ব্রাদারহুড অনেকদিন ধরেই কোন মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল না। অস্থির হয়ে পড়েছিল সবাই। ব্যাপারটা অত সহজ নয়, একটা জলজ্যান্ত মানুষ খুঁজে নিয়ে আসা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। গত মাসে ফিস্ট হয়েছে, এই মাসে লালগোল্লা। এদিকে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। নতুন সদস্যদের নাকি এই সমস্যা হয়।
সমস্যাটা আর কিছুই নয়, এই ব্রাদারহুড একটা ক্যানিব্যাল সংঘ। আমাদের কাজ হল মানুষের মাংস চেখে দেখা। অনেকেই ব্যাপারটা অমানবিক বলে মনে করে, কিন্তু আমরা করি না। আসলে তো মানুষ অন্যান্য জীবজন্তুদের মতোই একটা জীব, অন্যগুলোকে খেতে পারলে মানুষ খাওয়া যাবে না কেন? ব্রাদারহুডের কাজ হল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ সংগ্রহ করা। গত মাসে কপাল অনেক ভাল ছিল, দু-দুটো ছোট বাচ্চা পাওয়া গিয়েছিল, আমরা সবাই খেয়েছি, তোফা হয়েছিল। রান্না করার ভার আমার ওপরই পড়ে, কারণ আমি ভারতীয় রান্নায় পারদর্শী, মশলার ব্যবহারের কায়দা আমার মতো আর কেউ জানে না। এই পশ্চিমা দেশগুলোতে মশলার ব্যবহার নেই বললেই চলে, কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে একদম উল্টে দিয়েছি।
শুরুতে আমি ছিলাম একজন যাকে আপনারা বলেন “স্বাভাবিক” মানুষ, আমাকে এই সংঘে নিয়ে আসে আমার এক বন্ধু, ধরে নেয়া যাক তার নাম “এক্স”। সংঘের নাম, ঠিকানা, এমনকি কোন সদস্যের পরিচয় উচ্চারণ করলে আমাকে মেরে ফেলা হবে, আগেই বলে দেয়া হয়েছে। মেরে ফেলাই হবে না, আক্ষরিক অর্থেই খেয়ে ফেলা হবে। তবে সংঘের লোকেরা খুব মাইডিয়ার গোছের, সবার সাথে আমার খুব দহরম-মহরম। প্রথম দিন যখন মানুষের মাংস খেলাম, চোখ বন্ধ করে বলে উঠেছিলাম, উহ! এত স্বাদের খাবারও হয়? কোথায় লাগে এর কাছে পর্ক, বীফ, মাটন। তারপর থেকে আমি নিজেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লেগে গেলাম, বের করলাম আরও সুন্দর সুন্দর সব রেসিপি। সদস্যদের মধ্যে এখন আমি পাকা আসন করে নিয়েছি, সবাই আমাকে ডাকে “দ্য কুক”। মানুষের মাংসের এত স্বাদের কারণও আছে, মানুষের মাংস অনেক নরম, আর এতে লবণ বেশি। বাঘ যখন বুড়ো হয়ে যায় অথবা আহত হয়, বুনো জন্তু শিকার করে খেতে পারে না, তখন সে মানুষখেকো হয়ে ওঠে, কারণ শিকার করা সহজ। একবার ধরলে সত্যিই ছাড়া মুশকিল।
কিন্তু এই মাস যেতে বসলো, আমাদের শিকার জোটে নি। কী করবো? তাই আমাকে এই কাজটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেরে ফেলতে হল।
কী করেছি? না, তেমন গুরুতর কিছু না। আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে, খুব ভালোবাসতো আমাকে, কিন্তু কী করবো? উপায় ছিল না।
খুন করার পরের কাজগুলো সহজ, আগেও করেছি। চামড়া ছাড়িয়ে পচনশীল অঙ্গগুলো দ্রুত বের করে নিতে হল, এগুলো এমনি রান্না করা যায় না, কিডনী, যকৃত, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, ব্রেন, জিভ। অল্প ঘনমাত্রার ভিনেগারের আর আরও কিছু উপাদানে তৈরি বিশেষ দ্রবণে চুবিয়ে রাখতে হবে আটচল্লিশ ঘণ্টা, তারপর রান্নার উপযোগী হবে।
আমি ডান হাতের কিছু অংশ কেটে নিলাম, এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এক ডিশ রান্না করে ফেলবো এখনই। ব্রাদারহুডের সবাইকে জানানোর কথা, কিন্তু আমি জানাব না বলে ঠিক করেছি। একা খাওয়ার মজাই আলাদা। বাকি শরীরটা পলিথিনে মুড়িয়ে রেখে দিলাম ফ্রিজে। সুপরিসর ফ্রিজ, সহজেই জায়গা হয়ে গেল। আমি দুঃখিত, মার্থা, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এটা করতে চাই নি।
খাবার তৈরি হয়ে গেল দুঘণ্টার মধ্যেই। যা সুবাস ছেড়েছে না, ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল।
টেবিল পরিপাটি করে সাজালাম, হুইস্কির নতুন বোতল খুললাম, বরফ এনে দিলাম গ্লাসে। ফেনা উঠেছে গ্লাসে, তাজা মাংসের সাথে ড্রিংক জমবে ভালো।
পুরো বাটি শেষ করলাম আমি, অনেকদিন পর এমন তৃপ্তি করে খেলাম। ভুনা মাংসের মতো স্বাদের কী আছে, আর যদি সেটা মানুষের হয়? পাঁচ পেগ শেষ করেছি সেই সাথে। মাথা ঝিমঝিম করছে, মনে হচ্ছে বাতাসে উড়ে যাবো।
আরেক বাটি নেবার জন্য হাত বাড়িয়েছি, দরজা খুলে গেল। কে এলো খাওয়ার সময় বিরক্ত করতে? রাতের খাওয়া সারতে হয় নিরিবিলি, কোন ইন্টেরাপশন আমি পছন্দ করি না।
কিন্তু যে ঢুকেছে, তাকে আমি চিনি।
মার্থা।
চোখ কচলালাম আমি। মাথা ঠাণ্ডা করো, নিজেকে বললাম। ভুল দেখছি নিশ্চয়ই, বরফ দেয়া হুইস্কি হ্যালুসিনেশন তৈরি করেছে। পাঁচ পেগ খাওয়া ঠিক হয় নি, কোনমতেই ঠিক হয় নি।
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে মার্থা এসে বসলো টেবিলের ঐ প্রান্তে, টেবিলের নিচ দিয়ে ওর পা স্পর্শ করলো আমার পা। আমি চমকে উঠলাম, বরফশীতল।
না না, আমি ভুল দেখছি। চিমটি কেটে দেখলাম, ব্যথা পাচ্ছি। তা কী করে হয়?
মাংসের বাটিটা টেনে নিয়েছে মার্থা, খাওয়া শুরু করেছে হাতের একটা হাড়। নিজের মাংস নিজেই খাচ্ছে?
আমি ভাবলাম, মস্তিষ্ক আমাকে নিয়ে খেলছে। আমিও পাল্টা খেললে কেমন হয়? আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গিয়েছিলে মার্থা?
একটু বাইরে।
বাইরে তো তুষার পড়ছে, তুমি এই পোশাকে বাইরে থেকে ঘুরে এলে?
এলাম। আমার এখন তো কোন অনুভূতি নেই। মাংস চিবাচ্ছে সে।
বোতল শেষ। জিজ্ঞেস করলাম, জিন চলবে? ভদকা?
ভদকা, জবাব দিল সে। জীবিত থাকতে সে কখনোই ভদকা পছন্দ করতো না।
আমি উঠে গেলাম, ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলাম। বোতল নিয়ে আসার জন্য নয়, ফ্রিজে আসলেই দেহটা আছে কীনা দেখার জন্য।
দরজা খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার। আরে, পলিথিনে মোড়া পুঁটলিটা গেল কোথায়? সে জায়গায় আছে শুধু মাথাটা, খোলা চোখ এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা চুলশুন্য, সেখানে বিরাট এক গহ্বর, ব্রেনটা বের করে নেবার জন্য আমিই তৈরি করেছিলাম সেটা।
গোলমাল, বিরাট গোলমাল হয়েছে কোথাও। ভাল একটা ঘুম দিতে হবে, নেশার ঘোর কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বোতল না নিয়েই টেবিলে ফিরে আসি। মার্থা ততক্ষণে বাটি প্রায় শেষ করে এনেছে। এত তাড়াতাড়ি খায় সে?
আমি এসে তার মুখোমুখি বসলাম, তুমি মার্থা নও। তুমি মার্থা হতে পারো না। আমি তোমাকে নিজ হাতে খুন করেছি।
শান্ত চোখে আমার দিকে তাকাল সে, মুখ মুছলো। খাবারটা দারুণ হয়েছে, বলল সে।
আমার কথার জবাব দাও, চিৎকার করে বললাম আমি। কপালে ঘাম জমেছে আমার, রাগের সাথে জমা হচ্ছে ভয়। কী শীতল মার্থার চোখের চাহনি।
আমাকে খুন করে তুমি বিরাট ভুল করেছো, আলফ্রেড।
না, আমি তোমাকে মেরে ভুল করিনি। আমি ভুল দেখছি। হুইস্কি খাওয়া বেশি হয়ে গেছে, তাই ভুল দেখছি।
মোটেও ভুল দেখছ না। আমার পা যে খুব ঠাণ্ডা, টের পেয়েছ না? হাসি ফুটল মার্থার ঠোঁটে।
আমার মুখে কথা জোগাচ্ছে না। সে-ই কথা বলে চলল।
আমার গলায় যখন চেইন স’ টা চালালে, তখন আমার ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিল। কী করে তুমি এটা করতে পারলে?
আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। এক্ষুনি বিদায় হও।
তুমি যে কাজটা করেছো, সেটা খুব বীভৎস কাজ। সেটা কি একবারও তোমার মনে হল না?
দূর হও। ক্রমাগত চিৎকার করছি আমি। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, ঠিক যেভাবে ওর গলায় চেইন স’ চালানোর সময় গলাটা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল, সেভাবে মার্থার গলা ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, কণ্ঠনালী দিয়ে গলগল করে নেমে আসছে টকটকে লাল রক্ত।
থামো। বন্ধ করো। স্টপ ইট।
থামলো না সে। জিভটা খুলে পড়লো মুখ থেকে, লকলক করছে সাপের মতো, ঠিক যেন জীবন্ত কিছু। টেবিলের ওপর জ্যান্ত মাছের মতো নড়ছে ওটা। শরীর থেকে চামড়া খসে পড়লো, দেখা যায় না দৃশ্যটা। আমি চোখ সরাচ্ছি না, তাকিয়ে আছি আর চিৎকার করছি। প্লিজ, বন্ধ করো।
চামড়াবিহীন মার্থাকে কুৎসিত লাগছে, বুকের মাঝখান দিয়ে চিরে গেল, ভেতর থেকে বের হয়ে পড়লো অন্ত্র, নাড়িভুঁড়ি, হৃৎপিণ্ড এখনো স্পন্দিত হচ্ছে, রক্তে মাখামাখি একটা তাল যেন শরীরটা। মাথার চুল টপটপ করে সব পড়ে গেল, মাথার স্কাল্প খুলে গেল আর খুলিতে তৈরি হল গোল একটা গর্ত। স্বচ্ছ থিকথিকে একটা তরল বেরিয়ে পড়লো, ঘর নোংরা হয়ে গেছে, দুর্গন্ধে ভরে গেছে। ব্রেনটা, না না, কিলবিলে কিছু একটা মাথার গহ্বরটা থেকে বেরিয়ে পড়লো, মেঝেতে ঝরে পড়লো আর গা ঝাড়া দিয়ে, মুচড়ে মুচড়ে এদিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
আমার গলা দিয়ে তখন শব্দ বের হচ্ছে না, ভেঙে গেছে, ফ্যাঁসফ্যাঁস করছে। থামো, দোহাই লাগে তোমার।
দলাপাকানো দেহটা একটা চেইন স’ হাতে তুলে নিয়েছে, আমার দিকে এগিয়ে আসছে, বুঝতে পারছি, আমার গলা বরাবর চালাবে ওটা। উঠে দৌড় দেবো সে শক্তিও নেই।
চেইন স’ টা আমার গলা স্পর্শ করলো। গরম রক্তের ধারা টের পেলাম, আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালাম।
পুনশ্চঃ
প্রচণ্ড চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির মিস্টার উইলসন খবর দিয়েছিলেন পুলিশে। পুলিশ এসে যখন আলফ্রেডকে উদ্ধার করে, তখন সে মাটিতে পড়ে আছে, হাতে ধরা চেইন স’, নিজের গলায় চালিয়েছে। সারা ঘর রক্তে মাখামাখি, সেই সাথে আলফ্রেডের সারা শরীর ভেজা এক ধরণের থিকথিকে তরলে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, গলার ক্ষত বেশি গভীর নয়, এ যাত্রা বেঁচে যায় সে।
ফ্রিজ থেকে উদ্ধার করা হয় হতভাগ্য মার্থার দেহ, পলিথিনে মোড়ানো, মাথা বিচ্ছিন্ন, ব্রেন আর অন্যান্য অনেক অঙ্গ ভিনেগারের দ্রবণে চোবানো।
সুস্থ হয়ে ওঠার পর ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছে আলফ্রেড, মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত, কাউকেই চিনতে পারে না, সেরে উঠতে সময় লাগবে। সেই বাড়ি সীল করে দেয়া হয়েছে।
আর সেই ব্রাদারহুড? তারা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কোথাও কোন তথ্য রাখেনি আলফ্রেড। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কোন প্রশ্নই আসে না। মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে বলে ওঠে আলফ্রেড; মার্থা, তুমি কোথায়? চমৎকার মাংস রান্না করেছি, একবার এসে খেয়ে দ্যাখো।
………………………………………………….(সমাপ্ত)……………………………………………..