বায়ান্ন বাজারের তিপ্পান্ন গল্প

বায়ান্ন বাজারের তিপ্পান্ন গল্প

ভরসন্ধ্যায় সহিদের অট্টহাসিটা পাশের গলি পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। এলোমেলো চুল, পায়ে জীর্ণ স্যান্ডেল নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এককালের জিগরি দোস্ত রন্টু।
‘কী করবি তুই? কারে মারবি?’
কানের পাশে জুলফি মোচড়াতে লাগল সে। এই সহিদ যখন হাফপ্যান্ট পরে পাড়ার মাঠে ফুটবলে লাথি মারত, তখন সে অন্য পাড়ার ছেলেদের ঠ্যাঙাত। ওর কাছেই প্রথমে রিভলবার দেখে সহিদ। তারপর একদিন ওর কাছেই এসবের হাতেখড়ি।
‘কথা কস না ক্যান?’
উঠতি বয়সের এক ছোকরাকে আসতে দেখে চুপ মেরে গেল রন্টু। সহিদকে লম্বা করে সালাম দিয়ে চলে গেল ছেলেটা। আলতো করে কেবল মাথা দোলাল সে, এখন আর শব্দ করে সালামের জবাব নেয় না। সারা দিন অসংখ্য সালাম পায়।
‘কারে মারবার চাস?’
‘কাউরে মারনের লাইগা চাইতাছি না।’
সন্দেহের দৃষ্টিতে বাল্যবন্ধুর দিকে তাকাল সহিদ। রন্টু এখন ছিঁচকে মাস্তানি আর টুকটাক চাঁদাবাজি করে বেড়ায়।
‘আমারে ওইটা দে…খোদার কসম, রাইতেই জিনিসটা রিটার্ন দিমু।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সহিদ। রন্টুর হাত ধরে সে এই লাইনে এলেও আজ তার সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব। দুই বছর আগে স্বৈরাচারের পতনের পর জায়গামতো একে-ওকে ধরে সরকারি দলে ঢুকে পড়ে সে, বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই এলাকায় সবচেয়ে বড় নেতা হয়ে ওঠে।
‘আমারে বিশ্বাস কইরা পুরা ঘটনা না কইলে তুই একটা গুল্লিও পাবি না।’
সহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রন্টু, ‘বিশ্বাস তো করছিলাম একবার।’
কথাটা বুঝতে একটুও বেগ পেল না সহিদ। বছর তিনেক আগে এই রন্টু খোঁজ দিয়েছিল, ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণের এক ভেন্ডার জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করে। সহিদ তখন একটি ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার। তার বন্দুক চালানোর দক্ষতা কিংবদন্তিতুল্য। রন্টুর কথামতো জাল স্ট্যাম্প বিক্রেতাকে গিয়ে ধরল সে। কাজও হলো, কিন্তু বন্ধুকে এককালীন তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, ফিরোজকে যেন আর ডিস্টার্ব না করে। রন্টুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ফিরোজের সঙ্গে একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল তার জিগরি দোস্ত।
সহিদ তিক্তমুখে বলল, ‘বিশ্বাস না করবার পারলে ফোট!’
‘আমি যদি তর কোনো উপকার কইরা থাকি, তাইলে আমারে ওইটা দে।’
‘কইলাম তো, পুরা কাহিনি না কইলে গুল্লিও পাবি না।’
রন্টু তার চিরাচরিত হতাশার প্রকাশ ঘটাল এক হাতের মুঠি দিয়ে আরেক হাতের তালুতে জোরে জোরে আঘাত করে।
ছোটবেলা থেকেই রন্টুর আচার-আচরণের মধ্যে একটু বেশি মাত্রায় নাটকীয়তা আর বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলার প্রবণতা আছে। তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই, আছে শুধু চাপার জোর।
‘আমি যদি ঘটনাটা কই, তাইলে তুই আমার লগে বেইমানি করবি নাতো?’
সহিদের কপালে ভাঁজ পড়ল। ‘কী এমন ঘটনা যে, বেইমানির কথা উঠতাছে?’
নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রন্টু, ‘গালকাটা ইকবাল…আলিম ভাই…এয়ারপোর্ট…বিস্কুট…মনে আছে তোর?’
অন্য অনেকের মতো এই গপ্পটা সহিদ জানে। এই গল্পের সবচেয়ে বড় কথক রন্টু নিজেই। গালকাটা ইকবাল নিজেই নাকি গল্পটা বলেছে তাকে।

একটু আগে রন্টুকে তার সোনালি রঙের পিস্তলটা দিয়ে দিয়েছে। কথামতো রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ঘটনা ঘটবে, কিন্তু পৌনে নটা বেজে গেলেও রন্টুর দেখা নেই। অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছে তার মনে

সাতাত্তর-আটাত্তর সালের দিকে এই এলাকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিল আলিম ভাই, তার ডান হাত গালকাটা ইকবাল একদিন জানাল, তার কাছে পাকা খবর আছে, সন্ধ্যার দিকে কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট থেকে স্বর্ণের একটি চালান ঢুকবে তাঁতিবাজারে। সম্ভবত স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদের কারণে খবরটা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ব্রিফকেস-ভর্তি স্বর্ণে বিস্কুটের কথা শুনে আলিম ভাই নড়েচড়ে ওঠে। একটা প্রাইভেটকার নিয়ে তারা দুজন ওত পেতে থাকে এয়ারপোর্টের বাইরে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখতে পায়, প্রতিপক্ষ নিত্যানন্দ গ্রুপের সবচেয়ে বড় দুই ক্যাডার একটা জিপ নিয়ে হাজির। দৃশ্যটা দেখে আলিম ভাই রেগে গেলেও গালকাটা ইকবাল জানায়, এতে বরং সুবিধাই হয়ে গেল। তাদের আর কষ্ট করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর হাত থেকে ব্রিফকেসটা ছিনিয়ে নিতে হবে না। কাজ সেরে নিত্যানন্দ গ্রুপের ক্যাডার দুজন যখন মহা আনন্দে পুরান ঢাকায় ফিরছিল, তখন তাদের পথরোধ করে ইকবাল। মাত্র একটা পিস্তল হাতে নিয়ে স্বর্ণের ব্রিফকেসটা ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে দুজনকে। এই ঘটনার দুই বছর পর আলিম ভাই রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে হয়ে ওঠে বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী। প্রতিটি ঐশ্বর্যের পেছনে যে একটি অপরাধ থাকে, এই গল্পটা তার আরেকটি প্রমাণ।
‘তুই কী কইবার চাস?’ অনেকক্ষণ পর বলল সহিদ।
‘আমার কাছে পাক্কা খবর আছে, আইজকা আটটার পর একটা চালান ঢুকব।’
বন্ধুর দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সহিদ, ‘কয়জন থাকব?’
‘একজনই।’
চমকে উঠল সহিদ, ‘একজন!’—তার কাছে অবশ্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিকও মনে হলো না। স্মাগলাররা একেবারে মামুলিভাবে মালামাল বহন করে, যাতে সন্দেহের সৃষ্টি না হয়।
‘ইলিগ্যাল মাল…হালার পুতে চিল্লাইবারও পারব না। আরামসে কামটা করন যাইব।’
‘তুই একলা করতে পারবি?’
আবারও মাথা ঝাঁকালো রন্টু, হাতে পিস্তল থাকলে আমি কী করবার পারি, তুই তো জানোসই।’
সহিদ এটা জানে। কিন্তু সেসবই অতীতের কথা। এখন যে রন্টু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে নেশাখোর, ছিঁচকে মাস্তান, চিটিং-বাটপারি করে বেড়ানো একজন।
‘তুই কেমনে বুঝবি কোন লোকটা ক্যারি করতাছে?’
মুচকি হাসল রন্টু। ‘ক্যারিয়াররে আমি চিনি।’
‘কে?’
‘এইটা কইয়া দিলে আর থাকে কী?’
সহিদ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, ‘আচ্ছা, এক শর্তে দিবার পারি…’
‘কী শর্ত?’
‘ফিফটি আমার ফিফটি তোর।’
রন্টু বন্ধুর দিকে চেয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে সোজা উল্টো দিকে হাঁটা ধরল।
‘কই যাস…খাড়া!’ বন্ধুর পেছন পেছন কয়েক পা এগিয়ে গেল সে, ‘খাড়া কইতাছি!’
ঘুরে দাঁড়াল রন্টু, ‘লালচটা একটু কমা…বুঝলি,’ তর্জনী আর বুড়ো আঙুল এক করে পরিমাণটাও দেখিয়ে দিল সে, ‘তুই তো সব পাইছস…নেতা হইছস, বিয়া করছস…আইতে যাইতে মানুষ তরে সেলাম দেয়। আর কী চাস?’
সহিদ কিছু বলল না।
‘একটা দান মারবার চান্স পাইছিলাম, মাগার তুই এইহানেও খাবলা মারবার চাস।’
‘ঠিক আছে, তুই ষাইট আর আমি চল্লিশ?’
রন্টুর ঝাঁকড়া চুল দুলে উঠল, ‘একটা পিস্তল দিয়া হেল্প কইরা তুই এতগুলান বিস্কুট কেমনে চাস?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সহিদ নতুন প্রস্তাব দিল, ‘আমিও থাকলাম তোর লগে…আমার মোটরসাইকেল আছে। চল, দুই বন্ধু মিলা কামটা করি?’
‘এইটা সম্ভব না।’
‘ক্যান?’
‘তুই এই এলাকার নেতা…সবতে তরে চিনে। ওই ক্যারিয়ার তরে দেখলেই উল্টা দিকে লোড় মারব।’
মনে মনে সায় না দিয়ে পারল না সহিদ। তাকে এই এলাকার ছেলে-বুড়ো—সবাই চেনে। আর অপরাধজগতে তার চেহারাটা একটু বেশিই পরিচিত।
‘ঠিক আছে, আমি মোটরসাইকেল নিয়া একটু দূরে থাকলাম, কাম হওনের পর তুই আমার কাছে আয়া পড়বি?’
থুতনি চুলকে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল রন্টু।
‘গালকাটা ইকবাল কইলাম চোরের ওপর বাটপারি করছিল,’ আগের গল্পটার কথা স্মরণ করিয়ে দিল তাকে, ‘তর লগেও তো এই রহম কিছু অইবার পারে?’
‘এই চালানের খবর আমি ছাড়া কেউ জানে না।’
‘তার পরও কোনো গ্যারান্টি নাই…কহন কী হয়া যায়?’
সহিদের কথা একটু ভেবে দেখল সে, ‘ঠিক আছে, তুই বাইক লইয়া ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থাকবি। কামটা আমি একলাই করুম। ব্যাগটা লইয়াই আমি তোর কাছে আয়া পড়ুম।’
‘তুই কই থাকবি?’ সহিদ জানতে চাইল।
‘শাঁখারী বাজারে ঢুকনের রাস্তায়…’
‘ঠিক আছে।’
‘তয় ফরটি-সিক্সটি না। থার্টি-সেভেনটি হইলে আছি।’
মনে মনে হেসে উঠল সহিদ। জিনিস একবার হাতে আসার পর দরদাম উল্টে দেওয়া যাবে, ‘তোর কথাই সই।’

২.
অপেক্ষারত তিন যুবক রন্টুকে ঘরে ঢুকতে দেখে নড়েচড়ে বসল। এদের মধ্যে সজল নামের ছেলেটার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।
কোমর থেকে একটা সোনালি রঙের পিস্তল বের করে দেখাল রন্টু।
অস্ত্রটার দিকে অবিশ্বাস্যে চেয়ে রইল সজল। কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল বাড়িয়ে দিল, ‘জায়গামতোই আছে?’
‘হ’, পিস্তলটা কোমরে গুঁজে টাকাগুলো পকেটে ভরে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল রন্টু।
৩.
সহিদ তার বাইকটা রেখে দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। অস্থিরতায় বারবার হাতঘড়ি দেখছে সে। অস্ত্র ছাড়া নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। তার শত্রুর সংখ্যাও কম নয়।
একটু আগে রন্টুকে তার সোনালি রঙের পিস্তলটা দিয়ে দিয়েছে। কথামতো রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ঘটনা ঘটবে, কিন্তু পৌনে নটা বেজে গেলেও রন্টুর দেখা নেই। অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছে তার মনে। কেন জানি মনে হচ্ছে, নেশাখোর রন্টু তাকে টোপ দিয়ে দামি পিস্তলটা বাগিয়ে নিয়েছে। এখন সস্তা দরে বিক্রি করে নেশার টাকার জোগাড় করবে। কিন্তু এ কাজটা করে রন্টু যে বিরাট বড় একটা বোকামি করছে, সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
ঠিক এমন সময় তার দিকে আসতে থাকা একটি বাইকের দিকে চোখ গেল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল, রন্টু নয়, বোকামি করেছে সে নিজে।
সহিদ কোনো কিছু করার আগেই বাইকের পেছনে বসা ছেলেটা তার দিকে পিস্তল তাক করে ফেলল।
পাঁচটা গুলির মধ্যে প্রথম দুটো গুলির শব্দ শুনতে পেল সে।
তারপর সব অন্ধকার।

৪.
নিজের ঘরে খিড়কি দিয়ে খাটের নিচ থেকে একটা ট্রাঙ্ক বের করে আনল রন্টু। বিশ বছর ধরে পড়ে থাকলেও পিস্তলটা একদম নতুন দেখাচ্ছে। সহিদের মৃত্যুর পর ঠিক করেছিল, পিস্তলটার কথা সবাই ভুলে গেলে বিক্রি করে কিছু কামাবে। তারপর বেশ কয়েকবার বিক্রি করার কথা মাথায় এলেও কেন জানি করা হয়নি। তার কাছে মনে হতো, এই পিস্তলটা বিক্রি করে দিলে সে নিঃস্ব আর অক্ষম হয়ে যাবে। ট্রাঙ্কের ভেতরে রাখা এই অস্ত্রটাই তার শেষ আত্মবিশ্বাস হিসেবে কাজ করেছে এতগুলো বছর। আর এভাবেই বিশটি বছর পার হয়ে গেছে কেমন করে টেরই পায়নি।
বেশ দেরিতে বিয়ে করেছে সে। তার একমাত্র মেয়েটার বয়স মাত্র আট। কঠিন অসুখ হয়েছে ওর। প্রচুর টাকার দরকার। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। অভাবী আর নিঃসঙ্গ একজন মানুষ সে। বউয়ের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া হয়। বড় ভাই তার দোকানে বসার সুযোগও দিয়েছিল কিন্তু দোকানের ক্যাশ থেকে টাকা চুরি করে নেশা করতে গিয়ে সব হারিয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগিতে দুটো ঘর পেয়েছে বলে বউ-বাচ্চা নিয়ে কোনোমতে সংসার করে যাচ্ছে।
গতকাল অস্ত্র ব্যবসায়ী শুটার সামাদকে ফোন করে জানায় একটা বিদেশি পিস্তল বিক্রি করতে চায়। অভিজ্ঞ সামাদ পিস্তলের বিবরণ জেনে নিতে ভুল করেনি। সব শুনে কিছুক্ষণ পর তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, যদি ভালো দাম পেতে চায়, তাহলে যেন আজ সকালে চলে আসে জিনিসটা নিয়ে। তার সামনেই দরদাম করা হবে, বিক্রি থেকে বিশ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হবে তাকে।
অনেক বছর পর আবার কোমরে পিস্তল গুঁজে ঘর থেকে বের হয়ে গেল রন্টু।
৫.
শুটার সামাদ প্রশংসার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সোনালি রঙের পিস্তলটার দিকে।
‘রেয়ার জিনিস…এখন আর এইসব মেশিন পাওয়া যায় না।’
উসখুস করছে রন্টু। যত তাড়াতাড়ি বিক্রি করে চলে যাবে ততই ভালো। এটা সে কোত্থেকে পেয়েছে—এমন প্রশ্ন করা হলে কোন গল্পটা বলবে, আগেই ঠিক করে রেখেছে। গল্প বানানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই।
কিন্তু সামাদ এ নিয়ে কোনো প্রশ্নই করল না।
‘বিশ-বাইশ বছর তো হইবই…না?’
কথাটা শুনে রন্টুর বুক কেঁপে উঠল। বুঝতে পারল, লম্বা একটা সময়ের পরও এই পিস্তলটার কথা সবাই ভুলে যায়নি।
‘কী কইতাছ…বুঝবার পারলাম না?’
‘আরে, তুমি দেখি ঘাবড়ায়া যাইতাছ…’, রহস্যময় হাসি দিল সামাদ, ‘বিশ-বাইশ বছর আগে সহিদের কাছে আমি এই জিনিসটা বেচছিলাম।’
আলগোছে ঢোঁক গিলল রন্টু।
‘কত বছর পর আবার মেশিনটা হাতে পাইলাম…’ পিস্তলটায় পরশ বুলিয়ে বলল, ‘সহিদের খুব পছন্দ হইছিল…পঁচাত্তর হাজার ট্যাকায় বেচছিলাম।’
রন্টু কোনো কথাই বলল না।
‘এইটা তুমি কেমনে পাইলা আমি কিন্তু জিগামু না’, সামাদ বলল, ‘এইসব জাননের কোনো দরকারও নাই আমার।’
রন্টু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সামাদ যে তার কমিশন বাড়ানোর জন্য এই চাল চালছে, বুঝতে বাকি রইল না। সে কিছু বলতে যাবে অমনি প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ল তিন যুবক। এদের মধ্যে একজনকে সে ভালো করেই চেনে। তাকে দেখেই দ্রুত বুঝে গেল সব। নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল।
‘এই যে ভাতিজা…তোমার বাবার পিস্তল’, সোনালি রঙের পিস্তলটা তুলে ধরে বলল সামাদ, ‘আমি ওর কাছ থিকা শুইনাই বুঝবার পারছিলাম এইটা তোমার বাপের।’
রন্টুর দিকে রেগেমেগে তাকাল ছেলেটা, ‘তাইলে আপনেই আমার বাবার লগে গাদ্দারিটা করছিলেন?’
এখানকার এক কলেজের ছাত্ররাজনীতি করা এই ছেলে বাবার পথেই হাঁটছে। সে এখন শুটার সামাদের একজন নিয়মিত ক্রেতা।
‘বাপের কাছে মেশিন থাকলে কুনো হালার সাহস হইতো না তাঁরে গুলি করনের…আপনে তাঁর মেশিনটা সরাইছেন…’
দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে রন্টু বলল, ‘তুমি আমারে মারবার চাও, মারো! মাগার তার আগে আমার দুইটা কথা হুনো…’। অনেক চেষ্টা করছে চোখে পানি আনার কিন্তু আসছে না, ‘আসল বেইমান কইলাম এই হারামজাদা’, সামাদের দিকে আঙুল তুলে দেখাল সে।
তুই কি কইবার চাস!’ গর্জে উঠল অস্ত্র ব্যবসায়ী।
হাত তুলে তাকে বিরত করল জিতু, ‘হে কেমতে বেইমান হইল?’
চেহারায় করুণ ভাব এনে, চোখ দুটো ছলছল করে রন্টু তার গল্পটা বলতে শুরু করল:
সামাদের কাছে যে সহিদের পিস্তলটা আছে, সেটা বহু আগেই জানত সে। অভাবে পড়ে, নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য কিছুদিন আগে সামাদকে ভয় দেখিয়েছিল—সহিদের ছেলেকে সব বলে দেবে। এ কথা শুনে সামাদ ভয় পেয়ে তাকে কিছু টাকাও ধরিয়ে দেয়। সে ভালো করেই জানে, সহিদের ছেলে এসব জানতে পারলে তাকে আস্ত রাখবে না। গতকাল আবারও তার টাকার দরকার হলে সামাদকে ফোন করে, সামাদও তাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু টাকা দেবে বলে আজ আসতে বলে দেয়। এ কারণেই সে আজ এসেছে। এতক্ষণ যা বলল একদম সত্যি কথা। একবিন্দুও মিথ্যে নয়।
রন্টু চেষ্টা করেও চোখে পানি আনতে পারেনি। তার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছে সহিদের অল্প বয়সী ছেলেটা। ওদিকে শুটার সামাদ দাঁত বের করে হাসছে আর মা-বাপ তুলে গালি দিয়ে যাচ্ছে তাকে।
‘তুমিই কও ভাতিজা, আমি কি এইরহম একটা দামি জিনিস বিশ বছর ধইরা রাখমু? আমারে পাগলে কামড়াইছে? আমার কোনো আয়-রোজগার নাই, এরে-ওরে ফাঁপর দিয়া চলি। আমার কাছে এই পিস্তলটা থাকলে এইটা আমি ইউজ করতাম না?’
রন্টু দেখতে পেল সহিদের অল্প বয়সী ছেলেটার পিস্তল-ধরা হাত উঠে আসছে তার কপাল বরাবর।
‘আপনে আমারে এতিম করছেন!’
এই জীবনে প্রথমবারের মতো তার গল্পটা কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগল তার। আট বছরের মেয়েটার মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। টপটপ করে দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অবশেষে—একেবারে সত্যিকারের অশ্রু।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত