একদৃষ্টিতে পুরোনো শিব মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। অমাবস্যার অন্ধকারে আরো যেন বীভৎস সুন্দর হয়ে উঠেছে মহাকালের এই প্রাচীন পীঠস্থান।
আজও অতীতের এক জীবন্ত অভিশাপের রূপ নিয়ে গ্রামের এক নির্জন প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন অট্টালিকা।
ছোটবেলা থেকে কতশত গল্প যে শুনে এসেছি একে নিয়ে। শোনা যায় এই মহাকালের উপাসী ছিল নৃশংস ডাকাতের দল। যুগের পর যুগ ধরে এর সেবকেরা রাখালের বেশে নিয়ে গিয়ে বলি দিতো হতভাগ্য যাত্রীদের। সরল মানুষগুলির যখন প্রাণের ভয়ে অন্তিম আর্তনাদ করে উঠতো, তখন তার উত্তরে সেই নরপশুদের বিকৃত অট্টহাসি ধ্বনিত হত এই হত্যাপুরীর প্রতিটি পাষাণে।
পূর্ণিমা বা অমাবস্যার গভীর রাত্রে সেই রক্ত জল করা হাসির আওয়াজে ভয়ে কেঁপে উঠতো আশে পাশের পাঁচটি গ্রামের মানুষ।
কিন্তু কালের চক্রে সেই সমস্ত বীভৎসতাকে সাথে নিয়ে আজ তারা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের গর্ভে!
কিন্তু সত্যি কি তাই ?
গ্রামবাসীরা কিন্তু আজও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে এই নির্জন ভাঙা মন্দিরকে, তাদের বিশ্বাস ইতিহাসের পাতা থেকে ফিরে আসা সেই নরহত্যাকারীদের প্রেতাত্মারা নাকি আজো পাহারা দেয় তাদের ইষ্টের আশ্রয়ে যুগ যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনকে।
সত্যি কি মিথ্যে তা স্বয়ং মহাকালেরই একমাত্র জানা, কিন্তু আজকের দিনেও সূর্যাস্তের পর এর ত্রিসীমানায় আসতে সাহস পায়না গ্রামবাসীরা।
“বাবু , কি করতেসেন এইখেনে ?”
চমকে তাকিয়ে দেখলাম একটা অদ্ভুত হাসি মুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে পাগলাটে চেহারার মাঝবয়সী একজন মানুষ।
এতো রাতে কোথা থেকে এলো এ ?
গ্রামবাসীরা তো কেউ এই মন্দিরের পাশও মাড়ায়না!
তাহলে একে ?
ভাঙা স্বরে প্রশ্ন করে উঠলাম আমি “কে তুমি? কি করছো তুমি এতো রাতে এই মন্দিরে? গ্রামের লোকেরা তো শুনলাম কেউ দিনের বেলাতেও এর ধারে কাছে আসেনা। ”
একটু হেসে কাঁপা স্বরে বলে উঠলো মানুষটা ,”হেইখানেই যে আমারে আসতেই হয় বাবু, সোনার গন্ধ যে আমারে টেনে আনে বাবু। এতো বছর ধরে যে শুধুই খুইজ্যা গেছি তারে। ”
হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি তার দিকে। ‘সোনা ? তার মানে তবে গুপ্তধনের সন্ধান কি সত্যি পেয়েছে এই লোকটা ?’
মৃদু স্বরে বলে উঠলাম “পেয়েছো কিছু খুঁজে?”
একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলে উঠলো লোকটি “পেয়েছি, এতোদিন পর শেষমেশ পেয়েছি। দ্যাখবেন আসুন। ”
মন্ত্রমুগ্ধের মতন ওর পিছন পিছন এসে দাঁড়ালাম। মন্দিরের আরো ভেতরে এক এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। অন্ধকার যেন ক্রমশ আরো আরো গভীর আরো নিকষ হয়ে উঠেছে, এক অজানা আহ্বানে যেন আমাদেরকে নিজের গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এই ভাঙা অট্টালিকা।
প্রায় সম্মোহিতের মতন লোকটার পদধ্বনি কে অনুসরণ করে অবশেষে মন্দিরের গর্ভগৃহে এসে পৌঁছলাম আমি।
কোনো মতে একটা ভাঙা স্বরে চীৎকার করে বলে উঠলাম ” এ কোথায় নিয়ে চলেছো তুমি আমাকে ? কোথায় ,কোথায় তোমার সোনা ?”
একটু অদ্ভুত বিকৃত হাসি ঠোঁটে নিয়ে ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো লোকটা “এই তো বাবু , এসে গেছি আমরা। আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বরাবরের মতন পেয়ে যাবেন গো আপনি। দ্যাখেন”
মন্দিরের গর্ভগৃহে একটা বিশেষ পাথরে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর হাত , আর তার সঙ্গেই বহু , বহু যুগ পরে খুলে যাচ্ছে এক বন্ধ অধ্যায়। ………..
কিন্তু সত্যি কি তাই ?
লোকটা তাহলে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে কেন ? কোন আতঙ্কে ওর সারা শরীর ঠান্ডা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে ?
একটা জমাট অন্ধকার যেন একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। শত চেষ্টাতেও যেন সে আর এক পাও পিছিয়ে যেতে পারছেনা। গর্ভগৃহের কালো অন্ধকার চিরে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ছিটকে বেরিয়ে এলো এই পাষানপুরীর বুকে আর পরের মুহূর্তেই কয়েক শতাব্দীর ধারা মেনে কাল ভৈরবের সামনে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো একটা রক্তের সরু রেখা।
বহু বছর পর অবশেষে আমার অট্টহাসি আবার ধ্বনিত হলো আমার ইষ্টের সেবালয়ের প্রতিটি পাষানের বুকে। আজকের মতন আমার দায়িত্ব এবার সম্পূর্ণ ,
সব কাহিনীই মিথ্যে হয়না। নিজের ইষ্টের সম্পদ রক্ষার্থে আজও অতন্দ্র প্রহরায় জাগ্রত তার সেবকেরা।…
…………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………