গীর্জার ঘণ্টাধ্বনির প্রতি আমি চিরকালই ভীত এবং বীতশ্রদ্ধ। গভীর রাতে এই ঘণ্টাধ্বনি আমার সমস্ত শরীরে ভীতির হিমশীতল স্রোত বইয়ে দেয়। মনে হয় তিরুপল্লীর যেন সেই অশরীরী মিছিল আমার ঘরের দরজায় এসে ভিড় জমিয়েছে।
বীভৎস, অপার্থিব সেই সব দৃশ্য। এখনো যেগুলো দু:স্বপ্নের পর্দায় দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি। ভয়ে হাত-পা-শরীর যেন জমে পাথর হয়ে যায়। দরদর ধারায় ঘামতে থাকি, প্রকৃতিস্থ হতে সময় লাগে।
সেই ভয়াবহ, অতিপ্রাকৃত ঘটনাটা আজ এক দু:স্বপ্নের মতো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা আমারই জীবনে ঘটেছিল। এর প্রধান সাক্ষী আমার স্ত্রী। আর সেই ‘ ঘণ্টাঘর ‘ হোটেলের মালিক নবাব এফেন্দি ও তাঁর স্ত্রী মিসেস এফেন্দি, যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আর ছিলেন সেই ‘ ঘণ্টাঘর ‘ হোটেলেরই স্থায়ী বাসিন্দা বৃদ্ধ কর্নেল রত্নাকর গিরি। এঁরা বেঁচে থাকলে আমার হয়ে সাক্ষ্য দিতে পারতেন যে এই ঘটনা প্রকৃতই ঘটেছিল আর প্রত্যেক বছরের বিশেষ দিনে এটা ঘটে থাকে।
আমি তখন মাদ্রাজে থাকি। সবে বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী লীনা মাদ্রাজে প্রবাসী বাঙালী ঘরের মেয়ে। মোটামুটি সুন্দরী মহিলা। সবে বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার প্রচণ্ড মানসিক ও দৈহিক চাপ পড়ায় কিছুটা ক্লান্ত ছিল। তাই ঠিক করলাম, সমুদ্র তীরবর্তী কোনও মফস্বল শহরে হনিমুনে যাব। আর এরকম একটা শহরের খোঁজ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম তিরুপল্লী নামক শহরের নামটা বেরিয়ে এল।
তিরুপল্লী মাদ্রাজ লাইনের এক অখ্যাত ও অবজ্ঞাত শহর। যতদূর জানি জায়গাটা বহুপূর্বে সমুদ্রবন্দর হিসেবে খ্যাত ছিল। কিন্তু পরে সমুদ্রের নীচে চড়া পড়ে যাওয়ায় কোনও জাহাজ আর সেখানে ভিড়তে পারত না। ফলে এককালের বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর তার কার্যকারীতা হারিয়ে একটা জরাজীর্ণ , অবহেলিত স্থানে পরিণত হয়েছে। এর একদিকে সমুদ্র আর অন্য তিনদিকে পাহাড় ও টিলার সমাবেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে শহরটিতে। সবরকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকলেও কোনও কর্মব্যস্ততা নেই। শান্ত, নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রা। জনসংখ্যাও খুব বেশী নয়। শীতের সময় যা অল্পবিস্তর ট্যুরিস্ট দেখা যায়, বছরের অন্যান্য সময় প্রায় ফাঁকাই থাকে। হোটেলে সিটের কোনও অভাব থাকে না তখন। যে দু-চারটে ভালো হোটেল আছে, তার মধ্যে ‘ ঘণ্টাঘর ‘ উল্লেখযোগ্য। অল্প পয়সায় আরাম আয়েশ করে থাকা যায়। বিশেষ করে হোটেলের দোতলা আর তিনতলার জানলা থেকে চমৎকার উপভোগ করা যায় সমুদ্র। হু হু করে বাতাস আসে সমুদ্রের লবণাক্ত স্বাদ নিয়ে।
খবরের কাগজের অফিসে আমার এক বন্ধু আমায় তিরুপল্লী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিল। মাসকয়েক আগে সে সেখান থেকে ঘুরেও এসেছে, সুতরাং তার কথায় আস্থা রাখা যায়। আর সেই আস্থা নিয়েই আমি রেলওয়ে গাইড ঘেঁটে ট্রেনের সময়সূচী জেনে নিয়ে ফোন করলাম লীনাকে। শুনে খুশী হয়ে সম্মতি জানায় লীনা। টেলিফোনেই জানতে চাইল, ” আচ্ছা, হোটেলের নাম ঘণ্টাঘর কেন? কেমন অদ্ভুত নাম তাই না?”
আমি বললাম, ” তা তো বটেই। আমার মনে হয়, হোটেলের মাথায় কোনও ঘন্টা টন্টা ঝোলান আছে। তাই এই নাম।”
লীনা বলল, ” যাকগে, নাম দিয়ে কি হবে? জায়গা ভাল হলে আমার আপত্তি নেই।”
আমি বললাম, ” যতদূর শুনেছি লীনা, দারুণ জায়গা, একবার গেলে যেন আর ফিরে আসতে মন চায় না।”
” আরে বাহ, তাই নাকি! তবে তো এখনই রওনা দিতে হয়।”
” এখন না হলেও সময় হাতে খুব বেশী নেই লীনা। বিকেল পাঁচটায় ট্রেন….আমি টিকিট বুক করে ফেলেছি। ”
” ওহ বাবা, এত তাড়াতাড়ি….ঠিক আছে আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”
” প্লিজ”
” তুমি বাসায় ফিরবে কখন? ”
” দুপুর দুটোয়।”
” ঠিক আছে, এসো। ” লীনা ফোন রাখল।
আমরা যখন ট্রেনে চাপলাম তখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। ট্রেনের মধ্যে গল্পে আমরা এতই মশগুল ছিলাম যে কখন যে আবহাওয়ার পরিবর্তন শুরু হয়েছে, টেরও পাইনি। টের পেলাম যখন ট্রেন তিরুপল্লী স্টেশনে এসে থামল। দেখলাম অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চতুর্দিক, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, সাথে সোঁ সোঁ হাওয়া।
ছোট্ট স্টেশন। কয়েকটা গ্যাস লাইট মিটমিট করে জ্বলছে প্ল্যাটফর্মে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
এতক্ষণ ট্রেনের আলো ছিল বলে অন্ধকারের অস্তিত্ব টের পাই নি, কিন্তু ট্রেন চলে যেতেই একরাশ অন্ধকার নেমে এল চারদিকে।
সত্যি বলতে কি, স্টেশনে নেমেই আমার মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিল। গোটা স্টেশনটা জনমানবশূন্য। কি করি! সুটকেস দুটো হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা গেটে এসে থামলাম। সামনে স্টেশনমাস্টার, তাঁর পাশে বোধহয় পয়েন্টসম্যান। আর কোথাও কোনও যাত্রী নেই, আমি টিকিট দুটো ওনাদের সামনে দেখিয়ে জানতে চাইলাম, ” ঘণ্টাঘর হোটেলটা এখান থেকো কতদূর!?”
জবাব এল….” তিন কোয়ার্টার পথ। এই রাস্তা ধরে সোজা গেলে বামদিকে মোড় নিলেই শহরটা।”
” ট্যাক্সি বা রিক্সা পাওয়া যায় না এখানে?”
” যায়। তবে আজ পাবেন না।”
‘ কেন?”
“আজ ওরা বের হবে না।”
ইতিমধ্যে রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে কোথাও যেন গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল ঢং ঢং করে। মূহুর্তে পয়েন্টসম্যানের মুখ ভয়ে যেন বিবর্ন হয়ে গেল। ফিসফিস করে স্টেশনমাস্টারকে বলল, ” আজ দেখছি, সকাল সকাল শুরু হয়ে গেল!”
” হুঁ” ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল স্টেশনমাস্টার।
” দেখুন, আমাদের যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা” আমি বললাম।
” মনে হয় না, এই সময়টা ঠিক বেড়াবার সময় নয় কিনা!” জবাব এল।
” মুশকিল! ” আমি নিজের মনেই বললাম।
স্টেশনমাস্টার বললেন, ” আপনারা এক কাজ করুন না হয়, আজকের রাতটা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে কাল সকালে না হয় শহরে যাবেন।”
” কি দরকার! সামান্য পথ….হেঁটেই যেতে পারব”…রাগতস্বরে বলল লীনা।
” সে আপনাদের ইচ্ছা, তবে….. ”
” তবে কি?”
“আজ রাতে শহরে না গেলেই বোধহয় ভালো করবেন”।
লীনার তাগিদে স্টেশন ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম, দুই হাতে সুটকেস নিয়ে। স্টেশনমাস্টারের নির্দেশমতো এগোচ্ছি দুই হাতে সুটকেসের বোঝা নিয়ে আর মনে মনে অভিসম্পাত করছি এই বিরূপ আবহাওয়ার। পথের দুপাশে কোনও ঘরবাড়ি নেই, লম্বা টানা দেওয়াল। বোধহয় কোনও হাসপাতাল বা রেলওয়ে জমির সীমানা। অন্যপাশে জঙ্গল, ঝোপঝাড়, টিলা। আমার পাশে পাশে হাঁটছে লীনা। হঠাৎ হোঁচট খেয়ে বলল, ” কি ভূতুড়ে শহর রে বাবা, কোনও লোকজন নেই নাকি!”
সত্যিই আধ মাইলটাক পাড়ি দিয়েও কোন মানুষজনের দেখা পেলাম না। তবে শহরে যে পৌঁছে গেছি তা বুঝতে পারলাম দুই পাশের অন্ধকার ঘরবাড়ি দেখে। কোনও বাড়িতে কোথাও এতটুকু আলো জ্বলছে না, যেন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু সেইথেকে একটানা ঘন্টা বেজে চলেছে একনাগাড়ে।
শব্দের জোর বাড়ছে ক্রমশ…..
সৌভাগ্যবশত, বামহাতের বাঁক পার হয়ে একটা তেমাথায় এসে পেয়ে গেলাম ‘ ঘণ্টাঘর ‘। তেমাথায় এসে এই যৎসামান্য আলো দেখতে পেলাম; আর সেই গ্যাসপোস্টের আলোয় সামনেই একটা তিনতলা বাড়ির মাথায় বিশাল এক ঘন্টা ঝুলতে দেখে বুঝলাম কেন এই হোটেলের নাম ‘ ঘণ্টাঘর ‘। নমুনা হিসেবে ঢং ঢং করে ঘণ্টাধ্বনি এসে আকৃষ্ট করছিল আমাদের।
হোটেলের সদর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। লম্বা হলঘর। একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সিঁড়ির নীচে হোটেলের কাউন্টার। এক প্রৌঢ়া মহিলা আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। মুখে তাঁর বিস্ময়ের চিহ্ন। বললেন, ” আপনারা এই অসময়? ”
” বেড়াতে এসেছি। আমাদের জন্য ভালো সিট হবে তো?”
” সিট কেন স্যার? সারা হোটেলই খালি আছে। এসময় ট্যুরিস্ট বিশেষ থাকে না কিনা তাই বাড়তি বয়-বেয়ারাও নেই। তবে, সেজন্য চিন্তা করবেন না, আমি একাই ‘ম্যানেজ’ করে নেব।”মহিলা বললেন।
তিনতলার একটা চমৎকার ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ভদ্রমহিলা নেমে এলেন। পথশ্রমে আমরা দুজনেই ক্লান্ত থাকায় হোটেল লাউঞ্জে আমরা বসেছিলাম। উনি এসে বসলেন আমাদের সামনে। পরিচয় হল মিসেস নবাব এফেন্দির সাথে। অমায়িক ভদ্রমহিলা। স্বামী প্রায়ই অসুস্থ থাকেন, তাই ডাক্তারের পরামর্শমতো স্বামীর হাওয়া বদলানোর তাগিদে এই সমুদ্র তীরবর্তী শহরে বেড়াতে এসেছিলেন, তারপর এখানে থাকতে গিয়ে বুদ্ধি করে নিজেই হোটেল খুলে বসেছেন। এখন হোটেলের আয় থেকেই তাঁদের সংসার চলে। এছাড়াও একজন স্থায়ী বোর্ডারও আছেন। ভদ্রলোক চিরকুমার, অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল, নাম রত্নাকর গিরি। খুবই মিশুকে ভদ্রলোক। অবসর জীবনটা হোটেলেই কাটিয়ে দেবার ইচ্ছে তার। ঘন্টার শব্দ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, শহরের বিভিন্ন বাড়ির মাথায় আর গীর্জার চুড়োয় ঝুলে থাকা ঘন্টাগুলো সমুদ্রের বাতাসে চমৎকার ভাবে দোল খেয়ে বাজতে থাকে। প্রথম প্রথম অনভ্যস্ত কানে কর্কশ শোনালেও পরে একসময় শুনতে অভ্যাস হয়ে গেলে ভালোই লাগবে।”
কথাবার্তা শেষে আমাদের তিনতলায় থাকবার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন মিসেস এফেন্দি। তিনতলার ওপর চমৎকার সুসজ্জিত, ডবল বেডেড স্যুইট। আমরা হনিমুনে এসেছি শুনে এই ঘরটাই পছন্দ করে দিয়েছেন উনি। এটাই এই হোটেলের সেরা ঘর। চমৎকার পছন্দ হবার মতো ঘরই বটে। জানলার লম্বা পর্দা সরিয়ে কাঁচের সার্শি খুলে দিতেই হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আমাদের যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল। টিমটিমে রাস্তার আলোগুলো সার বেঁধে চলে গেছে সমুদ্রের কিনারা পর্যন্ত বিন্দু বিন্দু হয়ে। এরপর ঘন কালো অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে সমুদ্রের শুরু।
” রাতে খাবেন তো?” মিসেস এফেন্দি জানতে চাইলেন।
” অবশ্যই।”
” তবে আপনারা এখন বিশ্রাম নেন, আমি খানা রেডি করি”….বলে মিসেস এফেন্দি নীচে নেমে গেলেন।
” চমৎকার ঘর”! উচ্ছস্বিত হয়ে বলল লীনা।
” এত কষ্টের পর এটাই স্বান্তনা” আমি বললাম।
” কটা বাজে এখন? ”
” আটটা পঁচিশ। ”
” এখনো সন্ধ্যারাত। আমরা একবার সমুদ্রের ধার থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না?”
” তাহলে চলো। বৃষ্টি তো নেই।”
” চলো।”
মিসেস এফেন্দি কাউন্টারে ছিলেন না। সম্ভবত রান্নাঘরে ব্যস্ত। তাই দেখা হল না। আমরা কাউন্টারে একটা চিরকুট রেখে বেরিয়ে এলাম।
ঢং ঢং ঢং ঢং। শহরের বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমাগত ঘন্টা বেজে চলেছে। থামার কোনও লক্ষণই নেই, বরং প্রতিমূহুর্তে সামুদ্রিক শোঁ শোঁ হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বেড়েই চলেছে। পথের দু ধারের ঘরবাড়ি অন্ধকারাচ্ছন্ন, নিস্তব্ধ। এ শহরের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। এরা কি সব সন্ধে নামার সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে দেয় নাকি! একটা জনপ্রাণী যদি রাস্তায় থাকে! এমনকি একটা কুকুর বিড়াল পর্যন্ত দেখলাম না।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছলাম। বেশ চওড়া পাথরের বাঁধ দিয়ে ঘেরা শহর। বাঁধের মাঝে মাঝে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। সেইরকমই একটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামবার প্রয়াস নিচ্ছি এমন সময় নাকে এল পচা ভ্যাপসা গন্ধ। সমুদ্রে মাছ বা কুকুর-বিড়াল পচেছে ভেবে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। এমন সময় আমার হাতের টর্চটা হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। ব্যাটারি ফিউজ হয়ে গেল বোধহয়। লীনা অন্ধকারেই তরতর করে নেমে যাচ্ছে নীচে। আমি চিৎকার করে লীনাকে ডাকলাম, পাছে ও অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙে। আমিও দৌড়ে নীচে নামতে লাগলাম ওকে ফিরিয়ে আনতে। যত নীচে নামছি তত পচা গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
ওদিকে ক্রমেই প্রচন্ডতর হচ্ছে ঘণ্টাধ্বনি। যেন সারা শহরের ঘন্টা একসাথে বাজতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে লীনা আর্তচিৎকার করে ওপরে উঠে এল।
” কি হল?”
” কি জানি, পচা মতো কিসে যেন পা পড়ল! নরম, থলথলে কাদার মতো। উহ, কি গন্ধ! বমি হয়ে যাবে।”
” চলো ফেরা যাক।”
” চলো। ”
হোটেলে ফিরতে মিসেস এফেন্দি গম্ভীর মুখে বললেন, ” অপরিচিত জায়গায় এত রাতে ঘোরাটা ঠিক হয়নি আপনাদের।”
” কেন, চোর ডাকাতের ভয় আছে নাকি?”
” হাজারটা বিপদ আপদ থাকতে পারে। যাই হোক, আর এভাবে বাইরে বেরোবেন না।”
” ঠিক আছে।”
” কফি খাবেন?”
” মন্দ হয় না।”
” তাহলে এখানে বসুন। আমি আনছি।”
হোটেলের দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে মিসেস এফেন্দি ভেতরে চলে গেলেন। কথাবার্তা কেমন যেন রহস্যময়। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিঁড়ির ওদিকের অন্ধকার ফুঁড়ে প্রায় ছ’ফুট লম্বা এক ব্যক্তি বের হয়ে গেলেন। চুল উস্কোখুস্কো, নোংরা বেশভূষা , চোখ লাল। মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ বের হচ্ছে। লোকটি হঠাৎ প্রশ্ন করে, ” আজ রাতে বুঝি আপনারা এসেছেন?”
” জ্বি”।
” আজ রাতে আপনাদের আসাটা ঠিক হয় নি।”
” কেন বলুন তো? এখানে সবাই প্রায় এক কথা বলছে। আমরা এসে আপনাদের অসুবিধা করলাম নাকি?”
” অসুবিধা আমাদের নয়, আপনাদের। আমরা পুরনো লোক, অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি সারাটা রাত মদে বেহুঁশ থাকি, তাই কিছু টের পাই নে। বুড়ি মানে আমার মিসেস, এই হোটেলের মালিক সারারাত ধরে কিসব দোয়াদরুদ পাঠ করে ওর ঘরে বসে, সেখানে ওরা পাত্তা পায় না। কর্নেল রত্নাকর গিরিও তাঁর ঘরে মন্ত্রতন্ত্র পাঠ করে প্রার্থনা করেন, ওঁকেও আজকাল কেউ আর বিরক্ত করে না। সমস্যা আপনাদের নিয়ে।”
” ওরা কারা, মানে আপনি কাদের কথা বলছেন?”
” ওরা সব ওপারের লোকজন। ”
” ওপারের লোকজন! কি বলছেন আপনি!”
” দেখলেই বুঝবেন। ”
ইতিমধ্যে মিসেস এফেন্দি কফি নিয়ে আসলেন। এসেই ভাগালেন তাঁর নেশাগ্রস্ত স্বামীকে। ” আবার তুমি গিলে এসে বকবক শুরু করেছ? খামোখা ছেলেমানুষদের ভয় দেখাও? লজ্জা করে না? যাও তো এখান থেকে!”
মুখ বন্ধ করে নবাব এফেন্দি চলে গেলেন।
” এই নিন কফি। ওর মাথায় ছিট আছে বুঝলেন? সবসময় মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে। ওর কোনও কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন না। যাই দেখি আপনাদের রাতের খাবার কতদূর। ” কফির কাপগুলো সামনের টেবিলে রেখে মিসেস এফেন্দি ভেতরে চলে গেলেন আবার।
কফির কাপে হালকা চুমুক দিলাম। শীত শীত বর্ষায় ভালই লাগছিল কফিটা। আবার ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানলার কাঁচের সার্শির মধ্য দিয়ে দেখলাম। শোঁ শোঁ হাওয়া প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ঝাপটা দিচ্ছে জানলার কাঁচে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সামনের তেমাথার পথ। মানুষ তো দূরের কথা, একটা জীবজন্তুও নেই বাইরে। খাঁ খাঁ বিরান।
“ব্যাপারটা কি এদের?” লীনা স্বগতোক্তি করে।
” কি জানি। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে”!
” ভদ্রমহিলা কি যেন চেপে গেলেন।”
” পোড়োবাড়ি নাকি? কোনও ভয়-টয় আছে হয়তো।”
“হ্যাঁ, ভয় আছে, তবে অন্য ভয়”…..ঘরের কোণা থেকে কার যেন গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
” কি? কে আপনি?” আমি চমকে উঠে বললাম।
” রত্নাকর গিরি আমার নাম। এই হোটেলেই থাকি।” জবাব এল।
” শুনেছি আপনার নাম। এখানে আসুন না, কথা বলা যাবে।”
” থ্যাংকস। ”
সেই আধো অন্ধকার থেকে স্যুট পরা বয়স্ক একজন ভদ্রলোক মুখে চুরুট গুঁজে এগিয়ে এলেন। শেকহ্যান্ড করে বসলেন আমার পাশে। এরপর এটা ওটা নানান কথা, নানান গল্প। তিরুপল্লী শহরের একটা মোটামুটি ইতিহাস শুনলাম ওঁর মুখে। ১৮১৫ সালের ঘটনা সেটা। এর আগে পর্যন্ত বন্দর হিসেবে বেশ ভালোই পরিচিতি ছিল তিরুপল্লীর। এখান থেকে জাহাজ যেত মাদ্রাজ, ত্রিচিনোপল্লী, কোচিন আর ভিজাগাপত্তম বন্দরে। আবার অন্যান্য বন্দর থেকেও জাহাজ নোঙর করত এখানে। ১৮১৫ সালের ১৬ ই জুলাই হঠাৎ এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছাসে সমগ্র এই বন্দর শহরটা ধ্বংস হয়ে গেল। মারা গেল এ শহরের সমগ্র জনমানুষ। এমনকি শোক করার জন্য একটা কুকুর বিড়াল পর্যন্ত বাঁচেনি। পানি নেমে যাবার পর গীর্জার ঘন্টাগুলো পরপর কয়েকদিন বাতাসে দুলে দুলে বাজতে লাগল এই শহরের জন্য শোকপ্রকাশ করতে। তারপর থেমে গেল একসময়। এবং সেদিন থেকেই তিরুপল্লীর বন্দর হিসেবে সমৃদ্ধি ও খ্যাতি শেষ। এরপর অবশ্য মানুষ এসেছিল, কিন্তু তেমন করে আর জমে ওঠেনি এই শহর। সমুদ্রের তলায় বালির চড়া জমেছে ক্রমে, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে একসময়। ধীরে ধীরে বন্দর হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তিরুপল্লী।
রত্নাকর গিরির কাছ থেকে এও জানা গেল, আজ সেই অভিশপ্ত ১৬ জুলাইয়ের রাত। এই রাতেই দলে দলে সাগর থেকে উঠে আসে অশান্ত আত্মারা, সারারাত ধরে শহরময় তাণ্ডব করে বেড়ায়। সেজন্যই যা ভয় আজকের রাতটাকে।
হো হো করে হেসে প্রশ্ন করলাম, বিংশ শতাব্দীতে এসব ফ্যান্টাসি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য, মিঃ গিরি?”
” বেশ তো, চোখে দেখলে না হয় বিশ্বাস করবেন।”
” ঠিক আছে, নতুন ধরনের এক অভিজ্ঞতা হবে, কি বলো লীনা?”
” আমার কেন জানি না ভাল লাগছে না এসব “….লীনা ভয়জড়ানো গলায় বলল।
” ট্রাশ! আচ্ছা আপনাদের শহরে কি লোকজন নেই?”
” আছে, তবে আজকের রাতে কেউ এই শহরে থাকে না। সবাই আশেপাশের গ্রামে চলে যায়। কাল সকাল থেকে আবার সব ফিরতে শুরু করবে।”
” আপনারা পালালেন না কেন?”
” আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে তাই। আর তাছাড়া…… ‘
হঠাৎ প্রবলভাবে ঘন্টা বাজা শুরু হল। সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া রূপ নিল ঝড়ের। ভয়ে লীনার মুখ শুকিয়ে এল। আমতা আমতা করে বলল, ” আচ্ছা, আমরা এখন পালাতে পারি না মিঃ গিরি?”
“এখন আর সম্ভব নয়, ম্যাডাম। রাত এগারোটা বেজে গেছে। এতক্ষণে ওরা হয়ত দলে দলে সমুদ্র থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে। দেখছেন না, কিরকম ভাবে ঝড় বাড়ছে!”
” আমাদের ভয়টা কিসের? ভাল করে দরজা জানলা এঁটে শুয়ে থাকব। তাছাড়া নিজের চক্ষে না দেখা পর্যন্ত আমি ওসবে বিশ্বাসী নই। ” আমি বললাম।
ইতিমধ্যে মিসেস এফেন্দি আমাদের রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এলেন।
ডাইনিং টেবিলে তিনি আমাদের বললেন, ‘ আপনারা নিশ্চয়ই সব শুনেছেন?”
” হ্যাঁ, শুনলাম। ”
” ভয়ের কিছু নেই। আমরা তো আছিই। তাছাড়া, আপনাদের পাশের ঘরেই থাকবেন মিঃ রত্নাকর গিরি।”
” কোনও প্রবলেম নেই। লীনাই যা একটু ঘাবড়ে গেছে, আসলে ও খুব নার্ভাস কিনা।”
” আসলে আপনারা এমন একটা সময় আসলেন, আবার যে ফেরত পাঠাব সে উপায়ও ছিল না। দেখলেন তো রাস্তায় কোনও যানবাহন নেই। অবশ্য আজকের রাতটাই যা ভয়ের, কাল সকাল থেকে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
” ঠিক আছে, আমরা ঘুমিয়ে রাত কাবার করে দেবো। ”
খাওয়াদাওয়ার পর আবার আমরা লাউঞ্জে ফিরে এলাম। মিঃ রত্নাকর গিরি তখনো বসে বসে চুরুট টানছিলেন। আমরা বসলাম তাঁর সামনে। ইতিমধ্যে ঝড়ের দাপট আরও বেড়েছে। বৃষ্টির পানি জানলার সার্শিতে যেন নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে হিংস্র বিড়ালের মতো। ঘণ্টাধ্বনির প্রচণ্ড শব্দে যেন মহাপ্রলয়ের ইঙ্গিত।
জানলার সার্শির পর্দাটা সরাতেই ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। তেমাথার মোড়ে, গ্যাসলাইটের ধারে একটা অস্বাভাবিক লম্বা লোক দাঁড়িয়ে। তার পরনে গীর্জার সন্ন্যাসীদের মতো লম্বা জোব্বা।
ঠিক এইসময় ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল।
চলেন, আর নীচে বসা ঠিক হবে না”….রত্নাকর গিরি বললেন আমাদের।
” হ্যাঁ, চলেন, আমরা তিনতলায় যাই।”
তিনজনে তিনতলায় উঠে এলাম।
আমাদের ঘরের সামনে পৌঁছে দিয়ে মিঃ গিরি পাশের রুমের তালা খুললেন। বললেন, ” যে কোনও প্রয়োজনে আমাদের ডাকবেন।”
আমি মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম। উনি ঢুকে পড়লেন নিজের ঘরে। দেখবার ওনার ঘরের পাশে একটা স্ট্যান্ডে তামার একটা বড় পিকদানি। অন্ধকারে সেটা মুণ্ডহীন ঘোড়সওয়ারের মতো দেখাচ্ছিল। উনি ঘরে ঢুকে পড়তেই আমরাও নিজের ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরের ভেতর পিতলের চিরাগ জ্বলছে। পাশে একটা মোমবাতিস্ট্যান্ডে বেশ কিছু মোমবাতি সাজানো। পাশে একটা ম্যাচ। মিসেস এফেন্দি সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
দরজাটা ভাল করে এঁটে সারাটা ঘর পরীক্ষা করে নিলাম। জানলার সার্শিগুলো ঠিকমতো বন্ধ কিনা দেখে নিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক। জানলার সার্শির ভেতর দিয়ে তেমাথায় দৃষ্টি ফেললাম। ফাঁকা পরিষ্কার পথ। কেউ কোথাও নেই। আসলে আজেবাজে গালগল্প শুনে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছিল আমার। জানলার পর্দাটা ভাল করে টেনে দিয়ে এতক্ষণে আয়েশ করে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। লীনা গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে পড়েছে খাটে।
” কি সব কান্ড বলো তো?” লীনা ভয় মাখান গলায় বলল। ও ঘুমোয়নি এখনো।
” হ্যাঁ, এখানে এসেই সব দেখছি আর শুনছি।”
” আমার কিন্তু খুব ভয় ভয় করছে।”
” ভয়ের কি আছে? যতসব অবাস্তব ব্যাপার।”
” কিন্তু সমুদ্রের সিঁড়িতে সেই পচা গন্ধ?”
” সমুদ্রে কুকুর-বিড়াল পচেছে হয়ত।”
” কিন্তু ওটা মানুষের পচা দেহ….তখন বলিনি। গন্ধটা কিন্তু মানুষের লাশের”
” হবে, হয়ত, কেউ ডুবে মরেছে। তার দেহ”….আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম।
সবেমাত্র সিগারেটটা শেষ করেছি এমন সময় বাইরে অনেক মানুষের কোলাহল শোনা গেল। দ্রুত উঠে গেলাম জানলায়।
পর্দা সরিয়ে যা দেখলাম তাতে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। তেমাথায় প্রচুর লোকের জমায়েত হয়েছে। বুড়ো-বুড়ি, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর…..সবাই উৎফুল্ল, হাসছে, নৃত্য করছে। যেন শহরজুড়ে একটা আনন্দ মিছিল বের হয়েছে। ঘণ্টাধ্বনির প্রচণ্ড নিনাদ কখন থেমে গেছে। ঝড়-বৃষ্টি কোথায় গেছে কে জানে। চমৎকার জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে গোটা শহর। এইসব আনন্দ উল্লাসের মাঝে শ্লোগানের যে শব্দগুলো পেলাম, কান পেতে ভালো করে শুনতেই বুঝতে পারলাম কথাগুলো। তারা বলছে….” মুর্দারা জীবিত হয়েছে এখন… কে কোথায় আছ, বেরিয়ে এসো, আনন্দে যোগ দাও…..মুর্দারা জীবিত হয়েছে এখন। ”
হঠাৎ কাঁধে কার স্পর্শে চমকে উঠলাম। লীনা কখন যেন উঠে এসেছে আমার পাশে। ওর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমার দিকে চেয়ে শুকনো গলায় বলল, ” তাহলে ওরা সত্যি সত্যিই উঠে এসেছে।”
” তাই তো দেখছি।”
” কি হবে এখন? ”
” ভয় কি, আমি আছি, যাও শুয়ে পড়ো। ”
ভাল করে জানলার পর্দা টেনে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। ওদিকে বাইরে উল্লাসধ্বনি ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। এই অপার্থিব জনতা সারা শহরে মিছিল করে বেড়াচ্ছে। তাদের এই উল্লাসধ্বনি কতক্ষণ চলল কে জানে! হঠাৎ হোটেলের সদর দরজা ভেঙে পড়ার শব্দে চমকে উঠলাম। লীনা ভয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। ওকে শান্ত করব কি, সারা হোটেলে তখন তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। নীচের হলরুমে দাপাদাপি, চেয়ার টেবিল উলটে পড়ার শব্দ, কাঁচের পেয়ালা, বাসন-কোসন উলটে পড়ার ঝনঝন শব্দ। সেই সঙ্গে অট্টহাসি, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি। সিঁড়িতে কাদের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল, করিডোর ধরে কারা যেন দৌড়ে আসছে। পাশের রত্নাকর গিরির ঘরের দরজায় করাঘাত শুনলাম। তামার পিকদানি ঝনঝন করে উলটে পড়ল মেঝেতে। সেই সঙ্গে হিমশীতল আহ্বান” মুর্দারা জীবিত এখন…. তোমরা বেরিয়ে এসো ”
পরপর প্রচণ্ড এক শব্দে আমাদের ঘরের দরজার ছিটকিনি খুলে গেল। সাথে সাথে কয়েকটা ছায়ামূর্তি ঢুকে পড়ল ঘরে। সেই সঙ্গে তীব্র পচা গন্ধ। চিৎকার করছে তারা ” বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো তোমরা। ” বীভৎস তাদের মুখভঙ্গি, উৎকট তাদের অট্টহাসি। লীনা তো সাথে সাথে অজ্ঞান। আমি সেই অবস্থায় ওকে ঘিরে রাখলাম। ওরা আমাদের দুজনকে ঘিরে নাচতে শুরু করল, যেন দারুণ একটা মজা পেয়েছে তারা। তারপর কয়েকজন লীনার অচেতন দেহটাকে হাতে করে বাইরে বের করতে যেতেই আমি তাদের বাধা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা নরম থলথলে হাত আমায় চেপে ধরল। এত নরম হাত, অথচ কি প্রচণ্ড শক্তি! সেই সাথে তীব্র পচা গন্ধ। আমি বন্দি হয়ে গেলাম ওদের হাতে।
লীনার অচৈতন্য দেহটাকে হাতে হাতে করে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ওরা, সেই সঙ্গে আমাকেও টেনে নিয়ে চলল।
সিঁড়ি দিয়ে নামা পর্যন্ত বোধ ছিল আমার। তারপর কখন যেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি হোটেলের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশের বেডে লীনাও শুয়ে আছে। বিছানার কাছে বসে রয়েছেন মিসেস এফেন্দি। মাথার কাছে বসে রয়েছেন রত্নাকর গিরি। তাঁদের মুখেই শুনলাম, আমাদের নিয়ে ওরা প্রায় পথেই নেমে পড়েছিল। এমন সময় সদর দরজায় বাধা দেন মিসেস এফেন্দি ও কর্নেল রত্নাকর গিরি। রাত তখন শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ কি কারণে মুরগীর খাঁচার ভেতর থেকে একটা মোরগ ডেকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভৌতিক ছায়াদেহগুলো ভোর হবার সঙ্কেত পেয়ে আমাদের ফেলে পালিয়ে যায় সাগরের দিকে। যদিও ভোর হতে তখনো অনেক বাকি।
পরদিনই আমরা তিরুপল্লীকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম । এই ভয়ঙ্কর স্থানে আর নয়। প্রাণ নিয়ে ফেরাটাই তখন আমাদের কাছে পরম আশ্চর্য মনে হচ্ছিল।
সেই থেকে গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনলেই আমার শরীরে ভীতির হিমস্রোত বয়ে যায়। আমি সহ্য করতে পারি না শব্দটাকে।
………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………