পক্ষপাতদুষ্ট দুর্ঘটনা

পক্ষপাতদুষ্ট দুর্ঘটনা

সেদিন ছিল বুধবার। সকালবেলা। আমি স্কুলবাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আর দুয়েক মিনিটের মধ্যেই বাসটা এসে পড়ার কথা।

বাবা আমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে অফিসে চলে গেছে। প্রতিদিন এই একই নিয়ম। বাবা কোন কারণে এখানে আসতে না পারলে মা আসে। এখন মা নিশ্চয়ই দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেছে নিজের কাজে।
আমি ইথান জিঙ্গোলা জুনিয়র। আমার বাবা ইথান জিঙ্গোলা, মা কার্লা জিঙ্গোলা। আমি পড়ি সি-সাইড হাই স্কুলে, স্ট্যান্ডার্ড সেভেনে। আমার বাসা থেকে স্কুল মাত্র পনেরো মিনিটের পথ। আমি চাইলে আমার সাইকেল নিয়েই যেতে পারি, কিন্তু বাবা-মা যেতে দেয় না। বাবা-মা কেমন যেন, দুজনই খুব ভীতু, আমার মতো সাহসী না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, দূরদূরান্তে চলে যাই, বাসায় ফিরে বকুনি খাই, আবার সব ভুলে যাই। কিন্তু স্কুলে সাইকেল নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তো আর লুকিয়ে করা যায়না, কাজেই এটা আর করা হয়ে উঠছে না। আমার সাইকেলটা খুব ভাল, নাম “কমব্যাট”, চলে পঙ্খিরাজের মতো। আমি রোজ ঝেড়েমুছে চকচকে করে রাখি। বন্ধুদের মধ্যে সবার চেয়ে আমার সাইকেলটা সুন্দর। আমি বাবাকে বলে-কয়ে সামনে একটা ব্যাটারিচালিত লাল রঙয়ের লাইটও লাগিয়ে নিয়েছি। লাগানোই সার, লাইট জ্বালাতে হলে তো রাতে চালাতে হবে, আমার রাতে বের হওয়া একদম বারণ, ছেলেধরা নাকি আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাই হয়তো আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে চান বাবা আর মা। এই করতে গিয়ে আমার অপর ম্যালা বিধিনিষেধ আরোপ করে ফেলেছেন তাঁরা, আর নিত্যনতুন সব নিয়ম ক্লান্তিহীনভাবে আবিষ্কার করেছেন। বন্ধুবান্ধবরা এসব নিয়ে খুব হাসাহাসি করে, কিন্তু উপায় কী?

এই যে আমার বাসা স্কুলের এত কাছে, সাইকেল নিয়ে না হোক, আমি তো হেঁটেই চলে যেতে পারি। শরীরটা রোগাপটকা হলে কী হবে, আমি কিন্তু খুব খাটতে পারি। কাজেই এই সামান্য রাস্তাটা হেঁটে যাওয়া আমার কাছে কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু বাবার কড়া নিষেধ, কোনমতেই আমার একা একা স্কুলে যাওয়া চলবে না। আমার বয়স এখন তেরো, এই বয়সে ছেলেপুলেরা কত বিশাল ব্যাপারস্যাপার করে ফেলে, আর্নি তো এক মাস্টারের চেয়ারে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিলো, আর আমি স্কুলে যাবার জন্য সাদা রঙয়ের অ্যাম্বুলেন্স মার্কা ঐ বাসটার অপেক্ষায় থাকি।

আজ আমার মাথায় একটু দুষ্টুমি উঁকি দিয়েছে। বাস আসার সময় পার হয়ে গেছে প্রায় পাঁচ মিনিট হল। আমি কব্জিতে বাঁধা ইঁদুরের ছবি আঁকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম। হয়তো কোন কারণে কোথাও একটু দেরী হচ্ছে, এবার তাহলে হেঁটেই চলে যাই, কেমন হয়? কিন্তু আমি বুদ্ধিমান ছেলে, একটা নিষিদ্ধ কাজ করতে হলে পেছনে পালানোর রাস্তা রেখে করি। আমি মনে মনে মুখস্ত করে নিলাম যদি একা একা হেঁটে হেঁটে বড় রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে গেলে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, সেগুলোর যুতসই জবাব কী করে দেবো।
প্রথম প্রশ্নটাই হবে কেন আমি একা একা গেলাম। আমি জবাব দেবো, বাস আসতে দেরী করছিলো, এদিকে আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ক্লাসে দেরী হয়ে হাজির হওয়া গুরুতর অপরাধ, কাজেই আমি সেই ঝুঁকি নিই নি।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে, বড় রাস্তাটা আমি কী করে পার হলাম। জবাব দেবো, যখন দেখলাম যে রাস্তায় লাল বাতি জ্বলে গেছে, সব গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, তখনই আমি পা বাড়িয়েছি, এবং জেব্রা ক্রসিং থেকে এক পা-ও বাইরে যাইনি। এমনকি আমার পাশে এক লোককে বর্ম হিসেবে রেখে পুরো রাস্তাটা পার হয়েছি, যাতে কোন গাড়ি এসে হামলে পড়লে আগে ঐ লোকটাই ভর্তা হয়ে যায়! এটা হয়তো একটু স্বার্থপরের মতো কাজ হয়েছে, কিন্তু উপায় কী? আপনি বাঁচলে বাপের নাম। না থাক, শেষ অংশটা বলার দরকার নেই, শুধু বলবো জেব্রা ক্রসিং দিয়ে নিয়ম মেনে পার হয়েছি।

তৃতীয় প্রশ্ন হবে, রাস্তায় কত বিপদ-আপদ হতে পারতো। আমি বলবো, সবসময় আমি ফুটপাত দিয়ে হেঁটেছি, বিপদ হবার কোন প্রশ্নই আসেনা। তাছাড়া আমি পনেরো মিনিট হাঁটাতে শরীরের কয়েকশো ক্যালরি পুড়েছে (এতটা না পুড়লেও খানিকটা তো পুড়েছে), আমার সাস্থ্যের উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে আমি নিজের ক্লাস থেকেই উদাহরণ দিতে পারি। আমাদের ক্লাসের গাব্বুস ছেলে রুনাকো ওয়ার্নিক সবসময় স্কুলবাসে আসাযাওয়া করে আর বার্গার খায়। এই করে করে ওর ওজন হয়েছে চুয়াত্তর কেজি, এবং ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, শরীরটা ধুমসো কুমড়োপটাশের মতো হয়ে যাচ্ছে। কাজেই মাঝেমধ্যে হেঁটেই যাওয়া উচিৎ।

এসব বললে নিশ্চয়ই কাজ হয়ে যাবে। বাবামায়েরা ছেলেদের মুখে গম্ভীর মুখে জ্ঞানী কথা শুনলেই কেন যেন “ফিউজ” হয়ে যান।

আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে হাঁটা দিলাম। একটা নিষিদ্ধ কাজের মধ্যে যে কী আনন্দ আছে, সেটা বলে বোঝানো যাবে না, বুঝতে হলে নিজে করতে হবে!
আমি মনের সুখে গান গাইতে গাইতে কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। খানিকটা এগুতেই বাগড়া দিলো আমার জুতোটা। বোধহয় পাথর ঢুকেছে, আমি নিচু হয়ে জুতোর ফিতে খুললাম। অস্বস্তি নিয়ে চলা যায়না, যেমন গলায় কাঁটা নিয়ে খাবার খাওয়া যায়না। একটা সামান্য কাঁটা আকারে ছোট হলেও সবসময় গলায় বিঁধে থেকে যন্ত্রণা দিতে থাকে, বুঝিয়ে দেয় যে একে অবহেলা করার কোন কারণ নেই। তেমনি জুতোর ভেতরে এই ছোট্ট পাথরটা।

আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলাম, মানুষজনের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য একপাশে চেপে দাঁড়ালাম। আমি যথেষ্ট সচেতন নাগরিক। বাবা বলেছে যে ভালোমানুষ হতে হলে এই বয়স থেকেই নাগরিক সচেতনতা আয়ত্ত করতে হবে। বাবা মাঝেমধ্যেই আমাকে বিভিন্ন আজগুবি জিনিসের পাঠ দেয়ার চেষ্টা করে, “নাগরিক সচেতনতা” তার মধ্যে একটা।

আমি উবু হয়ে বসে জুতো খুলে পাথরের টুকরোটা বের করে ফেললাম। পায়ের কেনে আঙুলটা লাল হয়ে গেছে ওটার ঘষায়। আবার জুতো পরে ফিতে লাগাতে শুরু করলাম। আমি এখন একাই ফিতে বাঁধতে পারি, রুনাকো পারেনা।

তখন আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন একজন বুড়ো মানুষ, চামড়ায় ভাঁজগুলো খুব স্পষ্ট, গায়ের রং ফ্যাকাসে। খুব ধীরে ধীরে, লাঠি হাতে চলছেন। এই গতিতে হাঁটলে সামনের মোড়টাতে পৌঁছতেই উনার দুই থেকে তিন বছর লাগবার কথা। বয়স হলে নাকি নানারকম সমস্যা দেখা দেয়, মানুষজন “স্লো” হয়ে যায়। আমার বয়স কম বলে আমি অনেক “ফাস্ট”।
বুড়ো মানুষটা আমার ঠিক পাশে এসেছেন, তখনই ঘটে গেলো ঘটনাটি।

একটা তীক্ষ্ণ ব্রেক কষার শব্দ কানে এলো, কিন্তু গাড়িটা এতোই দ্রুত এদিকে ধেয়ে এলো যে সেই ব্রেকে কোন কাজ হল না।

অনেক মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেলো, আর ছাই রঙয়ের সেডান গাড়িটা রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে দিয়ে বিকট আওয়াজে আমার পাশের বুড়ো মানুষটার গায়ে এসে সরাসরি আঘাত হানল।

বুড়ো মানুষটার মুখ থেকে একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো, তিনি নিজেকে দুর্বল হাতে আড়াল করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তিনি একটা বলের মতোই উড়ে গেলেন কয়েক হাত দূরে। গাড়িটা তাঁর শরীরটাকে একদম দুমড়েমুচড়ে দিলো, তাতেই বোধহয় গাড়িটার গতি কমে গিয়ে সেটা একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। রাস্তা থেকে ফুটপাতে এভাবে গাড়ি উঠে যাওয়া আমি কখনো দেখিনি। নিদারুণ ভয়ে আমি তখন পাথর হয়ে গেছি, নড়াচড়ার সাহস পাচ্ছিনা।

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপরই আবার শুরু হল লোকজনের চিৎকার, পুলিশের অথবা অন্যকিছুর সাইরেন, হুটোপুটি। চারিদিকে লোক জমে গেলো।
অনেক কথা একসাথে শোনা যেতে লাগলো, “এই! ছেলেটা তো মরে গেলো।”

আরেকজন বলছে, না, ছেলেটা তো মরেনি, ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে। কপাল দেখেছো!

আরে, বুড়ো মানুষটা তো নড়াচড়া করছে না!
কেউ একজন এদিকে আসুন, প্লীজ! এখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, মারা গেছে একজন!

এই বাচ্চা ছেলে, তুমি ঠিক আছ তো?

আমি যেন জমে গেছি, কিছুই আমাকে স্পর্শ করছে না। আমি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বুড়ো মানুষটার দেহের দিকে। মরে গেছেন নিশ্চয়ই, কোন নড়াচড়া, কোন স্পন্দন নেই, অন্তত এখান থেকে অনুভব করা যাচ্ছেনা। জায়গাটা রক্তে মাখামাখি, মানুষটির মাথা থেঁতলে গিয়েছে উড়ে গিয়ে দেয়ালে পাওয়া আঘাতে, ঘিলু বেরিয়ে ছিটকে পড়েছে রাস্তায়, একটা হাত কব্জা থেকে খুলে এসে ঝুলছে, পা দুটো বেকায়দাভাবে দুদিকে ছড়ানো। লাল টকটকে রক্তের ধারা ফুটপাত থেকে নেমে যাচ্ছে রাস্তায়।

দুদিক থেকে দুজন মানুষ এসে আমাকে সস্নেহে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার কিছু হয়নি তো খোকা? কথা বল খোকা।

আমি অনুভব করলাম, আমার পেটে ভীষণভাবে গুলোচ্ছে। আমি আমার তেরো বছরের জীবনে কখনো কোন লাশ বা দুর্ঘটনা সামনাসামনি দেখিনি, তাই হয়তো আর সহ্য করতে পারলাম না, হড়হড় করে বমি করে ফেললাম।

পেট থেকে যেন সব বের হয়ে যাবে, আমি দেখতে পেলাম, আমি রাস্তায় বমি করে দিচ্ছি, খানিকক্ষণ আগে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া ব্রেকফাস্টের রুটি আর ডিমের টুকরোগুলো পেট থেকে বেরিয়ে আসছে।

আমার মাথা ভীষণ চক্কর দিয়ে উঠলো, আমি পড়ে গেলাম রাস্তায়। শেষমুহূর্তে কারো চিৎকার শুনলাম। জ্ঞান হারানোর আগে খেয়াল করলাম, আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, কারণ এই গাড়িটা আর দুয়েক ফুট এদিক ওদিক হলেই ঐ বুড়ো লোকটাকে না মেরে আমাকে মেরে ফেলতো।

২.
ইথান! মাই বেবি! চোখ খোল ইথান! আমি মায়ের গলা শুনলাম।

কেউ একজন মৃদু ধমক দিয়ে মা’কে চুপ করিয়ে দিলেন। বয়স্ক লোকের ভারিক্কী গলা।

আমি জ্ঞান ফিরে পেয়েছি, কিন্তু চোখ খুললাম না। প্রথমেই আন্দাজ করা যাক আমি কোথায় আছি। যদ্দুর মনে পড়ে আমি মুখ ভর্তি করে বমি করেছিলাম, তারপর অজ্ঞান হয়ে যাই। তাহলে এখন আমি হাসপাতালে আছি। আমি সন্তর্পণে নিজের ডান পা’টা নাড়লাম, সেই পায়ে এখনো আমার জুতোটা আছে। বাঁ পা নাড়লাম, সেই পা’টা খালি, নিশ্চয়ই সেখানেই ফেলে এসেছি।
সেখানে? কোনখানে? আমার মনে পড়ে যায়, হ্যাঁ, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, খুব খারাপ দুর্ঘটনা। একজন লোক মারা গেছেন, আমার থেকে মাত্র দুই হাত দূর থেকে লোকটাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো নিয়ন্ত্রণ হারানো ঘাতক গাড়িটা। কী আশ্চর্য, আমি মনে মনে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম, বাড়িতে গিয়ে বলবো যে জেব্রা ক্রসিং পার হওয়ার সময় একজনকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছি, যাতে আমার কিছু না হয়। কি আশ্চর্য, এই বুড়ো লোকটা আমার জন্য বর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন। আমার পেটে আবার পাক দিয়ে উঠলো।

ভারিক্কী গলার নিষেধ উপেক্ষা করেই মা আবার আমাকে ডাকলেন, ইথান সোনা, তুমি চোখ খোল, প্লীজ।
আমি চোখ খুললাম। মা ছুটে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কাঁদতে কাঁদতেই আমার গালে আর কপালে অজস্র চুমু খেতে লাগলেন। তিনি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো বলে চলেছেন, মাই চাইল্ড, মাই চাইল্ড।

আমি মৃদু স্বরে বলার চেষ্টা করলাম, আমি ঠিক আছি মা।

তাকিয়ে দেখলাম, মায়ের পাশে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি একজন ডাক্তার। আমার জ্ঞান ফিরে আসাতে বোধহয় উনার দায়িত্ব শেষ হয়েছে, তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরেই এখানে এসে দাঁড়ালেন বাবা, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছ, ইথান। এখন থেকে বাবার নিষেধ মেনে চলতে হবে, সোনা।

আর বলতে হবেনা। একদিনেই খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আমি ভাবলাম।

মা তখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। আরেকটু হলেই তিনি নিঃসন্তান হয়ে যেতেন। মা আমাকে কত ভালোবাসেন সেটা এখন টের পাচ্ছি।
আমি বাসায় ফিরে এলাম, তার আগে আমার ওপর কয়েকটা ছোটখাটো মানসিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হল, দেখা হল আমি স্বাভাবিক আছি কীনা। বীভৎস দুর্ঘটনা দেখলে নিশ্চয়ই কম বয়সীদের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়ে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তাই তাদেরকে মাঝেমধ্যে স্পেশাল কেয়ার দিতে হয়।

আমি শেষে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম, আমার ছুটি। আমি ঠিক আছি, আর ভয় নেই। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এটার ভয়কে পাত্তা দিলে আরও পেয়ে বসবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটাকে ভুলে যেতে বললেন তাঁরা।
অবশ্য এমন একটা দুর্ঘটনা মন থেকে যে সহসাই মুছে ফেলা সহজ কাজ নয় তা রাতেই টের পেলাম।

খেয়েদেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আমি শুয়ে পড়েছি, হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, একটা ছাই রঙয়ের সেডান গাড়ি আমার দিকে তুমুল বেগে এগিয়ে আসছে। আমি ভয় পেয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। গাড়িটা এসে আমাকে পিষে ফেলল, আমি তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। আমার মাথার ঘিলু ছিটকে বের হয়ে গেলো, ঠিক যেমন ঐ বুড়ো লোকটার হয়েছিলো। আমার একটা হাত কব্জা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, আর দুটো পা হাঁটুর নিচ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেলো।

গাড়িটা আমাকে পিষে ফেলে একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেছে। আমি দেখতে পেলাম, একজন বুড়ো মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, দেখছেন যে আমার শরীর থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে সয়লাব করে দিচ্ছে কালো পিচের রাস্তা।

আমার দেহে তখনো প্রাণ ধুকধুক করছে, আমি প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগলাম। মা, মা, কোথায় তুমি?

সহসা টের পাই যে মা আমাকে ধরে প্রাণপণে ধাক্কাচ্ছেন, ইথান! এই তো আমি! তোমার কিচ্ছু হয় নি ইথান, তুমি ঠিক আছ। ইথান, এদিকে তাকাও, তুমি স্বপ্ন দেখছ ইথান, প্লীজ সোনা, তুমি জেগে ওঠো।

আমি সহসাই টের পাই যে আমি মরে যাই নি, একটা স্বপ্ন দেখছিলাম মাত্র। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজবে, ধাক্কা দিয়ে কম্বলটা গায়ের ওপর থেকে সরিয়ে দিই। নাকে স্পষ্ট অনুভব করি বাসী রক্তের গন্ধ, আমার পেটে আবার মোচড় দিয়ে ওঠে, মা’কে একদিকে ঠেলে সরিয়ে বাথরুমে ছুটে যাই, ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে শুরু করি। রাতের সব খাবার আমার পেট থেকে বেরিয়ে যায়, সাদা ধবধবে বেসিনটা ভরে যায় থিকথিকে হলুদ ময়লায়।

আমি আয়নার দিকে তাকাই। একদিনেই আমার চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, তাকানো যায় না এমন অবস্থা, যেন আমার ওপর কেউ খুব অত্যাচার করেছে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে বাবার দিকে তাকাই আমি। তিনি চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সেই রাত কোনমতে কেটে গেলো, কিন্তু আমার সমস্যা দূর হল না। আমি রাতে ঘুমোতে যেতে ভয় পেতে লাগলাম, ঘুমোলেই সেই এক স্বপ্ন, সেই দুর্ঘটনা, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া। সবচেয়ে আশ্চর্য যে ব্যাপারটা সেটা হল, স্বপ্নের কোন গন্ধ থাকে না, কিন্তু এই স্বপ্নের সাথে আমি পাই বাসী রক্তের গন্ধ, নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে আমার, বমি করতে করতে অস্থির হয়ে যাই।
বাবা-মা আমার সমস্যা সারানোর চেষ্টার কোন ত্রুটি করলেন না, আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হল, ডাক্তাররা আমাকে ওষুধ দিলেন, ভাল ভাল কথা বললেন, ঘটনাটাকে স্রেফ দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যেতে বললেন।

আমিও তাঁদের কথা বিশ্বাস করলাম, অন্তত বিশ্বাস করার চেষ্টা করলাম যে ওটা স্রেফ দুর্ঘটনা। কিন্তু সেই স্বপ্ন কোনভাবেই আমার মাথা থেকে দূর হল না, প্রতি রাতেই সেই বুড়ো মানুষটি আমাকে দেখতে লাগলেন যে আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি, মারা যাচ্ছি। আমার চিৎকারে বাবা-মা ঘুমোতে পারছিলেন না। আমার সত্যিই খুব লজ্জা লাগছিলো, কিন্তু কী করবো?
আমি পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না, খুব অন্যমনস্ক। খেলাধুলাতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। সারাদিন গুম হয়ে বসে থাকি। কোন কারণ নেই, আমার গায়ে আঁচড়টিও লাগে নি, আমি বেঁচে গেছি, এমন দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে বেঘোরে। কিন্তু না ওষুধপত্র, না কোন যুক্তি, না কোন সান্ত্বনা আমার মন থেকে ঘটনাটাকে মুছে ফেলতে পারছিল।

আমার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছিল, কোন উন্নতি নেই। কাজেই আমার মন ভাল করার জন্য সবাই খুব উঠেপড়ে লাগলো, বলা হল যাতে আমাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয় আর খুব আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থা করা হয়। মনে আনন্দের স্মৃতি এলে খারাপ স্মৃতি দূরে সরে যাবে।

সেই সুযোগও চলে এলো। আমার দাদা আর বেঁচে নেই, কিন্তু দাদী আছেন। তিনি আইরিশ, থাকেন ডাবলিনে। বাবা-মা ঠিক করলেন যে সবাই মিলে বড়দিনের ছুটিতে সেখানে গিয়ে প্রতিবছরের মতোই হৈ-হুল্লোড় করা হবে, আর তাতেই হয়তো আমার মন খারাপ সেরে যাবে।
আমিও সেরে ওঠার জন্য মুখিয়ে আছি। বছরে এই একবার দাদীকে তাঁর সন্তানেরা সবাই মিলে দেখতে যান। আমাদের প্রতিবছর যাওয়া হয়না, কিন্তু এবার অনেক উৎসাহের সাথে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে পার্টি হয়, খেলাধুলো হয়, মজার কোন কমতি নেই। দাদী এই বয়সেও পিয়ানো বাজাতে পারেন, আর তাঁর গানের গলা আমাদের অনেক গায়িকাকেও হার মানায়। একবার তিনি অপেরা গেয়ে নাকি জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলেন শুধু গলার স্বর দিয়েই, সেই বিরল ঘটনা আমার জন্মের আগের। দেখা হয়নি, তবে বিশ্বাস করেছি। মানুষ আজব ঘটনা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।
আমরা বাক্সপেঁটরা গুছিয়ে তৈরি হলাম। বাবা প্লেনের তিনটে টিকিট কিনে এনেছেন। আবহাওয়া খুব একটা সুবিধের নয়, ডিসেম্বর মাসের কড়া শীত, সেই সাথে শুরু হয়েছে তুষারপাত। খুব বেশি তুষারপাত হলে যাওয়া ভেস্তে যেতে পারে, কাজেই আমি প্রাণপণে প্রার্থনা শুরু করেছি যেন যে করেই হোক ডাবলিনে যাওয়া হয়।
খুব শীত পড়েছে, কিন্তু তার মধ্যেও উৎসবের একটা আমেজ চলে এসেছে এখানে, কেউ প্রিয়জনের সাথে দেখা করতে যাবার জন্য তোড়জোড় করছে, কেউ উপহার কিনছে, কেউ ইতোমধ্যেই চলে গেছে, কেউ বাড়িঘর সাজাচ্ছে ফুল আর নানারকম রঙিন কাগজ দিয়ে। কারো কারো আত্মীয়স্বজন আবার আসছে এখানে, এই শহরে। আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, হয়তো ডাবলিনেও আমাদের জন্য খুব সুন্দর একটা উৎসব অপেক্ষা করছে। আমি খুশি হয়ে উঠতে থাকি। আনন্দময় উপলক্ষগুলোর একটা খুব ভাল দিক উপলব্ধি করলাম, আমি কয়েক রাত ধরে আর দুঃস্বপ্ন দেখছি না, সে জায়গায় অপেক্ষা করছি বড়দিনের। সবার জন্য উপহার কেনাকাটা করতে করতে আমি বীভৎস দুর্ঘটনাটি ভুলে যাবার চেষ্টা করতে থাকি।
আমি আর সবার মতো করে ধরেই নিলাম যে ওটা ছিল সত্যিই একটা দুর্ঘটনা, এতে সবসময় মন খারাপ করা কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখার মতো কিছু নেই। আমি বাবা-মায়ের সাথে বিভিন্ন কাজে হাত লাগাতে লাগলাম। তাঁদের মুখেও হাসি ফুটল, তাঁরা হয়তো ভাবলেন যে তাঁদের ছেলের সমস্যা সেরে গেছে। আমি একটা লাল মোজা (আসলে এক জোড়া) কিনলাম, উপহারের জন্য মোজা ঝুলিয়ে রাখার নিয়ম আছে।
আসলে যে সমস্যা সেরে যায়নি, তা টের পেলাম পরে।

৩.
আমাদের কপাল খুব ভাল। আমাদের ফ্লাইট ডিলে হচ্ছিল তুষারপাতের জন্য, একেবারে সময় বুঝেই যেন আমাদের রওনা দেবার আগেভাগে আকাশ ভেঙে শুরু হল তুষারপাত, সেই সাথে ঝড়। সব ফ্লাইট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ।

ধরেই নিয়েছিলাম যে এবার আর যাওয়া হচ্ছে না, কারণ ছ’ঘন্টা এয়ারপোর্টে বসে থেকেও কোন ভাল খবর শুনলাম না। অন্য যাত্রীরাও আমাদের মতো মন খারাপ করে বসে আছে, আর গাল দিচ্ছে বিরূপ আবহাওয়াকে। তাঁদের দুর্ভোগ দেখে সত্যিই খারাপ লাগে। ভুক্তভোগী না হলে আরেকজনের অসুবিধা ঠিক ঠাহর করা যায়না।

যখন আমরা মাথা নিচু করে চলে আসছিলাম, তখনই হঠাৎ ঘোষণা করা হল যে সব ঠিক হয়ে গেছে, দেরীতে হলেও প্লেন ছাড়বে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেছে।

যাত্রীদের মতো আমাদের মধ্যেও আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো, আমারা মহা উৎসাহে মালপত্র নিয়ে প্লেনে গিয়ে যার যার সীট দখল করে নিলাম।

বাবা আর মা পাশাপাশি বসেছেন, নিশ্চয়ই ঝগড়া করার সুবিধার্থে। আমার সীট পড়েছে সামনে, যাক, ভালোই হল, তাঁদের ঝগড়াঝাঁটি দেখতে হবেনা। আমি হেডফোন কানে গুঁজলাম, গান ছেড়ে দিলাম উচ্চ আওয়াজে। মাথা ঝাঁকাচ্ছি গানের তালে তালে।
চওড়া রানওয়ে দিয়ে ছুটে গেলো প্লেন, মাটি ছেড়ে উঠে গেলো আকাশে। আমরা ডাবলিনের উদ্দেশ্যে অবশেষে রওনা হতে পারলাম।

অবশ্য এই যাত্রাতে খানিকটা ঝুঁকি আছে বৈকি, আকাশ পরিষ্কার হলেও যেকোনো সময় আবার তুষারপাত শুরু হতে পারে, কাজেই তার আগে জায়গামত পৌঁছতে পারলেই বাঁচোয়া। যাত্রীরা সবাই উপরি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। পাইলট বলে দিলেন, যদি বেগতিক দেখেন, তাহলে হয়তো কাছাকাছি কোন এয়ারপোর্টে ইমারজেন্সি ল্যান্ড করতে হতে পারে। সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে, জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে আরও কয়েক ঘণ্টা লেট হওয়া ভাল। সবাই সানন্দে এটা মেনে নিয়েছে, রওনা হওয়া গেছে এটাই ঢের। অবশ্য না মেনে উপায় কী?

আমার পাশে বসেছেন বাদামী চুলের একজন ভদ্রলোক। তিনি এখন যেখানে বসে আছেন সেটাই আসলে ছিল আমার সীট, তিনি আমাকে অনুরোধ করাতে বদলাবদলি করেছি। তিনি একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে বলেছেন, খোকা, তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে আমি কি তোমার সীটটাতে বসতে পারি? আমার বাঁ দিকে না বসলে একটু সমস্যা হয়।

আমি মনে মনে ভাবলাম, ডান দিক আর বাঁ দিকে পার্থক্যটা কী? অবশ্য মুখে কিছু বললাম না, পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, এই দেশে খুব মিষ্টি হেসে সবকিছুর জবাব দেওয়ার নিয়ম। আমি তাই ঠোঁট দুটো একটু দুই দিকে ছড়িয়ে হাসির ভঙ্গি করে বললাম, নিশ্চয়ই।

তারপর আমার সীটে তিনি বসেছেন, তাঁর সীটে আমি। তিনি বসেই কাগজপত্র খুলে বসেছেন। এই বড়দিনের ছুটিতে এত কীসের কাজ নিয়ে তিনি প্লেনে চড়েছেন ভেবে পেলাম না। চুলোয় যাক গে। আমার চরকায় আমি তেল দিই।

বাইরে একইরকম দৃশ্য, নিচে সরু হয়ে আসা নদী আর তুষারে ঢাকা রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেকেই আমার মতো প্লেনে উঠে ঘুম দিয়েছে, রওনা দিতে পেরে তারা একেবারে নিশ্চিন্ত।

আমার ঘুম ভেঙে গেলো চিৎকারের শব্দে। মাইক্রোফোনে কেউ উঁচু গলায় বলছে, সম্মানিত যাত্রীরা, আপনারা ভয় পাবেন না। সবকিছু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। হ্যালো হ্যালো।

আমি চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, আর এদিকসেদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম আসলে কী হয়েছে।

আমাদের প্লেনটা ভীষণ কাঁপছে, একবার ওপরে উঠে যাচ্ছে আবার পরক্ষণেই লাফিয়ে নিচে নেমে আসছে। ভাগ্যিস আমাদের সবার সীটবেল্ট বাঁধা, নইলে আমাদের উড়ে গিয়ে সিলিঙয়ে বাড়ি খাওয়ার কথা।
যাত্রীরা ভয় পাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ককপিট থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, স্টুয়ার্ডেসরা অভয় দেবার চেষ্টা করছে যে ভয়ের কোন কারণ নেই। বাতাস পাতলা বলে একটা “এয়ার পকেটে” ঢুকে পড়েছে প্লেন, লাফালাফি শুরু করেছে। তাতে অবশ্য কোন কাজ হল না, ভীত যাত্রীরা সবাই একসাথে চিৎকার করছে, ভাবছে এই বুঝি মরে গেলো সবাই। প্রাণের মায়া সবাইকে বড় ব্যাকুল করে তোলে।

বাতাস খুব পাতলা বলে নিঃশ্বাসে একটু সমস্যা হচ্ছে, ওপর থেকে নেমে এসেছে অক্সিজেন মাস্ক। বুড়ো মানুষগুলো ইতোমধ্যেই নিজেদের নাকে চেপে ধরেছে মাস্ক।

আমি চুপচাপ বসে আছি, যাত্রীদের ভয় আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে, কারণ আবার পুরু বাতাস পাওয়াতে বিমানের পাখা জোর পাচ্ছে, সেটার ঝাঁকুনি কমে আসছে। সবসময় যারা বিমানে যাতায়াত করে, তাঁদের একবার না একবার এই অভিজ্ঞতা হবেই, যদি প্রতিকূল আবহাওয়া থাকে তাহলে বিমান অনেক অদ্ভুত আচরণ করে।

ধীরে ধীরে প্লেন আবার স্থির অবস্থানে চলে এলো, এখন আবার মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। সুপরিসর প্লেনটিতে স্বস্তির একটা ভাব চলে আসে, এতক্ষণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো শুধু, কিন্তু এখন আবার প্লেনের ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন কানে এলো।

যাক, বাঁচা গেলো, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।
আমার চোখ চলে গেলো বিমানের দেয়ালে। দেয়ালে লাগানো আছে সারি সারি ঝোলানো অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেখান থেকেই নজলের মাধ্যমে যাত্রীদের নাকের ডগায় চলে এসেছে অক্সিজেন মাস্ক। সবার মতো আমাদের পাশেও আছে একটা, কিন্তু ওটা এমন বেমক্কাভাবে দুলছে কেন?

বোধহয় ভালোমতো লাগানো হয়নি, অথবা লাগানো হলেও এখন স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। আমি স্টুয়ার্ডেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, বললাম যে এটা বিপজ্জনক, ভারী সিলিন্ডারটা দেয়াল থেকে খুলে এসে একটা দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

আমি ঠিক কিনারে বসিনি, বসেছেন সেই ভদ্রলোক, প্লেনে উঠেই কাগজে যেসব হিসাব আর আঁকিবুঁকি শুরু করেছেন, সেগুলো এখনো চলছে। এই মুহূর্তে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যে এই হিসাব ছাড়া তাঁর কাছে পৃথিবীর আর সবকিছু অর্থহীন। ঠিক তাঁর পাশেই পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা সিলিন্ডারটা যে তাঁকে আঘাত করতে পারে, সেটা তাঁর গোচরে আসেনি এখনো। আমি তাঁকেও ব্যাপারটা দেখালাম, বললাম সাবধান হতে। তিনি এক নজর দেখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিমল হাসি উপহার দিলেন, তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন।
আচ্ছা লোক তো! বোধহয় আমি বাচ্চা ছেলে বলে আমাকে পাত্তা দিলেন না। সব বড় মানুষই একরকম, আমার একটু রাগ হল।

স্টুয়ার্ডেস, যার নাম কেটি, সে সিলিন্ডারের ব্যাপারটা দেখাতে একজনকে ডেকে আনতে চলে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখছি, সে বিমানের সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো ফ্লোরে।
পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে সে হোঁচট খায়নি, কারণ আমরাও সীট থেকে লাফিয়ে উঠলাম।

প্লেন আবার দুলতে শুরু করেছে, সবকিছু থরথর করে কাঁপছে, আমার পেট মোচড় দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যে খাবারদাবার সব বেরিয়ে আসবে। প্লেনে অনেকে এমনিতেই বমি করে, সেজন্য পলিথিনের প্যাকেট থাকে সবার পায়ের কাছে, এমন ঝাঁকুনি খেলে পেট তো মোচড় দেবেই। আমি মুখ চেপে বসে থাকি, বমি করা খুব বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।

আমার পাশের ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব অভিজ্ঞ লোক, অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন, তিনি প্রায় উড়ে চলে যাওয়া একটা কাগজ লুফে নিলেন, তারপর তাঁর কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা শুরু করলেন হ্যান্ডব্যাগে, বিরক্তির ছাপ চোখেমুখে। হয়তো লোকসান যাচ্ছে ব্যবসায়। হিসাব বোধহয় প্রায় মিলিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু এই বিমানের ঝাঁকুনি দ্বিতীয়বারের মতো কাজে বাগড়া দিলো।

আমি নিজেকে সীটের সাথে আটকে রাখার চেষ্টা করছিলাম, সেই ভদ্রলোকও বেশি সুবিধা করতে পারছেন না, প্লেন খুব বেশি কাঁপাকাপি করছে। সারা প্লেনে ভীতু বাচ্চাকাচ্চাদের চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে, তাদের বাবা-মা তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু নিজেই সোজা হয়ে বসতে পারছেন না। ককপিট থেকে অবশ্য একটু পরপরই অভয়বাণী ভেসে আসছে, যেটা বরাবরের মতোই কোন কাজ করছে না।

হঠাৎ প্লেনটা একদিকে কাত হয়ে গেলো, প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণে, আর তখনই ঘটে গেলো দুর্ঘটনা।
দেয়াল থেকে যেন হ্যাঁচকা টানে কেউ ছুটিয়ে আনল সিলিন্ডারটাকে, সেটার হুক লাগানো দিকটা এসে আঘাত হানল আমার পাশে বসা ভদ্রলোকটিকে।
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম বলে বীভৎস ব্যাপারটা দেখতে হল না, কিন্তু চোখ বন্ধ হলেও কান তো আর বন্ধ হয়নি। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম মাংসের ভেতরে ধাতব কিছু ঢুকে যাওয়ার শব্দ। আমার নয়, আমার পাশের ভদ্রলোকের। একটা চিৎকার শোনা গেলো ভদ্রলোকের, তিনি বলে উঠলেন, ওহ গড।
আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে নিজেও চিৎকার করে উঠলাম। পেট গুলিয়ে বমি এসে গেলো সাথে সাথে।
ভদ্রলোকের মুখের মাঝখান দিয়ে ঢুকে গেছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের হুকটা, নাকটা ভেদ করে ফেলেছে, ভেতরের লাল মাংস দেখা যাচ্ছে। খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে মুখটা, গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। তিনি বেঁচে নেই, বলাই বাহুল্য।

আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, বোধহয় বীভৎস দৃশ্যগুলোতে কিছু একটা আছে, সেগুলো চেয়ে চেয়ে দেখা যায় না, আবার চোখ ফিরিয়েও নেয়া যায়না।
আমার পাশে অনেক চিৎকার শুরু হয়েছে। ক্যাপ্টেন প্লেনের নাকটা কোনমতে সোজা করার সাথেসাথে এদিকে ছুটে এসেছে বিমানের সব ক্রু। সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।

পিতামাতারা তাঁদের বাচ্চাদের এই দৃশ্য দেখাতে চাইছেন না, সন্তানদের চোখ হাত দিয়ে চেপে রেখেছেন। তারপরেও অনেকে দেখে চিৎকার করছেন। ব্যাপারটা কত ভয়ংকর, নিজে না দেখলে বোঝা যাবেনা।
আমার ক্ষুদ্র জীবনে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবধানে ঘটে গেলো দু দুটো দুর্ঘটনা। আমি কয়েক মিনিট পরেই আবিষ্কার করলাম যে আমি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছি। তাঁরাও কম ভয় পাননি, মা কাঁপছেন থেকে থেকে। আমি শুধু কাঁদছি।

কাঁদতে কাঁদতে আমি প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়লাম, তার আগে শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম চিৎকার আর গালিগালাজের আওয়াজ। বিমান কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দোষারোপ করছে সবাই।
আমি ভয় পেতে শুরু করেছি। কেউ তো জানে না, আমিই শুধু জানি যে ঐ ভদ্রলোকের জায়গায় বসার কথা ছিল আমার, তাঁর সাথে যদি সীট বদলাবদলি না করতাম তাহলে ঐ সিলিন্ডারের ধাতব হুকটা আমার শরীরে ঢুকে যেত, আর আমি মরে যেতাম।

আমি অপয়া না তো? মৃত্যু হয়তো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, পেয়েও যাচ্ছে হাতের কাছে, কিন্তু খুব অল্পের জন্য মিস করছে, আমি না মরে তাই অন্য দুজন মারা গেলো। প্রথমে সেই বুড়ো লোকটি, এখন এই ভদ্রলোক। মৃত্যু কি তিনবার নিশানা মিস করে?
মৃত ভদ্রলোককে একটি ব্যাগে ভরে চেন আটকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনো আমি শিউরে শিউরে উঠছিলাম।

৪.
আমরা ডাবলিনে দেরী করে হলেও পৌঁছেছি, কিন্তু উৎসবের মেজাজ নেই, বলাই বাহুল্য, আনন্দ বদলে গেছে শোকে।

আমার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, আমার দুঃস্বপ্ন আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু অন্য রূপে। কী রূপে তা কাউকে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, আমি প্রতি রাতে দেখছি দেয়াল থেকে একটা বিশাল সিলিন্ডার আমার দিকে ছুটে আসছে, আমার নাক-মুখ ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে চোখা কিছু একটা। আমি খুব ভয়ংকর যন্ত্রণায় যখন চিৎকার শুরু করি, তখন মা এসে আমাকে ডেকে তোলেন। এখন আমি মায়ের কাছে ঘুমোই, একা ঘুমোতে খুব ভয় লাগে।

সবচেয়ে বিরক্তিকর এই paranoid হয়ে যাবার ব্যাপারটা, আমার ভয় হচ্ছে, আমি নিজের অজান্তেই অপেক্ষা করছি পরের দুর্ঘটনাটির জন্য। এই বুঝি কেউ মারা গেলো, এবার হয়তো মৃত্যু বেছে নেবে আমাকেই।
উৎসব হচ্ছে, কিন্তু আমি সেখানে প্রাণ খুঁজে পাচ্ছি না, আমার জন্য শুধুই একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে এবারের বড়দিন। আমার খুব লজ্জা লাগছে, নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। যদিও সবাই খুব ভাল ব্যবহার করছে, আন্তরিকভাবে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কেক কাটা হল, মহাসমারোহে যীশুর জন্মদিন পালন করা হল। বেলুন ওড়ানো হল, আনন্দফুর্তি করা হল। আমি সবসময়েই হাসিমুখ করে থাকলাম, কিন্তু মনের কোণে কাঁটার মতো বিধে থাকলো একটা অস্বস্তিকর ভয়। সে যেন বলছে, আমি আসছি, আবার আসছি। তোমাকে খুঁজে পাবোই, পালাবে কোথায়?
একসময় আমাদের উৎসব শেষ হল, বেশ কয়েকদিন চলার পর। এই ক’দিন খুব আনন্দ হয়েছে এই বাড়িটাতে, এবার ফেরার পালা।

আমরা ফিরতি প্লেনে চড়ে বসেছি, দাদী আমাদেরকে বিদায় দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন। এই একটি উপলক্ষেই তিনি সন্তানদের কাছে পান। পরেরবার পাবেন কীনা ঠিক নেই, বয়স হয়েছে, হয়তো ওপারের ডাক চলে আসবে, সেই অনিশ্চয়তার কারণেই কান্নাকাটি।

ফিরতি পথে কোন ঝামেলা হল না, আমরা নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এলাম।
তখনো জানতাম না, আমার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।
***
স্কুল খুলে গেছে, আমি নিয়মিত ক্লাস করা শুরু করেছি। দুঃস্বপ্ন দেখি, কিন্তু চেপে যাওয়ার চেষ্টা করি, চিৎকার করি না আর।

সবসময় হৈচৈ করা মানুষের স্বভাবের মধ্যে পড়ে না, কিন্তু আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি, ভুলে যেতে চাইছি ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোকে।

বাচ্চাদের শিক্ষাদীক্ষা কিংবা চোখ ফোটানোর জন্য প্রতিবছর কোন না কোন জায়গায় সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়, এ বছরও হবে। আমি সানন্দে নাম লিখিয়ে এলাম। একটা ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা ভিজিট করবো, সেই ইন্ডাস্ট্রি কোল্ড ড্রিংকস, ফলের জুস এসব বানায়। সারাবছর আমরা যেগুলো খেয়ে আসছি, সেগুলোর মধ্যে একটা জিনিস কী করে কাঁচামাল অবস্থা থেকে বিভিন্ন স্তর পার হয়ে আমাদের অর্থাৎ ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে, সেটা জানতে পারবো, শুধু জানা নয়, চাক্ষুষ দেখতে পাবো, এটা তো একটা বিরাট ব্যাপার বটেই। আমাদের সাথে থাকবেন গাইড, ঘুরে ঘুরে দেখাবেন কোন কাজের পর কোন কাজটি করে পানীয় বানানো হয়।

ঠিক দিনক্ষণ মতো আমরা হই হই করে সেই ইন্ডাস্ট্রিতে হাজির হলাম। সবাই দলে দলে ভাগ হয়ে গেলাম একজন করে টিচার আর একজন করে কারখানার ক্রু-এর তত্ত্বাবধানে, দেখতে শুরু করলাম।

প্রথমেই আমরা জানতে পারলাম, পানীয় আর পানীয়ের বোতল তৈরি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে হয়ে থাকে। পানীয়ের জন্য আসল জিনিস যেটা, অর্থাৎ বিভিন্ন ফলের রস আলাদা করা হয়, সেটা একটা নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে ঝর্ণার মতো বয়ে যায়। প্রথমেই আসে বিশুদ্ধতার ব্যাপারটা, কারণ খাদ্যদ্রব্যের সাথে মানবদেহের সরাসরি সম্পর্ক। কাজেই ফলের রস তরল আকারে গিয়ে ঢোকে একটা পরিশোধন প্ল্যান্টে, সেখানে উচ্চ তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ করা হয়। আমরা হাঁ করে দেখতে পেলাম বিশাল পিপের মতো ছাদ অবধি উঁচু প্ল্যান্টটা, যেখানে টনকে টন পানীয় তৈরি হচ্ছে।

শুধু ফলের রস যদি পাবলিকের হাতে তুলে দেয়া হয় তাহলে অত নাকি মজা হয়না, কাজেই সেই ফলের রসের সাথে মেশানো হয় ফ্লেভার অনুযায়ী কৃত্রিম সুবাস, চিনি, বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, নষ্ট হওয়া ঠেকাতে উপকারি কিছু জীবাণু (!) ইত্যাদি। কিছু কিছু পানীয়ে নাকি ব্যাকটেরিয়া মেশানো বাধ্যতামূলক, নয়তো অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। মদ আর অন্যান্য বেভারেজ বানানোর সেকশনগুলো আলাদা, সেদিকে যেতে আমাদের নিষেধ করে দেয়া হল। আমরা দেখবো শুধু ফলের জুস বানানোর প্রক্রিয়া। কেন কে জানে, আমরা তো আর মদ খেতে যাচ্ছি না, দেখালে কী হতো?

এই পানীয় যখন তৈরি হয়ে যায়, তখনই খাওয়া যায়, কিন্তু চামচে করে তো আর সবাইকে এখান থেকে দেয়া যায় না, তাই কাঁচের বোতল, প্লাস্টিকের বোতল কিংবা স্টিলের ক্যানে পাঠিয়ে দেয়া হয় মাপমতো, যেখানে ওগুলো অপেক্ষা করছে। কাঁচের আর প্লাস্টিকের বোতল আসে আগের ব্যবহার করা বোতল গলিয়ে আর পরিশোধন করে, আজকাল আবার রিসাইক্লিং-এর ওপর অনেক জোর দেয়া হচ্ছে, অপচয় রোধ করার জন্য ব্যবহার করা জিনিস আবার ধুয়ে-মুছে ব্যবহারোপযগী করার নাম হচ্ছে রিসাইক্লিং। স্টিলের ক্যানগুলো অবশ্য স্টিলের সাথে আরও কিছু ধাতু মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যেমন অ্যালুমিনিয়াম, সেগুলো আসে আরেকটা জায়গা থেকে।

বোতলগুলো কিংবা ক্যানগুলো একটা চলমান বেল্টের ওপর দিয়ে “হেঁটে” আসে, পানীয় দিয়ে ভর্তি হয়ে চলে যায় আরেকটা জায়গায়, সেখানে এগুলোর মুখে ছিপি লাগিয়ে দেয়া হয়।

এবার পানীয় তৈরি, কিন্তু পুরোপুরি নয়। ফাইনাল একটা চেকিংয়ের জন্য এগুলোকে পাঠানো হয় সত্যি পানীয় হিসেবে উপযোগী আছে কীনা দেখার জন্য। যদি কোন একটি বোতলেও কোন ঘাপলা দেখা যায়, তাহলে পুরো ব্যাচটাকেই বাতিল করে দেয়া হয়, আবার নতুন করে একটা ব্যাচ তৈরি করা হয়।

এরপর বোতলের ওপরে লাগানো হয় রঙিন লেবেল, যেগুলো আগেই ছাপা থাকে। শুধু জুসভর্তি বোতল দিলেই তো হবেনা, যাতে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ যায় সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে।

আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সবকিছু, শেষ মাথায় এসে পড়েছি। নোটবুকে টুকে নিয়েছি পুরো প্রক্রিয়াটি।
আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে বিশাল বিশাল ক্রেন, সেগুলোতে আছে বিপুল ওজনের পানীয় ভর্তি কন্টেইনার। কারখানার বাইরে অপেক্ষা করছে বিশাল বিশাল লরি, কনটেইনার নিয়ে রওনা হয়ে যাবে গন্তব্যস্থানে। পানীয়গুলো দোকানে দোকানে পৌঁছে যাবে দোকানদারদের ফরমায়েশ মতো, তারপর সেখান থেকে আমরা কিনে খাবো।

আজ অবশ্য অন্য ব্যবস্থা, আমাদের সবাইকে একটা করে বড় বোতল ভর্তি ফলের জুস দেয়া হবে, স্কুল থেকে ঘুরতে এসেছি আমরা, কারখানার পক্ষ সেই উপলক্ষে। সবসময় দোকান থেকে কিংবা কাউন্টারে পয়সা ঢুকিয়ে কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছি, কিন্তু আজ সরাসরি কারখানা থেকে খাওয়া হবে, তাও আবার বিনে পয়সায়।
উপর দিয়ে যখন কনটেইনারগুলো একদিক থেকে আরেকদিকে চলে যাচ্ছিলো ক্রেনে সওয়ার হয়ে, তখন সত্যি বলতে কি, আমার বেশ ভয় লাগছিলো। একবার যদি শেকল ছিঁড়ে যায়, তাহলে সোজা মাথার ওপর পড়বে ক্রেন সহ কনটেইনার। অথচ নিচে দাঁড়িয়ে কি নিশ্চিন্তে কাজ করে যাচ্ছে লোকগুলো, কোন ভয়ডর নেই।

আমি কারখানার হলুদ ইউনিফর্ম পড়া লোকটাকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, ঐ শেকল যদি ছিঁড়ে যায়? আপনাদের এই পলকা হেলমেট ওটা ঠেকাতে পারবে তো?

লোকটা হো হো করে হেসে উঠলো, কী বলছ খোকা? আমরা কি হেলমেটের ওপর নির্ভর করি? চেয়ে দেখো ঐ মোটা শেকলগুলোর দিকে। এগুলো এক একটা কত ভার নিতে পারে, কল্পনাও করতে পারবে না। তারপরেও আমরা ঝুঁকি নিই না। যতটা নিতে পারে, তার মাত্র ষাট শতাংশ ভার দেয়া হয়। কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

ভদ্রলোকের মুখে কথা ফুরোল না, একটা বিকট আওয়াজে ভীষণ চমকে গিয়ে আমরা ওপরে তাকালাম।
যেই মজবুত শেকলের শক্তি নিয়ে তিনি গর্ব করছিলেন, আমাদের মাথার ওপর থেকে সেটা ঝনঝন শব্দ করে ছিঁড়ে গিয়েছে, এখন বিপুল ওজনের কনটেইনার নেমে আসছে ক্রেন ভেঙে, আমাদের মাথা বরাবর।

একটা চিৎকার শোনা গেলো, সবাই ছোটাছুটি শুরু করলো। সেই লোকটি আমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলেন অনেক দূরে। আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম, শক্ত ফ্লোরে পড়ে গিয়ে আমার হাত ছিলে গেলো, জ্বালা করে উঠলো কনুই। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই, আমি তাকিয়ে আছি উপর দিকে।

আমাকে সরিয়ে দিলেও সেই মানুষটি বাঁচতে পারলেন না, কয়েক টন ওজনের কনটেইনারটা এসে মানুষটির ওপরে আছড়ে পড়লো, আমি দেখতে পেলাম, তাঁর শরীরটা চাপা পড়লো ভারী চারকোণা বাক্সটির নিচে। একটা মরণ আর্তনাদ, তারপরেই লোকটি শেষ হয়ে গেলেন।

কনটেইনারটা চুরমার হয়ে গেছে, ছড়িয়ে পড়েছে ভেতরের পানীয়ের বোতলগুলো, কাঁচের বোতল ভেঙে বেরিয়ে আসছে পানীয়। আমি খেয়াল করলাম, যে ভদ্রলোকটি চাপা পড়েছেন, শুধু তাঁর পা দুটো দেখা যাচ্ছে, আর পুরো শরীরটা কন্টেইনারের নিচে, আমি কয়েক ফুট দূরে বসে আছি হতবাক হয়ে। আর কয়েক সেকেন্ড এদিক ওদিক হলেই আমি মরতাম, কিন্তু আবারো বেঁচে গেলাম।

আমার আবার পেটে মোচড় দিলো, যখন মেঝেতে ছড়ানো পানীয়ের মধ্যে একটা লাল রং মিশে যেতে দেখলাম। রং নয়, রক্ত।

চারদিক থেকে আমার সহপাঠীরা আর টিচাররা ছুটে এলেন, ওদিক থেকে এলেন কারখানার কর্মচারীরা। সবাই খুব ভয় পেয়েছেন, খুব দ্রুত আমাকে নিয়ে তাঁরা কারখানার বাইরে চলে এলেন।

আমি আবার কাঁদতে শুরু করেছি। কেন আমার ভাগ্যটা এমন হল? কী এমন দোষ করেছিলাম আমি?

৫.
আমি খুব করে প্রার্থনা করলাম, হে ঈশ্বর, আমাকে এসব থেকে মুক্তি দাও। যদি মুক্তি না দাও, তাহলে আমাকে মেরে ফেল। আমি তো আর নিতে পারছি না। নিজের মৃত্যু কামনা করতে হয়না, কিন্তু আমি তাই করতে লাগলাম। রোজ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে ওঠা আর সবসময় একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে থাকা, এই ব্যাপারগুলো যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা আর কে বুঝবে?
আমি বুঝতে পারলাম যে মৃত্যু আমার পিছু নিয়েছে। অনেকে হয়তও ভাবছে আমি অপয়া।

সবচেয়ে খারাপ যেটা হয়েছে যে এই তিনটি দুর্ঘটনা সাংবাদিকরা কী করে যেন এক করে ফেলেছে, আমাকে নিয়ে “ওয়ান্ডার বয়” শিরোনামে নিউজ হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে সবাই মরে যাচ্ছে, কিন্তু আমি বেঁচে যাচ্ছি। নিউজ কাভারেজে আমাকে পরোক্ষভাবে বলা হচ্ছে দোষী, যেন আমি বেঁচে গিয়ে, একদম অক্ষত থেকে খুব অন্যায় করেছি। আমি লজ্জায় টিভির সামনে বসতে পারি না, পত্রিকা পড়তে পারিনা, স্কুলে যেতেও ভয় পাচ্ছি। আমার বন্ধুরা অবশ্য এমন কিছু ভাবছে না, কিন্তু আমি নিজেই এখন খুব অস্বস্তির মধ্যে আছি আর প্রতি রাতে নিয়ম করে একবার দুঃস্বপ্ন দেখে বিকট চিৎকার করে জেগে উঠছি।

মানুষ একটানা অনেকদিন প্রচণ্ড ভয় নিয়ে বাঁচতে পারেনা, শরীর আর মন কোন একটা উপায় বের করে ফেলে এসব থেকে মুক্তির। কাজেই আমি এতকিছুর মধ্যেও সাহসী হয়ে উঠলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী দুর্ঘটনার। যে দুর্ঘটনা ঘটবে বলে আমি শিউরে উঠতাম, আমি মনে মনে সেটাকে নিমন্ত্রণ জানালাম। এসো দেখি, আমাকে মেরে ফেল। ভালোই হবে, অন্তত যন্ত্রণার শেষ হবে।

আমি সে রাতে অনেকদিন পর প্রথমবারের মতো ঘুমোতে গেলাম একা। মা’কে বললাম, থাক, আমি নিজেই না হয় লড়াই করি এই দুঃস্বপ্নের সাথে।
আমি চোখ বন্ধ করে আছি। আমি ঘুমিয়ে যাবো, স্বপ্ন দেখবো, তারপর আমি চিৎকার করে জেগে উঠবো। কয়েকদিন পর আবার আমার চোখের সামনে কেউ একজন মারা যাবে, আমি বেঁচে যাবো অল্পের জন্য, হয়তো এক আঙুল কিংবা আধ-ইঞ্চির জন্য। আজ দেখি, অন্য কিছু হয় কীনা।
আমি মনে মনে বলছি, কাম অন। দুঃস্বপ্ন, এসো। আমার সামনে এসে দাঁড়াও।

বারবার বলতে লাগলাম আমি, শেষে পাগলের মতো হয়ে উঠলাম, কুইক। জলদি, আমার সামনে এসো। আমাকে দেখাও বীভৎস এই স্বপ্ন। আমি দেখতে চাই।
নিদারুণ ক্লান্তিতেই কীনা জানিনা, এক সময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। একটা কালো পর্দা কেউ যেন আমার চোখের সামনে টেনে দিলো, অনেকদিন পর আমি গভীর ঘুম ঘুমোলাম, রোজকারের মতো ছাড়াছাড়া ঘুম নয়, কাটাকাটা দুঃস্বপ্ন দেখা ঘুম নয়।

সকালে উঠলাম, শরীরটা পালকের মতো হালকা ঠেকল। আমি অবাক হয়ে যাই, যে দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরেছে এতদিন, সেটা এক রাতেই আমাকে ছেড়ে পালাল কেন?

মা ব্রেকফাস্টের টেবিলে জিজ্ঞেস করলেন, আমি পা টিপে টিপে তোর রুমে ঘরে গিয়েছিলাম ঠিক আছিস কীনা দেখার জন্য। দেখি, তুই ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছিস। কাম অন, কুইক, আমি দেখতে চাই, এসব বলে কাউকে ডাকছিলি। একসময় ঘুমিয়ে পড়লি, আর কোন সাড়াশব্দ নেই। কাকে ডাকছিলি?
আমি হাসি। পাউরুটিতে মাখন লাগাতে থাকি। আমি মৃত্যুকে ডাকছিলাম, কিন্তু সেটা বলি কী করে?

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, তিন বছর পার হয়েছে, এখন আমার বয়স ষোল। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় আর কোন বীভৎস দুর্ঘটনা আমাকে দেখতে হয়নি। যেন আর দেখতে না হয়। মৃত্যু, দুর্ঘটনা এসব সত্যি বড় বিচিত্র জিনিস, যে এটাকে ডাকে তাকেই হয়তো এড়িয়ে চলে, আর যে এড়াতে চায় তাকে চোখের সামনে থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী তো আমি নিজেই।

……………………………………………………..(সমাপ্ত)………………………………………………

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত