অজানা দ্বীপ

অজানা দ্বীপ

আমি একজন বুড়ো নাবিক। একটা সময় ছিল, যখন আমার রক্ত ছিল টকটকে লাল, মাথার চুল ছিল কুচকুচে কালো, শরীরে ছিল মোষের জোর। আজও তার কিছুটা অবশিষ্ট আছে, পনেরো বছর বয়সে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি নাম লিখিয়েছিলাম নাবিকের খাতায়, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঙ্গী হয়েছে আমার, বলে শেষ করা মুশকিল। ঝড় উঠেছে, বাদামের খোসার মতো দুলেছে আমাদের জাহাজ, হারিয়েছি আমার অনেক বন্ধুকে, কখনো হাঙরের তাড়া খেয়ে কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়েছি, কখনো হিমশীতল হাওয়ায় ছিটকে পড়েছি সমুদ্রে। ঈশ্বরের অনেক কৃপা, তাঁর লীলা বোঝা বড়ই দায়, এত কিছু দেখেও আমি এখনো বেঁচে আছি।

মালবাহী জাহাজে কাটিয়েছি সারাজীবন, নারকেল আর ভোজ্য তেলের জোগান দিতে ছুটে বেড়িয়েছি এই বন্দর থেকে সেই বন্দর। পৃথিবীর সব সমুদ্রপথ চষে ফেলেছি আমি, কোন কোনটাতে যাওয়া হয়েছে একাধিকবার। হাতের তালুর মতোই আমার চেনা এই সমুদ্র, বিশেষ করে আটলান্টিক, আর আমি হলফ করে বলে দিতে পারি, এর মতো বৈচিত্র্যময় সাগর আর একটিও নেই। ক্ষণে ক্ষণে আর জায়গায় জায়গায় রূপ বদলায় এটি, কিন্তু দীর্ঘদিন ঘুরতে ঘুরতে সত্যি, হাতের তালুর মতোই চেনা হয়ে গিয়েছিল এই মহাসাগরের সবকিছু, এর নীল জলরাশি, এর প্রাণীবৈচিত্র্য, এর বুকে ছড়িয়ে থাকা রহস্যময় দ্বীপগুলো, তাই প্রতিকূল পরিবেশে বেরিয়ে পড়তে ভয় পেতাম না একটুও।

তারপর একদিন আমার সময় ফুরিয়ে এলো, নবীনদের জায়গা করে দিতে বুড়োদের সবখানেই সরে যেতে হয়। আমিও সরে গেলাম, তবে পুরোপুরি নয়, আমি সমুদ্র ছাড়লেও সমুদ্র আমাকে ছাড়ে নি। কোন জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাকে আর চাইলেন না ঠিকই, কিন্তু লোনা পানির গন্ধ আমাকে কেমন করে যেন টানে, আমি ঘরে থাকতে পারি না, আবার বেরিয়ে পড়ি। কয়েকমাস, এমনকি বছর কেটে যায়, তারপর ঘরে ফিরে আসি, কুইবেকে। কিন্তু থাকতে পারি না, আবার বেরিয়ে পড়ি। নাবিক থেকে আমি এখন একজন শখের পর্যটক, জাহাজে জাহাজে করে ঘুরে বেড়াই। বিয়ে-থা করিনি, তাই খরচও তেমন নেই, কী হবে সঞ্চয় করে রেখে? তার চেয়ে ঘুরে বেড়াই আর নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা করি আরও কিছু অভিজ্ঞতা, মজার কিছু ঘটনা।
তার মধ্যে একটি ঘটনা আমার জীবনটাকেই উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। সেই কথাই আমি আজ আপনাকে বলবো।

চার্চিল থেকে লিভারপুলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে ব্রিটিশ জাহাজ ভিক্টোরিয়া, এখানে এসেছিল কিছু পর্যটককে নিয়ে, এবার ফিরে যাচ্ছে। আমি সুযোগ বুঝে উঠে পড়লাম, সঙ্গে তেমন কিছু মালমাত্তা নেই, আছে আমার ডায়রি, সামান্য কিছু কাপড়চোপড়, একটা ছুরি, আমার রিভলবার, টুকিটাকি জিনিসপত্র। মাঝারি দামের একটা কেবিনে জাঁকিয়ে বসলাম, এক ঝলমলে সকালে ভিক্টোরিয়া চার্চিল বন্দর ত্যাগ করলো। অনেকেই এসেছে প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে, আমার তিনকূলে কেউ নেই, সী-গালেরা বুঝি আমার উদ্দেশ্যে বিদায় সম্ভাষণ জানালো তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে। একরাশ কালো ধোঁয়া ছাড়ল আমাদের জাহাজ, আমি আমার বহু ব্যবহৃত পাইপ থেকে ডেকে দাঁড়িয়ে ছাড়লাম তামাকের ধোঁয়া।

আমরা কোন পথে যাবো? হাহ, এই পথ আমার অনেকদিনের চেনা, প্রতিটি বাঁক, মোড়, মোচড় চিনি আমি। নর্থ আটলান্টিকের এই রুটটা অনেক পুরনো, কানাডা থেকে গ্রেট ব্রিটেনে যাওয়া আসা করার প্রসিদ্ধ সমুদ্রপথ। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে পথ, সোজা এগিয়ে যাও এই লাল রেখাটা ধরে, প্রথমে পড়বে হাডসন বে, তারপর ল্যাব্রাডর সি, তারপর যে খোলা জায়গাটাতে পড়তে হবে, সেখানে একই সাথে এসে মিশেছে নর্থ আটলান্টিক কারেন্টের গরম পানি আর বাফিন বে’র ঠাণ্ডা পানি। যাত্রাপথের শুরুতে তুমি পাবে বাঁয়ে অর্থাৎ উত্তরে সাউদাম্পটন আইল্যান্ড, ডানে অর্থাৎ দক্ষিণে অন্টারিও, তার পরে পড়বে বাঁয়ে লেক হারভার, ডানে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, যাত্রাপথের যখন আর চার আনা বাকি, তখন দেখবে, ডানে আর কিছুই চোখে পড়ছে না শুধু পানি ছাড়া, আর বাঁয়ে আছে বিশাল গ্রিনল্যান্ড। অবশেষে আইরিশ বাতাস গায়ে লাগতেই বুঝবে আর বেশি দূরে নয়, ডাবলিন আর গ্লাসগোর মধ্যের সঙ্কীর্ণ জলপথ দিয়ে ব্রিটিশ এলাকায় পদার্পণ (নাকি জাহাজার্পন?) ঘটবে। যাত্রাপথের শেষ মাথায় দেখা মিলবে গন্তব্য লিভারপুলের।

কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ঘরে মন টেকে না, তাই বেরিয়ে পড়া, তারপর যদি মন চায়, তবে ফিরবো, নয়তো চলে যাবো লন্ডন, সেখান থেকে কেপটাউনগামী জাহাজ ছাড়ে, তাতে চড়ে বসবো। আপাতত এই ছিল আমার পরিকল্পনা, জীবিত ফিরে আসি তো ভাল, আর না এলেও কাঁদার জন্য কাউকে তো রেখে যাচ্ছি না। আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে সমুদ্রে, আমার দাদা, পরদাদা, তাঁদেরও একই অবস্থা। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে, এমনটা ভাবা মুশকিল।
কিন্তু আমার প্ল্যান অনুযায়ী সব ঘটবে, আমি ভাবলেও বিধাতা তা ভাবেন নি। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কল্পনাতীত এক অভিজ্ঞতা।

ডেকে বসে রোদ গায়ে লাগাচ্ছি, আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। বুড়োদের সবাই এড়িয়ে চলে, একমাত্র বুড়ো ছাড়া। তাই আমার ভাব হয়ে গেছে মিস্টার এন্টোনিওর সাথে, তিনি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, আমার মতো তিনিও শখের পর্যটক, ঘুরে বেড়ান যেখানে ইচ্ছে হয়। তবে এই যাত্রায় আছেন তাঁর স্ত্রী ডালমা, ভদ্রমহিলার মনে হল দুনিয়ার কোন জিনিসেই আগ্রহ নেই, একমাত্র সেলাইয়ের কাজ ছাড়া। উলের বল দুটো নিয়ে তিনি একমনে কী যেন বুনে চলেছেন, মাফলার বা এই রকম কিছু একটা হবে। আমরা দুই বুড়ো বসে বসে চুরুট আর পাইপের ধোঁয়া ছাড়ি, গল্প করি পেছনে আসা অনেকগুলো বছরের (যেটা কখনোই ফুরোবে না) আর দাবা খেলি। মিস্টার এন্টোনিওর বই পড়ার শখ, তিনি একগাদা বই নিয়ে এসেছেন সাথে করে, যখন তিনি বই পড়েন, আমি তখন রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকি দূরে (নাকি আমার পেছনের দিনগুলোতে?), কি সুন্দর জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ, পেছনে রেখে যাচ্ছে সাদা ফেনা, ঠিক যেমন করে আমরা চলে যাই, রেখে যাই কিছু স্মৃতি।
দিনের আলো ফুরিয়ে এলো, আমরা সবাই ক্লান্ত। ঘুমোতে চলে গেলেন মিস্টার এন্টোনিও। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি ডেকে, একা একা স্মৃতি রোমন্থন করতে আর বিশাল এই আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমার ভাল লাগে। ধীরে ধীরে তখন আকাশে জমা হচ্ছিল মেঘ, ঢেকে দিচ্ছিল ফুটে থাকা অজস্র তারা।
আমি তখন ভাবতেও পারি নি, সে রাতটাই আমার পেছনে ফেলে আসা নাবিক জীবনের দুর্দান্ত সময়ের কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেবে, কিন্তু একদম অন্যভাবে।

তখন মেঘের আড়ালে চলে গেছে ক্ষয়া চাঁদ, রহস্যময় অন্ধকার জল থেকে থেকে ক্বচিৎ চিকচিক করে উঠছে। আমি ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছি। সহসা কেন যেন ঝিরিঝিরি হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, আমার বুড়ো হাড় জানান দিল, ঝড় আসছে। ওরে পুরাতন শত্রু (আমি ঝড়কে এই নামেই ডাকি), আমাকে আর ভয় দেখাস না, এই বুড়ো অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, অনেক দেখেছে, অনেক শুনেছে। আমি ভয় খেলাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম সহসা শান্ত সমুদ্র কেমন করে বদলে গেল, পাহাড়সমান ঢেউ উঠতে লাগলো একের পর এক, আর মুকুটের মাথায় পাথরের মতো আমাদের জাহাজ হঠাৎ করে উঠে যেতে লাগলো তার ডগায়, পরক্ষণেই নেমে আসতে লাগলো অনেক নিচে, আমার হৃদস্পন্দন তখন বেড়ে গেছে, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারছি না এই অপার্থিব সৌন্দর্য থেকে, হাঁ করে চেয়ে আছি মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে ধেয়ে আসা পরের ঢেউটার দিকে। তখনই ঘটলো বিপত্তি।

হঠাৎ একদিকে কাত হয়ে গেল আমাদের জাহাজ, শোরগোল শুরু হল, সবাই ভয়ে চিৎকার করছে। হিমশীতল আটলান্টিক তখন ভয়াল হয়ে উঠেছে, জাহাজ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কারণ তখন পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে পেল্লায় সাইজের সব হিমবাহ, মানে বরফের স্তূপ, কায়দামতো লাগলে ছাতু হয়ে যাবে আমাদের জাহাজ। ক্যাপ্টেন সাইমনের হাঁকডাক তখন শোনা যাচ্ছে হরদম, তিনি উচ্চস্বরে গালাগালি করছেন জাহাজের ক্রুদের, ফার্স্ট মেট অ্যান্ডারসন তখন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাল সামলাতে, জাহাজ তখন মাতালের মতো একবার এদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে তো আরেকবার অন্যদিক। আমার তখন অন্য কোন দিকে যাওয়ার উপায় নেই, কোনমতে ডেকের রেলিং ধরে ঝুলে আছি, কাউকে সাহায্য করা যায় কিনা তাই দেখছি।

পাল নামাও, চড়া স্বরে হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন। এই উতলা বাতাসে পাল তুলে রাখা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা, দমকা বাতাস কোথায় যে জাহাজকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, তা কেউ ভাবতেও পারবে না।

ক্রো’জ নেস্ট (জাহাজের মাস্তুলে উঁচু জায়গায় বসানো কাকের বাসার মতো একটা জায়গা, যেখানে বসে একজন লোক সবসময় সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দিকনির্দেশনা দেয়) থেকে ভেসে এলো মার্টিনের গলা, সে-ও হাত লাগিয়েছে। বিপজ্জনকভাবে সে ঝুলে আছে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দশাসই পালটাকে কব্জা করতে। কিন্তু ফসকে গেল তার হাত, কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকে ঝুলে থাকতে দেখা গেল বাতাসে, তখনই এলো একটা ভীষণ ঝড়ো হাওয়া, রোগাপটকা মার্টিনকে কোথায় যে উড়িয়ে নিয়ে গেল বোঝাই গেল না, হিমশীতল ভয়ংকর আটলান্টিক তাকে গিলে নিল।
আরে, মার্টিন তো ডুবে গেল, জাহাজে হুল্লোড় উঠলো।
আমার মাথায় যেন কী খেলে গেল, আমি কালবিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ঠিক সেই জায়গাটা তাক করে, যেখানে সে পড়েছে। পেছনে কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলো, আরে, বোকা বুড়ো করছে কী? আরে, মরবে তো? ওকে কেউ টেনে তোল, টেনে তোল।

আমার মাথায় তখন কিচ্ছু ঢুকছে না, কারণ তখন আমার বুড়ো শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে হিমশীতল জল, দাঁতে দাঁতে লেগে গেল আমার, হাড় পর্যন্ত কেঁপে গেল। ভুল করলাম না তো? মার্টিনকে তো বাঁচাতে পারবোই না, উল্টো নিজেও মরবো। ইস, কী মুখ্খু আমি!

বাজ পড়লো সমুদ্রের মধ্যে, কড় কড় কড়াৎ! কয়েক সেকেন্ডের জন্য কানে তালা লেগে গেল আমার, আর আলোতে যে অংশটা দেখা গেল, তাতে আবছা ওটা কী দেখা গেল? আরে, একটা মানুষের হাত না? ডুবছে, আর ভাসছে। ওখানেই আছে হতভাগা মার্টিন। আমি সেদিকে সাঁতরাতে লাগলাম।

কিন্তু যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন সেখানে আর কিছুই ডুবছে আর ভাসছে না, বেমালুম যেন উবে গেছে আমাদের মার্টিন। আমি পাগলের মত একবার এদিকে আর একবার ওদিকে যেতে লাগলাম। তখন পানির তাপমাত্রা দশের বেশি নয়, আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। তখনই আমি শুনতে পেলাম আর্তচিৎকার। পেছনে তাকিয়ে ক্রমাগত বজ্রপাতের আলোয় যা দেখলাম, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। আমাদের জাহাজ ভিক্টোরিয়া তখন বিপজ্জনকভাবে কাত হয়ে পড়েছে একদিকে, নিশ্চয়ই আঘাত খেয়েছে কোন বরফের চাঁইতে, ফেঁসে গেছে তলা। জাহাজ থেকে ভেসে আসছে বিপন্ন মানুষের চিৎকার, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। বিপদের সময় মানুষ মা, বাবা, ভাই, বোন সবাইকে ভুলে যায়, তখন নিজেকে বাঁচানোই এক নম্বর হয়ে দাঁড়ায়, অন্তত আমি তাই দেখেছি। কিন্তু মাঝসমুদ্রে সাহায্য করতে আসবে কে?

শোঁ শোঁ শব্দ শুনে পেছনে তাকালাম, আমার তখন ভয় পাওয়ার ক্ষমতাও যেন লুপ্ত হয়ে গেছে, বিশাল একটা ঢেউ ধেয়ে আসছে আমার দিকে, কী বিশাল আর ভয়ংকর সেটা দূর থেকে বোঝা যায় নি, কিন্তু আমার নিজেকে মনে হল এই ঢেউটার কাছে এক টিপ নস্যির চেয়েও নগণ্য!

আমি কোনদিকে সরে যাওয়ার আগেই আমাকে যেন কোলে তুলে নিল সমুদ্রের ঢেউ, মা যেমন সন্তানকে কোলে তুলে নেয়। কয়েক মুহূর্ত আকাশে ডানা ছাড়াই ভেসে থাকার মতো অনুভূতি হল, কী শুন্যতা! তারপরই ঝপাস করে আমাকে ছুঁড়ে দিল সাগরের বুকে, আমি চলে গেলাম অনেক নিচে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ারও সময় পেলাম না। যখন উপরে ভেসে উঠলাম, তখন চলে এসেছে পরের ঢেউটা, আমাকে পাহাড়সমান উঁচুতে ছুঁড়ে দিল আবারো। ফের আবার, আবার, আবার। ততক্ষণে আমাদের ভিক্টোরিয়া ডুবে গেছে, তার লোকজন আর মালসামানা কোথায় ছিটকে পড়লো কে জানে?

আমাকে নিয়ে তখন বলের মতো লোফালুফি করছে সমুদ্রের ঢেউ, অসহায়ের মত হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছি আমি, বাঁচার সম্ভাবনা এই অবস্থায় শুন্যের কাছাকাছি। কিন্তু বাবা শিখিয়েছিলেন, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, আমি তাই বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলাম, বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী! আশেপাশে কোন ডাঙা নেই, অন্তত আমার জানামতে, সাহায্য পাওয়ার আশা শুন্যের কোঠায়, কোন কিছু, এমনকি একটা তক্তাও নেই, যে ধরে বাঁচবো, এদিকে শরীরের শক্তি ফুরিয়ে আসছে। ঢেউ ক্রমাগত আমাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে, কে জানে, গহীন সাগরে আমার সলিলসমাধি হবে হয়তো। আমি তখন মৃত্যুর গন্ধ পেতে শুরু করেছি, এক মনে ঈশ্বরকে ডাকছি, বিপদের সময়ই কেন যে তাঁকে মনে পড়ে কে জানে!

কোনদিকে ভেসে যাচ্ছি জানি না, শুধু হাত পা ছুঁড়ে চলেছি বেঁচে থাকার আশায়। সে আশা কত তীব্র সেটা যিনি বিপদে পড়েছেন শুধু তিনিই বুঝবেন। শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে ভীষণমাত্রায়, কী হবে জানি না। দু চোখ ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে, আর পারছি না।

জ্ঞান হারানোর আগে শুধু মনে আছে, আরেকটা ঢেউ আমাকে ছুঁড়ে ফেললো দূরে, অনেক দূরে। যখন পানিতে এসে আবার পড়লাম, তখন সব অন্ধকার।

চোখের ওপর রোদ এসে পড়তে চোখ মেললাম। আরে, আমি তো শুয়ে আছি মাটিতে। এ কী যাদুর খেলা? এখানে কি কোন দ্বীপ থাকার কথা? স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালাম আঁতিপাঁতি করে। উঁহু, এখানে তো কোন দ্বীপ থাকার কথা নয়? তাহলে এখানে এই রহস্যময় দ্বীপ এলো কোত্থেকে? আমি চোখ ডললাম। দিনের কড়া আলো এসে পড়েছে চোখের ওপরে, দিন এসেছে, বিভীষিকার রাত কেটে গেছে। নিশ্চয়ই ঈশ্বরের পাঠানো একটা চমৎকার ঢেউ আমাকে এই সমুদ্রতটে ছুঁড়ে দিয়ে গেছে। ব্যাপারটা ভাল হয়েছে কীনা জানি না, তবে খারাপ তো হয়নি নিশ্চয়ই। অন্তত আমি বেঁচে তো আছি।

চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে উঠে বসলাম। তখনই গা গুলিয়ে এলো, পেট মোচড় দিয়ে উঠলো, হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। লোনা পানি আরও কিছু জিনিস নিয়ে পেট থেকে বেরিয়ে গেল। ভালোই হল, নয়তো পরে যন্ত্রণা দিত।

আমি দ্রুত হিসাবনিকাশ করে নিলাম, একেবারে খালি হাতে এখানে আসি নি, নিজের অবস্থা দেখে হাসিই পেল, নির্জন জনমানবশূন্য (তবে ভারী সুন্দর) এই দ্বীপে আমি আটকা পড়েছি, আমার কোমরে বাঁধা আছে বড় ছুরিটা, আর পকেটে ঠেকল যেন কী একটা। আরে, আমার বহুদিনের সঙ্গী পাইপটা। এতকিছুর পরেও রয়ে গেছে আমার পকেটে, কী আশ্চর্য! আর আছে আমার শার্ট প্যান্ট, হ্যাটটা কোথায় যে গেছে হদিস নেই, থাকার কথাও নয়। আমার কাছে জিনিসপত্র বলতে এটুকুই। এগুলোও থাকার কথা নয়, আছে যে এই ভাগ্যি।
বেঁচে থাকতে হলে মাথা গরম করলে চলবে না, এইসব পরিস্থিতিতে বাঁচতে হলে প্রথমেই যেটা চাই সেটা হল ঠাণ্ডা মাথা। মাথা খাটিয়ে এগোলে অনেক কঠিন বিষয়ও সহজ হয়ে যায়, অভিজ্ঞতা তাই বলে। আমার এখন খাবারের জোগাড় দেখতে হবে, পানির খোঁজ করতে হবে, রাতে তাপমাত্রা পড়ে যাবে খুব দ্রুত, শীত জাঁকিয়ে বসার আগেই নিজেকে গরম রাখার জন্য চাই আগুন, দ্বীপে যদি বুনো জানোয়ার থাকে তবে আগুন সেগুলোকেও দূরে রাখবে। একটা ভাল আশ্রয় চাই, যেটা রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বাতাস, শীত সবকিছু মোটামুটি আটকাতে পারবে। এই পাণ্ডববর্জিত দ্বীপে এই সব মিলবে কিনা কে জানে। সবশেষে এই দ্বীপ থেকে আবার সভ্যভূমিতে ফেরার উপায় দেখতে হবে, যেটা হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কপাল ভাল থাকলে একটা জাহাজ এসেও পড়তে পারে এই পথে, মুশকিল হল আমি জাহাজের রুট থেকে কতটা দূরে এসে পড়েছি, সেটাই জানি না, অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ কিছু তো নয়ই। সেগুলো পরের কাজ, আগেরটা আগেই সারি। কাজে লেগে পড়া যাক, সেজন্য দ্বীপটা একটু ঘুরে দেখতে হবে, তার আগে সূর্য দেখে দিক ঠিক করে নিলাম। ততক্ষণে পরনের ভেজা কাপড় চিপে পানি ঝরিয়ে নিলাম, চড়া রোদে শুকিয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কে জানে কীভাবে এই কাপড়েই রাত পার করলাম।

এই দ্বীপের নাম কী? কে জানে ছাই। আমি নাম দিলাম হিউগো আইল্যান্ড। আগে বোধহয় মানুষের পা পড়েনি, আমিই এই দ্বীপের আবিষ্কারক, কাজেই আমার নামে নাম হবে, এ আর আশ্চর্য কী? সবুজে ছাওয়া একটা দ্বীপ, প্রথমেই যেটা দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলাম সেটা একটা নারকেল গাছ, পানির অভাব হবে না, তবে বেশি খেলে পেটে সইবে কীনা সেটাই হল জিজ্ঞাসার বিষয়। কিচিরমিচির শুনে উপরে তাকালাম, দেখলাম একদল বানর, পাতা-ফল ছিঁড়ে চিবোচ্ছে, কয়েকটা আমাকে দেখে ভীত স্বরে ডাকল, কেউ মুখ ভেংচি কাটল, আর কয়েকটা পালিয়ে গেল। কয়েকটা তো রীতিমতো উৎসাহী, আড়াল থেকে কৌতূহল ভরে দেখতে লাগলো আমাকে, হয়তো আমাকে তাদেরই মতো কিছু একটা মনে করেছে, স্বজাতিভুক্ত আর কি! একটাকে যদি ঘায়েল করতে পারি তবে খাবারের জোগাড় হয়ে যাবে। শক্ত আর মজবুত দেখে একটা গাছের ডাল কেটে নিলাম, ছুরি দিয়ে সূচালো করে নিলাম ডগা। একটা অস্ত্র হাতে থাকা ভাল। খুব আহামরি না হলেও বর্শার কাজ দেবে। নলখাগড়া আর বাঁশ দেখে প্ল্যান খেলে গেল মাথায়, চওড়া হল মুখের হাসি। পানি “তৈরি” করা যাবে, সমুদ্রের পানি থেকেই। সেজন্যে লাগবে আগুন, বাঁশের একটা অংশ কেটে ফাঁপা জায়গায় ভরে নেব পানি, তারপর মুখটা আটকে দেব, নিচ থেকে আগুন দিয়ে তাপ দিতে হবে, পানি বাষ্পীভূত হয়ে যাবে নলখাগড়ার মধ্য দিয়ে, নলের অপর পাশে সেটাকে একটা কিছুতে ধরে রাখতে হবে। পাওয়া যাবে মিষ্টি পানি। নারকেলের মালা হলেই ধরে রাখতে পারবো। যত সহজে বলে ফেললাম তত সহজ নয় ব্যাপারটা, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাছাড়া পানি পাওয়া যাবে খুব কম, হিসাব করে খরচ করতে হবে। তবে উপায় হওয়া নিয়ে কথা।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পুরো দ্বীপে চক্কর দিলাম আমি, আকৃতিতে উপবৃত্তাকার দ্বীপটা, সবচেয়ে লম্বা জায়গায় প্রায় দু’কিলোমিটার। খাবার নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই, ফল আছে এন্তার, বুনো বেরি, কমলা আরও বেশ কিছু। কয়েকটা নিয়ে এসেছি পকেটে করে, গাছে উঠে নারকেল পাড়লাম, ছুরি দিয়ে কেটে পানি দিয়ে গলা ভেজালাম আর শাঁসটা খেয়ে নিলাম। পেটে দানাপানি পড়েছে, মন ভাল লাগলো বেশ। শরীরে বলও পাওয়া গেছে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, আশ্রয় কোথায় নেব? একটা আস্তানা বানিয়ে নেবার কথা যে মনে আসে নি তা নয়, তবে কপাল ভালো, একটা ছোট টিলামতো পাওয়া গেল সমুদ্রতটের কাছেই, সেটার ভেতরটা পরিষ্কার করে নিলাম। খাসা পাওয়া গেছে জায়গাটা, এটাই হবে আমার থাকার জায়গা। আগুন জ্বালাতে হবে, ধোঁয়া তৈরি করতে হবে, যাতে পোকামাকড় কাছে ঘেঁষতে না পারে। আগুন রাতের বেলায় অনেক দূর থেকে দেখা যায়, যদি পথে বাধা না থাকে। তবে সেটা জ্বালাতে কালঘাম ছুটে গেল আমার, বহু প্রাচীন উপায়ে যেভাবে গহীন অরণ্যের জংলীরা জ্বালায়, আমি সেই উপায়ে আগুন জ্বালালাম। এই বেলা বলে রাখি, উপায়টা সরল হলেও সহজ নয়। একটা আতশ কাঁচ হলে সূর্যের আলো থেকেই আগুন জ্বালানো যেত, নেই যখন কী আর করা যাবে। শক্ত দেখে একটা শুকনো কাঠি রাখলাম, শুকিয়ে যাওয়া কিছু তুষের মতো লতার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলাম শুকনো গাছের গুঁড়ির মধ্যে করা একটা ফুটোতে। তারপর কাঠিটা জোরসে ঘোরাতে লাগলাম ফুটোটার মধ্যে ঢুকিয়ে। যত জোরে ঘোরাবো, তত গরম হয়ে উঠবে জিনিসটা, একসময় ধোঁয়া দেখা যাবে, আর ক্রমে তৈরি হবে আগুন। অনেকক্ষণ ধরে একইভাবে একই গতিতে কাজ করতে হবে, নয়তো কোন লাভ হবে না। আমি কাঠি ঘোরাতে লাগলাম, ঘোরাতেই লাগলাম, কপালে জমে উঠতে লাগলো ঘাম, কাঁপছে তুষের গুঁড়ো, আমি থামছি না। ধোঁয়া দেখা দিল, কিন্তু আগুনের দেখা নেই। কয়েক মিনিট হয়ে গেল, হাত ব্যথা হয়ে গেছে, আমি দূর ছাই বলে রেখে দেব এমন সময় বেরিয়ে এলো আগুন। খুব ছোট একটা ফুলকি, এটাকেই কোথাও লাগিয়ে দিতে পারলে চমৎকার হবে। আমি একটা ছোট বাচ্চাকে যেমন সাবধানে ধরতে হয়, তেমনি ফুলকিটাকে ধরে নিয়ে গেলাম, খুব ধীরে ধীরে ফুঁ দিতে লাগলাম শুকনো খড়কুটোর মধ্যে রেখে। একটু ভুল করলেই নিভে যাবে ফুলকিটা, আমার এতক্ষণের পরিশ্রম জলে যাবে। অবশেষে আগুন লাগলো ডালপালা আর খড়কুটোয়, জ্বলে উঠলো ধিকিধিকি করে। আমি উসকে দিলাম সেটাকে, গাছের ডাল দিয়ে, আঃ, এতক্ষণে আরাম টের পাওয়া যাচ্ছে। ততক্ষণে দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে। আগুনটাকে যতটা পারা যায় বড় করেছি, কিছু কাঁচা ডালপালা এনে তাতেও লাগিয়ে দিয়েছি আগুন, এতে আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি হবে, পোকামাকড় দূরে থাকবে।
দূর দিগন্তে সূর্য অস্ত গেল। দ্বীপটাতে নেমে এলো অন্ধকার। আকাশ ঢেকে আছে মেঘে, বৃষ্টি নামবে কীনা কে জানে।

এবারে নিদ্রা। দু চোখ যেন আপনা থেকেই মুদে এলো। তোফা ঘুম হল সে রাতে, মনেই হয় নি শুয়ে আছি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা জনমানবশূন্য দ্বীপে, একা।

এই দ্বীপে আমি এসেছি দুদিন হয়ে গেছে। বলার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। তবে ঘটার বাকি ছিল।
তখন রাত। আমি নিশ্চিন্তে শুয়ে আছি আমার ছোট্ট আস্তানায়, ফিনিক ফোটা জোছনা ঝরে পড়ছে আমার চোখের সামনে যতদূর দেখা যায় সমুদ্রতটের, ততটাতেই। যাঁরা কখনো এই সৌন্দর্য দেখেন নি, তাঁরা বুঝবেন না, কোনমতেই, কোন ভাষাতেই এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে বহু সুন্দর বস্তু দেখেছি, তবে এই জোছনালোকিত সমুদ্রতটের কোন সমকক্ষ পাই নি। আমি ঘুমোতে যাবার আগে অপলক তাকিয়ে থাকি চাঁদের আলোয় স্নাত এই সমুদ্রের জলরাশির দিকে।

তৃতীয় দিন। আমি সেদিন দ্বীপটাতে ঘুরে দেখতে বেরিয়েছি, সমুদ্রতট থেকে একটা পথ চলে গেছে জঙ্গলের ভেতরে, হ্যাঁ, দ্বীপটার মাঝ বরাবর রয়েছে জঙ্গুলে জায়গা। তবে ভয়ের কিছু দেখিনি, কিছুদূর গিয়ে বুঝেছি বানর আর শুয়োর ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। সমুদ্রতটে রয়েছে লাখো লাখো লাল কাঁকড়া, তারা চলাফেরা করে নিশ্চিন্তে, তবে আমার পায়ের সাড়া পেলেই চোখের পলকে বালুতে গর্ত খুঁড়ে হারিয়ে যায়। তখনই চোখে পড়লো জিনিসটা।

একটা পায়ের ছাপ। ছাপটা দেখেই আমার আত্মা জল হয়ে গেল। কারণ এমন পায়ের ছাপ আমি বাপের কালে কখনো দেখিনি।

মাত্র দুটো আঙুল ছাপটাতে। আমার চেনা কোন প্রাণীর পায়ের ছাপ নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। আর আকার দেখে যেটা বুঝলাম, ওটা হবে লম্বায় আমার তিনগুন, ওজনে তার চেয়েও বেশি। এই দ্বীপে এটা কোত্থেকে এলো? আমি দ্বীপে আসার পর এই প্রথম সত্যিকারের ভয় পেলাম, ঢোক গিললাম, বনে না ঢুকে ফিরে এলাম। সত্যিই যদি এমন ভয়ংকর কিছু থেকে থাকে, একটা ছুরি আর গাছের ডাল নিয়ে এর মুখোমুখি হওয়া হবে আত্মহত্যার শামিল।

নিজের ডেরায় ফিরে এলাম, অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, মনে হল, আমি আর নিরাপদ নই। সতর্ক দৃষ্টি রাখলাম জঙ্গলের দিকে, কিছু একটা বেরিয়ে এলে যেন টের পাই। দিনের অন্যান্য কাজকর্ম সারলাম, তবে মনে গেঁথে আছে পায়ের ছাপটার কথা। বন থেকে বেরিয়ে এলো একটা দাঁতালো শুয়োর, চমকে উঠলাম আমি। আমাকে দেখেই অবশ্য পালিয়ে গেল সেটা।

রাত নামলো, আমি আজ এই আস্তানায় থাকতে স্বস্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ ঘটবে। বেঘোরে কি কোন অজানা জন্তুর হাতে প্রাণ খোয়াতে হবে? ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছি, এমন সময় কানে এলো শব্দটা।

তীক্ষ্ণ, প্রলম্বিত একটা চিৎকার। চেনা কোন জন্তুর ডাক নয়, তবে কি সেটার ডাক, যেটার পায়ের ছাপ আমি দেখেছি?

আবারো ডাকটা শোনা গেল, রক্ত হিম করে দেয় এমন একটা ডাক, আমি জিনিসটা কেমন দেখতে চিন্তা করতে লাগলাম, হায়েনার হাসির সাথে নেকড়ের ডাক মেলালে যেমন হয়, ঠিক তেমনি ডাকটা। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবং উঠে দৌড়াতে লাগলাম, লক্ষ উঁচু মেহগনি গাছটা। চট করে উঠে পড়লাম, উঠে গেলাম বেশ খানিকটা উঁচুতে। অন্তত কিছুটা সময় রক্ষা পেতে পারবো।

ভারী পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে, কেউ নির্ঘাত জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরুচ্ছে। আমি প্রাণ হাতে করে বসে রইলাম, নড়াচড়া করতে ভুলে গেছি।
চন্দ্রালোকিত সৈকতে জিনিসটা যখন বেরিয়ে এলো, তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, আর দেখে প্রমাদ গুনলাম।

প্রাণীটা দোপেয়ে। দেখতে গরিলার মতো, তবে আকারে সেটার চেয়ে অনেক বেশি। আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখল জন্তুটা, তারপর গর্জন করে উঠলো, মনে হল কানের কাছে বাজ পড়লো। বুক চাপড়াল সে, ঠিক গরিলার মতোই, তারপর এগিয়ে গেলো আমার জ্বালানো আগুনটার দিকে। একটা কাঠ তুলে নিল সেখান থেকে, তারপর ছুঁড়ে ফেললো দূরে। মাথা উঁচু করে বাতাস শুঁকল, কিছু একটা টের পেয়েছে। মানুষের গন্ধ পেয়ে গেল না তো?

ঘুরে দাঁড়ালো প্রাণীটা, এদিকেই তো আসছে। আমি তখন ঈশ্বরকে ডাকছি, রক্ষা কর প্রভু!

সোজা এদিকে আসছিল প্রাণীটা, আমি চাঁদের আলোতে দেখতে পেলাম জিনিসটার শরীর আর মুখ। সারা শরীর ধূসর রঙয়ের লোমে ঢাকা, মুখটা ছুঁচালো, শ্বদন্ত বেরিয়ে আছে, আলো পড়ে চকচক করছে। হলুদ রঙয়ের লালা গড়াচ্ছে মুখ দিয়ে। আর চোখ দেখে আমি গাছের ওপর থেকেও শিউরে উঠলাম, কামেলা রোগীর মতো হলুদ বর্ণের চোখ। চলার সময় গোঙানির মতো আওয়াজ করছে, আমার থেকে এখন দূরত্ব পনেরো হাতের মতো।

ভাগ্য ভাল, এমন সময় খসখস শব্দ হল জঙ্গলে। মুখ বের করলো একটা শুয়োর। দিনের বেলায় যেটা এসেছিল সেটাই কি?

দানবটা ঘুরে গেল সেদিকে। এক মুহূর্ত থম মেরে রইলো, তারপর সেটার দিকে দৌড়াতে লাগলো। আমি দম বন্ধ করে ঘটনা দেখছি।

বনে ঢুকে গেল প্রাণীটা। কিছুক্ষণ পরেই এলো মরণ চিৎকার। শুয়োরটাকে ধরেছে সেটা, এক টানে বোধহয় ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছে।

আমি সারারাত গাছের ওপরেই বসে রইলাম, নিচে নামার সাহস হল না, দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

ভোরের দিকে দু’চোখ এক হয়ে এসেছিল, এক সময় ঘুম ভাঙল। উফ, কি একটা রাত গেল।

পা টিপে টিপে গাছ থেকে নামলাম আমি, নিজের গুহায় ফিরলাম, তখন নিভে গেছে আগুন, ছাই পড়ে আছে। যেমন করেই হোক, এই দ্বীপ থেকে বেরুতে হবে, নয়তো ঐ শুয়োরটার মতো অবস্থা হবে আমারও।

লাঠি আর ছুরি নিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়লাম আমি, খাবারের জোগাড় দেখতে হবে। ভয়ে ভয়ে সামান্য গিয়েই ফিরে এলাম, রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে একটা জায়গা, এখানেই নিশ্চয়ই উদরপূর্তি করেছে জন্তুটা। চিবোনো হাড় পড়ে আছে এখানে, আমি পিছিয়ে এলাম।
সারাটা দিন পাহারা দিলাম আমি, বিশ্রাম নিলাম হাতে লাঠি নিয়ে, ছুরিটা প্রস্তুত রেখেছি। অবশ্য জিনিসটা আমাকে আক্রমণ করলে এসব কোন কাজেই আসার কথা নয়, শারীরিক শক্তিতে সেটা আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে।

সূর্য এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিগন্তে, আর আমার মনে জেঁকে বসছে ভয়, কাল রাতের মতোই কি নির্ঘুম কাটাতে হবে? আর কদিন এভাবে চলবে?
সন্ধ্যা হতেই গাছে উঠে বসেছি, আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়েছি যদিও। ওটা এলেও আমাকে তো দেখতে পাচ্ছে না। রাতে যদি কোন জাহাজ এদিকে আসে? সম্ভাবনা কম, তবুও, যদি আসে?

রাতের আঁধার যখন জেঁকে বসেছে, তখন আবার শোনা গেল সেই জন্তুটার আওয়াজ। মনে ভয় ধরে গেল আমার। দুপদুপ শব্দ করে সেটা বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। সেদিনের মতো হলুদ লালা পড়ছে মুখ থেকে, বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছি এখান থেকেও।

গতকালের মতো আজও আগুনের দিকে এগিয়ে গেল জন্তুটা, তবে কাঠ তুলে নিল না। চক্কর খেতে লাগলো আগুনটা ঘিরে।

আমি দম খিঁচে বসে আছি গাছের ওপর, আবার দেখে না ফেলে। এমন সময় এমন একটা আওয়াজ এলো, যেটা শোনার জন্য এই কদিন মুখিয়ে আছি আমি।
হ্যাঁ, একটা জাহাজের ভেঁপু। আগুন দেখেছে নিশ্চয়ই, দেখে সংকেত দিচ্ছে। আমার বাঁচার সুযোগ এসে গেছে। সভ্য জগতে ফেরার সুযোগ।

কিন্তু নিচে তো ওঁত পেতে আছে মূর্তিমান দানব। কী করে ওটাকে এড়িয়ে জাহাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো?
জাহাজটা স্থির হয়েছে বেশ খানিকটা দূরে। নড়াচড়া থামিয়ে দিয়েছে। আমি এখনো কোন সাড়া দিই নি। তাহলে কি সুযোগটা এভাবেই নষ্ট হবে? না না, এটা হতে দেওয়া যায় না। মরতে হলেও আমাকে চেষ্টা করতে হবে। আমি গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়লাম, ধুপ করে শব্দ হল, পা’টা মচকে গেল কিনা কে জানে, দেখার সময় নেই। সমুদ্রতটের দিকে দৌড় লাগালাম। দু হাত তুলে চিৎকার করলাম, এই, এই। বাঁচাও, এই তো, আমি এখানে। সাহায্য। সাহায্য। হেল্প। হেল্প।

আমাকে দেখে ফেলেছে জানোয়ারটা। ঘুরে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত থেমে পিছু নিল আমার। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, লম্বা লম্বা পায়ে আমার সাথে দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে ওটার। ইস, আর কত দূরে সমুদ্রের জল?

আধ মিনিট পরেই আমার ঘাড়ে ওটার নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো ওটার, ধরে ফেললো বলে। আমি একই সাথে পালাচ্ছি আর চিৎকার করছি, বাঁচতে আমাকে হবেই।
হঠাৎ বাঁ উরুতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করলাম, ক্ষুরধার নখর বিঁধিয়ে দিয়েছে জন্তুটা। আমি ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম, পেছন ফিরে অন্ধর মতো কয়েকবার ছুরি চালালাম, একবার লেগে গেলোও ওটার গায়ে, জান্তব চিৎকার করে পিছিয়ে গেল ওটা, তারপর বুক চাপড়ে আমাকে আবার ধাওয়া করলো। আমি তখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছি, পানি তখন আমার গোড়ালি স্পর্শ করছে। ক্রমে পানিতে গা ভাসিয়ে দিলাম আমি, প্রাণপণে সাঁতার কেটে দূরে সরে যেতে লাগলাম। বাঁ উরুতে তখন যেন আগুন জ্বলছে, ভীষণ জ্বালা করছে।

পেছনে তাকালাম একবার। প্রাণীটা কি আমার সাথে পানিতে নেমে পড়েছে? না, ঐ তো, সৈকতে দাঁড়িয়ে আছে। বুক চাপড়াল একবার, তারপর প্রলম্বিত অমানুষিক চিৎকার করে উঠলো, চাঁদের আলোয় কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে জীবটাকে! আমি সামনে তাকালাম, গলা চিৎকার করতে করতে ভেঙে গেছে, জলের ঝাপটায় ঝাপসা হয়ে আসছে জাহাজটার অবয়ব।
শেষবারের মতো আমি বলার চেষ্টা করলাম, বাঁচাও।
শক্ত একটা হাতের স্পর্শ টের পেলাম, আমাকে উপরে তুলে নিচ্ছে। আমি পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজলাম। হা ঈশ্বর, তোমাকে ধন্যবাদ।

পুনশ্চঃ
এই ছিল আমার গল্প। কেপটাউনগামী একটা জাহাজ, “স্কুনার ভি” আগুন জ্বালানো দেখতে পায় দ্বীপে, তারপর থামায়। আমি যখন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন দয়ালু ক্যাপ্টেন ফিলিপ আদেশ দেন আমাকে তুলে নিতে। আমাকে তুলে নেবার পরও আমি নাকি চিৎকার করছিলাম, সাহায্য করো, বাঁচাও, বিপদ, দানব, আরও নানা আবোলতাবোল শব্দ।

জাহাজের মুখ গন্তব্যের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল, রওনা হল দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে। আমার তখন গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে, ভুল বকছি, ঘুমের ওষুধ দিলেন জাহাজের ডাক্তার বোরম্যান। বিষাক্ত নখরের ক্ষতটা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারতো, কিন্তু সময়মত ওষুধ পড়াতেই হয়তো সেযাত্রা আমি সেরে উঠি। ও হ্যাঁ, আমার দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ হয়েছিল তিন মাসের, সেখান থেকে ফিরতি জাহাজে কুইবেক ফিরে আসি।

আমার ঘটনা তো শুনলেন। অনেকেই শুনেছে। বিশেষ একটা দল গিয়েছিল দ্বীপটার বিষয়ে খোঁজখবর করতে, কিন্তু আমার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী গিয়ে কিছুই পায় নি তারা, অথৈ পানি ছাড়া। তাঁদের আরেকটা কাজ ছিল ডুবে যাওয়া জাহাজ ভিক্টোরিয়ার ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা, কিছুই খুঁজে পায় নি তারা, বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে জাহাজটা। হায়, মিস্টার এন্টোনিও।

কে জানে, হয়তো চিরকালই দ্বীপটা অজানা থেকে যাবে, আবার আমার মতো সৌভাগ্যবান অথবা দুর্ভাগ্যবান কেউ গেলে খুঁজে পাবে রহস্যময় এই ছোট্ট দ্বীপটা। আটলান্টিকের বিশাল বুকে লুকিয়ে থাকা সেই দ্বীপের সমুদ্রতটে কি এখনো লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়ায়? রাতে কি অঝোরে ঝরে পড়ে জোছনা? উঁকি দেয় কি বুনো শুয়োর? কিচিরমিচির করে বানর, গান গায় পাখি?
আর সেই ভয়ংকর প্রাণীটা কি এখনো সেখানে আছে? কে জানে বাপু, তার সাথে মোলাকাত না ঘটাই ভাল।
তারপর ম্যালা জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু কেন যেন সেই দ্বীপটার কথা আমার খুব মনে পড়ে।

……………………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………………….

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত