শেষ ট্রেনের আড্ডা

শেষ ট্রেনের আড্ডা

এই এই এই….

ধর….ধর….ধর….বউ-টা মাছ নিয়ে পালাচ্ছে..

এইমাত্র নৌকা থেকে নেমে পারে এসে মাছ ভাগাভাগি করার কাজে যখন ব্যস্ত ছিলো অমর সহ অমরের বাবা….তখন তাদের পেছনের হাঁড়ি থেকে মাছ নিয়ে এক মহিলা দৌঁড় দিচ্ছিলো উল্টোদিকে। অমরের বাবা আশুতোষ ঘোষ..যাকে কিনা সবাই জামাই বলে চেনে তার আগে চোখ পড়লো….সেই চিৎকার করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষক করার চেষ্টা করলো….এখন গরম কাল তবে ইদানীং বৃষ্টির প্রকোপ খুব বেড়েছে….তাইতো জেলে পাড়ার সকলের মধ্যে মাছ ধরার একটা মোহ কাজ করছে। এই বৃষ্টির দিনেই জেলের পরিমাণ বাড়ে প্রচণ্ড। তাই সেদিন ওই চোর..চোর..ডাক-টা শুনে সকলে গিয়ে জাপটে ধরেছিলো মহিলা-টাকে..

আশুতোষ বাবু অরফে জামাই বললো – এই তুই কেন মাছ নিয়ে পালাচ্ছিলিস?

ওই বউ-টা বললো – আমাকে মাছ-টা দাও আমার খুব দরকার..

জামাই – তো মাছ যখন নিবি পয়সা এনেছিস? আর কেইবা তুই তোর মুখ কেন পর্দা দিয়ে ধাকা।

ওই বউ-টা জামাই এর পা ধরে জড়িয়ে অনেক আকুতি মিনুতি করেও জামাই মাছ-টা না দিয়ে মহিলা-টাকে

তাড়িয়ে দিলেন।

এই আমি আর পারছিনা….আমি হেরে গেছি?

বাবাই,সৈকত,অমিত-দা,আকাশ এরা তিনজন-ই প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠলো। আমরা জানতাম….তুই ও

পারবিনা….আকাশ বললো।

সুজয় – নে আমিও হেরে গেছি….এবার তোদের শান্তি….

অমিত-দা – যাক বাবা বেঁচে গেলো, আমাকে আর স্টেশনে নেমে কাউকে খাওয়াতে হবেনা।

ঠিক তখনি মাঝখান দিয়ে বাবাই বলে উঠলো। আরে অমিত-দা এতো খুশী হয়ে লাভ নেই। এখনো একজন

বাকি আছে?

অমিত-দা – কে?

বাবাই – ওইযে মলয়….দাঁড়াও ওকে ডাকছি। যদি ও জিতে যায়। মানে তোমার বানানো সারসংক্ষেপ দিয়ে যদি পুরো গল্পটা বলে দেয়। তাহলে কিন্তু আমাদের সকল-কে ঘুগনি হোক, কিংবা একটা সিদ্ধ ডিম দিয়ে চারটে পরোটা খাওয়াতেই হবে।

অমিত-দা – যেটা কথা দিয়েছি, কথা..তবে মনে রাখতে হবে….ওই জেলের ছেলে যাতে মরে যায় এমন ভাবে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বাবাই – আচ্ছা দাঁড়াও….আমি ডেকে আনছি….এই বুঝি ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে আমার বসার জায়গা-টা রেখো? আমি আসছি ওকে ডেকে।

বাবাই সামনের সিটের দিকে এগিয়ে গেলো….তারপর।

ওই মলয়।

আমি – হুম বল।

বাবাই – শোন-না ভাই অমিত-দা কে অনেকদিন পর বাগে পেয়েছি। দাদা একটা সারসংক্ষেপ বলে দিয়েছে….ওই সারসংক্ষেপ অনুযায়ী গল্প বলে শোনাতে পারলে দাদা স্টেশনে নেমে যাই পারুক সকল-কে খাওয়াবে। আমরা সবাই চেষ্টা করলাম। আমি,সৈকত,আকাশ,সুজয় এরা সবাই চেষ্টা করলাম পাড়লাম না। সুজয় তাও চেষ্টা করলো কিছুটা কিন্তু পারলোনা। এখন তুই পারবি ভাই….প্লিজ চল ভাই।

আমি – ধর এখন ভালো লাগছেনা। আমার ঘুম পাচ্ছে ভাই। তুই যা না ভুজুংভাজুং বলে ব্যাপার-টা মিটিয়ে দে….

বাবাই – প্লিজ চল,
আমি তোকে আমার ভাগের থেকে কিছুটা হলেও খাওয়াবো। শিওর।

আমি – সত্যি বলছিস?

বাবাই – হ্যাঁ একদম।

আমি – ওকে চল। গল্পটা কিরকম কি বলেছিলো?

বাবাই – আরে তুই নতুন ভাবেই বল-না।

আমি – না ভাই, সুজয় কতদূর বলেছে বল….

বাবাই – জামাই ওই মহিলা-টাকে তাড়িয়ে দিলেন।

আমি – বাকি-টা অমিত-দার কাছ থেকে শুনবো।

বাবাই – এই দেখো আমাদের লেখক।

অমিত-দা – মলয় একটা সারসংক্ষেপ আমি বলে দিচ্ছি সেই অনুযায়ী একটা গল্প বলো….কিন্তু হ্যাঁ গল্পের শেষ পরিণতি হিসেবে কিন্তু একটা ভয়ানক মৃত্যু হয়।

আমি – আচ্ছা বলো…..
অমিত দার মুখে সারসংক্ষেপ শুনে বলতে লাগলাম। আসলে আমরা রোজ শেষ ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরি। তাই আড্ডাটাও জমে যায় সেভাবে। ট্রেন সবে ব্যারাকপুর থেকে ছেড়েছে। আমি সুজয়ের শেষ লাইন-টা দিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করলাম।

দেখো আমার ভুলভ্রান্তি হতেই পারে….হলে মাপ করো। এই বলে শুরু করলাম।

আশুতোষ বাবু..যে কিনা পেশায় জেলে লোকমুখে জামাই নাম-টা প্রচলিত। তো ওই জামাই যখন ওই মহিলা-টিকে মাছ না দিয়ে মাছ-টা ওই মহিলা-টার হাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে নদীর পাড়ের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। তখন ওই মহিলা-টা জামাই এর থেকে মাছ-টা কেড়ে নিয়ে দৌঁড় দেয়। সেই দেখে….

জামাই – এতো বহুত দজ্জাল মহিলা….আশেপাশে যে যতো পারলো বাঁশের লগা, কঞ্চির লাঠি দিয়ে দৌঁড় দিলো ওই মহিলা-টার দিকে। সারাদিন তীব্র গরম, আর রাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তখন মাঝরাত হলেও….নদীর পাড়ে জেলে সংখ্যা এতো ছিলোযে যার ফলে মনে হচ্ছিলো এটা মাছের বাজার।

সকলে গিয়ে দৌঁড়ে ওই মহিলা-টাকে ধরলো আগে দু-চার ঘা কষিয়ে সপাৎ সপাৎ করে কষিয়ে বাঁশের বাড়ি মারলো ওই মহিলা-টাকে। চাঁদের আলো তখন মেঘে ঢাকা পড়েছে। নদীর আশেপাশের জঙ্গল থেক্র বিভিন্ন ব্যাঙ গুলো নানান স্বরে আর্তনাদ করছে। পরিবেশ-টাকে ক্ষণিক ক্ষনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিলো ক্রমাগত আঘাত প্রাপ্ত ওই মহিলার দেহ-টি যখন মাটিতে পড়ে গেলো। একটা মৃদু আওয়াজ কানের মধ্যে দিয়ে দুইভাগে ভাগ হয়ে একভাগের আওয়াজ গেলো সোজা হৃদয়ের দরজা পর্যন্ত আর এক ভাগের আওয়াজ গেলো রক্তের প্রতি বিন্দু বিন্দু পর্যন্ত।

সকলের মনে রাগ থাকলেও একটা বিষণ্ণতার ছাপ বউ-টা মারা গেলো না তো। জামাই ওই বউ-টার মুখের ঘোমটা খুলে ওই অন্ধকারের মধ্যে যা বুঝলো বউ-টার মুখ শুকনো….হয়তো কয়েকদিন খেতে পাইনি। কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিলো।

যাক বাবা..বেঁচে আছে।

এই চল চল সবাই মাছ-টা নিয়ে। এই বলে জামাই ওদের কে নিয়ে এগোতে লাগলো। মাটিতে আঘাত প্রাপ্ত ওই বউ-টা বলে উঠলো ” কাজ-টা ঠিক করলি না, তোকে পস্তাতে হবে ”

জামাই ব্যাপার-টা এড়িয়ে গেলো। জামাই মানে আশুতোষ বাবু বাজারের নাম করা জেলে তাই তার প্রচণ্ড ঘ্যাম। আর নদীতে একমাত্র সেই ৮-৯ ঘন্টা সময় নিয়ে মাছ ধরে। রাত প্রায় দু-টো বাজে। তখনো কিছু জেলে আছে। জামাই আরও একবার জাল ফেলতে চায় নদীতে। নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে,তার ছেলে,আর দুইজন মতন। নৌকা-টাও বেশ বড়ো ছিলো।

নৌকা-টা নদীর একটা নির্জন পাড় থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে যাওয়ার পর মোটামুটি একটা জায়গাই জাল-টা যখন শেষের পর্যায় এসে যায়। তখন নৌকা-টা পাড়ের দিকে ঘোরানো হয় তো হঠাৎ জাল-টা আটকে যায় কিছুর সাথে। এদিকে নৌকায় যারা ছিলো তারা সবাই নেমে গেছে। তারা জালের বাকি অংশের কার্য পর্যবেক্ষণ করছে। নৌকা-তে শুধু অমর আর তার বাবা। হঠাৎ ওই জালে কিছু একটা ফাঁসে, কারণ ওই জাল-টা ক্রমশ নিচের দিক থেকে একটা টান অনুভব করছিলো। জামাই তার ছেলেকে বলে শীগগির নীচে নাম জাল-টা বোধহয় কিছুর সাথে আটকে গেছে।

বাবার কথামতো কাজ। ছেলে সাথে সাথে জলে নামে কিন্তু ছেলে আর।উপরে উঠে আসেনা। তিন-চার মিনিট সময় পার হওয়ার পর ছেলে-কে উপরে আসতে না দেখে তার বাবা চিৎকার জুড়ে দেয়। আশেপাশের নৌকা গুলো তার দিকে এগিয়ে আসে, তার চিৎকার শুনে।

জামাই তাদের সবাই-কে বলে যে তার ছেলে আর উঠে আসছেনা। সেই জলে নেমেছে কখন। জামাই এর নামডাক আছে প্রচুর। তাই তাকে খুশি করবার সুযোগ খোঁজে সবাই। এই সুযোগ-টাও হাত ছাড়া করলোনা অনেকে।

তারা সকলে জলে ঝাঁপ দিয়ে জামাই এর ছেলে অমর-কে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অমর-কে তারা আর পায়না। এরপর অনেকবার খোঁজাখুঁজি করেও অমর-কে আর খুঁজে পাওয়া গেলোনা।

শেষে বাধ্যহয়ে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন জামাই। ভোর রাত। জামাই এর বউ তখন ঘুমাচ্ছে। নদী থেকে তার বাড়ি অনেক দূরে। নদী আলাদা পথে, আর তার বাড়ি আলাদা পথে। বাড়ি এসে জামাই চুপচাপ বউ এর পাশে শুয়ে পড়ে। বউ-কে ব্যাপার-টা জানায় না সে। জামাই ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। জামাই এর ঘুম ভাঙে পরেরদিন সকাল বেলায়। তার বউ এর চিৎকার শুনে। জামাই বউ এর চিৎকার শুনে বাইরে বেড়িয়ে আসে। চিৎকার – টা বাড়ির পেছন থেকে আসছিলো। জামাই সেখানে গিয়ে চমকে উঠলো, জামাই এর বাড়ির পেছনের ডোবা-টা জলে ভরে উঠেছিলো এই কয়েকদিনের বৃষ্টিতে। সেই ডোবাতে জামাই দেখলো তার ছেলের মৃতদেহ অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ততক্ষণে আশেপাশের লোকজনেরা সেইখানে এসে উপস্থিত হয়। সকলে জামাই এর ছেলের এই অবস্থা দেখে জামাই এর ছেলে-কে জল থেকে টেনে তোলে….তখন একটা অবাক করার বিষয় চোখে পড়ে সবার। ওই মৃতদেহ-টার পুরো শরীর মাছের আঁশ জাড়ানো। এই রকম-টা দেখে ওখানে সকলেই অবাক হয়। কিভাবে সম্ভব একটা ছেলে নদীতে তলিয়ে গেলো তার দেহ-টা কিভাবে তার নিজের বাড়ির ডোবাতেই পাওয়া গেলো তাও আবার অর্ধেক খাওয়া, আঁশ জড়ানো অবস্থায়।

অমর মরে যাওয়ার পর এক মাস হয়ে গেছে। জামাই রোজ রাতে একটাই স্বপ্ন দেখে। জামাই দেখে ওই সেই মহিলা-টা তার স্বপ্নে আসে..আর এসে বলে..ছেলেকে তো নিয়ে গেছি, এবার কি বউ-টাকেও নিয়ে যাবো?

নাও আমার গল্প শেষ। আমি সামনের সিটে গেলাম। আমার বান্ধবী মেসেজ করেছে আমি চললাম। আর হ্যাঁ স্টেশনে গিয়ে কিন্তু খাওয়া-তেই হবে নাহলে….অমিত -দার গার্লফ্রেন্ড-কে অমিত -দাদার নিকনেম-টা বলে দেবো।

অমিত-দা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বুঝলাম আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে আমাদের উপর। তাই আর দাদা-কে বিরক্ত না করে উঠে এলাম।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত