অভিশপ্ত রাত

অভিশপ্ত রাত
ঘটনাটির সাক্ষী আমি আর আমার এক সমবয়সী কাকা।সময়টা ছিল ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের কোন এক গরমের রাত। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি বিশাল বিল।
রাতে জেলেরা সেই বিলে মাছ ধরত, মাঝে মাঝে শখের বসে আমরাও মাছ ধরতে যেতাম।সেদিন সন্ধায় কাকা আমাকে এসে বলল “বিলে খুব মাছ যাচ্ছে যাবি নাকি আজ মাছ ধরতি?
আমি বললাম “চল যাই, মেলা দিন মাছ ধরতি যাওয়া হয়না।

কাকা বলল “তাহলে তুই রেডি থাকিস ১১ টার দিকে আমি ডেকে নিয়ে যাবনে”
পূর্নিমা রাত;শুল্কপক্ষের এই সময়টাই চাঁদ যেন তার সমস্ত আলো পৃথিবীর বুকে ঢেলে দেয়। রাত আনুমানিক ১১ টার দিকে কাকা আর আমি একটা নৌকা নিয়ে বের হলাম।কাঠের তৈরি মাছ ধরার ডিঙি নৌকা। সঙ্গে নিলাম মাছ ধরার জাল,টর্চ আর বর্শা (এক প্রকার মাছ ধরার যন্ত্র যেটা বাশের আগায় লোহার চিকন ধারালো
ফলা বেধে মাছের গায়ে গেথে দিতে হয়)।

নৌকা নিয়ে আমরা বিলের মাঝামাঝি এসে পানিতে টর্চ ফেলে খুব আস্তে আস্তে মাছ খুঁজতে লাগলাম। আমি বৈঠা মারছি আর কাকা নৌকার মাথায় এক হাতে টর্চ আর অন্যহাতে বর্শা নিয়ে স্থিরভাবে পানির দিকে তাক করে রইল।
হঠাত ঘুপ করে একটা শব্দ।
“নাহ মাছটা গাততি পারলাম না রে” কাকার কন্ঠে হাহাকার।

তারপর বর্শাটা পানির উপর তুলে আবার চলতে
লাগলাম। আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে একটু দূরে বোয়াল মাছ দ্রুত চলে গেলে যেমন পানিতে ঢেউ খেলে এরকম ঢেউ খেলে যাচ্ছিল।
আমি অনেক বার লক্ষ্য করছিলাম কিন্তু কাকাকে বলিনি।

হঠাৎ কাকাই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল “নৌকা ওইদিকে ঘোরা তো মাছ ওইদিকে বেশি নড়াচাড়া করছে।
আমিও নৌকা ঘুরিয়ে ঐদিকে নিয়ে এলাম আবার ঘুপ করে শব্দ।
নাহ আবারো ফসকে গেল।
কাকা বলছে মাছের গায়ে গেথে যাচ্ছে কিন্তু বর্শা উচু করলে মাছ নেই।
অবাক হলাম দুইজনই।
এরকম তো আগে কখনো ঘটেনি।

চাঁদের আলোয় চারপাশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল যখন আমরা বর্শাটা উচু করছি আমাদের পাশ দিয়ে মাছের ঢেউ দ্রুতবেগে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। আমার একটু ভয় ভয় করছিল কিন্তু কাকা ছিলেন ভীষন সাহসী।

আমি বললাম “কাকা চল বাড়ি যাই আজ আর মাছ ধরব না। কাকা বলল “এই মাছটা না ধরে যাব না;আমি পানির নিচে দুইবার দেখেছি বিশাল বড় মাছ,
একে ধরতে পারলে কাল সবাই আমাদের নাম করবে যে আমরা এতবড় মাছ ধরেছি।

কাকাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আমিও আপনমনে নৌকায় বৈঠা মারতে লাগলাম। হঠাৎ কাকা আমাকে আংগুল মুখে চেপে শব্দ করতে নিষেধ করল।
আমিও বৈঠা পানির উপর তুলে ফেললাম। পিনপতন নীরবতা। নিজের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিনা।

হঠাৎ কাকা বর্শা পানিতে ছুড়ে মারল। কেমন যেন আর্তনাদ শোনা গেল। কাকা খুশিতে আত্মাহারা “এবার ঘেঁথেছি রে…..

আমার খুব ভয় লাগছিল আর মনে হচ্ছিল আচ্ছা
কাকা কি আর্তনাদ শুনেছে? তারপর কাকা আস্তে আস্তে বর্শা পানি থেকে টেনে নৌকার উপর তুলল, হঠাৎ জোস্নার আলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদটার উপর হঠাত কোথা থেকে এক খন্ড মেঘ এসে ভর করল।
চারিদকে নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
আমার আর কাকার চোখ ভয়ে আতংকে বিষ্ফোরিত।

নৌকার পাটাতনের উপর তখনও গেথে রয়েছে ৩ বছর বয়সী শিশুটির নিষ্প্রাণ দেহটি।
আমি আর কাকা ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।
কারো মুখে টু শব্দটা পর্যন্ত নাই।
হঠাৎ আবার চাঁদের আলো ফিরে এলো, ফ্যাকাশে বর্ণের বাচ্চাটিকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক আগে পানিতে ঢুবে মারা গেছে।

গায়ে শেওলার প্রলেপ দেখে বোঝাই যাচ্ছিল
পানিতে ঢুবে ছিল ৩/৪ দিন। কাকার চোখ হঠাত গেল শিশুটির পায়ের উপর, হ্যাঁ প্রথমবার তো বর্শাটা মাছের লেজের দিকে লেগেছিল পরেরটা বুকের দিকে।
আশ্চর্য শিশুটির পা এবং বুকে বর্শার চিহ্ন।
দেখে মনে হচ্ছে কিচ্ছুক্ষণ আগেই কেউ বর্শা দিয়ে আঘাত করেছে।

আরো আশ্চর্য হলাম শিশুটির শরীর থেকে কোন রক্ত বের হচ্ছেনা অথচ বর্শা শরীরের এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বের হয়ে গেছে।
আমি নীরবতা ভেঙে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম “কাকা এখন কি করবা?

কাকা কোন উত্তর না দিয়ে শিশুটির পুরো শরীর গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তারপর বলল “চল পাড়ে নিয়ে যাই”। কাকার কথামতো শিশুটিকে পাড়ে নিয়ে আসলাম।

গ্রামের কয়েকজন লোক এবং মসজিদের ইমামকে এনে সেই রাতেই শিশুটিকে দাফন করা হলো গোরস্থানে।
উল্লেখ্য আমাদের বিল দিয়ে উজানের অনেক গ্রামের পানি বয়ে যায়।
ইমাম সাহেব ঘটনা শুনে বলল “নিশ্চয় উজানের গ্রামের কোন শিশু পানিতে ঢুবে মারা গেছে এবং লাশ স্রোতে ভেসে এসেছে।
কিন্তু মাছের গায়ে বর্শা ঘাঁথা আর সেই বর্শার দাগ কিভাবে শিশুটির গায়ে দেখা গেল এই বিষয়ে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেন নি।

এটা আজো আমাদের কাছে রহস্য হয়ে আছে। যাই হোক তারপর আমি আর কাকা কেউই আর কখনো রাঁতে মাছ ধরতে যায়নি।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত