মা, বাবা! বাঁচাও, বাঁচাও! আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি।
ধুপধাপ শব্দ পাওয়া গেল। কেউ ভারী পায়ে ছুটে আসছে।
আমার ঘরের দরজাটার ছিটকিনি লাগানো হয় না, কাজেই মানুষটা দরজা খুলে ঢুকে পড়লো।
বাবা এসেছেন। ততক্ষণে আমারও ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে, আমি বিছানার ওপর বসে কুলকুল করে ঘামছি আর জিভ বের করে হাঁপাচ্ছি।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। বাবা প্রথম মুখ খুললেন। আবার সেই সমস্যা?
আমি মাথা নাড়ি। সেই একই সমস্যা। আমার বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে, ঘামে ভিজে সারা শরীর জবজবে। খুব অস্থির লাগছে। একটা বিশ্রী স্বপ্ন যে শরীরকে ভীষণ ক্লান্ত করে দিতে পারে, সেটা আগে জানতাম না।
বাবা বললেন, পানি খাবি?
আমি কিছু বললাম না। খুব পিপাসা লেগেছে যদিও, গলা শুকিয়ে কাঠ।
বাবা নিজেই এগিয়ে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসটাতে পানি ঢাললেন। আমার হাতে দিলেন। বললেন, নে, পানি খা।
আমি ঢকঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে দিই।
তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে আমার মুখের দু’পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
আস্তে আস্তে খা, বললেন বাবা।
ততক্ষণে আমি পুরো গ্লাস খালি করে ফেলেছি। গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম বাবার দিকে।
আরও খাবি?
না।
তোর মাকে ডাকবো? না হয় এসে রাতটা এখানে থাকুক।
দরকার নেই। যাও, বাবা। আর কিছু হবে না। এক রাতে একবারের বেশি সমস্যা হয় না। তোমরা চিন্তা কোরো না।
বাবা খানিকক্ষণ দ্বিধা করলেন। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে একবার পেছনে তাকালেন, আমি দেখলাম, বাবার চোখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। দরজাটা একটু ফাঁক করে রেখে গেলেন এবার।
দুশ্চিন্তা থাকার কোন কারণই নেই। আমার বয়স খুব একটা কম, তা নয়। কয়েক ঘর পরে বাবা আর মা থাকেন, ডাক দিলেই উনাদের সাড়া পাওয়া যায়। বারান্দায় সবসময় একটা একশো পাওয়ারের বাতি জ্বলে, যাতে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে ভয় না পাই। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় নি। আজ চার দিন ধরে প্রতি রাতে আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বিকট, ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নটা কুৎসিত। বীভৎস। মানুষ তো কতরকম স্বপ্নই দেখে, সেটা নিয়ে এত চিন্তা করলে তো মুশকিল। কিন্তু আমি প্রতি রাতে একই স্বপ্ন দেখি, সেটাই হচ্ছে সমস্যা।
স্বপ্নটা হচ্ছে, আমি দেখি একটা আয়নার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। আমি হঠাৎ একটা পশুতে পরিণত হতে শুরু করি। আমার শরীরের চামড়া গলে গলে খসে পড়ে, পিঠের হাড় বেরিয়ে আসে, চোখ দুটো হলুদ হয়ে যায়, মুখের আকার বড় হয়ে বিশাল মুখগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে আসে কালো কুচকুচে লম্বা জিহ্বা, মুখের দু’পাশ দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত লালা পড়তে থাকে, শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে। আমার হাত দুটো বেঁকে যায়, আঙুল ভেদ করে বেরিয়ে আসে তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখর। আমি কুঁজো হয়ে যাই, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বুনো চিৎকার। হাতের মুঠো বদলে যায় থাবায়, পা পর্যন্ত বেঁকে যায়। সারা শরীর ভরে যায় লম্বা লম্বা লোমে। পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণী আছে বলে আমার জানা নেই। না কুকুর, না নেকড়ে, না অন্য কিছু। যেমন কুৎসিত, তেমনি ভয়ংকর সেই প্রাণী। পুরো সময় আমি অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপতে থাকি।
স্বপ্নে একসময় আমার সম্পূর্ণ রূপান্তর শেষ হয়, তারপর আর বোঝার উপায় থাকে না যে আমি একটা মানুষ, কিংবা মানুষ ছিলাম। ঘুষি মেরে আমি ভেঙে ফেলি আয়না। নিজের শরীর নিজের বড় বড় নখর দিয়েই ছিঁড়ে ফেলি, নিজেকে ছিন্নভিন্ন করতে থাকি।
এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি তখন প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করি, বাবাকে ডাকি, মা’কে ডাকি, ঘামে আমার পুরো শরীর ভিজে যায়, তেষ্টায় বুক ফেটে যায়।
আজকাল হরর মুভিগুলোতে এসবের চেয়েও বীভৎস জিনিস দেখায়। রক্তাক্ত লাশ, মানুষকে ফেঁড়ে দু’টুকরো করে ফেলা, চিবিয়ে চিবিয়ে নরমাংস খাওয়া, সব। যারা হরর মুভি দেখে, তারা মাঝেমধ্যে রাতে এসব নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে। কিন্তু আমি জীবনে কোন ভৌতিক ছবি দেখিনি, ভয়ের গল্পও পড়েছি খুব কম, কাজেই এটা কোন কারণ হতে পারে না।
স্বপ্নটা বাবা আর মা’কে বলেছি। প্রথমে তাঁরা দুজনেই ভেবেছেন, সাধারণ স্বপ্ন, একদিন, বড়জোর দু’দিন হয়তো আমি এমনটা দেখবো। আমিও তাই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু দিনের পর দিন আমি একই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি। আমার ভয় কমছে না, বরং বেড়েই চলেছে। মাঝেমধ্যে তো আমি পিঠে হাত দিয়ে দেখি, সত্যিই আমার পিঠ ভেদ করে কোন হাড় বেরিয়ে এসেছে কীনা পরখ করার জন্য।
এখন বাবা আর মায়ের দুশ্চিন্তা বেড়ে চলেছে। আমি লক্ষ করেছি, উনারা চুপিচুপি বলাবলি করেন, ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো? রাতদুপুরে যেভাবে চিৎকার করে, তাতে তো ভয়ই লাগে। জটিল কোন মানসিক রোগ হতে পারে। আজকাল তো ছেলেপুলেদের হরহামেশাই হচ্ছে। শেষকালে পাড়াপড়শিদের কানে গেলে তো সর্বনাশ। খুব সাবধানে থাকতে হবে।
আমি সারাদিন বিষণ্ণ হয়ে থাকি। পড়াশোনায় মন বসে না। ভার্সিটিতে যাই, কিন্তু ক্লাস, খেলাধুলা কিছুই ভাল লাগে না। বন্ধুদের কাউকে বলিনি ব্যাপারটা, যদি হাসাহাসি করে?
দিনের আলোতেও হঠাৎ হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠি। রাতে ঘুমোতে যেতে ভয় পাই। আবার যদি ঐ স্বপ্নটা দেখি? এমনটা চলতে থাকলে আমি যত শক্ত মনের মানুষই হই না কেন, নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। তাছাড়া সারাদিন খাবারদাবারে রুচি পাই না। চারদিনেই আমার গাল ভেঙে গেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, আর সে চোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের মতো, আমি নিজেই চমকে যাই। আমার এক বন্ধু নিজে থেকেই জানতে চেয়েছিল কী হয়েছে, আমি শুকনো হাসি হেসে এড়িয়ে গেছি। কাউকে কিছু বলা যাবে না, কাউকে না।
মা চান আমার সাথে এসে শুতে, হয়তো ছেলের আশেপাশে কেউ থাকলে ভয়টা কেটে যাবে। আমি সেটা করতে দিই না। বাবাকেও আমার ঘরে থাকতে দিই না। আমার বয়স এখন বাইশ, একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছি, বাবা কিংবা মায়ের সাথে শুয়ে ভয় দূর করতে হবে, এটা চিন্তা করেই খুব লজ্জা লাগে।
রাত নেমেছে। আমি ঘুমোতে গেলাম। বুক কাঁপছে। আমি জানি, সেই স্বপ্নটা আবার দেখবো, তারপর চিৎকার করতে করতে ঘুম ভাঙবে। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে গেলে ঘুম হবার কথা নয়। তবুও, সারারাত তো আর তাই বলে জেগে বসে থাকতে পারি না। বাবা বলে দিয়েছেন, দরজা খোলা রাখিস, আবার ভয় পেয়ে যদি ফিট হয়ে পড়ে যাস।
আমি বাবার দিকে তাকাতেই তিনি হেসে আমার মাথায় হাত বুলোলেন। ভয়ের কিছু নেই। একটু সাহস রাখ্, দেখবি স্বপ্ন আপনা থেকেই চলে গেছে।
আমার শোবার ঘরটা দেখেই ভয় ভয় লাগতো এই ক’টা দিন। কেমন একটা শীত শীত ভাব ঘরটার বাতাসে, যেন অশরীরী কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অবস্থা চলছিল এই ক’দিন ধরেই, যেদিন থেকে আমি বিশ্রী স্বপ্নটা দেখা শুরু করি। বিছানার বালিশ, কম্বল সবকিছু কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। এমনিতে ঠাণ্ডা থাকা খুব দোষের কিছু না, কিন্তু এই ঠাণ্ডাতে একটু অস্বস্তি হয়। মনে হয় আর কেউ এই জিনিসগুলোতে হাত দিয়েছিলো, যেন আমার হাত সেই অশরীরী জীবের হাতে লেগে যাচ্ছে। আমি শিউরে শিউরে উঠি।
প্রথমেই বিছানায় হাত দিয়ে দেখলাম। আরে, আজ তো ঠাণ্ডা লাগছে না। কেমন একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে পুরো বিছানায়। আমার কেমন ঘুম এসে গেল এক মুহূর্তেই।
আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম, গলা পর্যন্ত টেনে দিলাম কম্বলটা। আহ, কি আরাম।
খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। আগে ঘুম আসতে মিনিট কয়েক দেরী হতো, আজ এক মিনিটও লাগলো না, শোয়া মাত্রই ঘুম। ভাল। গভীর ঘুমে মানুষ স্বপ্ন দেখে না, অগভীর ঘুমে আর উত্তেজিত মস্তিষ্কে দেখে। আজ গভীর ঘুম হবে। হঠাৎ আসা কুৎসিত স্বপ্নটা কি হঠাৎই বিদায় নিলো? হায় খোদা, তোমাকে ধন্যবাদ।
বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, এই চারদিন ধরে যে আমি ভয়ের চোটে ঠিকমতো ঘুমোতে পারিনি, সেই আমার ঘুম ভাঙল বেলা আটটার সময়। এক ঘুমে রাত কাবার হয় অতি দরিদ্র মানুষদের, যারা সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মাটি কাটে, ইট ভাঙে। এই প্রথম আমি সেই তৃপ্তিমাখা ঘুমের স্বাদ পেলাম। সত্যি, একটা ভালো ঘুমের মতো মধুর আর কী আছে?
আমি ভেজানো দরজাটা খুলে বের হলাম। মা’কে এদিকসেদিক দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে বারান্দায় বসে বাবা আর মা এ-সময় চা খান। বোধহয় আমি আরাম করে ঘুমোচ্ছি বলে এত বেলাতেও ডাকেন নি। বাবা হয়তো কোন কারণে বাইরে গেছেন।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা’কে ডাক দিলাম, মা, শুনে যাও। আমার অসুখ সেরে গেছে।
মায়ের হালকা পায়ে হেঁটে আসার শব্দ পাওয়া গেল। প্রথমে শাড়ির পাড়ের একটা অংশ দেখা গেল, তারপর ও-ঘর থেকে মা মুখ বের করে উঁকি দিলেন।
আমি বলতে গেলাম, মা … …
কিন্তু তার আগেই মা ভীষণ চিৎকার করে উঠলেন। আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন।
এক মুহূর্ত তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপরই পেছনে ঘুরে ছুট দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুরো ঘটনাটি ঘটে গেল, আমি বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
মা আমাকে দেখে ভয় পেলেন কেন? কী হয়েছে? আমার তো আর সমস্যা নেই, দুঃস্বপ্ন বিদায় নিয়েছে। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, খুব ফুরফুরে লাগছে। তাহলে ভয় পাওয়ার কারণ কী?
চকিতে আমার মাথায় একটা সন্দেহ উঁকি দিয়ে ওঠে। আমি মায়ের পেছনে পেছনে গেলাম না, বরং সোজা বাথরুমের দিকে দৌড় দিলাম। মনে মনে বলতে থাকি, খোদা, যা ভাবছি তা যেন সত্যি না হয়।
বাথরুমের বেসিনের ওপর বসানো আছে একটা বড় আয়না। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। চেয়ে আছি অপলক নয়নে।
আমি নিজের হাতখানা মুখের সামনে এনে ধরলাম। গা গুলিয়ে বমি এসে গেল সাথে সাথে।
সবকিছু চোখের সামনে চক্কর দিয়ে উঠলো আমার, দপদপ করতে শুরু করলো মাথা।
জ্ঞান হারানোর আগে আমার শুধু এটুকু মনে আছে, আমি মুখ ভরে বমি করছি, আর ধবধবে সাদা বেসিনটা ভেসে যাচ্ছে থিকথিকে ময়লায়।
পরিশিষ্টঃ
আমি ডক্টর মাহবুব আসরারকে ঘটনাটা বলেছি, আদ্যোপান্ত, দাঁড়ি-কমা কিছুই বাদ দিই নি। তিনি শুনে সাথে সাথে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। যুগ খুব খারাপ পড়েছে, সাইকিয়াট্রিস্টদের এখন পোয়াবারো, বিভিন্ন হরর আর সায়েন্স ফিকশন রিলেটেড মুভি দেখে দেখে তাঁরা এখন সব ঘটনারই ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলেন।
তিনি বলেছেন, আমি যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম, সেটার অনুভূতি খুব তীব্র ছাপ ফেলে আমার মনে। আমার অবচেতন মন তাই ধীরে ধীরে, আমার অগোচরেই তৈরি হতে থাকে ঘটনাটা আমাকে চাক্ষুষ দেখানোর জন্য। এক সকালে তাই আমার মস্তিষ্ক আমাকে বাথরুমের আয়নায় দাঁড় করিয়ে দেখাল, আমি সত্যি সত্যি একটা কুৎসিত জীবে পরিণত হয়ে গেছি।
দৃশ্যটা দেখার পর আমার স্নায়ুতে প্রচণ্ড চাপ পড়ে, তাই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। হয়তো ছোটকালে আমি কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছিলাম, সেটা আবার ফিরে এসেছিলো এই ঘটনাটার মাধ্যমে। আমাকে ব্যাপারটা দেখিয়ে ফেলার পর মস্তিষ্ক ভাবে, তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে, তাই সে রাত থেকেই এই স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু মায়ের ব্যাপারটা? ডক্টর বলেছেন, আমার মা আসলে আমাকে দেখে ভয় পান নি, হয়তো আমি মনের ভুলে কোন কাপড়চোপড় না পরেই ঘরের বাইরে চলে এসেছিলাম, এত বড় ছেলেকে নগ্নদেহে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা তাই ভয় পেয়ে ছুটে চলে গিয়েছিলেন।
এই ব্যাখ্যা শুনে আমার ডক্টরের ঢ্যাঁড়সের মতো ছুঁচলো মুখটাতে জুতো দিয়ে একটা বাড়ি দিতে ইচ্ছে করলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মা যখন আমাকে দেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর দু’চোখে ছিল স্পষ্ট ভয়, সেই ভয়ের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। তাছাড়া তখন আমি অবশ্যই একটা প্যান্ট, নিদেনপক্ষে একটা ট্রাউজার পরে ছিলাম। ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পাগলের ডাক্তার পাগলই হয়, কাজেই তার চিন্তাও পাগলের মতোই হবে, এটাই স্বাভাবিক।
ডক্টরের কথা ভুল, তার দুটো কারণ আমার কাছে আছে। প্রথম কারণ, একসাথে দুজনের দৃষ্টিবিভ্রম হওয়া অসম্ভব। হয় আমার বিভ্রম হবে, নয়তো মায়ের। অবশ্য আমি মা আর বাবা, দুজনকেই আমার স্বপ্নের বর্ণনা পুরোপুরি বলেছি, যেটা শুনে ডক্টর বলেছেন যে বর্ণনা শুনেই অবচেতন মন হুবহু একটা দৃশ্য দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে। হয়তো তাঁরা আমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন, তাই আমাকে দেখেই তাঁরা সেই ভয়ংকর প্রাণীকে চিন্তা করেছিলেন।
কিন্তু বিভ্রম হয়েছে শুধু মায়ের, বাবার নয়। তাছাড়া খুব সন্দেহের ব্যাপার হচ্ছে, মা’কে যখন জিজ্ঞেস করি যে তিনি ঠিক কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন, তিনি জবাব দেন না, শুধু গম্ভীর হয়ে যান। তাহলে কি আমি আর মা, দুজনে মিলে সত্যিই দেখেছিলাম? কিছুক্ষণের জন্য কি আমি সত্যিই কোন ভয়ংকরদর্শন পশুতে পরিণত হয়েছিলাম?
এই ডাক্তারগুলো দু’কলম লেখাপড়া করে নিজেদেরকে যে কী মনে করে, তারাই জানে। এমন ভাব ধরে চেম্বারে বসে থাকে যেন তারাই মহা পণ্ডিত, আমরা সবাই মহামূর্খ, আজেবাজে সমস্যা নিয়ে আসি। যা বলি তার একটা বাস্তব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্যাটা মাহবুব আসরারের কাছে যদি আর গেছি তাহলে নিজের কান কেটে ফেলবো।
তাছাড়া আর যাওয়ার দরকার হবে বলে মনে হয় না। সেই স্বপ্নটা তো বিদায় নিয়েছে, আমি এখন প্রতি রাতে খুব শান্তিতে ঘুমোই। ঝাঁটা মারি সাইকিয়াট্রিস্টের কপালে।
বাথরুমের আয়নায় দেখা সেই কুৎসিত দৃশ্যটা এখনো আমার আবছা আবছা মনে পড়ে। কবে ভুলে যাবো সেই অপেক্ষায় আছি।
…………………………………………….(সমাপ্ত) ………………………………………..