষের হাসনের আওয়াজ পাইছে সিথানের কাছে। গ্রামের মৌলানার থন ফতোয়া লইয়া সখিনার কব্বর খোড়া হইল।
-দেখা গেল লাশ পাওয়া যায়নি তাইনা?
-হ! আপনে কেমনে জানলেন?
-এসব গল্পে এমনটাই হয়।
-সখিনারে কিন্তু তারপরেও মানুষ দেখেছে। আয়নাল লস্কর সখিনারে দেখছিল জহির হাওলাদারের দুই পোলামাইয়ারে ধাক্কা দিয়া পুকুরে ফালায়া দিতে। পোলামাইয়া দুইটা বাঁচে নাই। সব বাইচ্চারে মারার কসম খাইছে সে কসস্ম পুরা না হইলে সেয় ফিরব না। আমি জানি আপনে আমার কতা বিশ্বাস জান নাই। গ্রামে যান গেলেই বুঝবেন।
-খালা আমি সত্যিই আপনার গল্প বিশ্বাস করি নাই। চালু ভুতের গল্প মনে হইছে আমার কাছে। যাই হোক। আমার ট্রেন চলে আসবে আমি উঠি। আর কিছু কাপড় কিনা নিয়েন। ভাল থাইকেন।
আমি আরো একটা একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম বুড়ির দিকে। সে বিড়বিড় করে বলল, “পিন্দনের কাপড়ের দরকার তো আমার ফুরাইছে গো বাপধন”।
আমি কথাটার মানে বুঝলাম না। বৃদ্ধা আমার হাত থেকে টাকাটা নিল। তারপর ধীর পায়ে মিশে গেল ভিড়ের মাঝে। দু হাত ঘষতে ঘষতে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ট্রেইনের হুইসেল বাজছে। ট্রেইন চলে এসেছে। আমি ব্যাকপ্যাক আর ব্যাগটা তুলে নিলাম।
ট্রেইন প্লাটফর্মে ঢুকতেই নারী কন্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার আর পুরুষ কন্ঠের চেচামেচিতে কেপে উঠল প্লাটফর্ম। ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম একটা ছবছরের বাচ্চাকে নাকি ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাটা নাকি মা বাবার সাথে দাদার বাড়ি সুজনদীঘি গ্রামে যাচ্ছিল। কয়েকজন লোক হলফ করে বলছে যে তারা এক কানা বৃদ্ধা মহিলাকে দেখেছে বাচ্চাটাকে ট্রেনের নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে। তারপর নাকি মহিলা উধাও হয়ে গিয়েছিল।
সারা স্টেশন খুজেও আর সেই মহিলাকে পাওয়া যায়নি।