স্নানাহারের জন্য উঠি-উঠি করিতেছিলাম, বেলা সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছিল-এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোনের ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল
শুনিতে পাইলাম, সে বলিতেছে, ‘হ্যালো, কে আপনি? বিধুবাবু? ও..নমস্কার! নমস্কার! কি খবর? অ্যাঁ। বলেন কি?..আমায় যেতে হবে? তা বেশ ..কত নম্বর?….ও আচ্ছা…আধঘন্টার মধ্যেই গিয়ে পৌছুব…’
পাঞ্জাবির বোতাম লাগাইতে লাগাইতে ব্যোমকেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, বলিল, ‘চল হে, একটু ঘুরে আসা যাক। একটা খুন হয়ে গেছে, বিধুবাবু স্মরণ করেছেন।’
আমি দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোন বিধুবাবু? ডেপুটি কমিশনার?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ-তিনিই। আমার ওপর এত দয়া কেন হল, বুঝতে পারছি না। নিজের ইচ্ছায় যে ডাকেন নি, তা তাঁর কথার ভাবেই বোঝা গেল। বোধহয় ওপর থেকে হুড়ো এসেছে।’
পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিধুবাবুর সঙ্গে কাজের সুত্রে আমাদের আলাপ হইয়াছিল। তিনি বেশ মুরুব্বিগোছের লোক ছিলেন, দেখা হলেই প্রাম্ভারিকভাবে ব্যোমকেশকে অনেক সদুপদেশ দিতেন; ব্যোমকেশ যে বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতায় তাঁহার অপেক্ষা সর্বাংশে ছোট, এই কথাটি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নানাভাবে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেন। ব্যোমকেশ অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁহার লেকচার শুনিত ও মনে মনে হাসিত। বিধুবাবু নিজের গুণ গরিমার বর্ণনা করিতে করিতে অনেক সময় পুশিসের অনেক গুঢ় খবর প্রকাশ করিয়া ফেলিতেন। তাই,পুলিস-সংক্রান্ত কোনও খবর প্রয়োজন হইলেই ব্যোমকেশ তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইয়া একদফা লেকচার শুনিয়া আসিত। যৌবনকালে বোধ করি বিধুবাবু একেবারে নির্বোধ ছিলেন না; বিশেষত এই বয়স পর্যন্ত তাঁহার অসাধারণ ধৈর্য ও কর্মোৎসাহ ছিল। কিন্তু পুলিস-আইনের কলে পড়িয়া তাঁহার বুদ্ধিটা যন্ত্রবৎ হইয়া পড়িয়াছিল। সহকর্মীরা আড়ালে তাঁহাকে ‘বুদ্ধুবাবু ’ বলিয়া ডাকিত।
যা হোক, তাড়াতাড়ি কিছু জলযোগ করিয়া লইয়া আমরা দু’জনে বাহির হইলাম। বাসে যথাস্থানে পৌছিতে মিনিট কুড়ি সময় লাগিল। স্থানটা শহরের উত্তরাংশে, ভদ্র বাঙ্গালী পল্লীর কেন্দ্রস্থল। নম্বর খুঁজিতে খুঁজিতে চোখে পড়িল, একটি বাড়ির দরজায় দুইজন লালপাগড়ি দাঁড়াইয়া সতর্কভাবে গোঁফে চাড়া দিতেছে; বুঝিলাম, এই বাড়িটাই ঘটনাস্থল।
ব্যোমকেশের নাম শুনিয়া কনেস্টবলদ্বয় পথ ছাড়িয়া দিল; আমরা প্রবেশ করিলাম। বাহির হইতে দেখিলে দোতলা বাড়িটা ছোট বলিয়া মনে হয়, কিন্তু ভিতরে বেশ সুপ্রসর, অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি বলিয়া মনে হয়। বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই সম্মুখের খোলা দালানে বড় বড় টবে বাহারে তালগাছ সাজানো রহিয়াছে চোখে পড়িল। একটা প্রকান্ড কাচের পাত্রে লাল মাছ খেলা করিতেছে। দালানের তিন ধারে বারান্দাযুক্ত কয়েকটি ঘর। প্রবেশদ্বারের সম্মুখে দালানের অপর প্রান্তে উপরে উঠিবার দু’মুখো সিঁড়ি। ডানধারের একটা ঘরে অনেক লোক গিসগিস করিতেছে দেখিয়া আমরা সেই দিকেই গেলাম। দেখিলাম, ঘরের মধ্যস্থলে টেবিলের সম্মুখে স্থুলকায় পক্কগুম্ফ বিধুবাবু ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বসিয়া আছেন; বাড়ির চাকরের এজেহার হইয়া গিয়াছে—বামুনের এজেহার হইতেছে। লোকটা কাঁদো-কাঁদো মুখে জোড়-হস্তে দাঁড়াইয়া বিধুবাবুর কড়া কড়া প্রশ্নের জবাব দিতেছে ও ধমক খাইয়া চমকাইয়া চমকাইয়া উঠিতেছে। কয়েকজন নিম্নতন পুলিস-কর্মচারী চারিদিক ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
আমাদের দেখিয়া বিধুবাবুর মুখ আরও অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, ‘আপনারা এসেছেন, বসুন। বিশেষ কিছু নয় –একটা খুন হয়েছে, সামন্য ব্যাপার। কে আসামী, তাও পরিষ্কার বোঝা যাচেছ। ওয়ারেন্টও ইসু করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কর্তার হুকুম হল আপনাকে ডাকতে—তাই –’ বিধুবাবু সজোরে গলাঝাড়া দিয়া বলিলেন, ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম—আপনিও দেখুন,যদিও দেখবার কিছুই নেই।’
কৈতববাদের অপার মহিমা; দেবতা একটু প্রসন্ন হইলেন, বলিলেন, ‘এ বাড়ির কর্তা করালীবাবু গতরাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন হয়েছেন। মৃত্যুর ধরনটা একটু নুতন গোছের, তাই সাহেবে একেবারে ঘাবড়ে গেছেন। কিন্তু আসলে ব্যাপার খুব সহজ—করালীবাবুর এক ভাগনে—মতিলাল , সে-ই এ কাজ করেছে; আর করেই ফেরার হয়েছে।’
ব্যোমকেশ বিনীতভাবে বলিল, ‘গোড়া থেকেই সমস্ত কথা না বললে আমার মত লোকের বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। দয়া করে একটু খোলসাভাবে বলবেন কি?’
বিধুবাবুর মুখের মেঘ সম্পূর্ণ কাটিয়া গেল, তিনি একটু প্রাম্ভারি হাস্য করিয়া বলিলেন, ‘একটু বসুন। এই লোকটির এজেহার শেষ করে নিই, তারপর সব কথা আপনাকে বুঝিয়ে বলব।’
পাচক ব্রাহ্মণটা তখনও দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছিল, বিধুবাবু তাহাকে প্রচণ্ড এক ধমক দিয়া বলিলেন, ‘সাবধান হয়ে বুঝে-সমঝে কথা বলবে। মিথ্যে কথা একটি বলেছ কি সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতকড়া—বুঝলে?
বামুনঠাকুর শীর্ণকণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে।’
বিধুবাবু তখন অসমাপ্ত জেরা আরম্ভ করিলেন, ‘কাল রাত্রে তুমি মতিলালবাবুকে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে, ঘড়ি তো দেখিনি—বোধহয়, একটা দুটো হবে।’
‘ঠিক করে বল, একটা না দুটো?’
‘আজ্ঞে, বারোটা একটা হবে।’
বিধুবাবু হুমকি দিয়া উঠিলেন, ‘আবার পাঁচরকম কথা! ঠিক বল, বারোটা, না একটা, না দুটো?’
পাচক একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘আজ্ঞে, বারোটা।’
দারোগা ক্ষিপ্রহস্তে জবানবন্দী লিখিয়া লইতে লাগিল।
‘তিনি চোরের মত পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেলেন?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ—তিনি প্রায় রোজ রাত্তিরেই বাড়ি থাকেন না।’
‘আবার বাজে কথা! যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও। মতিলালবাবুকে তুমি উপর থেকে নেমে আসতে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে না হুজুর। তিনি যখন সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, তখন দেখেছিলুম।’
‘উপর থেকে নামতে দেখনি! তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
‘আজ্ঞে আমি—আজ্ঞে আমি—’
‘সত্যি বল, তুমি তখন কোথায় ছিলে?’
পাচক ভয়-কম্পিত স্বরে জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, ‘আজ্ঞে ধর্মাবতার, আমার দেশের লোকেরা এ বাড়ির সামনে মেছ করে থাকে—তাই রাতের কাজকর্ম শেষ হলে তাদের আড্ডায় গিয়ে একটু বসি।’
‘ওঃ—তুমি তখন আড্ডায় বসে গাঁজায় দম দিচ্ছিলে!’
‘আজ্ঞে—’
‘সদর দরজা তাহলে খোলা ছিল?’
ভয়ে পাচকটা শুকাইয়া গিয়াছিল, অস্ফুট কণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ—’
বিধুবাবু কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করিয়া থাকিয়া বলিলেন, হুঁ। তাহলে রাত্রে বাড়িতে কারা আসা—যাওয়া করেছিল, তুমি আড্ডায় বসে বসে দেখেছিলে?’
‘আজ্ঞে, আর কেউ বাড়ি থেকে বাড়ি থেকে বেরোননি।’
‘হুঁ। তুমি কখন বাড়ি ফিরলে?’
‘আজ্ঞে, মতিলালবাবু চলে যাবার আধঘণ্টা পরেই আমি বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে দিলুম। সুকুমারবাবু তার আগেই ফিরে এসেছিলেন।’
‘অ্যা! সুকুমারবাবু আবার কোথা থেকে ফিরে এসেছিলেন?’
‘তা জানি না হুজুর।’
‘তিনি কখন ফিরেছিলেন?’
‘মতিবাবু বেরিয়ে যাবার কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে।’
বিধুবাবুর ভ্রুকুটি গভীরতর হইল। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘তুমি এখন যেতে পার। দরকার হলে আবার তোমার এজেহার হবে।’
পাচকঠাকুর ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া পলায়ন করিল। বিধুবাবু তখন ঘর হইতে অনক্য পুলিস—কর্মচারীদের সরিয়া যাইতে বলিলেন। ঘরে কেবল আমি আর ব্যোমকেশ রহিলাম। বিধুবাবু আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘দেখলেন তো, একজনকে জেরা করেই সব কথা বেরিয়ে পড়ল। ভাল করে জেরা করতে জানলে—যা হোক, আপনাকে গোড়া থেকে না বোঝালে আপনি বুঝতে পারবেন না। বাড়ির সকলের জবানবন্দী নিয়ে যেসব কথা জানা গেছে, তােই মোটামুটি আপনাকে বলছি—মন দিয়ে শুনুন।’
ব্যোমকেশ মাথা হেট করিয়া নীরবে কথা শুনিতে লাগিল। বিধুবাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘এই বাড়ির যিনি কর্তা ছিলেন, তার নাম করালীবাবু। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। বেশ অবস্থাপন্ন লোক, কলকাতায় চার-পাঁচখানা বাড়ি আছে, তা ছাড়া ব্যাঙ্কেও দু‘তিন লাখ টাকা জমা আছে।
‘স্ত্রী-পুত্র না থাকলেও তাঁর পুষ্যির অভাব নেই। তিনটি ভাগনে—মতিলাল, মাখনলাল আর ফণিভূষণ এবং শ্যালীর দুটি ছেলে-মেয়ে—সবসুদ্ধ এই পাঁচটি লোককে করালীবাবু প্রতিপালন করতেন। তারা সবাই এই বাড়িতে থাকে। তাদের তিন কুলে কেউ নেই।
‘যতদুর জানা যায়, করালীবাবু ভয়ঙ্কর ক্ষপিশ মেজাজের লোক ছিলেন। বাতব্যাধিতে পঙ্গু ছিলেন, বয়সও ষাট-বাষট্টি হয়েছিল—তাই নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরুতেন না। কিন্তু বাড়িসুদ্ধ লোক তাঁকে বাঘের মতন ভয় করত। তাঁর এক অদ্ভুদ পাগলামি ছিল—তিনি কেবলই নিজের উইল তৈরি করতেন। তাঁর তিনখানা উইল দেরাজ থেকে বেরিয়েছে। প্রথমটায় তিনি মাখনকে ওয়ারিস করে যান, দ্বিতীয়টায় ওয়ারিস মতিলাল, এবং সবশেষটায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি সুকুমারকে দিয়ে গেছেন। শেষ উইলটা তৈরি হয়েছে—পরশু। সুকুমারই এখন তাঁর ওয়ারিস।
‘করালীবাবু থেকে থেকে উইল বদলাবার কারণ ছিল এই যে, যখন যার ওপর তিনি চটতেন, তখনই তাকে উইল থেকে খারিজ করে দিতেন।
‘এই উইলের ব্যাপার নিয়ে কাল দুপুরবেলা মতিলালের সঙ্গে করালীবাবুর খুব একচোট ঝগড়া হয়ে যায়। মতিলালের শরীরে অনেক দোষ আছে—সে তাঁকে ‘ঘাটের মড়া’ ‘বাহাত্তুরে বুড়ো’ ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে চলে আসে।
‘তারপর রাত্রি প্রায় বারোটার সময় মতিলাল চুপিচুপি বাড়ি থেকে পালায়—বামুন এবং চাকর দু’জনেই তাকে পালাতে দেখেছে। আজ সকালবেলা দেখা গেল, করালীবাবু তাঁর বিছানায় মরে পড়ে আছে।
‘কি করে মৃত্যু হল, প্রথমটা কেউ বুঝতে পারেনি। আমি এসে বার করলুম—তাঁর ঘাড়ে, ঠিক মেডালা আর ফার্স্ট ভার্টিরা‘র মাঝখানে একটা ছুঁচ আমুল ফুটিয়ে দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়েছে।’
বিধুবাবু চুপ করিলে ব্যোমকেশ মুখ তুলিল, ‘ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! মেডালা আর ফার্স্ট সার্ভিক্ল ভার্টিব্রা‘র সন্ধিস্থলে ছুঁচ ফুটিয়ে খুন করেছে, এ যে একেবারে Bride of Lammermoor!’ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘মতিলালের নামে ওয়ারেন্ট বার করে দিয়েছেন? লোকটা কাজকর্ম কিছু করে কি না, খবর পাওয়া গেছে কি?’
বিধুবাবু বলিলেন, ‘কিছু না—কিছু না! থার্ড ক্লাস অবধি বিদ্যে, ঘোর বয়াটে। মামার অন্ন মারত, আর বেলেল্রাগিরি করে বেড়াত।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর মাখনলাল?’
‘তিনিও প্রায় দাদার মত, তবে অতটা নয়। কোকেন, গাঁজা-টাজা খায় বটে, কিন্তু দাদার মত এখনও নাম-কাটা সেপাই হয়ে ওঠেনি।’
‘আর ফণিভূষণ?’
‘তিনি আবার খোঁড়া। কথায় বলে—কানা খোঁড়া এক গুণ বাড়া, কিন্তু এ ছোড়া বোধহয় অতটা খারাপ নয়। তার কারণ, খোঁড়া বলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না। তিন ভাইয়ের মধ্যে এই ফণিভূষণই একটু মানুষের মতন বোধ হল।’
‘আর সুকুমার?’
‘সুকুমার বেশ ভাল ছেলে, মেডিক্যাল কলেজের ফিফথ ইয়ারে পড়ে। তার বোন সত্যবতীও কলেজে পড়ে। এরা দুই ভাই-বোনে বুড়োর যা কিছু সেবা-শুশ্রুষা করত।’
‘এরা সকলেই বোধহয় অবিবাহিত?’
‘হ্যা—মেয়েটিও।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘এবার চলুন, বাড়িটা একটু ঘুরে দেথা যাক। মৃতদেহ বোধহয় এখনও স্থানান্তরিত হয়নি।’
‘না।’ একটু অপ্রসন্নভাবেই বিধুবাবু উঠিয়া অগ্রবর্তী হইয়া চলিলেন, আমরা তাহার অনুসরণ করিলাম। উপরে উঠিবার সিঁড়ি বারান্দার দুই দিক হইতে উঠিয়া মাঝে চওড়া হইয়া দ্বিতলে পৌছিয়াছে। সিঁড়ির নীচে একটি ঘরের দরজা খোলা দেখা গেল, ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ও ঘরটি কার?’
বিধুবাবু বলিলেন, ‘ওটা মতিলালের ঘর। বিশেষ কারণবশ তিনি নীচে শোয়াই পছন্দ করতেন। কর্তা অত্যন্ত কড়া মেজাজের লোক ছিলেন, রাত্রি ন’টার পর কারুর বাইরে থাকবার হুকুম ছিল না। এর ঠিক ওপরের ঘরেই কর্তা শুতেন।’
‘ও—আর এ ঘরটি?’ বলিয়া ব্যোমকেশ সিঁড়ির পাশে কোণের ঘরটি নির্দেশ করিল।
‘ওটায় মাখনলাল থাকে।’
‘এরা সবাই যে-যার ঘরে আছেন বোধহয়? অবশ্য মতিলাল ছাড়া?’
‘নিশ্চয়। আমি কড়া হুকুম দিয়ে দিয়েছি, আমার বিনা অনুমতিতে কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যায়। দোরের কাছে কনস্টেবর মোতায়েন আছে।’
ব্যোমকেশ অস্ফুট স্বরে প্রশংসা ও অনুমোদনসূচক কি একটা বলিল, শুনা গেল না। দোতলায় উঠিয়া সম্মুখেই একটা বন্ধ দরজা দেখাইয়া বিধুবাবু বলিলেন, ‘এই ঘরে করালীবাবু শুতেন।’
দরজার সম্মুখে গিয়া হঠ্যাৎ ব্যোমকেশ নতজানু হইয়া ঝুঁকিয়া বলিল, ‘এটা কিসের দাগ? বিধুবাবু ঝুঁকিয়া একবার দেখিলেন, তারপর সোজা হইয়া তাচ্ছিল্যভরে বলিলেন, ‘ও চায়ের দাগ। প্রত্যহ সকালে ঐ মেয়েটি—সত্যবতী—চা তৈরি করে এনে করালীবাবুকে ডাকত—আজ সকালে সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখল, তিনি মরে পড়ে আছেন। সেই সময় বোধহয় পেয়ালা থেকে চা চলকে পড়েছিল।’
‘ও—তিনিই বুঝি করালীবাবুর মৃত্যুর কথা জানতে পারেন?’
‘হ্যাঁ।’
দ্বারে চাবি লাগানো ছিল, বিধুবাবু তালা খুলিয়া দিলে আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি মাঝারি আয়তনের, আসবাবপত্র বেশি নাই, কিন্তু যে কয়টি আছে, সেগুলি পরিপাটীভাবে সাজানো। মেঝেয় মৃজাপুরীর কার্পেট পাতা; ঘরের মাঝখানে কাজকরা টেবিল-ক্লথে ঢাকা ছোট টিপাই; এক কোণে একটি আলনা—তাতে কোঁচানো থান ও জামা গোছানো রহিয়াছে, জুতাগুলি নীচে বার্ণিশ করা অবস্থায় সারি সারি রাখা আছ। ঘরের বাঁ দিকের কোণে একখানি খাট—খাটের উপর চাদর-ঢাকা একটা বস্তু রহিয়াছে, দেখিলে মনে হয়, যেন কেহ পাশ ফিরিয়া চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। খাটের পাশে একটি টেবিল, তাহার উপর কয়েকটি ঔষধের শিশি ও মেজার গ্লাস সারি দিয়া সাজানো রহিয়াছে। কাচের গেলাস ঢাকা একটি কুঁজা খাটের শিয়রে মেঝের উপর রাখা আছে। মোটের উপর ঘরটি দেখিলে গৃহকর্তা কিরুপ গোছালো লোক ছিলেন, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়, এবং বিছানায় শয়ন ঐ চাদর-ঢাকা লোকটি যে গত রাত্রিত এই ঘরেই খুন হইয়াছিল, তাহা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য হইয়া পাড়ে। টিপাইয়ের উপর এক পেয়ালা অনাস্বাদিত চা তখনও রাখা ছিল, ব্যোমকেশ প্রথমে সেই পেয়ালাটাই অনেকক্ষণ ধরিয়া নিরীক্ষণ করিল। শেষে মৃদুস্বরে কতকটা নিজমনেই বলিল, ‘পেয়ালার অর্ধেক চা চলকে পিরিচে পড়েছে, পেয়ালাটা অর্ধেক খালি, পিরিচটা ভরা—কেন?’
বিধুবাবু অধীরভাবে মুখের একটা শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘সে কথা তো আগেই বলেছি, মেয়েটি—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুনেছি। কিন্তু কেন?’
বিধুবাবু এই অর্থহীন প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করিলেন না, বিরক্তমুখে জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন।
ব্যোমকেশ সন্তর্পণে চায়ের পেয়ালাটা তুলিয়া লইল। চায়ের উপর একটা শ্বেতাভ ছালি পড়িয়াছিল, চামচ দিয়া চা নাড়িয়া সে আস্তে আস্তে একটু চা মুখে দিল। তারপর পেয়ালাটি যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া মুখ মুছিয়া খাটের পাশে গিয়া দাঁড়াইল।
কিছুক্ষণ স্থিরভাবে বিছানার দিকে চাহিয়া থাকিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মৃতদেহ নাড়াচাড়া হয়নি? ঠিক যেমনটা ছিল তেমনি আছে?’
বিধুবাবু জানালার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। কেবল চাদরটা মাথা পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া হয়েছে, আর ছুঁচটা বার করে নিয়েছি।’
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে চাদরটি তুলিয়া লইল। শুষ্ক শীর্ণ লোকটি, যেন দেয়ালের দিকে পাশ ফিরিয়া ঘুমাইতেছে। মাথার চুল সব পাকিয়া যায় নাই, কপালের চামড়া কুঁচকাইয়া কয়েকটা গভীর রেখা পড়িয়াছে। মুখে মৃত্যু-যন্ত্রণার কোনও চিহ্ন নাই।
ব্যোমকেশ লাস না সরাইয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে পরীক্ষা করিল। ঘাড়ের চুল সরাইয়া দেখিল, নাকের কাছে ঝুঁকিয়া অনেকক্ষণ কি নিরীক্ষণ করিল। তারপর বিধবাবুকে ডাকিয়া বলিল, ‘আপনি নিশ্চয় খুব ভালো করেই লাস পরীক্ষা করেছেন, তবু দুটো বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ঘাড়ে তিনবার ছুঁচ ফোটানোর দাগ আছে।’
বিধুবাবু পূর্বে তাহা লক্ষ্য করেন নাই, এখন তাহা দেখিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ—কিন্তু ও বিশেষ কিছু নয়। মেডালা আর মেরুদন্ডের সন্ধিস্থলটা খুঁজে পায়নি, তাই কয়েকবার ছুঁচ ফুটিয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি কি?’
‘নাকটা দেখেছেন?’
‘নাক?’
‘হ্যাঁ—নাক।’
বিধুবাবু নাক দেখিলেন। আমিও ঝুঁকিয়া দেখিলাম, নাসারন্ধ্রের চারিদিকে কয়েকটা ছোট ছোট কালো দাগ রহিয়াছে, শীতের সময় গায়ের চামড়া ফাটিয়া যেরুপ দাগ হয়, সেইরুপ।
বিধুবাবু বলিলেন, ‘বোধহয় সর্দি হয়েছিল। ঘন ঘন নাম মুছলে ওরকম দাগ হয় এ থেকে আপনি কি অনুমান করলেন? বিধুবাবুর স্বর বিদ্রুপ-তীক্ষ্ণ।
‘কিছু না—কিছু না। চলুন, এবার পাশের ঘরটা দেখা যাক। ওটা বোধহয় করালীবাবুর বসবার ঘর ছিল।’
পাশের ঘরে টেবিল, চেয়ার, টাইপ রাইটার, বইয়ের আলমারি ইত্যাদি ছিল—এই ঘরেই করালীবাবু অধিকাংশ সময় কাটাইতেন। বিধুবাবু টেবিলের দেরজা নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘এই দেরাজে উইলগুলো পাওয়া গেছে।’
ব্যেমকেশ এই ঘরটাও ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। দেরাজে অন্য কোনও কাগজপত্র ছিল না। ঘরের অপর দিকে ছোট একটি গোসলখানা—ব্যোমকেশ সেটাতে একবার উঁকি মারিয়া ফিরিয়া আসিল, বলিল, ‘এখানে কিছু দেখবার দরকার নেই। এবার চলুন সুকুমারবাবুর ঘরে—তিনি মৃতের উত্তরাধিকারী না? ভাল কথা, ছুঁচটা একবার দেখি।’
বিধুবাবু পকেট হইতে একটা খাম বাহির করিয়া দিলেন। ব্যোমকেশ তাহার ভিতর হইতে একটি ছুঁচ বাহির করিয়া দুই আঙুলে তুলিয়া ধরিল। সাধারণ ছুঁচ অপেক্ষা আকারে একটু বড় ও মোটা—অনেকটা কাঁথা সেলাইয়ের ছুঁচের মত; তাহার প্রান্ত হইতে একটু সুতা ঝুলিতেছে। ব্যোমকেশ বিস্ফারিত-নয়নে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া চাপা-স্বরে কহিল, ‘আশ্চর্য! ভারি আশ্চর্য!
‘কি?’
‘সুতো। দেখছেন, ছুঁচে সুতো পরানো রয়েছে—কালো রেশমের সুতো!’
‘তা তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ছুঁচে সুতো পরানো থাকাতে আশ্চর্যটা কি?’
ব্যোমকেশ এবার বিধুবাবুর মুখের দিকে তাকাইল, তারপর যেন একটু লজ্জিতভাবে বলিল, ‘তাও বটে, আশ্চর্য হবার কি আছে। ছুঁচে সুতো পরানো তো হয়েই থাকে, তার জন্যেই তো ছুঁচের সৃষ্টি!’ ছুঁচ খামে ভরিয়া বিধুবাবুকে ফেরত দিল, বলিল, ‘চলুন, এবার সুকুমারবাবুকে দেখা যাক।’
বারান্দার বাঁ দিকের মোড় ঘুরিয়া কোণের ঘরটা সুকুমারবাবুর। দ্বার ভেজানো ছিল, বিধুবাবু নিঃসংশয়ে দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
সুকুমার টেবিলের উপর কনুই রাখিয়া দু‘হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়াছিল, আমরা ঢুকিতেই তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘরের এক ধারে খাট, অপর ধারে টেবিল, চেয়ার ও বইয়ের আলমারি। কয়েকটা তোরঙ্গ দেয়ালের এক ধারে উপরি উপরি করিয়া রাখা আছে। সুকুমারের বয়স বোধ করি চব্বিশ-পঁচিশ হইবে; চেহারাও বেশ ভাল, ব্যায়ামপুষ্ট বলিষ্ঠগোছের দেহ। কিন্তু বাড়িতে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার ফলে মুখ শুকাইয়া, চোখ বসিয়া গিয়া চেহারা অত্যন্ত শ্রীহীন হইয়া পড়িয়াছে। আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তাহার চোখে একটা ভয়ের ছায়া পড়িল।
বিধুবাবু বলিলেন, ‘সুকুমারবাবু, ইনি—ব্যোমকেশ বক্সি—আপনার সঙ্গে কথা কইতে চান।’
সুকুমার গলা সাফ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’
ব্যোমকেশ টেবিলের সম্মুখে বসিল। একখানা বই টেবিলের উপর রাখা ছিল, তুলিয়া লইয়া দেখিল—গ্রে’র অ্যানাটমি। পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে বলিল, ‘আপনি কাল রাত বারোটার সময় কোথা থেকে ফিরেছিলেন সুকুমারবাবু?’
সুকুমার চমকিয়া উঠিল, তারপর অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘সিনেমায় গিয়েছিলুম।’
ব্যোমকেশ মুখ না তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন সিনেমায়?’
‘চিত্রা।’
বিধুবাবু একটু ধমকের সুরে বলিলেন, ‘এ আমাকে আগে বলা উচিৎ ছিল। বলেননি কেন?’
সুকুমার আমতা-আমতা করিয়া বলিল, ‘দরকারি কথা বলে মনে হয়নি, তাই বলিনি—’
বিধুবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, ‘দরকারী কি অদরকারী, সে বিচার আমরা করব। আপনি যে চিত্রায় গিয়েছিলেন, তার কোন প্রমান আছে?’
সুকুমার কিছুক্ষণ নতমুখে চিন্তা করিল, তারপর আলনায় টাঙানো পাঞ্জাবির পকেট হইতে একখন্ড রঙীন কাগজ আনিয়া দেখাইল। কাগজখানা সিনেমা টিকিটের অর্ধাংশ, বিধুবাবু সেটা ভাল করিয়া দেখিয়া নোটবুকের মধ্যে রাখিলেন।
ব্যোমকেশ বইয়ের পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে বলিল, ‘সন্ধ্যের ‘শো’ তে না গিয়ে ন’টার ‘শো’ তে গিয়েছিলেন—এর কোনও কারণ ছিল কি?’
সুকুমারের মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল, সে অনুচ্চ স্বরে বলিল, ‘না, কারণ এমন কিছু—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশি রাত্রি পর্যন্ত বাইরে থাকা করালীবাবু পছন্দ করেন না, এ কথা নিশ্চয় জানা ছিল?’
সুকুমার উত্তর দিতে পারিল না, পাংশুমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
হঠ্যাৎ তাহার মুখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘করালীবাবুর সঙ্গে আপনার শেষ দেখা কখন হয়েছিল?’
একটা ঢোক গিলিয়া সুকুমার কহিল, সন্ধ্যে পাঁচটার সময়।’
‘আপনি তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
সুকুমার জোর করিয়া নিজের কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘মেসোমশাইকে উইল সম্বন্ধে কিছু বলতে গিয়েছিলুম। তিনি মতিদাদাকে বঞ্চিত করে আমার নামে সমস্ত সম্পত্তি উইল করেছিলেন; এই নিয়ে মতিদা’র সঙ্গে দুপুরবেলা তাঁর বচসা হয়। আমি মেসোমশাইকে বলতে গিয়েছিলুম, আমি একা তাঁর সম্পত্তি চাই না, তিনি যেন সবাইকে সমান ভাগ করে দেন।’
‘তারপর?’
‘আমার কথা শুনে তিনি আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন।’
‘আপনিও বোধহয় বেরিয়ে গেলেন?’
‘হ্যাঁ । সেখান থেকে আমি ফণীর ঘরে গিয়ে বসলুম। ফণীর সঙ্গে কথা কইতে কইতে রাত হয়ে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই ভাবলুম, বায়োস্কোপ দেখে আসি; ফণীও যেতে বললে। তাই রাত্রে চুপি চুপি গিয়েছিলুম, ভেবেছিলুম মেসোমশাই জানতে পারবেন না।’
সুকুমারের কৈফিয়ত শুনিয়া বিধুবাবু সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইয়াছেন, তাহা বেশ বুঝা গেল। ব্যোমকেশের মুখ কিন্তু নির্বিকার হইয়া রহিল। বিধুবাবু বেশ একটু কঠিন স্বরে বলিলেন, ‘আপনার মনের কথা কি বলুন তো ব্যোমকেশবাবু? আপনি কি সুকুমারবাবুকে খুনী বলে সন্দেহ করেন?’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘না না, সে কি কথা—চলুন, এবার এঁর ভগিনীর ঘরটা—’
বিধুবাবু অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বলিলেন, ‘চলুন। কিন্তু অযথা একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করবার কোনো দরকার ছিল না, সে কিছু জানে না। তাকে যা জিজ্ঞেস করবার আমি জিজ্ঞাসা করে নিয়েছি।
ব্যোমকেশ কুণ্ঠিতভাবে বলিল, ‘সে তো নিশ্চয়। তবু একবার—’
বারান্দা যেখানো মোড় ফিরিয়াছে, সেই কোণের উপর মেয়েটির ঘর; বিধুবাবু গিয়া দরজায় টোকা মারিলেন। আধ মিনিট পরে সতের-আঠারো বছরের মেয়ে দরজা খুলিয়া আমাদের দেখিয়া কবাটের পাশে সরিয়া দাড়াইল। আমরা সঙ্কুচিত-পদে ঘরে প্রবেশ করিলাম। সুকুমারও আমাদের পিছনে পিছনে আসিয়াছিল, সে গিয়া ক্লান্তভাবে বিছানায় বসিয়া পড়িল।
ঘরে ঢুকিবার সময় মেয়েটিকে একবার দেখিয়া লইয়াছিলাম। তাহার গায়ের রঙ ময়লা, লম্বা রোগা গোছের চেহারা, কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ দু’টি লাল হইয়া উঠিয়াছে, মুখও ঈষৎ ফুলিয়াছে; সুতরাং সে সুশ্রী কি কুশ্রী, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। মাথার চুল রুক্ষ। এই শোকে অবসন্ন মেয়েটিকে জেরা করার নিষ্ঠুরতার জন্যে মনে মনে ব্যোমকেশের উপর রাগ হইতেছিল, কিন্তু তাহার কুণ্ঠার আড়ালে যে এক দৃঢ় সঙ্কল্পিত উদ্দেশ্য রহিয়াছে, তাহও বুঝিতে পারিতেছিলাম। ব্যোমকেশ মেয়েটিকে একট নমস্কার করিয়া বিনীতভাবে বলিল, ‘আপনাকে একটু কষ্ট দেব, কিছু মনে করবেন না। এ রকম একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা যখন বাড়িতে হয়ে যায়, তখন বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত পুলিসের ছোটখাটো উৎপাতও সহ্য করতে হয়—’
বিধুবাবু ফোঁস করিয়া উঠিলেন, ‘পুলিসের নামে বদনাম দেবেন না, আপনি পুলিস নন।’
ব্যোমকেশ সেদিকে কর্ণপাত না করিয়া বলিল, ‘বেশি নয়, দু’ একটা সাধারণ প্রশ্ন আপনাকে করব। বসুন ।’ বলিয়া ঘরের একটি মাত্র চেয়ার নির্দেশ করিল।ভ
মেয়েটি বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার ব্যোমকেশের দিকে তাকাইল। তারপর চাপা ভাঙা গরায় বলিল, ‘আপনি কি জানতে চান, বলুন। আমি দাঁড়িয়েই জবাব দিচ্ছি।’
‘বসবেন না? আচ্ছা, আমিই তাহলে বসি।’ চেয়ারে বসিয়া ব্যোমকেশ একবার ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। এ ঘরটিও সুকুমারের ঘরের মত অত্যন্ত সাদাসিধা—আসবাবের বাহুল্য নাই। খাট, চেয়ার, বইয়ের আলমারি; বাড়তির মধ্যে একটা দেরাজযুক্ত ড্রেসিং টেবিল।
কড়িকাঠের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকাইয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনিই রোজ সকালে করালীবাবুকে ডাকতেন?’
মেয়েটি নীরবে ঘাড় নাড়িল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ তাহলে চা দিতে গিয়ে আপনি প্রথম জানতে পারলেন যে তিনি মারা গেছেন?’
মেয়েটি আবার ঘাড় নাড়িল।
‘তার আগে আপনি কিছু জানতেন না?’
বিধুবাবু গলার মধ্যে গজ্গজ্ করিয়া বলিলেন, ‘বাজে প্রশ্ন, বাজে প্রশ্ন। একেবারে foolish!’
ব্যোমকেশ যেন শুনিতে পায় নাই, এমনিভাবে বলিল, ‘রাত্রিতে করালীবাবুর দরজা খোলা থাকত?’
‘হ্যাঁ। এ বাড়ির কারুর দরজা বন্ধ করে শোবার হুকুম ছিল না। মেসোমশাই নিজেও রাত্রিতে দরজা খুলে শুতেন।’
‘বটে! তাহলে—’
বিধুবাবু আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘ঢের হয়েছে, এবার উঠুন। যত সব বাজে প্রশ্ন করে বেচারীকে বিরক্ত করবার দরকার নেই। আপনি ক্রস্ একজামিন করতে জানেন না—’
এতক্ষণে ব্যোমকেশের বিনীতভাবের মুখোশ খসিয়া পড়িল। খোঁচা-খাওয়া বাঘের মত সে বিধুবাবুর দিকে ফিরিয়া তীব্র অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে কহিল, ‘যদি বার বার বিরক্ত করেন, তাহলে কমিশনার সাহেবকে জানাতে বাধ্য হবে যে, আপনি আমার অনুসন্ধানে বাধা দিচ্ছেন। আপনি জানেন, এ ধরণের কেস সাধারণ পুলিসের এলাকায় পড়ে না—এটা সি আই ডি’র কেস?’
গালে চড় খাইলেও বোধ করি বিধুবাবু এত স্তম্ভিত হইতেন না। তিনি আরক্তচক্ষুতে কটমট করিয়া কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের পানে তাকাইয়া রহিলেন। তারপার একটা অর্ধোচ্চারিত কথা গিলিয়া ফেলিয়া গট্গট্ করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
ব্যোমকেশ মেয়েটির দিকে ফিরিয়া আবার আরম্ভ করিল, ‘আপনি করালীবাবুর মৃত্যুর কথা জানতেন না? ভেবে দেখুন।’
‘ভেবে দেখেছি, জানতুম না।’ মেয়েটির গলার আওয়াজে একটু জিদের আভাস পাওয়া গেল। ব্যোমকেশ কিছুক্ষাণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া চুপ করিয়া রহিল। তারপর বলিল, ‘যাক। এখন আর একটা কথা বলুন তো, করালীবাবু চায়ে ক’ চামচ চিনি খেতেন?’
মেয়েটি এবার অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল, শেষে বলিল, ‘চিনি? মেসোমশাই চায়ে চিনি একটু বেশি খেতেন, তিন-চার চামচ দিতে হত—’
বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন হইল, ‘তবে আজ চায়ে আপনি চিনি দেননি কেন?’
মেয়েটির মুখ একেবারে ছাইয়ের মত হইয়া গেল, ত্রাস-বিস্ফারিত নয়নে সে একবার চারিদিকে চাহিল। তারপর অধর দংশন করিয়া অতিকষ্টে নিজেকে সম্বরণ করিয়া বলিল, ‘বোধহয় মনে ছিল না, কাল থেকে আমার শরীরটা ভাল নেই—’
‘কাল কলেজে গিয়েছিলেন?’
অস্পষ্ট অথচ বিদ্রোহপূর্ণ উত্তর হইল, ‘হ্যাঁ।’
অলসভাবে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সব কথা খুলে বললে আমাদের অনেক সুবিধা হয়, আপনাদেরও হয়তো সুবিধা হতে পারে।’
মেয়েটি ঠোট টিপিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, উত্তর দিল না।
ব্যোমকেশ আবার বলিল, ‘সব কথা বলবেন কি?’
মেয়েটি আস্তে আস্তে কাটিয়া কাটিয়া বলিল, ‘আমি আর কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিল। এতক্ষণ সে টেবিলের উপর রক্ষিত একটা সেলাইয়ের বাক্সের দিকে চাহিয়া কথা কহিতেছিল, এবার টেবিলের নিকট গিয়া দাঁড়াইল। বাক্সটা নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘এটা আপনার বোধ হয়?’
‘হ্যাঁ।’
বাক্সটা ব্যোমকেশ খুলিল। বাক্সর মধ্যে একটা অসমাপ্ত টেবিল-ক্লথ ও নানা রঙের রেশমী সুতা তাল পাকানো ছিল। সুতার তালটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ নিজমনেই বলিতে লাগিল, ‘লাল, বেগুনী, নীল, কালো—হুঁ—কালো—’ সুতা রাখিয়া দিয়া বাক্সর মধ্যে কি খুঁজিল, পাট-করা টেবিল-ক্লথটা খুলিয়া দেখিল; তারপর মেয়েটির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘ছুঁচ কই?’
মেয়েটি একেবারে কাঠ হইয়া গিয়াছিল, তাহার মুখ দিয়া কেবল বাহির হইল—‘ছুঁচ?’
ব্যোমকেশ বলিল—‘হ্যাঁ—ছুঁচ। ছুঁচ দিয়েই সেলাই করেন নিশ্চয়। সে ছুঁচ কোথায়?’
মেয়েটি কি বলিতে গেল, কিন্তু কিছু বলিতে পারিল না; হঠাৎ ফিরিয়া ‘দাদা’ বলিয়া ছুটিয়া গিয়া সুকুমার যেখানে বসিয়াছিল, সেইখানে তাহার কোলের উপর মাথা রাখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। চাপা কান্নার আবেগে তাহার সমস্ত দেহ কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল।
সুকুমার বিহ্বলের মত তাহার মুখটা তুলিবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিতে লাগিল, ‘সত্য—সত্য—?’
সত্যবতী মুখ তুলিল না, কাঁদিতেই লাগিল। ব্যোমকেশ তাহাদের নিকটে গিয়ে খুব নরম সুরে বলিল, ‘ভাল করলেন না, আমাকে বললে পারতেন। আমি পুলিস নই—শুনেছেন তো। বললে হয়তো আপনাদের সুবিধা হত—চল অজিত।’
ঘর হইতে বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ সন্তর্পণে দ্বার ভেজাইয়া দিল; কিছুক্ষণ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া হঠাৎ মুখ তুলিয়া বলিল, ‘এবার?—হ্যাঁ—ফণীবাবু। চল, বোধহয় ওদিকের ঘরটা তাঁর।’
করালীবাবুর ঘর পার হইয়া বারান্দার অপর প্রান্তের মোড় ঘুরিয়া পাশেই একটা দরজা পড়ে, ব্যোমকেশ তাহাতে টোকা মারিল।
একটি কুড়ি-বাইশ বছর বয়সের ছোকরা দরজা খুলিয়া দিল। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনিই ফণীবাবু?’
সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—আসুন।’
ফণীর চেহারা দেখিয়াই মনে হয়, তাহার শরীরে কোথাও একটা অসঙ্গতি আছে; কিন্তু সহসা ধরা যায় না। তাহার দেহ বেশ পুষ্ট, কিন্তু মুখখানা হাড় বাহির করা; বহুদিনের নিরুদ্ধ বেদনা যেন অল্পবয়সেই তাহার মুখখানাকে রেখা-চিহ্নিত করিয়া দিয়াছে। আমরা ঘরে প্রবেশ করিতেই সে আগে আগে গিয়া একটা চেয়ার নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’ তখন তাহার হাঁটার ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিলাম, শারীরিক অসঙ্গতিটা কোনখানে। তাহার বাঁ পা’টা অস্বাভাবিক সরু—চলিত কথায় যাহাকে ‘ছিনে-পড়া’ বলে, তাই। ফলে, হাঁটিবার সময় সে বেশ একটু খোঁড়াইয়া চলে।
আমি বিছানার এক পাশে বসিলাম, ফণী আমার পাশে বসিল। ব্যোমকেশ প্রথমটা যেন কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না, শেষে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘এই ব্যাপারে পুলিস আপনার দাদা মতিলালবাবুকে সন্দেহ করে, আপনি জানেন বোধ হয়?’
ফণী বলিল, ‘জানি; কিন্তু আমিও জোর করে বলতে পারি যে, দাদা নির্দোষ। দাদা ভয়ানক রাগী আর ঝগড়াটে—কিন্তু সে মামাকে খুন করবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিষয় থেকে বঞ্চিত হবার রাগে তিনি এ কাজ করতে পারেন না কি?’
ফণী বলিল, ‘সে অজুহাত শুধু দাদার নয়, আমাদের তিন ভায়েরই আছে। তবে শুধু দাদাকেই সন্দেহ করবেন কেন?’
ব্যোমকেশ প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া বলিল, ‘আপনি যা জানেন, সব কথাই বোধহয় পুলিসকে বলেছেন, তবে দু’ একটা কথা জানতে চাই—’
ফণী একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘আপনি কি পুলিসের লোক নন? আমি ভেবেছিলুম, আপনারা সি আই ডি—’
ব্যোমকেশ সাহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, আমি একজন সামান্য সত্যাম্বেষী মাত্র—’
বিস্ফারিত চক্ষে ফণী বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু? আপনি সত্যাম্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী?’
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল, ‘এখন বলুন তো, করালীবাবুর সঙ্গে বাড়ির আর সকলের সম্বন্ধটা কি রকম ছিল? অর্থাৎ তিনি কাকে বেশি ভালবাসতেন, কাকে অপছন্দ করতেন—এই সব।’
ফণী কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া চুপ করিয়া রহিল, তারপর একটু ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘দেখুন, আমি খোঁড়া মানুষ—ভগবান আমাকে মেরেছেন—তাই আমি ছেলেবেলা থেকে কারুর সঙ্গে ভাল করে মিশতে পারি না। এই ঘর আর এই বইগুলো আমার জীবনের সঙ্গী (বিছানার পাশে একটা বইয়ের শেলফ দেখাইল)—মামা যে আমাদের পাঁচজনের মধ্যে কাকে বেশি ভালবাসতেন, তা নির্ভুলভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বড় তিরিক্ষি মেজাজের লোক ছিলেন, তাঁর মনের ভাব মুখের কথায় প্রকাশ পেত না। তবে আঁচ-আন্দাজে যতদূর বোঝা যায়, সত্যবতীকেই মনে মনে ভালবাসতেন।’
‘আর আপনাকে?’
‘আমাকে—আমি খোঁড়া অকর্মণ্য বলে হয়তো ভেতরে ভেতরে একটু দয়া করতেন—কিন্তু তার বেশি কিছু—। আমি মৃতের অমর্যাদা করছি না, বিশেষত তিনি আমাদের অন্নদাতা, তিনি না আশ্রয় দিলে আমি না খেতে পেয়ে মরে যেতুম, কিন্তু মামার শরীরে প্রকৃত ভালবাসা বোধহয় ছিল না—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তিনি সুকুমারবাবুকে সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, জানেন বোধহয়?’
ফণী একটু হাসিল—’শুনেছি। সুকুমারদা সব দিক থেকেই যোগ্য লোক, কিন্তু ও-থেকে মামার মনের ভাব কিছু বোঝা যায় না। তিনি আশ্চার্য খেয়ালী লোক ছিলেন; যখনই কারুর ওপর রাগ হত, তখনই টপাটপ টাইপ করে উইল বদলে ফেলতেন। বোধহয়, এ বাড়িতে এমন কেউ নেই—যার নামে একবার মামা উইল তৈরি না করেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শেষ উইল যখন সুকুমারবাবুর নামে, তখন তিনিই সম্পত্তি পাবেন।’
ফণী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আইনে কি তাই বলে? আমি ঠিক জানি না।’
‘আইনে তাই বলে।’ ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ অবস্থায় আপনি কি করবেন, কিছু ঠিক করেছেন কি?’
ফণী চুলের মধ্যে একবার আঙুল চালাইয়া জানালার বাহিরে তাকাইয়া বলিল, ‘কি করব, কোথায় যাব, কিছুই জানি না। লেখাপড় শিখিনি, উপার্জন করবার যোগ্যতা নেই। সুকুমারদা যদি আশ্রয় দেয়, তবে তার আশ্রয়েই থাকব—না হয়, রাস্তার গিয়ে দাঁড়াতে হবে।’ তাহার চোখের কোলে জল আসিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া আমি তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইলাম।
ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘সুকুমারবাবু কাল রাত্রি বারোটার সময় বাড়ি ফিরেছেন।’
ফণী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল—‘রাত্রি বারোটার সময়! ওঃ—হ্যাঁ, তিনি বায়স্কোপে গিয়েছিলেন!’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘করালীবাবুকে ক’টার সময় খুন করা হয়েছে, আপনি আন্দাজ করতে পারেন? কোন রকম শব্দ-টব্দ শুনেছিলেন কি?’
‘কিছু না। হয়তো শেষ রাত্রে—’
‘উহুঁ—তিনি রাত্রি বারোটায় খুন হয়েছেন।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘উঃ, আড়াইটে বেজে গিয়েছে—আর না, চল হে অজিত। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে—আপনাদেরও তো এখনও খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি—নমস্কর।’
এমন সময় নীচে একটা গণ্ডগোল শোনা গেল; পরক্ষণেই আমাদের ঘরের দরজা সজোরে ঠেলিয়া একজন লোক উত্তেজিতভাবে বলিতে বলিতে ঢুকিল, ‘ফণী, দাদাকে অ্যারেস্ট করে এনেছে—’ আমাদের দেখিয়াই সে থামিয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই মাখনবাবু?’
মাখন ভয়ে কুঁচকাইয়া গিয়া ‘আমি—আমি কিছু জানি না।’ বলিয়া সবেগে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।
নীচে নামিয়া দেখিলাম, বসিবার ঘরে হুলস্থুল কাণ্ড। বিধুবাবু ঘরে নাই, থানার ইনস্পেক্টর তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছেন। একটা পাগলের মত চেহারার হাতকড়া-পরা লোককে দু’জন কনস্টেবল ধরিয়া আছে আর সে হাউমাউ করিয়া বলিতেছে, ‘মামা খুন হয়েছেন? দোহাই মশাই, আমি কিছু জানি না—যে দিব্যি গালতে বলেন গালছি—আমি মাতাল দাঁতাল লোক—ডালিমের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি—ডালিম সাক্ষী আছে—’
ইনস্পেক্টরবাবুটি সত্য সত্যই কাজের লোক,এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে বসিয়াছিলেন, আমাদের দেখিয়া বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু, ইনিই মতিলাল—বিধুবাবুর আসামী। যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান, করতে পারেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কোথায় একে গেপ্তার করা হল?’
যে সাব-ইনস্পেক্টরটি গ্রেপ্তার করিয়াছিল, সে বলিল, ‘হাড়কাটা গলির এক স্ত্রীলোকের বাড়িতে—’
মতিলাল আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘ডালিমের বাড়িতে ঘুমুচ্ছিলুম—কোন্ শালা মিছে কথা বলে—’
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া তাহাকে নিবারণ করিয়া বলিল, ‘আপনি তো ভোর না হতেই বাড়ি ফিরে আসেন, আজ ফেরেননি কেন?’
পাগলের মত আরক্ত চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া মতিলাল বলিল, ‘কেন? আমি—আমি মদ খেয়েছিলুম—দু’বোতল হুইস্কি টেনেছিলুম—ঘুম ভাঙেনি—’
ব্যোমকেশ ইনস্পেক্টবাবুর দিকে চাহিয়া ঘাড় নাড়িল, তিনি বলিলেন,, ‘নিয়ে যাও—হাজতে রাখো—’
মতিলাল চীৎকার করিতে করিতে স্থানান্তরিত হইলে, ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিধুবাবু কোথায়?’
‘তিনি মিনিট পনের হল বাড়ি গেছেন—আবার চারটের সময় আসবেন।’
‘আচ্ছা, তাহলে আমরাও উঠি, কাল সকাল আবার আসব। ভাল কথা, বাড়ির ঘরগুলো সব খানাতল্লাস হয়েছে?’
‘করালীবাবুর আর মতিলালের ঘর খানাতল্লাস হয়েছে, অন্য ঘরগুলো খানাতল্লাস করা বিধুবাবুর দরকার মনে করেননি।’
‘মতিলালের ঘর থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’
‘কিছু না।’
‘উইলগুলো দেখা হল না, সেগুলো বোধহয় বিধুবাবু সীল করে রেখে গেছেন। থাক, কাল দেখলেই হবে। আচ্ছা,চললুম। ইতিমধ্যে যদি নতুন কিছু জানতে পারেন, খবর দেবেন।’
বাসায় ফিরিলাম। রাত্রে করালীবাবুর বাড়ির একটা নক্সা তৈয়ার করিয়া ব্যোমকেশ আমাকে দেখাইল, বলিল, ‘করালীবাবুর ঘরের নীচে মতিলালের ঘর; মাখনের ঘর তার পাশে। ফণীর ঘরের নীচে বৈঠকখানাঘর অর্থাৎ যেখানে পুলিস আড্ডা গেড়েছে। সত্যবতীর ঘরের নীচে রান্নাঘর, আর সুকুমারের ঘরের নীচের ঘরে চাকর বামুন শোয়।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ প্ল্যান্ কি হবে?’
‘কিছু না।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নক্সাটা মনোনিবেশ সহকারে দেখিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার কি রকম মনে হচ্ছে? মতিলাল বোধহয় খুন করেনি—না?’
‘না—সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’
‘তবে কি?’
‘সেইটে বলাই শক্ত, মতিলালকে বাদ দিলে চারজন বাকী থেকে যায়—ফণী,মাখন,সুকুমার আর সত্যবতী। এদের মধ্যে যে কেউ খুন করতে পারে। সকলের স্বার্থ প্রায় সমান।’
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘সত্যবতীও?’
‘নয় কেন?’
‘কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে—’
‘মেয়েমানুষ যাকে ভালবাসে, তার জন্যে করতে পারে না, এমন কাজ নেই।’
‘কিন্তু তার স্বার্থ কি? করালীবাবুর শেষ উইলে তার ভাই-ই তো সব পেয়েছে।’
‘বুঝলে না? যে লোক ঘণ্টায় ঘণ্টায় মত বদলায়, তাকে খুন করলে আর তার মত বদলাবার অবকাশ থাকে না।’
স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। এদিক হইতে কথাটা ভাবিয়া দেখি নাই। বলিলাম, ‘তবে কি তোমার মনে হয়—সত্যবতীই—?’
‘আমি তা বলিনি। সুকুমার হতে পারে, সম্পূর্ণ বাইরের লোকও হতে পারে। কিন্তু সত্যবতী মেয়েটি সাধারণ মেয়ে নয়।’
খানিক্ষন চুজ করিয়া ভাবিতে লাগিলাম। গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত প্রকার খাপছাড়া ও পরস্পর-বিরোধী মালমশলা আমাদের হস্তগত হইয়াছিল যে, তাহার ভিতর হইতে সুসংলগ্ন একটা কিছু বাহির করা প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। ব্যাপারটা এতই জটিল যে, ভাবিতে গেলে আরও জট পাকাইয়া যায়।
শেষে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মৃতদেহ দেখে তুমি কি বুঝলে?’
‘এই বুঝলাম যে,হত্যা করবার আগে হত্যাকারী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করেছিল।’
‘কি করে বুঝলে?’
‘তাঁর ঘাড়ে হত্যাকারী তিনবার ছুঁচ ফুটিয়েছিল। ক্লোরোর্ফম না করলে তিনি জেগে উঠতেন। তাঁর নাকে ছোট দাগ দেখেছিলে মনে আছে? সেগুলো ক্লোরোর্ফমের চিহ্ন।’
‘তিনবার ছুঁচ ফোটাবার মানে?’
‘মানে, প্রথম দু’বার মর্মস্থানটা খুঁজে পায়নি। কিন্তু সেটা তেমন জরুরী কথা নয়; জরুরী কথা হচ্ছে এই যে, ছুঁচটা বিঁধিয়ে রেখে গেল কেন? কাজ হয়ে গেলে বার করে নিয়ে চলে গেলেই তো আর কোনও প্রমাণ থাকত না।’
‘হয়তো তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর একটা কথা—রাত বারোটার সময় খু্ন হয়েছে, তুমি বুঝলে কি করে?’
‘ওটা আমার অনুমান। কিন্তু সত্যবতী যদি কখনও সত্যি কথা বলে,দেখবে, আমার অনুমানটা ঠিক। ডাক্তারের রিপোর্ট থেকেও জানা যাবে।’
কিছুক্ষণ উর্ধ্বমুখে বসিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুকুমারের টেবিলের ওপর একখানা বই রাখা ছিল—গ্রে’র অ্যানাটমি। সারা বইয়ের মধ্যে কেবল একটা পাতায় কয়েক লাইন লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দেওয়া ছিল।’
‘সে কয় লাইনের অর্থ?’
‘অর্থ—মেডালা এবং প্রথম কশেরুর যদি ছুঁচ বিঁধিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে।
আমি লাফাইয়া উঠিলাম—‘বল কি! তাহলে?’
‘কিন্তু আশ্চার্য! লাল পেন্সিলটা সুকুমারের টেবিলে দেখলুম না।’ বলিয়া হঠাৎ উঠিয়া গভীর চিন্তাক্রান্তমুখে ঘরময় পায়চারি করতি লাগিল। আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন গজগজ করিতেছিল,কিন্তু ব্যোমকেশের চিন্তাসূত্র ছিন্ন করিতে ভরসা হইলা না। জানিতাম, এই সময় প্রশ্ন করিলেই সে খেঁকী হইয়া উঠে।
রাত্রে শয়ন করিয়া সে একটা প্রশ্ন করিল, ‘তুমি তো একজন সাহিত্যিক, বল দেখি thimble-এর বাঙরা কি?’
আমি আশ্চার্য হইয়া বলিলাম, ‘thimble? যা আঙুলে পরে দর্জিরা সেলাই করে?’
‘হ্যাঁ।’
আমি ভাবিতে ভাবিতে বলিলাম, ‘অঙ্গুলিত্রাণ হতে পারে—কিম্বা—সূচীবর্ম—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওসব চালাকি চলবে না, খাঁটি বাঙালা প্রতিশব্দ বল।’
স্বীকার করিতে হইল, বাঙালা প্রতিশব্দ নাই, অন্তত আমার জানা নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি জানো?’
‘উঁহু। জানলে আর জিজ্ঞাসা করব কেন?’
ব্যোমকেশ আর কথা কহিল না। আমিও বাঙলা ভাষার অশেষ দৈন্যের কথা চিন্তা করিতে করিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম।
পরদিন সকালে উঠিয়া দেখি, ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গিয়াছে। একটু রাগ হইল; কিন্তু বুঝিলাম, আমাকে না লইয়া যাওয়ার কোনও মতলব আছে—হয়তো আমি গেলে অসুবিধা হইত।
যখন ফিরিল, তখন বেলা প্রায় এগারোটা; জামা খুলিয়া পাখাটা চালাইয়া দিয়া সিগারেট ধরাইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হল?’
সে একপেট ধোঁয়া টানিয়া আস্তে আস্তে ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল, ‘উইলগুলো দেখা গেল। উইলের সাক্ষী বাড়ির বামুন আর চাকর—তাদের টিপসই রয়েছে।
‘আর?’
‘বাড়ির অন্য ঘরগুলো ভাল করে খানাতল্লাস করতে বললুম। কিন্তু বিধুবাবু গোঁ ধরেছেন, আমি যা বলব, তার উল্টো কাজটি করবেন। শেষ পর্যন্ত ভয় দেখিয়ে এলুম, যদি খানাতল্লাস না করেন, কমিশনার সাহেবকে নালিশ করব।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি! তিনি এখনও মতিলালকে কামড়ে পড়ে আছেন।’ কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘মেয়েটা ভয়ানক শক্ত, এমন মুখ টিপে রইল, কিছুতেই মুখ খুললে না! অথচ এ রহস্যের চাবিকাঠি তার কাছে। যা হোক, দেখা যাক, বিধুবাবু যদি শেষ পর্যন্ত খানাতল্লাস করা মনস্থ করেন হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’
‘কি পাওয়া যাবে, প্রত্যাশা কর?’
‘কে বলতে পারে? সামান্য জিনিস, হয়তো একটা ডাক্তারি দোকানের ক্যাশমেমো কিম্বা একটা পেন্সিল, কিম্বা—কিন্তু বৃথা গবেষণা করে লাভ নেই। চল, নাইবার বেলা হল।’
দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় চোখ বুজিয়া শুইয়া কাটাইয়া দিল; মনে হইল, সে যেন প্রতীক্ষা করিতেছে। তিনটা বাজিতেই পুঁটিরামচা দিয়া গেল, নিঃশব্দে পান করিয়া ব্যোমকেশ পূর্ববৎ পড়িয়া রহিল।
সাড়ে চারটা বাজিবার পর পাশের ঘরে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ দ্রুত উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল, ‘কে আপনি?… ও ইনস্পেক্টরবাবু, কি খবর? …সুকুমারবাবুর ঘর সার্চ হয়েছে! বেশ বেশ, বিধুবাবু তাহলে শেষ পর্যন্ত…তাঁর ঘরে কি পাওয়া গেল?…অ্যাঁ, সুকুমারবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তারপর—কিছু পাওয়া গেল? ক্লোরোফর্মের শিশি—আলমারিতে বইয়ের পেছনে ছিল—আর? উইল! আর একখানা টাইপ—করা উইল? বলেন কি? কোন্ তারিখের?…যে রাত্রে করালীবাবু মারা যান, সেইদিন তৈরি—হুঁ। কোথায় ছিল? বাকা্র তলায়! এ উইলে ওয়ারিস কে?…ফণীবাবু!
‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, পর্যায়ক্রমে এবার তারই পালা ছিল বটে। …সুকুমারবাবুর বোনকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? …না…ও বুঝেছি…ঘরে আর কিছু পাওয়া যায়নি? এই ধরুন—একটা লাল পেণ্সিল? পাননি? আশ্চার্য! সেলাইয়ের কোনও উপকরণ পাননি? তাই তো! বিধুবাবু আছেন?… মতিলালকে খালাস করতে গেছেন…তবু ভাল, বিধুবাবুর সুমতি হয়েছে। সুকুমারবাবুর ঘর ছাড়া আর কোন্ কোন্ ঘর সার্চ হয়েছে? আর হয়নি! কি বললেন, বিধুবাবু দরকার মনে করেননি! বিধুবাবু তো কিছুই দরকার মনে করেন না। আমার আজ যাবার দরকার আছে কি? নুতন উইলখানা দেখতুম…ও নিয়ে গেছেন…আচ্ছা—কাল সকালেই হবে। লাল পেণ্সিল আর ঐ সেলাইয়ের উপকরণটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে—ততক্ষণ—কি বলছেন? সুকুমারের বিরুদ্ধে overwhelming প্রমাণ পাওয়া গেছে? তা বলতে পারেন—কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া গেছে? মৃত্যুর সময় সণ্বন্ধে কি লিখেছেন? আহারের তিন ঘন্টা পরে…তার মানে আন্দাজ রাত বারোটা…আচ্ছা,কাল সকালে নিশ্চয় যাব।’
ফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। তাহার চিন্তা-কুঞ্চিত ভ্রু ও মূখ দেখিয়া মনে হইল, সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সুকুমারই তাহলে? তুমি তো গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলে—না?’
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ ব্যাপারে যত কিছু প্রমাণ, সবই সুকুমারের দিকে নির্দেশ করছে। দেখ, করালীবাবুর মৃত্যুর ধরনটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এ ডাক্তারের কাজ। যারা ডাক্তারি কিছু জানে না, তারা ওভাবে খুন করতে পারে না। যে ছুঁচটা ব্যবহার করা হয়েছে, তাও তার বোনের সেলায়ের বাক্স থেকে চুরি করা, এমন কি, সুতোটা পর্যন্ত এক। সুকুমার বারোটার সময় বাড়ি ফিরল—ঠিক সেই সময় করালীবাবুও মারা গেলেন। সুকুমারের ঘর সার্চ করে বেরিয়েছে ক্লোরোফর্মের শিশি, আর একটা টাইপ-করা উইল—করালীবাবুর শেষ উইল, যাতে তিনি সুকুমারকে বঞ্চিত করে ফণীকে সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। সুকুমার নিজের মুখেই স্বীকার করেছে যে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা করালীবাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল—সুতরাং তিনি যে আবার উইল বদলাবেন, তা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল। খুন করার মোটিভ্ পর্যন্ত পরিষ্কার পাওয়া যাচ্ছে।’
‘তাহলে সুকুমারই যে আসামী, তাতে আর সন্দেহ নেই?’
‘সন্দেহের অবকাশ কোথায়?’ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, সুকুমারকে দেখে তোমার কি রকম মনে হল? খুব নির্বোধ বলে মনে হল কি?’
আমি বলিলাম,‘না। বরঞ্চ বেশ বুদ্ধি আছে বলেই মনে হল।’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘সেইখানেই ধোঁকা লাগছে। বুদ্ধিমান বোকার মত কাজ করে কেন?’
বলিয়াই ব্যোমকেশ সচকিতভাবে সোজা হইয়া বসিল। দ্বারের কাছে অস্পষ্ট পদধ্বনি আমিও শুনিতে পাইয়াছিলাম, ব্যোমকেশ গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘কে? ভিতরে আসুন।’
কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর আস্তে আস্তে দ্বার খুলিয়া গেল। তখন ঘোর বিস্ময়ে দেখিলাম, সস্মুখে দাড়াঁইয়া আছে—সত্যবতী!
সত্যবতী ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিল; কিছুকাল শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে বাঁচান।’
অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আমি একেবারে ভ্যাবাচাকা খাইয়া গিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু তড়াক করিয়া সত্যবতীর সম্মুখে দাঁড়াইল। সত্যবতীর মাথাটা ঘুরিয়া গিয়াছিল, সে অন্ধভাবে একটা হাত বাড়াইয়া দিতেই ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া তাহাকে একখানা চেয়ারে আনিয়া বসইয়া দিল। আমাকে ইঙ্গিত করিতেই পাখাটা চালাইয়া দিলাম।
প্রথম মিনিট দুই-তিন সত্যবতী চোখে আঁচল দিয়া খুব খানিকটা কাঁদিল, আমার নির্বাক লজ্জিত মুখে অন্য দিকে চোখ ফিরাইয়া রহিলাম। আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনেও এমন ব্যাপার পূর্বে কখনও ঘটে নাই।
সত্যবতীকে পূর্বে আমি একবারই দেখিয়াছিলাম; সাধারণ শিক্ষত বাঙ্গালী মেয়ে হইতে সে যে আকারে-প্রকারে একটুও পৃথক, তাহা মনে হয় নাই। সুতরাং ঘোর বিপদের সময় সমস্ত শঙ্কাসঙ্কোচ লঙ্ঘন করিয়া সে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হইতে পারে, ইহা যেমন অচিন্তনীয়, তেমনই বিস্ময়কর। বিপদ উপস্থিত হইলে অধিকাংশ বাঙালীর মেয়েই জড়বস্তু হইয়া পড়ে। তাই এই কৃশাঙ্গী কালো মেয়েটি আমার চক্ষে যেন সহসা একটা অপূর্ব অসামান্যতা লইয়া দেখা দিল। তাহার পায়ের মলিন জরির নাগরা হইতে রুক্ষ অযত্নসম্বৃত চুল পর্যন্ত যেন অনন্যসাধারণ বিশিষ্টতার ভরপুর হইয়া উঠিল।
ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া সে যখন মুখ তুলিয়া আবার বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে আপনি বাঁচান,’ তখন দেখিলাম, সে প্রাণপণে আত্মসম্বরণ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার গলার স্বর তখনও কাঁপিতেছে।
ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল,‘আপনার দাদা অ্যারেস্ট হয়েছেন, আমি শুনেছি—কিন্তু—’
সত্যবতী ব্যাকুলভাবে বলিয়া উঠিল, ‘দাদা নির্দোষ, তিনি কিছু জানেন না—বিনা অপরাধে তাঁকে—’ বলিতে বলিতে আবার সে কাঁদিয়া ফেলিল।
ব্যোমকেশ ভিতরে ভিতরে বিচলিত হইয়াছে বুঝিলাম, কিন্তু সে শান্তভাবেই বলিল, ‘কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে—’
সত্যবতী বলিল, ‘সে সব মিথ্যে প্রমাণ। দাদা কখনও টাকার লোভে কাউকে খুন করতে পারেন না। আপনি জানেন না—তাঁর মতন লোক; ব্যোমকেশবাবু, আমার মেসোমশায়ের টাকা চাই না, আপনি শুধু দাদাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, আমার আপনার পায়ে কেনা হয়ে থাকব।’ তাহার দুই চোখ দিয়া ধারার মত অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু সে আর তাহা মুছিবার চেষ্টা করিল না—বোধ করি, জানিতেই পারিল না। ব্যোমকেশ এবার যখন কথা কহিল, তখন তাহার কণ্ঠস্বরে একটা অশ্রুতপূর্ব গাঢ়তা লক্ষ্য করিলাম, সে বলিল, ‘আপানার দাদা যদি সত্যই নির্দোষ হন, আমি প্রাণপণে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করব—কিন্তু—’
‘দাদা নির্দোষ, আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না—একটা মাছিকে মারাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়—’ বলিতে বলিতে সে হঠাৎ নতজানু হইয়া ব্যোমকেশের পায়ের উপর হাত রাখিল।
‘ও কি করছেন? উঠে বসুন—উঠে বসুন?’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজেই চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পা সরাইয়া লইল।
‘আপনি আগে বলুন, দাদাকে ছেড়ে দেবেন?’
ব্যোমকেশ দুই হাত ধরিয়া সত্যবতীকে জোর করিয়া তুলিয়া চেয়ারে বসাইয়া দিল, তারপর তাহার সম্মুখে বসিয়া দৃঢ় স্বরে বলিল,‘আপনি ভুল করছেন—সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার মালিক আমি নই—পুলিস। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্ত চেষ্টা করতে হলে সব কথা আমার জানা দরকার। বুঝেছেন না, আমার কাছ থেকে যতক্ষণ আপনি কথা গোপন করবেন, ততক্ষণ কোন সাহায্যই আমি করতে পারব না।’
চক্ষু নত করিয়া সত্যবতী বলিল, ‘আমি তো কোনও কথা গোপন করিনি।’
‘করছেন। আপনি সেই রাত্রেই করালীবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে বলেননি।’
ত্রাস-বিস্ফারিত নেত্রে সত্যবতী ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইল, তারপর বুকে মুখ গুঁজিয়া নীরব হইয়া রহিল।
ব্যোমকেশ নরম সুরে বলিল, ‘এখন সব কথা বলবেন কি?’
কাতর চোখ দুটি তুলিয়া সত্যবতী বলিল, ‘কিন্তু সে কথা আমি কি করে বলব? তাতে দাদার ওপরেই সব দোষ গিয়ে পড়বে।’
অনুনয়ের কণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন,আপনার দাদা যদি নির্দোষ হন, তাহলে সত্যি কথা বললে তাঁর কোনও অনিষ্ট হবে না, আপনি নির্ভয়ে সমস্ত খুলে বলুন, কোনো কথা গোপন করবেন না।’
সত্যবতী অনেকক্ষণ মুখ নীচু করিয়া ভাবিল, শেষে ভগ্ন স্বরে বলিল,‘আচ্ছা, বলছি। আমার যে আর উপায় নেই—’উদগত অশ্রু আঁচল দিয়া মুছিয়া নিজেকে ঈষৎ শান্ত করিয়া সে ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—
‘সেদিন সন্ধ্যেবেলা মেসোমশায়ের সঙ্গে দাদার একটু বচসা হয়েছিল। মেসোমশাই দাদাকে সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন, তাই নিয়ে মতিদা’র সঙ্গে দুপুরবেলা তুমুল ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। কলেজ থেকে ফিরে তাই শুনে দাদা মেসোমশাইকে বলতে গিয়েছিলেন যে, তিনি সব সম্পত্তি চান না, সম্পত্তি যেন সকলকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। মেসোমশাই কোনও রকম তর্ক সইতে পারতেন না, তিনি রেগে উঠে বললেন, ‘আমার কথার ওপর কথা! বেরোও এখান থেকে—তোমাকে এক পয়সা দেব না।’
‘মেসোমশাই যে এ কথায় রাগ করবেন, তা দাদা বুঝতে পারেননি; তিনি সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ফণীদা’র ঘরে গিয়ে বসলেন। ফণীদা খোঁড়া মানুষ, বাইরে বেরুতে পারেন না—তাই দাদা রোজ সন্ধ্যেবেলা তাঁর কাছে বসে খানিকক্ষণ গল্প করতেন। ফণীদা’কে আপনারা বোধহয় দেখেছেন? তিনি ইস্কুল-কলেজে পড়েননি বটে, কিন্তু বেশ ভাল লেখাপড়া জানেন।
তাঁর আলমারির বই দেখে বুঝতে পারবেন—কত রকম বিষয়ে তাঁর দখল আছে। অনেক সময় আমি তাঁর কাছে পড়া বলে নিয়েছি।
‘মেসোমশায়ের সঙ্গে বচসা হওয়াতে দাদার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল,তিনি রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় আমাকে বললেন, ‘সত্য, আমি বায়স্কোপ দেখতে যাচ্ছি, সাড়ে এগারটার সময় ফিরব—সদর দরজা খুলে রাখিস।’ এই বলে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন।
‘আমাদের বামুনঠাকুর রাত্রির খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর বাইরে গিয়ে অনেক রাত্রি পর্যন্ত নিজের দেশের লোকের আড্ডায় গল্পগুজব করে, আমি জানতুম—তাই দাদাকে দোর খুলে দেবার জন্যে আমি আর জেগে রইলুম না। রাত্রি দশটার পর হাঁড়ি-হেঁসেল উঠে গেলে আমিও গিয়ে শুয়ে পড়লুম।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল, যেন দাদার ঘরে একটা শব্দ শুনতে পেলুম। মেঝের ওপর একটা ভারী জিনিস—টেবিল কি বাক্স সরালে যে রকম শব্দ হয়, সেই রকম শব্দ। ভাবলুম দাদা বায়স্কোপ দেখে ফিরে এলেন।
‘আবার ঘুমবার চেষ্টা করলুম; কিন্তু কি জানি ঘুম এল না—চোখ চেয়ই শুয়ে রইলুম। দাদার ঘরে থেকে আর কোনও সাড়া পেলুম না; মনে করলুম তিনি শুয়ে পড়েছেন।
‘এইভাবে মিনিট পনের কেটে যাবার পর—বারান্দায় একটা খুব মৃদু শব্দ শুনতে পেলুম, যেন কে পা টিপে টিপে যাচ্ছে। ভারী আশ্চার্য মনে হল; দাদা তো অনেকক্ষণ শুয়ে পড়েছেন, তবে কে বারান্দায় দিয়ে যাচ্ছে? আমি আস্তে আস্তে উঠলুম; দরজা একটু ফাঁক করে দেখলুম—দাদা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চাঁদের আলো বারান্দায় পড়েছিল, দাদাকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা কথা; আপনার দাদার পায়ে জুতা ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাঁর হাতে কিছু ছিল?’
‘না।’
‘কিছু না? একটা কাগজ কিম্বা শিশি?’
‘কিছু না।’
‘তখন ক’টা বেজেছিল; দেখেছিলেন কি?’
সত্যবতী বলিল, ‘দেখবার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’
ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’
সত্যবতী বলিল, ‘দেখার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’
ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’
সত্যবতী বলিতে লাগিল,‘প্রথমটা আমি কিছু বুঝতে পারলুম না। দাদা পনের মিনিট আগে ফিরে এসেছেন—তাঁর ঘরে আওয়াজ শুনে জানতে পেরেছি—তবে আবার তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? হঠ্যাৎ মনে হলো হয়তো মেসোমশায়ের শরীর খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরেই গিয়েছিলেন। মেসোমশাই কখনও কখনও রাত্রিবেলা বাতের বেদনায় কষ্ট পেতেন—ঘুম হত না। তখন তাঁকে ওষুঝ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হত। আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে মেসোমশাইয়ের ঘরের দিকে গেলুম।
‘তাঁর ঘরের দোর রাত্রে বরাবরই খোলা থাকে—আমি ঘরে ঢুকলুম। ঘর অন্ধকার—কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেও কি রকম একটা গন্ধ নাকে এল। গন্ধটা যে ঠিক কি রকম তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না—তীব্র নয়, অথচ—’
‘মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ?’
‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ।’
‘হুঁ—ক্লোরোফর্ম। তারপর!’
‘দোরের পাশেই সুইচ। আলো জ্বেলে দেখলুম, মেসোমশাই খাটে শুয়ে আছেন—ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর শোবার ভঙ্গী দেখে একবারও মনে হয় না যে তিনি—, কিন্তু তবু কি জানি কেন আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। সেই গন্ধটা যেন একটা ভিজে ন্যাকড়ার মতন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করবার উপক্রম করলে।
‘কিছুক্ষণ আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, ওটা ওষুধের গন্ধ, মেসোমশাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
‘পা কাঁপছিল, তবু সন্তর্পণে তাঁর খাটের পাশে দাঁড়ালুম। ঝুঁকে দেখলুম—তাঁর নিশ্বাস পড়ছে না। তখন আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা আমি বোঝাতে পারব না—মনে হচ্ছে এইবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। বোধহয় মাথাটা ঘুরেও উঠেছিল; নিজেকে সামলাবার জন্যে আমি মেসোমশায়ের বালিশের ওপর হাত রাখলুম। হাতটা ঠিক তাঁর ঘাড়ের পাশেই পড়েছিল—একটা কাটার মত কি জিনিস হাতে ফুটল। দেখলুম,একটা ছুঁচ তাঁর ঘাড়ে আমূল বেঁধানো—ছুঁচে তখনও সুতো পরানো রয়েছে।
‘আমি আর সেখানে থাকতে পারলুম না। কিন্তু কি করে যে আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলুম, তাও জানি না। যখন ভাল করে চেতনা ফিরে এল, তখন নিজের বিছানায় বসে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি আর কাঁদছি।
‘তারপর তো সবই আপনি জানেন। দাদাকে আমি সন্দেহ করিনি, আমি জানি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না, তবু একথা যে কাউকে বলা চলবে না, তাও বুঝতে দেরি হল না। পরদিন সকালবেলা কোনোরকমে চা তৈরি করে নিয়ে মেসোমশায়ের ঘরে গেলুম—’
সত্যবতীর স্বর ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল। তাহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা, চোখের আতঙ্কিত দৃষ্টি হইতে বুঝিতে পারিলাম, কি অসীম সংশয় ও যন্ত্রণার ভিতর দিয়া সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটা তাহার কাটিয়াছিল। ব্যোমকেশের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে। সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘আপনার মত অসাধারণ মেয়ে আমি দেখিনি। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করে মূর্ছা—হিস্টিরিয়ার ঠেলায় বাড়ি মাথায় করত—আপনি—’
সত্যবতী ভাঙ্গা গলায় বলিল,‘শুধু দাদার জন্যে—’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আপনি এখন তাহলে বাড়ি ফিরে যান। কাল সকালে আমি আপনাদের ওখানে যাব।’
সত্যবতীও উঠিয়া দাঁড়াইল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না?’
ব্যোমকেশ কহিল, ‘বলবার কিছু নেই। আপনাকে আশা দিয়ে শেষে যদি কিছু না করতে পারি? এর মধ্যে বিধুবাবু নামক একটি আস্ত—ইয়ে আছেন কিনা, তাই একটু ভয়। যা হোক, এইটুকু বলতে পারি যে, আপনি যে সব কথা বললেন, তা যদি প্রথমেই বলতেন, তাহলে হয়তো কোনও গোলমাল হত না।’
অশ্রুপূর্ণ চোখে সত্যবতী বলিল, ‘আমি যা বললুম তাতে দাদার কোনও অনিষ্ট হবে না? সত্যি বলছেন? ব্যোমকেশবাবু, আমার আর কেউ নেই—’ তাহার স্বর কান্নায় বুজিয়া গেল।
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি গিয়া সদর দরজাটা খুলিয়া দাঁড়াইল, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘আপনি আর দেরি করবেন না—রাত হয়ে গেছে। আমাদের এটা ব্যাচেলর এস্টাব্ বলিশমেন্ট—বুঝলেন না—’
সত্যবতী একটু ব্যস্তভাবে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সে চৌকাঠ পার হইয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে তাহাকে কি বলিল শুনিতে পাইলাম না। সত্যবতী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। ক্ষণকালের জন্যে তাহার কৃতজ্ঞতা-নিষিক্ত মিনতিপূর্ণ চোখ দুটি আমি দেখিতে পাইলাম—তারপর সে নিঃশব্দে ছোট্ট একটি নমস্কার করিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।
দরজা ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল,‘সাতটা বেজে গেছে।’ তারপর মনে মনে কি হিসাব করিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বলিল, ‘এখনও ঢের সময় আছে।’
আমি সাগ্রহে তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কি বুঝলে? আমি তো এমন কিছু—কিন্তু তোমার ভাব দেখে বোধ হয়, যেন তুমি ভেতরের কথা বুঝতে পেরেছ।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—‘এখনও সব বুঝিনি।’
আমি বলিলাম, ‘যাই বল, সুকুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ যতই গুরুতর হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে খুন করেনি।’
ব্যোমকেশ হাসিল—‘তবে কে করেছে?’
‘তা জানি না—কিন্তু সুকুমার নয়।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিল। বুঝিলাম, এখন কিছু বলিবে না। আমিও বসিয়া এই ব্যাপারে অদ্ভুত জটিলতার কথা ভাবিতে লাগিলাম।
অনেক্ষণ পরে ব্যোমকেশ একটা প্রশ্ন করিল, ‘সত্যবতীকে সুন্দরী বলা বোধ হয় চলে না—না?’
আমি চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘কেন বল দেখি?’
‘না, অমনি জিজ্ঞাসা করছি। সাধারণে বোধহয় কালোই বলবে।’
বর্তমান সমস্যার সঙ্গে সত্যবতীর চেহারার কি সম্বন্ধ আছে, বুঝিলাম না; কিন্তু ব্যোমকেশের মন কোন্ দুর্গম পথে চলিয়াছে, তাহা অনুমান করা অসম্ভব। আমি বিবেচনা করিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ, লোকে তাকে কালোই বলবে, কিন্তু কুৎসিত বোধহয় বলতে পারবে না।’
ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাও—‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’—কেমন?—ভাল কথা, অঞ্জিত, তোমার বয়স কত হল বল দেখি?’
সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘আমার বয়স—’
‘হ্যাঁ—কত বছর ক’মাস ক’দিন, ঠিক হিসেব করে বল।’
কে জানে—হয়তো আমার বয়সের হিসাবের মধ্যেই করালীবাবুর মৃত্যু-রহস্যটা চাপা পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশের অসাধ্য কার্য নাই; আমি মনে মনে গণনা করিয়া বলিলাম, ‘আমার বয়স হল ঊনত্রিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন।–কেন?’
ব্যোমকেশ একটা ভারী সস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক তুমি আমার চেয়ে তিন মাসের বড়। বাঁচা গেল। কথাটা কিন্তু মনে রেখো।’
‘মানে?’
‘মানে কিছুই নেই। কিন্তু ও কথা থাক। এই ব্যাপার নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠেছে। চল, আজ নাইট-শো’তে বায়স্কোপ দেখে আসি।’
ব্যোমকেশ কখনও বায়স্কোপে যায় না, বায়স্কোপ থিয়েটার সে ভালই বাসে না। তাই বিস্ময়ের অবধি রহিল না। বলিলাম, ‘তোমার আজ হল কি বল দেখি? একেবারে খেপচুরিয়াস্ মেরে গেলে না কি?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘অসম্ভব নয়। আমি লগনচাঁদা ছেলে—ভট্টাচায্যিমশাই কুণ্ঠী তৈয়ার করেই বলেছিলেন, এ ছেলে ঘোর উষ্মাদ হবে। কিন্তু আর দেরি নয়। চল, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। ‘চিত্রা’য় ক’দিন থেকে একটা ভাল ফিল্ম দেখাচ্ছে।’
আহারাদি করিয়া বায়স্কোপে উপস্থিত হইলাম। রাত্রি সাড়ে নয়টার চিত্র-প্রদর্শন আরম্ভ হইল। ছবিটা কিছু দীর্ঘ—শেষ হইতে প্রায় পৌনে বারোটা বাজিল।
অনেক দূর যাইতে হইবে—বাসও দু’একখানা ছিল; আমি একটাতে উঠিবার উপক্রম করিতেছি, ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না হেঁটেই চল না খানিকদূর।’ বলিয়া হনহন করিয়া চলিতে আরাম্ভ করিল।
কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট ছাড়িয়া সে যখন পাশের একটা সরু রাস্তা ধরিল, তখন বুঝিলাম সে করালীবাবুর বাড়ির দিকে চলিয়াছে। এত রাত্রে সেখানে কি প্রয়োজন, তাহা হৃদয়জম হইল না। যাহা হউক, বিনা আপত্তিতে তাহার সঙ্গে চলিলাম।
স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছু বেশি দ্রুতপদেই আমরা চলিতেছিলাম, তবু করালীবাবুর বাড়ি পৌঁছিতে অনেকটা সময় লাগিল। করালীবাবুর দরজার পাশেই একটা গ্যাস-পোস্ট ছিল, তাহার নীচে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ হাতের আস্তিন সরাইয়া ঘড়ি দেখিল। কিন্তু ঘড়ি দেখিবার প্রয়োজন ছিল না, ঠিক এই সময় অনেকগুলো ঘড়ি চারিদিক হইতে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করিয়া দিল।
ব্যোমকেশ উৎফুল্লভাবে আমার পিঠে একটা চাপড় মারিয়া বলিল, ‘হয়েছে। চল, এবার একটা ট্যাক্সি ধরা যাক।’
পরদিন বেলা সাড়ে আটটার সময় আমরা করালীবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। কয়েকজন পুলিস-কর্মচারী ও বিধুবাবু হাজির ছিলেন। ব্যোমকেশকে দেখিয়া বিধুবাবু একটু অপ্রস্তুত হইলেন, কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, আপনি শুনেছেন বোধহয় যে, সুকুমারকে অ্যারেস্ট করেছি। সে-ই আসল আসামী, তা আমি গোড়া থেকেই বুঝেছিলাম—আমি শুধু তাকে ল্যাজে খেলাচ্ছিলুম।’
‘বলেন কি?’ ব্যোমকেশ মহা বিস্ময়ের ভান করিয়া এমনভাবে বিধুবাবুর পশ্চাদ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, যেন খেলাবার যন্ত্রটা সত্য সত্যই সেখানে বিদ্যমান আছে। ইনস্পেক্টর,সাব-ইনস্পেক্টর হাসি চাপিবার চেষ্টায় উৎকট গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিইয়া লইল।
বিধুবাবু একটু সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন, ‘আপনি আজ কি মনে করে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিছু না। শুনলুম,আর একটা নুতন উইল বেরিয়েছে—তাই সেটা দেখতে এলুম।’
উইল ব্যোমকেশকে দেখাইবেন কি না, তাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বিধুবাবু অনিচ্ছাভরে ফাইল হইতে একটা কাগজ বাহির করিয়া দিলেন। বলিলেন, ‘দেখবেন, ছিঁড়ে ফেলবেন না যেন। এই উইলটাই হচ্ছে সুকুমারের বিরুদ্ধে সেরা প্রমাণ। করালীবাবুকে খুন করবার পর এটা সুকুমার চুরি করে নিজের ঘরে এনে লুকিয়ে রেখেছিল—কোথায় রেখেছিল জানেন? তার ঘরে যে তিনটে ট্রাঙ্ক উপরো-উপরি করে রাখা আছে, তারই নীচের ট্রাঙ্কটার তলায়।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বাঃ, সবই যে মিলে যাচ্ছে দেখছি! কিন্তু একটা কথা বলুন তো, সুকুমার উইখানা ছিঁড়ে ফেললে না কেন?’
বিধুবাবু নাকের মধ্যে একপ্রকার শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘হুঁ, সে বুদ্ধি থাকলে তো। ভেবেছিল, আমরা তার ঘর সার্চই করব না।’
‘সুকুমার কিছু বললে?’
‘কি আর বলবে! সবাই যা বলে থাকে, যেন ভারি আশ্চর্য হয়ে গেছে, এমনি ভাব দেখিয়ে বললে, ‘আমি কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ উইলখানা উল্টাইয়া দেখিয়া, সমুচিত শ্রদ্ধার সহিত তাহার ভাঁজ খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। আমিও গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, সাদা এক-তা ফুলস্ক্যাপ্ কাগজের উপর ছাপার অক্ষরে লখা রহিয়াছে—
‘অদ্য ইংরাজী ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে, আমি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে এই উইল করিতেছি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ও নগদ টাকা আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় শ্রীমান ফণীভূষণ পাইবে। পূর্বে যে সকল উইল করিয়াছিলাম, তাহা অত্র দ্বারা নাকচ করা হইল। স্বাক্ষর—শ্রীকরালীচরণ বসু।’
উইল পড়িয়া ব্যোমকেশ লাফাইয়া উঠিল, দেখিলাম, তাহার মুখ উত্তেজনায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিল, ‘বিধুবাবু, এ কি আশ্চার্য ব্যাপার! উইল যে—’ বলিয়া কাগজখানা বিধুবাবুর সম্মুখে পাতিয়া ধরিল।
বিধুবাবু বিস্মিতভাবে সেটা আগাগোড়া পড়িয়া বলিলেন, ‘কি হয়েছে? আমি তো কিছু—’
‘দেখছেন না?’ বলিয়া স্বাক্ষরের নীচেটা আঙুল দিয়া দেখাইল।
তখন বিধুবাবু চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া বলিলেন, ‘ওঃ, সাক্ষী—’
‘চুপ!’ ব্যোমকেশ ঠোঁটে আঙুল দিয়া ঘরের ভেজানো দরজার দিকে তাকাইল। কিছুক্ষণ উৎকর্ণভাবে শুনিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া হঠাৎ কবাট খুলিয়া ফেলিল।
মাখনলাল দরজায় কান পাতিয়া শুনিতেছিল, সবেগে পালইবার চেষ্টা করিল। ব্যোমকেশ তাহাকে কামিজের গলা ধরিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল; জোর করিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিয়া বলিল, ‘ইনস্পেক্টরবাবু, একে ধরে রাখুন—ছাড়বেন না। আর, কথা কইতে দেবেন না।’
মাখন ভয়ে আধমরা হইয়া গিয়াছিল, বলিল, ‘আমি—’
‘চুপ! বিধুবাবু একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনিয়ে নিন। আসামীর নাম দেবার দরকার নেই—নামটা পরে ভর্তি করে নিলেই হবে।’ বিধুবাবুর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘ততক্ষণ এই লোকটাকে ল্যাজে খেলান—আমরা আসছি।’
বিধুবাবু বুদ্ধিভ্রষ্টের মত বলিলেন, ‘কিন্তু আমি কিছুই—’
‘পরে হবে। ইতিমধ্যে আপনি ওয়ারেন্টখানা আনিয়ে রাখুন। এস অজিত।’
দ্রুতপদে ব্যোমকেশ উপরে উঠিয়া গিয়া ফণীর কবাটে টোকা মারিল। ফণী আসিয়া দরজা খুলিয়া সম্মুখে ব্যোমকেশকে দেখিয়া ঈষৎ বিস্ময়ের সহিত বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের ব্যস্তসমস্ত ভাব আর ছিল না, সে সাহস্যমুখে বলিল, ‘আপনি শুনে সুখী হবেন, করালীবাবুর প্রকৃত হত্যাকারী কে—তা আমরা জানতে পেরেছি।’
ফণী একটু মলিন হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা গ্রেপ্তার হয়েছেন জানি। কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘বিশ্বাস না হবারই তো কথা। তাঁর ঘর থেকে আর একটা উইল বেরিয়েছে।–সে উইলের ওয়ারিস আপনি!’
ফণী বলিল, ‘তাও শুনেছি। কথাটা শুনে অবধি আমার মনটা যেন তেতো হয়ে গেছে। তুচ্ছ টাকার জন্যে মামার অপঘাতে প্রাণে গেল।’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘অর্থমনর্থম্! তিনি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, এতেও আমি খুশি হতে পারছি না ব্যোমকেশবাবু। নাই দিতেন টাকা—তবু তো তিনি বেঁচে থাকতেন।’
ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বইগুলা দেখিতে দেখিতে অন্যমনস্কভাবে বলিল, ‘তা তো বটেই। পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ—শঙ্করাচার্য তো আর মিথ্যে বলেননি! এটা কি বই? ফিজিওলজি! সুকুমারবাবুর বই দেখছি।’ বইখানা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ নামপত্রটা দেখিল।
ফণী একটু হাসিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ—সুকুমারদা মাঝে মাঝে আমাকে তাঁর ডাক্তারি বই পড়তে দিতেন। কি আশ্চার্য দেখুন। এ বাড়িতে আমি সুকুমারদাকেই সবচেয়ে আপনার লোক মনে করতুম—এমন কি, দাদাদের চেয়েও—অথচ তিনিই—’
ব্যোমকেশ আরও কতকগুলি বই খুলিয়া দেখিয়া বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি তো দেখছি একজন পাকা গ্রন্থকীটি! সব বই দাগ দিয়া পড়েছেন।’
ফণী বলিল, ‘হ্যাঁ। পড়া ছাড়া আর তো কোনও অ্যামুজমেন্ট নেই—সঙ্গীও নেই। এক সুকুমারদা রোজ সন্ধ্যাবেলা খানিকক্ষণ আমার কাছে এসে বসতেন। আচ্ছা, ব্যোমকেশবাবু, সত্যই কি সুকুমারদা এ কাজ করেছেন? কোন সন্দেহ নেই?’
ব্যোমকেশ চেয়ারে আসিয়া বসিল, বলিল, ‘অপরাধীর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে সন্দেহের বিশেষ স্থান নেই। বসুন—আপনাকে সব কথা বলছি।’
ফণী বিছানায় উপবেশন করিল, আমি তাহার পাশে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন, হত্যা দু’রকম হয়—এক, রাগের মাথায় হত্যা, যাকে crime of passion বলে; আর এক, সঙ্কল্প করে হত্যা। রাগের মাথায় যে—লোক খুন করে, তাকে ধরা কঠিন নয়—অধিকাংশ সময় সে নিজেই ধরা দেয়। কিন্তু যে লোক ভেবে-চিন্তে নিজেকে যথাসম্ভব সন্দেহমুক্ত করে খুন করে, তাকে ধরাই কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কে আসামী, তার নাম আমরা জানতে পারি না, পাঁচজন লোকের ওপর সন্দেহ হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আমরা কোন্ পথে চলব? তখন আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে—হত্যার প্রণালী থেকে হত্যাকারীর প্রকৃতি বোঝবার চেষ্টা করা।
‘বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি—হত্যাকারী লোকটা একাধারে বোকা এবং চতুর। সে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত খুন করেছে অথচ নির্বোধের মত খুনের যা-কিছু প্রমাণ নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে। বলুন দেখি, সত্যবতী ছুঁচ দিয়ে খুন করবার কি দরকার ছিল? বাজারে কি ছুঁচ পাওয়া না? আর উইলখানা যত্ন করে লুকিয়ে রাখবার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি? ছিঁড়ে ফেললেই তো সব ন্যাটা চুকে যেত। এ থেকে কি মনে হয়?’
ফণী হাতের উপর চিবুক রাখিয়া শুনিতেছিল, বলিল, ‘কি মনে হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সে বোকমির ভান করতে পারে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসামী যে হোক সে বুদ্ধিমান।
‘কিন্তু বুদ্ধিমান লোকও ভুল করে,বোকা সাজবার চেষ্টাও সব সময় সফল হয় না। এ ক্ষেত্রেও আসামী কয়েকটা ছোট ছোট ভুল করেছিল বলে আমি তাকে ধরতে পেরেছি।’
ফণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ভুল সে করেছিল?’
‘বলছি।’ ব্যোমকেশ পকেট হাটকাইয়া একটা সাদা কাগজ বাহির করিল—‘কিন্তু তার আগে এ বাড়ির একটা নক্সা তৈরি করে দেখাতে চাই। একটা পেন্সিল আছে কি? যে কোনও পেন্সিল হলেই চলবে।’
ফণীর বিছানায় বালিশের পাশে একটা বই রাখা ছিল, তাহার ভিতর হইতে সে একটা লাল পেন্সিল বাহির করিয়া দিল।
পেন্সিলটা লইয়া ব্যোমকেশ ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃদু হাস্যে সেটা পকেটে রাখিয়া দিয়া বলিল, ‘থাক, প্ল্যান্ আঁকবার দরকার নেই—মুখেই বলছি। অপরাধী প্রধানত তিনটি ভুল করেছিল। প্রথমে—সে গ্রে’র অ্যানাটমির এক জায়গায় লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছিল; দ্বিতীয়—সে বাক্স টানবার সময় একটু শব্দ করে ফেলেছিল; আর তৃতীয়—সে আইন ভাল জানত না।’
ফণীর মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা একেবারে মড়ার মত হইয়া গিয়াছিল, সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করিল,‘আইন জানত না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আর সেই জন্যেই তার অতবড় অপরাধটা ব্যর্থ হয়ে গেল।’
শুঙ্ক অধর লেহন করিয়া ফণী বলিল, ‘আপনি কি বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘সুকুমারবাবুর ঘর থেকে যে উইলটা বেরিয়েছে—উইল হিসেবে সেটা মূল্যহীন। তাতে সাক্ষীর দস্তখত নেই।’
মনে হইল, ফণী এবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইবে। অনেকক্ষণ কেহ কোনও কথা বলিল না; দৃষ্টিহীন শুঙ্ক চক্ষু মেলিয়া ফণী মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করিয়া ধরিয়া অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, ‘সব বৃথা—সব মিছে—’ ব্যোমকেশবাবু, আমাকে একটু সময় দিন, আমি বড় অসুস্থ বোধ করছি।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘাড় নাড়িল, ‘আধ ঘণ্টা সময় আপনাকে দিলুম—তৈরি হয়ে নিন।’ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘থিম্বলটা অবশ্য’ ফেলে দিয়েছেন; সেটা সুকুমারের ঘরে রেখে আসেননি কেন বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়িতে আঙুল থেকে খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন—না? তাই হবে। কিন্তু ক্লোরোফর্ম কার হাত দিয়ে আনালেন? মাখন?’
ফণী বিছানায় শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘আধ ঘণ্টা পরে আসবেন—’
দ্বার ভেজাইয়া দিয়া আমরা নীচে নামিয়া আসিয়া বসিলাম। মাখন তখনও ইনস্পেক্টর ও সাব-ইনস্পেক্টরের মধ্যবর্তী হইয়া দারুভুত জগন্নাথের মত বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ ভীষণ ভ্রৃকুটি করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কবে ফণীকে ক্লোরোফর্ম এনে দিয়েছ?’
মাখন চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমি কিছু জানি না—’
‘সত্যি কথা বল, নইলে ওয়ারেন্টে তোমার নামই লেখা হবে।’
মাখন কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘দোহাই আপনাদের, আমি এ সবের মধ্যে নেই। ফণী বলেছিল রাত্রে তার ঘুম হয় না, একফোটা করে ক্লোরোফর্ম খেলে ঘুম হবে—তাই—’
‘বুঝেছি। একে এবার ছেড়ে দিতে পারেন, বিধুবাবু।’
মুক্তি পাইয়া মাখন একেবারে বাড়ি ছাড়িয়া দৌড় মারিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওয়ারেন্ট এসেছে?’
বিধুবাবু বলিলেন, ‘না, এই এল বলে। কিন্তু কার জন্যে ওয়ারেন্ট?’
‘করালীবাবুকে যে খুন করেছে তার জন্য।’
বিধুবাবু অতিশয় অপ্রসন্নভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, এটা পরিহাসের সময় নয়। কমিশনার সাহেব আপনাকে একটু স্নেহ করেন বলে আপনি আমার ওপর হুকুম চালাচ্ছেন, তাও আমি সহ্য করেছি। কিন্তু তামাশা সহ্য করব না।’
‘তামাশা নয়—এ একেবারে নিরেট সত্যি কথা। শুনুন তবে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ সংক্ষেপে সমস্ত কথা বিধুবাবুকে বলিল। বিধুবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়বিহুল হইয়া রহিলেন, তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘তাই যদি হয়, তবে তাকে একলা ফেলে এলেন কি বলে? যদি পালায়?’
‘পালাবে না; সে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে। আর সেইটেই আমাদের একমাত্র ভরসা; কারণ, তার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা বিশেষ কঠিন হবে। জুরীদের আপনি জানেন তো—তারা ‘নট্ গিল্টি’ বলেই আছে।’
‘তা তো জানি—কিন্তু—’ বিধুবাবুর আবার বসিয়া পড়িলেন।
ঠিক আধ ঘণ্টা পরে আমরা ফণী ঘরে এলাম। বিধুবাবু সর্বপ্রথম দরজা খুলিয়া গটগট্ করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন।
ফণী বিছানয়া শুইয়া আছে, বিছানার পাশে তাহার ডান হাতটা ঝুলিতেছে; আর ঠিক তাহার নীচে মেঝের উপর পুরু হইয়া রক্ত জমিয়াছে। কব্জির কাটা ধমনী হইতে তখনও ফোঁটা ফোঁটা গাঢ় রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।
কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতটা আমি প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু এ ছাড়া তার উপায়ই বা ছিল কি?’
ফণীর বুকের উপর একখানা চিঠি রাখা ছিল; সেটা তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ পাঠ করিল। চিঠেতে এই কয়টি কথা লেখা—
‘ব্যোমকেশবাবু,
চলিলাম। আমি খোঁড়া অকর্মণ্য, এখানে আমার অন্ন জুটিবে না—দেখি ওখানে জোটে কি না।
আমি জানি,মোকাদ্দমা করিয়া আপনারা আমার ফাঁসি দিতে পারিতেন না। কিন্তু আমার বাঁচিয়া কোনও লাভ নাই; যখন টাকাই পাইলাম না,তখন কিসের সুখে বাঁচিব?
মামাকে খুন করিয়াছি সেজন্য আমার ক্ষোভ নাই; তিনি আমাকে ভালবাসিতেন না, খোঁড়া বলিয়া বিদ্রুপ করিতেন। তবে সুকুমারদার কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। কিন্তু তিনি ছাড়া দোষ চাপাইবার লোক আর কেহ ছিল না।
তা ছাড়া, তিনি ফাঁসি গেলে আর একটা সুবিধা হইত। কিন্তু যে কথা নিজের বিকলাঙ্গতার লজ্জায় জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নাই আজ আর তাহা প্রকাশ করিব না।
ক্লোরোফর্ম কোথা হইতে পাইয়াছি তাহা বলিব না; যে আনিয়া দিয়াছিল সে আমার অভিসন্ধি জানিত না। তবে পরে হয়তো সন্দেহ করিয়াছিল।
আপনি আশ্চার্য লোক, থিম্বলের কথাটাও ভুলেন নাই। সেটা সত্যই আঙুল হইতে খুলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম; ঘরে ফিরিয়া আসিয়া চোখে পড়িল। সেটা এই ঘরেই আছে—খুঁজিয়া লইবেন। সেদিন রাত্রিতে সত্যবতীর ঘর হইতে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করিয়াছিলাম—সে তখন রান্নাঘরে ছিল।
আপনি ছাড়া আমাকে বোধহয় আর কেহ ধরিতে পারিত না কিন্তু তবু আপনাকে বিদ্বেষ করিতে পারতেছি না। বিদায়। ইতি—
বহুদূরের যাত্রী
ফণীভূষণ কর
চিঠিখানি বিধুবাবুর হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার বোধহয় আর কোনও বাধা নেই। তাঁর ভগিনীকেও জানানো দরকার। তিনি বোধহয় নিজের ঘরেই আছেন।–চল অজিত।’
সপ্তাহখানেক পরে আমরা দুইজনে আমাদের বসিবার ঘরে অধিষ্ঠিত ছিলাম। বৈকালবেলা নীরবে চা—পান চলিতেছিল।
গত কয়দিন অপরাহ্ণে ব্যোমকেশ নিয়মিত বাহিরে যাইতেছিল। কোথায় যায়, আমাকে বলে নাই, আমিও জিজ্ঞাসা করি নাই। তাহার কাছে মাঝে মাঝে এমন দু’একটা গোপনীয় কেস আসিত যাহার কথা আমার কাছেও প্রকাশ করিবার তাহার অধিকার ছিল না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আজও বেরুবে না কি?’
ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ।’
একটু সঙ্কুচিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘নুতন কেস হাতে এসেছে, না?’
‘কেস? হ্যাঁ—কিন্তু কেসটা বড় গোপনীয়।’
আমি আর ও বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিলাম না, বলিলাম, ‘সুকুমারের ব্যাপার সব চুকে গেছে?’
‘হ্যাঁ—প্রোবেটের দরখাস্ত করেছে।’
আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, ঠিক কিভাবে ফণী খুন করলে, আমাকে বুঝিয়ে বলতো; এখনও ভাল করে জট ছাড়াতে পারছি না।’
চায়ের শূণ্য পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা শোন, পর পর ঘটনাগুলো যেমন ঘটেছিল, বলে যাচ্ছি—
‘সেদিন দুপুরবেলা করালীবাবুর সঙ্গে মতিলালের ঝগড়া হল। সন্ধ্যেবেলা সুকুমার এসে তাই শুনে করালীবাবুকে বোঝাতে গেল। সেখান থেকে গালাগালি খেয়ে বেরিয়ে ফণীর ঘরে প্রায় সাড়ে সাতটা পর্যন্ত কাটালে; তারপর খেয়েদেয়ে বায়স্কোপ দেখতে গেল। এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই।’
‘না।’
‘রাত্রি আটটার থেকে নয়টার মধ্যে—অর্থাৎ সত্যবতী যে সময় রান্নাঘরে ছিল, সেই সময় ফণী তার ঘর থেকে থিম্বল আর ছুঁচ চুরি করলে। সে বুঝতে পেরেছিল, করালীবাবুর আবার উইল বদলাবেন এবং এবার সে সম্পত্তি পাবে। সে ঠিক করলে, বুড়োকে আর মত বদলাবার ফুরসৎ দেবে না। বুড়োকে ফণী বিষচক্ষে দেখত; বিকলাঙ্গ লোকের একটা অদ্ভুত মানসিক দুর্বলতা প্রায়ই দেখা যায়—তারা নিজেদের দৈহিক বিকৃতি সম্বন্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে পারে না। ফণী বোধহয় অনেকদিন থেকেই করালীবাবুকে খুন করবার মতলব আঁটছিল। ‘বামুনঠাকুর এজেহার থেকে জানা যায়, রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারোটার সময় মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। গাঁজাখোরদের সময়ের ধারণা থাকে না, তাই বামুনঠাকুর একটু সময়ের গোলমাল করে ফেলেছিল। আমি হিসাব করে দেখেছি , মতিলাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ঠিক এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। তার ও-দোষ বরাবরই ছিল—রাত্রে বাড়ি থাকত না।
‘সে বেরিয়ে যাবার পর ফণীও নিজের ঘর থেকে বেরুল। মতিলালের ঘর করালীবাবুর শোবার ঘরের ঠিক নীচেই, পাছে পায়ের শব্দ হয়, তাই ফণী এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। ঘুমন্ত করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল; তারপর সে তাঁর ঘাড়ে অপটু হস্তে ছুঁচ ফোটালে। তিনবার ফোটবার পর তবে ছুঁচ যথাস্থানে পৌছল। সুকুমারের মতন ডাক্তারি ছাত্র যদি একাজ করত, তাহলে তিনবার ফোটাবার দরকার হত না।
‘করালীবাবুকে শেষ করে ফণী পাশের ঘরের দেরাজ থেকে তাঁর শেষ উইল বার করলে—দেখলে, উইল তার নামেই বটে।
‘এখানে একটু সন্দেহের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে যে, ফণী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করে পাশের ঘরে গিয়ে উইলটা পড়লে; যখন দেখলে উইল তারই নামে, তখন ফিরে এসে করালীবাবুকে খুন করলে। সে যাই হোক, এই ব্যাপারে তার দশ-বারো মিনিট সময় লাগল।
‘এখন কথা হচ্ছে, উইলখানা নিয়ে সে কি করবে? যথাস্থানে রেখে দিলেও পারত, কিন্তু তাতে সুকুমারকে ভাল করে ফাঁসানো যায় না। অথচ নিজেকে বাঁচাতে হলে একজনকে ফাঁসানো চাই—ই।
উইল আর ক্লোরোফর্মের শিশি সে সুকুমারের ঘরে লুকিয়ে রেখে এল। জানত, এত বড় কাণ্ডের পর সব ঘর খানাতল্লাস হবেই—তখন উইলও বেরুবে। এক ঢিলে দুই পাখি মরবে—সুকুমার তখন ফিরতে পারে না; সে ফিরছে—যখন ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে—
‘আর কিছু বোঝাবার দরকার আছে কি?’
‘উইলে সাক্ষীর দস্তখত না থাকার কারণ কি?’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘আমার মনে হয়, খাওয়া-দাওয়ার পর করালীবাবু উইলটা লিখেছিলেন, তাই আর রাত্রে কিছু করেননি। সম্ভবত তাঁর ইচ্ছে ছিল, পরদিন সকালে চাকর-বামুনকে দিয়ে সহি দস্তখত করিয়ে নেবেন।’
নীরবে ধুমপান করিয়া কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল, তারপর জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সত্যবতীর সঙ্গে তারপর আর দেখা হয়েছিল? সে কি বললে? খুব ধন্যবাদ দিলে তো?’
বিমর্যভাবে মাথা নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। শুধু গলায় আঁচল দিয়ে পেন্নাম করলে।’
‘চমৎকার মেয়ে কিন্তু—না?’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল,তর্জনী তুলিয়া বলিল, ‘তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, সে কথাটা মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ—কেন?’
উত্তর না দিয়া ব্যোমকেশ পাশের ঘরে প্রবেশ করিল। মিনিট পাঁচেক পরে বিশেষ সাজ-সজ্জা করিয়া বাহির হইয়া আসিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার গোপনীয় মক্কেল তো ভারী শৌখিন লোক দেখছি, সিল্কের পঞ্জাবি পরা ডিকেটটিভ না হলে মন ওঠে না।’
এসেন্স-মাখানো রুমালে মুখ মুছিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। সত্য অণ্বেষণ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, অনেক তোড়জোড় দরকার।’
আমি বললাম, ‘সত্য অণ্বেষণ তো অনেকদিন থেকেই করছ, এত সাজ-সজ্জা তো কখনো দেখিনি।’
ব্যোমকেশ একটু গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘সত্য অণ্বেষণ আমি অল্পদিন থেকেই আরম্ভ করেছি।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে অতি গভীর। চললুম।’ মুচকি হাসিয়া ব্যোমকেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।
‘সত্য—ওঃ।’ আমি লাফাইয়া গিয়া তাহার কাঁধ চাপিয়া ধরিলাম—‘সত্যবতী! এ ক’দিন ধরে ঐ মহা সত্যটি অণ্বেষণ করা হচ্ছে বুঝি? অ্যাঁ—ব্যোমকেশ! শেষে তোমার এই দশা। কবি তাহলে ঠিক বলেছেন—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খবরদার। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, অর্থাৎ সম্পর্কে তার ভাণ্ডর। ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলবে না। এবার থেকে আমিও তোমায় দাদা বলে ডাকব।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আমাকে এত ভয় কেন?’
সে বলিল, ‘লেখক জাতটাকেই আমি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি।’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, ‘বেশ, দাদাই হলুম তাহলে।’ ব্যোমকেশের মস্তকে হস্তার্পণ করিয়া বলিলাম, ‘যাও ভাই, চারটে বাজে, এবার জয়যাত্রায় বেরিয়ে পড়। আশীর্বাদ করি, সত্যের প্রতি যেন তোমার অবিচলিত ভক্তি থাকে।’
ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গেল।
………………………………………………………………….সমাপ্ত…………………………………………………………