১২ জুন ২০১৭
আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলাম প্রায় এক সপ্তাহ পর। এখন অনেকটা সুস্থ আছি বললে ভুল হবে। বরং বলা যায় এখন আমি জানি আমার অবস্থাটা কি। আমি স্কিৎজোফেনিয়ায় ভুগছি। তবে সেটা এখনও মারাত্মক কিছু না। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ওষুধ আর মেডিটেশন করলে আস্তে আস্তে সুস্থ হওয়ার সম্ভবনাও আছে। এই অসুখটা দেখা দিয়েছি সেই মাস তিনেক আগের এক্সিডেন্টের পর। যে এক্সিডেন্ট আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে আমার ফুলের মত ছেলে সৌরভ আর মেয়ে মিমিকে। আর তার সাথে প্রায় আধমরা করে দিয়েছে আমার স্ত্রী নীলিমাকে। সেই ঘটনার পর মানসিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার। বারবার শুধু মনে হয়েছে ওরা কেন, আমিও তো মরে যেতে পারতাম এক্সিডেন্টটে।
আমি কিন্তু গাড়ি খুব আস্তেই চালাই, কিন্তু সে দিন কেন যে ট্রাকটাকে ওভারটেক করতে গেলাম? সেই থেকেই আস্তে আস্তে আমার মাথায় বাসা বেধেছে বিভিন্ন সব উদ্ভট চিন্তা। এই অসুখের জন্মও মনে হয় সেখান থেকেই।
যদিও বাবার কাছে শুনেছিলাম যে আমার দাদুর নাকি শেষ বয়সে মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। মানোসিক রোগ কি জিন-গত? কি জানি।
আজ বাড়ি ঢুকেই যখন দেখলাম সামনের ঘরের সোফায় সৌরভ বসে আছে, তখনই বুঝতে বাকি রইল না যে ডাক্তার যাই বলুক, আমার পক্ষে সুস্থ হওয়া মনে হয় আর হবে না। আমার দিকে কিরকম একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন কারেন্ট খেলে গেল। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। শোবার ঘরে ঢোকার আগে একবার উঁকি মেরে দেখলাম, ও সেই একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘরে ঢুকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর বিছানাটা দিকে। পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলাম। অঘরে ঘুমিয়ে আছে। মাথার পাশে রাখা মনিটারটা জানান দিচ্ছে ওর হৃদস্পন্দন। এটাও সেই এক্সিডেন্টের ফল। সামনের ট্রাকটায় লোহার রোড ছিল। সেইটেই বিঁধে যায় শিরদাঁড়ায়। কোমরের নীচ থেকে প্যারালাইজড। আর পেটেও চোট লেগেছিল গুরুতর।
উঠে স্যালাইনের বোতলটা চেঞ্জ করে দিতে গিয়ে ওটা হাত থেকে পরে টুং করে শব্দ হল। নীলিমার ঘুম ভেঙে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল কখন এসেছি।
বললাম, “এই কিছুক্ষণ আগে।”
“এখন ঠিক আছো?”
বললাম, “হ্যাঁ।” বললাম না যে এই উপরে আসার সময়ও বুঝতে পেরেছি যে আমি পুরোপুরি ঠিক নেই।
একটা ব্যাপার সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি যে মিথ্যে কথা বললে নীলিমা ঠিক ধরে ফেলে। সামান্য হেসে বলল, “এবার কাকে দেখলে?”
মাথা নিচু করে বললাম, “সৌরভ।”
নীলিমা চুপ করে থাকল। শুধু দেখলাম ওর চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিসে। কিছুক্ষণ সব চুপ চাপ। তারপর নীলিমা ধরা গলায় বলল, “ওরা নেই সুমিত। ওরা নেই।” আবার শুরু হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। আমার চোখের সামনেটাও কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ লেখা থামাই। নীলিমাকে খাইয়ে দিয়ে হবে।
১৩ জুন ২০১৭
আজ আর বেশি লিখতে পারব না। আসলে বসতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। নীলিমার বেডপ্যানটা লিক করেছিল, আর তাতেই বিছানা টিছানা ভিজে একশা কান্ড। সেই সব পরিস্কার করতে করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। সব শেষে ওকে ‘গুড নাইট’ বলে শুতে যাওয়ার সময় নীলিমা বলল, “তোমায় খুব কষ্ট দিচ্ছি না? আমিও সৌরভ আর মিমির সাথে মরে গেলে ভালো হত, তাই না।”
বললাম, “কি যাতা বলছ বল তো? আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কি আছে বল? তুমিও যদি চলে যাও তাহলে তো…”
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শুনে আমি কথা বলা থামিয়ে দরজার দিকে তাকালাম। দেখলাম সৌরভ আর মিমি দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে আমাদের দেখছে। সেই লালচে চোখ, সেই ঘোলাটে দৃষ্টি। সব নিস্তব্ধ। কেটে গেল আরও মিনিট পাঁচেক। তারপর নীলিমার গলা শুনে চমকে উঠলাম।
“কি দেখছো ওই দিকে?”
“না, কিছু না,” বললাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নীলিমা আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “তুমি নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা কর না, এই ভাবে কতদিন চলবে?”
“কি বঝাবো? আমার ছেলে মেয়ে আজ আমার জন্যই…”
“তুমি নিজেকে দোষারোপ করা যতদিন না বন্ধ করবে, ততদিন এই অসুখ তোমার পিছন ছাড়বে না।”
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। আমি নিজেও যে সেটা বুঝি না, তা নয়। কিন্তু যতবার বোঝানোর চেষ্টা করি, ততবার কে যেন মাথার মধ্যে এসে চিন্তাগুলো জড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নীলিমা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল। বলল, “তুমি গুজারিস সিনেমাটা দেখেছিলে?”
সিনেমা দেখতে যে আমি বিশেষ পছন্দ করি না সেটা নীলিমা জানে। আমার একটুও ভালো লাগে না পর্দায় সব আজগুবি গল্প দেখতে। সব গল্পের শেষ কি হ্যাপি এন্ডিং-এই হতে হবে?
“কেন বল তো?”
“দুপুরে তো বাড়িতেই থাক। কাল বরং আমি ঘুমিয়ে পড়লে একবার দেখে নিও মুভিটা।”
আমি মাথা নাড়লাম। ও বলল, “মাথা নাড়লে হবে না। বল প্রমিস?”
নীলিমার মুখে প্রমিস কথাটা আমায় যেন টেনে নিয়ে গেল সেই কলেজের দিনগুলোতে। তখনও ঠিক কোন কিছু বলে নীলিমা বলত, ‘বল প্রমিস।’ আর সেই যে যখন মিমি হল, আমি কতবার বলেছিলাম যে ওর ভালো নাম ব্রততী না রেখে বরং পিয়ালি রাখো, কিন্তু সেখানেও সেই এক কথা। হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে কোন রকমে আমার হাতটা ধরে বলেছিল, ‘একদম না। ওর নাম ব্রততী। প্রমিস?’
১৪ জুন ২০১৭
আজ দুপুরে সিনেমাটা দেখলাম। ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে সিনেমা। প্যারালাইজড ম্যাজিসিয়ান ইচ্ছামৃত্যু চাইবে কোর্টের কাছে। ছবিটা দেখতে দেখতে ভীতরে কেমন জানি একটা ভয় চাড়া দিয়ে উঠল। নীলিমা কেন দেখতে বলল এই সিনেমাটা?
একে তো মন ভালো নেই, তার উপর যতক্ষণ সিনেমাটা দেখলাম ততক্ষন দেখি আমার পিছনের সোফায় বসে থাকল সৌরভ আর মিমি। কিন্তু কোন কথা বলল না। ওরা কথা বলে না। প্রথম প্রথম কিন্তু বলত। তারপর আস্তে আস্তে বলা বন্ধ করে দিল। শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠি। কিন্তু ওরা নিশ্চুপ। নীলিমাকে বললে ও বলে, “তোমার মনের ভুল ওই সব। তুমি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছ তাই কথা শুনতে পাচ্ছ না। এরপর দেখবে, আস্তে আস্তে ওদের দেখতেও পাবে না।”
আমিও সেই দিনের আশায় আছি। যেদিন ওদের আর দেখব না, সেদিন বুঝব আমি পুরোপুরি সুস্থ।
সিনেমাটা দেখে উপরে গিয়ে নীলিমার পাশে বসলাম। আজ ও ঘুমিয়ে নেই। ওর মুখটা দেখে মনে হল কষ্ট পাচ্ছে খুব। বললাম, “কষ্ট হচ্ছে?”
ও কোন রকমে মুখ বিকৃত করে বলল, “আর পারছি না গো, আর পারছি না।”
এই ভাবে নীলিমাকে দেখতে পারছি না আমি। বুকের ভীতরে যেন একটা কষ্ট দলা বেঁধে আছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে টেবিল থেকে ঘুমের ইনজেকশনটা নিয়ে ওর হাতে পুস করে দিলাম। ব্যাথায় যেন কুঁকড়ে গেল ও। তারপর মিনিট তিনেকের মধ্যে ঢলে পড়ল অঘর ঘুমে।
১৫ জুন ২০১৭
আজও সকাল থেকেই মনটা ভালো নেই। যেমন ভাবছিলাম যে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছি, সেটা ভুল। কাল রাতে লেখা শেষ করে সবে শুয়েছি এমন সময় ‘বাপি’ ডাক শুনে চমকে উঠলাম। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দেখি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সৌরভ আর মিমি। আমাকে উঠে বসতে দেখে মিমি বলল, “বাপি খুব ভয় লাগছে। তোমার কাছে শোব?”
নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগল। এত ওষুধ এত মেডিটেশন সব ব্যর্থ। সুস্থ আর হতে পারছি কোথায়? কাল অবধি ঠিক ছিল আজ আবার সেই একই জায়গায় ফিয়ে এলাম। পাশের টেবিলে রাখা ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে দিলাম ওদের উদ্দেশ্যে। মুহূর্তে দরজার পিছন দিয়ে মিলিয়ে গেল দুজন। আর ফুলদানিটা ঠংঠং শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে গিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস নীলিমাকে ঘুমের ওষুধটা দিয়েছিলাম, না হলে এই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত বেচারির।
আজ সকালে উঠেও দেখি সৌরভ আর মিমি সামনের ঘরের সোফায় বসে আছে। আমাকে আসতে দেখে আবার সেই অদ্ভুত চাহুনি নিয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি পাত্তা দিলাম না। বেশি পাত্তা দিলেই আমার মাথা আরও খারাপ হয়ে যাবে।
নীলিমার ঘরে গিয়ে দেখি নীলিমার ঘুম ভেঙে গেছে। আর দেখে মনে হল কষ্টটাও যেন একটু কম।
“আজকে ভালো লাগছে?”
নীলিমা কোন উত্তর দিল না। আবার বললাম, “কি হল? ভালো লাগছে একটু?”
“তুমি সিনেমাটা দেখেছিলে?”
“কোন সিনেমা?” আমি না বোঝার ভান করলাম।
“গুজারিস?”
“হু,” বলে পাশের টেবিল থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে সেটা ছুরি দিয়ে কাটতে লাগলাম।
“কিছু ভাবলে?”
“তুমি কি পাগল হলে নাকি? এই সব কথা ভুলেও ভাববে না, বলে দিলাম।”
নীলিমা সামান্য হেসে বলল, “এখনও এত ভালোবাসো আমায়?”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। আপেলের একটা কুচি আস্তে করে ওর মুখে পুরে দিলাম।
কাল রাতের কথাটা ওকে বলতে নীলিমা বলল, “তুমি একটা কথা বল তো? কাল যে সকালে বাজারের দিকে গেছিলে, সেখানে দেখতে পেয়েছিলে ওদের?”
“না,” সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
“আর হাসপাতালে?”
“না।”
“তার মানে তুমি ওদের শুধু এই বাড়িতেই দেখতে পাও। তাই তো?”
এই কথাটা আমি কখনও ভেবে দেখিনি। সত্যিই তো। বাড়ির বাইরে গেলে তো কখনও সৌরভ বা মিমিকে দেখতে পাই না। তার মানে কি এই বাড়িতে ওদের সব ব্যবহৃত জিনিষগুলোর সাথে আমার অসুখের যোগাযোগ আছে? তাহলে এই বাড়ি যদি ছেড়ে দিই তবে আমি কি সুস্থ হয়ে উঠব?
“কি ভাবছো?” চটক ভাঙল নীলিমার প্রশ্নে।
বললাম, “তুমি যা ভাবছ, তাই।”
“তাহলে আমায় কথা দাও যে আমি মরে গেলে তুমি এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।”
“বারবার মরার কথাটা উঠছে কেন বুঝতে পারছি না,” একটু বিরক্ত হয়ে বললাম। “আর অন্য কোথায় যাব? টাকা কোথায়?”
নীলিমা সামান্য হেসে বলল, “কেন মনে নেই এই বাড়ির ফায়ার ইন্সিওরেন্স করা আছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তুমি বরং বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিও। তাতে লাভ দুটো। প্রথম হল ইন্সিওরেন্সের টাকাটা পেয়ে যাবে, আর দ্বিতীয় হল তোমার অসুখের থেকেও হয়তো মুক্তি পেয়ে যাবে।”
আমি কিছু বললাম না। কিন্তু নীলিমা যেটা বলেছে সেটা খুব যে একটা ভুল তাও না। দেখি।
১৮ জুন ২০১৭
গত তিনদিন লেখার একটুও সময় পাইনি। নীলিমার অবস্থা দিনদিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সারাদিন কষ্টে ছটপট করছে ও। আমি আর ওকে এইভাবে দেখতে পারছি না। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি ওকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু ঈশ্বর আবার কবে আমার কথা শুনেছে যে আজ শুনবে?
নীলিমার কষ্টের ফলে আমিও যেন একটু বেশিই উদবিঘ্ন হয়ে আছে। আর তার ফল স্বরূপ ঘন ঘন দেখতে পাচ্ছি সৌরভ আর মিমিকে। দরজার দিকে তাকালেই দেখছি ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে ঘোলাটে চোখে।
একবার মনে হল তাড়াতাড়ি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্ত পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল সেইবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে গিয়ে সে কি কাণ্ড। সবে আর্টিফিশিয়াল ভিব্রাটরটা বন্ধ করতেই নীলিমা প্রায় মরেই যাচ্ছিল। তাই এবার আর সেই ভুল করলাম না। কি করব বুজতে পারছি না। কান্না পাচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে গলার কাছে কি যেন একটা আটকে আছে।
২০ জুন ২০১৭
নীলিমাকে এইভাবে আমি আর দেখতে পারছি না। ওকে এইভাবে রোজ তিলতিল করে মরে যেতে দেখে আমিও যেন ভীতরে ভীতরে মরে যাচ্ছি। সারাদিন প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। কান্না পাচ্ছা। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। শেষমেষ আজ দুপুরে ঠিক করে ফেলেছি, ওর কষ্টটা শুধু আমিই লাঘব করতে পারি। আজ আমাদের চোদ্দতম বিবাহবার্ষিকী। আজ রাতেই ওকে ওর জীবনের সেরা গিফটটা দেব। ওকে মুক্তি দেব ওর কষ্ট থেকে।
এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। আজ বিকেলে গিয়ে পেট্রল পাম্প থেকে ছয় লিটার পেট্রোল কিনে এনেছি। মিনিট পাঁচেক আগে নীলিমার ঘরে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম সৌরভ আর মিমি ওদের শোবার ঘরে শুয়ে আছে। আমি আস্তে করে ওদের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলাম। তারপর উঠে গেলাম নীলিমার ঘরে। অঘরে ঘুমচ্ছে ও। সে তো ঘুমবেই। আজ যে ঘুমের ওষুধের ডোজটা প্রায় চারগুন করে দিয়েছি। এই ঘুম আর ভাঙবে না আমার নীলিমার। আস্তে করে গিয়ে বসলাম ওর বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপর উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলাম আর্টিফিশিয়াল ভিব্রাটরটা। হঠাৎ যেন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নীলিমার। বারবার মুখটা হা করে বাতাস নিতে চাইছে ও। আমি এই দৃশ্য আর দেখতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কতক্ষন এইভাবে বসে ছিলাম জানি না। চোখ যখন খুললাম, তখন দেখি নীলিমার দেহে কোন সাড় নেই। দুহাতে করে বুকে জড়িয়ে নিলাম ওকে, শেষ বারের মত। তারপর আলতো করে শুইয়ে দিলাম।
পাশে রাখা পেট্রোলের ক্যানটা থেকে ভালো করে পেট্রোল ছড়িয়ে দিলাম সারা ঘরে। তারপর একই ভাবে পেট্রোল ছড়িয়ে দিলাম সারা বাড়িময়। পেট্রোলের উগ্র গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করছিল আমার। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলাম। তারপর পকেট থেকে দেশলাই বের করে আগুন ধরিয়ে দিলাম আমার আর নীলিমার স্বপ্নের প্রাসাদে। ভেবেছিলাম ইন্সিওরেন্সের টাকাটা নিয়ে পালাবো, কিন্তু বাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে মত পাল্টালাম।
তারপর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এসেছি থানায়। নীলিমাকে আমি মুক্তি দিয়েছি ঠিকই তবে মানুষ মারার সাজা আমায় পেতেই হবে। না হলে মরে গিয়ে যে সৌরভ আর মিমিকে মুখ দেখাতে পারব না!
না এবার লেখা বন্ধ করি, ইন্সপেক্টর সাহেব ডাকছেন।
* * *
ডাইরিটা পড়া শেষ করে ডাঃ মুন্সি তাকাল ইন্সপেক্টার বিশ্বাসের দিকে। বললেন, “বুঝলাম। শুধু স্কিৎজোফেনিয়া নয়, লোকটার মানসিক ভারসাম্যও ঠিক নেই। যদিও ছেলে মেয়ে মারা গেলে অনেকের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়।”
ইন্সপেক্টার বিশ্বাস বললেন, “তাহলে আর কি, লেগে পড়ুন। এইরকম ইন্টারেস্টিং পেসেন্ট আর পাবেন কোথায়?”
“লোকটা এখনও পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়নি বুঝলেন। যদি তাই হত, তাহলে কি আর সারেন্ডার করত?”
“আমিও সেটাই ভেবেছিলাম ডাঃ মুন্সি। কিন্তু…” এই বলে উনি ডাঃ মুন্সির সামনে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং রেখে দিলেন। খবরটা ১২ মার্চ ২০১৭ সালের।
ডাঃ মুন্সি কাটিংটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন।
“গতকাল রাত সাড়ে এগারোটার সময় বজবজ রোডে একটি বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একটি গাড়ির। ধাক্কার ফলে গাড়িটি পড়ে যায় পাশের খালে। গাড়ির চালক সুমিত সিনহা (৩৮) গুরুতর আহত হয়েছেন। চোট লেগেছে মাথায়। পিছনের সিটে বসা ওনার পুত্র সৌরভ সিনহা (৬) আর কন্যা ব্রততী সিনহা (৮) চোট পেলেও সেটা গুরুতর নয়। কিন্তু সংঘর্ষের ফলে মৃত্যু হয়েছে ওনার স্ত্রী নীলিমা সিনহার (৩৭)।”
গল্পের বিষয়:
রহস্য