বেশ অনেক বছর আগের কথা।
কাগজে একটা খবর বেরিয়েছিল, একজন খুনী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই কলকাতাতেই লুকিয়ে আছে। পুলিশ তদন্ত করে এই পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল যে খুনীটা উত্তর কলকাতার কোথাও কোনও বাড়িতে ছদ্মবেশে ডেরা গেড়ে আছে। লোকটার ছবিও ছাপা হয়েছিল। কাগজে বলা হয়েছিল কেউ যদি লোকটার সন্ধান দিতে পারে, তাহলে গভর্নমেন্ট থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
সে সময় এখনকার মতো এত খুন খারাপি হতো না। তাই এইরকম একজন ভয়ঙ্কর খুনীকে পুলিশ ধরতে পারছে না, আর সে বহাল তবিয়তে এই কলকাতায় রয়েছে জেনে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর ভয় পেয়েছিলাম বলেই ঘটনাটা আজও আমার মনে আছে।
এরপর সেই খুনী ধরা পড়েছিল কিনা সে খবর আর পাইনি। অন্তত কাগজে কিছু চোখে পড়েনি।
জানতে পেরেছিলাম অনেক বছর পর। সেও খবরের কাগজ পড়েই।
ঘটনাটা এইরকম…….
মানিকতলা ব্রিজের ওপারে একটা টু রুমড ফ্ল্যাট কিনেছিলেন বিভাবতী সরকার। টাকাটা দিয়েছিল তাঁর একমাত্র ছেলে। দিল্লিতে চাকরী করে। মা’কে বলেছিল, ” তুমি তো কলকাতা ছেড়ে নড়বে না, টাকা দিচ্ছি একটা ফ্ল্যাট কিনে নাও। রিটায়ার করে তো কলকাতাতেই তোমার কাছে গিয়ে থাকতে হবে।”
সেইমতো বিভাবতী দেবী ফ্ল্যাটটি কিনলেন। ফ্ল্যাটবাড়িটা একটা পুরনো ভাঙা বাড়ি আর খানিকটা জলা জমির ওপর তৈরি। একসময় এইসব অঞ্চলে বাড়ি ঘর কমই ছিল। যে বাড়ি ভেঙে এই ফ্ল্যাট…. সেটা ছিল কোনও এক ডাকসাইটে জমিদারের। জমিদারী কবে চলে গিয়েছিল, জমিদারের বংশধররাও কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সাবেকী জমিদারী মেজাজটি চলে যায়নি। সে আমলের পুরনো বাড়ি জমিদারপুত্রদের পছন্দ হচ্ছিল না। তাই সেটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে দু-এক ঘর ভাড়াটে আসত। আবার চলে যেত। সামান্য টাকার ভাড়া। তাই জমিদারপুত্রদের মন ভরত না। তারা ঠিক করল, বাড়িটা বেচে দেবে। সেজন্য নতুন ভাড়াটেও আর বসাল না। কেননা ভাড়াটেসুদ্ধ বাড়ি কিনতে কেউ চাইবে না।
তারপর কত হাতবদল হয়ে এখন সেই বাড়িটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা হাল ফ্যাশনের নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি। কিন্তু পেছনের অংশে এখনও এখানে সেখানে ডোবা, জলা, ঢোল-কলমি আর বনতুলসীর ঝোপ রয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় না জায়গাটা কলকাতার মধ্যে।
এইখানে দুটো ঘরের ফ্ল্যাট কিনে থাকেন বিভাবতী। একাই থাকেন পুজো-আচ্চা নিয়ে। খুব ভক্তিমতী। নিজেই রাঁধেন।
একটি কাজের মেয়ে আছে। সে সারা দিন তাঁকে সাহায্য করে। তার সঙ্গেই গল্প করে তাঁর সময় কাটে।
সবই ভাল তবু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি। বিভাবতী এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছিলেন যাতে তিনি বুঝেছিলেন যে বাড়িটার কিছু দোষ আছে। বিশেষ করে উত্তর দিকের ঘরটায়।
তাঁর অসাধারণ মনের জোর আর সাহস ছিল তাই তিনি রাতে একাই থাকতে পারতেন। না থেকেই বা উপায় কি? ছেলের এতগুলো টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। এখন ছেড়ে যাবেন ই বা কোথায়? ছেলেকেই বা কি বলবেন? বাধ্য হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন। কাউকে কিছু বলতেন না। এখানে তাঁর কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আছে। তারা মাঝেমাঝেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসত। কিন্তু কাউকে তিনি রাতে থাকতে বলতেন না। তাঁর একা থাকা নিয়ে আত্মীয়রা চিন্তা করলেও তিনি হেসে বলতেন, তিনি ভালোই আছেন। তাছাড়া ভগবান যা করবেন, তাই হবে। অনর্থক ভেবে লাভ কি।
এতখানি ভগবানের ওপর বিশ্বাস দেখে আত্মীয়রাও কেউ কিছু বলত না। শুধু জানিয়ে যেত, অসুখ বিসুখ করলে যেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাদের খবর দেন।
তা বিভাবতী দেবী একটা বুদ্ধিমতীর কাজ করেছিলেন। টেলিফোন নিয়েছিলেন। আর সেটা রেখেছিলেন মাথার কাছে একটা টুলের ওপর।
মনে মনে অবশ্য জানতেন অসুখ বিসুখ ছাড়া আর যে ভয়টা তিনি নিঃশব্দে হজম করে যান, তার প্রতিকার টেলিফোন করে লোক ডেকে হয় না।
টেলিফোন নেবার কিছুদিন পরেই একটা ঘটনা ঘটল। মাঝে মাঝেই তিনি দু’একজনকে ফোন করেন। কিন্তু তাঁকে বড় একটা কেউ ফোন করে না।
হঠাৎ সেদিন গভীর রাতে টেলিফোন বাজার শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। এত রাতে কে ফোন করছে? নিশ্চয় রঙ নাম্বার। তিনি মশারীর মধ্যে থেকে হাত বাড়াতে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন মশারির বাইরে থেকে একটা কালো লোমশ হাত রিসিভারটা তুলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। হ্যাঁ, শুধুই একটা হাত।
তিনি চমকে উঠলেন। ভয় পেলেন। কিন্তু মূহুর্তেই সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ” কে তুমি? কি চাও?”
উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু অস্পষ্ট একটা পায়ের আওয়াজ ঘরের বাইরে চলে গেল।
বিভাবতী দেবী আর উঠলেন না। ভগবানকে স্মরণ করে আবার শুয়ে পড়লেন।
সকালে উঠে ভাবলেন, তিনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন?
তখনই চোখে পড়ল, রিসিভারটা টুলের নীচে ঝুলছে।
বিনবিন করে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তারপরই তিনি নিজেকে শক্ত করে নিলেন। সংসারের সব কাজই তিনি রোজকার মতো করলেন। কাউকে রাতের ঘটনা বললেন না। বললেই রটে যাবে, ফ্ল্যাটটা ভূতুড়ে। আর সে কথা ছেলের কানে গেলে তারা আর আসবে না।
একটা কথা ভেবে তাঁর ভয় হল, এখানে এসে পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারছিলেন উত্তর দিকের ঘরটায় কিছু আছে। তবে এ ঘর তিনি ব্যবহার করেন না। কিন্তু গতরাতের ঘটনায় তিনি বুঝতে পারলেন যে সে এ ঘরেও আসতে শুরু করেছে। তাহলে তিনি এখানে থাকবেন কি করে?
তারপরই তাঁর মনে হল, লোকটা কিন্তু তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। ‘ কে তুমি? কি চাই’ প্রশ্ন করাতেই সে রিসিভার ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। কেনই বা এসেছিল, কেনই বা চলে গিয়েছিল, তার উত্তর খুঁজে পেলেন না। আরও একটা উত্তর খুঁজে পেলেন না, অত রাতে কে তাঁকে ফোন করেছিল? সত্যিই কি রঙ নাম্বার ছিল?
যাই হোক, এদিনের পর থেকে আর সে এ ঘরে ঢোকে নি। কিন্তু গোল বাধাল একদিন কাজের মেয়েটা।
তিনি ঠিক করেছিলেন কাজের মেয়েটাকে রাতে তাঁর কাছে থাকতে বলবেন। তারজন্য, বেশি মাইনেও দেবেন। মেয়েটা রাজিও হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ আলোগুলো নিভে গেল। বিভাবতী দেবী বুঝলেন, লোডশেডিং। এ তো রোজকার ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎই কাজের মেয়েটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এল তাঁর কাছে। মুখ দিয়ে তার কথা সরছে না।
” কি রে মালতী? কি হয়েছে?” বিভাবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন।
মালতী অতি কষ্টে শুধু বলল, ” একটা লোক…….”
” লোক! কোথায় লোক?”
মালতী আঙুল দিয়ে ওদিকের ঘরটা দেখিয়ে দিল। তারপর কোনওরকমে বলল, ওই ঘরটায় যখন ও ঝাঁট দিতে ঢুকেছিল, তখনই লোডশেডিংটা হল। আর তখনিই স্পষ্ট দেখল একটা লম্বা মতো লোক ঘরের ভেতর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…..
বিভাবতীর বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। লোক বলতে মালতী কি বোঝাতে চাইছে, বুঝতে বাকি রইল না তাঁর। কিন্তু মুখে সাহস দেখিয়ে বললেন, ” ও ঘরে লোক আসবে কোথা থেকে? নিশ্চয় চোখের ভুল।”
মালতী যতই বোঝাতে চায় চোখের ভুল নয়, বিভাবতী ততই বলেন, না, চোখের ভুল। ও ঘরে লোক আসবে কোথা থেকে?”
মালতী চুপ করে আছে দেখে তিনি আরও জোর দিয়ে বললেন, ” আমি এত দিন আছি। কই কোনওদিন তো কিছু দেখিনি।”
মিথ্যে কথাই বলতে হয়েছিল বিভাবতীকে। কিছু না দেখলেও ঐ বদ্ধ ঘরে মানুষের চলাফেরার শব্দ তিনি এক আধবার নয়, বারবার শুনেছিলেন।
বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হয়েছিল বিভাবতীকে। না বললে যে মালতী এ বাড়িতে কাজ করাই ছেড়ে দেবে।
শেষ পর্যন্ত মালতী থাকল। তবে সন্ধে হবার আগেই চলে যেত। তখন থেকে বিভাবতী সারা রাত একা মুখ বুজে। আর পাশের তালাবন্ধ ঘরটায় মূর্তিমান আতঙ্ক।
সেদিনও তাঁর নিস্তব্ধ ঘরটাকে সচকিত করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তবে গভীর রাতে নয়, সন্ধ্যের একটু পরে।
চমকে উঠলেন বিভাবতী। কোনওরকমে রিসিভারটা তুলে নিলেন।
তারপরই খুশীতে তাঁর গলার স্বর আটকে গেল, ” হ্যালো!….ও বৌমা! ”
একমাত্র ছেলের বৌ ফোন করেছে দিল্লি থেকে।
” হ্যাঁ, তা আছি একরকম…… ভালই আছি….আচ্ছা, তুমি কি আগে একদিন অনেক রাতে ফোন করেছিলে?……..ও, করো নি?……তাহলে রঙ নাম্বার……হ্যাঁ……অনেক রাতে একবার ফোন বেজেছিল আমার ঘরে…..ধরতে পারিনি……কেটে গিয়েছিল।
তুমি আসবে কলকাতায় পরশুদিন?…… খুব খুশী হলাম শুনে……মাত্র এক রাতের জন্য?….তোমার বন্ধুর বিয়েতে……থাকতে পারবে না দুদিন?…..কি আর করা যাবে…..তাই এসো। ”
বৌমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে বিভাবতী দেবী রিসিভারটা রেখে দিলেন। তারপর মুখ তুলতেই চমকে উঠলেন। ঘরের বাইরে জানলার গরাদ ধরে লম্বা মতো কে একজন দাঁড়িয়ে।
” কে? কে ওখানে?”
সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা সরে গেল…..যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিভাবতীর রক্ত হিম হয়ে গেল। ও কি শুনতে এসেছিল এ বাড়িতে নতুন কেউ আসছে কিনা?
বিভাবতী দেবীর ছেলের বৌ অঞ্জনা দিল্লির একটা বিখ্যাত ইংরেজি কাগজের অফিসে কাজ করে। কলকাতায় তার এক বন্ধুর বিয়েতে এসেছে। রাতটুকু শুধু শাশুড়ির কাছে থাকবে। পরের দিন সকালের ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাবে।
নিজের লোককে কাছে পাবার আনন্দে বিভাবতী দেবী মনে মনে খুশী হলেও সেইসঙ্গে একটু ভয়ও পেলেন। ঐ যাকে এ বাড়িতে প্রায়ই দেখা যায়…..বৌমাও তাকে দেখে ফেলবে না তো?
সেদিন দুপুরেই অঞ্জনা হাসতে হাসতে এল। সারা দুপুর শাশুড়ির পাশে শুয়ে কত গল্পই না করল। বিকেলে বেরিয়ে গেল কিছু কেনাকাটা করতে। বলে গেল সন্ধ্যের আগেই ফিরবে।
ঠিক সন্ধেবেলাতেই ফিরল অঞ্জনা। ফুটপাত থেকে উঠে কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তারপরেই ঢোকার দরজা। কলিংবেল টিপতে যাচ্ছিল, দরকার হল না। মালতী দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। বৌদিকে দেখে একটু হাসল।
” কাজ হয়ে গেল?”, অঞ্জনা জিজ্ঞেস করল।
” হ্যাঁ”, মালতী হেসে জবাব দিল।
” বাড়ি যাচ্ছ?”
” হ্যাঁ”।
অঞ্জনা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবার একটু প্যাসেজ। প্যাসেজটা অন্ধকার। অঞ্জনা এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ মনে হল সে যেন এগোতে পারছে না……কিসে যেন বাধা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে ঠেলে বের করে দিতে চাইছে। অঞ্জনা থতমত খেয়ে গেল। তখনই তার মনে হলো তার সামনে দু’হাত দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে……চোর নাকি?
অঞ্জনা দিল্লিতে খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করা মেয়ে, সংবাদ সংগ্রহের জন্য নানা জায়গায় ছুটতে হয়। অত সহজে ভয় পায় না। ধমকের সুরে বলল, ” কে ওখানে?”
পরক্ষনেই মনে হল কেউ যেন পথ ছেড়ে সরে গেল।
পাছে মা ভয় পান তাই ব্যাপারটা নিয়ে অঞ্জনা বেশী হৈচৈ করল না। ঘরে ঢুকে শাশুড়িকে শুধু একটা কথাই বলল,” প্যাসেজটায় আলোর ব্যবস্থা নেই?”
বিভাবতী অবাক হয়ে বললেন, ” আছে বৈকি। এই তো মালতী গেল আলো জ্বেলে।”
” কিন্তু…. কিন্তু আমি তো ঢুকে দেখলাম, প্যাসেজ অন্ধকার। ”
বিভাবতী বললেন, ” হয়ত বালবটা কেটে গেছে।”
আধঘণ্টার মধ্যে অঞ্জনা সাজসজ্জা করে বিয়েবাড়ি চলে গেল। রাত দশটায় যখন ফিরল তখন দেখল, প্যাসেজে দিব্যি আলো জ্বলছে।
এবার শোবার পালা। কাল সকালেই প্লেন ধরতে হবে।
বিভাবতী চেয়েছিলেন, অঞ্জনা তাঁর সঙ্গেই শুলে ভাল হয়। অঞ্জনা কিন্তু শাশুড়ির সঙ্গে শুতে রাজি হল না। বলল, পাশের ঘরটা তো খালি পড়ে আছে। আমি ওখানেই শোব।”
বিভাবতীর মুখটা শুকিয়ে গেল। তিনি অনেক করে বোঝালেন। বললেন, ” ও ঘরটা ব্যবহার করি না, পরিষ্কার করা নেই? কি দরকার? একটা রাত না হয় আমার কাছেই শুলে?”
অঞ্জনা ভাবল, বোধহয় ও ঘরে বিছানা পাতা, মশারী টাঙানোর হাঙ্গামার জন্যই শাশুড়ি ও ঘরে শুতে বারণ করছেন। তাই বলল। ” আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আমি সব ঠিক করে নিচ্ছি।”
বলে উত্তর দিকের ঘরে গিয়ে ঝাঁটপাট দিয়ে বিছানা পেতে নিল।
নিরুপায় বিভাবতী আর কি করেন? শুধু বললেন, ” ভয়টয় পেলে আমায় ডেকো। ”
অঞ্জনা হেসে বলল, ” কিসের ভয়? ভূতের?”
‘ ভূত’ কথাটা হঠাৎই তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
কি আর করেন বিভাবতী, এক ফাঁকে তাঁর গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা অঞ্জনার বালিশের নিচে রেখে দিয়ে এলেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন, ” হে ঠাকুর, বৌমাকে রক্ষা কোরো।”
খুব ক্লান্ত ছিল অঞ্জনা। তাই হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে শোয়ামাত্র ঘুম। তখনও সে জানত না কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে……..
অনেক রাত্রে আচমকা তার ঘুমটা ভেঙে গেল। অসহ্য গরমে তার নিশ্বাস যেন আটকে আসছে। মশারির মধ্য দিয়ে তাকিয়ে দেখল, পাখা চলছে না। লোডশেডিং? কলকাতায় এত লোডশেডিং হয়! কিন্তু তখনই বাইরের জানলার দিকে চোখ পড়তে দেখল, রাস্তার আলোগুলো দিব্যি জ্বলছে।
তাহলে?
হঠাৎই তার মনে হল, ঘরের মধ্যে আরও কেউ রয়েছে। চমকে তাকাতেই দেখল, তার বিছানা থেকে মাত্র হাত পাঁচেক দূরে লম্বা মতো একটা লোক কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এইরকমই একটা আবছা চেহারা সে প্যাসেজে দেখেছিল সন্ধ্যেবেলা শপিং সেরে বাড়ি ঢোকার সময়। তখন মুখ দেখতে পায় নি।
ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল অঞ্জনা। পারল না। মনে হল, তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে।
কি করবে ভাবছে, এইসময় দেখল, লোকটা এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে………।
অঞ্জনা চিৎকার করতে গেল, পারল না। মুখ থেকে শুধু একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরলো।
ততক্ষণে মূর্তিটা একেবারে মাথার কাছে এসে পড়েছে। একটা হাত দিয়ে মশারীটা তুলছে……তারপর কনকনে ঠাণ্ডা হাতটা দিয়ে অঞ্জনার বাঁ হাতটা খপ করে ধরে টানাটানি করতে লাগল।
” মাগো!”
একটা শব্দই অঞ্জনার মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
পরদিন অনেক বেলায় শাশুড়ির ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল অঞ্জনার। প্রথমে মনে হয়েছিল রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু নিজের হাতের দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। হাত মুচড়ে ধরার দাগটা তখনো লাল হয়ে আছে। আর…..আর মাথার দিকে মশারিটাও খানিকটা তখনো উঁচু হয়ে আছে।
অঞ্জনা বিভাবতী দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আপনি এখানে একা আর থাকবেন না। আমার সঙ্গে চলুন। ”
বিভাবতী বললেন, ” হুট করে কি এখানের পাট চুকিয়ে যাওয়া যায়?”
অঞ্জনা বলল, ” তবে আমি এখন যাই। খুব তাড়াতাড়ি আপনার ছেলেকে নিয়ে আসছি। তারপর একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করা যাবে। এ ক’দিন একটু সাবধানে থাকবেন।”
বিভাবতী একটু হাসলেন।
ব্যাপারটা অঞ্জনা সহজে ছেড়ে দেয় নি। এই বাড়িতে এক রাত থাকার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কাগজে লিখল। কলকাতায় এসে পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে যে তথ্যটা বের করেছিল তা হচ্ছে……সেই দীর্ঘদেহী খুনীটা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল দলবল নিয়ে। সাহস করে কেউ পুলিশকে খবর দিতে পারেনি। কিন্তু জমিদারপুত্রদের একজন বাড়িটা খালি করার জন্য একদিন লেঠেল পাঠিয়ে তাকে খুন করে ঐখানেই পুঁতে রাখে। পুলিশ পরে এসে মাটি খুঁড়ে লাশের সন্ধান করে।
আশ্চর্য! কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি।