রাত ২ টার মত বাজে। রান্নাঘর থেকে চুপিচুপি দিয়াশলাই টা পকেটে নিয়ে বের হলাম। আমার বাড়ির সামনে বিশাল বড় মাঠ। মনটার ভিতরে খুব ছটফট করছে। আমি হাটতে হাটতে মাঠের মাঝখান পর্যন্ত গেলাম। পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বলিয়ে লম্বা একটা টান দিলাম।
চোখের সামনে হান্টারের ক্ষত-বিক্ষত শরীর টা ভেসে উঠলো। মুখ দিয়ে অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, চোখ ভিজে গেলো। মূহুর্থের মধ্যেই যেন চোখের পলোকে ঘটেগেলো ঘটনাটা।
অন্য আর দশটা কুকুরের মত কোন সাধারন কুকুর ছিলো না হান্টার। বাশ বাগানের এক পুরোনো ভাঙা কবরস্থানের সুরং এর ভিতরে জন্ম কুকুরটার। ৭ টা কুকুর সানার ভিতরে হান্টার ছিলো সবচেয়ে চতুর। তাই ওটাকেই পছন্দ হলো। ওখান থেকে ওকে নিয়ে বাসায় আসলাম, পরিস্কার করে গোসল করালাম। ওর তাকানো আর চলাফেরা দেখে ওর নাম দিলাম হান্টার।
আমরা জানি কুকুর খুবই প্রভুভক্ত প্রাণী। সাভাবিক ভাবেই হান্টার আমার অনেক ভক্ত হলো। আমার সব কথা বুঝতো ও। মাত্র ৭ মাসেই প্রাপ্ত বয়স্ক ও ভয়ংকর গর্জন প্রাপ্ত হলো আমার কুকুর টা। সারা রাত চোর ডাকাত তো দুরের কথা, একটা বিড়ালও ঢুকতে সাহস পেতো না আমার বাড়ির ত্রিসীমানায়। বাড়ি থেকে বের হলেই আমাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত লেজ নাড়িয়ে পাহাড়া দিতে দিতে এগিয়ে দিয়ে আসত। আবার আমার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকত ওই মোড়েই। আমাকে দেখা মাত্র আহ্লাদে আটখানা হয়ে কুই কুই আওয়াজ করে
দৌরে আসত আমার দিকে। সমানে পা চাটা শুরু করত আর গড়গড় আওয়াজ তুলে নানান অভিযোগ করত আমার কাছে। আমি মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে দিতাম। ওর নালিশের আওয়াজ টা খুব পরিচত আমার কাছে। আমি বুঝতাম ওর সব কথা। হয় মা ওকে খাবার দিতে দেরি করেছে, নাহয় আমার ছোট বোন নিধী ওর গায়ে পানি ঢেলে দিয়ে খিল খিল করে হেসে দিয়েছে।
বাসায় পৌছানো পর্যন্ত হান্টার যেভাবে একবার আমার সামনে একবার আমার পিছনে দৌড়াতো আর ঘেউ ঘেউ গর্জন তুলতো যেন সবাই কে জানান দিচ্ছে “হুশিয়ার সাবধান”।
একবার জোর করে ওকে একটা পুকুরের পানিতে নামিয়েছিলাম গোসল করানোর জন্য। সে যে কি রাগ আমার ওপর বলার মতো না। ২ দিন কিচ্ছু খায়নি, কথা বলেনি আমার সাথে। কিন্তু দ্বায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ছিল না তার। সেদিন বুঝলাম ও কোনো সাধারন কুকুর নয়।
হঠাৎ আমাদের প্রতিবেশি জাকির কাকার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। ট্রাক এর ড্রাইভার হওয়ার কারনে রাত করে বাড়ি ফেরেন তিনি।
বললেন “কে ওখানে? ফয়সাল বাবা না?”
-জী কাকা আমি।
-কি করছো এতো রাতে এখানে বসে?
-কিছুনা কাকা। মন ভালো না তাই বসে আছি।
-রাত অনেক হয়েছে বাবা যাও গিয়ে শুয়ে পরো।
বলে তিনি চলে গেলেন।
আরেক টা সিগারেট ধরালাম।
স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠলো, আমার একটু ভুলের জন্য… উফফ!!! আর মনে করতে পারছিনা।
প্রতিদিনের মত আজো হান্টার আমাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিলো। আমি কানে Head Phone দিয়ে গান শুনছিলাম। হঠাৎ হান্টার আমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে একটা পুকুরের মধ্যে ফেলে দিলো! আমি পুকুরের পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে আমার হান্টারের ভয়ংকর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। মুহুর্থেই ঘটে গেলো সব। তরিঘরি করে উঠে রাস্তায় এসে দেখি আমার হান্টার রক্তাক্ত রাস্তায় লেপ্টে আছে। সময় যেন থেমে গেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি হান্টারের দিকে। একটা মাইক্রবাস বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালাচ্ছিলো। হর্ন দেয়া সর্তেও কানে Head Phone থাকায় কিচ্ছু শুনতে পাইনি আমি।
হান্টার কে পুকুরে চুবিয়ে ছিলাম বলে এতো রাগ হয়েছে ওর?? সেই রাগ পুষে রেখে আজ সুযোগ পেয়ে এভাবে প্রতিশোধ নিলো ও!!!
নতুন জীবন দিয়ে গেলো ও আমাকে।
আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম “হান্টার!!”
একটা হাওয়া গর্জন দিয়ে উত্তর দিল “ঘেউ ঘেউ”
(পরদিন জাকির কাকার কাছে শুনলাম গত রাতে আমার পাশে নাকি হান্টার বসে লেজ নারাচ্ছিলো! তিনি হান্টারের মৃত্যু সংবাদ না জানায় অবাক হননি। আমি আরো জোরালো ভাবে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, ” বিশ্বাস করো বাবা, আমি নিজের চোখে হান্টারকে দেখেছি তোমার পাশে ছিলো…