ছায়া-কায়া-মায়া

ছায়া-কায়া-মায়া

স্বীকার করছি, সেদিন শিকার করতে যাওয়াটা পাকা শিকারীর মতো কাজ হয়নি।

সকাল থেকেই খেপে খেপে আকাশের বুকে কালো মেঘ উঠছে এবং তার সাথী হয়ে আসছে উদ্দাম ঝোড়ো হাওয়া আর ঝমাঝম বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট-বাট সমস্ত!

দুর্যোগ বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না বটে, কিন্তু সাঁওতাল পরগণা সন্মন্ধে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি মাত্রেই জানেন, এই অল্পক্ষণের দুর্যোগেই মাঠ-ঘাট-বাটের অবস্থা হয় কতটা বিপজ্জনক এবং ছোট ছোট পাহাড়ি নদীগুলো পর্যন্ত ফুলে-ফেঁপে দুকূল ভাসিয়ে হয়ে ওঠে – কতটা দুর্দমনীয়! আর অরণ্য রাজ্য তো দুরধিগম্য হয়ে ওঠে বললেও অত্যুক্তি হয় না।

আমরা তিন বন্ধু, তিন সরকারি কর্মচারী এবং প্রত্যেকেরই হাতে ছুটি আছে আর মাত্র কয়েকটা দিন। ছুটি ফুরোলেই আবার পায়ে পড়তে হবে কাজের শৃঙ্খল! অতএব ছুটি ফুরোবার আগের দিনটাকে যেন-তেন প্রকারে কাজে লাগানোর জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে আমরা বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের হাতে ছিল তিনটে ছররা-ছোঁড়া বন্দুক, কারণ স্বপ্নেও কোনোদিন বাঘ-টাঘ মারিনি, তাই আমাদের পাখি শিকার ছাড়া অন্য কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না। কিন্তু বেরোবার সময় ডাকবাংলোর খানসামার মুখে শোনা গেল একটা বেমক্কা কথা।

বলল, “হুজুর, বেলা পড়বার আগেই বাংলোয় ফিরে আসবেন”।

জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন?”

“….অন্ধকার পথে চলতে চলতে বিপদে পড়তে পারেন!”

“….বিপদ? বাঘ-ভাল্লুক?”

“….না”।

“….তবে?”

সে আর জবাব না দিয়ে বাংলোর ভেতর চলে গেল। তার মুখ দেখে মনে হলো, এ সন্মন্ধে আর কোনো কথাই সে খোলসা করতে রাজি নয়। অল্পক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করলুম, কিন্তু – বিপদটা কি হতে পারে, কিছুই আন্দাজ করা গেল না। তারপরেই পড়লুম উত্তেজনার আবর্তে – শিকারের উত্তেজনা! ডাকবাংলো ও খানসামার স্মৃতি পর্যন্ত মন থেকে মুছে গেল।

অস্থায়ী ঝড়ঝাপটা আর বৃষ্টির দাপটে মাঝেমাঝে কষ্ট পেয়েছিলুম নিশ্চয়ই, তবে তা স্বত্তেও তিনটে বালি-হাঁস আর একটা চক্রবাক’কে রাতের খানার উপকরণ বানাতে সমর্থ হলাম। তারপরেও আমাদের উৎসাহ বহ্নি নির্বাপিত হয়নি। কিন্তু হঠাৎ দুটো ব্যাপার উপলব্ধি করা গেল – আমরা ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছি এবার বেলাবেলি যথাস্থানে ফিরতে না পারলে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাদের অবস্থা হবে কানামাছির মতো।

আমরা তখন একটা অরণ্যের ভেতর দিয়ে পদচালনা করছি। মাথা তুললে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়, দিনের আলো এখনও আকাশ থেকে মুছে যায়নি কিন্তু মেঘমেদুর দিনের শেষে ইতিমধ্যেই অন্ধকার নামতে শুরু করে দিয়েছে জঙ্গলে। এরই মধ্যে দলে দলে নানা জাতের পাখি বাসামুখো হতে শুরু করেছে এবং কোনো কোনো দল নিরাপদে বাসায় ফিরে সমস্বরে আরম্ভ করে দিয়েছে দৈনিক সান্ধ্য সঙ্গীতের সাধনা।

দীনেশ বলল, “তাড়াতাড়ি পা চালাও…নইলে বিপদ হবে ঘনীভূত! অন্ধকার নামলেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে বনের বাঘ-ভাল্লুকরা”।

প্রমথ বলল, “তাড়াতাড়ি পা চালাতে তো বলছ, কিন্তু পা চালাব কোনদিকে? কে জানে এই বন থেকে বেরোবার পথ?”

আচম্বিতে অপরিচিত হেঁড়ে গলা শোনা গেল, “আমি জানি!”

সচমকে মুখ ফিরিয়ে চারিদিকে তাকিয়েও আবিষ্কার করা গেল না, কোথা থেকে সেই অভাবিত, আকস্মিক কন্ঠস্বরের উৎপত্তি! সামান্য দুটি শব্দ – ‘আমি জানি’…কিন্তু শুনেই কেন জানি না, বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল আমাদের।

আগেই বলেছি, বর্ষণসিক্ত আসন্ন সন্ধ্যার সামিয়ানায় ঢেকে যাচ্ছে জঙ্গল, কিন্তু তখনো পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে যায় নি চরাচর। কোথাও কোথাও অন্ধকারের প্রভাব কিছু অল্প বটে,কিন্তু জায়গায় জায়গায় জঙ্গল বেশ গভীর এবং নিকষ কালো অন্ধকার বিরাজ করছে সেখানে । সেরকমই একটা দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে হঠাৎ দীনেশ বলে উঠল, “ও কে ওখানে?”

ভালো করে চেয়ে দেখলুম, একটা মনুষ্যমূর্তি যেন ওখানে স্থির প্রতিমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাদা ধবধবে আলখাল্লার মতো লম্বা জামা প্রায় তার পা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে এবং রহস্যময় ছায়ার ভেতর থেকে সেই মনুষ্যমূর্তির অস্তিত্ব প্রকাশ করে দিচ্ছিল তার জামার সেই শুভ্রতাই।

আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলুম। মূর্তির দুটো অতি উজ্জ্বল চক্ষু মাছের চোখের মতো নিষ্পলক এবং তাদের দৃষ্টি যেন বনজঙ্গলের সব বাধা পার হয়ে চলে গিয়েছে দূর-দূরান্তরে!

আমরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম সেখানে প্রায় মিনিটখানেক। এই লোকটাই কি কথা কইছিল? শুনলুম তো বাংলা কথা, কিন্তু এ লোকটাকে দেখে তো বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না। বোধহয় বিহারী। এখানকার অনেক লোক বাংলায় বেশ কথা কইতে পারে।

কিন্তু বাঙালি হোক বা বিহারী হোক, এই দুর্যোগের সন্ধ্যায় এই বিজন বনে অন্ধকারের সঙ্গে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটা কি করছে? এই জায়গাটা তো বেড়াবার বা বিশ্রাম করবার জায়গা নয়, তাছাড়া লোকটিকে দেখে শিকারী বলেও মনে হচ্ছে না, কারণ দেখা যাচ্ছে সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।

কিন্তু একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমাদের। লোকটির সাদা আলখাল্লার জায়গায় জায়গায় কাদামাটির ছাপ এবং তার হাত দুখানাতেও পুরু কাদামাটির প্রলেপ। এমনকি, লোকটার দাড়ি, গোঁফ এবং মাথার চুলও কাদামাটির দাগ থেকে মুক্ত নয়।

লোকটার উচ্চতা ছয় ফুটের কম হবে না। মাথায় অবিন্যস্ত সাদা সাদা তুলোর মতো লম্বা লম্বা চুল এবং রাশিকৃত পাকা গোঁফদাড়ি তার মুখের অধিকাংশ ঢেকে বুকের কাছ পর্যন্ত ছেয়ে ফেলেছে। বয়স বোধকরি ষাট পার হয়েছে, কিন্তু দেহ এখনো ঋজু এবং বলিষ্ঠ।

আমরা যে তিন-তিনটে মানুষ ভীত এবং সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছি, সেদিকে সে ভ্রুক্ষেপও করল না দেখে আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে বসলাম, “মশাই, এই বন থেকে বেরোবার পথ কোনদিকে হবে বলতে পারেন?”

তবু লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই। সে ফিরেও তাকাল না। তার মুখ দিয়ে বাক্যস্ফূর্তিও হলো না। শুধু তার চোখদুটো যেন আরও চকচক করে উঠল। কেবল নীরবে দক্ষিণ বাহু তুলে সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল জঙ্গলের ডানদিকটা।

“…..ধন্যবাদ মশাই, ধন্যবাদ, দয়া করে বলতে পারেন আমাদের আর কতটা পথ চলতে হবে?”

এবার আর কোনো জবাব না দিয়েই মূর্তিটা সাঁৎ করে সরে গেল ঝোপের ভেতর, আমাদের সবার চোখের আড়ালে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্য বরাহ নিদারুণ ভয়ে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে ঝোপটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চোখের নিমেষে কোথায় পালিয়ে গেল।

আমি দারুণ বিস্মিত হয়ে বললাম, “বন্য বরাহ তো দারুণ হিংস্র জীব। সে পালিয়ে গেল কার ভয়ে?!!”

দীনেশ হঠাৎ শিউরে উঠে বলল, “উঃ, কি ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে!”

প্রমথ বলল, “হাওয়াটা আসছে ওই ঝোপের দিক থেকেই! কি আশ্চর্য, ঝোপের দিক থেকে হঠাৎ এত ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে কেন?”

কেবল বরফের মতো কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া নয় – সেই সঙ্গে আমি পেলুম স্যাঁতস্যাঁতে কাঁচা মাটির গন্ধ! মনের মধ্যে জাগল কিরকম একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা এবং একটা অজানা বিভীষিকার ইঙ্গিত। সে কি অকারণে?

ঝোপের ভেতর দিকে আরেকবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি চালনা করলুম। সেখানে তখন আসর পেতেছে রাত্রির অন্ধকার এবং সেই অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠেছে দুটো নীলাভ দীপ্তি – ঠিক যেন কোনো হিংস্র জন্তুর ক্ষুধিত চক্ষু! ওটা কি জন্তু হতে পারে? ওটাকে দেখেই কি প্রাণভয়ে চম্পট দিল বন্য বরাহটা? কিন্তু কিছুক্ষণ আগের সেই অদ্ভুত বুড়ো লোকটা তো ওই ঝোপের ভেতরেই ঢুকেছে। তার কি প্রাণের ভয় নেই?

তার প্রাণের ভয় না থাকলেও আমাদের আছে। ওই দীপ্ত চক্ষু জন্তুটা যে আমাদেরই লক্ষ্য করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তাড়াতাড়ি সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলুম, “চলো, চলো, ধরো ওই ডানদিকের পথ। এই অলুক্ষুণে বন থেকে এখন বের হতে পারলে বাঁচি”।

বনের মধ্যে তখন আবছা আলো-আঁধারির খেলা। কাছাকাছি চোখ চলে, কিন্তু দূরের দিকটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। কোথাও ছাড়া ছাড়া ঝোপঝাড়, আবার কোথাও দূর্ভেদ্য অরণ্যের প্রাচীর, কোথাও আবার খন্ড খন্ড জমি। একাধিক জায়গায় বৃষ্টি ভেজা নরম মাটির ওপর নজরে পড়ল সন্দেহজনক ভয়াবহ হিংস্র জন্তুর পদচিহ্ন। বলা বাহুল্য, আমাদের চলার গতি বেড়ে উঠল।

…..ব্যাপারটা কিছুই বুঝলুম না, কিন্তু আচম্বিতে আমাদের চারিপাশে যেন মহা শোরগোল পড়ে গেল। আমাদের পেছন দিক থেকে বেগে ছুটে আসতে লাগল পালে পালে হরিণ, একদল বন্য বরাহ, অনেকগুলো হায়েনা, শেয়াল, খরগোশ প্রভৃতি। তারা কেউ আমাদের প্রতি দৃকপাতও করল না – বেশ বোঝা গেল দারুণ কোনো আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে তারা সকলে একসাথে পলায়ন করছে। তার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো একবার দেখা দিয়েই পালিয়ে গেল একটা চিতাবাঘও!

শুনেছি অরণ্যে দাবানল লাগলে সব জীবজন্তুরা এইভাবে একসাথে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু এখানে তো দাবানলের ব্যাপার ঘটেনি, আছে কেবল ঘনঘন বর্ষার ঝরন। তবে এতগুলো জানোয়ারের এমন বিষম আতঙ্কের কারণ কি?

আর একটা ব্যাপারও লক্ষ্য না করে পারলুম না। গাছে গাছে সারাদিনের পরিশ্রান্ত পাখিদের কলকাকলিও হঠাৎ কি এক কারণে যেন থেমে গেছে। একটা পাখির ডাক আর কোথাও থেকে শোনা যাচ্ছে না! যেন কি এক বিষম আতঙ্ক তাদেরও কন্ঠরূদ্ধ করে দিয়েছে!

তারপরেই আমাদের পিছন দিক থেকে বইতে শুরু করল হু হু করে একটা প্রবল ও তুষার শীতল হাওয়া – একটু আগেই ঝোপের কাছে পেয়েছিলুম যার অভাবিত ও অসহনীয় স্পর্শ।

হতবুদ্ধির মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একবার পিছন দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বাধ্য হলুম।

দূরে আবছা-আবছা দেখা যাচ্ছে চলন্ত শ্বেতবর্ণের একটা কিছু।

আরও নিকটস্থ হলে বোঝা গেল, সেটা আলখাল্লার মতো একটা ধবধবে সাদা ঢিলা জামা। জামার ওপর দিকে ঝোড়ো বাতাসের তোড়ে লটপট করে উড়ছে রাশি রাশি তুলোর মতো শুভ্র লম্বা মাথার চুল ও মুখের দাড়ি! এবং সেই রাশিকৃত চুলের শুভ্রতার মাঝখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আশ্চর্য দুটো নীলাভ দীপ্তি!

বুঝতে বিলম্ব হল না লম্বা জামা পরে হনহন করে এদিকে এগিয়ে আসছে সে কোন দীপ্তচক্ষু মূর্তি! কিন্তু কেন এগিয়ে আসছে?

মূর্তি যত এগিয়ে আসে, হাওয়ার কনকনানি তত বেড়ে ওঠে, মনে হয় সর্বাঙ্গে যেন তুষারপাত হচ্ছে! তারপরেই চারিদিক ভরে ওঠে স্যাঁতস্যাঁতে কাঁচা মাটির গন্ধে! সদ্য খোঁড়া ভিজে মাটি!

কে ওই বলিষ্ঠ বুড়ো? ওকে দেখেই কি দারুণ ভয়ে বনের হিংস্র জন্তুগুলো দলে দলে ছুটে পালিয়ে যায় এবং স্তব্ধ হয়ে যায় গীতকারী পাখিদের কলরব? এবং বইতে থাকে তুহিন শীতল হাওয়া?

কিন্তু কেন, কেন, কেন?

দুটো নীলাভ দীপ্তি – দুটো জ্বলন্ত চক্ষু! ক্রুর, হিংস্র, বুভুক্ষু! মাছের চোখের মতো নিষ্পলক!

সহসা এক অজানিত বিপুল আতঙ্কে আমার সারা দেহ-মন সমাচ্ছন্ন হয়ে গেল – পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলুম, “প্রমথ! দীনেশ! পালাও, পালাও, পালাও!”

অল্পক্ষণ পরেই বনের সীমানা পার হয়ে আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে পড়লুম। আকাশে আলোর চোখ মুদে এসেছে বটে, কিন্তু রাত্রির কালিমা ভালো করে তখনও জমে ওঠেনি – সে হচ্ছে দিবানিশির রহস্যময় সন্ধিক্ষণ।

খানিক দূরে পশ্চিম দিকে দেখা যাচ্ছে ছায়া-রঙ মাখা একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ের স্তুপ।

প্রমথ সানন্দে বলে উঠল, “ওই যে জাফরগঞ্জের নবাব-বাড়ির ধ্বংসস্তুপ! চেনা জায়গার এত কাছে এসে পড়েও আমরা পথ হারিয়ে বনে বনে অন্ধের মতো ঘুরে মরছিলুম!”

নেই আর সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শ, নেই আর সেই সদ্য খোঁড়া কাঁচা মাটির গন্ধ!

দীনেশ সবিস্ময়ে হাত তুলে বলে উঠল, “দেখো, দেখো – ও আবার কি?”

দেখা গেল ধ্বংসাবশেষের বুরুজের ওপর আকাশের গায়ে জেগে রয়েছে আলখাল্লা পরা একটা দীর্ঘায়ত মূর্তি – ঝোড়ো হাওয়ায় লটপট করে উড়ছে তার মাথার লম্বা চুলগুলো! দীপ্তোজ্জ্বল নীলাভ চক্ষুর অস্তিত্ব এত দূর থেকে বোঝা গেল না।

…………………সমস্ত শুনে ডাকবাংলোর খানসামা বলল, “আগেই তো আপনাদের বেলা পড়ে এলে বনের ভেতর থাকতে মানা করেছিলুম!”

আমি বললুম, “কিন্তু তুমি কিছুই তো খুলে বলোনি!”

খানসামা মৃদু হেসে বলল, “খুলে বললে আপনারা কি তখন আমার কথায় বিশ্বাস করতেন?”

“….তোমার কথাটা কি?”

“….হুজুর, আপনারা মুবারক খাঁয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন”।

“….কে সে?”

“….জাফরগঞ্জের নবাবদের শেষ বংশধর। নবাবীত্ব ঘুচে গেছে তার পূর্বপুরুষদের আমলেই, নবাববাড়িও এখন ভেঙেচুরে একটা ইঁটের পাঁজার মতো অনেকখানি জায়গা জুড়ে পড়ে রয়েছে। মুবারক খাঁয়ের পেশা ছিল খুন-ডাকাতি-রাহাজানি। শেষটায় সে ধরা পড়ে আর বিচারে তার ফাঁসি হয়”।

“….ফাঁসি হয়? তার মানে সে আর বেঁচে নেই?”

খানসামা বলল, “না হুজুর। কিন্তু নানাজনে নানা কথা বলে। সূর্য অস্ত গেলেই মুবারক খাঁ নাকি নিজের হাতে কবরের মাটি খুঁড়ে রোজ বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেকে নাকি সাঁঝেরবেলা বনের ভেতর গিয়ে তাকে দেখে পালিয়ে এসেছে, আবার অনেকে নাকি পালিয়ে আসতে পারেনি, এমনকি তাদের লাশগুলো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি”।

খানসামা আমাদের নৈশ ভোজের ব্যবস্থা করার জন্য বাংলোর ভেতর চলে গেল। আমরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলুম।

তারপর দীনেশ হঠাৎ হো-হো করে অট্টহাস্য করে উঠে বলল, “সব ঝুটা বাবা, সব ঝুটা! বনের ভেতর গিয়ে আমরা পড়েছিলুম একটা পাগলের পাল্লায়!”

প্রমথ বলল, “আর সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা?”

“….সারাদিন ধরে যা ঝড়বৃষ্টি চলেছে। মাঝেমাঝে কনকনে হাওয়ার প্রকোপ বেড়ে ওঠাটা একটুও অস্বাভাবিক নয়”।

“….কিন্তু সেই স্যাঁতস্যাঁতে কাঁচা মাটির গন্ধ?”

“….বৃষ্টি পড়লেই মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ বেরোতে থাকে”।

“…..কিন্তু কার ভয়ে বনের সব জানোয়ারগুলো অমন করে পালিয়ে যাচ্ছিল?”

“….নিশ্চয়ই তারও কোনো সঙ্গত কারণ আছে – যা আমরা জানি না”।

আমার মতামত উহ্য রইল।

………………………………………………………………( সমাপ্ত)………………………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত